শেষ নাহি যে – ২

সকাল ন’টার সময়ে দ্বিতীয়বারের জন্য ঘুম ভাঙল বিহান চট্টোপাধ্যায়ের। প্রথম বার ভেঙেছিল ভোর ছ’টার সময়ে। কোনওরকমে লেপ গায়ে জড়িয়ে, বিছানা ছেড়ে উঠে, বাথরুমে হিসি করে সেই যে বিছানা নিয়েছে, আর ওঠেনি। বাপ রে বাপ! কী ঠান্ডা! মোবাইলের অ্যাপ দেখাচ্ছে বকুলতলার তাপমাত্রা এখন আট ডিগ্রি। সঙ্গে গাঢ় কুয়াশা। ভিজ়িবিলিটি নিল।

সমুদ্রবন্দরের নিকটবর্তী বকুলতলার অবস্থান কলকাতা থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে। তাতেই কী ভয়ংকর ঠান্ডা রে ভাই! হাড়ের মধ্যে শীতের সুচ ঢুকে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে খটাখট শব্দ হচ্ছে। মুখ দিয়ে গলগল করে বাষ্প বার হচ্ছে। যে কেউ দেখলে ভাববে বিহান ধূমপান করছে।

কাল রাতে বিহান ধূমপান না করলেও ঠান্ডার থেকে বাঁচতে কারণবারি পান করেছিল সনতের সঙ্গে। দু’জনে মিলে রামের একটা ছোট বোতল শেষ করেছে। সঙ্গে ছিল ‘অভিরুচি’ থেকে আনা চিকেন পকোড়া। অভিরুচি বকুলতলার সবচেয়ে নামী রেস্তরাঁ। খাবারের মান খুবই খারাপ। বেশি তেল-মশলা দিলেই যে ভাল রান্না হয় না, সেটা এদের কে বোঝাবে! কিন্তু বিহান উপায়হীন। রোমে থাকলে রোমানদের মতো আচরণ করতে হয়।

রাতের খাবার বলতে ছিল বিহানের রান্না করা রুটি আর ডিমের ঝোল। খাবার খেয়ে বাসন মেজে শুতে রাত দেড়টা বেজেছিল। সেই ‘রাম-ঘুম’ এখন ভাঙল। অফিস যেতে দেরি না হয়ে যায়। একলাফে বিছানা থেকে উঠল বিহান। রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভে কেটলি বসিয়ে দু’কাপ চা চড়াল। নিজের বিছানা সাফ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বকুলতলার চার মাথার মোড় থেকে এক কিলোমিটারের ভিতরে এই বাড়ির ভাড়া মাসে পাঁচ হাজার টাকা। দোতলা বাড়ির উপরের তলায় কর্তা-গিন্নি আর তাঁদের দশ বছরের ছেলে থাকে। ওঁরা দূর থেকে চাকরি করতে আসা পোর্টের কর্মচারী ছাড়া অন্য কাউকে ভাড়া দেন না। ব্যাচেলর ভাড়াটে মোটেই পছন্দ করেন না। সনৎ রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটিয়ে এই মেসটা ম্যানেজ করেছে। মেসে পা রাখার আগে বিহানকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখাতে হয়েছে।

বিহান বকুলতলা পোর্টের ডিইও বা ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। অতীতে যাদের বলা হত ক্লার্ক বা কেরানি, তাদেরই কর্পোরেট জগতে নতুন পরিচয়, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। সামান্য বেতনের চুক্তিভিত্তিক চাকরিকে পুষিয়ে দেওয়ার জন্য গালভরা উপাধি! এখন সব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বসে গিয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকজন বয়স্ক কর্মচারী কম্পিউটার চালাতে পারেন না বা পারলেও করতে চান না। সেই কাজ করে দেওয়ার জন্য রাজ্যের সব জেলায় কম্পিউটার-সাক্ষর ছেলেমেয়েদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে।

শিবপুরের দীনবন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে বি কম পাশ করার পরে দীর্ঘ তিন বছর ধরে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে বিহান। পায়নি। বেসরকারি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এটিএম আর শপিং মলের সিকিয়োরিটি গার্ড ছাড়া কোনও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য রাজ্যে গেলে কাজ আছে, মাইনেও ভাল। কিন্তু ঠাঁইনাড়া হওয়ার ইচ্ছে বিহানের নেই। বউ আর মা’কে ছেড়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিহান রবিঠাকুরের কবিতার সেই প্রবাদপ্রতিম সন্তানের মতো, যাকে মায়েরা বাঙালি করে রেখেছে।

ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজটা বিহানকে জুটিয়ে দিয়েছে সনৎ কুইলা। সনৎ তার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড এবং কলেজের ক্লাসমেট। সনৎ কলেজ থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। খরাজ পার্টি তখন সদ্য বাংলার রাজনীতিতে পা রেখেছে। সেই দলের ছাত্র সংগঠনের হয়ে কলেজ ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারির পোস্টে দাঁড়িয়েছিল সনৎ। ক্ষমতায় থাকা কিশলয় পার্টির ছাত্র সংগঠনের হাতে প্রবল মার খেয়েও ভোটের ময়দান ছেড়ে পালায়নি। তার এই একরোখা ব্যক্তিত্বের জন্য ছাত্রছাত্রীরা ঢেলে ভোট দিয়েছিল। নির্বাচনে জিতেছিল সনৎ। রাজনৈতিক উত্থানের সেই শুরু। সনতের গুরু ছিলেন সুধাকর ঘোষ। সনৎ বুঝেছিল, কিশলয়ে নাম লিখিয়ে লাভ নেই। ওখানে কেউ তাকে পাত্তা দেবে না। খরাজ বাংলায় নতুন, নিজেদের জায়গা পোক্ত করার জন্য প্রচুর টাকা ওড়াচ্ছে এই রাজ্যে। তাই সনৎ বড় মেশিনের ছোট বল্টু হওয়ার চেয়ে ছোট মেশিনের বড় লিভার হতে চেয়েছে। প্ল্যানিং সফল। কলেজে পড়তে পড়তেই সনৎ খরাজ পার্টির ছাত্র সংগঠনের রাজ্যস্তরের নেতা হয়ে গিয়েছিল। ও-ই বিহানকে বলেছিল, “সরকারের ঝুলিতে আর টাকা নেই। সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না।”

গণতান্ত্রিক মোর্চাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কিশলয় পার্টি খরাজ পার্টিকে নানা সুযোগ-সুবিধে দেয়। সেই সুবিধের কারণেই বিহান আর সনৎ হাওড়ার বকুলতলা বন্দর অফিসে চাকরিটা পেয়ে গেল। তাদের প্রাথমিক চাকুরিদাতা বন্দর হলেও মাঝখানে এক কনট্র্যাক্টর আছেন। তাঁকে সকলে মিস্টার দাস বলে ডাকে। নাম কেউ জানে না। সিড়িঙ্গে চেহারার মিস্টার দাস সবসময় ধূসর রঙের সাফারি পরে থাকেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। পায়ে দামি জুতো। নাকের নীচে বাটারফ্লাই গোঁফ, যেটা দেখলেই বিহানের মনে হয় আঠা দিয়ে লাগানো আছে!

দু’জন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীর বেতন বাবদ প্রতি মাসে তিরিশ হাজার টাকা মিস্টার দাসের হাতে তুলে দেয় বকুলতলা পোর্ট। বিনিময়ে মাসের শেষে কাজ বুঝে নেয়। এগারো মাসের চুক্তি। এগারো মাসের শেষে পুনর্নবীকরণ না হলে চাকরি গেল।

বিহানের কাজের সময় সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা। মাঝখানে এক ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক। মেশিনে বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে অফিসে ঢুকতে হয়। বেরনোর সময়েও একই ব্যবস্থা। কে ক’টায় ঢুকছে এবং বেরচ্ছে, সব বন্দরের সেন্ট্রাল সার্ভারে নথিভুক্ত থাকে। পালানোর উপায় নেই।

পালিয়ে করবেটা কী বিহান? একশো কিলোমিটার উজিয়ে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। বকুলতলার আগের স্টেশনের নাম পোর্ট স্টেশন। সেখান থেকে সারাদিন মালগাড়ি ছাড়ে। হাতে গোনা কয়েকটা লোকাল ট্রেন আছে। সেগুলো এমন বেখাপ্পা সময়ে ছাড়ে যে বিহান কখনও ট্রেনে চড়ার কথা ভাবেনি। শুনেছে ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। জাতীয় সড়ক দিয়ে শনশন করে চলে সরকারি আর বেসরকারি বাস। তাতে উঠলেও হরেদরে একই সময়। ছ’ঘণ্টার যাতায়াত এড়াতে মেস ভাড়া নিয়েছে বিহান আর সনৎ।

বিছানা সাফ করে রান্নাঘরে ঢুকল বিহান। চা ছেঁকে, দুটো কাপে ঢেলে, চারটে বিস্কুট প্লেটে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে সনৎকে খোঁচা মেরে বলল, “চা!”

সনৎ আর বিহানের বয়স ছাব্বিশের সামান্য উপরে। বিহানকে ছাব্বিশের মতোই দেখতে লাগে। ফরসা গায়ের র‌ং, রোগাপাতলা চেহারা, একমাথা চুল, চোখদুটো ভাসা-ভাসা। সনৎকে দেখে মনে হয় তিরিশ পেরিয়েছে অনেকদিন। এবং সেটা মনে হওয়ার পিছনে কারণও আছে। রাজ্যস্তরের নেতা হওয়ার ওজন আছে, নানা দু’নম্বরি কাজ করে ঘুষ খেয়ে পকেট গরম থাকার অভিঘাত আছে, এই বয়সেই গাড়ি-বাড়ি করে ফেলার আত্মদর্প আছে। সব মিলিয়ে ছ’ফুট, শ্যামবর্ণ সনৎকে পেটমোটা কোলা ব্যাঙের মতো দেখতে। মাথার চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, ওজন একশো দশ কিলো, চোখের নীচে অ্যালকোহলের কারণে পাউচ। পটোলের মতো মোটা মোটা দশ আঙুলে গোটা আটেক আংটি, গলায় তিনটে সোনার চেন, হাতে সোনার মোটা বালা। একগাদা তাবিজ আর কবচ শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঝুলছে। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। সেটা নেতাসুলভ গাম্ভীর্য আনার কারণে, না সত্যিই দরকার, জানে না বিহান। সনৎ সব সময়ে সাদা কুর্তা আর পাজামা পরে থাকে। হাওড়া ময়দানের পুরনো বাড়ি বিক্রি করে সে চলে গিয়েছে গঙ্গার ওপারে। হেস্টিংস এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। সেখানেই বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। হেস্টিংস এলাকাতেও ও নেতা। সনৎ এখনও বিয়ে করেনি। কোনও বান্ধবীও নেই। বিহান কানাঘুষোয় শুনেছে সনতের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি আছে। সেটা কখনও দেখেনি বিহান।

সনৎ ডিউটি করে সপ্তাহে দু’দিন। বৃহস্পতিবার সকালে এসে মেসে চান-খাওয়া সেরে দুপুর একটার সময়ে বন্দরের ভিতরে ঢোকে। বেরয় রাত দশটা নাগাদ। সে অফিসে কাজ করে না। সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন ‘খরাজ রাজ্য ফেডারেশন’ বা ‘কেআরএফ’-এর রাজ্যস্তরের নেতা হিসেবে তার কাজ হল সংগঠনকে মজবুত করা। বাংলার প্রতিটি জেলার প্রতি ব্লকে তার যোগাযোগ। এমন কর্মযোগীর পক্ষে কি সামান্য ডেটা এন্ট্রির কাজ করা সম্ভব?

রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকার কত সুবিধে! বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স থাকা সত্ত্বেও সপ্তাহে চারদিন সনতের অনুপস্থিতি নিয়ে পোর্টের ম্যানেজমেন্ট বা মিস্টার দাস, কেউ কথা বলে না।

জেলা স্তরের একাধিক পার্টি মিটিং সেরে রাত দশটার সময়ে মেসে ফিরে সে বিহানের সঙ্গে মদ খেতে বসে। বিহানকেও বাধ্য হয়ে খেতে হয়। অনেক সপ্তাহেই এমন হয়েছে যে বিহান খায়নি, কিন্তু মদ আর চাট কিনে এনেছে গাঁটের টাকা খরচ করে। বিহানের না খাওয়ার কারণটা খুব সহজ। সনৎ পকেট থেকে টাকা বার করে না। পকেট থেকে টাকা না বার করার ঘটনাটা শুধু মদ কেনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। সনৎ মেস ভাড়া বা বাজার করার টাকাও শেয়ার করে না।

চাকরি পাওয়ার সময়ে সনৎ বিহানকে সাহায্য করেছিল। কৃতজ্ঞতাবশত বিহান প্রথম কয়েক মাস সনৎকে কিছু বলেনি। পরে বুঝেছে, প্রথমেই প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। করেনি বলে সনৎ মাথায় চেপে বসেছে। পোর্টের অফিসে ডেটা এন্ট্রির কাজ বিহানকে দিয়ে করায়। মেসে রান্না করা, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, কাপড় কাচা… সব বিহান করে। এবং এর পরেও খরাজ পার্টির সদস্য হিসেবে মাইনের একটা অংশ বিহানকে ডোনেশন হিসেবে দিতে হয়।

ঝাঁট দেওয়া শেষ করে বিহান দেখল সনৎ ঠান্ডা চা আর বিস্কুট নিয়ে খাটে লেপমুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে। পাশে রাখা রয়েছে দুটো স্মার্টফোন। দুটো মোবাইলের চারটে কানেকশন যে কী কাজে লাগে, ঈশ্বর জানেন!

সনৎকে নিয়ে মাথা ঘামালে অফিসের দেরি হয়ে যাবে। স্টোভে চালডাল বসিয়ে বিহান স্নান করতে ঢুকল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দুটো অমলেট ভেজে নেবে। খিচুড়ি আর অমলেট। শীতের পক্ষে আদর্শ খাবার। এটাই আজকের সকালের, দুপুরের আর রাতের খাবার। দিনে দু’‌বেলা স্টোভের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

ইমারশন হিটার একটা আছে, কিন্তু এখন সেটায় জল গরম করার সময় নেই। স্নানঘরে ঢুকে কিছু না ভেবেই ঝুপুস করে এক মগ জল মাথায় ঢেলে দিল বিহান। ঠান্ডার চোটে বিকট চিৎকার করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে লাগল, “আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও। উরেশালা! ধুইয়ে দাও! ঠান্ডায় মরে গেলুম রে! ধুইয়ে দাও!”

তার চিৎকার শুনে শোওয়ার ঘর থেকে সনৎ হাসছে। ঝপাঝপ কয়েক মগ বরফঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে গামছা দিয়ে গা মুছতে থাকে বিহান। ক’টা বাজল কে জানে! ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতেই হবে। আজ তার চাকরির অ্যানুয়াল কনট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। মিস্টার দাসকে দিয়ে সেটা করিয়ে নিতে হবে। লোকটাকে চটাতে চায় না বিহান। দরিয়ার সন্তান হওয়ার দিন কাছে চলে এসেছে। সামনে অনেক খরচ।

বিহানের বাড়ি হাওড়া ময়দানে। তার বউ দরিয়া থাকে লিলুয়ায়, বাপের বাড়িতে। গর্ভাবস্থায় প্রায় সব মেয়েই বাপের বাড়ি থাকে। এটা কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু দরিয়া বিয়ের পরে কখনওই শ্বশুরবাড়ি থাকেনি। শুধু তাই নয়, বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল দরিয়াদের বাড়ি বসবাস-এ। কারণ বিহানের মা শ্রীরূপার এই বিয়েতে মত ছিল না। তিনি ছেলের বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর অমতে বিয়ে করার পরে শ্রীরূপা বিহানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দরিয়া এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। যদিও বিহানের জন্য এই বাড়ির দরজা সব সময় খোলা। তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই শ্রীরূপার।

বিয়ের আগে একবার মাত্র শ্রীরূপার সঙ্গে দরিয়ার দেখা হয়েছিল। বিয়ের পরে, গত দেড় বছরে একবারও মোলাকাত হয়নি। দরিয়া গর্ভবতী, এই কথা জানার পরেও মন গলেনি শ্রীরূপার।

বিয়ের পর থেকে বিহান নিজের জীবনটা তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। সোমবার সকাল থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সে বকুলতলার মেসে থাকে। শনিবার রাত আর রোববার সকালটা হাওড়া ময়দানের বাড়িতে মায়ের কাছে কাটিয়ে রোববার দুপুরে চলে যায় বসবাস-এ। শ্বশুর সাম্যব্রত আর শাশুড়ি সীমার সঙ্গে গল্প করে কিছুটা সময় কাটে। আর দরিয়া তো আছেই! বসবাসে পৌঁছে বেঁচে থাকার একটা আবছা মানে খুঁজে পায় বিহান। সারা সপ্তাহের অক্সিজেন পেয়ে যায় রবিবারের ওই কয়েক ঘণ্টায়।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে শার্ট প্যান্ট গলাল বিহান। ফুল সোয়েটার পরে গলায় মাফলার জড়িয়ে একটু আরাম হল। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল খিচুড়ি তৈরি। দুটো ডিম ভেঙে প্লাস্টিকের মগে ফেটিয়ে, পেঁয়াজ কুচি আর নুন-হলুদ দিয়ে চেঁচাল, “সনৎ, তুই কখন খাবি?”

“বেড়ে রেখে দে। পরে খাব।” মোবাইলে কথা বলার ফাঁকে হুকুম করল সনৎ।

বিহান দুটো অমলেট বানাল। সনতের খিচুড়ি আর অমলেট থালায় রেখে কাঠের মিটসেফে ঢুকিয়ে দিল। নিজের খিচুড়ি একটা থালায় নিয়ে হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে বলল, “গত মাসের অনেক কাজ পেন্ডিং রয়ে গিয়েছে। তুই একদম কিছু না করলে কী করে হবে বল তো? গত এক বছরে বকুলতলা পোর্টে কতগুলো কার্গো লোডিং আর আনলোডিং হয়েছে, তার ডেটা হেড অফিসে মেল করতে বলেছে। আমার একার পক্ষে এত ডেটা এন্ট্রি করা সম্ভব?”

ঠান্ডা চায়ে সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে ঠান্ডা চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে সনৎ বলল, “তুই কি আমাকে কাজ করতে বলছিস?”

বিহান বুঝতে পারছে, সে আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সনৎকে অফিসের কাজ করতে বলা আর বাঁদরকে ‘দেবতার গ্রাস’ মুখস্থ করতে বলা একই ব্যাপার। কিন্তু আজ কনট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। মিস্টার দাস রিনিউয়াল না করলে বিহানের চাকরি থাকবে না। যার বউয়ের আজকালের মধ্যে সন্তান হতে চলেছে, সে কোনও রিস্ক নিতে পারে না।

বিহান মিনমিন করে বলল, “ডেটা এন্ট্রির কাজ। যে কাজের জন্য আমরা মাইনে পাই।”

সনৎ ক্রুর হেসে বলল, “আমি সংগঠনের কাজ করি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করি। মাইনের সব টাকা আমি সংগঠনকে দিয়ে দিই। ওই টাকায় আমার কোনও লোভ নেই।”

“আমাকে দু’জনের কাজ করতে হচ্ছে,” বিহান নাছোড়বান্দা, “আমি পেরে উঠছি না। মিস্টার দাস যদি আমার পারফরম্যান্সে অখুশি হয়ে কনট্র্যাক্ট রিনিউয়াল না করেন তা হলে কী হবে?”

“উরিত্তারা! হেব্বি বললি কিন্তু! তা হলে উত্তরটাও শুনে রাখ। তোর বদলে একটা অভাবী ছেলে চাকরি পাবে। ঠিক কি না? সবার কপালে তো আর তোর মতো শাঁসালো শ্বশুর জুটবে না। সবাই তোর মতো ঘরজামাইও হতে পারবে না।” তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল সনৎ। আবার মোবাইলে বকরবকর শুরু করল।

শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিহান। খাওয়া শেষ। এবার টিফিন বক্সে খাবার ভরে বেরতে হবে।

বিহান সার বুঝেছে, এই দুনিয়ায় একটা জিনিসেরই গুরুত্ব আছে। টাকা! টাকার জন্যই সে বউ আর নিজের বাড়ি ছেড়ে বকুলতলায় পড়ে রয়েছে। টাকার জন্যই বউ বাপের বাড়িতে থেকে টিউশনি করে। তার সঙ্গে বকুলতলায় থাকতে পারে না। মেসবাড়িতে ভূতের মতো একা থাকা, হাত পুড়িয়ে রান্না করা, কাপড় কাচা, ঘর ঝাঁট দেওয়ার কষ্ট তো আছেই। সেগুলো গায়ে লাগত না, যদি বউ সঙ্গে থাকত। আর বিছানায় একা রাত কাটানোর কষ্ট কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

টাকা! সামান্য ক’টা টাকার জন্য সকাল থেকে উঠে চরকি পাক খাচ্ছে বিহান। গরম খিচুড়ি খেয়ে মুখ পুড়োচ্ছে, নিজের এঁটো থালা মাজছে, নিজের এবং সনতের এঁটো চায়ের কাপ ধুচ্ছে, কাঁধে ব্যাগ আর পায়ে জুতো গলিয়ে মেসবাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিচ্ছে অফিসের উদ্দেশে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে, সকাল দশটা দশ বাজে। আজকেই দেরিটা হতে হল?

পাশাপাশি এটাও মনে হচ্ছে, আজ সকালে দরিয়াকে ফোন করা হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *