শেষ নাহি যে – ৫

সাম্যব্রতকে মোবাইল ফেরত দিয়ে চোখ বুজল দরিয়া। পেটের ব্যথাটা মাঝে মাঝে একদম চলে যাচ্ছে। তখন শরীরের অন্য জায়গার ব্যথাগুলো চাগাড় দিচ্ছে। পায়ের যেখানে বোমার টুকরো ঢুকে রয়েছে, সেখানকার ব্যথার চলন মোটরবাইকের মতো। ভটভট করে আসছে, চারদিক কাঁপিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। মাথাব্যথার চলন রিকশার মতো। টুকটুক করে আসছে। আসছে তো আসছেই। যাওয়ার নামটি নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা উপসর্গ। ঝিমুনি ভাব, এই শীতেও ঘাম হওয়া, বারবার জল তেষ্টা পাওয়া। কোনও মানে হয় এইসব ন্যাকামোর? দরিয়ার শরীরে রোগবালাই নেই বললেই চলে। তার আজ এই অবস্থা? ধুস!

বিহান বলেছে, খারাপ জিনিস নিয়ে না ভাবতে। তা হলে আরও শরীর খারাপ হবে। এখন তা হলে কী নিয়ে ভাববে দরিয়া? বিহানের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিন নিয়ে? সেই যে, তপন স্যরের বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দিন…

না। দরিয়া বরং ভাববে বিহানের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার কথা। এই তো! গত সোমবার ভোরবেলা…

হাওড়া থেকে পোর্টের উদ্দেশে স্টেট বাস ছাড়ে আধঘণ্টা পরপর। বিহান ধরে ভোর ছ’টার বাস। তা হলে ন’টার মধ্যে বকুলতলার মেসে পৌঁছে ব্যাগ রেখে ধীরেসুস্থে অফিস যাওয়া যায়। সোমবারের রান্নাটা আগে দরিয়াই করে দিত। বক্সে করে নিয়ে যেত বিহান। ডাক্তার মিত্র বারণ করার পরে বিহান আর খাবার নিয়ে যায় না। সাম্যব্রত বলেছিলেন, তিনি রান্না করে দেবেন। বিহান রাজি হয়নি।

শীতকালের ভোর। লেপ ছেড়ে যখন বেরয় বিহান, দরিয়ার কান্না পায়। তার জন্য কত কষ্ট করছে ছেলেটা। ওই কনকনে ঠান্ডায় গ্যাসে জল গরম করে স্নান করছে, তাদের দু’জনের জন্যে চা বানাচ্ছে। দরিয়াকে নিজের হাতে চা খাইয়ে দিচ্ছে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তার দুই গালে আর কপালে চুমু খাচ্ছে। কৃতজ্ঞতায়, ভালবাসায়, তৃপ্তিতে দরিয়ার বুক ভরে যায়। তার বরের মতো ভালমানুষ এই দুনিয়ায় আর একটাও আছে? একদিন নিশ্চয়ই তারা একসঙ্গে থাকবে। তখন দু’জনে খুব মজা করবে। খুব! অনাগত সেই দিনের কথা ভেবে চোখে জল চলে আসে দরিয়ার। গলার কাছে কী একটা পুঁটুলি পাকিয়ে ওঠে।

চোখ মুছে অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের আসনের দিকে তাকাল দরিয়া। অ্যাম্বুল্যান্স চালাচ্ছে যে লোকটা, তার নাম রাজু হেলা। বছর চল্লিশ বয়স। চিমসে চেহারা, গাল ভরতি ব্রণের খানাখন্দ, চুলে বাহারি টেরি কাটা। পরনে সিল্কের সাদা ফুলহাতা শার্ট আর বেলবটম ট্রাউজ়ার্স। গলায় লাল মাফলার। এইরকম আজকাল কেউ পরে না।

দরিয়ার নাম দরিয়া কেন, এই নিয়ে স্কুল-কলেজে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আসল কারণ, ‘দরিয়ায় আইল তুফান’ গানটি সাম্যব্রতর খুব পছন্দের। মন ভাল থাকলে মাঝেমধ্যে খাওয়ার টেবিলে তাল ঠুকে পুরো গানটিই গেয়ে থাকেন। দরিয়ার অবশ্য নিজের নাম একদমই পছন্দ নয়। সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন লোকে তার নাম শুনে নানা মন্তব্য করে থাকে। “কী অদ্ভুত নাম!” “কে রেখেছে? খুব আঁতেল কেউ?”

রাজু তার নাম শুনে বলল, “খুব কায়দার নাম তো!” তারপরে টেরিতে হাত বুলিয়ে রাজেশ খন্নার কায়দায় গান ধরল, “নদিয়া সে দরিয়া, দরিয়া সে সাগর, সাগর সে গেহরা জাম”। দরিয়া বুঝতে পারল পোশাক, চুলের কায়দা বা কথাবার্তার ক্ষেত্রে রাজু হেলা রাজেশ খন্নাকে নকল করে। হয়তো রাজেশ থেকেই ওর নাম হয়ে গিয়েছে রাজু।

সাম্যব্রত বিরক্ত হয়ে বললেন, “এটা গান গাওয়ার সময় নয়। তুমি চলো।”

“চলো বললেই কি আর যাওয়া যায় স্যর! রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখছেন তো। পুরো লাইফ রিস্ক কেস। ‘জ়িন্দেগি কা সফর হ্যায় ইয়ে ক্যায়সা সফর, কোই সমঝা নহি, কোই জানা নহি’। জান হাথেলি পে নিয়ে যেতে হবে। খচ্চা আছে।”

“কত নেবে? ডক্টর মিত্র তো বলেছেন…”

“স্যর স্যরের কথা বলবেন। রাজু রাজুর কথা বলবে। এটা হিজ় হিজ় হুজ় হুজ়। পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।”

“লিলুয়া থেকে হাওড়া ময়দান পাঁচ হাজার টাকা!” তেড়ে উঠেছেন সাম্যব্রত, “পাঁচ কিলোমিটারের জন্য তুমি এত টাকা নেবে? এই ঠান্ডায় এয়ার কন্ডিশনের দরকার নেই। আমার মেয়ের অক্সিজেনও লাগবে না। তুমি তো দিনে ডাকাতি করছ হে!”

“যাবেন না স্যর। রাজু হেলার সঙ্গে যেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দিয়েছে? অন্য গাড়ি ডেকে নিন। বাজার মে হর চিজ় মিলতা হ্যায়!”

সাম্যব্রত অন্য অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কোনও অ্যাম্বুল্যান্স চালক যেতে রাজি হয়নি। সকলের মুখে এক কথা। রাস্তায় গন্ডগোল হচ্ছে, যাব না। সাম্যব্রত বুঝে গিয়েছেন, এদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। রাস্তায় গন্ডগোল থাক আর না-ই থাক, তিনি রাজুর অ্যাম্বুল্যান্স নিতে বাধ্য। এবং রাজু যে টাকা চেয়েছে সেটা দিতেও বাধ্য।

অগত্যা আবার রাজুর কাছে। সে ড্রাইভারের আসনে বসে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে ডায়ালগবাজি করছে, “বাবুমশাই, জ়িন্দেগি বড়ি হোনে চাহিয়ে, লম্বি নেহি।”

সাম্যব্রত বললেন, “বলছ ‘আনন্দ’ সিনেমার ডায়ালগ, আর আমাদের দিচ্ছ কষ্ট! ”

ডান হাত দিয়ে টেরি ঠিক করে রাজু বলল, “ ‘আই হেট টিয়ার্স, পুষ্পা!’ শুনুন স্যর, একটা কথা আগেভাগে বলে দিই। আপনাদের ভাগ্য খুব ভাল যে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। এই রাজু হেলা খরাজ পার্টির নেতা। জেলার আপৎকালীন যানচালক সমিতির একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক।”

“একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক ব্যাপারটা কাঁঠালের আমসত্ত্বর মতো শোনাচ্ছে। অন্যজন কি তোমার যমজ ভাই, যে কুম্ভমেলায় হারিয়ে গিয়েছে?” বলল দরিয়া।

“আওয়াজ দিচ্ছেন ম্যাডাম?” দরিয়ার দিকে তাকিয়ে রাজু বলল, “ভাবছেন ফালতু ড্রাইভারের রোয়াব কত! তাই না? মনে রাখবেন, এই আনপড় রাজুই এখন আপনার ভরসা।” কথাটা বলেই সাম্যব্রতর কাছে হাত পেতে রাজু বলল, “টাকাটা দিন।”

পাঁচ হাজার টাকা রাজুর হাতে দিয়ে সাম্যব্রত ভাবলেন, কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। হাতে রইল পনেরো হাজার। সরকারি হাসপাতালে টাকা লাগার কথা নয়। কিন্তু যদি লাগে? যদি পনেরোতে না হয়? আজকাল ডেবিট কার্ড না ক্রেডিট কার্ড… কী সব পাওয়া যায়। সাম্যব্রতকে ব্যাঙ্ক থেকে একটা কার্ড দিয়েছিল। কী করে ব্যবহার করতে হয়, শেখেননি। পাড়াতেই গোটা চার এটিএম আছে। কোনও দিনও ঢোকেননি। কী করে টাকা বার করতে হয় জানেন না। আজ মনে হচ্ছে শিখে রাখলে ভাল হত।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দরিয়া দেখতে পাচ্ছে, লিলুয়ার গলি থেকে বেরিয়ে ফ্লাইওভার ধরেছে অ্যাম্বুল্যান্স। ফাঁকা উড়ালপুল দিয়ে সাঁইসাঁই করে চলে এল রেললাইনের এপারে। ওয়ান ওয়ে রাস্তায় হাওড়ার দিকে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য ছাড় আছে। তা ছাড়া চারদিকে যা গন্ডগোল হচ্ছে, তার মধ্যে মোড়ে কোনও ট্র্যাফিক পুলিশ দেখতে পেল না দরিয়া। পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাওড়া চলে এল রাজুর অ্যাম্বুল্যান্স। এখানে মেট্রো রেলের কাজ চলছে পুরোদমে। জি টি রোড আংশিকভাবে বন্ধ। এ গলি-সে গলি দিয়ে রাজু চলে এসেছে হাওড়ার গুলমোহরে।

অতীতে এখানকার রেল কলোনিতে একাধিক গুলমোহর গাছ ছিল। দরিয়া ছোটবেলায় সাম্যব্রতর সঙ্গে এখানকার মাঠে অনেকবার সার্কাস দেখতে এসেছে। গাছগুলো আর নেই। তাদের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গুলমোহর নামের এক ম্লান বাসস্টপ। দরিয়া সাম্যব্রতকে বলল, “এখান থেকে বঙ্গবাসী হাসপাতাল হাঁটা রাস্তা।”

সাম্যব্রত নিচু গলায় দরিয়াকে চুপ করতে বললেন। দরিয়া ঘাড় তুলে দেখল, হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের দিক থেকে গণতান্ত্রিক মোর্চার একটা মিছিল এদিকে আসছে। মিছিলের একদম সামনে বড় ব্যানার নিয়ে হেঁটে আসছে দু’জন মাঝবয়সি লোক। দু’জনের পরনেই জিন্‌স আর জ্যাকেট। পিছনে শ’দেড়েক লোক। তাদের হাতে গণতান্ত্রিক মোর্চার পতাকা। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পতাকার ডান্ডাগুলো ধাতুর তৈরি। রোদ পড়ে চকচক করছে। কারও কারও হাতে কৃপাণ এবং কাতানও রয়েছে। দরিয়া সাম্যব্রতকে বলল, “প্রসূতির অ্যাম্বুল্যান্সে ওরা ঝামেলা করবে না। তুমি চিন্তা কোরো না।”

সাম্যব্রত বললেন, “চিন্তা তো করতেই হবে। যে দু’জন ব্যানার ধরে আছে, তাদের একজনের নাম বাবিন। সদ্য খরাজ পার্টি থেকে গণতান্ত্রিক মোর্চায় গিয়েছে। পাল্টি খাওয়া লোকরা ভয়ানক হয়।”

রাজু অ্যাম্বুল্যান্সের ইঞ্জিন বন্ধ করে চুপচাপ বসেছিল। বলল, “ঠিক বলেছেন স্যর। বাবিন আগে আমাদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক ছিল।”

টেনশনের মুহূর্তেও সাম্যব্রত ফিক করে হেসে ফেলেছেন, “এই তা হলে তোমার সেই কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাই!”

“বিপদের টাইমে কেন উংলি করছেন স্যর? বাবিন আমাকে দেখতে পেলে হেব্বি বাওয়াল দেবে!” কাঁপা গলায় বলল রাজু। এখন রাজু হেলা তার রাজেশ খন্না অবতার থেকে বেরিয়ে এসেছে।

মিছিল আরও এগিয়ে এসেছে। বাবিন হাঁক পাড়ছে, “খরাজ পার্টির কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও!” বাকিরা ধুয়ো দিচ্ছে, “ভেঙেদ্দাও, গুঁড়িয়েদ্দাও!”

“খরাজ পার্টি জেনে রাখো, হামলা হলে পাল্টা হবে।”

“হামলা হলে পাল্টা হবে।”

মিছিল এখন অ্যাম্বুল্যান্সের পাশ দিয়ে হাঁটছে। সাম্যব্রত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, দরিয়া আধশোওয়া হয়ে দেখছে। রাজু ড্রাইভারের আসনে বসে মাথা নিচু করে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, গাড়ির মেঝেয় কিছু পড়ে গেছে। রাজু সেটা খুঁজছে।

রাজুর এই অদ্ভুত পসচারের জন্যই সে ধরা পড়ে গেল। অ্যাম্বুল্যান্স দেখে কেউ কিচ্ছু বলেনি। মিছিল গাড়ি পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। মিছিলের শেষ দিকের একটি কমবয়সি ছেলে জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে রাজুর পিঠে খোঁচা মেরে বলল, “কী রে! কোথায় মাথা গুঁজে রেখেছিস?”

খোঁচা খেয়ে মাথা তুলে রাজু বলল, “কেন বে? তোর কী?”

ছেলেটা রাজুকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “ও বাবিনদা! খরাজ পার্টির জোকারটা আজকের দিনে অ্যাম্বুল্যান্স বার করেছে।”

মুহূর্তে মিছিল থমকে দাঁড়াল। বন্ধ হয়ে গেল স্লোগানবাজি। দরিয়া দেখল, বাবিন বড় বড় পা ফেলে এদিকে এগিয়ে আসছে। দরিয়া নিচু গলায় বলল, “রাজুদা, চলো।” সাম্যব্রতও বললেন, “রাজু, দাঁড়িয়ে থেকো না। গাড়িতে স্টার্ট দাও!”

কথাটা বলার দরকার ছিল না। রাজু বুঝে গিয়েছে, এখান থেকে পালাতে হবে। সে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়েছে। ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার… গাড়ি এগোচ্ছে। মিছিলের শেষের দিকের লোকেরা দু’দিকে সরে যাচ্ছে হুটারের শব্দ শুনে। রাজু বোধ হয় বিপদ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে।

হঠাৎ কেউ একজন জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে রাজুর সাদা শার্টের কলার চেপে ধরল। এবং রাজুর মাথাটা অ্যাম্বুল্যান্সের জানালায় ঠুকে দিল। হাতে স্টিয়ারিং, পায়ে ক্লাচ-ব্রেক-অ্যাক্সিলারেটর, কিন্তু শরীর আটকে আছে জানলায়। এইভাবে গাড়ি চালানো যায় না। থার্ড গিয়ারে যেতেই রাজুর গলায় এমন টান লাগল যে সে খকখক করে কাশতে কাশতে ব্রেক চেপে গাড়ি থামিয়ে দিল। ব্রেক খুব জোরে চাপা হয়ে গিয়েছে। বিকট শব্দ করে গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। দরিয়া আর একটু হলে স্ট্রেচার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। জানালার ফ্রেমে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিল। দেখল, রাজুকে চালকের আসন থেকে নামিয়ে মুখে ঘুসি মেরে বাবিন বলল, “শালা খরাজ পার্টির দালাল। কত টাকা ঝেড়েছিস তার হিসেব আমার কাছে আছে। আজই তোর বিচার হবে।”

ঘুসি খেয়ে রাজুর ঠোঁট কেটে রক্ত বেরচ্ছে। ফিল্‌মি কায়দায় বাঁ হাতের পিছন দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছে সে বলল, “যা ঝেড়েছি, তার অর্ধেক তোকে দিয়েছি। আজ তুই সতী সাজিস না।”

গাড়িতে বসে সাম্যব্রত কপাল চাপড়ে বললেন, “মার খাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করল বোকাটা!” তাঁর কথা নির্ভুল প্রমাণ করে বাবিন থাপ্পড় কষাল রাজুর গালে। লোকটা চড়ের অভিঘাতে রাস্তায় ছিটকে পড়ল। মিছিলের বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজুর উপরে। দরিয়া চিৎকার করে বলল, “বাবা! কিছু করো। লোকটা মরে যাবে! ও না থাকলে আমরা বঙ্গবাসী হাসপাতালে যেতে পারব না।”

সাম্যব্রত হুড়মুড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামলেন। দেড়শো লোকের জমায়েতের কেন্দ্রে যাওয়া সহজ নয়। একে গুঁতিয়ে, ওকে সরিয়ে, তাকে ধাক্কা মেরে কিছুটা এগোলেন। আর এগোনো যাচ্ছে না। মিছিলের ছেলেগুলো হাতে হাত ধরে শক্ত ব্যারিকেড তৈরি করেছে। সাম্যব্রতর মনে পড়ল, এই ভাবে তাঁরাও একদিন ব্যারিকেড তৈরি করতেন কলেজ স্ট্রিটে। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস, প্রকাশ্যে গুলি চালানো… সব কিছু থাকা সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। ‘তুমি আলো আমি আঁধারের পথ ধরে, আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন!’

লাল টুকটুকে দিন আর এল না।

সেইসব অগ্নিগর্ভ দিন আর আজকের মধ্যে কত তফাত! একদা বিপ্লবী সাম্যব্রত এখন ডোমেস্টিক অ্যানিম্যাল। গর্ভবতী মেয়ের বাবা, অসুস্থ বউয়ের স্বামী। একসময় জয় করার জন্য ছিল গোটা বিশ্ব। আজ জয় করার জন্য কিচ্ছু পড়ে নেই। যা আছে, তা হল আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা আর পরাজয়ের গ্লানি। আছে মেয়ে আর তার গর্ভস্থ সন্তানকে হারানোর ভয়। আজ সাম্যব্রতর ভিক্ষা চাওয়ার পালা। পাশঝোলায় হাত ঢুকিয়ে রেডবুক মুঠোর মধ্যে ধরে তিনি দূর থেকে চেঁচালেন, “বাবিন, আমি সোমুদা!”

বাবিন বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গণধোলাই তদারক করছিল। ‘সোমুদা’ ডাক শুনে চমকে উঠে এদিক-ওদিকে তাকাল। ভিড়ের মধ্যে থেকে হাত নাড়লেন সাম্যব্রত, “এই যে! আমি এখানে।”

বাবিন ভুরু কুঁচকে সাম্যব্রতকে দেখল। হাতের ইশারায় চ্যালাচামুণ্ডাদের বলল, ধোলাই বন্ধ করতে। ভিড় ঠেলে সাম্যব্রতর দিকে এগিয়ে এসে বলল, “সোমুদা, আপনি?”

অ্যাম্বুল্যান্সের জানালা দিয়ে দরিয়া দেখল, বাবিন সাম্যব্রতর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। প্রণাম চুকিয়ে পিঠ টান করে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “এখানে কী করছেন?”

সাম্যব্রত বাবিনের হাত ধরে বললেন, “আমার মেয়ের লেবার পেন উঠেছে। ওকে নিয়ে বঙ্গবাসী হাসপাতালে যাচ্ছি। রাজু আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা ওকে বকাবকি করলে আমার যে যাওয়া হবে না বাবা!”

‘বকাবকি!’ সাম্যব্রতর শব্দচয়নের প্রশংসা করল দরিয়া। সামান্য বকাবকি করা হয়েছে। মারধর তো আর নয়!

সাম্যব্রতর কথা শুনে বাবিন অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে তাকিয়েছে। দরিয়া দ্রুত চোখেমুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল। সে সাধারণ মানুষ। টাকা, ক্ষমতা, লোকবল, রাজনৈতিক ক্ষমতা— কিছুই নেই। যাদের কিছু নেই, তারাও সারভাইভ করে। যে ভাবেই হোক না কেন। দরিয়াও সারভাইভ করবে। চোখে জল এনে, হাতজোড় করে সে বলল, “খুব কষ্ট হচ্ছে দাদাভাই! আমি আর পারছি না!”

বাবিন তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে রাজুর কলার ধরে রাস্তা থেকে তুলে গালে আর একটা থাপ্পড় কষিয়ে বলল, “ছোটবেলায় সোমুদার কাছে অঙ্ক আর ইংরিজি পড়তাম। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। কোনও দিনও এক নয়া পয়সা নেননি। নকশাল ছিলেন, ভুলভাল পলিটিক্স করতেন। কিন্তু সাচ্চা আদমি। তাঁর মেয়েকে নিয়ে তুই হাসপাতাল যাচ্ছিস। তাই ছেড়ে দিলাম। না হলে এই গুলমোহর বাসস্ট্যান্ডে তোর লাশ পুঁতে রেখে দিতাম। যা এখান থেকে। পালা!”

দরিয়াকে এখন আর অভিনয় করতে হচ্ছে না। সে সত্যি সত্যিই কাঁদছে। মায়ের দেওয়া বিপত্তারিণীর প্রসাদি ফুল আঁচলে বাঁধা রয়েছে। আঁচল মুঠোয় ধরে সে বিড়বিড় করে বলল, “ঠাকুর! তুমি আমাদের বাঁচিয়ে দিলে ঠাকুর!”

পরমুহূর্তে মনে হল ঠাকুর নয়, বাবার সুনামের জন্য সে মুক্তি পেল। এখন ভালয় ভালয় রাজু অ্যাম্বুল্যান্সে উঠলে হয়। মার খেয়ে লোকটার হাড়গোড় ভেঙে যায়নি তো?

রাজু খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে আসছে। গাল আর কপাল থেকে ঝরঝর করে রক্ত বেরচ্ছে। ঠোঁট ফুলে আলুর মতো হয়ে গিয়েছে। শখের সাদা শার্টে রক্তের দাগ। প্যান্টের হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে গিয়েছে। চুল উসকোখুসকো। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে আবার ঠোঁটের রক্ত মুছে সে চালকের আসনে বসল। সাম্যব্রত গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দরিয়ার পাশে বসলেন। দরিয়া দেখল, বাবিন জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দরিয়া হাতজোড় করে বলল, “অনেক ধন্যবাদ স্যর।”

বাবিন অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে চাপড় মেরে বলল, “রাজু! বেরিয়ে যা। ওখান থেকে ফিরে একবার আমার সঙ্গে দেখা করিস।”

কথা না বলে রাজু অ্যাম্বুল্যান্সে স্টার্ট দিল।

হাওড়া স্টেশনের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা পুরনো আর নতুন স্টেশন কমপ্লেক্স পেরিয়ে রেল মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে গিয়ে ফোরশোর রোডে পড়েছে, সেই রাস্তা ধরেছে রাজু। এই এলাকাটা রেল পুলিশের আওতায় বলে গন্ডগোল নেই। অল্প কিছু হকার আর ট্রেনযাত্রীদের দেখা যাচ্ছে।

অ্যাম্বুল্যান্সে ফার্স্ট এড বক্স আছে। রেল মিউজিয়ামের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাজুর ড্রেসিং করে দিলেন সাম্যব্রত। গাল আর কপালের রক্ত বন্ধ হল।

মিনিট পাঁচের মধ্যে রাজুর চেহারা ভদ্রস্থ হয়েছে। উসকোখুসকো চুলে চিরুনি বুলিয়ে, টেরিটি কায়দা মতো কেটে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে গান ধরল, “চল চল চল মেরে সাথী, ও মেরে হাথি…”

হঠাৎ গান থামিয়ে সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে রাজু বলল, “রাজু হেলা খারাপের কাছে খারাপ। ভালর কাছে ভাল। ওই বাবিনকে রাজু হেলা ঠিকই সালটে নেবে। কিন্তু আপনার সঙ্গে আজ থেকে রাজু হেলার অন্য সম্‌পক্কো। পাঁচ হাজার নয়। ওটা আমি এক হাজার করে দিলাম। ঠিকাচে?”

সাম্যব্রত মাথা নিচু করে ভাবলেন, রাজুর মুড ভাল থেকে খারাপ হয়ে যাওয়ার আগে টাকাটা নিয়ে নেওয়া যাক। তিনি হাত পেতে বললেন, “দাও।”

পকেট থেকে দুটো দু’হাজার টাকার নোট বার করে রাজু বলল, “আমরা বঙ্গবাসী হাসপাতালে এসে গিয়েছি।”

কলেজে পড়ার সময়ে একবার বঙ্গবাসী হাসপাতালে এসেছিল দরিয়া। সেদিনই বিহানের মায়ের সঙ্গে তার প্রথম ও শেষ দেখা। সেই দিনটার কথা এখন দরিয়া মনে করতে চায় না। অ্যাম্বুল্যান্সের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখল, সবকিছু আগের মতোই আছে। বড় বড় বিল্ডিং, অজস্র মানুষের ভিড়, মাঝখানের খোলা জায়গায় কিছু গাছপালা।

সাম্যব্রত আর রাজু অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নেমে গিয়েছে। দরিয়া পায়ের গোছ থেকে শাড়ি সরিয়ে দেখল, ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে গিয়েছে। তার উপরে এই লেবার পেন। গর্ভযন্ত্রণা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে দরিয়া। ভয়ের চোটে বিপত্তারিণীর ফুল-ভরতি আঁচলের খুঁট হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “আমাকে ভাল করে দাও ঠাকুর। দেখো, তোমারও ভাল হবে!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *