শেষ নাহি যে – ৮

ট্রেনের হাতল ফসকে যাওয়ার ফলে গতিজাড্যের কারণে বিহান ছিটকে গিয়েছে। প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়ে আসছে। চলন্ত ট্রেন তাকে টানছে, যেভাবে লোহাকে কাছে টানে চুম্বক। বিহান এইবার খোয়ায় মাথা ঠুকে জ্ঞান হারাবে। অথবা ধাতব চাকার তলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এলোমেলো পা ফেলে সে ছুটছে…

হঠাৎ সবল দুটো হাত তাকে ধরে এক ঝটকায় ট্রেনে তুলে নিল।

ট্রেনের মেঝেতে বসে হাঁপাচ্ছে বিহান। চোখ বুজে রয়েছে বলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অতটা দৌড়নোর ফলে ফুসফুসে একফোঁটা বাতাস নেই। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কবাডি খেলোয়াড়রা যেভাবে বিপক্ষ দলের এলাকায় ঢুকে একে-তাকে ছুঁয়ে আবার নিজের কোর্টে ফিরে আসে, সেইভাবেই মৃত্যুর কোর্টে গিয়ে যমরাজকে ছুঁয়ে আবার জীবনের কোর্টে ফিরে এসেছে বিহান। তার ফুসফুস এখন বাতাস চাইছে, বাতাস।

এক যাত্রী বললেন, “সুদাম না থাকলে তুমি এতক্ষণে পটলডাঙার টিকিট কেটে ফেলতে।”

অন্য যাত্রী বললেন, “শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলে সুদামকে একটা পেন্নাম কোরো। ওর জন্যই তুমি আজ বেঁচে গেলে।”

বিহান এবার চোখ খুলল। ট্রেন যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। কামরায় অনেক যাত্রী। বিহান আন্দাজ করল, এঁরা কলকাতার বাসিন্দা। চাকরির কারণে পোর্ট এলাকায় থাকেন। গন্ডগোলের আঁচ পেয়ে বাড়ি ফিরছেন।

প্রথম যাত্রী স্মার্টফোনে নিউজ় চ্যানেল দেখতে দেখতে বললেন, “শিলিগুড়ি আর উত্তর দিনাজপুরে গন্ডগোল শুরু হয়েছে। সরকারি বাস জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুবীরদা, এবার আপনার দলের ছেলেরা মার খাবে।”

দ্বিতীয় যাত্রী, যাঁর নাম সুবীর, বললেন, “আমিও মোবাইলে নিউজ় চ্যানেল দেখছি কিশোর। চ্যানেল বলছে, পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ডে মাইন বিস্ফোরণ। ওখানে তো গণতান্ত্রিক মোর্চার দাদাগিরি।”

প্রথম যাত্রী কিশোর বললেন, “ওরকম বলবেন না সুবীরদা। মানসী বসুকে আপনার দল খরাজ পার্টির লোক মেরে দিল। সেটা অন্যায় নয়?”

সুবীর বললেন, “শোনো কিশোর, আমরা সবাই জানি যে তুমি পোর্টে কিশলয় পার্টি করো আর পাড়ায় গণতান্ত্রিক মোর্চা। গিরগিটিও তোমার কাছে লজ্জা পাবে।”

সুবীর আর কিশোরের মধ্যে জোর তরজা শুরু হয়ে গেছে। কামরার বাকি যাত্রীরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে ভার্বাল ডুয়েল চালাচ্ছে। সেসবে কান না দিয়ে, মাথা তুলে বিহান বলল, “সুদামদা, একটু জল খাওয়াবে?”

সুদাম মেঝেতে বসে ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। নিজের নাম শুনে বিহানের দিকে তাকাল। জলের বোতল এগিয়ে বলল, “আমাকে চেনো?”

সুদামের পরনে ঢোলা সাদা পায়জামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। গলায় উড়নি জড়ানো। মাথার চুল কাঁধ ছাপিয়েছে। গলায় আর হাতে নানারকমের মালা আর হার। একপায়ে ঘুঙুর পরা। হাতে একতারা। অজস্র কাপড়ের টুকরো সেলাই করে বানানো ঝোলা কাঁধে। সুদামকে দেখে ট্রেনে-গান-গাওয়া-ভিখারি বলে মনে হচ্ছে না।

ঢকঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে তেষ্টা মিটেছে বিহানের। সুদামকে বোতল ফেরত দিয়ে, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, “মিনুদির রিকশা চেপে স্টেশন পর্যন্ত এলাম। মিনুদিই বলল, তুমি এই ট্রেনের প্রথম কামরায় থাকো।”

ঘাড় ঘুরিয়ে একমাত্র ভাল চোখটি দিয়ে বিহানকে দেখল সুদাম। বলল, “তোমাকে চিনতে পারলাম না!”

“না চেনারই কথা,” মৃদু হাসল বিহান, “তুমি একবার একটা দরকারে আমার বাড়ি এসেছিলে। আমি তোমার আধার কার্ডের গন্ডগোল ঠিক করে দিয়েছিলাম।”

এক চোখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। মুখময় ফুটে উঠল হাসি। সুদাম বলল, “হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে। তুমি পোর্টে চাকরি করো। নামটা ভুলে গেছি।”

“আমার নাম বিহান। তুমি এই গন্ডগোলের দিনে হাওড়া যাচ্ছ কেন? যদি ফিরতে না পারো?”

“আমি যখন বাড়ি থেকে বার হয়েছিলাম, তখন সব শান্ত ছিল। বেরনোর পরে গন্ডগোল শুরু হয়েছে। ওই নিয়ে চিন্তা কোরো না। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি গন্ডগোল চলতে থাকে, তা হলে রাতটা হাওড়া স্টেশনে কাটিয়ে দেব।”

“দেখা যাক।” চিন্তিত মুখে বলল বিহান।

বিহানের কথা শেষ হতে না হতেই সুবীর বললেন, “এই যে! লেনিন সরণির ভিডিয়ো দেখো। রাজপথে প্রকাশ্যে মারামারি এবং লুঠতরাজ শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক মোর্চার মারমুখী কর্মীদের সামলাতে পারছে না পুলিশ।”

কিশোরও কম যান না। নিজের স্মার্টফোন বাড়িয়ে বললেন, “শ্যামবাজারে বাস পুড়িয়ে দিয়েছে খরাজ পার্টির ক্যাডাররা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা শহরে অঘোষিত বন্‌ধ।”

সুবীর মোবাইল উঁচিয়ে বললেন, “খরাজ পার্টির একাধিক কর্মী খুন হয়েছেন।”

কিশোরও মোবাইল উঁচিয়ে বললেন, “আমাদের পার্টির ছেলেদের কারা মারছে? আপনারা! সরকার মিলিটারি নামানোর কথা চিন্তা করছে।”

কামরার যাত্রীরা আবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে ঝগড়া শুরু করেছে। চিৎকারে কান পাতা দায়। তারই মধ্যে বিহান শুনতে পেল, তার মোবাইল বাজছে।

মিনুর রিকশায় বসেই সে ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে রেখেছিল। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বার করল বিহান। কে ফোন করেছে? শ্বশুরমশাই? না মা?

দু’জনের কেউ নয়। ফোন করেছে সনৎ। মোবাইল কানে দিয়ে বিহান বলল, “বল।”

“কোথায়?” আয়েশি গলায় জিজ্ঞেস করছে সনৎ। তার কথার মধ্যে হাওয়ার শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে।

“ট্রেনে,” উত্তর দিল বিহান, “তুই কোথায়? বাইকে চেপেছিস না কি? এত হাওয়া দিচ্ছে কেন?”

বিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সনৎ পাল্টা প্রশ্ন করল, “ট্রেন এখন কোথায়? লাইনে কোনও গন্ডগোল আছে নাকি?”

“এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে,” সামান্য থেমে বিহান বলল, “তুই কোথায় বললি না তো?”

“সেটা জেনে তোর কী লাভ?” খিঁচিয়ে উঠল সনৎ।

বিহান ম্লান হেসে বলল, “কালকেই বকুলতলা চলে আসব। ডেটা এন্ট্রির পেন্ডিং কাজ সোমবারের মধ্যে তুলে দেব। প্রমিস।”

“আমাকে প্রমিস করে কী লাভ? আমি তোকে চাকরি দিয়েছি নাকি?”

“হ্যাঁ। তুই-ই আমায় চাকরি দিয়েছিস। তুই প্লিজ় দেখ, চাকরিটা যেন থাকে। না হলে বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব!”

বিহানের আকুতি সনতের কানে ঢুকল কি না কে জানে! সে ফোন কেটে দিয়েছে। মোবাইল ফোনটা ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে ঢুকিয়ে বিহান সুদামের দিকে তাকাল। সুদাম এতক্ষণ ফোনালাপ শুনছিল। কিন্তু সে বিহানকে একটাও কথা জিজ্ঞেস করল না। বাইরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।

গানের সুর বিহানের চেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীত। লাইনগুলো মনে পড়ছে না। দীনবন্ধু ইনস্টিটিউশনে নবীনবরণ উৎসবের দিন গানটা গাওয়া হয়েছিল। বিহান অল্পসময়ের জন্য অনুষ্ঠানে ছিল। শুরু হওয়ার একটু পরেই সুযোগ বুঝে টুক করে কলেজ কাটে।

* * *

হাওড়া গার্লস কলেজটা হাওড়া ময়দান ফ্লাইওভারের নীচে। সোম আর মঙ্গলবার মঙ্গলাহাটের কারণে মানুষ আর মালপত্রে পুরো এলাকাটা নরক হয়ে থাকে। তখন রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো অবশ্য পরিষ্কার-পরিছন্ন।

মেয়েদের কলেজ বলেই বোধহয় ডিসিপ্লিন বেশি। দরিয়াদের ইতিমধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। দরিয়া এমন ভাব করে, যেন একটা ক্লাস কাটলে পরীক্ষায় ফেল করে যাবে! সেই তুলনায় মণিদীপা ডাকাবুকো। সে-ই দরিয়াকে ফুসলে কলেজ থেকে বার করেছে। বিহানের সঙ্গে দু’জনে চলে এসেছে হাওড়া স্টেশনে। ফেরি সার্ভিস ধরতে। হাওড়া থেকে লঞ্চে করে ফেয়ারলি প্লেসে যাওয়া হবে। গঙ্গার ওপারে পৌঁছে, ইচ্ছে হলে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করা হবে। ইচ্ছে না হলে ফিরতি লঞ্চের টিকিট কেটে হাওড়া ফিরে আসা। পরিচিত মুখের সঙ্গে লঞ্চে দেখা হয়ে গেলে মণিদীপা ভরসা। তিনজন কলেজের ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। কেউ সন্দেহ করবে না।

সেটা ছিল হেমন্তকাল। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। গঙ্গায় একটু আগে জোয়ার এসেছে। অফিসযাত্রীদের ভিড় নেই। এখন লঞ্চে যাত্রী হাতে গোনা। লঞ্চের ডেকে উঠে দরিয়া বিহানকে জিজ্ঞেস করল, “যারা লঞ্চ চালায়, তাদের কী বলা হয়?”

“পাইলট।” আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিল বিহান।

“ভ্যাট!” হাসিতে ফেটে পড়েছে মণিদীপা।

“ভ্যাট বললে কেন?” সিরিয়াস মুখে জিজ্ঞেস করল বিহান, “তুমি জানো? কী বলে?”

“যারা গাড়ি চালায় তাদের ড্রাইভার বা শফার বলে। যারা প্লেন চালায় তাদের পাইলট বলে। যারা জাহাজ চালায় তাদের সেলর বলে। যারা সাইকেল চালায় তাদের সাইক্লিস্ট বলে।”

“কুমোরপাড়ার গোরুর গাড়ি চালাত বংশীবদন। তাকে কী বলে?” মণিদীপাকে জিজ্ঞেস করল বিহান।

“অত জানি না বাবা! ” বিহান আর দরিয়াকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে মণিদীপা লঞ্চের সামনের দিকে চলে গেল।

চড়া রোদ উঠেছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ছোট ছোট ঢেউ খলবলিয়ে উঠে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। বিহান হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা মাখতে মাখতে বলল, “এইরকম ওয়েদারে শেয়াল-কুকুরের বিয়ে হয়।”

দরিয়া ওড়নায় মুখ লুকিয়ে কুলকুলিয়ে হাসছে। বিহান অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “স্যরি!”

“কী জন্য?”

“ওই কথাটা বললাম বলে।”

“কোন কথাটা?”

“ওই যে! শেয়াল কুকুরের…”

“আমি কিছু মনে করিনি। আমি জানি যে আমাকে খারাপ দেখতে।”

দরিয়ার কথা শুনে বিহান আকাশ থেকে পড়ল, “যাব্বাবা! সে-কথা আমি কখন বললাম?”

“তুমি যে কথাটা বলেছিলে সেটা আর একবার বলো।”

“আরে! ওই কথাটা তুমি সিরিয়াসলি নিলে নাকি? ওটা তো প্রবাদ! মানে কথার কথা! সব্বাই বলে তো! এর মাধ্যমে তোমাকে শেয়াল বা কুকুর— কিছুই বলা হচ্ছে না। মানে, ওগুলো কাউকেই বলা হচ্ছে না। এটা জাস্ট…”

বিহান তোতলাচ্ছে। এক কথা বলতে গিয়ে অন্য কথা বলে ফেলছে। একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা। এই সময়ে মরার উপরে খাঁড়ার ঘা দেওয়ার কায়দায় দরিয়া বলল, “তুমি তা হলে আমাকে বিয়ে করবে না?”

কিছু না বুঝেই বিহান বলল, “আমি সে-কথা কখন বললাম?” পরমুহূর্তে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “এর মধ্যে বিয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?”

দরিয়া নীচের ঠোঁট কামড়ে, ভুরু কুঁচকে সিরিয়াস গলায় বলল, “জানতাম।” তারপর লঞ্চচালকের কেবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে মণিদীপার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফেয়ারলি প্লেসের লঞ্চঘাট এসে গিয়েছে।

লঞ্চ থেকে নেমে দুই বান্ধবী পাশাপাশি হাঁটছে। বিহান একটু পিছনে। স্ট্র্যান্ড রোডে পড়ে মিলেনিয়াম পার্কের দিকে হাঁটা লাগাল দু’জনে। বিহান কী আর করে! রাস্তার কোণে বসে থাকা বুড়ির কাছ থেকে একটা সিগারেট কিনে আয়েশ করে ধরাল। বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস তার নেই। সনতের সঙ্গে থাকলে দু’-একটা খেতেই হয়। এখন খাচ্ছে রাগ করে।

মণিদীপা হঠাৎ বান্ধবীকে ছেড়ে পিছিয়ে এল। বিহানকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি দরিয়াকে কী বলেছ? ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না কেন?”

“আমি জানি না বস!” হাত তুলে দিয়েছে বিহান, “তোমরা, মেয়েরা, খুব জটিল জিনিস। তোমাদের বোঝার জন্য সরকারের তরফ থেকে টোল ফ্রি নম্বর রাখা উচিত। ওয়ান এইট জিরো জিরো…” মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন করার অভিনয় করে বিহান, “হ্যালো? স্যর? আমার বান্ধবী মুখ গোঁজ করে আছে। কী করব?”

“দুই টিপুন,” বলল মণিদীপা।

“কী বললে?” বিহানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে।

মণিদীপা বিহানের দিকে নিষ্পাপ দৃষ্টি বিছিয়ে বলল, “হিন্দিকে লিয়ে এক দাবাইয়ে, বাংলায় কথা বলার জন্য দুই টিপুন, ফর ইংলিশ ডায়াল থ্রি।”

“ও আচ্ছা!” হুশ-হুশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে বিহান।

“কেন? তুমি কী ভাবলে?” জানতে চাইছে মণিদীপা।

“কিছু না। কিছু না। নাথিং।”

“টোল ফ্রি নাম্বার ছাড়া সরকার বাহাদুর অন্য কোনওভাবে তোমাদের সাহায্য করতে পারে?”

“খবরের কাগজ আর টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া, সিনেমা শুরু হওয়ার আগে নিউজ়রিল দেখানো, স্কুল আর কলেজে সাবজেক্ট হিসেবে ‘মেয়েলজি’ ইনক্লুড করা, অনেক কিছু আছে। মিনিস্ট্রি অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইমেন খোলাটাও খুব জরুরি।”

বিহান আর মণিদীপা কথা বলতে বলতে হাঁটছে। সামনে দরিয়া। হঠাৎ সে পিছন ফিরে একগাল হেসে মণিদীপাকে বলল, “হ্যাঁ ভাই বকুলফুল! সেইটা কখন হবে মনে আচে?” দুই বান্ধবী যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে তখন পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় মেয়েরা যেভাবে কথা বলত, সেইভাবে বলে।

মণিদীপা স্মার্টলি বলল, “তা আবার মনে নেই কো! সেই আঁটকুড়োর বেটা তো গালে হাত দিয়ে বসে রয়েচে!”

“হায় ভকোপান! থালে কী করা উচিত? বল না লো সই!”

“ফিরে চল, বকুলফুল! ফিরে চল! বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালে সে যদি বিরক্ত হয়?”

দরিয়া এবার বিহানের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, “চলো গো প্রাণনাথ! আমরা এবার ফিরে যাই।”

“আমরা মানে কারা?” কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেছে বিহান, “আজকে ঘুরতে আসার কথা ছিল তোমার আর আমার। তোমার বন্ধু কেন এসেছে?”

“আমার কোনও দোষ নেই রাজাধিরাজ!” দু’হাত জোড় করেছে মণিদীপা, “বকুলফুল ডেকেচিল বলে এয়েচি। আমার ভুল হয়ে গেচে। আমি এই ঘাট মানলুম,” স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে শিবপুর ট্রামডিপোগামী মিনিবাস যাচ্ছে। সেটায় চড়ে উধাও হয়ে গেল মণিদীপা।

সেদিকে না তাকিয়ে রাস্তার কোণে বসে থাকা বুড়ির কাছ থেকে আর একটা সিগারেট কিনে ধরাল বিহান। দরিয়া বলল, “এবার কী হবে?”

“কার কী হবে? তোমার বান্ধবীর কথা বলছ?” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিহান বলল, “মণিদীপা হল গিয়ে আইএসআই ছাপযুক্ত, আগমার্কা চালু মাল। ওর কোনও বিপদ হবে না। আমার বরং মিনিবাসের প্যাসেঞ্জারদের জন্য চিন্তা হচ্ছে।”

“মণিদীপাকে নিয়ে তুমি আজেবাজে কথা বলবে না। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর তুমি সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দাও। ওসব খেলে ক্যানসার হয়।”

“পয়সা দিয়ে কিনলাম। একটু ধোঁয়া খেয়ে নিই।” মুচকি হাসল বিহান।

সেদিন দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে স্ট্র্যান্ড রোড পেরিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিল, তার হিসেব নেই। প্রথমবার কলেজ কাটা, প্রথমবার বন্ধুর সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, প্রথমবার কলকাতার রাস্তা থেকে নানারকমের খাবার খাওয়া— দিনটা ভোলার নয়। সন্ধে নেমে আসার মুখে দু’জনে মিলে দাঁড়িয়েছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটা চায়ের দোকানের সামনে। দুটো স্পেশ্যাল চা অর্ডার করে বিহান বলল, “বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। বাবা-মা’কে কী বলবে?”

“আমার কোনও চাপ নেই। সত্যি কথাই বলে দেব। তুমি কী বলবে?”

“কী বলব?” ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বিহান বলল, “সত্যি কথা মা’কে বলতে আমারও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সত্যি কথাটা কী, সেটাই তো আমি জানি না।”

দরিয়া বিহানের কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”

চায়ের ভাঁড় ডাস্টবিনে ফেলে, দুটো চায়ের দাম মিটিয়ে বিহান বলল, “সরস্বতী পুজোর দিন তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমাকে আমি ভালবাসি। মানে, ভালবাসা কাকে বলে আমি জানি না। তাও…”

দরিয়ার চা খাওয়া শেষ। দুটি ছেলেমেয়ে কলকাতা শহরের রাস্তা দিয়ে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় অফিস-ফেরতা মানুষের ঢল নেমেছে। তিলধারণের স্থান নেই। বাস, প্রাইভেট গাড়ি আর ট্যাক্সির উপদ্রবে রাস্তা পেরনো অসম্ভব ব্যাপার। দরিয়া সন্তর্পণে বিহানের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমার কাছ থেকে তুমি কী শুনতে চাও? আমি তোমাকে ভালবাসি কি না?”

বাসকে পাশ কাটিয়ে, ট্যাক্সিকে ডজ করে, পথচারীদের গুঁতো খেয়ে রাস্তা পেরল দু’জনে। বিহানের হাত ছাড়েনি দরিয়া। ওপারের ফুটপাথে উঠে বলল, “হ্যাঁ বিহান। আমি তোমাকে ভালবাসি। এই যে তোমাকে ছুঁয়ে আছি, এতেই আমি খুশি। এই যে তোমার চুলে হাত বোলাতে পারছি, এতেই আমি খুশি। এখন মরে গেলেও আমার আর কোনও দুঃখ থাকবে না। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কায়দা যদি জানতাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম। কিন্তু সেটা জানি না। তুমি ছাড়া নিজেকে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়।”

* * *

“অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ ভায়া?” জিজ্ঞেস করল সুদাম। চটকা ভেঙে বিহান দেখল, ট্রেন বাহারবেড়িয়া জংশনে দাঁড়িয়ে। এটা বেশ বড় স্টেশন। এখান থেকে হাওড়া পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়। বিহান বলল, “কী আর ভাবব? বউটার কথা ভাবছিলাম। কখন যে ওর কাছে পৌঁছতে পারব…”

“গিন্নিকে খুব ভালবাসা হয়?” ভাববাচ্যে জিজ্ঞেস করল সুদাম।

উত্তর না দিয়ে হাই তুলে বিহান বলল, “ক’টা বাজে গো?”

সুদাম বলল, “সাড়ে বারোটা। ট্রেন ঠিকঠাক চললে বাহারবেড়িয়া থেকে হাওড়া স্টেশন পাক্কা এক ঘণ্টা।”

“এখনও পর্যন্ত তো ঠিকই চলছে,” বলল বিহান। তার কথার মধ্যে কিশোর বললেন, “আর চলবে বলে মনে হয় না। খরাজ পার্টির লোকেরা আমাদের ধরে খুব পেটাচ্ছে। এবার আমাদের পাল্টা মার দিতেই হবে।”

সুবীর তাঁর থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, “ও লে বাবা লে! কী মিত্তি ছেলে সব। সারা রাজ্য জুড়ে লুঠতরাজ চালিয়ে এখন ভিকটিম কার্ড খেলা হচ্ছে।”

আবার ঝগড়া শুরু হয়ে গিয়েছে কিশোর আর সুবীরের মধ্যে। ট্রেনের যাত্রীরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে চেঁচাচ্ছে। তার মধ্যে বেজে উঠেছে বিহানের ফোন। তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বার করে সে দেখল সাম্যব্রত ফোন করেছেন।

কানে ফোন দিয়ে বিহান বলল, “হ্যালো!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *