শেষ পাপের প্রায়শ্চিত্ত

শেষ পাপের প্রায়শ্চিত্ত 

লেক রোড ভিআইপি কলোনির ১৭/১ নম্বর বাড়ি। 

ছিমছাম সাজানো গোছানো স্টাডিরুম। সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বা কাঁচের জানালা দিয়ে তফিসুল বারী বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। একটু আগেই রাতের খাওয়া শেষ করেছেন। স্ত্রী সালেহা বারী আজ ছয় বছর হল বোন ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় সালেহার কথা মনে পড়ে না। কিন্তু রাতের খাওয়ার সময়টা সালেহার শূন্যতা খুব বেশি অনুভব করেন। স্ত্রীকে ছাড়া কখনও রাতের খাবার খাননি তিনি। এখন সালেহা নেই, তিনি একাই রাতের খাওয়া শেষ করেন। 

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়াল চুরুট ধরালেন তফিসুল বারী। এটা তার অনেক পুরনো অভ্যাস। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয় এতে, কিন্তু অদ্ভুত অবসন্নতা নেমে আসে। ঘুম ভালো হয়। 

জানালার লম্বা কাঁচের ওপাশে আলোকিত লন। সশস্ত্র প্রহরা রয়েছে। এখান থেকেই কয়েকজন গার্ডকে দেখতে পেলেন তিনি। এই প্রহরার ভেতরে থাকতে তফিসুল বারীর মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। সারা পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ মনে হয় নিজেকে। মানুষ যত ওপরে ওঠে তত বেশি একা হতে শুরু করে। আজ একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি খুব বেশি একা। তার আশেপাশে যত লোকজনের ঘোরাঘুরি, তাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিস্বার্থ নিয়েই ঘোরে। কিন্তু তারপরেও তার কিছুই করার নেই। আগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, গভীর রাতে লেখালেখির ফাঁকে তিনি হাঁটতে বের হতেন। রাতের শহর দেখতেন। কেমন নিঃশ্বাস ফেলে শহর ঘুমায়। প্রতিটা বাড়িই যেন বিচ্ছিন্ন মহানগরের মত অন্ধকারে ডুবে থাকে। আজকাল আর রাতের শহর দেখা হয় না। সারাক্ষণ মানববেষ্টিত হয়ে থাকতে হয় তাকে। একা থাকতে চাইলেও সেই সুযোগ নেই। 

সেই পনেরো জনের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশের ইনভেস্টিগেশান ব্রাঞ্চের সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে একটা তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত জানা গিয়েছে যে পনেরটা পাসপোর্টই জাল। কিন্তু ইমিগ্রেশনে কেন সেটা ধরা পড়ল না-এটা একটা বড় প্রশ্ন। মোসাব্বেরকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু এই পনেরোজনের হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। 

হঠাৎ একটা গলা খাঁকারির শব্দে কিছুটা চমকে পেছনে তাকালেন তফিসুল বারী। তার এই স্টাডিতে তিনি ছাড়া আর কেউ আসে না! তাহলে? তিনি দেখলেন, স্টাডির কোণায় রাখা আরাম কেদারায় কে যেন বসে আছে। জায়গাটা অন্ধকার হওয়াতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 

“কে?” তফিসুল বারী জিজ্ঞাসা করলেন। 

ক্লিকিচ। 

রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খোলার শব্দ হল। 

অন্ধকার কোণা থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল, “এগোবেন না স্যার। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। শুধু আপনাকে কিছু কথা বলতেই আমি এসেছি।” 

তফিসুল বারী চুরুটটা পাশের এশট্রেতে রাখতে রাখতে বললেন, “কিছু কথা বলতে কেউ রিভলভার তাক করে না।” 

কণ্ঠটা বলল, “চিন্তা করবেন না। এটা শুধুমাত্র সিকিউরিটির জন্য। সাইলেন্সার লাগানো আছে। আপনি চিৎকার করলে বাধ্য হয়ে আমাকে গুলি করতে হবে। আমি খুব বেশি সময় নেব না।” 

“কে তুমি?” 

“শংকর। শংকর সাহা।” 

তফিসুল বারীর মনে হল, তিনি যেন ভূত দেখছেন। অন্ধকার কোণাটায় যেন ভূত বসে আছে। তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কে? কে? 

“শংকর। সাবেক জেলসুপার। 

“শংকর! শংকর তুমি!” 

“হ্যাঁ স্যার। আমি।” 

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তফিসুল বারী কিছুটা আগ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন আসলেই শংকর কিনা। 

শংকর বললেন, “এগোবেন না স্যার। প্লিজ।” 

তফিসুল বারী বাম হাত দিয়ে ডান হাত পেছনে ধরে বললেন, “কিভাবে ঢুকলে এখানে?” 

“সেটা আপনার না শুনলেও চলবে স্যার। অনেক কষ্ট করে এখানে ঢুকেছি।” 

“আমি জানতে চাই কে তোমাকে এখানে ঢুকতে সাহায্য করেছে।” 

“কাজের কথায় আসি স্যার। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে পাহাড়ি জেলখানা ভেঙে যে তেরোজন আসামী পালানোর ঘটনা ঘটে, যার পেছনে আমার হাত আছে বলে ধারণা করা হয়, আসলে সেই ধারণা ভুল।” 

তফিসুল বারী কিছুই বললেন না। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারে, যেখানে শংকর বসে আছে সেখানে তাকিয়ে থাকলেন। শংকর বলতে থাকলেন, “বশির জামান আমাকে সেই জেলখানাটার ঠিকানা বলতে বাধ্য করেছিল। আমি কোনভাবেই আপনাকে জানানোর সময় পাইনি। জেলেখানায় বিস্ফোরণ হওয়ার পরে আপনি যখন আমাকে ফোন দেন তখনও আমি আপনার সেই ফোন রিসিভ করতে পারিনি, কারণ আমি বশিরের কাছে জিম্মি ছিলাম। আমার পরিবার তার হাতে জিম্মি ছিল।” 

খুব দক্ষতার সাথে শংকর মেজর জেনারেল ফিরোজের সম্পৃক্ততা আর প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের কথা এড়িয়ে গেলেন। তিনি আগে থেকেই কথাগুলো ঠিক করে এনেছিলেন। 

“আসলে, আমি আপনাকে কিছু জানাবো, তার আগেই বশির আমাকে খুন করে। মানে খুন করার চেষ্টা করে আর কি। কিন্তু আমি বেঁচে যাই স্যার। কিভাবে বেঁচে যাই সেটা আজও আমার কাছে রহস্য। আমি অনেকবার আপনার কাছে আসতে চেয়েছি স্যার। আপনাকে সব কিছু বলতে চেয়েছি। পারিনি।” 

তফিসুল বারী এবার পেছনে ঘুরলেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। একটু আগে যে দুজন গার্ডকে দেখা যাচ্ছিলো, তাদেরকে আর দেখা যাচ্ছে না। হয়ত আশেপাশে কোথাও টহল দিচ্ছে। তিনি বললেন, “তুমি যে নির্দোষ তার প্রমাণ কি শংকর? তার কোন প্রমাণ আছে?” 

“না স্যার। এই মুহূর্তে কোন প্রমাণ নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, মেজর জেনারেল ফিরোজ আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন আপনার এখানে আসার জন্য। আমি নির্দোষ স্যার। এই মুহূর্তে আমার জানামতে কোন সাক্ষী নেই, কিন্তু আমি নির্দোষ। আপনি মেজর জেনারেলের সাথে কথা বলতে পারেন।” 

তফিসুল বারী নীরব। আলোকিত সবুজ লনে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। দুপাশের গাছগুলো হেলেদুলে সেই বাতাসের উপস্থিতি প্রমাণ করছে। হঠাৎ করেই যেন লনটা খুব বেশি নীরব মনে হচ্ছে তার। ভ্রু জোড়া কুঁচকে তিনি শংকরের দিকে ঘুরে বললেন, “এই মুহূর্তে তুমি এখানে বন্দী। তুমি কি এটা জানো শংকর? তুমি যদি আমাকে গুলিও কর, তোমার এখানে আসা না আসা সমান হয়ে যাবে। তুমি আমাকে গুলি করবে আর সবাই বিশ্বাস করবে যে তুমি আসলেই একটা খুনি। তুমি নির্দোষ, এটা তখন রূপকথার মত শোনাবে। আমার কথা শুনলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।” 

“কী কথা?” 

“তোমার রিভলভারটা এই টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখ। তারপর বের হয়ে যাও। কাল সকালে আমার আমার অফিসে এসে দেখা করো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তার বদলে আমার একটা শর্ত আছে।” 

শংকরের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল। খুশিতে নাকি ভয়ে সেটা শংকর বুঝতে পারলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী শর্ত?” 

“বদলে ওই জেলখানার কথাটা তোমাকে চেপে যেতে হবে। মনে করবে যে ওখানে কোন জেলখানা ছিল না। কেউ ছিল না। ওই তেরোজনের ব্যাপারে বা ওই জেলখানার ব্যাপারে কখনও কোন প্রশ্ন উঠলে তুমি কাউকে কিচ্ছু বলবে না। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক কোন তদন্ত হলে কখনওই যেন তুমি এর ভেতরে না জড়াও।” 

শংকর নিজেকে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বলল, “অবশ্যই স্যার।” 

“তাহলে তুমি এখন আসতে পারো শংকর। রিভলভারটা রেখে যাও। আমি গার্ডদেরকে বলে দিচ্ছি। ওরা তোমাকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।” 

শংকর অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসল। পাশের মৃদু ল্যাম্পের আলোয় সেই পুরনো শংকরকে দেখতে পেলেন তফিসুল বারী। শংকর রিভলভার থেকে ম্যাগাজিনটা বের করে পকেটে রাখল। তারপর শূন্য রিভলভারটা টেবিলের ওপরে রেখে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তফিসুল বারী টেবিলের ওপরে রাখা ইন্টারকমের রিসিভারটা তুলে বললেন, “ফজলুল। আছ? একটু ভেতরে আসো তো।” 

ইন্টারকমের ওপাশে নীরবতা। 

“ফজলুল?” তফিসুল বারী আবার বললেন। ওপাশে কেউ কোন সাড়া দিল না। হঠাৎ পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। পাশের কাঁচের জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। 

তফিসুল বারী কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের বুকশেলফে ফট করে একটা শব্দ হল। 

শংকর দরজার কাছ চিৎকার করে বললেন, “স্যার, বসে পড়েন, স্নাইপার।” 

তফিসুল বসে টেবিলের আড়ালে বসে পড়লেন। হৃৎপিণ্ডটা হাতুড়ির মত বাড়ি খাচ্ছে বুকের ভেতরে। আর একটু হলেই গুলিটা তার মাথার খুলি ভেদ করে বের হয়ে যেত। শংকর ভাঙা কাঁচের টুকরো বাঁচিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোন রকমে তফিসুল বারীর কাছে আসলেন। 

“স্যার, ঠিক আছেন?” শংকর বলল। 

তফিসুল বারী মাথা নেড়ে জানালেন যে তিনি ঠিক আছেন। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় তাকে বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। শংকর টেবিলের ওপরে খানিকটা মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল কোথা থেকে গুলিটা চলেছে। 

পুরো লন ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

শংকর টেবিলের ওপর থেকে রিভলভারটা নিলেন। ম্যাগজিন লাগালেন। তারপর তফিসুল বারীকে বললেন, “স্যার, পুলিশে খবর পৌঁছে গিয়েছে না এতক্ষণে?” 

তফিসুল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “চলে যাওয়ার কথা। এই বাড়িতে কোনভাবে গুলি চললে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মেট্রোপলিটন পুলিশ কন্ট্রোল রুম জেনে যাবে।” 

হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপরকার ইন্টারকমটা টেনে নিলেন শংকর। তারপর রিসিভারটা কানে ধরলেন। কোন ডায়াল টোন নেই। পুরো বাড়িটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। 

শংকর বললেন, “স্যার, এখান থেকে যেভাবেই হোক বের হতে হবে। আপনি চলেন আমার সাথে। কিচ্ছু হবে না।”

তফিসুল বারী অন্ধকারে মাথা নেড়ে কি বললেন বুঝতে পারলেন না শংকর। এক পশলা গুলির শব্দে সব কিছু চাপা পড়ে গেল। শংকর তফিসুল বারীর হাত ধরে ফিসফিস করে বললেন, “কাঁচ দেখেন। মাথা উঁচু করবেন না। আর হাত দুটো সাবধানে রাখবেন। কাঁচের ওপরে যেন না পড়ে।” 

তফিসুল বারী হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা রিভলভার বের করলেন। তারপর বললেন, “চল।” 

দুইজনে নিচু হয়ে দরজার কাছে যেতেই শংকর শুনতে পেল, বাড়ির প্রধান দরজাতে চাপা একটা শব্দ হচ্ছে। শংকর বললেন, “বাড়িতে কোন লুকানোর মত জায়গা আছে স্যার?” 

তফিসুল বারী রিভলভারটা হাত বদল করে বললেন, “আমি চোর বাটপার না যে আমার বাড়িতে লুকানোর জায়গা থাকবে। যে এই কাজটা করেছে আমি তাকে গুলি করে মারব। আমি এইভাবে লুকিয়ে থাকব না। তুমি আমাকে ছাড় শংকর।” 

শংকর দরজার সাথে ঠেস দিয়ে বললেন, “পাগলামি করবেন না স্যার, যেই এই কাজ করে থাকুক, সে একা করেনি। আমি নিশ্চিত এরা একা না। অনেকজন আছে। আপনি প্লিজ মাথা ঠাণ্ডা করেন।” 

বিকট শব্দে একট বিস্ফোরণ হল নিচে। সদর দরজার ভাঙা অংশগুলো এদিক ওদিকে ছিটকে পড়তে শুরু করল। শংকর তাড়াতাড়ি তফিসুল বারীকে নিয়ে পাশের করিডোর ধরে পেছন দিকে যেতে লাগলেন। বিস্ফোরণের শব্দের পরে কোন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু আগুনের মৃদু হলুদ আলো দেখা যাচ্ছে। 

শংকর বললেন, “স্যার, আপনি আস্তে আস্তে পেছন দিকে এগোতে থাকেন, আমি দেখছি কি হয়েছে।” 

তফিসুল বারী একমুহূর্ত কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “যাও।” 

নাইট গগলস পরা দশটা ছায়া মূর্তি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে শুরু করল। পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্রতিটা গেটে দুইজন করে মৃত্যুদূত অপেক্ষা করে আছে। বাড়ির ছাদেও তিনজন আছে। বাড়ির আঙ্গিনায় ঢোকার তিনটা গেটেই তিনটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। প্রথম গুলিটা লাগলে আর এত ঝামেলা করতে হত না। 

দশজনের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সাথে সাথে দরজার ভাঙা অংশগুলো ডিঙিয়ে যে মানুষটা ঢুকল, সে কংস। তার জ্বলজ্বলে চোখে দশ বছরের পুরনো প্রতিশোধের আগুন। কংসের পেছনে আরও দুইজন ছায়ামূর্তি। কংস বলল, 

“বাড়িটা সার্চ করো। দেখো কোন লুকানো কম্পার্টমেন্ট আছে কিনা। বেজমেন্টটাও সার্চ করো। কুইক।” 

হঠাৎ পর পর তিনটা গুলির শব্দ হল ওপর তলায়। 

***

শংকর সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। দরজার আড়ালে কান পেতে ছিল সে। কংসচক্রের মৃত্যুদূতগুলোর জুতোর নিচে রাবারের সোল লাগানো থাকলেও শংকর ভোঁতা আওয়াজ শুনে বোঝার চেষ্টা করল যে ওরা ঠিক কতজন আছে। ঘামে ভেজা হাতের তালুতে রিভলভারটা আরও শক্ত করে ধরল সে। একের বেশি আছে ওরা। তাই দরজার কাছে পড়ে থাকা একটা কাঁচের টুকরো পাশের রুমের দরজায় ছুঁড়ে মারল শংকর। সাথে সাথে ছায়ামূর্তিগুলো রুমটার দিকে হাতের অস্ত্র তাক করল। শংকর সেই সুযোগটা কাজে লাগাল। রিভলভারের গুলিতে পর পর দুইজনের মাথার খুলি উড়িয়ে দিল। তারপর ডাইভ দিয়ে করিডোরের শেষ মাথা পার হয়ে গেল। 

এলোমেলোভাবে বৃষ্টির মত এক পশলা গুলি চলল। তফিসুল বারীর সাথে দ্বিতীয় কাউকে এরা আশা করেনি। 

***

কংস বলল, “এই বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ আছে।” 

তারপর পিঠে ঝোলানো কারবাইনটার সেফটি ক্যাচ খুলে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। 

করিডোরের দুই দেয়ালে ঠেস দিয়ে আটজন কংস সৈনিক পজিশন নিয়েছে। একটু দূরেই দুইজনের লাশ পড়ে আছে। কংস ইশারায় বললেন যে, করিডোরের শেষ মাথায় একটা গ্রেনেড গড়িয়ে দিতে। যেই গুলি করুক, সে আরও শিকারের আশায় করিডোরের শেষ মাথাতেই বসে আছে। 

গ্রেনেডের পিন খোলার শব্দ হল। গড় গড় করে একটা গ্রেনেড গড়িয়ে গেল করিডোরের শেষ মাথায়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল গ্রেনেডটা। একটা আর্তনাদ শোনা গেল। কংস বলল, “মুভ।” 

আটজনের দলটা সারিবদ্ধভাবে করিডোরের শেষ মাথায় যেতেই পরপর তিনটা গুলি চলল। দুইজন কংস সৈন্য ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। 

***

শংকর তৈরিই ছিলেন। করিডোরের শেষ মাথায় অপেক্ষা না করে তিনি করিডোরের বিপরীত দিকের একটা সিঁড়ির নিচে অপেক্ষা করছিলেন। 

বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকা যাবে না। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাতাসে বারুদের গন্ধ। পেছনে তাকালেন তিনি। একটা সিঁড়ির অবয়ব দেখতে পেলেন। তিনি অনুমান করলেন, এই সিঁড়িটা নিচতলায় যায়। একটা দরজা আছে। ওটা খুললেই বাড়ির পেছনের বাগান। তিনি অপেক্ষা করছিলেন করিডোরের শেষ মাথায় কারও আসার। যখন কেউ আসল না, তিনি অপেক্ষা করলেন। যখনই গ্রেনেডটা গড়িয়ে এসে বিস্ফোরিত হল, তিনি চিৎকার করলেন। ‘ফলস ক্রাই’ চালটা কাজে দিল। সাথে সাথে তিনি মারা গিয়েছেন ভেবে আটজনের দলটা বের হয়ে আসল, তখনই শংকর সিঁড়ি নিচ থেকে গুলি করলেন। তিনটা গুলির ভেতরে দুইটা ভেদ করল দুইটা ছায়ামূর্তির শরীর। আর একটা ফসকে গেল। গুলি চালিয়েই শংকর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। 

কোন শব্দ হল না, কারণ পায়ের জুতো তিনি খুলে ফেলেছেন অনেক আগেই। 

*** 

কংস ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ল। কে তাকে এইভাবে ঘোল খাওয়াচ্ছে? এইবার সে একটা চাল চালবে। এমন একটা চাল, যা খেলা শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ওয়াকিটকি তুলে নিল কংস। বলল, “সুলেমান, পুলিশের ভ্যানটা রেডি কর।” 

***

নিচতলার রান্নাঘর। ওয়াশিং মেশিনের পেছনের অন্ধকারে ডুবে আছেন তফিসুল বারী। জানালা দিয়ে একটু পর পর উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছেন। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। ঘামে ভিজে গিয়েছেন তিনি। ঘর্মাক্ত হাতের মুঠোয় রিভলভারটা এখনও ভরসা যোগাচ্ছে। ওপরতলায় অনেকগুলো গোলাগুলির শব্দ হয়েছে। আর্তনাদও শুনতে পেয়েছেন তিনি। ধরেই নিয়েছেন শংকর বেঁচে নেই। 

এখনও তিনি বুঝে উঠতে পারেনি এরা কারা, আর কেনই বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা করার মত দুঃসাহস দেখিয়েছে। বশিরের দলের কেউ? বশিরের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছে? নাকি অন্য কেউ? অনেক ভেবেও তিনি কিছু বের করতে পারলেন না। 

হঠাৎ পুলিশের সাইরেনের শব্দ কানে আসল তার! পুলিশ এসে পড়েছে। আর কোন ভয় নেই। তিনি জানালা দিয়ে একটু উঁকি দিলেন। হ্যাঁ, আসলেই পুলিশ। লাল সাইরেন লাইট দেখা যাচ্ছে। 

তফিসুল বারী বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। সব কটাকে এবার জন্তুর মত গুলি করে মারবেন। একটাও যেন বের হতে না পারে। অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসলেন তিনি। তারপর রান্না ঘরের দরজা দিয়ে পেছনের বারান্দায় বের হয়ে আসলেন। লাল সাইরেন লাইটে বাড়ির পেছনের বাগানটা কিছুটা আলোকিত হয়েছে। 

গাড়ির দরজা খুলে একজনকে বের হতে দেখলেন তফিসুল বারী। তিনি হাত তুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে গুলি চলল। ব্রাশ ফায়ার। অনেকগুলো অ্যাসল্ট রাইফেল একসাথে গর্জে উঠল। বাগানের ঝোপের ভেতর থেকে একটা ছায়া ডাইভ দিয়ে তফিসুল বারীকে নিয়ে পাশের লোহার ডাস্টবিনটার আড়ালে গিয়ে পড়লেন। লোহার ডাস্টবিনটায় গুলি লেগে ঠং ঠং করে শব্দ হল। 

শংকর তফিসুল বারীকে বললেন, “কি করছিলেন আপনি?” শংকর হঠাৎ ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বলল, “এরা পুলিশ না স্যার। এটা ওদের একটা চাল।” 

তালুর নিচে চটচটে তরল অনুভব করলেন শংকর। তফিসুল বারীর কাছ থেকে কোন সাড়া পেলেন না। শেষ রক্ষা হয়নি। গুলির বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তফিসুল বারীকে এফোঁড়ওফোড় করে দিয়েছে। শংকর তফিসুল বারীর নিথর দেহটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাগানের বেড়ার কিনারে সরে গেলেন। 

আবার গর্জে উঠল অ্যাসল্ট রাইফেল। গুলির শব্দ এগিয়ে আসছে। কেউ একজন বলছে, “ফ্ল্যাশলাইটগুলো জ্বালিয়ে দাও। ছাদের ওপরের ফ্ল্যাশ লাইটগুলো জ্বালিয়ে দাও।”

শংকর নিজেকে বাঁচানোর জন্য বুকে হেঁটে সরে যেতে লাগলেন। 

এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষন থেমে নেই। শংকরের পিঠে গুলি লেগেছে। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন। দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল তার। নাহ, জ্ঞান হারানো যাবে না। পায়ের আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু আত্মরক্ষা করার মত কোন কিছুই বাকি নেই। 

আস্তে আস্তে স্নায়ুগুলো হাল ছেড়ে দিল। শংকরের দেহটা ঘাসের ওপরে লুটিয়ে পড়ল। জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেলেন অনেকগুলো সাইরেনের শব্দ। পেছনে তাকিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন, ছায়ামূর্তিগুলো সরে যাচ্ছে। এদিকে ওদিকে পালাচ্ছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলেন, স্পেশাল ফোর্সের ভ্যানগুলো লন পার হয়ে বাড়ির দিকেই আসছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে হয়ত কেউ পুলিশকে জানিয়েছে। 

স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা শংকরের সংজ্ঞাহীন দেহটা যখন আবিষ্কার করল, তখনও তার নিঃশ্বাস চলছে। 

***

অনেক দূর থেকে কেউ যেন ডাকছে। বলছে, “শুনতে পাচ্ছেন? জেগে থাকার চেষ্টা করেন। এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে থাকেন।” 

শংকর ঝাপসা চোখে একটা লোকের চেহারা দেখতে পেল। লোকটা বারবার তাকে একই কথা বলছে। একবার মনে হল লোকটা খাইরুল। আবার মনে হল লোকটা মেজর জেনারেল। আবার মনে হল, না আসলে লোকটা সেই মানুষখেকো বনে দেখা সেই মানুষগুলোর একটা; কোন মানুষগুলো? সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে শংকরের। শরীরহীন একটা আত্মা হয়ে যেন বাতাসে ভেসে যাচ্ছেন তিনি। অনেক কোলাহল। অনেক মানুষের কণ্ঠ। এদের ভেতরে কোন একজনকে বললে সে সুতপা সুলেখাকে খবর দেবে না? তাদের কাছের মানুষটা যে বেঁচে আছে আর সে নির্দোষ এটা তাদের খুব জানা দরকার। 

স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা শংকরকে খুব দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। একজন নার্স স্ট্রেচারের সাথে অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছুটতে শুরু করল। 

ঝাপসা চোখে শংকর নার্সটাকে দেখতে চেষ্টা করলেন। নার্সটাকে বললেন সে কি সুতপাকে একটু খবর দেবে? সুতপাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে নার্স। ওকে একটু খবর দেবেন? মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতাম। পাঁচটা বছর আজ দেখব কাল দেখব করে মেয়েটাকে দেখতেই পাইনি। খাইরুল সাহেবেকেও জানাতে হবে যে তার বোন এখনও বেঁচে আছে। যে ব্যথা তিনি আজ পাঁচ বছর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তার সম্পূর্ণটাই মিথ্যা-কথাগুলো মনে মনেই বললেন শংকর। কথা হয়ে আর সেগুলো বের হতে পারল না। নার্সের হাতে একটা সিরিঞ্জ দেখতে পেলেন তিনি। সিরিঞ্জ ভর্তি সবুজ রঙের তরল। সিরিঞ্জের সুঁইটা তার শিরায় প্রবেশ করার সাথে সাথে শরীরের ভেতরে যেন আগুন ধরে গেল। ব্যথায় শরীরটা কুঁকড়ে গেল তার। 

ঝাপসা চোখে শেষবারের মত নার্সটাকে আরেকবার দেখলেন তিনি। এই চেহারাটা অনেক আগে একবার দেখেছেন। অনেক আগে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। 

মেয়েটা জুঁই, যে একটু আগেই ঈশ্বরের আদেশ পালন করল। শংকরের অনিশ্চিত মৃত্যুটা নিশ্চিত করল। ছায়াসংঘের কাজ নিয়ে সেই কাজ অসম্পূর্ণ রাখলে তার পরিণতি মৃত্যু। কারণ তার ফলে সংঘের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। শংকর সেই কাজটাই করেছেন। খাইরুলকে হত্যা করার দায়িত্ব নিয়েছেন, কিন্তু তা শেষ করেননি। 

***

সারি সারি পুরনো বইয়ের দোকান। খবিরুলের দোকানে পুরনো বইয়ের একটা লট এসেছে। কমবয়সী একটা ছেলে বস্তা থেকে বইগুলো বের করে বাছাই করছে। বেশির ভাগ বইই ছেঁড়া ফাটা। কোন বইয়ের প্রথম অর্ধেক আছে তো শেষ অর্ধেক নেই। কোন বইয়ের শেষ অর্ধেক আছে তো প্রথম অর্ধেক নেই। বইগুলোর বেশির ভাগই পাঠ্যবই। সার্টিফিকেট পেয়ে যাওয়ার পরে বইগুলোর প্রয়োজনও ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছে কেউ। 

মোটামোটি ভালো মানের বইগুলো দোকানের ভেতরে রাখতে রাখতে খবিরুলের হাতে ধরা দৈনিক পত্রিকার দিকে চোখ পড়ল। নতুন পড়া শিখেছে। তাই যেটা পায় সেটাই পড়তে শুরু করে। শুরুতে সব পাঠকই এই ছেলেটার মত সর্বভূক থাকে। তারপর কেউ হয় মাংসাশী, কেউ হয় নিরামিষী। 

“প্রধানমন্ত্রীর হত্যাঃ জাতীর পরাজয়”

গতকাল আনুমানিক রাত এগারটার দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তফিসুল বারী তার নিজ বাসভবনে একদল আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকান্ডের ফলে সারাদেশে শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে। সাধারণ জনগণের ভেতরে উৎকণ্ঠা 

দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে কংসচক্রের হাত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। 

গতকাল প্রেস ব্রিফিঙে স্পেশাল ফোর্সের চীফ কমান্ডার তীলক বড়ুয়া জানান, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের ভেতরের কারও হাত রয়েছে এই হত্যাকাণ্ডে। তবে এখন পর্যন্ত কোন জীবিত প্রহরীকে উদ্ধার করা যায়নি। সব মিলিয়ে মোট ছত্রিশ জন প্রহরীর লাশ পাওয়া গিয়েছে। প্রহরীদের লাশের পাশাপাশি আরও তেরোজন আততায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুইজন আততায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের ভেতরে একজন এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দানকারী বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে স্পেশাল ফোর্সের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। 

এই ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন… 

“ওই ছুড়া, কি দেখিস?” খবিরুল খেঁকিয়ে উঠল। কাজ বাদ দিয়ে ছেলেটা সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে খুব মেজাজ খারাপ হল তার। ছেলেটা থতমত খেয়ে হাতের বইগুলো নিয়ে দোকানের ভেতরে রেখে আসল। 

তারপর আবার বস্তা থেকে বই বের করে বাছতে লাগল। হঠাৎ একটা অন্যরকম বই পেল ছেলেটা। একটা ডায়েরি, নেভি-রু মলাট। ডায়েরিটা ভেজা ছিল বলে মনে হল। কেমন কড়কড়ে হয়ে গিয়েছে। খবিরুলের দিকে তাকাল সে। খবিরুলের মনোযোগ সংবাদপত্রের দিকে। ছেলেটা খুব সাবধানে ডায়েরিটা খুলে দেখল। কিছুই লেখা নেই ডায়েরিটাতে। পাতার পর পাতা, সবই সাদা। কেউ কিছুই লেখেনি। শুধু ডায়েরির শেষ পাতায় হিজিবিজি করে একটা গোলাকার ছবি আঁকা। 

বেরসিক ডায়েরিটা ছেলেটাকে টানল না। ডায়েরিটার জায়গা হল পুরনো বইয়ের বান্ডিলে। পুরনো বইয়ের এক নিভৃত জগতে হারিয়ে গেল ডায়েরিটা। 

(সমাপ্ত) 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *