শেষ পরকীয়া
পাড়াগাঁয়ের পুকুরপাড়ে ছাইয়ের গাদার আড়ালে মানকচু কিংবা ধুতরো ফুলের ঝোপের পিছনে বসে যেসব গ্রামবৃদ্ধ স্নানরতা রমণীদের ঘাটের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকেন, গ্রাম্যগঞ্জনা এবং কখনও কখনও মৃদু বা তত-মৃদু-নয় প্রহার ও গলাধাক্কা তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারে না এই দার্শনিক অভ্যাস থেকে।
বিদ্যাবুদ্ধি লেখক হয়তো এখনও ততটা বুড়ো এবং অথবা নির্লজ্জ হননি কিন্তু তাঁরও হয়েছে ওই একই দশা, ছাইয়ের গাদার পিছনে বসে দর্শনসুখ না ভোগ করলেও পরকীয়া লিখে তাঁর ফুর্তি হয়েছে প্রচুর, জীবনে এই প্রথম এমন নিষিদ্ধ কাজের আনন্দ পেলেন তিনি।
যাঁরা জানতেন না যে, এই রকম জটিল ও নিষিদ্ধ বিষয়ে আমার এত অগাধ জ্ঞান এবং যাঁরা পরকীয়ামালা পাঠ করে বিচলিত বোধ করছেন তাঁদের জন্য এবার প্রথমেই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কথিত কাহিনী দিয়ে শুরু করি। বিদ্যাসাগর মহোদয়ের যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব মহাকাব্য ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪, ২য় সংস্করণ), যা কিনা কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত; সেখান থেকে সংক্ষিপ্তাকারে আমি উপস্থাপন করছি।
এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী এক সুপণ্ডিত কথকের কথায় মোহিত হয়ে তাঁর প্রতি ঘনিষ্ঠ হন এবং অবশেষে সেবাদাসী হয়ে পড়েন। একদিন পণ্ডিত কথকতার সময় ব্যভিচার বিষয়ে বললেন। যে নারী পরপুরুষে উপগতা হয় নরকে তাকে অনন্তকাল কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। কণ্টকাকীর্ণ লোহার শিমুল গাছকে উপপতিরূপে তাকে গ্রহণ করতে হয়। যমদূতেরা তাকে সেই গাছ আলিঙ্গন করতে বাধ্য করে সেই ব্যভিচারিণীর সর্বশরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, রক্ত পড়তে থাকে; সে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিলাপ, পরিতাপ ও অনুতাপ করতে থাকে। তবু তার রক্ষা নেই। পণ্ডিতমশায় তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন স্ত্রীজাতিকে সাবধান করে দিয়ে যে, ‘ক্ষণিক সুখের অভিলাষে পরপুরুষে উপগতা হওয়া উচিত নহে।’
এই ভয়ানক শাস্তিভোগ বৃত্তান্ত শুনে সেই সেবাদাসী তৎক্ষণাৎ সাবধান হয়ে গেল। সে আর সেদিন সন্ধ্যায় কথকঠাকুরের শয়নগৃহে প্রবেশ করল না।
পণ্ডিতমশায় যখন তাকে ডেকে পাঠালেন এবং জানতে চাইলেন, ‘আজ কী হল ?’ সেবাদাসী শোকাকুল বচনে শিমুল গাছের উপাখ্যান শুনে তার ভয় হয়েছে এবং তার পক্ষে আর শয়নগৃহে গুরুদেবকে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব নয়, সেটা জানিয়ে দিলেন।
তখন পণ্ডিত সহাস্যে বললেন, ‘আরে পাগলি, তুমি এই ভয়ে আজ শয্যায় আসছ না ! আমরা পূর্বাপর যেমন বলে এসেছি, আজও তাই বলেছি। শিমুলগাছ আগে ওরকম ভয়ংকর ছিল বটে; কিন্তু শরীরের ঘষায় ঘষায় লোহার কাঁটাগুলো ক্রমে ক্ষয় পাওয়াতে শিমুল গাছ তেল হয়ে গিয়েছে। এখন আলিঙ্গন করলে সারা শরীর শীতল ও পুলকিত হয়।’
বিধবার সঙ্গে প্রণয় বা ঘনিষ্ঠতা বোধহয় সে অর্থে পরকীয়া পর্যায়ে পড়ে না। তবে খানদানি বিধবা সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলি এক আশ্চর্য কাহিনী লিখেছিলেন তাঁর চাচাকাহিনীতে। সে বিধবা কিন্তু কোনও মানুষের বিধবা নয়, সে সিংহের বিধবা।
বরোদার মহারাজ সয়াজি রাওকে ইথিওপিয়ার রাজা একজোড়া সিংহ উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু পুরুষ সিংহটি মারা যায়। তখন সেই বিধবা সিংহীর ঘরে একটি গুজরাটি সিংহ বর হিসেবে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। খাঁচার দরজা দিয়ে বর ঢুকলেন আস্তে আস্তে। হঠাৎ সিংহী এক লাফ দিয়ে এসে পড়ে সিংহের ঘাড়ে। মুহূর্তের মধ্যে নতুন বর নিহত হল। মুজতবা লিখেছেন, বরোদার মহারাজা সিংহের সিংহীর দ্বারা নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘এদেশের খানদানি বিধবা— তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক—নতুন বিয়ে করতে চায় না। হাবশি সিংগিনী এদেরও হার মানালে যে ?’
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বৈধতা-অবৈধতা সংক্রান্ত এ যাবৎ সবচেয়ে মারাত্মক গল্পটি অবশ্য পরশুরাম বিরচিত, সেই অসামান্য ‘ভূশণ্ডীর মাঠে।’ সে গল্প লিখতে গিয়ে পরশুরামের পর্যন্ত কলমের কালি শুকিয়ে গিয়েছিল। শিবুর তিন জন্মের তিন স্ত্রী এবং নৃত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামী। এই ডবল এ্যহস্পর্শযোগে ভূশণ্ডীর মাঠে যুগপৎ জলস্তম্ভ, দাবানল ও ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল।
সিংহ বা ভূতের পরকীয়ার সমস্যা ছেড়ে এবার আমরা একটু মানুষের পরকীয়ায় মনোযোগ দেব।
প্রথমেই সেই বিখ্যাত কমার্শিয়াল আর্টিস্টের গল্পটি বলে নিই। এই শিল্পী ভদ্রলোক এক বিজ্ঞাপন কোম্পানির ধরাবাঁধা কাজ করেন। তাঁর নিজস্ব স্টুডিয়োতে সেদিন তিনি খুব ক্লান্ত অবস্থায় বসে আছেন। কিছু কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। অথচ এক আলুলায়িত বসনা, টানটান সুন্দরী সামনেই সোফার উপরে শুয়ে একটা গোলাপ ফুলে চুম্বন করছে। একটা লিপস্টিকের বিজ্ঞাপনের জন্য ছবিটা তৈরি করতে হবে, তাড়াতাড়িই করতে হবে। কিন্তু আজ নানা হাঙ্গামা ছিল সারাদিন। শিল্পীর কাজ করতে ভাল লাগছে না।
মডেল সুন্দরীর দিকে কিছুক্ষণ নিথর তাকিয়ে থেকে তুলি হাত থেকে নামিয়ে শিল্পী বললেন, ‘মিসেস দাস, আজ থাক। বড় মাথাটা ধরেছে। আপনি বরং এই সামনের চেয়ারটায় এসে বসুন, একটু চা খাই।’ শিল্পী পাশের টেবিল থেকে দুটো পেয়ালা নিয়ে বাড়ি থেকে আনা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। মডেল সুন্দরী কাপড়-চোপড় গোছগাছ করে সামনের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে শিল্পীর সঙ্গে গল্প আরম্ভ করলেন, কোনও প্রণয় ভালবাসার ব্যাপার নয়, টুকটাক সাধারণ কথাবার্তা।
এমন সময়, যেমন হয়, সিঁড়িতে চপল চটির শব্দ। শিল্পীর স্ত্রী হঠাৎ হঠাৎ স্টুডিয়োতে এসে পড়েন, আজও তাই হয়েছে। ঘটনার গুরুত্ব বোঝা মাত্র শিল্পী আঁতকে উঠলেন, তাঁর স্ত্রী যদি তাঁকে এখন চা খেতে খেতে সুন্দরী মডেলের সঙ্গে গল্প করতে দেখে, তা হলে সমূহ সর্বনাশ।
শিল্পী মডেলকে বললেন, ‘সর্বনাশ, আমার স্ত্রী আসছেন। আপনি তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় এলোমেলো করে সোফার উপর শুয়ে পড়ুন। আমার স্ত্রী যদি আপনাকে আমার সঙ্গে চা খেতে দেখতে পান, ঘোর বিপদ হবে।’
এক ধর্মযাজক একদা এক বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, ‘দশজন কুমারীর সঙ্গে আমি থাকব তবু একজন বিবাহিতার সঙ্গে নয়।’ পরকীয়াবিদ্বেষী সেই ধর্মযাজকের সঙ্গে, বলা বাহুল্য, সেই সভার সব পুরুষ শ্রোতাই একমত হয়ে হর্ষধ্বনি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরাও তাই চাই।’
পরকীয়ার প্রধান অসুবিধা হল, মহিলাটির স্বামী-দেবতাকে নিয়ে। যে ভদ্রলোক জীবনে কোনওদিন এক মুহূর্তের জন্য স্ত্রীর প্রতি কোনও রকম মনোযোগ দেননি, তিনিই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন, সেই মহিলার প্রতি অন্য কোনও পুরুষমানুষ সামান্য মনোযোগ দিলে।
তবে সেই সব পুরুষমানুষ, যাঁরা বিশ্বপ্রেমিক, যাঁরা মহিলা দেখলেই গদগদ হয়ে প্রেমে পড়েন, যাঁরা ভাবেন মহিলামাত্রেই সুরসিকা, তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ, নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যে দু-একটা রসিকতা করার চেষ্টা করে দেখবেন, তাতে হয়তো ভুল ভাঙতে পারে।
পরকীয়া, যাকে সাধুভাষায় বিবাহোত্তর প্রণয় বলা চলে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটের উপর যতই ভাল হোক উত্তরোত্তর খরচের ব্যাপার। এই তো গত শীতে একজন দুঃসাহসী সাহিত্যিককে দুটি কাশ্মীরি শাল কিনতে হয়েছিল, এই তাঁর নবীনা বান্ধবীকে উষ্ণ রাখার জন্য, অপরটি তাঁর প্রবীণা স্ত্রীকে ঠান্ডা রাখার জন্য।
দুটি ক্ষুদ্র কাহিনী দিয়ে এই পরকীয়া কথামালা শেষ করছি। এক ভদ্রলোক একদিন তাঁর স্ত্রীর প্রণয়ীকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন। প্রণয়ীটি মোটেই ভীত বা বিব্রত না হয়ে বললেন, ‘দেখুন হাতাহাতি বা মারামারি করে লাভ নেই। তার চেয়ে আসুন তাসের জুয়া খেলি, আপনার স্ত্রী আমার হবে না আপনারই থাকবে জুয়া খেলে সেটা ঠিক করে ফেল।’ স্বামী ভদ্রলোক উদাসীনভাবে বললেন, ‘দেখুন, জুয়াটাকে সামান্য একটু ইন্টারেস্টিং করার জন্য যদি একটা টাকা বাজি সঙ্গে থাকে তাতে কি আপনার আপত্তি হবে ?’ মোদ্দা কথা, ভদ্রলোকের কাছে তাঁর স্ত্রীর মূল্য এক টাকাও নয়।
তবে অন্য গল্পটি একটু আলাদা। মৃত্যুকালে স্ত্রী স্বামীর হাত ধরে বলেছেন, ‘ওগো, আমার মৃত্যুর পরে তুমি কাউকে প্রাণ ভরে ভালবেসো।’ স্বামী আবেগবিধুর কণ্ঠে বললেন, ‘অসম্ভব, এ জীবনে আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।’ স্ত্রী বললেন, ‘আমার গয়নাগাঁটি সব তার জন্য রেখে যাচ্ছি, তুমি তাকে দিয়ো।’ এতক্ষণে স্বামী মৃত্যুপথযাত্রিণী রুগ্ণা পত্নীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হার, দুলগুলো হবে কিন্তু চুড়ি আর বালাগুলো হবে না, তার হাত-টাতগুলো যে তোমার থেকে অনেক গোলগাল।’