পঁচিশ
শীতের সূর্য অস্ত গেল। সায়াহ্ন-ছায়ায় ঘরের মধ্যেটা ঝাপসা হইয়াছে, একটা জরুরী সেলাইয়ের বাকীটুকু কমল আলো জ্বালার পূর্বেই সারিয়া ফেলিতে চায়। অদূরে চৌকিতে বসিয়া অজিত। ভাবে বোধ হয় কি-একটা বলিতে বলিতে যেন হঠাৎ থামিয়া গিয়া সে উত্তরের আশায় উৎকণ্ঠিত আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছে।
মনোরমা-শিবনাথের ব্যাপারটা বন্ধু-মহলে জানাজানি হইয়াছে। আজিকার প্রসঙ্গটা শুরু হইয়াছে সেই লইয়া। অজিতের গোড়ার বক্তব্যটা ছিল এই যে, এমনিই একটা-কিছু যে শেষ পর্যন্ত গড়াইবে, তাহা সে আগ্রায় আসিয়াই সন্দেহ করিয়াছিল।
কিন্তু সন্দেহের কারণ সম্বন্ধে কমল কোন ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না।
তাহার পরে হইতে অজিত অনর্গল বকিয়া বকিয়া অবশেষে এমন জায়গায় আসিয়া থামিয়াছে যেখানে অপর পক্ষের সাড়া না পাইলে আর অগ্রসর হওয়া চলে না।
কমল অত্যন্ত মনোযোগে সেলাই করিতেই লাগিল, যেন মাথা তুলিবার সময়টুকুও নাই।
মিনিট দুই-তিন নিঃশব্দে কাটিল। আরো কতক্ষণ কাটিবে স্থিরতা নাই, অতএব, অজিতকে পুনরায় চেষ্টা করিতে হইল, বলিল, আশ্চর্য এই যে শিবনাথের আচরণ তোমার কাছে ধরাই পড়ল না।
কমল মুখ তুলিল না, কিন্তু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
অর্থাৎ তুমি এতই সাদাসিধে যে কোন সন্দেহই করনি, এ কি কেউ বিশ্বাস করতে পারে?
কেউ কি পারে-না-পারে জানিনে, কিন্তু আপনিও কি পারবেন না?
অজিত বলিল, হয়ত পারি,—কিন্তু তোমার মুখের পানে চেয়ে, এমনি পারিনে।
এইবার কমল মুখ তুলিয়া হাসিল, কহিল, তা হলে চেয়ে দেখুন, বলুন পারেন কিনা।
অজিতের চোখের দৃষ্টি জ্বলিয়া উঠিল; কহিল, তোমার কথাই সত্যি, তাকে অবিশ্বাস করনি বলেই তার ফল দাঁড়াল এই!
দাঁড়িয়েছে মানি, কিন্তু আপনার তরফে সন্দেহ করার সুফল কি পরিমাণে হাতে পেলেন সেটাও খুলে বলুন? এই বলিয়া সে পুনরায় একটুখানি হাসিয়া কাজে মন দিল।
ইহার পরে অজিত সংলগ্ন-অসংলগ্ন নানা কথা মিনিট দশ-পনের অবিচ্ছেদে বলিয়া শেষে শ্রান্ত হইয়া কহিল, কখনো হাঁ, কখনো না। হেঁয়ালি ছাড়া কি তুমি কথা বলতে জানো না?
কমল হাতের সেলাইটা সোজা করিতে করিতে কহিল, মেয়েরা হেঁয়ালিই ভালবাসে, ওটা স্বভাব।
তা হলে সে স্বভাবের প্রশংসা করতে পারিনে। স্পষ্ট বলতে একটু শেখো, নইলে সংসারে কাজ চলে না।
আপনিও হেঁয়ালি বুঝতে একটু শিখুন, নইলে ও-পক্ষের অসুবিধেও এমনি হয়। এই বলিয়া সে হাতের কাজটা পাট করিয়া টুকরিতে রাখিয়া বলিল, স্পষ্ট করার লোভ যাদের বড্ড বেশী, বক্তা হলে তারা খবরের কাগজে বক্তৃতা ছাপায়, লেখক হলে লেখে নিজের গ্রন্থের ভূমিকা, আর নাট্যকার হলে তারাই সাজে নিজের নাটকের নায়ক। ভাবে, অক্ষরে যা প্রকাশ পেলে না, হাত-পা নেড়ে তাকে ব্যক্ত করা চাই। তারা ভালবাসলে যে কি করে সেইটে শুধু জানিনে। কিন্তু একটু বসুন, আমি আলোটা জ্বেলে আনি। এই বলিয়া সে দ্রুত উঠিয়া ও-ঘরে চলিয়া গেল।
মিনিট পাঁচ-ছয় পরে ফিরিয়া আসিয়া সে আলোটা টেবিলের উপর রাখিয়া নীচে মেঝেতে বসিল।
অজিত বলিল, বক্তা বা লেখক বা নাট্যকার কোনটাই আমি নই, সুতরাং, তাদের হয়ে কৈফিয়ত দিতে পারব না, কিন্তু তারা ভালবাসলে কি করে জানি। তারা শৈব-বিবাহের ফন্দি আঁটে না,—স্পষ্ট পরিচিত রাস্তায় পা দিয়ে হাঁটে। তাদের অবর্তমানে অন্যের খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়, আশ্রয়ের জন্যে বাড়িওয়ালার শরণাপন্ন না হতে হয়, অসম্মানের আঘাত যেন না—
কমল মাঝখানে থামাইয়া দিয়া কহিল, হয়েছে, হয়েছে। হাসিয়া বলিল, অর্থাৎ তারা আগাগোড়া ইমারত এমন ভয়ানক নিরেট মজবুত করে গড়ে তোলে যে মড়ার কবর ছাড়া তাতে জ্যান্ত মানুষের দম ফেলবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত রাখে না। তারা সাধু লোক।
হঠাৎ দ্বারপ্রান্তে অনুরোধ আসিল, আমরা ভেতরে আসতে পারি?
কণ্ঠস্বর হরেন্দ্রর। কিন্তু আমরা কারা?
আসুন, আসুন, বলিয়া অভ্যর্থনা করিতে কমল দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
হরেন্দ্র এবং সঙ্গে আর একটি যুবক। হরেন্দ্র বলিল, সতীশকে আমাদের আশ্রমে তুমি একটি দিন মাত্র দেখেচ, তবু আশা করি তাকে ভোলনি?
কমল হাসিমুখে কহিল, না। শুধু সেদিন ছিল কাপড়টা সাদা, আজ হয়েছে হলদে।
হরেন্দ্র বলিল, ওটা উচ্চতর ভূমিতে আরোহণের বাহ্যিক ঘোষণামাত্র, আর কিছু না। ও ৺কাশীধাম থেকে সদ্য-প্রত্যাগত,—ঘণ্টা-দুয়ের বেশী নয়। ক্লান্ত, তদুপরি ও তোমার প্রতি প্রসন্ন নয়; তথাপি আমি আসছি শুনে ও আবেগ সংবরণ করতে পারলে না। ওটা আমাদের ব্রহ্মচারীদের মনের ঔদার্য, আর কিছু না। এই বলিয়া সে ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া কহিল, এই যে! আর একটি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী পূর্বাহ্ণেই সমুপস্থিত। যাক, আর আশঙ্কার হেতু নেই, আমার আশ্রমটি ত ভাঙচে, কিন্তু আর একটা গজিয়ে উঠল বলে। এই বলিয়া সে ভিতরে প্রবেশ করিল এবং, দ্বিতীয় চৌকিটা সতীশকে দেখাইয়া দিয়া বলিল, বসো; এবং নিজে গিয়া খাটের উপর বেশ করিয়া জাঁকিয়া বসিল। কমল দাঁড়াইয়া, গৃহে তৃতীয় আসন নাই দেখিয়া সতীশ বসিতে দ্বিধা করিতেছিল, হরেন্দ্র বুঝে নাই তাহা নয়, তবুও সহাস্যে কহিল, বসো হে সতীশ, জাত যাবে না। কাশী-ফেরত যত উঁচুতেই উঠে থাকো, তার চেয়েও উঁচু জায়গা সংসারে আছে এ কথাটা ভুলো না।
না, সেজন্যে নয়, বলিয়া সতীশ অপ্রতিভ হইয়া বসিয়া পড়িল।
তাহার মুখ দেখিয়া কমল হাসিল, বলিল, খোঁচা দেওয়া আপনার মুখে সাজে না হরেনবাবু। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাও আপনি, মহন্ত মহারাজও আপনি। ওঁরা বয়েসেও ছোট, পাণ্ডাগিরিতেও খাটো। ওঁদের কাজ শুধু আপনার উপদেশ ও আদেশ মেনে চলা, সুতরাং—
হরেন্দ্র কহিল, সুতরাংটা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা হয়ত আমিই, কিন্তু মোহান্ত ও মহারাজ হচ্চেন দুই বন্ধু সতীশ ও রাজেন। একজনের কাজ আমাকে উপদেশ দেওয়া এবং অন্যের কাজ ছিল সাধ্যমত আমাকে না-মেনে চলা। একজনের ত পাত্তা নেই, অন্যজন ফিরে এলেন ঢের বেশী তত্ত্ব সঞ্চয় করে। ভয় হচ্চে ওর সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলতে হয়ত আর পেরে উঠবো না। এখন ভাবনা কেবল ঐ অর্ধ-অভুক্ত ছেলের পাল নিয়ে। কাশী-কাঞ্চী ঘুরিয়ে সেগুলোকে ও ফিরিয়ে এনেচে।
ইতিমধ্যে আচারনিষ্ঠার যে লেশমাত্র ত্রুটি ঘটেনি তা তাদের পানে চেয়েই বুঝেচি; শুধু ক্ষোভ এই যে, আর একটুখানি চেপে তপস্যা করালে ফিরে আসার গাড়ি ভাড়াটা আমার আর লাগতো না।
কমল ব্যথার সহিত প্রশ্ন করিল, ছেলেরা বুঝি খুব রোগা হয়ে গেছে?
হরেন্দ্র কহিল, রোগা! আশ্রম-পরিভাষায় হয়ত তার কি-একটা নাম আছে—সতীশ জানতেও পারে, কিন্তু আধুনিক কালের আঁকা শুক্রাচার্যের তপোবনে কচের ছবি দেখেচ? দেখনি? তা হলে ঠিকটি উপলব্ধি করতে পারবে না। দোতালায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার ত হঠাৎ মনে হয়েছিল একদল কচ সার বেঁধে বুঝি স্বর্গ থেকে আশ্রমে এসে ঢুকচে। একটা ভরসা পেলাম, আমাদের আশ্রমটা ভেঙ্গে গেলে তারা না খেয়ে মারা যাবে না, দেশের কোন একটা কলা-ভবনে গিয়ে মডেলের কাজ নিতে পারবে।
কমল কহিল, লোকে বলে আপনি আশ্রম তুলে দিচ্চেন, এ কি সত্যি?
সত্যি। তোমার বাক্যবাণ আমার সহ্য হয় না। সতীশের এখানে আসার সেও একটা হেতু। ওর ধারণা তুমি আসলে ভারতীয় রমণী নও, তাই ভারতের নিগূঢ় সত্য-বস্তুটিকে তুমি চিনতেই পারো না। সেইটি তোমাকে ও বুঝিয়ে দিতে চায়। বুঝবে কিনা সে তুমিই জানো; কিন্তু ওকে আশ্বাস দিয়েছি যে, আমি যাই করি না কেন ওদের ভয় নেই। কারণ, চতুর্বিধ আশ্রমের কোন্ আশ্রমটি অজিতকুমার নিজে গ্রহণ করবেন সঠিক সংবাদ না পেলেও, পরম্পরায় এ খবরটুকু পাওয়া গেছে যে, তিনি বহু অর্থব্যয়ে এমন দশ-বিশটা আশ্রম নানা স্থানে খুলে দেবেন। ওঁর অর্থও আছে, দেবার সামর্থ্যও আছে। তার একটার নায়কত্ব সতীশের জুটবেই।
কমল মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, দানশীলতার মত দুষ্কৃতি চাপা দেবার এমন আচ্ছাদন আর নেই। কিন্তু ভারতের সত্য-বস্তুটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে সতীশবাবুর লাভ কি হবে? আশ্রম তুলে দিতেও আমি হরেনবাবুকে বলিনি, টাকার জোরে ভারতবর্ষময় আশ্রম খুলতেও আমি অজিতবাবুকে নিষেধ করব না। আমার আপত্তি শুধু ঐটিকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার। তাতে কার কি ক্ষতি?
সতীশ বিনীতকণ্ঠে বলিল, ক্ষতির পরিমাণ বাইরে দেখা যাবে না। কিন্তু তর্কের জন্যে নয়, শিক্ষার্থী হিসেবে গোটা কয়েক প্রশ্ন যদি করি তার কি উত্তর পাবো না?
কিন্তু আজ আমি বড় শ্রান্ত সতীশবাবু।
সতীশ এ আপত্তি কানে তুলিল না, বলিল, হরেনদা এইমাত্র তামাশা করে বললেন আমি কাশী-ফেরত, যত উঁচুতেই উঠে থাকি, তার চেয়েও উঁচু জায়গা সংসারে আছে। সে এই ঘর। আমি জানি, আপনার প্রতি ওঁর শ্রদ্ধার অবধি নেই,—আশ্রম ভাঙ্গলে ক্ষতি হবে না। কিন্তু আপনার কথায় ওঁর মন যদি ভাঙ্গে সে লোকসান পূর্ণ হওয়া কঠিন।
কমল চুপ করিয়া রহিল। সতীশ বলিতে লাগিল, রাজেনকে আপনি ভাল করেই জানেন, সে আমার বন্ধু। মূল বিষয়ে মতের মিল না থাকলে আমাদের বন্ধুত্ব হতে পারত না। তার মত ভারতের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির মধ্যে দিয়ে স্বজাতির পরম কল্যাণ আমারও কাম্য। এরই আশায় ছেলেদের সঙ্ঘবদ্ধ করে আমরা গড়ে তুলতে চাই। নইলে মৃত্যুর পরে কল্প-কাল বৈকুণ্ঠবাসের লোভ আমাদের নেই। কিন্তু নিয়মের কঠোর বন্ধন ছাড়া ত কখনো সঙ্ঘ সৃষ্টি হয় না। আর শুধু ছেলেরাই ত নয়, সে বন্ধন আমরা নিজেরাও যে গ্রহণ করেচি। কষ্ট ওখানে আছে,—থাকবেই ত। বহু শ্রম করে বৃহৎ বস্তু লাভ করার স্থানকেই ত আশ্রম বলে। তাতে উপহাসের ত কিছু নেই।
জবাব না পাইয়া সতীশ বলিতে লাগিল, হরেনদার আশ্রম যাই হোক না কেন, সে সম্বন্ধে আমি আলোচনা করব না, কারণ, সেটা ব্যক্তিগত হয়ে পড়ার ভয় আছে। কিন্তু ভারতীয় আশ্রমের মধ্যে যে ভারতের অতীতের প্রতিই নিষ্ঠা ও পরম শ্রদ্ধা আছে এ ত অস্বীকার করা যায় না। ত্যাগ, ব্রহ্মচর্য, সংযম এ-সকল শক্তিহীন অক্ষমের ধর্ম নয়; জাতিগঠনের প্রাণ ও উপাদান সেদিন এর মধ্যেই নিহিত ছিল, আজ এ যুগেও সে উপাদান অবহেলার সামগ্রী নয়। মরণোন্মুখ ভারতকে শুধু কেবল এই পথেই আবার বাঁচিয়ে তোলা যায়। আশ্রমের আচার ও অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আমরা এই বিশ্বাস, এই শ্রদ্ধাকেই জাগিয়ে রাখতে চাই। একদিন মন্ত্র-মুখরিত, হোমাগ্নি-প্রজ্বলিত, তপস্যা-কঠোর ভারতের এই আশ্রমই জাতি-জীবনের একটা মৌলিক কল্যাণ সফল করবার উদ্দেশ্যেই উদ্ভূত হয়েছিল; সে প্রয়োজন আজও যে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, এ সত্য কোন্ মূর্খ অস্বীকার করতে পারে?
সতীশের বক্তৃতায় আন্তরিকতার একটা জোর ছিল। কথাগুলি ভাল এবং নিরন্তর বলিয়া বলিয়া একপ্রকার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল। শেষের দিকে তাহার মৃদু-কণ্ঠ সতেজ ও উদ্দীপনায় কালো-মুখ বেগুনে হইয়া উঠিল। সেইদিকে নিঃশব্দ ও নিষ্পলক-চক্ষে চাহিয়া সুপবিত্র ভাবাবেগে অজিতের আপাদমস্তক রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, এবং হরেন্দ্র তাহার আশ্রমের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে যত মৌখিক আস্ফালনই করিয়া থাক, আশ্রমের বিগত গৌরবের বিবরণে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝখানে সে ঝড়ের বেগে দোল খাইতে লাগিল। তাহারই মুখের প্রতি সতীশ তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিয়া বলিল, হরেনদা, আমরা মরেছি, কিন্তু এই আশ্রমের মধ্যে দিয়েই যে আমাদের নবজন্ম-লাভের বিজ্ঞান আছে, এ সত্য ভুলতে যাচ্ছেন আপনি কোন্ যুক্তিতে? আপনি ভাঙ্গতে চাচ্চেন, কিন্তু ভাঙ্গাটাই কি বড়? গড়ে তোলা কি তার চেয়ে ঢের বেশী বড় নয়? আপনিই বলুন!
কমলের মুখের প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, জীবনে ক’টা আশ্রম আপনি নিজের চোখে দেখেছেন? ক’টার সঙ্গে আপনার যথার্থ নিগূঢ় পরিচয় আছে?
কঠিন প্রশ্ন। কমল বলিল, বাস্তবিক একটাও দেখিনি এবং আপনাদেরটা ছাড়া কোনটার সঙ্গে কোন পরিচয়ই নেই।
তবে?
কমল হাসিমুখে কহিল, চোখে কি সমস্তই দেখা যায়? আপনাদের আশ্রমে শ্রম করাটাই চোখে দেখে এলাম, কিন্তু বৃহৎ বস্তু লাভের ব্যাপারটা যে আড়ালেই রয়ে গেল।
সতীশ কহিল, আপনি আবার উপহাস করচেন।
তাহার ক্ষুব্ধ মুখের চেহারাটা দেখিয়া হরেন্দ্র স্নিগ্ধস্বরে বলিল, না না সতীশ, উপহাস নয়, উনি রহস্য করচেন মাত্র। ওটা ওঁর স্বভাব।
সতীশ কহিল, স্বভাব! স্বভাব বললেই ত কৈফিয়ত হয় না হরেনদা। ভারতের অতীত দিনের যা নিত্য-পূজনীয়, নিত্য-আচরণীয় ব্যাপার তাকেই অবমাননা, তাকেই অশ্রদ্ধা দেখান হয়। একে ত উপেক্ষা করা চলে না।
হরেন্দ্র কমলকে দেখাইয়া কহিল, এ বিতর্ক ওঁর সঙ্গে বহুবার হয়ে গেছে। উনি বলেন, অতীতের কোন দায় নেই। বস্তু অতীত হয় কালের ধর্মে, কিন্তু তাকে ভাল হতে হয় নিজের গুণে। শুধু মাত্র প্রাচীন বলেই সে পূজ্য হয়ে ওঠে না। যে বর্বর জাত একদিন তার বুড়ো বাপ-মাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতো, আজও যদি সেই প্রাচীন অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে সে কর্তব্য নির্দেশ করতে চায় তাকে ত ঠেকান যায় না সতীশ।
সতীশ ক্রুদ্ধ উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, প্রাচীন ভারতীয়ের সঙ্গে ত বর্বরের তুলনা হয় না হরেনদা!
হরেন্দ্র বলিল, সে আমি জানি। কিন্তু ওটা যুক্তি নয় সতীশ, ওটা গলার জোরের ব্যাপার।
সতীশ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া কহিল, আপনাকেও যে একদিন নাস্তিকতার ফাঁদে পড়তে হবে এ আমরা ভাবিনি হরেনদা।
হরেন্দ্র কহিল, তুমি জান আমি নাস্তিক নই। কিন্তু গাল দিয়ে শুধু অপমান করাই যায় সতীশ, মতের প্রতিষ্ঠা করা যায় না। শক্ত কথাই সংসারে সবচেয়ে দুর্বল।
সতীশ লজ্জা পাইল। হেঁট হইয়া হাত দিয়া তাহার পা ছুঁইয়া মাথায় ঠেকাইয়া কহিল, অপমান করিনি হরেনদা। আপনি ত জানেন, আপনাকে কত ভক্তি করি আমরা; কিন্তু কষ্ট পাই যখন শুনি ভারতের শাশ্বত তপস্যাকেও আপনি অবিশ্বাস করেন। একদিন যে উপাদান যে সাধনা দিয়ে তাঁরা এই ভারতের বিরাট জাতি, বিরাট সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন, সে সত্য কখনো বিলুপ্ত হয়নি। আমি সোনার অক্ষরে স্পষ্ট দেখতে পাই, সেই ভারতের মজ্জাগত ধর্ম,—সেই আমাদের আপন জিনিস। সেই ধ্বংসোন্মুখ বিরাট জাতটাকে আবার সেই উপাদান দিয়েই বাঁচিয়ে তোলা যায় হরেনদা, আর কোন পথ নেই।
হরেন্দ্র কহিল, না-ও যেতে পারে সতীশ। ও তোমার বিশ্বাস, এবং তার দাম শুধু তোমার নিজের কাছে। একদিন ঠিক এই-রকম কথার উত্তরেই কমল বলেছিলেন, জগতের আদিম যুগে একদিন বিরাট অস্থি, বিরাট দেহ, বিরাট ক্ষুধা দিয়ে বিরাট জীব সৃষ্টি হয়েছিল; তাই নিয়ে সে পৃথিবী জয় করে বেড়িয়েছিল—সেদিন সেই ছিল তার সত্য উপাদান। কিন্তু আর একদিন সেই দেহ, সেই ক্ষুধাই এনে দিলে তাকে মৃত্যু। একদিনের সত্য উপাদান আর একদিনের মিথ্যে উপাদান হয়ে তারে নিশ্চিহ্ন করে সংসারে মুছে দিলে। এতটুকু দ্বিধা করলে না। সেই অস্থি আজ পাথরে রূপান্তরিত, প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বস্তু।
সতীশ হঠাৎ জবাব খুঁজিয়া না পাইয়া বলিল, তবে কি আমাদের পূর্ব-পিতামহদের আদর্শ ভ্রান্ত? তাঁদের তত্ত্ব-নিরূপণে সত্য ছিল না?
হরেন্দ্র বলিল, সেদিন ছিল হয়ত, কিন্তু আজ না থাকায় বাধা নেই। সেদিনের স্বর্গের পথ আজ যদি যমের দক্ষিণ দোরে এনে হাজির করে দেয়, মুখ ভার করবার হেতু পাইনে সতীশ।
সতীশ গূঢ় ক্রোধ প্রাণপণে দমন করিয়া কহিল, হরেনদা, এ-সব শুধু আপনাদের আধুনিক শিক্ষার ফল; আর কিছু নয়।
হরেন্দ্র বলিল, অসম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা যদি আধুনিক কালের কল্যাণের পথ দেখাতে পারে, আমি লজ্জার কারণ দেখিনে সতীশ।
সতীশ বহুক্ষণ নির্বাক স্তব্ধভাবে বসিয়া পরে ধীরে ধীরে কহিল, লজ্জার, সহস্র লজ্জার কারণ কিন্তু আমি দেখি হরেনদা। ভারতের জ্ঞান, ভারতের প্রাচীন তত্ত্ব এই ভারতেরই বিশেষত্ব এবং প্রাণ। সেই ভাব, সেই তত্ত্ব বিসর্জন দিয়ে দেশকে যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়, তবে সে স্বাধীনতায় ভারতের ত জয় হবে না, জয় হবে শুধু পাশ্চাত্য নীতি ও পাশ্চাত্য সভ্যতার। সে পরাজয়ের নামান্তর। তার চেয়ে মৃত্যু ভাল।
তাহার বেদনা আন্তরিক। সেই ব্যথার পরিমাণ অনুভব করিয়া হরেন্দ্র মৌন হইয়া রহিল, কিন্তু জবাব দিল এবার কমল। মুখে সুপরিচিত পরিহাসের চিহ্নমাত্র নাই, কণ্ঠস্বর সংযত, শান্ত ও মৃদু; বলিল, সতীশবাবু, নিজের জীবনে যেমন নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন, সংস্কারের দিক দিয়েও যদি তাকে এমনি পরিত্যাগ করতে পারতেন, এ কথা উপলব্ধি করা আজ কঠিন হতো না যে ভাবের জন্যে, বিশেষত্বের জন্যে মানুষ নয়, মানুষের জন্যেই তার সমাদর, মানুষের জন্যেই তার দাম? মানুষই যদি তলিয়ে যায়, কি হবে তার তত্ত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠায়? নাই বা হলো ভারতের মতের জয়, মানুষের জয় ত হবে! তখন মুক্তি পেয়ে এতগুলি নর-নারী ধন্য হয়ে যাবে। চেয়ে দেখুন ত নবীন তুর্কীর দিকে। যতদিন সে তার প্রাচীন রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, পুরুষ-পরম্পরাগত পুরানো পথটাকেই সত্য জেনে আঁকড়ে ধরে ছিল, ততদিনই তার হয়েচে বারংবার পরাজয়। আজ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সে সত্যকে পেয়েছে,—তার সমস্ত আবর্জনা ভেসে গেছে; আজ তাকে উপহাস করে সাধ্য কার? অথচ, সেই প্রাচীন মত ও পথই একদিন দিয়েছিল তারে বিজয়, দিয়েছিল ঐশ্বর্য, কল্যাণ, দিয়েছিল মনুষ্যত্ব। ভেবেছিল, সেই বুঝি চিরন্তন সত্য। ভেবেছিল, তাকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে বিগত গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে। মনেও করেনি তারও বিবর্তন আছে। আজ সেই মোহ গেল মরে, কিন্তু ওদের মানুষগুলো উঠলো বেঁচে। এমন দৃষ্টান্ত আরও আছে, আরও হবে। সতীশবাবু, আত্মবিশ্বাস এবং আত্ম-অহঙ্কার এক বস্তু নয়।
সতীশ বলিল, জানি। কিন্তু পশ্চিমের লোকেরাই যে মানুষের প্রশ্নের শেষ জবাব দিয়েছে—এও ত না হতে পারে? তাদের সভ্যতাও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, এও ত সম্ভব?
কমল মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ সম্ভব। আমার বিশ্বাস হবেও।
তবে?
কমল বলিল, তাতে ধিক্কার দেবার কিছু নেই। সতীশবাবু, মন্দ ত ভালর শত্রু নয়, ভালর শত্রু তার চেয়ে যে আরও ভাল,—সে। এইখানেই ভারতের ভয়। এবং, সেই আরও ভাল যেদিন উপস্থিত হয়ে প্রশ্নের জবাব চাইবে সেদিন তারই হাতে রাজদণ্ড তুলে দিয়ে ওকে সরে যেতে হবে। একদিন শক, হূন, তাতারের দল ভারতবর্ষ গায়ের জোরে জয় করেছিল, কিন্তু এর সভ্যতাকে বাঁধতে পারেনি, তারা আপনি বাঁধা পড়েছিল। এর কারণ কি জানেন? আসল কারণ তারা নিজেরাই ছিল ছোট। কিন্তু মোগল-পাঠানের পরীক্ষা বাকী রয়ে গেল, ফরাসী-ইংরেজ এসে পড়ল বলে। সে মিয়াদ আজও বাজেয়াপ্ত হয়নি। ভারতের কাছে এর জবাব একদিন তাদের দিতেই হবে। সে প্রশ্ন থাক, কিন্তু পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতার কাছে ভারতবর্ষ আজ যদি ধরা দেয়, দম্ভে আঘাত লাগবে, কিন্তু তার কল্যাণে ঘা পড়বে না, আমি নিশ্চয় বলতে পারি।
সতীশ সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, না, না, না। যাদের আস্থা নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাসের ভিত্তি যাদের বালির ওপর, তাদের কাছে এমনি করে বলতে থাকলেই হবে সর্বনাশ। এই বলিয়া হরেন্দ্রর প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া কহিল, ঠিক এইভাবেই একদিন বাঙলায়—সে বেশীদিন নয়,বিদেশের বিজ্ঞান, বিদেশের দর্শন, বিদেশের সভ্যতাকে মস্ত মনে করে সত্যভ্রষ্ট, আদর্শভ্রষ্ট জন- কয়েক অসম্পূর্ণ শিক্ষার বিজাতীয় স্পর্ধায় স্বদেশের যা-কিছু আপনা তাকে তুচ্ছ করে দিয়ে দেশের মনকে বিক্ষিপ্ত, কদাচারী করে তুলেছিল। কিন্তু এতবড় অকল্যাণ বিধাতার সইল না। প্রতিক্রিয়ায় বিবেক ফিরে এলো। ভুল ধরা পড়ল। সেই বিষম দুর্দিনে মনস্বী যাঁরা স্বজাতির কেন্দ্রবিমুখ উদ্ভ্রান্ত চিত্তকে স্ব-গৃহের পানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন, তাঁরা শুধু দেশের নয়, সমস্ত ভারতের নমস্য। এই বলিয়া সে দু হাত জোড় করিয়া মাথায় ঠেকাইল।
কথাটা যে সত্য তাহা সবাই জানে। সুতরাং হরেন্দ্র-অজিত উভয়েই তাহাকে অনুসরণ করিয়া নমস্যদের উদ্দেশে যখন নমস্কার জানাইল তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই ছিল না। অজিত মৃদুকন্ঠে বলিল, নইলে খুব বেশী লোকে হয়ত সে সময় ক্রীশ্চান হয়ে যেতো। শুধু তাঁদের জন্যেই সেটা হতে পারে নি। কথাটা বলিয়াই সে কমলের মুখের পানে চাহিয়া দেখিল চোখে তাহার অনুমোদন নাই, আছে শুধু তিরস্কার। অথচ, চুপ করিয়াই আছে। হয়ত, জবাব দিবার ইচ্ছাও ছিল না। অজিতকে সে চিনিত,—কিন্তু হরেন্দ্রও যখন ইহারই অস্ফুট প্রতিধ্বনি করিল তখন তাহার অনতিকালপূর্বের কথাগুলার সহিত এই সসঙ্কোচ জড়িমা এমনি বিসদৃশ শুনাইল যে, সে নীরবে থাকিতে পারিল না। কহিল, হরেনবাবু, এক-ধরনের লোক আছে তারা ভূত মানে না, কিন্তু ভূতের ভয় করে। একেই বলে ভাবের ঘরে চুরি! এমন অন্যায় আর কিছু হতেই পারে না। এদেশে আশ্রমের জন্যে টাকার অভাব হবে না, ছেলের দুর্ভিক্ষও ঘটবে না; অতএব, সতীশবাবুর চলে যাবে, কিন্তু ওঁকে পরিত্যাগ করার মিথ্যাচার আপনাকে চিরদিন দুঃখ দেবে।
একটু থামিয়া কহিল, আমার বাবা ছিলেন ক্রীশ্চান, কিন্তু আমি যে কি, সে খোঁজ তিনিও করেন নি, আমিও করিনি। তাঁর প্রয়োজন ছিল না, আমার মনে ছিল না । কামনা করি, ধর্মকে যেন আমরণ এমনি ভুলেই থাকতে পারি, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল অনাচারী বলে এইমাত্র যাদের গঞ্জনা দিলেন, এবং নমস্য বলে যাঁদের নমস্কার করলেন, সর্বনাশের পাল্লায় কার দান ভারী, এ প্রশ্নের জবাব একদিন লোকে চাইতে ভুলবে না।
সতীশের গায়ে কে যেন চাবুকের ঘা মারিল। তীব্র বেদনায় অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি জানেন এঁদের নাম? কখনো শুনেছেন কারো কাছে?
কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
তা হলে সেইটে আগে জেনে নিন।
কমল হাসিয়া কহিল, আচ্ছা। কিন্তু নামের মোহ আমার নেই। নাম জানাটাকেই জানার শেষ বলে আমি ভাবতে পারিনে।
প্রত্যুত্তরে সতীশ দুই চক্ষে শুধু অবজ্ঞা ও ঘৃণা বর্ষণ করিয়া ত্বরিতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
সে যে রাগ করিয়া গেছে তাহা নিঃসন্দেহ। এই অপ্রীতিকর ব্যাপারটাকে কথঞ্চিৎ লঘু করিবার মানসে হরেন্দ্র হাসির ভান করিয়া খানিক পরে বলিল, কমলের আকৃতিটা প্রাচ্যের, কিন্তু প্রকৃতিটা প্রতীচ্যের। একটা পড়ে চোখে, কিন্তু অপরটা থাকে সম্পূর্ণ আড়ালে। এইখানে হয় মানুষের ভুল। ওঁর পরিবেশন করা খাবার গেলা যায়, কিন্তু হজম করতে গোল বাধে। পেটের বত্রিশ নাড়ীতে যেন মোচড় ধরে। আমাদের প্রাচীন কোন-কিছুর প্রতি ওর না আছে বিশ্বাস, না আছে দরদ। অকেজো বলে বাতিল করে দিতে ওর ব্যথা নেই। কিন্তু সূক্ষ্ম নিক্তি হাতে পেলেই যে সূক্ষ্ম ওজন করা যায় না—এ কথাটা ও বুঝতেই পারে না।
কমল কহিল, পারি, শুধু দাম নেবার বেলাতেই একটার বদলে অন্যটা নিতে পারিনে। আমার আপত্তি ঐখানে।
হরেন্দ্র বলিল, আশ্রমটা তুলে দেবো আমি স্থির করেচি। ও শিক্ষায় মানুষ হয়ে ছেলেরা দেশের মুক্তি—পরম কল্যাণকে ফিরিয়ে আনতে পারবে, আমার সন্দেহ জন্মেচে। কিন্তু, দীন-হীন ঘরের যে-সব ছেলেকে সতীশ ঘরছাড়া করে এনেছে তাদের দিয়ে যে কি করব আমি তাই ভেবে পাইনে। সতীশের হাতে তুলে দিতেও ত তাদের পারব না।
কমল কহিল, পেরেও কাজ নেই। কিন্তু এদের নিয়ে অসাধারণ অলৌকিক কিছু একটা করে তুলতেও চাইবেন না। দীন-দুঃখীর ঘরের ছেলে সকল দেশেই আছে; তারা যেমন করে তাদের বড় করে তোলে, তেমনি করেই এদের মানুষ করে তুলুন।
হরেন্দ্র বলিল, ঐখানে এখনো নিঃসংশয় হতে পারিনি কমল। মাস্টার-পণ্ডিত লাগিয়ে তাদের লেখাপড়া শেখাতে হয়ত পারব, কিন্তু যে সংযম ও ত্যাগের শিক্ষা তাদের আরম্ভ হয়েছিল তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ওদের মানুষ করা যাবে কিনা, সেই আমার ভয়।
কমল বলিল, হরেনবাবু, সকল জিনিসকেই অমন একান্ত করে আপনারা ভাবেন বলেই কোন প্রশ্নের আর সোজা জবাবটা পান না। সন্দেহ আসে, হয় ওরা দেবতা গড়ে উঠবে, না হয়, একেবারে উচ্ছৃঙ্খল পশু হয়ে দাঁড়াবে। জগতের সহজ, সরল, স্বাভাবিক শ্রী আর চোখের সামনে থাকে না। পরায়ত্ত মনগড়া অন্যায়ের বোধের দ্বারা সমস্ত মনকে শঙ্কায় ত্রস্ত মলিন করে রাখেন। সেদিন আশ্রমে যা দেখে এসেচি সে কি সংযম ও ত্যাগের শিক্ষা? ওরা পেয়েছে কি? পেয়েছে অপরের দেওয়া দুঃখের বোঝা, পেয়েছে অনধিকার, পেয়েছে প্রবঞ্চিতের ক্ষুধা। চীনাদের দেশে জন্ম থেকে মেয়েদের পা ছোট করা হয়। পুরুষেরাও তাকে বলে সুন্দর,—সে আমায় সয়, কিন্তু মেয়েদের সেই নিজেদের পঙ্গু, বিকৃত পায়ের সৌন্দর্যে যখন নিজেরাই মোহিত হয়, তখন আশা করার কিছু থাকে না। আপনাদের নিজেদের কৃতিত্বে মগ্ন হয়ে রইলেন, আমি জিজ্ঞেসা করলাম, বাবারা কেমন আছ বল ত? ছেলেরা একবাক্যে বললে, খুব সুখে আছি। একবার ভাবলেও না। ভাবাটাও তাদের শেষ হয়ে গেছে,—এমনি শাসন। নীলিমাদিদি আমার পানে চেয়ে বোধ করি উত্তর চাইলেন, কিন্তু বুক চাপড়ে কাঁদা ভিন্ন আমি আর এ কথার জবাব খুঁজে পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম, ভবিষ্যতে এরাই আনবে দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে।
হরেন্দ্র কহিল, ছেলেদের কথা যাক, কিন্তু রাজেন, সতীশ এরা ত যুবক? এরাও ত সর্বত্যাগী?
কমল বলিল, রাজেনকে আপনারা চেনেন না, সুতরাং সেও যাক। কিন্তু বৈরাগ্য যৌবনকেই ত বেশী পেয়ে বসে। ও যেখানে শক্তি, সেখানে বিরুদ্ধ-শক্তি ছাড়া তাকে বশ করবে কে?
হরেন্দ্র বলিল, রাগ করো না কমল, কিন্তু তোমার রক্তে ত বৈরাগ্য নেই। তোমার বাবা য়ুরোপিয়ান, তাঁর হাতেই তোমার শিশু-জীবন গড়ে উঠেচে। মা এদেশের, কিন্তু তাঁর কথা না তোলাই ভাল। দেহের রূপ ছাড়া বোধ হয় সেদিক থেকে কিছুই পাওনি। তাই, পশ্চিমের শিক্ষায় ভোগটাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় বলে জেনেচ।
কমল কহিল, রাগ করিনি হরেনবাবু। কিন্তু এমন কথা আপনি বলবেন না । কেবলমাত্র ভোগটাকেই জীবনের বড় করে নিয়ে কোন জাত কখনো বড় হয়ে উঠতে পারে না। মুসলমানেরা যখন এই ভুল করলে তখন তাদের ত্যাগও গেলো, ভোগও ছুটলো। এই ভুল করলে ওরাও মরবে।পশ্চিম ত আর জগৎ-ছাড়া নয়, সে বিধান উপেক্ষা করে কারও বাঁচবার জো নেই। এই বলিয়া সে একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তখন কিন্তু মুচকে হেসে আপনারাও বলবার দিন পাবেন,—কেমন! বলেছিলাম ত! দিন-কয়েকের নাচন-কোঁদন ওদের যে ফুরুবে সে আমরা জানতাম। কিন্তু চেয়ে দেখো, আমরা আগাগোড়া টিকে আছি। বলিতে বলিতে সুবিমলহাস্যে তাহার সমস্ত মুখ বিকশিত হইয়া উঠিল।
হরেন্দ্র কহিল, সেদিনই যেন আসে।
কমল কহিল, অমন কথা বলতে নেই হরেনবাবু। অতবড় জাত যদি মাথা নীচু করে পড়ে, তার ধূলোয় জগতের অনেক আলোই ম্লান হয়ে যাবে। মানুষের সেটা দুর্দিন।
হরেন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, তার এখনো দেরি আছে, কিন্তু নিজের দুর্দিনের আভাস পাচ্চি। অনেক আলোই নিব-নিব হয়ে আসচে। পিতার কাছে নেবানোর কৌশলটাই জেনেছিলে কমল, জ্বালাবার বিদ্যে শেখোনি। আচ্ছা, চললাম। অজিতবাবুর কি বিলম্ব আছে?
অজিত উঠি-উঠি করিল, কিন্তু উঠিল না।
কমল বলিল, হরেনবাবু, আলো পথের ওপর না পড়ে চোখের ওপর পড়লে খানায় পড়তে হয়। সে আলো যে নেভায় তাকে বন্ধু বলে জানবেন।
হরেন্দ্র নিশ্বাস ফেলিল, কহিল, অনেক সময়ে মনে হয়, তোমার সঙ্গে পরিচয় কুক্ষণে হয়েছিল। সে প্রত্যয়ের জোর আমার আর নেই, তবু বলতে পারি, যত বিদ্যে, বুদ্ধি, জ্ঞান ও পুরুষকারের জৌলুস ওরা দেখাক, ভারতের কাজে সে-সমস্তই অকিঞ্চিৎকর।
কমল বলিল, এ যেন ক্লাসে প্রমোশন না-পাওয়া ছেলের এম.এ.পাস করাকে ধিক্কার দেওয়া। হরেনবাবু, আত্ম-মর্যাদাবোধ বলে যেমন একটা কথা আছে, বড়াই করা বলেও তেমনি একটা কথা আছে।
হরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইল, কহিল, কথা অনেক আছে। কিন্তু, এই ভারতই একদিন সকল দিক দিয়েই জগতের গুরু ছিল, তখন অনেকের পূর্বপুরুষ হয়ত গাছের ডালে ডালে বেড়াতো। আবার এই ভারতবর্ষই আর একদিন জগতে সেই শিক্ষকের আসনই অধিকার করবে। করবেই করবে।
কমল রাগ করিল না, হাসিল। বলিল, আজ তারা ডাল ছেড়ে মাটিতে নেবেছে। কিন্তু কোন্ মহা-অতীতে একজনের পূর্বপুরুষ পৃথিবীর গুরু ছিল এবং কোন্ মহা-ভবিষ্যতে আবার তার বংশধর পৈতৃক পেশা ফিরে পাবে এ আলোচনায় সুখ পেতে হলে অজিতবাবুকে ধরুন। আমার অনেক কাজ।
হরেন্দ্র বলিল, আচ্ছা, নমস্কার। আজ আসি। বলিয়া বিষণ্ণ-গম্ভীরমুখে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।