শেষ নাহি যে – ৭

রাজু আর সাম্যব্রত মিলে একটা নড়বড়ে ট্রলি নিয়ে এসেছে। ট্রলিটা দেখে ঘেন্না করছে দরিয়ার। তারা গরিব হতে পারে, কিন্তু বাড়িতে পরিষ্কার বিছানায় শোয়। পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। এই ট্রলিটা ভীষণ নোংরা। এক পাশে কালচে লাল দাগ লেগে রয়েছে। বোধহয় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। এই ট্রলিতে দরিয়াকে শুতে হবে? সাম্যব্রতর দিকে করুণ মুখে তাকাল সে।

সাম্যব্রত অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “কিছু করার নেই রে মা! চোট না লাগলে পাড়ার নার্সিং হোমেই সব হয়ে যেত।”

ঠিক কথা। এখন আর এইসব ভেবে লাভ নেই। দরিয়া কোনওরকমে নিজেকে হিঁচড়ে ট্রলিতে ওঠাল। রাজু অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে পার্কিং লটের দিকে চলে গেল।

ট্রলিতে শুয়ে দরিয়া দেখল, মোটা আর বেঁটে একটা লোক কুতকুতে চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার বয়স বছর পঞ্চান্ন। মাথার চুল ধবধবে সাদা। কামানো গাল। পরনে ফতুয়া আর পাজামা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। কপালে তিলক কাটা। ট্রলির হ্যান্ডেলে হাত রেখে লোকটা বলল, “মা জননীর কপাল খারাপ। ভুল দিনে ব্যথা উঠেছে।”

“আপনি কে?” জিজ্ঞেস করল দরিয়া।

“আমার নাম মন্টু হাইত,” হাত জড়ো করেছে লোকটা, “এই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। বয় আর গার্লের ঠাকুরদা হয়ে গেছি, কিন্তু উপাধিটা রয়ে গেছে।”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মন্টুদা!” বলল দরিয়া।

“আরও কষ্ট বাকি আছে রে মা!” স্নেহমেশানো গলায় বলে মন্টু, “আমাদের হাসপাতালে মেটারনিটি ওয়ার্ডের কোনও বেড খালি নেই। তোকে মেঝেয় অ্যাডমিশন নিতে হবে।”

“মেঝে?” চমকে উঠে সাম্যব্রতর হাত চেপে ধরে দরিয়া।

“এখন নিয়ম হয়েছে, কোনও পেশেন্ট ফেরানো যাবে না। সবাইকে ভরতি করতে হবে। একটা বেডে তিনজন মা শোওয়ার পরেও পোয়াতির লাইন কমছে না। তখন মেঝেই ভরসা।” ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে একটা বিল্ডিং-এ ঢুকেছে মন্টু।

দরিয়া সাম্যব্রতর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো! প্লিজ় বাবা!”

সাম্যব্রত বললেন, “এখানে পেয়িং বেডের ব্যবস্থা নেই?”

“সেগুলোও ভরতি,” দাঁড়িয়ে পড়েছে মন্টু। সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বলছে, “আপনারা বড় ফেমিলির মানুষ। খরচ করতে পিছপা হবেন না। বিপদে পড়েছেন বলে বঙ্গবাসী হাসপাতালে এসেছেন। তা না হলে মা জননীর বাচ্চার নার্সিং হোমে জন্মানোর কথা।”

সাম্যব্রত এতক্ষণে বুঝতে পারলেন। সৌম্যদর্শন মানুষটি ঘুষ চাইছে। ইংরিজিতে যাকে বলে ব্রাইব বা স্পিড মানি, হিন্দিতে রিশ্‌ওয়াত, সংস্কৃতে উৎকোচ। সাম্যব্রত জীবনে কখনও ঘুষ নেননি। মহাকরণে চাকরির সময়ে অনেক সুযোগ এসেছিল। তিনি ঘুষ নেন না বলে ডিপার্টমেন্টের বাকিদের অসুবিধে হত। কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। ঘুষ দেওয়ার কথাও সাম্যব্রত ভাবতেও পারেন না। একটা আস্ত জীবন এইভাবে কাটিয়ে আজ তিনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন, যখন তাঁকে ঘুষ দিতে হবে। না দিয়ে উপায় নেই। এতে তিনি আদর্শচ্যুত হচ্ছেন কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এটা নয়। মুশকিল অন্য জায়গায়। ঘুষ কীভাবে অফার করতে হয়, এটা তিনি জানেন না।

সাম্যব্রত নিজের মতো করে কথা সাজিয়ে নিলেন। বললেন, “আপনি তো সবই জানেন। আমার টাকা খরচ করার সামর্থ্য আছে। তা-ও এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। আপনি একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিন। যা লাগে দিয়ে দেব স্যর!” ওয়ার্ড বয়কে তিনি সচেতনভাবে ‘স্যর’ বলেছেন। ইগোতে একটু মালিশ করা আর কী!

“আমার হাতে সেই ক্ষমতা নেই দাদা,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল মন্টু, “আমি বড়জোর ডাক্তারবাবু বা ওয়ার্ড মাস্টারকে অনুরোধ করে দেখতে পারি। ওঁদের আবার খাঁই অনেক।”

“কত স্যর?” ভয়ে ভয়ে বললেন সাম্যব্রত। তাঁর কাছে যা টাকা আছে, তাই দিয়ে খাঁই মিটবে তো!

“ডাক্তারবাবু তিন নেবেন। মাস্টারমশাই নেবেন দুই। আমি এক। পারলে বলুন। না হলে মেঝের ব্যবস্থা দেখি,” স্ত্রীরোগ বিভাগের ইমার্জেন্সিতে ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত পেতেছে মন্টু।

“কোনও অসুবিধে নেই স্যর। আপনার ভরসাতেই তো এখানে আসা।” পকেট হাতড়ে তিনটে দু’হাজার টাকার নোট বার করে মন্টুর হাতে গুঁজে দিয়েছেন সাম্যব্রত।

ইমার্জেন্সি রুমে ডাক্তারের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন মাঝবয়সি এক চিকিৎসক। রোগা, বেঁটে, রাজ্যের বিরক্তি মুখে জমা হয়েছে। একভাঁড় চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “সিস্টার, ‘আরোগ্য নিকেতন’ পড়েছেন?”

কর্তব্যরত সিস্টার বললেন, “ডক্টর ঘোষ, বইটা নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা না?”

দরিয়া হেসে ফেলেছে। সে খুব একটা গল্প-উপন্যাস পড়ে না। কিন্তু ‘আরোগ্য নিকেতন’ যে নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা নয়, এটা তার জানা। ডক্টর ঘোষ আড়চোখে দরিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হাসছ কেন? এটা কি নাট্যশালা?”

সৌভাগ্যবশত এই লাইনটাও দরিয়ার জানা। সে আবারও হেসে ফেলল। ডক্টর ঘোষের মুখ থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিরক্তির মুখোশটা সরে গেল।

তিনি বললেন, “কে বলেছিল?”

“প্রসন্ন গুরুমশাই,” ফিক করে হাসল দরিয়া।

“আর ‘আরোগ্য নিকেতন’?”

“তারাশঙ্করের লেখা।”

উত্তরে ডক্টর ঘোষ খুশি হয়ে দরিয়াকে নিয়ে এগজামিনেশন রুমে চলে গেলেন।

সাম্যব্রত সেই সময়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রোগীর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর… এইসব তথ্য জুগিয়ে বেড হেড টিকিট বা বিএইচটি রেডি করছিলেন। সাম্যব্রত বললেন, “পেশেন্টের পায়ে ও হাতে চোট লেগেছে।”

প্রিন্টার থেকে ফড়ফড় করে টিকিট বেরচ্ছে। সেগুলো টেনে নিয়ে স্টেপলার দিয়ে আটকে ছেলেটি বলল, “কী করে লাগল?”

“পায়ে বোমার টুকরো লেগেছে। হাতে লাঠির আঘাত,” বললেন সাম্যব্রত।

ছেলেটা অবাক হয়ে সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, “লেবার পেশেন্টের মারামারি কেস? জীবনে শুনিনি!” তারপর টিকিটের কোণে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ধপাস করে একটা ছাপ্পা দিল। টিকিট হাতে নিয়ে সাম্যব্রত দেখলেন, ছাপ্পায় লেখা রয়েছে, ‘পুলিশ কেস’। দরিয়াকে পরীক্ষা করে ডক্টর ঘোষ এগজামিনেশন রুম থেকে ফেরত এসেছেন। সাম্যব্রত টিকিট তুলে দিলেন ডক্টর ঘোষের হাতে।

টিকিট দেখে ডাক্তার ঘোষের মুখচোখ বদলে গিয়েছে। খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “পুলিশ কেসের স্ট্যাম্প মারা কেন?”

“ফিজ়িকাল অ্যাসল্ট হয়েছে স্যর,” বিনীতভাবে বললেন সাম্যব্রত। “মেয়েকে নিয়ে নার্সিং হোমে যাব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, এমন সময়ে বোমাবাজি হয়েছে। পায়ে বোমার টুকরো লেগেছে। হাতে লাঠির আঘাত।”

ডক্টর ঘোষ নিদানপত্র লিখছেন। সাম্যব্রত চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যে ডাক্তার হাসপাতালের বেড বিক্রি করে কাটমানি নেন, তিনিই আবার বিভূতিভূষণ আর তারাশঙ্কর পড়েন। কী বিচিত্র জীবন!

নিদানপত্র লেখা শেষ করে ড্রয়ার থেকে মোটকা প্যাড বার করে ডক্টর ঘোষ বললেন, “ইনজুরি রিপোর্ট লেখা মানেই অশান্তি। কয়েকদিন বাদে কোর্ট থেকে সমন আসবে সাক্ষী দিতে যাওয়ার জন্য।” তারপর দরিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কে মেরেছে? কী দিয়ে মেরেছে? কোথায় মেরেছে? যা জিজ্ঞেস করছি, তার স্পেসিফিক উত্তর দেবে। একটাও বেশি কথা বলবে না।”

দরিয়া ঘাবড়ে গিয়ে সাম্যব্রতর দিকে তাকাল। সে তো জানেই না কে তাকে মেরেছে! সাম্যব্রত ইশারায় দরিয়াকে চুপ থাকতে বললেন। নিজে বললেন, “কে মেরেছে দেখতে পাইনি।”

ইনজুরি রিপোর্ট লেখা শেষ করে ডক্টর ঘোষ বললেন, “পায়ের চোটটা দেখাও।”

দরিয়া শাড়ি সরিয়ে পায়ের চোট দেখাল। পুঁচকে একটা টর্চ জ্বেলে দরিয়ার চোখে আলো ফেললেন। কী দেখলেন কে জানে! মুহূর্তের মধ্যে তাঁর শরীরের ভাষা বদলে গেল। দরিয়ার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “খিঁচুনি হয়েছিল?”

“না।”

“বমি করেছিলে নাকি?”

“না। তবে কিছুক্ষণ আগে থেকে গা গুলোচ্ছে,” বলল দরিয়া। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিকট জোরে ওয়াক তুলল।

ডক্টর ঘোষ মন্টুকে বললেন, “তাড়াতাড়ি একে লেবার রুমে নিয়ে যাও। ওখানে গাইনির ডাক্তার দেখে ডিসিশন নেবে। আমাকে অন্য পেশেন্ট দেখতে দাও।”

সিস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে মন্টু দরিয়াকে দেখছিল। ডক্টর ঘোষের কথা শুনে বলল, “ইয়েস স্যর।” তারপর ট্রলি ঠেলতে লাগল। দরিয়া শুয়ে শুয়ে দেখল, সিস্টার সাম্যব্রতকে বলছে, “আপনি ইমার্জেন্সির বাইরে অপেক্ষা করুন। দরকার হলে আমরা ডেকে নেব।”

ট্রলিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় ঘাড় উঁচু করে দরিয়া দেখল, সাম্যব্রত চাতক পাখির মতো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটা সুইং ডোর হঠাৎ দু’দিকে খুলে গিয়ে ট্রলি সমেত দরিয়াকে গপ করে গিলে দু’পাটি চোয়াল বন্ধ করে দিল।

বিশাল বড় করিডর দিয়ে ট্রলি চলেছে ঘড়ঘড় করে। দরিয়া ভাবছে, বিহান কতদূর এল কে জানে! তার মনে পড়ে যাচ্ছে বিহানের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটার কথা…

* * *

সরল সাদাসিধে ছেলেটাকে এক পলক দেখেই ভাল লেগেছিল। ওইরকম ভাললাগা অনেককে দেখে তৈরি হয়। মেসি আছেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আছেন। উত্তমকুমারকেও ভাল লাগে! ওই নিয়ে মাথা ঘামায়নি দরিয়া।

ঝামেলা পাকিয়েছিল মণিদীপা। ছোট্টবেলা থেকে বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে মেয়েটা খুব পাকা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে অঙ্ক খাতায় ছবি এঁকে বুঝিয়েছিল, কী করে বাচ্চা হয়। কী অসভ্য! ইস!

মণিদীপাই দরিয়াকে বলেছিল, “অ্যাই! তোর চোখমুখ অন্যরকম লাগছে কেন রে?”

“কীরকম আবার লাগবে?” ফুল বিলোতে বিলোতে বলেছিল দরিয়া।

“ওই বিহানটা ছেলেটার সঙ্গে ইশারায় কী সব কথা হল দেখলাম! কী ব্যাপার?” কনুই দিয়ে দরিয়ার কোমরে ধাক্কা মেরে মণিদীপা গেয়ে উঠল, “চোখে চোখে কথা বলো, মুখে কিছু বলো না, হায় রে!” ‘হায় রে’ বলার সময়ে ফিল্‌মি কায়দায় ডানহাতের মণিবন্ধ দিয়ে কপালে ধাক্কা মারল।

“তুই চুপ কর,” লজ্জায় লাল হয়ে দরিয়া বলেছিল, “বিদ্যার আরাধনার দিনও তোর অসভ্যতা গেল না।”

অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে বিহানের দিকে তাকানোর ফুরসত পায়নি দরিয়া। পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যখন তপন স্যরের বউয়ের সঙ্গে বসে সবার জন্যে ভোগের প্রসাদ ভাগ করছে, তখন মণিদীপা উড়তে উড়তে এসে দরিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল, “ছোকরা এখনও লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। ওকে বলে দিই যে আজ সন্ধেবেলা শরৎ সদনে ফাংশন দেখতে যাচ্ছি।”

“কী ফাংশন?” আকাশ থেকে পড়েছিল দরিয়া।

“আমি কী করে জানব?” মুখ বেঁকিয়ে চলে গিয়েছিল মণিদীপা।

অঞ্জলি দিয়ে সনৎ চলে গিয়েছিল। ভোগ খাওয়ার জন্য রয়ে গিয়েছিল বিহান। ভোগ খাওয়াটা অছিলা। আসলে সে দরিয়ার জন্য ফিল্ডিং কাটছিল। মণিদীপা তার কাছে গিয়ে বলল, “আজ বিকেল চারটের সময়ে শরৎ সদনে ফাংশন আছে। আমি যাচ্ছি!”

“দরিয়া আসবে না?” উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে বিহান।

“হাঁদা গঙ্গারাম!” ভোগের খিচুড়ির হাতা নেড়ে, জিভ কেটে পালিয়ে গেল মণিদীপা।

মণিদীপা যায়নি। দরিয়া এসেছিল আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। বিহান পরেছিল সাদা টি-শার্ট আর নীল ডেনিম। দু’জনে মিলে শরৎ সদনে ঢুকতে গিয়ে দেখে, গেটের বাইরে ফুচকা বিক্রি করছে বুধনকাকা। পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে লেডিস পিন্টু।

ওদের দেখে দরিয়া একছুটে পালিয়ে গেল। পিছন পিছন বিহান। দু’জনে মিলে উঠে বসল ফাঁকা একাত্তর নম্বর বাসে। এই বাসটা স্লো সাইকেল রেসে নাম দিলে ফার্স্ট হত। হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদা যেতে ছুটির দিনেও একটি ঘণ্টা সময় নেয়।

ফাঁকা বাসে বসে দু’জনের সে কী কলকল করে গল্প! কে কোথায় থাকে, কার বাড়িতে কে আছে, কোন স্কুলে পড়ে, বারো ক্লাস পাশ করার পরে কী প্ল্যান… সব আলোচনা হয়ে গেল। বিহানের মোবাইল থাকলেও দরিয়ার কোনও মোবাইল ফোন নেই। সে সীমার ফোন নম্বর দিয়ে বিহানকে প্রমিস করিয়ে নিল, কখনও ফোন করবে না। সীমা যখন স্নান করতে যাবে বা ঘুমোবে, তখন দরিয়া মিসড কল দেবে। তৎক্ষণাৎ বিহানকে ফোন করতে হবে।

গল্পে গল্পে একদিকের ট্রিপ শেষ। শিয়ালদার বাসস্ট্যান্ডে নেমে চা, ফুচকা, চুরমুর আর এগরোল খেয়ে ফেরার জন্য অন্য একটা একাত্তর নম্বর বাসে উঠল দু’জনে। সন্ধে নেমেছে। ফাঁকা বাস। চোরের লজ্জা নিয়ে বিহান টুক করে ছুঁয়ে দিল দরিয়ার আঙুল। দরিয়া ভীষণ রেগে গিয়ে বিহানের হাতে চিমটি কেটে দিল।

বিহানের খুব জোরে লেগেছে। সে দরিয়ার ঝুঁটি ধরে দিল এক টান!

চুলে হাত দেওয়া! দরিয়া তো রেগে আগুন! সে বিহানের গাল টিপে দিয়ে বলল, “পুচু পুচু! বাচ্চা ছেলের সাহস কত!”

“কী? আমাকে বাচ্চা বলা? দাঁড়াও। মজা দেখাচ্ছি।” পিছনের সিটের কোনার দিকে দরিয়াকে ঠেসে ধরে টুক করে গালে চুমু খেয়ে নিল বিহান। অমনি দরিয়া সিঁটিয়ে গেল। সেই যে মাথা নিচু করে, জড়সড় হয়ে, গায়ে ওড়না জড়িয়ে লেডিস সিটে গিয়ে বসল, আর ঘুরেও দেখল না।

পিছনের সিটে বসে বিহান তখন অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছে। এ কী করল সে? একটা মেয়েকে চুমু খেল? এখন যদি কোনও গন্ডগোল হয়ে যায়? কী জাতীয় গন্ডগোল হতে পারে, এই নিয়ে কোনও ধারণা নেই বিহানের। কিন্তু সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

হাওড়া স্টেশনে বাস থেকে নেমে গেল দরিয়া। সে লিলুয়ার ট্রেন ধরবে। একবারও ঘুরে তাকাল না। দরিয়া অনেক পরে বিহানের মুখে শুনেছিল, হাওড়া ময়দানে বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মরমে মরে যাচ্ছিল বিহান। সে এ কী করল! সে তো সনতের থেকেও খারাপ ছেলে! ও শুধু মুখে মেয়েদের নিয়ে খারাপ কথা বলে। আর সে? আলাপের প্রথম দিনই চুমু খেয়ে ফেলল? ছি!

দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মায়ের কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেয়েছিল বিহান। শ্রীরূপার ধমক মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাতে স্বপ্নে এল বাসন্তী রঙের প্রজাপতি। সে ফড়ফড় করে খাটের চারিদিকে উড়ছে আর বলছে, “তপনার টোলে, পুচু পুচু দোলে।” তাই শুনে তপন স্যরের বউ বলল, “বাচ্চা ছেলের সাহস কত!” বিহান দেখল একটা একাত্তর নম্বর বাস ফুল স্পিডে আসছে। তার চালকের আসনে বসে সনৎ বলছে, “নিজ মাল নিজ দায়িত্বে রাখিবেন। হাওড়া শিয়ালদা! হাওড়া শিয়ালদা! বজবজ… বজবজ…”

ভোররাতে বারমুডা ভিজে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল বিহানের। সে বাথরুমে গিয়ে বারমুডা ধুয়ে এল।

সারাদিন কেটে গেল ফোনের অপেক্ষায়। দরিয়ার মায়ের মোবাইল থেকে কখন মিসড কল আসবে সেই আশায় বসে থেকে পড়াশুনো ডকে উঠল। টিউশনি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। দরিয়ার স্কুলের সামনে সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে সারাটা দিন কাটিয়ে দিল বিহান।

ফোন এল রাত আটটার সময়ে। বিহান তখন ত্রিকোণমিতির প্রবলেম খুলে বসে রয়েছে। ‘মনে করো ক-খ-গ একটি বিষমবাহু ত্রিভুজ।’ একবার রিং হয়ে কেটে গেল ফোন। বাঘের মতো লাফিয়ে নিজের মোবাইল থেকে রিং ব্যাক করল বিহান।

ওপাশ থেকে দরিয়া বলল, “স্কুলের বাইরে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিলে কেন? কেবলুশ কোথাকার!”

রাগেনি! রাগেনি! ‘কেবলুশ’ বলেছে মানে রাগেনি! সারাদিনের সব টেনশন চলে গেছে বিহানের। সে বলল, “তুমি কাল কথা বললে না কেন? আমার বুঝি কষ্ট হয় না? আমি সারাদিন পড়াশুনো করতে পারিনি। টিউশনি যাইনি। মা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে! মনে হয় সব বুঝতে পেরে গেছে!”

“মন দিয়ে পড়াশুনো করো। দু’মাস বাদে পরীক্ষা। ভাল রেজ়াল্ট করতে হবে।” টুক করে ফোন কেটে দিয়েছে দরিয়া।

* * *

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে প্রেমটা হয়ে বিহানের সর্বনাশ হয়ে গেল। পড়াশুনো ডকে উঠল। দরিয়াকে রোজ একবার দেখার জন্যে সাইকেল চালিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে লিলুয়া চলে যেত। রোজ রাতে মোবাইলে গুজুরগুজুর। ফোনে টক টাইম ভরার জন্য মায়ের কাছে হাত পাততে হচ্ছিল ঘনঘন। শ্রীরূপা কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস না করে তার বেস্টফ্রেন্ড সনৎকে জিজ্ঞেস করলেন।

সনৎও পড়াশুনো আর টিউশনি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রীরূপার কথা শুনে সে বন্ধুর সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো মিলিয়ে নিল। তারপরে একদিন বিহানের পিছু নিয়ে চলে গেল লিলুয়ায়। দরিয়া তখন স্কুল কেটে বিহানের সঙ্গে লিলুয়া রেল কলোনির মাঠে বসে গল্প করছে।

বিহানের হাত নিজের হাতে নিয়ে দরিয়া বলল, “পরীক্ষা এসে গেছে। এখন রোজ দেখা করা উচিত নয়। পড়াশুনো আগে। পড়াশুনোর ব্যাপারে আমি খারাপের দলে। টেস্ট পেপার আর স্যরের দেওয়া সাজেশন গাঁতিয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিলে কোনওমতে পাশ করে যাব। আমার বাবা গ্র্যাজুয়েশন করতে পারেনি। আমাকে ওটা করতেই হবে।”

বিহান অন্যমনস্ক গলায় বলল, “আমার মা ইংরিজিতে এমএ। বাবাও তাই। বাবা প্রাইভেট কোম্পানির উঁচু পদে কাজ করত। পাশাপাশি নাটক করত, কবিতা লিখত। মা মনে করত ওসব করা মানে সময় নষ্ট। বাবাকে জোর করে মুম্বইতে ট্রান্সফার নেওয়াল। বাবার কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু একবার মায়ের আঁচলের তলা থেকে বেরনোর পরে স্বাধীনতা কাকে বলে বুঝে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”

“মানে?” দরিয়া অবাক।

“বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা মুম্বইতে আবার বিয়ে করেছে। ওদের একটা ইংরেজি নাটকের গ্রুপ আছে। সেটা সারা ভারত ঘুরে শো করে। তা ছাড়া বাবা হিন্দি সিরিয়ালের সংলাপ লেখে। মায়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।”

“তোমার সঙ্গেও নেই?”

“না। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখন এইসব ঘটে গেছে। কাজেই বাবাকে আমার মনেও নেই। আমার জীবন জুড়ে শুধু মা। বাবার ছাঁচে মা আমাকে গড়ে তুলতে চাইছে। আমি উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করব। ভাল কলেজে ভরতি হয়ে আবার ভাল রেজাল্ট করব। তারপরে ভাল চাকরি করব। একবারও ভাবছে না যে আমি পড়াশুনোয় অ্যাভারেজ।”

দরিয়া ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “এই ক’দিন ভাল করে পড়াশুনো করো। বাকিটা পরে ভাবা যাবে।”

বিহান আর দরিয়ার প্রেমের এই গপ্পোটা এইখানে এসে নতুন বাঁক নিল। ওরা যদি যে যার মতো বাড়ি চলে যেত, মন দিয়ে পড়াশুনো করে মোটামুটি একটা রেজাল্ট করত, তা হলে প্রেমটা টিকতেও পারত, না টিকতেও পারত। কম বয়সে এইসব প্রেম কত হয়! আবার কেটেও যায়! কিন্তু দরিয়া আর বিহানের প্রেমটা কাটল না। তার কারণ গল্পে একজন ভিলেন ঢুকে গেল। তার নাম সনৎ।

সে দুটো কাজ করল। লিলুয়া রেল কলোনির মাঠে বসে বিহান আর দরিয়াকে প্রেম করতে দেখে চলে গেল বসবাস। সাম্যব্রত আর সীমাকে জানিয়ে দিল, তাঁদের মেয়ে কী করছে। তারপর হাওড়া ময়দানে ফিরে শ্রীরূপাকে সবটা খুলে বলল।

বসবাস-এ এই নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। সাম্যব্রত দরিয়াকে বলেছিলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকটা ভাল করে দে। দরকার হলে বিহানকে বাড়িতে ডেকে একসঙ্গে পড়াশুনো কর। সারাজীবনে এই দেড় মাস আর কখনও ফেরত আসবে না।”

আর বিহান? বাড়ি ফিরে শ্রীরূপার হাতে সে বেদম মার খেয়েছিল। শ্রীরূপা মোবাইল কেড়ে নিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিহান স্কুলে বা টিউশনিতে গেলে সঙ্গ দিতেন। সবার উপরে ছিল সনতের শকুনের চোখ।

‘রেবেলিয়ন’ বা পুরনো নিয়ম তছনছ করে দেওয়ার প্রবণতা কৈশোরের স্বাভাবিক ধর্ম। এটা অনেকভাবে আসে। বিহানের ক্ষেত্রে এল আত্মধ্বংসের পথ ধরে। শ্রীরূপার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিহান সিদ্ধান্ত নিল, পরীক্ষায় খারাপ ফল করে মা’কে শাস্তি দেবে।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এল। চলেও গেল। রেজাল্ট বেরতে দেখা গেল বিহান টেনেটুনে পাশ করেছে। সনৎ সেকেন্ড ডিভিশন। দরিয়া আর মণিদীপা ফার্স্ট ডিভিশন।

শ্রীরূপা তখন থেকেই ছেলের প্রতি বিরূপ। সনৎ আর বিহান যখন শিবপুরের দীনবন্ধু ইনস্টিটিউশনে কমার্স পড়তে ভরতি হল, বিহানের অ্যাডমিশন ফি-এর টাকা বাঁ হাতে ছুড়ে দিয়েছিলেন।

দরিয়া আর মণিদীপা আর্টস নিয়ে ভরতি হল হাওড়া গার্লস কলেজে। চারজন ছেলেমেয়ে এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেল।

* * *

দরিয়ার মাথায় এইসব দৃশ্য এতক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল। দৃশ্যাবলি ছিঁড়ে গেল। গা গুলিয়ে উঠল হঠাৎ তার। কিছু বোঝার আগেই বমি করল।

কেউ একজন পাশ থেকে বলল, “পেশেন্ট অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোককে খবর দাও। তাড়াতাড়ি। কন্ডিশন ভাল নয়।”

একটা কালো পরদা নেমে আসছে দরিয়ার চোখের সামনে। সে শুনতে পাচ্ছে, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করা হচ্ছে, “মেটারনিটি ওয়ার্ডের পেশেন্ট দরিয়া চ্যাটার্জির বাবা সাম্যব্রত চক্রবর্তী। আপনি অবিলম্বে লেবার রুমের সামনে চলে আসুন।”

দরিয়ার জ্ঞান ফিরে আসছে। চোখের সামনে থেকে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সে চোখ খুলে দেখল, সাম্যব্রত সামনে দাঁড়িয়ে।

দরিয়া অসহায়ের মতো বলল, “বাবা, বিহান কোথায়?”

দরিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সাম্যব্রত মোবাইল বার করে বিহানকে ফোন করলেন। হঠাৎই দরিয়া আর একবার বমি করল এবং অজ্ঞান হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *