শেষ নাহি যে – ১৩

অ্যাম্বুল্যান্সে উঁকি মেরে সাম্যব্রত দেখলেন, চালকের আসনে রাজু নেই। কোথায় গেল রে বাবা! এই বিপদের দিনে আবার চালাতে হবে ভেবে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়নি তো? তা হলে সাম্যব্রত একেবারে জলে পড়বেন। সার্জিকাল ওয়ার্ড থেকে ট্রলিতে করে দরিয়াকে নিয়ে আসছে অন্য এক ওয়ার্ড বয়। একে ‘বয়’ বলা যেতেই পারে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। সাম্যব্রত খেয়াল করলেন, দরিয়ার শরীরে ব্লাড চালানো শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন একটি স্যালাইন চলছে। ছেলেটি অ্যাম্বুল্যান্সের পাশে ট্রলি রেখে বলল, “ডেরাইভার কোথায়?”

“বুঝতে পারছি না,” বলে এদিক-ওদিক দেখছেন সাম্যব্রত।

“এটা তো রাজুদার গাড়ি,” বলল ওয়ার্ড বয়, “চলে আসবে। আপনি চিন্তা করবেন না।” তার পরে ট্রলি রেখে দিয়ে চলে গেল।

সাম্যব্রত চেঁচিয়ে বললেন, “ভাই, পেশেন্টকে গাড়িতে তুলে দিয়ে যাও।”

“রাজুদা তুলে দেবে,” ঘুরেও দেখল না ওয়ার্ড বয়। সাম্যব্রত ঘাবড়ে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। দরিয়ার চোখ বন্ধ। ভুরু কুঁচকে রয়েছে, দাঁতে দাঁত চাপা, চোয়াল শক্ত। সাম্যব্রত বললেন, “কী রে, কষ্ট হচ্ছে?”

চোখ খুলল দরিয়া। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, “সেই ব্যথাটা ফিরে এসেছে। আমি আর পারছি না বাবা! এইখানে সবার সামনে চেঁচালে খুব খারাপ হবে। তুমি প্লিজ় কিছু করো।”

‘কিছু করো’ বলার সময়ে দরিয়ার কথা জড়িয়ে গেল। নাক আর মুখ চেপে, নাভির থেকে উঠে আসা চিৎকার দমন করছে সে। পরের বার আর চিৎকার চাপতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্যব্রত উত্তেজিত হয়ে সিগারেট ধরালেন। রাজু গেল কোথায়?

ভাবতে না ভাবতেই সাম্যব্রত দেখলেন, হাসপাতালের পিছনের ফটক দিয়ে রাজু ভিতরে ঢুকছে। দু’হাত ভরতি অজস্র পতাকা। পতাকার বান্ডিল সাম্যব্রতর হাতে ধরিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনের দরজা খুলে রাজু ট্রলিটা এমন ভাবে রাখল যে দরিয়া নিজেই টুক করে ঢুকে গেল। ট্রলি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে রেখে ফিরে এসেছে রাজু। সামনের দরজা খুলে চালকের আসনে বসে পাশের সিট থাবড়ে সাম্যব্রতকে গান শুনিয়ে দিল, “দিয়ে জ্বলতে হ্যায়, ফুল খিলতে হ্যায়, বড়ি মুশকিল সে মগর দুনিয়া মে দোস্ত মিলতে হ্যায়।” তারপর বলল, “এখানে বসুন বন্ধু। যাওয়ার পথে অনেক কাজ আছে।”

সাম্যব্রত কথা না বাড়িয়ে রাজুর পাশে বসলেন। রাজু অ্যাম্বুল্যান্স স্টার্ট দিল।

রাস্তায় পড়ে ডানদিকে ঘুরেছে গাড়ি। গাড়ির মাথায় নীল বিকন জ্বলছে। বাজছে হুটার। কিছুটা যাওয়ার পরেই চলে এল ফোরশোর রোড। এই রাস্তা দিয়ে গেলেই দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোল প্লাজ়া।

রাজু বলল, “রাস্তাঘাটের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আর্মির জওয়ানরা টহল দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও ক্যালাকেলি বন্ধ হচ্ছে না। হাওড়া আর শেয়ালদা থেকে কোনও ট্রেন ছাড়ছে না। কোনও ট্রেন ঢুকতেও পারছে না। বাস, ট্যাস্‌কি, রিস্‌কা— সব মায়ের ভোগে। আর্মির মালগুলো পাবলিক দেখলেই হ্যারাস করছে। এই অবস্থায় কাজ উদ্ধার করতে গেলে ভদ্দরলোক সেজে লাভ নেই। আমাদের ‘জেজেটিটি’ নিয়ম ফলো করতে হবে।”

“সেটা আবার কী?” জিজ্ঞেস করলেন সাম্যব্রত।

“যখন যেমন তখন তেমন। আমি রাস্তা থেকে কিশলয় পার্টি, খরাজ পার্টি আর গণতান্ত্রিক মোর্চার ফেল্যাগ জোগাড় করেছি। আপনি ওগুলো আলাদা করুন। তার পরে সিটের তলায় লুকিয়ে রাখুন। আর্মির জওয়ানের পাল্লায় পড়লে প্রেগন্যান্ট মাদার দেখিয়ে ছাড় পেয়ে যাব। কিন্তু পলিটিক্যাল পার্টি আজ কাউকে রেয়াত করছে না। যে দলকে সামনে দেখব, তার ঝান্ডা অ্যাম্বুল্যান্সের জানালায় আটকে দেব।”

সাম্যব্রত নীরবে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ করতে লাগলেন। মিনিট তিনেকের মধ্যে গোছানো শেষ। রাজু বুদ্ধি করে সুতলি দড়িও নিয়ে এসেছে পতাকা বাঁধার জন্যে।

কাজ চুকিয়ে দরিয়ার দিকে তাকালেন সাম্যব্রত। মেয়েটাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে। একটা করে ব্যথার ঢেউ আসছে আর ও দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলানোর চেষ্টা করছে। মুখ ঘামে ভিজে গিয়েছে। চোখ বিস্ফারিত। অ্যাম্বুল্যান্সের বেডের হাতল এত জোরে চেপে ধরেছে যে আঙুলের গাঁট ফ্যাকাশে। পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে দরিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “আমরা প্রায় এসে গেছি।”

গোটা ফোরশোর রোডে কোনও মানুষ নেই। আর্মির সাঁজোয়া গাড়ি টহল দিচ্ছে। আকাশে উড়ছে বায়ুসেনার হেলিকপ্টার। পুলিশ ভ্যানও দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি মোড়ে। তারই মধ্যে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ধারের ইলেকট্রনিক গুড্‌সের দোকানের শাটার বেঁকিয়ে উপরে তোলা হয়েছে। লুঠ করা হয়েছে মালপত্র। রাস্তায় পড়ে রয়েছে ভাঙা টিভি আর গেমিং কনসোল। পান-বিড়ির দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানো হয়েছে পার্টি অফিস। পুড়ছে রাজনৈতিক পতাকা।

অ্যাম্বুল্যান্স এখন টোল প্লাজ়ার সামনে। সব লেন ফাঁকা। পুলিশের প্রহরার মধ্যে টাকা দিয়ে কুপন সংগ্রহ করল রাজু। অ্যাম্বুল্যান্স প্রবল গতিতে উঠে গেল ব্রিজের উপরে।

যাক! আর কোনও ভয় নেই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি ঢুকে যাবে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে। ডক্টর সেন ফোন করে দিয়েছেন ওখানকার গাইনি বিভাগে। রেফারাল কার্ডে সব কথা লিখে দিয়েছেন। মেয়েকে ভরতি করতে সমস্যা হবে না। এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। আশা করা যায় সাতটার মধ্যে দরিয়ার সিজ়ারিয়ান সেকশান হয়ে যাবে।

গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সাম্যব্রত। মেয়েকে বললেন, “একবার বাইরে তাকিয়ে দেখ। এখান থেকে আমাদের হাওড়াকে কী সুন্দর দেখতে লাগে!”

দরিয়া কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুলল। তারা এখন অনেক উঁচুতে। এখান থেকে গঙ্গায় ভেসে থাকা দু’-একটা ডিঙি নৌকোকে পুঁচকি দেখাচ্ছে। আজ কোনও লঞ্চ চলছে না। আকাশের রং গাঢ় নীল। তার ছায়া পড়েছে গঙ্গায়। চারিদিক কী শান্ত! কী সুন্দর! গোটা দুনিয়াটা যদি এইরকম হত!

ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল দরিয়া। আর একটা ব্যথার ঢেউ আসছে!

চালকের আসনে বসা রাজু বলল, “দিদিমণি! আমরা ব্রিজ পেরিয়ে এলাম। নো ঝামেলা! আর এক মিনিট! একটু ম্যানেজ করুন!”

রাজুর কাঁধে হাত রেখে সাম্যব্রত বললেন, “গাড়ি আস্তে করো। সামনে খরাজ পার্টি রাস্তা অবরোধ করেছে। গাড়িটা সাজাতে সময় লাগবে।”

রাজু অ্যাম্বুল্যান্সের গতি কমিয়েছে। সাম্যব্রত দ্রুত হাতে সুতলি দড়ি দিয়ে দু’দিকের জানালায় পতাকা বেঁধে দিলেন। একটা অপেক্ষাকৃত বড় পতাকা হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে বার করে চিৎকার করে উঠলেন, “লাল ঝান্ডা করে পুকার…”

দরিয়া চেঁচিয়ে বলল, “বাবা! কী হল তোমার? এখন পাগলামো করার সময় নয়।”

সাম্যব্রতর চোখে জল। চশমা খুলে চোখ মুছে বললেন, “মেরুদণ্ডটা অনেক কাল আগেই প্লাস্টিকের বানিয়ে ফেলেছি, মা! দীর্ঘদিন আগে এক কবি বলেছিলেন, ‘চেতনাধারার ছাপ জীবনকে গড়ে না। জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে।’ সেই বয়সে কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। আজ পারছি।”

দরিয়া আঁচলে বাঁধা বিপত্তারিণী ঠাকুরের ফুল মুঠোয় নিল। অর্ধেক ফুল বাবার হাতে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কবিতা-ফবিতা বুঝি না বাবা! প্লিজ় হাসপাতালে নিয়ে চলো। আর… পারছি… না!”

শুকনো ফুল হাতে নিয়ে সাম্যব্রত ঢোক গিললেন। চোয়াল শক্ত করে ফুলের পাপড়ি পাশঝোলায় ঢুকিয়ে রাখলেন। অ্যাম্বুল্যান্স ধীরগতিতে চলছে। অবরোধের সামনে এসে রাজু ব্রেক কষেছে। নিচু গলায় সাম্যব্রতকে বলল, “আপনি কথা বলুন।”

“তুমি আমার ফোনটা রাখো।” মোবাইল রাজুকে দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে গাড়ি থেকে নামলেন সাম্যব্রত। তাঁর কাঁধে খরাজ পার্টির পতাকা পতপত করে উড়ছে।

পুলিশ ট্রেনিং স্কুল বা পিটিএস স্টপের সামনে, রাস্তার মাঝখানে শ’খানেক মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকে রাস্তার মাঝখানে চটি বা খবরের কাগজ পেতে বসে আছে। এখানে রাস্তায় কোনও গাড়ি নেই। নেই কোনও যাত্রী। দু’-একটা বাইক হুশহাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোর হ্যান্ডেলে খরাজ পার্টির ফ্ল্যাগ বাঁধা। অবরোধকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই কমবয়সি চ্যাংড়া ছেলের দল। কপালে ফেট্টি বাঁধা, সারা মুখে খরাজ পার্টির পতাকার রঙের আবির লেপা রয়েছে। হাতে পতাকা, মুখে মদের গন্ধ। এদের সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে না। এরা যুক্তি বোঝে না। এদের মধ্যে নেতাটি কে? তাকে খুঁজছেন সাম্যব্রত।

লম্বাচওড়া একটি ছেলে এগিয়ে এসে হাত নেড়ে বলল, “ওয়াপস চলা যাইয়ে।”

গাড়িতে গর্ভবতী মেয়ে আছে, তার অবস্থা সংকটজনক, তাকে ডাক্তার রেফার করেছে… এই সব কথা এখানে কেউ শুনবে না।

সাম্যব্রত ডিভাইডারে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বলছেন, “বন্ধুরা! আমি আসছি হাওড়া থেকে। সেখানে গণতান্ত্রিক মোর্চার ক্যাডাররা আমাদের মারতে এসেছিল। আমরা ছেড়ে কথা বলিনি। পাল্টা মার দিয়েছি। এলাকা ধরে ধরে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে বার করেছি শয়তানগুলোকে। তার পরে যা করার করেছি। আপনারা কি পেরেছেন, আমাদের মতো পাল্টা দিতে? না হাতে চুড়ি পরে বসে আছেন? কখন পুলিশ আর মিলিটারি আসবে সেই আশায়?”

ছেলেছোকরার দল ভাষণ শুনে চুপ করে গিয়েছে। বোঝার চেষ্টা করছে, লোকটা কে! ওরা তো জানে না যে সাম্যব্রত স্ট্রিট কর্নারিং করে, মিছিলে হেঁটে, মিটিংয়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গেয়ে বড় হয়েছেন। খবরের কাগজে আলতা দিয়ে পোস্টার লিখে, রাতের অন্ধকারে সেই পোস্টার দেওয়ালে সেঁটে বড় হয়েছেন। বোমা বেঁধে, বোমা মেরে, পুলিশের গুলি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, মানুষ খুন করে বড় হয়েছেন। পড়াশুনো ছেড়েছেন, জেল খেটেছেন, মেধাবী ছাত্র হয়েও করণিক হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। কেননা, তিনি সারা জীবন ধরে একটা কাজই করেছেন। রাজনীতি। জলের মধ্যে যেভাবে মাছ থাকে, সাম্যব্রত তেমনই মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পারেন। বয়স হয়েছে, স্কিলে জং ধরেছে, কিন্তু বাঘের বাচ্চা কখনও রক্তের স্বাদ ভোলে না।

“ওরা মারছে। আমরা মার খাচ্ছি। দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে মাত্র কয়েকটা পরিবার, আমরা বুড়ো আঙুল চুষছি। আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যে শিক্ষা নেই, অন্ন নেই, পানীয় জল নেই, চাকরি নেই। সব ওদের হাতে। ওরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়বে, নামকরা কলেজে ভরতি হবে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে বিদেশে ঘুরতে যাবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা অশিক্ষিত, বেকার হয়ে রাস্তায় ফ্যাফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে। সময় কাটানোর জন্য হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে চুষিকাঠি। সস্তার মোবাইল, ফ্রিতে আনলিমিটেড ডেটা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। কথা ছিল, আমরা ওদের উপরে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ব, ছিঁড়েখুঁড়ে পাওনা আদায় করব। তার বদলে আমরা সেলফি তুলছি, শেয়ার করছি আর লাইক কুড়োচ্ছি। আগে আমরা ভিখিরি ছিলাম। এখন ‘লাইক ভিখিরি’ হয়েছি। দাবি আদায় করার বদলে আদায় করছি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। ওরা হাসছে। ওদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলেফেঁপে উঠছে। এভাবে কত দিন? পাল্টা মার দিতে হবে না?”

কী বলছেন, সাম্যব্রত নিজেই জানেন না। কে শত্রু, কে মিত্র, কে আমরা, কে ওরা— সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বক্তৃতার অভিনয় করছেন। রাজনৈতিক স্কিল ব্যবহার করছেন নিজের স্বার্থে। মেয়ের স্বার্থে। উপায়হীন ভাবে। জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে!

প্রথম হাততালি দিল লম্বাচওড়া ছোকরাটি। সাম্যব্রত বুঝলেন, পঞ্চাশ শতাংশ যুদ্ধজয় সম্পূর্ণ! বাকি আছে আরও পঞ্চাশ।

লম্বাচওড়া ছোকরাকে দেখে একে একে সবাই হাততালি দিতে লাগল। সাম্যব্রত আকাশে খরাজ পার্টির পতাকা উঁচিয়ে চিক্কুর ছাড়লেন, “খরাজ পার্টি!”

সবাই বলল, “জিন্দাবাদ!”

লম্বাচওড়া চিৎকার করে বলল, “গণতান্ত্রিক মোর্চা!”

সবাই বলল, “মুর্দাবাদ!”

সাম্যব্রত এবার বললেন, “বন্ধুরা! একবার অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে উঁকি মারুন।”

সকলের প্রতিনিধি হয়ে লম্বাচওড়া উঁকি মেরে দেখছে। সাম্যব্রত চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, “অ্যাম্বুল্যান্সে শুয়ে রয়েছেন আমাদের দলের নবীন নেত্রী। উনি সকাল থেকেই নিজের এলাকায় টহলদারিতে ব্যস্ত ছিলেন, যাতে কোথাও কোনও অশান্তি না হয়। ওদের সেটা সহ্য হয়নি। একজন পূর্ণগর্ভাকে বোম মেরেছে। তাও উনি দমে যাননি। কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই লেবার পেইন শুরু হয়েছে। আপনারা যদি অনুমতি দেন, তা হলে ওকে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে ভরতি করে আমি এখানে চলে আসছি। সবাই মিলে অবরোধ চালিয়ে যাব।”

লম্বাচওড়া জানালা দিয়ে মুখ গলিয়ে দরিয়ার সঙ্গে কথা বলেছে। কথা বলেছে রাজুর সঙ্গেও। দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, “রাস্তা ছোড় দো! ইন লোগোঁকো জানে দো!”

আজ সাম্যব্রত একশো শতাংশ সফল। মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি। নাস্তিক বলে ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। নিজের ক্ষমতার উপরে পূর্ণ আস্থা আছে।

অবরোধকারীদের একে একে জড়িয়ে ধরলেন সাম্যব্রত। করমর্দন করলেন লম্বাচওড়ার সঙ্গে। অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে রাজুকে বললেন, “চলো। শেষ হার্ডল পার করা গেল।”

ভিড় দু’পাশে সরে অ্যাম্বুল্যান্সকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। এগোচ্ছে গাড়ি। প্রথম থেকে দ্বিতীয় গিয়ারে উঠে রাজু বলল, “দূর শালা! এ আবার কে?”

সাম্যব্রত দেখলেন, উল্টোদিক দিয়ে তাঁদের লেনে একটা প্রাইভেট কার আসছে। ট্র্যাফিক আইন মানার কোনও প্রয়োজন বোধ করছে না। গাড়ির ড্রাইভারের আসনে যে বসে আছে, তাকে চিনতে পারলেন সাম্যব্রত। তাঁর জামাইয়ের বন্ধু সনৎ।

ছেলেটিকে একদম পছন্দ করেন না সাম্যব্রত। দরিয়া আর বিহানের প্রেমের খবর যেদিন বাড়ি বয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেদিনই আন্দাজ করেছিলেন, দরিয়ার প্রতি ছোকরার দুর্বলতা আছে। দরিয়া ছেলেটাকে পাত্তা না দিয়ে ভালই করেছে। খুব ধান্দাবাজ টাইপ। দরিয়া যখন কলেজে, তখন মেয়ের অনুপস্থিতিতে বাড়িতে হানা দিত। মেয়ে বিহানের সঙ্গে কী কী করছে তার নিখুঁত ধারাবিবরণী মাসে অন্তত একবার পেয়ে যেতেন সাম্যব্রত। পাশাপাশি এটাও খেয়াল করেছিলেন, ছোকরা রাজনীতির মই বেয়ে তরতরিয়ে উঠছে। ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে খরাজ পার্টির জেলাস্তরের নেতা হয়ে গেল কলেজে পড়ার সময়েই। পরবর্তীকালে রাজ্যস্তরের নেতা। সাম্যব্রত জানেন, সনৎই বিহানকে বকুলতলার চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে। সাম্যব্রত জানেন, বিহান এবং সনৎ এখন আর আগের মতো বন্ধু নেই। এবং সাম্যব্রত জানেন, সনৎ তাঁর অতীত রাজনৈতিক পরিচয় জানে।

সনৎকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে সাম্যব্রতর। প্রেমে ব্যর্থ মানুষ আহত বাঘের চেয়েও ভয়ংকর হয়। এ এখন কী মূর্তি ধারণ করবে কে জানে! তিনি একটু আগে খরাজ পার্টির হয়ে ভাষণ দিয়েছেন। সেটা জানলে যে কী হবে কে জানে! সাম্যব্রত ঠিক করলেন, এইটুকু দূরত্ব মাথা নিচু করে পার করবেন। ফুট দশেকের মামলা।

দুটো গাড়ি পরস্পরকে পেরচ্ছে। সাম্যব্রতর মাথা নিচু। রাজু স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সনতের গাড়ি যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দিচ্ছে। এমন সময়ে সনতের চারচাকা দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ি থেকে তড়াক করে নেমে সোজা সাম্যব্রতর দিকে এসে সনৎ বলল, “কাকু, আপনি এখানে?”

আর মাথা নিচু করে থাকা যাবে না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “সনৎ যে! কেমন আছ? এখন এখানে?”

সনতের এগিয়ে আসার মধ্যে একটা নিশ্চিত ভাব আছে। ও জানে ও কী করতে চায়। দরজার পাশে এসে হ্যােন্ডলে চাপ দিয়ে কঠিন গলায় বলল, “নেমে আসুন।”

অ্যাম্বুল্যান্সের দরজা খুললেই সনৎ দেখে ফেলবে যে সিটের নীচে কিশলয় পার্টি আর গণতান্ত্রিক মোর্চার পতাকা রাখা রয়েছে। সাম্যব্রত হ্যান্ডেল চেপে রেখে বললেন, “অ্যাম্বুল্যান্সে দরিয়া রয়েছে। ওর লেবার পেইন শুরু হয়েছে। বিহান তোমাকে বলেনি?”

“নেমে আসুন!” গলার স্বর চড়েছে সনতের। আওয়াজ শুনে চ্যাংড়া ছেলেগুলো ধীরে ধীরে এদিকে আসছে। সাম্যব্রত হাতজোড় করে বললেন, “ওর পায়ে বোমার টুকরো লেগেছে। বঙ্গবাসী হাসপাতাল থেকে ওকে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেছে। এখন আটকিয়ো না সনৎ। মেয়েটা মরে যাবে!”

অ্যাম্বুল্যান্সের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে সনৎ দেখল, দরিয়ার চোখ উল্টে গেছে। সারা শরীর ফুঁড়ে ঘাম বেরচ্ছে। যন্ত্রণায় কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে দরিয়া। তারই মধ্যে হাতজোড় করে সনৎকে বলল, “যেতে দাও, প্লিজ়! আমি আর পারছি না।”

সনৎ মুচকি হাসল। চেঁচিয়ে বলল, “সাম্যব্রত! সাম্য যার ব্রত। নামকরণকে সার্থক করার জন্য আপনি তো বরাবর নকশাল করে এসেছেন কাকু। আজ পাল্টি খেয়ে খরাজ পার্টিতে? চক্করটা কী?”

চ্যাংড়া ছেলেগুলো এগিয়ে আসছে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। লম্বাচওড়া বলল, “আরে সানাতদা, এ তো আমাদের লোক!”

সাম্যব্রত হাতজোড় করেছিলেন। দরজার হ্যান্ডেলে আর হাত ছিল না। এই সুযোগে বাইরে থেকে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের দরজা খুলে ফেলেছে সনৎ। সাম্যব্রতর হাত ধরে এক টান দিয়েছে। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সাম্যব্রত। হাঁটুতে লাগল, হাতের তালুতে লাগল, ঘাড়ে বেদম জোরে লেগেছে। তিনি বুঝতে পারছেন, এবার হাটুরে মার খেতে হবে। মরেও যেতে পারেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি নিজের জীবন নিয়ে নয়, দরিয়ার জীবন নিয়ে চিন্তিত।

এখন কথার খেলা, ঝান্ডা নেড়ে রং বদলানোর সময় ফুরিয়েছে। এখন শিরদাঁড়া সোজা রেখে একটাই কাজ করতে হবে। মারতে হবে!

সিটের নীচ থেকে একটা ঝান্ডা নিলেন। যে দলেরই হোক না কেন, ঝান্ডাকে উল্টে ধরলে সেটা হয় ডান্ডা। সাম্যব্রত সেই ডান্ডা সপাটে চালিয়েছেন সনতের ঘাড়ে। কোথায় আঘাত করলে সিরিয়াস ইনজুরি না করে একটা লোককে অকেজো করে দেওয়া যায়, এটা তিনি সত্তর দশক থেকে জানেন।

ঘাড়ে লাগা মাত্র ‘আঁক’ শব্দ করল সনৎ। মুখ হাঁ। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। দু’হাত বাড়িয়ে অবলম্বন খুঁজতে গিয়ে স্লো মোশনে এগিয়ে আসছে সাম্যব্রতর দিকে। সাম্যব্রত চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, ছেলেছোকরার দল হইহই করে এগিয়ে আসছে। সাম্যব্রত এক ধাক্কায় সনৎকে রাস্তায় ফেলে দিলেন। ফেলে দিলেন ঝান্ডাও। লাফ দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে রাজুকে বললেন, “পালাও!”

রাজু ইঞ্জিন বন্ধ করেনি। ফার্স্ট গিয়ারে গাড়ি রেখে বসে ছিল। সাম্যব্রত গাড়িতে ওঠা মাত্র টপাটপ গিয়ার বদলে পৌঁছে গিয়েছে ফোর্থ গিয়ারে। অ্যাম্বুল্যান্স ঝড়ের গতিতে পিটিএস থেকে রেস কোর্সের ক্রসিংয়ে চলে এসেছে। পিছনে দৌড়ে আসছে ছেলের দল। ইট ছুড়ছে, খিস্তি করছে। একটা বাইকও আসছে ডিকডিক শব্দ করে। সাম্যব্রত কপালের ঘাম মুছলেন। তিনি জানেন, ওরা আর কিছু করতে পারবে না। সামনেই রবীন্দ্র সদন। মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরলেই বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। এখানে ওরা ঝামেলা করতে আসার সাহস পাবে না।

গাইনি ইমার্জেন্সির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামল রাজু। ওর সব চেনা। কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছে একটা ট্রলি। গাড়ির দরজা খুলে রাজু দরিয়াকে বলল, “এখানে চলে আসুন।”

দরিয়া হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, তলপেট চেপে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। জ্ঞান আর জ্ঞানহীনতার ধূসর সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে। যম আর মানুষের টাগ অফ ওয়ারে ক্লান্ত। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। সাম্যব্রত আর রাজু মিলে কোনওরকমে তাকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে ট্রলিতে তুলল। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ইমার্জেন্সিতে ঢুকছে রাজু। সাম্যব্রতর ভিতরে আর একটা ফোঁটাও এনার্জি বাকি নেই। তিনি সিঁড়িতে বসে পড়ে হাঁপাচ্ছেন। শ্বাসকষ্টটা এতক্ষণ ছিল না। এবার ফিরে আসছে। পকেট থেকে ইনহেলার বার করে দুটো পাফ নিলেন তিনি। একটু জিরিয়ে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। এরা আবার কোথায় পাঠাবে কে জানে! সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে এখন প্রায় ছ’টা বাজে। এখনও মেয়েটার একটা গতি হল না। পকেটে লাখ লাখ টাকা না থাকলে সাধারণ মানুষের কি এদেশে চিকিৎসা হবে না? সকলের জন্যে স্বাস্থ্য— এটা কি কথার কথা হয়েই থেকে যাবে?

দু’জন জুনিয়র ডাক্তার আর একজন সিস্টার মিলে দরিয়াকে দেখছে। হাতের স্যালাইনের লাইন ঠিক করে দিচ্ছে। একজন জুনিয়র ডাক্তার এগিয়ে এসে সাম্যব্রতকে বলল, “আপনি পেশেন্টের বাবা?”

“হ্যাঁ।” জবাব দিলেন সাম্যব্রত।

“আমাদের স্যর ওটি-তে আছেন। ডলিম্যাম ওঁকে ফোন করে সব জানিয়েছেন। আমরা এখনই অপারেশন শুরু করছি। তবে একটা কথা…”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাম্যব্রত বললেন, “বলুন।”

হাতের ইশারায় ট্রলি নিয়ে যেতে বলল জুনিয়র ডাক্তার। ট্রলি চোখের আড়াল হতেই বলল, “এই অপারেশনে রিস্ক আছে। সবাইকেই ওটি-র আগে রিস্ক বন্ডে সই করতে হয়। তাতে লেখা থাকে, ‘রোগীর কিছু হয়ে যেতে পারে জেনেও আমি অপারেশন করাতে রাজি হচ্ছি।’ কিন্তু এই পেশেন্টের ক্ষেত্রে সত্যিই কিছু হয়ে যেতে পারে। অজ্ঞান করার পরে কী হবে আমরা কেউই জানি না। বেশ ব্লাড লস, প্রোলংড লেবার। তার উপরে অজ্ঞান করা। এগুলো খুব আনপ্রেডিক্টেবল।”

সিস্টার একটা ছাপা ফর্ম এগিয়ে দিয়েছে সাম্যব্রতর দিকে। সাম্যব্রত কলম বার করার জন্য পাশঝোলায় হাত ঢোকালেন। একই সঙ্গে হাতে ঠেকল রেডবুক আর বিপত্তারিণীর পুজোর ফুল। আজ আর দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য করলেন না সাম্যব্রত। দুটিতেই হাত ছুঁইয়ে অবশেষে ব্যাগ থেকে কলম বার করে আনলেন। কাগজটা না পড়েই সই করে দিলেন। সিস্টার বলল, “বাইরে অপেক্ষা করুন। ওটি শেষ হলে আপনাকে ডেকে নেওয়া হবে।”

সাম্যব্রত বাইরে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে রাজু।

রাস্তার দোকান থেকে চা আর কেক কিনে খাচ্ছেন দু’জনে। সাম্যব্রতকে মোবাইল ফেরত দিয়ে রাজু বলল, “আপনি যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন আপনার জামাইয়ের ফোন এসেছিল। আমি ফোন ধরে বলেছি, ‘পরে ফোন করুন’। মেয়েকে চাইল। কিন্তু সে কথা বলার অবস্থায় ছিল না।”

“আগে বলোনি তো!” চায়ে চুমুক দিয়ে কল লিস্ট দেখছেন সাম্যব্রত।

“বলার অবস্থা ছিল?” কেকে কামড় দিয়েছে রাজু।

সাম্যব্রত ঘাড় নাড়লেন। সত্যিই! গত আধঘণ্টা যে রকম ঝোড়ো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে শ্বাস নেওয়া মুশকিল ছিল। সাম্যব্রত শ্বাস নিতে পারছিলেন না বলেই নেবুলাইজার ব্যবহার করেছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বিহানকে ফোন করলেন তিনি। একবার রিং হতেই বিহান ফোন ধরে বলল, “আপনি কোথায়? আপনার ফোন অন্য একজন ধরেছিল। আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”

“চিন্তার কিছু নেই,” জামাইকে নিশ্চিন্ত করতে সাম্যব্রত বললেন, “তখন একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভার ফোন ধরেছিল। ওসব কথা ছাড়ো। দরিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুমি কখন আসছ?”

“আমি এই তো বঙ্গবাসী হাসপাতাল থেকে বেরলাম। কোথাও কোনও গাড়ি নেই। সনৎ আমার জন্যে একটা বাইকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাতে করেই আমরা আসছি।”

সাম্যব্রতর চা খাওয়া বন্ধ। খালি ভাঁড় ঝুড়িতে ফেলে সিগারেট ধরিয়ে তিনি বললেন, “আমরা মানে? তোমার সঙ্গে আর কে আছে?”

“আমি আর সুদামদা। ওঁকে আপনি চিনবেন না। আমার পরিচিত।”

“সনতের পরিচিত নয় তো?”

“কেন বলুন তো?”

সাম্যব্রত জানালেন, পিটিএস স্টপে কী হয়েছিল। সনতের লোকজনদের রাস্তা অবরোধ, পথ আটকানো এবং তাঁর সঙ্গে হাতাহাতি—সবটাই জানালেন। শুধু নিজের ভাষণ দেওয়ার কথাটা চেপে গেলেন।

বিহান সবটা শুনে বেজায় অবাক হয়ে বলল, “এতক্ষণে বুঝেছি!”

“কী?”

“সনতের যে একটা চারচাকা আছে এটা আমি কানাঘুষোয় শুনেছিলাম। লোকে বলে ও নাকি গাড়ি নিয়ে বকুলতলায় যাতায়াত করে। আমি যা মাইনে পাই, ও তাই-ই পায়। ওই টাকায় সংসার চলে না। গাড়ি কিনল কী করে কে জানে!”

“এখন এইসব কথা ভাবার সময় নয় বিহান।”

“আমি বকুলতলা থেকে বেরনোর পরে সনৎ ওর গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়েছিল। আমাকে বলেনি যে গাড়িতে ফিরবে। তা হলে আমাকে লিফ্‌ট দিতে হত।”

সিগারেটে টান দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “আবারও বলছি এখন এসব ভাবার সময় নয়। তোমাদের একমাত্র কাজ নিরাপদে এখানে এসে পৌঁছনো। তুমি এখন কোথায়?”

“সবে ফোরশোর রোডে পড়েছি। এখানে রাস্তা শুনশান।”

“দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে যাওয়ার পরে যে রাস্তা ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে ঘুরে গেছে, সেইটা ধরো। রেড রোড হয়ে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে এসো। পিটিএসের সামনে দিয়ে না আসাই ভাল। ওখানে সনৎ তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

“আমরা যদি অবরোধের খানিকটা আগে বাইক থেকে নেমে পড়ে বাকি রাস্তাটা হেঁটে যাই?”

“আমি এখান থেকে কোনও পরামর্শ দেওয়ার জায়গায় নেই বিহান। ও, হ্যাঁ। একটা পরামর্শ দিতে পারি। রাস্তা থেকে সব দলের পতাকা জোগাড় করে সঙ্গে রাখো। কিশলয় পার্টি, খরাজ পার্টি, গণতান্ত্রিক মোর্চা… তিন দলেরই। প্রয়োজন মতো ব্যবহার কোরো। এইসব ছ্যাঁচড়া পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে ডিল করতে গেলে আমাদেরও ছ্যাঁচড়া হতে হবে।”

“ভাল বলেছেন,” হাসছে বিহান, “মন্টুদা, বাইক দাঁড় করাও।”

সাম্যব্রত আগেই ফোন কেটে দিয়েছিলেন, তাই মন্টুর নাম শুনতে পাননি। পেলে বিহানকে পরামর্শ দিতেন অবিলম্বে বাইক থেকে নেমে পড়তে। মন্টুও বুঝতে দেয়নি, সে সব কথা শুনেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *