শেষ নাহি যে – ৬

পৌনে বারোটা বাজে। বকুলতলা বাসস্ট্যান্ডে বিহান দাঁড়িয়ে আছে পনেরো মিনিট ধরে। একটাও বাস আসেনি। এগারোটা নাগাদ পোর্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এখান দিয়ে হেঁটে সে মেসে ফিরেছিল। তখন বাসস্ট্যান্ডে অল্প কিছু লোক ছিল। অভিরুচি-তে খদ্দের না থাকলেও দোকান খোলা ছিল। এখন অভিরুচির ঝাঁপ বন্ধ। বাসস্ট্যান্ডে সে ছাড়া আর কোনও যাত্রী নেই। তখন যে বাসটা কলকাতা যাচ্ছিল, তার কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছিল, “যারা যাবেন বাসে উঠে পড়ুন। এর পরে আর বাস নেই। তাড়াতাড়ি!” কথাটা সিরিয়াসলি নেয়নি বিহান। এখন মনে হচ্ছে, কন্ডাক্টর ঠিকই বলেছিল।

বাস নেই তো কী হয়েছে? বকুলতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। আজ গাড়িতে করেই হাওড়া যাবে বিহান। পার্সে ছ’হাজার টাকা আছে। খরচ করা যেতেই পারে। গাড়িচালকদের অফিসটা মূল রাস্তা থেকে সামান্য ভিতর দিকে। সেদিকে এগোল বিহান। অফিসের মধ্যে বসে ড্রাইভাররা টিভি দেখছে। বিহান গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “কলকাতা যাওয়ার কেউ আছেন না কি?”

চালকদের মধ্যে একজন ঘুরে তাকাল। বছর পঞ্চাশ বয়স, কুচকুচে কালো গায়ের রং, বিশাল মোটা গোঁফ, পান খাওয়া ঠোঁট খয়েরের কারণে লাল টুকটুক করছে। অফিসের এক কোণে পিচ্‌ করে পানের পিক ফেলে বলল, “আজ কেউ গাড়ি বার করে? মাথাফাতা খারাপ না কি? দেকচেন না, খলিসানির মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে দিয়েচে।”

চালক যে জায়গাটার নাম করল, সেটা হাওড়া জেলায়। ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে। তা হলে কি গন্ডগোল কলকাতা থেকে অন্য জেলায় ছড়াচ্ছে?

বয়স্ক চালক বলল, “হোয়াট্‌সঅ্যাপে ফোটো এসেচে। ওখানে খরাজ পার্টির পাঁচজনকে মেরে ফেলেচে।”

কমবয়সি এক চালক বলল, “তুমি ওইসব ভাটের কথা বিশ্বাস করছ দাদা!”

“ফোটো আচে। দেখতে চাস?”

“ওইসব পুরনো ফোটো দেখিয়েই গুজব ছড়ায়। আমি তো খবরের কাগজে না বেরলে কিছুই বিশ্বাস করি না।”

“খবরকাগজ যেন সতী সাবিত্রী!” খিঁচিয়ে ওঠে বয়স্ক চালক, “আর টিভিতেও তো বাস জ্বালানোটা দেখাচ্চে। চোকে ন্যাবা হয়েচে না কি?”

“তা হলে ওইটুকুই বলো। ফালতু গুজব রটিয়ো না। এই হোয়াটস্‌অ্যাপটা হয়েছে যত নষ্টের গোড়া,” কথা থামিয়ে টিভি দেখতে থাকে কমবয়সি চালক।

দুই চালকের ঝগড়ার মধ্য থেকে সরে আসে বিহান। যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছে। আজ আর প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে না। তা হলে ট্রেকার! ওটায় চড়ে যতটা সম্ভব যাওয়া যাক। যেখানে নামিয়ে দেবে সেখান থেকে অন্য ট্রেকার ধরা যাবে। বিহান বুঝতে পারছে তার লিলুয়া ফেরাটা ক্রমশ অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু চেষ্টা তাকে করতেই হবে। বকুলতলা বাসস্ট্যান্ডে অন্যদিন গাদা গাদা ট্রেকার দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটাও নেই। বিহান এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে, এমন সময়ে বিকট চিৎকার করে এক মহিলা বলল, “ও বাবু! তুমি কোথায় যাবে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে বিহান দেখল, মিনুদি।

মিনু মিস্ত্রিকে বকুলতলার সব্বাই চেনে। কারণ সে বকুলতলার একমাত্র মহিলা রিকশাওয়ালা! উচ্চতা পাঁচ ফুটের এক সুতো বেশি নয়। বেশ মোটা। গাছকোমর করে শাড়ি পরে যখন সাঁইসাঁই করে রিকশা চালায়, তখন সবাই ঘুরে দেখে আর ফ্যাকফ্যাক করে হাসে। মিনুর নাম হয়ে গিয়েছে ‘রসগোল্লা রিসকাউলি’। মাস ছয়েক আগে পোর্টের অফিস থেকে বিহান সবে বেরিয়েছে, এমন সময়ে মিনু তাকে ধরেছিল। “এই যে ভালমানুষের পো! আমার একটা উব্‌গার করে দাও দিকি!”

“কী উপকার?” জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যস্ত বিহান।

“আঁধার কার্ডে আমার বরের ঠিকানা ভুল আছে। কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছে না। তুমি ঠিক করে দেবে?”

বিহান বলেছিল, “এইসবের জন্য আলাদা দফতর আছে। সেখানে যাও।”

“থাক! আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। আঁধারের আপিসে গিয়ে গিয়ে পায়ে কড়া পড়ে গেল। আমাদের পাড়ার একজন বলল, তুমি কম্পিউটার নিয়ে কাজ করো। তাই বললুম। করে দাও না গো!”

কম্পিউটার নিয়ে কাজ করলে যদি পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করা যেত, তা হলে কী ভালই না হত। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। বাধ্য হয়ে মিনু আর সুদামকে মেসে ডেকেছিল বিহান। সমস্ত কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে বুঝেছিল, কাজটা শক্ত কিছু নয়। নিজে না পারলেও করিয়ে দেওয়া যাবে। আধার সহায়তা কেন্দ্রের ছেলেগুলো তার চেনা।

দিন পনেরো সময় লাগলেও কাজটা করে দিয়েছিল বিহান। সংশোধিত আধার কার্ড পাওয়ার পরে মিনু আর সুদামের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বিহানের। ভুলেই গিয়েছিল ওদের কথা। আজ মিনুর চিৎকার শুনে বুকে বল পেল। যাক! একজন অন্তত বিপদের দিনে দাঁত খিঁচিয়ে কথা বলল না।

বিহান মিনুর রিকশার কাছে গিয়ে বলল, “খুব বিপদে পড়েছি মিনুদি।”

“কী হয়েছে?” কুটকুট করে সুপুরি চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল মিনু। সে পরে রয়েছে ময়লাটে হলদে রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউজ়। পায়ে হাওয়াই চপ্পল।

“আমার বউয়ের বাচ্চা হবে। ব্যথা উঠেছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে গন্ডগোলের জন্যে আমি বাড়ি ফিরতে পারছি না।”

“মা ষষ্ঠীর কৃপা কবে কার উপরে পড়বে, কেউ বলতে পারে না,” ঘাড় নাড়ছে মিনু, “তোমার বাড়ি কোথায়?”

“হাওড়া স্টেশনের কাছে,” ইচ্ছে করেই লিলুয়া না বলে হাওড়া স্টেশনের নাম করল বিহান। মিনু লিলুয়ার নাম না-ও জানতে পারে।

বিহানের উত্তর শুনে মিনু অবাক হয়ে বলল, “তুমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছ কেন? ট্রেনে চলে যাও!”

“এখন ট্রেন আছে?” বোকার মতো জিজ্ঞেস করল বিহান, “এখানকার ট্রেনের সময় সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই।”

“হাওড়া এস্টেশনে যাওয়ার ট্রেন বকুলতলা এস্টেশনে আসে সাড়ে বারোটার সময়। এখন সওয়া বারোটা বাজে। তুমি আমার রিসকায় উঠে পড়ো।”

“না!” ঘাড় নাড়ে বিহান।

চোয়াল শক্ত করে মিনু বলল, “বকুলতলা এস্টেশন এখান থেকে তিন কিলোমিটার। দৌড়ে চলে যাও।”

বিহান দৌড় দিল। সে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় নষ্ট করেছে। সে একটা গাধা। অন্য যে কেউ হলে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে ট্রেনের সময় জেনে রাখত। সে পনেরো মিনিটে তিন কিলোমিটার দৌড়তে পারবে তো? পাঁচ মিনিটে এক কিলোমিটার! বাপ রে! স্কুলে পড়ার সময়ে ফুটবল খেলত বিহান। তার পরে শরীরচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। এর মধ্যেই হাঁপ ধরছে। বাবা গো!

রিকশার হর্নের প্যাঁকপ্যাঁকানি শুনে মুখ ঘোরাল বিহান। রিকশার প্যাডেল চালিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে মিনু। মুহূর্তের মধ্যে পাশে এসে বলল, “দৌড়লে যতক্ষণে পৌঁছবে, রিসকায় তার আগে। বুঝেছ ভালমানুষের পো? নাও। এ বার উঠে পড়ো।”

আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে বিহান। সে রিকশায় উঠে বসল। মোবাইল রেখে দিল ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে। দৌড়োদৌড়ির সময়ে মোবাইল রাস্তায় পড়ে গেলে খুব ঝামেলায় পড়বে। মিনু সাঁইসাঁই করে রিকশা চালাচ্ছে আর বলছে, “মেয়েমানুষের ঘাড়ে চাপবে না। সে খুব ভাল কথা। আমাকে অনেক সওয়ারি এই কতা বলে। কিন্তু তোমরা ঘাড়ে না চাপলে আমার সোমসার কী করে চলবে বলতে পারো?”

বিহান উত্তর দিল না। রিকশায় বসে মনে হচ্ছে সবাই তাকে ঘুরে দেখছে। অস্বস্তি কাটাতে জিজ্ঞেস করল, “সুদামদা কী করে?”

“গান গায়,” প্যাডেল মারছে মিনু।

“কী গান?”

“তোমার সঙ্গে যখন দেখা করেছিল, তখন বুঝতে পারোনি যে ও এক চোখে দেখতে পায় না?”

লজ্জায় জিভ কাটল বিহান। এটা সে খেয়াল করেনি।

“বিয়ের আগে ও পাড়ার ফাংসানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। গান শুনেই তো পিরিত হল। তার পরে ওর চোখে কী একটা বাজে রোগ হল। সেই থেকে এক চোখে দেখতে পায় না। তবে গানটা ছাড়েনি। ট্রেনে গান গেয়ে ভালই রোজগার করে।”

“অন্ধ কানাই পথের ধারে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে”। রবিঠাকুর মনে পড়ে গেল বিহানের। সুদাম মিস্ত্রি ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালায়।

মিনু বকবক করেই যাচ্ছে। “ও রোজ পোর্ট এস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে গান গাইতে গাইতে হাওড়া এস্টেশন চলে যায়। আবার ওই ট্রেনেই ফেরত আসে। পোর্টের পরের এস্টেশনই তো বকুলতলা।”

“ওই টাকায় সংসার চলে?” জিজ্ঞেস করল বিহান। ‘ভিক্ষে’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারল না সে।

“আমি আছি কী করতে?” ফুঁসে ওঠে মিনু, “রসগোল্লা রিসকাউলি বলো আর যাই বলো, সারাদিনে পনেরো-কুড়িটা টিরিপ হয়েই যায়। দিনের শেষে তিনশো টাকা নিয়ে ঘরে ঢুকি। ও-ও নিয়ে আসে শ’দুয়েক টাকা। পনেরো হাজার টাকায় আরামসে সোমসার চলে যায়।”

বিহান চুপ। রিকশা চালিয়ে আর ভিক্ষে করে স্বামী-স্ত্রী তার সমান রোজগার করে।

মিনু বলল, “আমি রিসকা চালাই বলে সবাই খুব আওয়াজ দেয়। বেশি আওয়াজ দেয় ব্যাটাছেলে রিসকাওলারা। আমি ওদের ভাত মারছি কি না! তাই অত রাগ। আমি পাত্তা দিই না। ওদের বলি, একচোখো ভাতারকে যখন সহ্য করি, তখন তোদের একচোখোমিও সহ্য করে নেব।”

“বাবা! তোমাদের খুব প্রেম তো!” হাসছে বিহান।

“প্রেম কি শুদু তোমরাই করবে, ভালমানুষের পো? রসগোল্লা রিসকাউলি আর কানা গাইয়ে গরিব বলে পিরিত করবে না?”

“না না! আমি তা বলিনি!” লজ্জা পেয়েছে বিহান। তার মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক বছর আগের কথা। স্কুলজীবনের এক সরস্বতী পুজোর কথা। যে দিন সে দরিয়াকে প্রথম দেখেছিল।

* * *

“কাল তপন স্যরের বাড়িতে সরস্বতী পুজো আছে। যাবি তো?” বঙ্গবাসী সিনেমা হলের ফ্রন্ট রোয়ে বসে ‘মন মানে না’ দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল সনৎ। সে আর বিহান স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে এসেছে।

ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার শুরু। বিহানের মা শ্রীরূপা এখনও জানতে পারেননি। সনতের বাবা-মা সবই জানেন। কিন্তু তাঁরা ছেলেকে সামলাতে পারেন না। সনৎ বিড়ি-সিগারেট, পানমশলা-গুটখা, মদ-গাঁজা পর্যন্ত চেখে ফেলেছে বলে দাবি করে। দুই বন্ধু হরিহর আত্মা হলেও নেশার ব্যাপারে বিহান সনৎকে সঙ্গ দেয় না। দু’-একবার সিগারেট টেনে দেখেছে। ভাল লাগেনি।

একটা নেশা দু’জনেরই হয়েছে। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার নেশা। এই সিনেমাটা রিলিজ় করেছে গত বছরের শেষের দিকে। নতুন বছরেও রমরমিয়ে চলছে। নেহাত ব্ল্যাকারদের সঙ্গে সনতের চেনাশোনা আছে, তাই আজ টিকিট পাওয়া গেল।

তপন স্যর এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাস্টারমশাই। ওঁর কাছে ইংলিশ পড়লে সব প্রশ্ন কমন আসে। দুই বন্ধুই ইংলিশে কাঁচা। বাধ্য হয়ে তপনার টোলে নাম লিখিয়েছে।

‘তপনার টোল’ নামটা ছাত্রদের দেওয়া। হাওড়া ময়দান চত্বরের সব ছেলেমেয়ে ওঁর কাছে ইংরেজি পড়তে আসে। বাড়ির বাইরে যত চটি থাকে, তত চটি সেলের সময়ে জুতোর দোকানের স্টকেও থাকে না। আর সাইকেলের কথা না বলাই ভাল। বিশু নামের এক ছোকরা তপনার টোলের পাশে সাইকেল স্ট্যান্ড বানিয়ে ভালই কামাচ্ছে।

সরস্বতী ঠাকুরের প্রতি সনতের ভক্তি কতটা, বিহানের জানা আছে। তার কাছে সরস্বতী পুজো মানে পাড়ার প্যান্ডেলে দাদাগিরি করা, ড্যাবড্যাব করে মেয়ে দেখা আর সন্ধে থেকে প্যান্ডেলের পিছনে লুকিয়ে মদ খাওয়া। তার হঠাৎ তপনার টোলের পুজোয় যাওয়ার ইচ্ছে হল কেন?

সিনেমা দেখে বেরিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল বিহান, “তুই পাড়ার পুজো ছেড়ে তপনার টোলের পুজোতে! ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।”

সনৎ ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করল। তার মানে ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘তোর বাবার কী?’ যা খুশি হতে পারে। বিহান বলল, “ঠিক আছে। কাল তপনার টোলেই অঞ্জলি দেব। কিছু না খেয়ে থাকবি কিন্তু!”

পরদিন সকাল আটটার সময়ে তপনার টোলে গিয়ে বিহানের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সপ্তাহের সাত দিন ধরে যতগুলো ব্যাচ এখানে টিউশনি নেয়, তার সব ছাত্রছাত্রী আজ মা সরস্বতীকে অয়েলিং করতে এসেছে। শাহরুখ খানের হাউসফুল সিনেমা চলার সময়ে হলের বাইরেও এত পাবলিক থাকে না। এর মধ্যে অঞ্জলি দেওয়া সম্ভব?

বিহান কেটে পড়ার ধান্দা করছিল। হঠাৎ শুনল তপনা হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করছে, “যারা অঞ্জলি দিবি তারা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। দরিয়া আর মণিদীপা তোদের কাছে ফুল নিয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি শয়তানি করিস, তা হলে তাকে কাল থেকে আর পড়াব না।”

মোক্ষম শাসানি! সব্বাই চুপ করে গেল। তারই মধ্যে দুটো মেয়ে ঘুরে ঘুরে সবার হাতে ফুল দিচ্ছে। দু’জনেরই পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। মাথার চুল খোলা।

ক্লাস এইট থেকে বিহান বড় হতে শুরু করেছে। গোঁফদাড়ি গজাচ্ছে, বুকে লোমের পাপোশ, গলার স্বর ভেঙে ব্যাঙের মতো হয়ে গিয়েছিল। এখন বড়দের মতো। পায়ে লোম গজানোর পরে ফুলপ্যান্ট ছাড়া পরে না। স্নান করার সময়ে বাথরুমে ঢুকে অসভ্য কাজ করে। তারপরে লজ্জা আর অপরাধবোধে তিন-চারদিন ওইসব কথা ভাবে না। এইভাবেই সবাই বড় হয়। বিহান ভেবেছিল, আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেল। সামনের নির্বাচনে ভোট দেবে। কয়েক মাস পরে কলেজে ভরতি হবে। তা হলে সে এখন অ্যাডাল্ট। বড়দের ব্যাপার-স্যাপারগুলো বোঝে।

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা মেয়েটাকে দেখে বুঝল, তার মধ্যে এমন সব অনুভূতির জন্ম হচ্ছে, যা সে এতদিন টের পায়নি। বুকের বাঁদিকে গুবগুবি বাজছে। ঘামে হাত ভিজে গিয়েছে। জিভ শুকিয়ে আসছে। খালি মনে হচ্ছে, মেয়েটা যদি তাকে অঞ্জলির জন্যে ফুল না দেয়, তা হলে সে মরেই যাবে। কী যেন নাম মেয়েটার? সাগরিকা না মণিকা? না কি অন্য কিছু? পুরো দুনিয়া ভুলে গিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিহান। মেয়েটা ফুল বিলি করতে করতে তার দিকে আসছে। আচ্ছা, মেয়েটা কি স্লো মোশনে আসছে? তা না হলে ওর আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? চাতকপাখি যেভাবে রৌদ্রদগ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, বিহান সেই ভাবে তাকিয়ে রয়েছে।

হঠাৎ বিহানের কোমরে সনৎ কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, “মালটাকে হেব্বি দেখতে না?”

মাল! কার সম্পর্কে এই শব্দ ব্যবহার করল সনৎ? দাঁতে দাঁত চেপে বিহান বলল, “তুই মাল বললি কাকে?”

“আরে! ওই দরিয়া নামের মেয়েটাকে। ওর সঙ্গে যেটা আছে, সেটাও ঘাপচু মাল। তবে দরিয়ার পাশে জাস্ট নস্যি!”

বিহান সনতের কথা শুনছে না। সে তাকিয়ে রয়েছে হলুদ প্রজাপতির দিকে। পাখনা মেলে প্রজাপতি তার দিকেই আসছে। কী যেন নাম? ও হ্যাঁ! দরিয়া। দরিয়াও খেয়াল করেছে, একটা ছেলে ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বিহানের দিকে তাকিয়ে পাতলা হাসল। বিহান জানে না তার মধ্যে কী ভর করেছে। সে দরিয়ার দিকে তাকিয়ে অবিকল একই কায়দায় হাসল।

ফুল দিতে দিতে দরিয়া আরও কাছে চলে এসেছে। এবার সে তার দুটো ভুরু তুলে নাচাল। বিহান ঘোরের মধ্যে রয়েছে। সেও তাই করল। দরিয়া হার স্বীকার করে নিয়েছে। অসহায় বালিকার মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিহানের সামনে এসে একমুঠো ফুল এগিয়ে দিল। বিহান হাত পেতে ফুল নিল। নেওয়ার সময়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য বিহানের আঙুল স্পর্শ করে গেল দরিয়ার আঙুল। কী নরম! কী তুলতুলে! ঠিক যেন পাখির

পালক! ঢোক গিলে, ভারী গলায় বিহান বলল, “তেরা নাম কেয়া হ্যায় বাসন্তী?”

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা মেয়ে দুটি হেসে কুটোপাটি। দরিয়া সনতের হাতে ফুল দেওয়ার সময়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর নাম মণিদীপা। আর আমার নাম দরিয়া। অঞ্জলি দিয়ে চলে যেয়ো না। প্রসাদ খেয়ে যাবে।”

“আচ্ছা,” ঘাড় নাড়ল বিহান। পুরোহিতমশাই মন্ত্রপাঠ শুরু করেছেন। বিহান চোখ বন্ধ করে পুজোর মন্ত্র বিড়বিড় করছে। এগুলো ছোটবেলা থেকে বলে বলে মুখস্থ। হঠাৎ তার কানের কাছে হিসহিস করে সনৎ বলল, “তুই দরিয়ার দিকে তাকাবি না বলে দিলাম। দরিয়া আমার!”

মন্ত্রপাঠ বন্ধ করে সনতের দিকে তাকাল বিহান। গত এক মিনিটে তার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, সেটা সে বুঝে উঠতে পারছে না। অচেনা একটা মেয়েকে দেখে এত উতলা হওয়ার কারণ তার কাছে পরিষ্কার নয়। সিনেমায় দেখেছে, শাহরুখ খানের সঙ্গে কাজলের প্রেম হয়। দেবের সঙ্গে কোয়েলের। সেই প্রেম নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বিরাট চাপের ব্যাপার! হাজার প্রশ্ন, লক্ষ কনফিউশন। তার মধ্যে গাম্বাট সনৎ নতুন ঝামেলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিহান অবাক হয়ে বলল, “দরিয়া তোর? এই কথাটার মানে কী?”

“আমি ওকে ভালবাসি।”

“উরিত্তারা! এই কথাটা দরিয়া জানে?”

“এখনও নয়। দু’-এক দিনের মধ্যেই মালটাকে তুলে ফেলব।”

অঞ্জলি শেষ হয়ে গিয়েছে। হাতের ফুল সরস্বতী ঠাকুরের দিকে ছুড়ে বিহান বলল, “সবাই তোর কাছে মাল, তাই না রে সনৎ? মদও মাল, মণিদীপাও মাল, দরিয়াও মাল।”

“ম্যাচ্ছেলে নিয়ে কী বুঝিস তুই?” বিহানের থুতনি নেড়ে দিল সনৎ, “সন্টা মনা! বাড়ি গিয়ে মায়ের আঁচলের তলায় ঢুকে বসে থাকিস আর দুদুভাতু খাস। এইসব হল অ্যাডাল্টদের ব্যাপার!”

* * *

“ট্রেন ঢুকে গিয়েছে!” মিনুর চিৎকারে ঘোর কাটল বিহানের। সে দেখল মিনু প্যাডেল মারছে ঝড়ের গতিতে। বকুলতলা স্টেশন এখনও অনেকটা দূর। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে গেলেও এখনও দাঁড়ায়নি। তার মানে মিনিটখানেক সময় পাওয়া যাবে। মিনুদি হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, “ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য টাইম নষ্ট করবে না। সোজা উঠে যাবে।”

“তুমি কথা বোলো না। হাঁপিয়ে যাবে।” স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলছে বিহান। ট্রেন বকুলতলা স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, যাত্রীরা ওঠানামা করছে।

গম্ভীর হর্ন বাজিয়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করল।

রিকশা থেকে একলাফে নেমেছে বিহান। দৌড় দিয়েছে স্টেশনের দিকে। ট্রেনের গতি বাড়ছে। সে কি ট্রেনটা ধরতে পারবে?

মিনু চিৎকার করে বলছে, “তুমি প্রথম কামরায় উঠে যাও। ওখেনে আমার বর আচে।”

বিহান স্টেশনে ঢুকল। তরতর করে সিঁড়ি টপকে পৌঁছে গেল প্ল্যাটফর্মে। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে হাওড়াগামী ট্রেন। গতি বেড়ে যাওয়ার ফলে কামরাগুলো আর আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা প্রতিবিম্বর মতো লাগছে। বিহান গতি বাড়াল। দৌড়তে লাগল ট্রেনের পাশাপাশি। আর একটু দৌড়লেই প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়ে গিয়ে পাথর আর খোয়ার ঢিবি শুরু হবে। ওইখানে মুখ থুবড়ে পড়লে আর দেখতে হবে না!

আর কিছু ভাবছে না বিহান। ছুটন্ত অবস্থায় সে ট্রেনের হাতলের দিকে হাত বাড়াল। এবং ধাতব হাতল স্পর্শ করা মাত্র তার ঘেমো হাত পিছলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *