শেষ নাহি যে – ৪

বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্সের সেন্সরে আঙুলের ছাপ দিয়ে পোর্টের ভিতরে ঢুকে মোবাইলে সময় দেখল বিহান। সওয়া দশটা বাজে। পনেরো মিনিট দেরি করার জন্য মিস্টার দাসের কাছে আজেবাজে কথা শুনতে হবে। লোকটা খেঁকুড়ে টাইপের।

নিজের অফিসের দিকে না গিয়ে মিস্টার দাসের চেম্বারের দিকে এগোল বিহান। উনি যদি এখনও নিজের চেম্বারে থাকেন, তা হলে বিহান বেঁচে গেল। সে যে পনেরো মিনিট দেরি করেছে, এটা উনি বুঝতে পারবেন না।

আজকের দিনটা বিহানের পক্ষে শুভ নয়। মিস্টার দাসের চেম্বারে ঢোকার মুখেই ওর চামচা বলল, “স্যর তোমার কাছে গেলেন। পোর্টের ম্যানেজার ফোন করে স্যরকে ধাতানি দিয়ে বলেছেন, কার্গোর লোডিং আর আনলোডিং নিয়ে ডেটা এন্ট্রিতে চার মাসের ব্যাকলগ আছে। স্যর তোমার ওপরে বহুত খচে আছেন।”

সর্বনাশ করেছে! বিহান নিজের অফিসের দিকে দৌড় দিল। লম্বা করিডর দিয়ে দৌড়ে ডানদিকে ঘুরে একটা ঘুপচি গলি দিয়ে কয়েক পা গেলেই তার বসার খুপরি।

করিডর দিয়ে দৌড়তে গিয়ে ব্রেক কষল বিহান। ডানদিকের গলি থেকে বেরিয়ে এসেছেন মিস্টার দাস। মুখে বিরক্তি আর রাগের ছাপ স্পষ্ট। বিহানকে দেখে বললেন, “দৌড়ে আসার দরকার নেই। তুমি লেট।”

“স্যরি স্যর!” হাঁপাচ্ছে বিহান।

“স্যরি কেন বলছ? তুমি তো প্রত্যেক দিনই লেট করো!” বিহানকে পেরিয়ে যাচ্ছেন মিস্টার দাস। বিহান পিছন পিছন হাঁটছে, “কোনও দিনও করি না স্যর। আজই হয়ে গেছে।”

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে মিস্টার দাস বললেন, “তুমি এখন যাও।”

অন্য যে কেউ হলে চলে যেত। মিস্টার দাস এখন রেগে আছেন। একটু পরেই রাগ পড়ে যাবে। তখন বললেই হল, “আর কোনও দিনও হবে না স্যর। এবারের মতো মাফ করে দিন।” মিস্টার দাস বলতেন, “ঠিক আছে, যাও।” সব মিটে যেত।

কিন্তু আজ বিহানের হাতে সময় নেই। আজ কনট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। সে বলল, “স্যর, আপনার সঙ্গে একটা দরকার ছিল।”

মিস্টার দাস বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমাকে তো যেতে বললাম। আবার কী হল?”

চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বিহান বলল, “স্যর, আমার রিনিউয়ালটা…”

মিস্টার দাস নিজের কেবিনে ঢুকলেন। চেয়ারে বসে রিমোট টিপে দেওয়ালে মাউন্ট করা টিভি চালিয়ে বললেন, “তোমার বিরুদ্ধে পোর্ট থেকে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। কার্গোর লোডিং আর আনলোডিং-এর ডেটা এন্ট্রিতে চার মাসের ব্যাকলগ কেন?”

কথা বাড়ালেই বিপদ। কিন্তু আজ বিহান নিরুপায়। সে বলল, “স্যর, কাজটা আমাকে একা তুলতে হচ্ছে।”

“তো?” বললেন মিস্টার দাস।

“সনতের কাজটাও আমাকেই করতে হয় স্যর,” গড়গড় করে বলে দিল বিহান, “ও সপ্তাহে মাত্র দু’দিন অফিসে আসে। সেই দু’দিনও কাজ না করে সংগঠনের মিটিং করে।”

ভুরু কুঁচকে মিউট করা টিভির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মিস্টার দাস। সামান্য ভেবে বললেন, “তুমি এক কাজ করো। তোমার এই অভিযোগটা লিখিত আকারে আমাকে দাও। পোর্টের বড়কর্তার জন্যও একটা কপি দিয়ো।”

এ তো মহা গেরো! বিহান সামান্য কনট্র্যাকচুয়াল স্টাফ। লিখিত অভিযোগ জানাতে গিয়ে কী বিপদে পড়বে কে জানে! হয়তো চাকরিটাই চলে যাবে। অজানা আশঙ্কায় দু’হাতের পাতায় মুখ ঢাকল বিহান। তারপর নিজেই নিজেকে সাহস জুগিয়ে বলল, ঝামেলায় গিয়ে কী দরকার? যা বলার বলা হয়ে গেছে। একটা দেঁতো হাসি দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল শুরু করল বিহান, “আমি তো স্যর কথার কথা বললাম। এবারের মতো মাফ করে দিন।”

“ওইভাবে কথা ঘোরানো যায় নাকি?” মিস্টার দাসের গলায় যেন মিছরির ছুরি, “তোমার কাজের অসুবিধে হচ্ছে। সেটা তুমি লিখিত জানাবে না? মৌখিক অভিযোগের তো কোনও গুরুত্ব নেই।”

“ভুল হয়ে গেছে স্যর,” বিহানের দেঁতো হাসি বন্ধ হয়ে গেছে।

মিস্টার দাস বললেন, “সনৎ কুইলা খরাজ পার্টির রাজ্যস্তরের নেতা। এটা তুমি জানো?”

“জানি স্যর। ও আমার স্কুলের বন্ধু।”

“সনৎই তোমাকে এই চাকরিতে ঢুকিয়েছে। তাই না?” জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার দাস।

“হ্যাঁ স্যর।”

“তা হলে তোমার জানা উচিত যে, ও কোনও কাজ করবে না। তোমাকেই ওর সব কাজ তুলে দিতে হবে।”

“হ্যাঁ স্যর।” বিহান ঠিক করেছে ‘হ্যাঁ স্যর’ ছাড়া অন্য কোনও কথা সে এখন বলবে না।

“তা হলে তুমি মেনে নিচ্ছ যে তোমার কাজে গাফিলতি হয়েছে?”

“হ্যাঁ স্যর।”

“কাজে গাফিলতি হলে তোমার অ্যানুয়াল কনট্র্যাক্ট রিনিউয়াল কী করে করি বলো তো? কাল অন্য একজন ফাঁকিবাজ স্টাফ এসে বলবে, ‘স্যর, কনট্র্যাক্ট রিনিউয়াল পেপারে সই করে দিন।’ আমাকে তখন সেটাও মেনে নিতে হবে। এইসব দু’নম্বরি প্রবণতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা ভাল।”

বিহান বুঝতে পারছে, মিস্টার দাস তাকে নিয়ে খেলছেন। হুলোবেড়াল যেমনভাবে থাবার মধ্যে ইঁদুরছানাকে নিয়ে খেলে, ঠিক সেইভাবে। কিন্তু বিহানের কিছু করার নেই। তাকে এই চাকরিটা রাখতে হবে। মাসের শেষে পনেরো হাজার টাকা তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকে।

মিস্টার দাসের টেবিলের পাশে গিয়ে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বিহান বলল, “এইবারের মতো ক্ষমা করে দিন স্যর। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে। টাকাটা খুব দরকার।”

এক ধাক্কায় বিহানকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মিস্টার দাস। চিৎকার করে বলছেন, “‘এইসব সস্তা মেলোড্রামা আমার সঙ্গে একদম করবে না! গেট আউট! বেরিয়ে যাও আমার চেম্বার থেকে।”

টেবিলের পাশ থেকে সরে দাঁড়াল বিহান। টিভির দিকে একপলক তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার দাস।

সামনের মাস থেকে চাকরিটা রইল কি না কে জানে! বিহান চোখের জল মুছছে। মিস্টার দাসের চেম্বারে থাকার আর কোনও মানে হয় না। বরং নিজের খুপরিতে গিয়ে সারাদিন খেটে যদি কাজটা তুলে দেওয়া যায়, তা হলে আগামীকাল আর একবার মিস্টার দাসকে বলা যাবে। সনৎকেও বলে দেখতে হবে। ও চাকরি দিয়েছিল। চাকরি যাওয়া ও-ই আটকাতে পারবে বলে মনে হয়।

মিস্টার দাসের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে টিভির দিকে নজর গেল বিহানের।

মিউট করে রাখা টিভির পরদায় আছড়ে পড়ছে একের পর এক নিউজ় ক্লিপ। পরদার নীচে পিঁপড়ের মতো হাঁটছে নিউজ় স্ক্রল। ‘আততায়ীর গুলিতে নিহত গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বোস। খুনি পলাতক।’ ‘মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের শোকপ্রকাশ।’

দাসের টেবিল থেকে রিমোট তুলে নিয়ে টিভিতে শব্দ দিল বিহান। স্কুপ নিউজ় চ্যানেলে কথা বলছেন খরাজ পার্টির সুপ্রিমো সুধাকর ঘোষ। “আজ সকাল সাড়ে সাতটায় গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসু অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর স্বামী, গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতা মনোজ বসুকে সহানুভূতি জানানোর জন্য কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। আমি একটু বাদেই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। পাশাপাশি অন্য একটা কথা না বললেই নয়। সেটা হল, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে গণতান্ত্রিক মোর্চা। পুলিশি তদন্ত চলাকালীন মনোজ বসু বলতে শুরু করেছেন, ‘খরাজ পার্টির লোকেরা মানসী বসুকে খুন করেছে।’ বাংলার বুকে মনোজ কি খাপ পঞ্চায়েত বসিয়েছেন? উনি কী করে জানলেন, খুনি কে? তার রাজনৈতিক পরিচয় কী? ওঁর বক্তব্য সম্প্রচার হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে গণতান্ত্রিক মোর্চার চারজন পার্টিকর্মী খুন হয়েছেন। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, অবিলম্বে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিন। জেনে রাখবেন, প্রতিটি জেলায়, মহল্লায়, পাড়ায় এবং প্রতিটি বুথে আমাদের কর্মীরা সতর্ক আছেন। একজনের গায়ে হাত পড়লে রাজ্যে কিন্তু আগুন জ্বলবে।”

এইসব দৃশ্য আর শব্দ বিহানের মস্তিষ্কে কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করল না। সে রিমোটের মিউট বাটন টিপে টিভিকে শব্দহীন করল। মিস্টার দাসের কেবিন থেকে বেরিয়ে এগোল নিজের খুপরির দিকে। এখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দরিয়ার সঙ্গেও না। মনে হচ্ছে, পোর্টের সব্বাই জেনে গিয়েছে যে তার চাকরি নেই।

কম্পিউটারের সামনে বসতে না বসতেই কলকলিয়ে উঠল মোবাইল। নির্ঘাত দরিয়া ফোন করেছে।

মোবাইল হাতে নিয়ে বিহান দেখল, ফোন করেছেন সাম্যব্রত। উনি সাধারণত কোনও দরকার ছাড়া ফোন করেন না। ফোন কানে দিয়ে বিহান বলল, “বলুন।”

“যা বলছি, ঠান্ডা মাথায় শোনো। প্যানিক কোরো না। ঠিক আছে?” বললেন সাম্যব্রত।

কথাগুলো প্যানিক তৈরির জন্য যথেষ্ট। বিহান শুকনো গলায় বলল, “শুনছি।”

“দরিয়ার লেবার পেন শুরু হয়েছে।”

“এ তো ভাল কথা!” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিহান।

“কথা না বলে চুপচাপ শোনো,’ জামাইকে মৃদু ধমক দিলেন সাম্যব্রত, “তুমি জানো কি না জানি না, গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসু আজ সকালে খুন হয়েছেন।”

“এইমাত্র জানলাম,” বলল বিহান, “টিভি দেখে মনে হল কলকাতায় খরাজ পার্টি আর গণতান্ত্রিক মোর্চার মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়েছে।”

বিহানকে থামিয়ে দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “দরিয়াকে নিয়ে নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিকে আসছিলাম। গণতান্ত্রিক মোর্চা আর খরাজ পার্টির মারামারির মধ্যে পড়ে দরিয়ার পায়ে বোমার টুকরো ঢুকে গেছে। হাতে লাঠির আঘাত লেগেছে।”

“দরিয়া কেমন আছে?” কম্পিউটার শাট ডাউন করছে বিহান। মাউস নাড়ানোর সময়ে হাত কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এই শীতেও গলগল করে ঘামছে সে।

“আপাতত ভাল আছে।”

“আপাতত ভাল আছে? এই কথাটার মানে কী?” কথা বলতে বলতে অফিস থেকে বেরিয়ে গলিতে পড়েছে বিহান।

“মেটারনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার মিত্র বললেন, পায়ে বোমার টুকরো অপারেশন করে বার করতে হবে। দরিয়ার ডেলিভারি ওখানে হবে না। এখন দরিয়াকে নিয়ে হাওড়ার বঙ্গবাসী হাসপাতাল যাচ্ছি। শুনলাম হাওড়ার রাস্তায় গন্ডগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। তোমাদের ওদিকের কী খবর?”

“এখনও পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে।”

“তুমি কি আসতে পারবে?” কুণ্ঠাভরে জিজ্ঞাসা করলেন সাম্যব্রত, “আমি একাই সবটা সামলে নেব। তবে পাশে কেউ একজন থাকলে একটু জোর পেতাম। মেয়েটাও বারবার তোমার কথা বলছে। ওর মোবাইল ফোনটা গন্ডগোলের সময়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। আমি ওর নম্বরে ফোন করে দেখেছি। বলছে, ‘সুইচ্‌ড অফ’। কেউ ঝেঁপে দিয়েছে!”

“ওকে একবার ফোনটা দিন,” নরম গলায় বলল বিহান। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল। পোর্টের সামনের রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেলা এগারোটার সময় বাসস্ট্যান্ডে যত লোক থাকার কথা, তত লোক এখন নেই। অভিরুচি রেস্তরাঁর সামনে সারাদিন ভিড় লেগে থাকে। আজ দোকান খোলা থাকলেও খদ্দের নেই। কলকাতাগামী একটা বেসরকারি বাস প্যাঁ-প্যাঁ করে হর্ন বাজিয়ে স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। বাসে যাত্রীর সংখ্যা হাতে-গোনা। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, “যাঁরা যাবেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। এর পরে আর বাস নেই!”

হর্নের শব্দদূষণের সঙ্গে যোগ হয়েছে মোবাইলের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের শব্দ। তার মধ্যে শোনা যাচ্ছে দরিয়ার গলার আওয়াজ, “বিহান, তুমি কোথায়? এত আওয়াজ হচ্ছে কেন?”

দরিয়ার গলার আওয়াজ বৈশিষ্ট্যহীন। হাস্কি নয়, সুরেলা নয়, কোকিলকণ্ঠীও নয়। কিন্তু ওই বৈশিষ্ট্যহীন গলার আওয়াজ শুনেই বিয়ের এতদিন পরেও শ্বাস গাঢ় হয়ে আসে বিহানের। মনে হয়, এক্ষুনি গিয়ে বউটাকে জড়িয়ে ধরে। দরিয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন থেকেই ওর গলার আওয়াজ ভাল লাগত বিহানের। ডালভাত খেয়ে যে শান্তি পাওয়া যায়, দরিয়ার গলার আওয়াজ শুনে সেই শান্তি পায় বিহান।

বিহান বলল, “আমি রাস্তায়। তুমি কেমন আছ?”

“ভাল আছি। খুব ভাল আছি।”

“ইস! কী মিথ্যুক আমার বউটা! তোমার বাবার কাছ থেকে সব খবর পেয়েছি। অফিস থেকে এই বেরলাম। মেসে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাস ধরব। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমার কাছে পৌঁছে যাব।”

“ইস! কী মিথ্যুক আমার বরটা!” বিহানের কথা বলার ধরন নকল করে বলল দরিয়া, “বকুলতলা থেকে বাসে হাওড়া আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। আমি যেন জানি না!”

দরিয়ার হাসিতে ক্লান্তির ছাপ। বিহান বলল, “পাড়ায় গুন্ডামি শুরু করেছ নাকি? মাথায় আর পায়ে লাগল কী করে?”

“গুন্ডামি কি শুধু ছেলেরাই করতে পারে?”

“তোমার গুন্ডামি তো সেই সরস্বতী পুজোর দিন থেকে দেখে আসছি। যেদিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল,” বলল বিহান। তার কথা শুনে দরিয়া আবার হাসছে। হাসি শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে বিহানের। যাক বাবা! ওর তা হলে খুব বেশি চোট নেই। আর থাকলেও সেটা ওকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সাম্যব্রতকে বলতে হবে, দরিয়াকে এই সময়টা টেনশনমুক্ত রাখতে। শারীরিক কষ্টের সঙ্গে যেন মানসিক কষ্ট জুড়ে না যায়। বিহান ঠিক করল, নিজের কাজের ঝামেলার কথা দরিয়াকে বলবে না। বিহান যদি পাখি হত, তা হলে এক্ষুনি ডানা মেলে উড়ে যেত। পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার উড়ে অন্য মহাদেশে পৌঁছয়। আর সে মাত্র একশো কিলোমিটার উড়ে যেতে পারবে না?

পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে বিহান বলল, “আমি যতক্ষণ না তোমার কাছে পৌঁছচ্ছি ততক্ষণ আমরা দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা… এইসব নিয়ে ভাবব না। এইসব নিয়ে কথা বলব না। আমরা অন্য কথা ভাবব। আমরা অন্য কথা বলব। ঠিক আছে?”

“কী নিয়ে কথা বলব তা হলে?”

“আমি তার কী জানি!” হাসল বিহান, “তুমি কিছু একটা বলো।”

“আমি কিছু বলব না। তুমি বলো।”

বিহান সামান্য ভেবে বলল, “কাল রাতে আমি আর সনৎ মিলে মদ খেয়েছি। বেশি না। অল্প!”

“এইটা ভাল কথা হল?” ছদ্মরাগ দরিয়ার গলায়, “আমাকে না দিয়ে খেয়ে নিলে? কী স্বার্থপর গো তুমি!”

ফিক করে হেসে বিহান বলল, “তুমি আর আমি মিলে কোথায় ভদকা খেয়েছিলাম মনে আছে?”

“ওইসব ছাইপাঁশ খাওয়ার কথা মনে থাকবে না? খুব মনে আছে।”

“মাতাল হয়ে তুমি আমাকে কী বলেছিলে মনে আছে?”

নিচু গলায় দরিয়া বলল, “বাবা পাশে বসে রয়েছে।”

“আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলি?”

“বলো।”

“মদ খেয়ে তুমি বুধনকাকার মতো হিন্দি মেশানো বাংলা বলা শুরু করেছিলে,” জড়ানো গলায় অভিনয় করছে বিহান, “তুমি বলেছিলে, ‘অ্যাই বিহানোয়া! তুমি হামকো ভালবাসতা হ্যায়?’ আমি বলেছিলাম, ‘বাসতা হ্যায়।’ তুমি বলেছিলে, ‘সত্যি সত্যি বাসতা হ্যায় না মিথ্যে মিথ্যে বাসতা হ্যায়?’ আমি বলেছিলাম…”

ওপার থেকে ক্লান্ত গলায় দরিয়া বলল, “ঠিক আছে। আমার মন ভাল হয়ে গেছে। পরে আবার কথা হবে।” তারপরে ফোন কেটে দিল।

মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে গলা থেকে মাফলার খুলল বিহান। হনহন করে হেঁটে এসে গরম লাগছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাটাও কমেছে। সামনেই মেস।

বিহান ঘরে ঢুকে দেখল, সনৎ এখনও খাটেই লেপমুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে। মোবাইলে কাউকে উত্তেজিত গলায় বলছে, “আমার একটাই কথা। হামলা হলে পাল্টা হবে।” বিহানকে দেখে ফোন কেটে ভুরু নাচিয়ে বলল, “তুই অফিস থেকে চলে এলি?”

ন্যাপস্যাকে বাসি জামাকাপড় ভরতে ভরতে বিহান বলল, “সনৎ, আমাকে কিছু টাকা ধার দিবি? দরিয়ার লেবার পেন শুরু হয়েছে। আমাকে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে।”

“বাচ্চাটা কার?” বিচ্ছিরিভাবে হাসছে সনৎ, “তুই তো সারা সপ্তাহ এখানে থাকিস। অন্য কেউ ব্যাটিং করে দেয়নি তো?”

বিহান মাথা নিচু করে বলল, “তুই আমাকে যত ইচ্ছে অপমান কর। কিন্তু প্লিজ় হাজার দশেক টাকা ধার দে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি শোধ করে দেব।”

“কী ভাবে করবি? দাসদা তো তোর চাকরির অ্যানুয়াল কনট্র্যাক্ট রিনিউ করেননি।” সনতের চোখ জ্বলন্ত সিগারেটের মতো লাল।

আত্মসম্মানের শেষ ফোঁটা বিসর্জন দিয়ে সনতের পা ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল বিহান, “আমার ভুল হয়ে গেছে সনৎ। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে।”

“দাসদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তুই আমার নামে ওঁকে যা যা বলেছিস, সব বলেছেন। যার নামে এক্ষুনি চুকলি কেটে এলি, তার পা ধরতে কেমন লাগে রে?”

বিহান নিচু গলায় বলল, “দরিয়াকে তুই ভালবাসতিস। কিন্তু দরিয়া তোকে কখনও ভালবাসেনি। তুই কেন ভাবিস যে, আমি দরিয়াকে তোর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি? ও কোনওদিনও তোর ছিল না। তুই বিয়ে করে ফেল সনৎ। একটা মেয়ের ভালবাসা পেলেই তুই পুরনো সব কথা ভুলে যাবি।”

বিহানের কথা শুনে সনৎ এক ঝটকায় পাশ ফিরল। বালিশের তলা থেকে মোটা মানিব্যাগ টেনে নিয়ে দুটো পাঁচশো টাকার নোট ছুড়ে দিয়ে বলল, “ভিখিরি কোথাকার! ফোট্‌ এখান থেকে! আমার এখন অনেক কাজ।”

দশ হাজার টাকা চেয়ে পাওয়া গেল এক হাজার টাকা। তাই সই। বিহানের পার্সে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। আশা করি এতে হয়ে যাবে।

নোটদুটো তুলে নিয়ে বিহান বলল, “তুই কীভাবে ফিরবি? রাস্তাঘাটের অবস্থা ভাল নয়।”

“তাই নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। ফোট্‌ শালা!” আবার মোবাইল তুলে নিয়েছে সনৎ।

“আমার কাজটা থাকবে তো রে?”

“তুই যাবি এখান থেকে?” গর্জন করে উঠল সনৎ, “নাকি লাথি মেরে বার করে দেব?”

বিহান ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে মেস থেকে বেরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *