“তুমি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলেন সাম্যব্রত।
বিহান উত্তর দিল, “বাহারবেড়িয়া জংশন। আর ঘণ্টাখানেক লাগবে। দরিয়াকে একবার ফোন দিন।”
সাম্যব্রত নিচু গলায় বললেন, “ও একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
“একটু অসুস্থ মানে?” চিৎকার করে উঠেছে বিহান, “কী হয়েছে ওর?”
সাম্যব্রত বললেন, “তুমি রাস্তায় রয়েছ। উত্তেজিত হোয়ো না। এক্ষুনি মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল। তুমি তাড়াতাড়ি এসো, প্লিজ়!”
বিহান কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিয়েছেন সাম্যব্রত। কারণ একজন সেবিকা কোমরে হাত দিয়ে, ভুরু কুঁচকে তাঁকে দেখছে। সাম্যব্রত ফোন কাটতেই সেবিকা বলল, “আমি আপনাকে ডেকে পাঠালাম যাতে মেয়ের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে পারেন। আপনি এসেই মিডিয়াকে ফোন করা শুরু করে দিলেন?”
সাম্যব্রত অবাক হয়ে বললেন, “মিডিয়া? আমি তো জামাইকে ফোন করেছিলাম।”
“আপনাদের ওইসব কোড ওয়ার্ড আমি জানি না ভেবেছেন?” গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাচ্ছে সিস্টার, “মামা মানে পুলিশ, জামাই মানে মিডিয়া, ভাইপো মানে পাড়ার গুন্ডা— সব জানি।”
“বিশ্বাস করুন দিদি! আমি আমার মেয়ের বরকে ফোন করেছিলাম। কোনও মিডিয়াকে চিনি না।”
“সব্বাই তাই বলে,” কাঁসরের মতো গলায় বলল সিস্টার, “এরপর পেশেন্ট মরে গেলে জামাইদের নিয়ে চলে আসে। তাই না মন্টুদা?”
মন্টু ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে দরিয়ার মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “যা বলেছেন নমিতাদি। এক্কেবারে খাঁটি কথা।”
জলের ঝাপটায় দরিয়ার জ্ঞান ফিরেছে। সে সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, “বিহান এসেছে?”
“না। আমি এক্ষুনি ওকে ফোন করেছিলাম। সিস্টার বকাবকি করলেন বলে লাইন কেটে দিলাম।” নিচু স্বরে বললেন সাম্যব্রত।
নমিতা সিস্টার গলা আবার চড়িয়ে বলল, “মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে। পেশেন্ট পার্টি বাইরে যান।”
সাম্যব্রত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। মন্টু ট্রলি ঠেলে একটা বড় হলঘরে দরিয়াকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে বেরিয়ে গেল।
দরিয়া বুঝতে পারছে, এটা লেবার রুম। আশেপাশে হবু মায়েরা শুয়ে। হঠাৎ ‘ট্যাঁ ট্যাঁ’ করে বাচ্চার গলার আওয়াজ শোনা গেল।
সদ্যোজাত শিশুর কান্না শুনে বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে এল দরিয়ার। তার মধ্যে অজস্র অনুভূতি খেলা করছে। কখনও ভয় করছে, কখনও দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কখনও বিহানের উপরে তীব্র অভিমান হচ্ছে। পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে, তার গর্ভের সন্তান বিহান আর তার ভালবাসার ফসল। বিহানকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।
দরিয়ার চিন্তাস্রোতে বাঁধ দিতে চলে এসেছে নমিতা সিস্টার। খ্যারখ্যার করে বলছে, “গুনগুন মাসি, এদিকে এসো।”
গুনগুন মাসি আবার কে? ঘাড় ঘুরিয়ে দরিয়া দেখল, বছর ষাটের এক মহিলা দুটো সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাগুলোকে রেলিং দেওয়া কটে রেখে দরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এর স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে। বদলে দিই?”
“দাও,” ছোট্ট উত্তর দিল নমিতা সিস্টার। সে এতক্ষণ দরিয়াকে পরীক্ষা করছিল। হাত থেকে গ্লাভস খুলে বলল, “তোমার ডেলিভারি হতে দেরি আছে মা ঠাকরুন। এখন লেবার রুমে ঢুকে ভিড় বাড়িয়ো না। ওয়ার্ডে গিয়ে শুয়ে থাকো।”
গুনগুন মাসি স্যালাইনের পাউচ বদলে দিয়েছে। ডেকে এনেছে মন্টুকে। তাকে দেখেই নমিতা সিস্টার চেঁচাল, “একে এখানে আনলে কেন? বাচ্চা হতে দেরি আছে। শিগ্গির মেটারনিটি ওয়ার্ডে নিয়ে যাও।”
মন্টু বলল, “আমি কী জানি! ঘোষ স্যর এখানে পাঠিয়ে দিলেন। এই মেয়েটার পায়ে বোমা লেগেছিল।”
“ইনজুরি?” নমিতা সিস্টারের চোখ কপালে উঠেছে, “একে সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি না করে এখানে কে ভরতি করল?”
“ঘোষ স্যর,” হাসছে মন্টু।
“লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কমপ্লিট ম্যাড!” আবার চেল্লাচ্ছে নমিতা, “মন্টুদা, তুমি টিকিট আর পেশেন্ট নিয়ে আবার ইমার্জেন্সিতে যাও। এই পেশেন্ট মেটারনিটি ওয়ার্ডে নয়, সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি হবে।”
মন্টু আবার ট্রলি ঠেলে লেবার রুম থেকে বেরিয়েছে। সিমেন্টের চোকলা-ওঠা মেঝে দিয়ে ট্রলির নড়বড়ে চাকা যাওয়ার সময়ে সেটা থরথর করে কাঁপছে। কিছুক্ষণ ট্রলি চলার পরে দরিয়া দেখল, তাকে আবার ইমার্জেন্সিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ট্রলি দাঁড় করিয়ে মন্টু বলল, “স্যর! নমিতা সিস্টার এই পেশেন্টকে ভরতি নিল না।”
ডক্টর ঘোষ মোবাইলে কথা বলছিলেন। মন্টুর কথা শুনে ফোন কেটে বললেন, “একজন পেশেন্টকে সিস্টার ওয়ার্ডে ভরতি করতে চাইছে না! কেন জানতে পারি?”
মাথা চুলকে মন্টু বলল, “সিস্টার বলল, বাচ্চা হতে দেরি আছে। এখন একে সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি করে দিন। পায়ের সমস্যা মিটলে তার পরে মেটারনিটি ওয়ার্ডে যাবে।”
“আচ্ছা?” দরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে, কণ্ঠস্বরে শ্লেষ মিশিয়ে ডক্টর ঘোষ বললেন, “রুগি কোন ওয়ার্ডে ভরতি হবে, সেটা কে ঠিক করবে? ডাক্তার না সিস্টার? সিস্টারের এত সাহস হয় কী করে?”
“আমি জানি না স্যর,” মন্টু হাসছে। মন্টুর হাসি দরিয়ার বিসদৃশ লাগছে। পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়ার পরেও এই লোকগুলো তাকে একটা বেড জোগাড় করে দিতে পারছে না! সেই জন্যে কোনও লজ্জাও নেই। বোকার মতো হাসছে!
ডক্টর ঘোষের হাতে টিকিট দিয়ে মন্টু বলল, “আপনি যা করার করুন। আমি একটু বসি।”
মন্টু টুলে বসে পা নাচাচ্ছে। ডক্টর ঘোষ মোবাইলে কাউকে ধরেছেন। এবার যেটা শুরু হল, সেটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য দরিয়া যাবতীয় শারীরিক এবং মানসিক অসুবিধে ভুলে গেল।
ফোনালাপ শুনে বোঝা যাচ্ছে, ওপারে রয়েছে নমিতা সিস্টার। ডক্টর ঘোষ বলছেন, “নমস্কার। আপনার একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যাবে? নিদেনপক্ষে সেলফি? অথবা খুরের ধুলো? হ্যাঁ হ্যাঁ, খুর। যাকে আমরা ভাল বাংলায় লেগ ডাস্ট বলি। আপনার লেগ ডাস্ট না নিলে আর কার নেব বলুন? আপনার পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। পেশেন্ট কোন ওয়ার্ডে ভরতি হবে, সেটা আপনি যেভাবে একজন ডাক্তারকে ডিক্টেট করছেন তাতে আমি আপ্লুত। সেই কারণেই অটোগ্রাফ চাইছিলাম!”
ওদিক থেকে নমিতা সিস্টার কী বলল শোনা গেল না। কিন্তু এদিকে ডক্টর ঘোষের মুখচোখ বদলে গেছে। তিনি মন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সর্বনাশ! সিস্টার এখানেই আসছে। আজ আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না!”
ডক্টর ঘোষের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমার্জেন্সিতে চলে এসেছে নমিতা সিস্টার। সে গটগট করে ডক্টর ঘোষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার বলুন।”
ডক্টর ঘোষ মিনমিন করে বললেন, “পেশেন্ট কোন ওয়ার্ডে ভরতি হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আপনার না আমার?”
নমিতা সিস্টার কিছুক্ষণ ডক্টর ঘোষের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরে বিকট চিৎকার করে বলল, “মেটারনিটি ওয়ার্ডে ভরতি থাকার সময়ে ইনজুরির কারণে পেশেন্ট মারা গেলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আপনি?”
দরিয়া অবাক হয়ে ভাবল, এরা সবাই ভাবছে কেন যে সে মরে যাবে? তার তো কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে না। তা হলে?
নমিতার চিৎকার শুনে ডক্টর ঘোষ ধড়ফড়িয়ে উঠে বললেন, “ঠিক আছে! ঠিক আছে। অত চেঁচাতে হবে না। আমি পেশেন্টকে সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি করছি। এবারে চুপ করুন, প্লিজ়!”
“যা বলি আপনার ভালর জন্যেই বলি। কথাটা মনে থাকে না কেন?” নাক সিঁটকে বলল নমিতা সিস্টার। তারপরে জুতোর টকাটক আওয়াজ তুলে লেবার রুমে চলে গেল।
ইমার্জেন্সিতে এখন নীরবতা। ভাগ্য ভাল যে অন্য কোনও পেশেন্ট নেই। ডক্টর ঘোষ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মন্টুর দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “বোকার মতো হাসছ কেন? যাও! মেয়েটাকে সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি করে দাও।”
“ঠিক আছে স্যর!” এখনও হাসছে মন্টু।
দরিয়ার জন্য আবার নতুন বেড টিকিট বানানো হল। ডক্টর ঘোষ নতুন নিদানপত্র লিখলেন।
মন্টু আবার ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে দরিয়াকে নিয়ে যাচ্ছে। এবারে সম্পূর্ণ অন্যদিকে। দরিয়ার অল্প অল্প ভয় করছে। হাসপাতালে ভরতি হওয়ার আগেই যদি এত ঝামেলা, তা হলে চিকিৎসা পেতে না জানি কত অশান্তি অপেক্ষা করে আছে! সে নিজের মনকে এই বাস্তবের থেকে দূরে রাখার জন্যে মন্টুর সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। “ডাক্তারবাবু যখন কথা বলছিলেন, তখন তুমি হাসছিলে কেন মন্টুদা?”
মন্টু এখনও হাসছে, “মা জননী, আজ অবধি দেখেছ, কোনও সিস্টার কোনও ডাক্তারকে এইরকম বকুনি দিচ্ছে?”
দরিয়ার হাসপাতালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই বললেই হয়। কী সরকারি, কী প্রাইভেট। অনেক বছর আগে একবার এই বঙ্গবাসী হাসপাতালেই এসেছিল। সেদিনের অভিজ্ঞতা দরিয়া কিছুতেই মনে করতে চায় না। অবশ্য তার কারণ স্বাস্থ্যকর্মী নন। অন্য একজন।
সেসব কথা এখানে বলার কোনও মানে হয় না। দরিয়া বলল, “না গো মন্টুদা!”
মন্টু বলল, “এমন ঘটনা ডাক্তার ঘোষ আর সিস্টারের মধ্যে রোজ ঘটে। কেন বলো তো?”
“জানি না।”
“ওরা সোয়ামি-ইস্তিরি। কলেজ জীবনে লাভ ছিল। পরে ম্যারেজ হয়েছে। এরা বাড়িতে লাঠালাঠি করে। হাসপাতালেও লাঠালাঠি করে। বাড়িতে ‘তুমি’ বলে। এখানে ‘আপনি’। এদের জন্য বঙ্গবাসী হাসপাতালে কাক-চিল কমে গেছে!”
মন্টুর কথা শুনে হাসছে দরিয়া। যাবতীয় অসুবিধের কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করছে। ভাল কোনও কথা মনে করার চেষ্টা করছে। সেই দিনটার কথা, যেদিন সে আর বিহান প্রথম একসঙ্গে কলকাতায় এসে চা খেয়েছিল। যেদিন হাওড়ায় পৌঁছে বিহান তাকে চুমু খেয়েছিল! অনেক বছর আগে, সরস্বতী পুজোর সন্ধেবেলা একাত্তর নম্বর বাসের পিছনের সিটে বসে গালে ঠোঁট ছোঁওয়ানো নয়। সত্যিকারের চুমু!
* * *
কলকাতার আকাশে তখন আতশবাজির রোশনাই। ঘোড়ায় চড়ে অবাঙালি বর যাচ্ছে বিয়ে করতে। সঙ্গে রয়েছে তাসাপার্টি। তারা জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুর বাজাচ্ছে। দরিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “দাঁড়াও। বরকে একবার দেখে নিই।”
দরিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে বিহান বলল, “তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাকু-কাকিমা চিন্তা করবেন।”
আবার ফেয়ারলি প্লেস। আবার লঞ্চ। এবার ফেরার পালা। আসার সঙ্গে যাওয়ার তফাত হল এই যে, এখন লঞ্চ অফিসযাত্রীতে গিজগিজ করছে। একটু দূরে আলোকোজ্জ্বল হাওড়া ব্রিজ অলৌকিক ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিছন দিকে ঘুরলে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় হুগলি সেতু। কিন্তু সেটির মধ্যে স্থাপত্য বেশি, মায়া কম। ঢেউয়ের মাথায় প্রতিফলিত হয়ে অর্বুদ টুকরোয় ভেঙে যাচ্ছে হাওড়া ব্রিজের লাল নীল হলুদ সবুজ আলো। ভাঙছে, জুড়ছে, আবার নতুন প্যাটার্ন তৈরি করছে। দেখে দেখে আশ যেন মেটে না।
দরিয়া জলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিহান তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, “চলো। হাওড়া এসে গেছে। নামতে হবে।”
ঘোর কাটিয়ে জল থেকে ডাঙার দিকে এগোল দরিয়া।
হাওড়া স্টেশনের পুরনো কমপ্লেক্সের সামনে দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। দরিয়া ট্রেন ধরে লিলুয়া যাবে। বিহান হাঁটাপথে হাওড়া ময়দান। গঙ্গার ধারের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধোঁয়া ছেড়ে, দরিয়ার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বিহান বলল, “কাল কখন দেখা হবে?”
শিউরে উঠে বিহানের হাত সরিয়ে দরিয়া বলল, “সিগারেট খাওয়া বন্ধ করো তো! মুখ দিয়ে বিচ্ছিরি গন্ধ বেরচ্ছে!”
বিহানকে এবার পায় কে! সে দরিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা পেরলেই রেল মিউজিয়ামে যাওয়ার রাস্তা। জনহীন। ফাঁকা। কম আলো।
“কোথায় যাচ্ছি?” জানতে চাইল দরিয়া। উত্তর না দিয়ে হকারের কাছ থেকে মিন্ট লজেন্স কিনে মুখে পুরেছে বিহান। শিউরে উঠে মুখে হাত চাপা দিয়ে দরিয়া বলছে, “অসভ্য কোথাকার! আমি কিছুতেই তোমার সঙ্গে ওই অন্ধকারে যাব না।”
বিহান উত্তর দিল না। দরিয়া বলল, “তুমি প্রমিস করো যে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবে। তা হলে আমি তোমার সঙ্গে ওদিকে যাব।”
বিহান দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রেলের বিরাট ডাকবাক্স। সিলিন্ডারের মতো গড়ন। মাথাটা গোল। গায়ে লাল রং। তার উপরে কালো ডোরাকাটা। ঠোঁট থেকে সিগারেটের শেষ প্রান্তটা নিয়ে চিঠি ফেলার খোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে বিহান বলল, “ধূমপানের বিরুদ্ধে খোলা চিঠি লিখলাম। প্রমিস! আর কোনও দিনও সিগারেট খাব না।”
বিহানের কাণ্ড দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে দরিয়া। দৌড় লাগিয়েছে রেল মিউজিয়ামের দিকে। অন্ধকার রাস্তায় তাকে চেপে ধরল বিহান। কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাল।
দরিয়া আর বিহান হাঁটতে হাঁটতে পুরনো কমপ্লেক্সের দিকে ফেরত আসছে। দরিয়া বিহানকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এর আগে তুমি কখনও…”
“কিস-কিন্ধা কাণ্ড ঘটিয়েছি কি না? এটাই জানতে চাইছ? উত্তর হল, না। তুমিই প্রথম এবং তুমিই শেষ। তুমি না থাকলে চুমুহীন জীবন কাটিয়ে দেব।”
দরিয়া স্টেশনের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার আগে বিহানের হাতে হাত রেখে বলল, “একটা সত্যি কথা বলব?”
“বলো।”
“সরস্বতী পুজোর দিন তোমার সঙ্গে দেখা না হলেও তোমাকে আমি মিস করতাম।” বিহানের হাত ছেড়ে দিয়ে স্টেশনে ঢুকে যাচ্ছে দরিয়া।
* * *
সেইসব ছেলেমানুষি ভরা দিনের কথা ভেবে দরিয়ার ঠোঁটে পাতলা একটা হাসি ফুটে উঠেছিল। ভীষণ জোরে চারবার শব্দ হওয়ায় হাসি মিলিয়ে গেল। মন্টু তার ট্রলি ঠেলে ইমার্জেন্সি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে অন্য একটা বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছে। আওয়াজটা এত জোরে হল যে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দরিয়া কানে হাত চাপা দিয়ে বলল, “কী হল মন্টুদা?”
খোলা আকাশের নীচে ট্রলি ফেলে রেখে মন্টু হাসপাতালের গেটের দিকে দৌড় দিল। দরিয়া দেখল, সে গাছতলায় ট্রলিতে শুয়ে রয়েছে। আশেপাশে জনপ্রাণী নেই। এবার কী হবে?
ভয়ের চোটে দরিয়ার বুক ধড়ফড় করছে। মন্টুদা গেল কোথায়? সাম্যব্রতই বা কোথায়? সে কি ট্রলি থেকে নেমে যাবে? না এখানেই শুয়ে থাকবে? লোকগুলো তো এদিকেই আসছে!
হঠাৎই তার ট্রলি চলতে শুরু করেছে। দরিয়া দেখল, মন্টু ফিরে এসেছে। সে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে দৌড়চ্ছে অন্য একটা বাড়ির দিকে। একই সঙ্গে চিৎকার করে বলছে, “হাওড়া কোর্টের সামনে বোম পড়েছে। আজ ব্যাপক বাওয়াল হবে।”
যারা চিৎকার করছিল তারা ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের দিকে চলে গিয়েছে। ট্রলি ঢুকেছে সার্জারি বিল্ডিংয়ে। এদিকটা এখনও শান্ত। পরিষ্কার ওয়ার্ডে ঢুকে মন্টু সিস্টারকে বলল, “মা জননীকে ভরতি করে আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। ওদিকে ক্যাচাল শুরু হয়ে গেছে।”
এই ওয়ার্ডের সিস্টার এক পলক দরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ডক্টর ব্যানার্জি ওয়ার্ডেই আছেন। উনি পেশেন্টকে ওটি-তে নিয়ে গিয়ে পায়ের উন্ড দেখবেন।”
দরিয়ার মাথা এতক্ষণে ঠান্ডা হয়েছে। সে ভাবল, যাক বাবা! মসৃণভাবে কাজ হচ্ছে। ডাক্তার ব্যানার্জি লোকটা ভাল হলেই ভাল।
মন্টু দরিয়াকে একটা বেডে শুইয়ে দিল। স্যালাইনের পাউচ ঝুলিয়ে দিল স্ট্যান্ডে। ওটা এতক্ষণ কোলের ছেলের মতো ট্রলিতে দরিয়ার পাশে শুয়ে ছিল। একই সঙ্গে দরিয়া দেখল, সাম্যব্রতকেও সার্জারি ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।
ডক্টর ব্যানার্জি এলেন মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। লম্বা, ফরসা, রোগা। ইনি হলেন সেই রকম ডাক্তার, যাঁকে দেখলেই রোগীর অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যায়। গা দিয়ে সুন্দর গন্ধ বেরচ্ছে। ডক্টর ব্যানার্জি দরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “একসঙ্গে কতগুলো প্রবলেম বাঁধিয়েছিস? পেটে বাচ্চা, পায়ে বোমা! তোকে তো ‘পেশেন্ট অফ দি ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত!”
দরিয়া ফিক করে হাসল। বলল, “আপনি আমাকে ভাল করে দিন।”
“সিস্টার! মেয়েটাকে ওটি-তে পাঠান।” টর্চ জ্বেলে দরিয়ার চোখ দেখছেন ডক্টর ব্যানার্জি, “এর কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে মেটারনিটি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেব। এখানে একটু পর থেকেই বোমা খাওয়া পেশেন্টদের ভিড় শুরু হবে।”
সিস্টার দরিয়াকে ওটি-তে পাঠানোর আগে বলল, “বাবার সঙ্গে কথা বলবে?”
দরিয়া ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ।”
সাম্যব্রত মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। গত কয়েক ঘণ্টায় তাঁর চোখের কোল বসে গিয়েছে। মুখ শুকনো। জোর করে হাসলেন তিনি। সাম্যব্রতকে দেখে খারাপ লাগল দরিয়ার। সে বলল, “চিন্তা কোরো না। আমি একটু বাদেই চলে আসব।”
মন্টু ট্রলি ঠেলে দরিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিল।
সাম্যব্রত অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। দরিয়াকে ভিতরে নিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। এত সময় লাগছে কেন কে জানে! এর মধ্যে বোমায় আহত মেয়েরা এই ওয়ার্ডে ভরতি হয়েছে। ছেলেদের পাঠানো হয়েছে পাশের ওয়ার্ডে। পুলিশ আর মিডিয়া; কিশলয় পার্টি, খরাজ পার্টি আর গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতা-নেত্রী, লোকাল গুন্ডায় হাসপাতাল সরগরম। আগের সেই শান্তির পরিবেশ আর নেই। সাম্যব্রত বাধ্য হয়ে তিনবার বাইরে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে এলেন। দু’বার ইনহেলার নিলেন। হাওড়া কোর্টের লাগোয়া পাইস হোটেল থেকে এক থালা ভাত-ডাল-সবজিও খেয়ে নিলেন। আবার কখন খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে কে জানে! এক পিস মাছ বা একটা ডিম নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। নিলেন না। এখন প্রতিটি পাইপয়সা হিসেব করে খরচ করতে হবে।
সাড়ে তিনটের সময় সাম্যব্রত দেখলেন, ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারের সবুজ পোশাক পরে বিল্ডিং-এর বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন। সাম্যব্রত টুকটুক করে হেঁটে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
ডক্টর ব্যানার্জি সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “পেশেন্টের লেবার পেন অ্যাসেস করার জন্য গাইনিকলজিস্ট ডলি সেনকে কলবুক দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছি। উনি চলে আসবেন। সেই ফাঁকে বলি, আপনাকে দুটো খবর দেওয়ার আছে। একটা ভাল আর একটা খারাপ খবর। কোনটা আগে শুনবেন?”
“ভালটাই আগে শুনি,” বললেন সাম্যব্রত।
সিগারেটে টান দিয়ে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, “আপনার মেয়ের পায়ে একটা পেরেক ঢুকেছিল। সেটা বার করে ক্ষতস্থান সেলাই করে দিয়েছি। এখন ওই জায়গাটা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।”
“খারাপ খবরটা?” ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলেন সাম্যব্রত।
“পায়ের ইনজুরি থেকে অনেকটা ব্লিডিং হয়েছে। হেমারেজিক শক থেকেই বোধহয়, আপনার মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।”
সাম্যব্রত ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মেয়েটা বাঁচবে তো?”
গম্ভীর মুখে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, “সেটা বলার সময় এখনও আসেনি।”