শেষ নাহি যে – ৩

দরিয়া অনেকদিন ধরেই ঠিক করে রেখেছে যে উল্টোপাল্টা খরচ করবে না। কিন্তু বুধনের ফুচকা দেখলে মাথার ঠিক থাকে না। কোন কাস্টমারের কী চাহিদা সেটা বুধন খুব ভাল করে জানে! এ পাড়ার সবাই বুধনের পুরনো কাস্টমার। ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, গোলমরিচ, ধনেপাতা দিয়ে পুরটা দুর্দান্ত বানায়। নোনতা নোনতা, টক টক তেঁতুলগোলা জলের কথা ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। ওই জিনিস ছাড়া যায় নাকি? তখন খরচ কমানোর কথা মাথা থেকে উড়ে যায়।

বুধনের কাছ থেকে মাত্র দুটো ফুচকা খেয়েছিল দরিয়া। ওই খেয়েই পেট খারাপ। তলপেটে মোচড় দিচ্ছে। একবার টয়লেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। মুশকিল হল, পেটে মোচড় দিলেও বেগটা আসছে না। বিছানা থেকে না উঠে, দরিয়া অপেক্ষা করতে লাগল, কখন সাম্যব্রত চা নিয়ে আসবেন।

গর্ভাবস্থার ছ’মাস পর্যন্ত বাড়ির সব কাজই দরিয়া করত। রান্না করা, ঘর সাফাই, জামাকাপড় কাচা, বাসন মাজা বা সাপ্তাহিক বাথরুম পরিষ্কার— সব। কাজের লোক রাখার সামর্থ্য তাদের নেই। ছ’মাসের মাথায় নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিকের গাইনিকলজিস্ট ডাক্তার মিত্র বলে দিলেন, “বাড়ির কাজ আর করা যাবে না। দরিয়ার ব্লাড প্রেশার বেশি। ডেলিভারির সময়ে সমস্যা হতে পারে।”

সেই থেকে সব কাজ সাম্যব্রত করেন।

প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়া নিয়ে দরিয়ার আপত্তি ছিল। ওসব জায়গায় অনেক খরচ। সাম্যব্রত মেয়ের কথা শোনেননি। ভারী গলায় বলেছেন, “পাড়ার মধ্যে ছোট্ট মেটারনিটি ক্লিনিক। শুধু নরমাল ডেলিভারি আর সিজ়ারিয়ান সেকশন হয়। ডাক্তার মিত্র আমার চেনা। পনেরো হাজার টাকার প্যাকেজ। ওটা বেড়ে বড়জোর কুড়ি হবে। ওই নিয়ে তুই ভাবিস না।”

দরিয়া কখনও সাম্যব্রতর মুখের উপরে কথা বলে না। সে চুপ করে গিয়েছে। সব ভালয় ভালয় মিটে গেলে বাবাকে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। টিউশনি করে সে-ও অল্পবিস্তর টাকা জমিয়েছে।

সকাল আটটার সময়ে প্লাস্টিকের ট্রেতে তিন কাপ চা নিয়ে হাজির সাম্যব্রত। মেয়েকে বললেন, “আজ ঠান্ডাটা একটু কম বলে মনে হচ্ছে না?”

আধশোওয়া হয়ে, চায়ের কাপ গালে ঠেকিয়ে দরিয়া বলল, “আমার তো ভীষণ শীত করছে।”

“বড্ড শীতকাতুরে হয়েছিস।” ট্রে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। এখন ওখানে বসে কত্তা-গিন্নি একসঙ্গে চা খাবেন আর গল্পগাছা করবেন।

বাবা আর মায়ের প্রেম দেখে হিংসে হয় দরিয়ার। বুড়োবয়সে প্রেম বাড়ে কি না কে জানে! সাম্যব্রত তো সীমাকে ছেড়ে এক ঘণ্টাও থাকতে পারেন না। বাজারহাট যাওয়া, পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারতে যাওয়া, সকাল বিকেল হাঁটতে বেরনো… যাই করুন না কেন, সেটা চুকিয়ে সীমার পাশে বসে পড়েন। তারপরে দু’জনে মিলে নিচু গলায় বকরবকর শুরু হয়ে যায়।

এক কাপ চা শেষ করেও টয়লেটের বেগ এল না। তলপেটের কিনকিনে ব্যথাটা যাওয়ার নাম করছে না। বিহানের সঙ্গে একবার কথা বলবে নাকি? থাক বাবা! দরকার নেই। ওর ফেরার কথা আগামীকাল। তার আগে এই সব ঝামেলা ওর কানে না তোলাই ভাল।

মোবাইলের ঘড়ি বলছে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বিহান রোজ সকাল সাড়ে দশটার সময়ে ফোন করে। সকালের দিকে মেসে অনেক কাজ থাকে। ফোনে কথা শুরু করলে অফিস যেতে দেরি হয়ে যায়। বিশেষ দরকার না থাকলে রুটিন ভাঙে না দরিয়া। আজ ভাঙবে কি? বুঝতে পারছে না। একবার সীমার সঙ্গে কথা বলবে?

দরিয়ার এই মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে বসবাস-এর সামনে হঠাৎ গুড়ুম করে শব্দ হল, লরির টায়ার ফেটে গেলে এইরকম শব্দ হয়। চমকে উঠে কানে হাত চাপা দিল দরিয়া। ঠিক এই সময়ে রাস্তা দিয়ে একদল ছেলে হইহই করে চলে গেল। বিছানা সংলগ্ন টেবিলে চায়ের কাপ রেখে, লেপ সরিয়ে বিছানা ছাড়ল দরিয়া। দাঁড়াল জানালার সামনে। হঠাৎ কী শুরু হল!

সাম্যব্রত দরিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, “গণতান্ত্রিক মোর্চার ছেলেগুলো দৌড়চ্ছে কেন? বোমাটা ওরাই ফাটাল।”

“ওটা বোমা ফাটার আওয়াজ ছিল?” সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল দরিয়া, ‘আমি ভাবলাম লরির টায়ার ফাটল।”

“না, ওটা বোমা ফাটার আওয়াজ,” বললেন সাম্যব্রত।

পাড়ার মধ্যে প্রকাশ্যে বোমাবাজি কখনও দেখেনি দরিয়া। তার ধারণা ছিল, ওসব দূরে হয়। খারাপ জায়গায় হয়। শুধু টিভির নিউজ়ে দেখা যায়। তাদের পাড়া খুব শান্ত, ভদ্র। এই পাড়ায় গুন্ডা বদমাশ নেই।

হঠাৎ দরিয়া দেখল, মুখে রুমাল বাঁধা একদল ছেলে বুধনকে ঝুপড়ি থেকে টেনে বার করে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল। এলোপাথাড়ি কিল, ঘুষি, লাথি। যন্ত্রণায় বুধন চিৎকার করতে লাগল।

হ্যাঁচকা টান মেরে দরিয়াকে জানালার কাছ থেকে সরিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “হাটুরে মার মারছে। লোকটা বোধ হয় বাঁচবে না।”

“বুধনকাকাকে কেন মারছে ওরা?” বলতে বলতে দরজার দিকে দৌড়েছে দরিয়া, “লোকটা পার্টি-পলিটিক্স করে না। ওকে কেন মারবে?”

সাম্যব্রত আটকানোর আগেই দরজা খুলে বারান্দায় চলে গিয়েছে দরিয়া। দেখছে, বুধন মাথায় হাত দিয়ে ছুটছে। চার-পাঁচ পা ছুটে গিয়ে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল বুধন। সেটা দেখে দরিয়া চিৎকার করে ছেলেগুলোকে বলল, “নিরীহ মানুষকে ধরে মারিস। তোদের লজ্জা করে না?” মুখে রুমাল বাঁধা ছেলেটা দরিয়ার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকাল। দেখে দরিয়ার পেট গুড়গুড় করে উঠল।

সাম্যব্রত মেয়ের হাত ধরে শোওয়ার ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। দরিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে খেয়াল করল, আশেপাশের বাড়ির দরজা জানালা ফটাফট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দোকানের শাটার নেমে যাচ্ছে ঘড়ঘড় করে। রাস্তা এখন জনহীন। পাড়ায় কোনও মানুষ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

সাম্যব্রত নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে টিভি চালিয়েছেন। নিউজ় চ্যানেলে গিয়ে আঁতকে উঠে বললেন, “সে কী? কখন হল? জানতেই পারিনি!”

সীমা টিভির দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “খুন হয়েছেন? কখন?”

দরিয়া বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে টিভির দিকে তাকাল। চ্যানেলের সঞ্চালক পরিমল বলছে, “আজ সকাল সাড়ে সাতটায় রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে মর্নিংওয়াক করার সময়ে অজানা এক আততায়ীর গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসুর শরীর। বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেছেন। তাঁর মরদেহ এখনও রাখা রয়েছে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে। ময়নাতদন্তের পরে দেহ তুলে দেওয়া হবে তাঁর স্বামী, গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতা মনোজ বসুর হাতে।”

দরিয়ার মাথায় ঘুরছে মাথায় লাঠির আঘাত খাওয়া বুধনের মুখ। লোকটা হয়তো এখনও মরেনি। দরিয়া বলল, “বুধনকাকাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কি বাঁচানো যাবে?”

“গন্ডগোলের মধ্যে বাইরে বেরবি? পাগল হয়ে গেলি না কি?” মেয়ের হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়েছেন সাম্যব্রত। টিভিতে পরিমল বলছে, “মানসীদেবীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকেই বিক্ষিপ্ত হিংসার খবর আসছে। গণতান্ত্রিক মোর্চা এবং খরাজ পার্টির কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে নাকাল হচ্ছেন কলকাতার মানুষ। বিবাদী বাগ এলাকায় তিনটি মিনিবাস জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে মিনিবাস মালিকেরা শহরের সমস্ত রুটে বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে বেসরকারি বাস, সরকারি বাস, ট্যাক্সি, অ্যাপ-ক্যাব এবং মেট্রো পরিষেবা অব্যাহত আছে। এবার আমরা চলে যাব গণতান্ত্রিক মোর্চার প্রধান, নিহত মানসী বসুর স্বামী, মনোজ বসুর কাছে। বলুন স্যর।”

পরদায় এখন মনোজ বসু। ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে বয়স। দুধসাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষটির চুল অনেক দিনই সাদা। দাড়িগোঁফও পেকে গিয়েছে। সব মিলিয়ে মুখটা কদমফুলের মতো লাগছে। তিনি মাপা গলায় বললেন, “যাঁর সঙ্গে জীবনের সাতাশটা বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। সেটা আমার ব্যক্তিগত বেদনার জায়গা। নিজস্ব শোক আমি ঘরের কোণে পালন করব। কিন্তু মানসী বসু শুধু আমার পত্নীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী। বাংলার মানুষের মনে তিনি আশার প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন। গত পনেরো বছর ধরে অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কিশলয় পার্টি সরকার চালাচ্ছে। বিরোধী দল খরাজ পার্টি হল কিশলয় পার্টির বি টিম। কিশলয় পার্টির হাতের পুতুল। মানসী বাংলার মানুষের মনে এই ভরসা জোগাচ্ছিলেন যে এই দুই মাফিয়াগোষ্ঠীকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করা যাবে। এই দুই দলের হুলিগানদের হাত থেকে বাড়ির মেয়ে-বউদের বাঁচানো যাবে। মানসীকে খুন করে সেই আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু চেষ্টা সফল হবে না। এই হত্যা প্রমাণ করে দিল, খরাজ পার্টি এবং তার সুপ্রিমো সুধাকর ঘোষ আমাদের ভয় পেয়েছে। তাই তারা মানুষ খুনের রাজনীতি করছে। বাংলার মানুষ এই মৃত্যুর বদলা চায়।”

মনোজের কথা শেষ হওয়া মাত্র পাড়ায় হইহই রব উঠল। সাম্যব্রত বিরক্ত হয়ে বললেন, “কোথায় মানুষকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করবে! তা না, লোক খেপাচ্ছে! এবারে গৃহযুদ্ধ বাঁধবে।”

টিভির পরদায় আবার পরিমল। সে বলছে, “মানসী বসুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হিংসা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”

সাম্যব্রত উত্তেজিত হয়ে সিগারেট ধরিয়ে হুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “একজন অন্তত সুস্থ মানুষের মতো কথা বললেন।”

দরিয়া বা সীমা কেউই ঘরের মধ্যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে সাম্যব্রতকে বকুনি দিল না। তাদের চোখ টিভির পরদায় আটকে রয়েছে। টিভিতে দেখাচ্ছে কলকাতার রাস্তায় বোমাবাজির দৃশ্য। ডালহৌসি এলাকায় পর পর মিনিবাস জ্বলছে। লোকেরা ভয়ার্ত মুখে দৌড়োদৌড়ি করছে। সরকারি বাসে অসহনীয় ভিড়। এসপ্লানেড মেট্রো স্টেশনে টিকিটের জন্য লম্বা লাইন।

দরিয়া দাঁতে দাঁত চিপে রয়েছে। এইসব দৃশ্য দেখার পর থেকে তার পেটের ব্যথা বাড়তে শুরু করেছে। পুরো পেট মোচড় দিচ্ছে এখন। এই অনুভূতি আগে কখনও হয়নি। সীমাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, “মা, আমার খুব পেট ব্যথা করছে।”

দরিয়ার কথা শুনে সীমা রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে বললেন, “কখন থেকে ব্যথা উঠেছে?”

“ভোর থেকেই। আমি ভেবেছিলাম ফুচকা খেয়ে…”

সীমা বিরক্ত হয়ে বললেন, “তখন বললে এই ঝামেলা পোহাতে হত না। তোর বাবা টুক করে তোকে রিকশায় তুলে নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিকে নিয়ে যেত।”

“এখন ওসব ভেবে লাভ নেই,” আলমারি থেকে পাজামা পাঞ্জাবি বার করে বাথরুমের দিকে এগোচ্ছেন সাম্যব্রত, “দরিয়ার শাড়ি, ম্যাক্সি আর টুকিটাকি জিনিসপত্র একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেডি করা আছে। আমি ওটা নিচ্ছি। তুমি আলমারি থেকে কুড়ি হাজার টাকা আমাকে বার করে দাও।”

দরিয়া বিছানা থেকে উঠেছে। ভাবে, মেটারনিটি ক্লিনিকে চলে গেলে ভালই হয়। সাম্যব্রতকে বাড়ি পাঠিয়ে ওখানে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। এই সব গন্ডগোল কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে।

বাড়িতে পরার ম্যাক্সি বদলে একটা সাধারণ শাড়ি পরে নিল দরিয়া। তার উপরে চাপিয়ে নিল গরম পোশাক। কাঁধের ব্যাগ নিতে গিয়েও নিল না। বাবার কাছে টাকা থাকবে। নিউ লাইফে পৌঁছে টাকা চেয়ে নেওয়া যাবে। ব্যাগের কী প্রয়োজন? মোবাইলটা সঙ্গে থাক। মেটারনিটি ক্লিনিকে ভরতি হয়ে যাওয়ার পরে বিহানকে ফোন করে জানিয়ে দেবে।

সাম্যব্রত ব্যাগ নিয়ে সদর দরজার সামনে গিয়ে দরিয়াকে বললেন, “আমি একটা টোটো ডাকছি। তুই আস্তে আস্তে আয়।” সীমা বিছানা থেকে কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে বিপত্তারিণীর ফুল দরিয়ার আঁচলে বেঁধে বললেন, “ওখানে পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করে দিস।”

দরিয়া মায়ের হাতে হাত রেখে বলল, “আচ্ছা।”

“আয়,” মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে আবার খাটে বসেছেন সীমা। হাতে নিয়েছেন টিভির রিমোট। আবার টিভিতে শুরু হয়েছে হিংসার খবর।

পাড়া থমথম করছে। রাস্তার উপরে পড়ে রয়েছে বুধনের দেহ। তার পাশ দিয়ে টোটো চালিয়ে আসছে লেডিস পিন্টু।

বছর চল্লিশের পিন্টুকে পাড়ার সবাই ‘লেডিস পিন্টু’ বলে ডাকে, কারণ তার হাবভাব মেয়েলি। লোকটা বিয়ে করেনি। দিনের বেলায় টোটো চালায় আর সন্ধেবেলা মুখে মেকআপ করে লিলুয়া স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। পাড়ার লোকে ওকে নিয়ে নানা কুকথা বলে।

সাম্যব্রত আর দরিয়ার সঙ্গে লেডিস পিন্টুর সম্পর্ক ভাল। ওর মোবাইল নম্বরও রাখা আছে দু’জনের কাছে। দরকারে ডেকে নেওয়া হয়। দরিয়া পিন্টুদা বলে ডাকে। সাম্যব্রত বলেন পিন্টু।

টোটো ঘুরিয়ে লেডিস পিন্টু বলল, “মরণ দশা! আজকের দিনেই ব্যথা উঠল? পার্টির ছেলেগুলো কী বিচ্ছিরি ভাবে মারপিট করছে তা জানিস? কখন কী হয়ে যায়!”

“জানি,” টোটোয় উঠে বলল দরিয়া, “বুধনকাকাকে কীভাবে মারল দেখেছ?”

“দেখব না আবার?” চোখের জল মুছে লেডিস পিন্টু বলল, “বুধনের বাড়ি বালিয়া জেলায়। বাংলায় ফুচকা বিক্রি করে দেশে সংসার চালাত। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। বালিয়ায় গিয়ে এক সপ্তাহের বেশি থাকতে পারত না। বুধনের বউ বলত, ‘বঙ্গাল আমার সতীন।’ সেই বাংলাই লোকটার কী অবস্থা করল দেখলি? বুধন ছিল আমার মতো। না ঘর কা, না ঘাট কা। না বাংলার, না বালিয়ার। তাই ও আমার ভাল বন্ধু ছিল। তোমরা ওকে মেরে দিলে।”

“তোমরা মানে! তোমরা কারা?” জিজ্ঞেস করলেন সাম্যব্রত।

“তোমরা, মানে যারা নর্মাল, তারা।” গলি থেকে বেরিয়ে প্রধান সড়কে পড়েছে লেডিস পিন্টু। “দেখছ না, তোমাদের মতো নর্মালরা দরজা এঁটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বসে আছে। এই সময় লেডিস পিন্টু না থাকলে পোয়াতি মেয়েটাকে নার্সিংহোম নিয়ে যেতে পারতে?”

পিন্টুর কথায় সায় দিয়ে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করছেন সাম্যব্রত। ঠিক এই সময়ে টোটোর পাশে গুড়ুম করে শব্দ হল। আগুনের ঝলকানিতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ধোঁয়ায় ভরে গেল রাস্তা। লেডিস পিন্টু চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলল, “পোয়াতি মেয়ে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। এখন কেউ ঝামেলা করবি না বলে দিলাম।”

সাম্যব্রত দরিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “পিন্টু, তাড়াতাড়ি চলো।”

দরিয়া ককিয়ে উঠে বলল, “বাবা, আমার পা! কিছু একটা ঢুকেছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”

“আর পাঁচ মিনিট মা। আমরা এসে গিয়েছি।” মেয়ের মাথা নিজের কোলে নিয়ে টোটোতে গুঁড়ি মেরে বসলেন সাম্যব্রত। তখনই তাঁর চোখে পড়ল, কয়েকটা ছেলে রাস্তার উপরে মারামারি করছে। পরিস্থিতি বুঝে সাম্যব্রত বললেন, “পিন্টু, ডানদিকের গলিতে ঢুকে যাও।”

লেডিস পিন্টু ঢুকে গেল ডানদিকের গলিতে। আর তখনই ঘটল অঘটনটা। একটা ছেলে দৌড়ে এসে টোটোর দিকে লাঠি ছুড়ল। লাঠিটা উড়ে এসে লাগল দরিয়ার হাতে। দরিয়ার হাত থেকে মোবাইল ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল। সাম্যব্রত অবাক হয়ে দেখলেন, দরিয়া ব্যথায় কুঁকড়ে বলে উঠল, “বি…হা…ন!” তারপরে চোখ বুজল।

“পায়ে বোমার টুকরো ঢুকেছে। ওটা বার করতে পারিনি। হাতের চোটটার জন্য চিন্তা নেই। আর বাচ্চা একদম ঠিক আছে।” বললেন ডাক্তার।

“যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল,” রুমাল দিয়ে টাকের ঘাম মুছলেন সাম্যব্রত। লেডিস পিন্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল।

ডক্টর মিত্র বললেন, “নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। পা থেকে বোমার টুকরোটা বার করার জন্য অপারেশন করতে হবে। আমি গাইনিকলজিস্ট। ওটা আমি পারব না।”

“অপারেশনটা তা হলে আজই করে দিন। আপনার চেনা কোনও সার্জনকে ডেকে নিন।”

“ডাকতেই পারতাম। কিন্তু অন্য সমস্যা আছে। বোম্ব ইনজুরি বা লাঠির আঘাত… এগুলো শারীরিক নির্যাতন বা ফিজ়িকাল অ্যাসল্ট। এর জন্যে পুলিশ কেস হবে।”

ফতুয়ার পকেট থেকে ইনহেলার বার করে একটা লম্বা টান দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “আপনি এখানে ডেলিভারিটা করে দিন। আমরা তারপর থানায় যাব।”

“এই পেশেন্টের ডেলিভারি এখানে হবে না।”

“মানে?” ইনহেলার পকেটে ঢুকিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “দরিয়ার প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা আপনি চেক আপ করলেন। এখন বলছেন ডেলিভারি করবেন না? এটা কী ধরনের কথা?”

ডক্টর মিত্র সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা শুধুমাত্র মেটারনিটি ক্লিনিক। আমি শুধু গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে ডিল করি। আপনার মেয়ের কেসটা কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে।”

সাম্যব্রত চুপ।

ডক্টর মিত্র বললেন, “ওকে সরকারি হাসপাতালে ভরতি করিয়ে ইনজুরি রিপোর্ট লেখাতে হবে। থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে। এগুলো রুটিন কাজ। কারও বিরুদ্ধেই কেউ কোনও ব্যবস্থা নেবে না। মেয়ে ভাল থাকলে ভাল। কিন্তু ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি হাজার ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আমি আপনাকে করজোড়ে অনুরোধ করছি, মেয়েকে হাওড়ার বঙ্গবাসী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

সাম্যব্রত কী বলবেন বুঝতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়লেন। ডক্টর মিত্র মোবাইলে কাউকে কিছু বললেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই স্ট্রেচারে তোলা হল দরিয়াকে। সে ফিসফিস করে সাম্যব্রতকে বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?”

সাম্যব্রত উত্তর দিলেন না। দেখলেন, স্ট্রেচার ঢুকে যাচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে। লেডিস পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাকে কত দেব?”

“মরণ দশা আমার!” কপালে হাতের তালু ঠুকে লেডিস পিন্টু বলল, “ওরা তো যা দেওয়ার দিয়েছে। বোমা, লাঠি! আমি অন্যরকম। আমি আজ কিছু নেব না। যে টাকাটা বাঁচল, ওটা পরে কাজে লাগবে। এবার যাও। সাড়ে দশটা বাজে।”

সাম্যব্রত লেডিস পিন্টুর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠলেন। সাম্যব্রত দেখলেন, এই শীতেও দরিয়া ঘামছে। ঘোলাটে গলায় সে বলল, “বাবা, বিহানকে ফোন করো। আমার মোবাইলটা তো রাস্তায় পড়ে গেছে।”

আরে! জামাইকে এখনও ফোন করা হয়নি! মনেই ছিল না সাম্যব্রতর। তিনি নিজের মোবাইল থেকে বিহানের নম্বর ডায়াল করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *