শেষ নাহি যে – ১২

“উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেওয়ার স্বভাব খুব খারাপ,” নিজের মনে বলল বিহান।

সুদাম গুনগুন করে সুর ভাঁজছিল। সেটা থামিয়ে ভাববাচ্যে বলল, “কার উপরে রাগ করা হচ্ছে?”

“আমার বন্ধু সনৎ। বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছে আমি কোথায়। কিন্তু নিজে কোথায় আছে সেটা বলছে না।”

বিহানের কথা থামিয়ে সুদাম বলল, “ওই দেখো!” তার আঙুল আকাশের দিকে।

উপরে তাকিয়ে বিহান দেখল খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শ্যাওলা রঙের একটা হেলিকপ্টার। এতটাই নীচ দিয়ে উড়ছে যে রোটর ব্লেডের শপশপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিহান বলল, “এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার।”

সুদামের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কখনও হেলিকপ্টার দেখেনি। অবাক হয়ে বলল, “প্লেন এত নীচ দিয়ে যায় নাকি?”

“কী ব্যাপার কে জানে! তাড়াতাড়ি চলো সুদামদা,” হাঁটা লাগিয়েছে বিহান। রেল মিউজ়িয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলেই ফোরশোর রোড। রাস্তায় কোনও লোক নেই। একটি লরি অনেকক্ষণ ধরে পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। জ্বলন্ত লরির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্মির ভ্যান। ধোঁয়ার কারণে দেখতে পায়নি দু’জনে। সেখান থেকে ভেসে এল, “আব্বে ওয়ে নওটঙ্কি! হাথ উপর!”

সুদামের পোশাক দেখে ওদের মনে হয়েছে যাত্রাদলের অভিনেতা। বিহান দেখল ধোঁয়ার আড়াল থেকে খটখট জুতোর আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে ছ’ফুটিয়া এক জওয়ান।

বিহান আর সুদাম দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা এগিয়ে এসে সুদামের হাতের একতারার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের নল গলিয়ে বলল, “ইয়ে কেয়া হ্যায়?”

“এটা একতারা। গান গাওয়ার সময়ে লাগে।” ব্যথাহত মুখে জানাল সুদাম। যেন বন্দুকের নল একতারায় নয়, তার বুকে ঠেকানো রয়েছে।

“ইকতারা!” ঘাড় নাড়ল ফৌজি, “ইসকো লেকে কঁহা যা রহা হ্যায়?”

বিহানের হিন্দি খুব খারাপ। সে বলল, “মেরা বিবিকা তবিয়ত খারাপ স্যর। হাসপাতাল যাচ্ছি স্যর। শি ইজ় প্রেগন্যান্ট স্যর।”

বিহানের হিন্দি শুনে ফৌজি হাসছিল। শেষটা শুনে হাসি মুছে বলল, “জলদি বিবিকে পাস যাও।”

চিৎকার শুনেই বিহান আর সুদাম দৌড় দিয়েছে। দু’জনে চলে এসেছে বঙ্গবাসী হাসপাতালের পিছনের গেটে।

এখানে রোগীর বাড়ির লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়ি বা সিগারেটে টান দিয়ে নিচ্ছে, এক ভাঁড় চা বা একটা কেক খেয়ে নিচ্ছে। বিহান বলল, “এক ভাঁড় চা খাই। একবার হাসপাতালে ঢুকে গেলে আর বেরতে পারব না।”

“চলো,” বলল সুদাম। একতারা বাজিয়ে গান ধরল, “বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা…” ঘোর শীতে সুদাম বসন্তের গান গাইছে। বিহানের মুখে তেতো হাসি ফুটে উঠল। তার মনে পড়ে গেল, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় সে আর দরিয়া বাড়িতে গুলতাপ্পি দিয়ে মন্দারমণি বেড়াতে গিয়েছিল। থাকার কোনও সমস্যা নেই। মণিদীপার জ্যাঠার হোটেল আছে সেখানে।

* * *

প্ল্যানটা প্রথম আসে বিএস ম্যাডামের মাথায়, “দোলের সময় সবাই মিলে মন্দারমণি গেলে কেমন হয়?”

“খুব ভাল হয় ম্যাডাম। ওখানে আমার জ্যাঠার হোটেল আছে,” গর্বের সঙ্গে বলেছিল মণিদীপা।

“তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই। এই বছর দোল পড়েছে দোসরা এপ্রিল। শুক্রবার। আর হোলি পড়েছে শনিবার। আমরা বৃহস্পতিবার রাতে চলে গেলাম আর রবিবার সকালে চলে এলাম। আইডিয়াটা কেমন?”

সারা ক্লাস আনন্দে হইহই করে উঠেছিল।

প্রিন্সি ম্যাডাম প্রস্তাবটা এক কথায় খারিজ করে দিলেন। বিএস ম্যাডামকে ধমক দিয়ে বললেন, “এতগুলো কমবয়সি মেয়েকে নিয়ে ওইসব জায়গায় রাত কাটানোর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কিছু একটা হয়ে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি।”

প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেল, কিন্তু আইডিয়াটা মণিদীপা মারফত পৌঁছে গেল বিহানের কাছে। যেদিন প্রিন্সি ম্যাডাম ফতোয়া জারি করলেন, সেই দিন রাত ন’টার সময়ে দরিয়ার মোবাইলে বিহানের ফোন এল।

রোজ রাত ন’টায় দরিয়া বসবাস-এর ছাদে চলে যায়। নীচে থাকলেই সীমা হাজারটা প্রশ্ন করেন। “কার ফোন?” “এত রাতে ফোন কেন?” “দিনের বেলা ফোন করা যায় না?” “ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?”

সাম্যব্রত মুখে কিছু বলেন না। মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ দিয়ে যা বলার বলে দেন। দরিয়া তাই ফোনে প্রেম করার সময়ে ছাদে চলে যায়। একতলা বাড়ির ছাদে ওঠার জন্য একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে। কয়েকটা টব আর জলের ট্যাঙ্ক ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই।

ফোনালাপের সময় দু’জনে কলকল করে কত যে গল্প করে! সকালে কী খাওয়া হল, কী পরে কলেজ যাওয়া হল, কলেজে কে কার সঙ্গে কী করল, কোন ম্যাডাম বা স্যরের পিছনে লাগা হল… এইসব অর্থহীন বকরবকর। সেগুলো বলতে আর শুনতে যে কী ভাল লাগে! মাঝে মাঝে কথা ফুরিয়ে যায়। তখন দু’জনেই নীরব। বসবাস-এর ছাদে বসে দরিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, বিহানও নিজের ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দিন শেষ হয়ে গিয়েছে, নেমে এসেছে রাত, পৃথিবী টুক করে সূর্যের চারদিকে আর এক পাক ঘুরে নিচ্ছে। সারা দুনিয়া জুড়ে অনেক শিশুর জন্ম হচ্ছে। মারা যাচ্ছে অনেক লোক। নদী আর সাগরে দূষণ বাড়ছে। ফসিল ফুয়েল আরও একটু কমে এল। বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ আর একটু বেড়ে গেল। পৃথিবী আরও একটু কম বসবাসযোগ্য হল। এই অনন্ত এবং নিরবধি কালচক্রের মধ্যে মোবাইলে গাল ঠেকিয়ে বসে রয়েছে দুই যুবক-যুবতী। কেননা তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছে। কী আশ্চর্য আর রহস্যময়, কী জটিল আর অলৌকিক এই প্রেম!

আজ প্রথম থেকেই বিহান আক্রমণাত্মক। চোখা প্রশ্ন করছে। স্ট্রেট এবং টু দ্য পয়েন্ট উত্তর চাইছে। “তোমাদের কলেজ থেকে মন্দারমণি যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে। সেটা তোমার বাড়ির লোক জানে?”

“না। কেন?” অবাক দরিয়া।

“গুড। তুমি আর মণিদীপা মন্দারমণিতে যাচ্ছ। উঠছ ওর জ্যাঠার হোটেলে।”

“এটা কখন ঠিক হল?”

“এটা আমি আর মণিদীপা মিলে ঠিক করেছি। মণিদীপার বন্ধু, আমাদের কলেজের সুদীপ্তও যাচ্ছে। আমি আর সুদীপ্ত অনন্যা হোটেলে উঠব। বুকিং-এর দায়িত্ব মণিদীপার। মন্দারমণি পৌঁছে হোটেলে উঠে তোমরা রাত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে। আর পরদিন ভোরবেলা আমাদের হোটেলে চলে আসবে।”

“অসভ্য কোথাকার!” ঝাঁঝিয়ে উঠেছে দরিয়া, “তোমাদের মাথায় কি ওইসব ছাড়া আর কিছু নেই?”

“লুকিয়ে লুকিয়ে আর কতদিন চুমু খাব? সিনেমা হলের কোণের সিটে বসতে আর ভাল্লাগে না। এবার একটা এসপার-ওসপার হয়েই যাক।”

“তুমি কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছ,” হঠাৎ গম্ভীর দরিয়া, “কাদের সঙ্গে মিশছ বলো তো?”

দরিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিহান বলল, “ব্যাগে কী কী নিতে হবে, বাড়িতে কী ঢপ মারতে হবে, সেগুলো মণিদীপা তোমায় বুঝিয়ে দেবে। রাখছি।” তারপর ফোন কেটে দিল।

পরদিন সকালেই মণিদীপা বসবাস-এ এসে এমন নাটক শুরু করল যে লজ্জায় দরিয়ার কান লাল। কলেজ থেকে যাওয়াটা বাতিল হয়ে যাওয়া, প্রিন্সি ম্যাডামের কারণে জ্যাঠার কাছে মণিদীপার সম্মান মাটিতে মিশে যাওয়া, জ্যাঠার মুখরক্ষা করতে দরিয়ার সঙ্গে মন্দারমণি যাওয়ার প্ল্যান, দরিয়ার আপত্তিতে প্ল্যান ঘেঁটে যাওয়া— পুরোটা অভিনয় করে দেখাল। সাম্যব্রত অবাক হয়ে দরিয়াকে বললেন, “ঘুরে আয়। কাছেই তো।”

“সামনে পরীক্ষা বাবা!” লজ্জায় সাম্যব্রতর চোখে চোখ রাখতে পারছে না দরিয়া, “তা ছাড়া খরচও আছে।”

“কিচ্ছু খরচ নেই। বললাম না, ওটা আমার বাবার হোটেল! সরি! জ্যাঠার হোটেল!”

বৃহস্পতিবার দিঘার ট্রেনে উঠে বসল দুই বান্ধবী। বিহান আর সুদীপ্ত কীভাবে মন্দারমণি পৌঁছবে দরিয়া জানে না। সাম্যব্রত আর মণিদীপার বাবা ছাড়তে এসেছিলেন। তখনই দরিয়া জেনে গেল, মণিদীপার জ্যাঠা সারা সপ্তাহ হাওড়ার বাড়িতে থাকেন। উইকেন্ডে মন্দারমণি গিয়ে ব্যাবসা সামলান।

ট্রেন ছেড়ে দিল। দরিয়ার জীবনে এই প্রথমবার বাবা-মা’হীন ট্রেনযাত্রা। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখ চলে গেল দরিয়ার। তার পাশে বসে মণিদীপা বকবক করে যাচ্ছে।

কাঁথি স্টেশনে নেমে ট্রেকারে চেপে চাউলখোলা হয়ে মন্দারমণি পৌঁছে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় দরিয়ার। এত সুন্দর জায়গা পশ্চিমবাংলায় আছে? বাড়ির এত কাছে? অবিশ্বাস্য! পরের বার অবশ্যই বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতে হবে!

হোটেলে চেক-ইন করার পরে রুমেই আড্ডা মারল দু’জনে। রাত ন’টার মধ্যে ভাত আর পমফ্রেট মাছের ঝাল দিয়ে ডিনার করে শুয়ে পড়ল ওরা।

পরদিন সূর্য ওঠার আগে উঠে পড়েছে মণিদীপা। তুলে দিয়েছে দরিয়াকেও। “তাড়াতাড়ি চল! ব্রেকফাস্ট এখানে করব। ওদের জন্যও খাবার নেব। এখন বেরব, ফিরব সেই লাঞ্চের সময়।”

“ওরা চলে এসেছে?” ভয়ের চোটে বুক ধড়ফড় করছে দরিয়ার।

“কাল আমাদের সঙ্গে এক ট্রেনেই এসেছে।” সমুদ্রে স্নানের পোশাক, তোয়ালে, জল প্রতিরোধক মোবাইল কভার, সানস্ক্রিন লোশন আর রোদচশমা ব্যাগে ভরে রুম থেকে বেরচ্ছে মণিদীপা। ম্যানেজারকে বলছে, “আমরা কিন্তু সেই লাঞ্চের সময় ফিরব। সারা সকাল চান করব। জোয়ার ক’টার সময়ে আসে?”

মালিকের ভাইঝিকে তোয়াজ করতে ব্যস্ত ম্যানেজার। সে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সঙ্গে ভাল গাইড দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের হোটেলেরই মেয়ে।”

“কাউকে লাগবে না কাকু। আমরা আশেপাশেই থাকব। আপনার নম্বর আমার কাছে আছে। দরকার হলে ফোন করব।”

ম্যানেজার চুপ করে গেল। দু’জনে লুকিয়ে মদ খাবে। সেই জন্য সঙ্গে কাউকে রাখতে চাইছে না।

ছোট্ট দুটো ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছে দুই বান্ধবী। এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে চলে এসেছে বিহানদের হোটেলের সামনে। এখানে একগাদা বাঙালি ট্যুরিস্ট হইচই করছে। কে হোটেলে ঢুকছে, কে বেরচ্ছে… নজরদারি করার কেউ নেই।

সমুদ্রের ধারে দরিয়া আর বিহানের দেখা হয়ে গেল। নীল শর্টস আর খালি গায়ে বিহানকে খুব সেক্সি লাগছে! অন্য মেয়েরা টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে বিহানকে। সেটা চোখে পড়ল দরিয়ার।

বিহানের নিজেকে কখনও এত পূর্ণ বলে মনে হয়নি। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশ, ঝিকিয়ে ওঠা রোদের বল্লম, চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ানো শীত, হাসিখুশি মানুষের ঢল, খলবলিয়ে এসে সারা শরীর চাটতে থাকা সমুদ্রের জিভ… এই সবই তার জীবনে প্রথম। পাশে নিজস্ব নারী থাকার ফলে নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে মনে হচ্ছে।

সুদীপ্ত আর মণিদীপা হোটেলের ঘরে ঢুকে গিয়েছে। বিহান সেই চেষ্টা করল না। সমুদ্রের জলে গা ভিজিয়ে, বালির উপরে বসে দরিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “ভদকা খাবে?”

বিহানের কাঁধে মাথা রেখে দরিয়া আঙুল দিয়ে বালিতে আঁকিবুকি কাটছে। ব-এ হ্রস্ব ই, হ-এ আকার, দন্ত্য-ন। লেখা শেষ হওয়ার আগেই নোনা জল এসে কখনও ব খেয়ে নিচ্ছে, কখনও দন্ত্য-ন, কখনও হ্রস্ব-ই। আবার লিখছে দরিয়া। এ এক মজার খেলা। হার নিশ্চিত জেনেও খেলে যেতে হয়। বিহানের প্রশ্ন শুনে সে বলল, “খাব। কিন্তু অন্য জায়গায় চলো। এখানে বড্ড চিৎকার।”

হোটেলের রুমে ঢুকে মদ্যপান না করে বিহান আর দরিয়া চলে গেল মোহনার কাছে। এদিকে হোটেল কম, ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। বেলাভূমিতে ছোট্ট ঝুপড়ি বানানো রয়েছে। সেখানে বিয়ার আর মাছভাজা কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এক প্লেট পমফ্রেট ভাজা কিনে ফিরে এল বিহান। ঝাউগাছের ছায়ায় বসে ব্যাকপ্যাক থেকে বার করল ভদকার কোয়ার্টার বোতল, মিনারেল ওয়াটার আর গেলাস। জল ও সুরার মেলামেশা হয়ে গেলে গেলাস হাতে নিয়ে বিহান বলল, “চিয়ার্স!”

“আমি কিন্তু আগে কখনও খাইনি,” লজ্জা পাচ্ছে দরিয়া, “যদি কিছু হয়ে যায়?”

“আজ তুমি এমন অনেক কিছু করবে, যা আগে করোনি। ভদকায় ভয় পেলে চলে?”

“নোংরা! অসভ্য! বাজে একটা লোক!” লজ্জায় লাল হয়ে এক চুমুকে গেলাস শেষ করে দিল দরিয়া। বিহান আঁতকে উঠে বলল, “অত তাড়াতাড়ি নয়! চড়ে যাবে তো! তোমাকে তখন পাঁজাকোলা করে হোটেলে দিয়ে আসতে হবে।”

“হোক শালা! তাই হোক!” গেলাস বাড়িয়ে দিয়েছে দরিয়া।

“হাফ পেগ মাল খেয়ে তোমার নেশা হয়ে গেছে!” ফিকফিক করে হাসছে বিহান।

“তুমি বুধনকাকাকে চেনো?” হুট করে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে গিয়েছে দরিয়া।

“কে, সে?”

“আমাদের পাড়ায় থাকে। সকালবেলা দুধ আর বিকেলবেলা ফুচকা বিক্রি করে। বুধনকাকার বাংলা আর আমার মায়ের হিন্দি শুনলে তুমি না হেসে থাকতে পারবে না। আমি বলার চেষ্টা করছি।” আবার এক চুমুকে মদ শেষ করে পমফ্রেটে কামড় দিয়ে দরিয়া বলল, “এই বিহানোয়া! তুম হমকো ভালবাসতা হ্যায়?”

বিহান জিজ্ঞেস করল, “ইয়ে ভালবাসা হোতা কেয়া হ্যায়?”

“ভালবাসা আর ভূত একই রকম হোতা হ্যায়। কোই নেহি দেখা। কিন্তু সবাই মানতা হ্যায় কে ভূত হ্যায়। তুম বুঝ নহি সকতা?”

বিহান হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, “খুব বুঝ সকতা হ্যায়। আর তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলি, ‘হ্যাঁ। হাম তুমকো ভাল বাসতা হ্যায়।’”

“কতটা বাসতা হ্যায়?”

“অনেকটা বাসতা হ্যায়।”

“ঝুট কেন বোলতা হ্যায়? তোমার মতলব হাম সমঝতা হ্যায়। হোটেলের রুম মে লে জাকে হিজিবিজি কাম করেগা। ইস লিয়ে হমকো মদ খাইয়ে দিয়েছ।”

“দূর শালা! এ তো মহা ঝামেলা!” বিহান রাগের অভিনয় করছে, “ঠিক আছে। তোমাকে আমাদের হোটেলে যেতে হবে না। তুমি তোমার হোটেলে যাও।”

“শাট আপ!” আঙুল তুলে বলে দরিয়া, “এখন থেকে আমি যা বলব, সেটাই হোগা। আর দারু হ্যায়?”

“না। শেষ হয়ে গেছে।”

“হোটেলের রুমে হ্যায়?”

“হুম!”

“হুমহাম বাদ মে করেগা। পহেলে ইয়ে বাতাও, তুম হামকো বিয়ে করেগা?”

বিহান ভুরু কুঁচকে বলল, “পারলে তো আজ, এখানেই বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন না করলে কোনও চাকরি পাওয়ার চান্স নেই।”

“ধ্যাত্তেরিকা!” বাঁ হাতের পিছন দিয়ে মুখ মুছে উঠে দাঁড়িয়েছে দরিয়া, “এখন নয়। টাইম পে বিয়ে করেগা তো? না কি অন্য লড়কি দেখকে ভাগ যায়গা?”

দরিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে বালিতে হাঁটছে বিহান, “তুমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে আমার ভাল লাগে না দরিয়া। এই সব কথা কেন বলছ? আমাকে প্লিজ় একটা কাজ জোটাতে দাও। তার আগে বিয়ে বিয়ে করে লাফিয়ো না।”

দরিয়া এখন সিরিয়াস। সে বলল, “বাবা কিছু বলে না। কিন্তু মায়ের তরফ থেকে চাপ আছে। বাবাকে রোজ বলে খবরের কাগজের পাত্রপাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দিতে।”

“মা’কে বলে দাও যে তুমি একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করো।”

“মা জিজ্ঞেস করবে ছেলেটা কে? কী করে? কত টাকা মাইনে পায়?”

“মা’কে বলবে ছেলেটার নাম বিহান চট্টোপাধ্যায়। হাওড়া ময়দানে থাকে। বি কম সেকেন্ড ইয়ার। এখনও পর্যন্ত এক টাকাও রোজগার করে না। তবে আমাকে ফুলটাইম ভালবাসে।”

বিহানদের হোটেল এসে গিয়েছে। দরিয়ার কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে বিহান। বাঙালি পরিবারটির কর্তা জড়ানো গলায় বলছেন, “বাহামা, কেম্যান আইল্যান্ড, বালি, ওয়াইকিকি— দুনিয়ার সেরা সব সি বিচ আমার ঘোরা। তারা কেউ বাংলার মন্দ-রমণীর সঙ্গে পেরে উঠবে না।”

হোটেলের রুমে ঢুকে আবার একটু মদ্যপান হল। গল্পগুজব কম হল, ভাব-ভালবাসা বেশি হল। কিন্তু আমরা সেদিকে তাকাব না। দুই যুবক-যুবতীর ব্যক্তিগত মুহূর্তকে প্রকাশ্যে আনার কী প্রয়োজন?

নির্দিষ্ট দিনেই বাড়ি ফিরে এসেছিল দরিয়া আর মণিদীপা। বিহান আর সুদীপ্তও। সনৎ জানতে পারেনি এই গোপন অ্যাডভেঞ্চারের কথা। সে তখন রাজনীতির সাপলুডো খেলায় মত্ত।

সেই বসন্তেই দুই পক্ষের বাড়ির অজান্তে বিহান আর দরিয়ার বিয়ে হল ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে। দরিয়ার তরফে সাক্ষী ছিল মণিদীপা এবং এক কলেজ বান্ধবী। বিহানের তরফে সুদীপ্ত এবং কলেজের আর এক বন্ধু। তাদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল, সনৎ যেন এই সংবাদ জানতে না পারে।

ওরা বলেনি। বি কম ফাইনালের রেজ়াল্ট বেরল। শুরু হল চাকরি খোঁজার দুঃসময়। অবশেষে সনতের দাক্ষিণ্যে বকুলতলা পোর্টে ডেটা এন্ট্রি অপারেটারের চাকরিটা জুটিয়ে ফেলল বিহান।

তাকে না দিয়ে বিহানকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে বলে রাগের চোটে সুদীপ্ত সনৎকে বলে দিল, দরিয়া আর বিহানের রেজিস্ট্রি ম্যারেজের কথা।

সেই থেকে সনতের সঙ্গে বিহানের সম্পর্ক চিরকালের জন্য খারাপ হয়ে গিয়েছে। সনৎ বিহানের বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে বদলে হয়ে গেল শত্রু। প্রথমেই সে শ্রীরূপাকে বলে দিল যে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে বিহান আর দরিয়া রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিল। সঙ্গে জুড়ে দিল, দরিয়ার জন্যই বিহানের বি কমের রেজ়াল্ট ভাল হয়নি।

শ্রীরূপা সব শুনে ঠান্ডা মাথায় বিহানকে বললেন, “আমি যত দিন বেঁচে থাকব ততদিন যেন ওই মেয়েটা এই বাড়িতে না ঢোকে। আমি মরে গেলে বেলেল্লাপনার হাট বসিয়ো।”

মন্দারমণির সেই দিনগুলোকে আজকাল স্বপ্ন বলে মনে হয় বিহানের। ঝাড়া হাত-পা দুটো ছেলেমেয়ে, একে অপরকে ভালবেসে কাছে আসার চেষ্টা করছে, একটু নিরালা খুঁজছে, সুযোগ পেলেই ঠোঁটে ঠোঁট রাখছে, শরীরে শরীর মিশে যাচ্ছে— ওই স্বর্গীয় অনুভূতি জীবনে একবারই আসে। সামাজিক বিয়ের সময় থেকেই তাদের জীবনে শুধু অশান্তি। বিয়ে হল শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে শ্রীরূপা এলেন না। বিয়ের পরে দরিয়া শ্বশুরবাড়ি যেতে পারেনি। বিহানকে এক সপ্তাহে তিন জায়গায় থাকতে হয়। মানে বেশি খরচ। দরিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি করত। কলেজের পাট শেষ হওয়ার পরে সেটা বাড়িয়েছে। বিয়ের পর থেকে সে ফুলটাইম প্রাইভেট টিউটর। বিহানও তার মাইনের একটা অংশ ব্যাঙ্কে রাখছে। অল্প অল্প করে, বিদুরের খুদের মতো সঞ্চয় জমছে যৌথ সেভিংস অ্যাকাউন্টে।

এক ছাদের নীচে থাকতে গেলে সবার আগে একটা ঘর চাই। বিহানের চাহিদা সামান্য। শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর আর নিজস্ব বাথরুম। একফালি বারান্দা হলে খারাপ হয় না। সেখানে শীতকালে বিহান মরশুমি ফুল ফোটাবে। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, পপি। একটুখানি বাগান পেলে তো কথাই নেই। বিট, গাজর, ওলকপি ফলিয়েই ছাড়বে। ফুলকপি আর বাঁধাকপিও চেষ্টা করে দেখবে। টমেটো, ধনেপাতা আর বেগুন তো এমনিই হয়। বাজার যাবে শুধু আলু, আদা, পেঁয়াজ আর রসুন কিনতে।

বাহারবেড়িয়া জংশনের কাছে একটা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে বিহান। আজকালকার ভাষায় ‘ওয়ান বিএইচকে’। একটা বেডরুম, একটা হল, একটা কিচেন। বাথরুম তো থাকবেই। ভাড়া চাইছে মাসে পাঁচ হাজার টাকা। বিহান আর দরিয়া মিলে ঠিক করে রেখেছে, বাচ্চাটা মাস ছয়েক হয়ে গেলেই ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। ওখান থেকে বিহান বকুলতলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবে। দরিয়াও সকালের ট্রেন ধরে লিলুয়ায় এসে সারাদিন টিউশনি করে আবার ফিরে যাবে। বাচ্চাটা মায়ের সঙ্গেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবে। করুক। কম বয়স থেকেই শিখুক লড়াই কাকে বলে।

সবচেয়ে বড় কথা, তারা দু’জনে একসঙ্গে রাত কাটাতে পারবে। এত দিন বিয়ে হয়ে গেল। তেমন করে পরস্পরকে চেনাই হল না। সংসার করার মানে এখনও পর্যন্ত জানতেই পারল না বিহান। যাদের টাকা নেই, তাদের কি ভগবান সব দিক দিয়েই মেরে রাখে? কে জানে!

* * *

বিহানের চটকা ভাঙল সুদামের কথায়। “চা যে জুড়িয়ে গেল! ভুরু কুঁচকে এত কী ভাবছ?”

লজ্জা পেয়ে ঘাড় নাড়ল বিহান, “কিছু না!” এক চুমুকে চা শেষ করে চায়ের দাম মিটিয়ে হাসপাতালে ঢুকল। অনুসন্ধান কেন্দ্রের কর্মচারীকে দরিয়ার নাম বলতে সে বলল, “সামনেই সার্জিকাল ওয়ার্ড। ওখানে গিয়ে আপনি ডক্টর ডলি সেনের সঙ্গে কথা বলুন।”

ডক্টর সেন সার্জারি ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন। বিহান তাঁর কাছে গিয়ে বলল, “নমস্কার ম্যাডাম। আমার স্ত্রী দরিয়া। আজ এখানে ডেলিভারির জন্য ভরতি হয়েছে।”

দরিয়ার নাম শুনে ডক্টর সেন মোবাইল বন্ধ করে বললেন, “আপনি কিছু জানেন না?”

বিহান ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি অনেক দূর থেকে আসছি। ফোনে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি।”

“এই সব গন্ডগোলের দিনে ফোনে যোগাযোগ না করে কেউ মুভ করে?” ডক্টর সেন বিরক্ত, “এনিওয়ে, আপনার বউ যখন এখানে এসেছিল, তখন অবস্থা খারাপ ছিল। ওকে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়েছে। আপনি ওখানে চলে যান।” ডক্টর সেন ব্যস্ত হয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে গেলেন।

বিহানের মাথায় হাত। এত কিছু হয়ে গেল আর সে কিছুই জানল না? যাকগে! যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখনই সাম্যব্রতকে ফোন করতে হবে।

ব্যাকপ্যাক থেকে মোবাইল বার করে বিহান দেখল, বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। সাম্যব্রতর নম্বরে ডায়াল করল সে। রিং হয়ে গেল। কেউ ফোন ধরল না। চিন্তিত মুখে রি-ডায়াল করল বিহান।

অনেকক্ষণ ধরে রিং হওয়ার পরে অচেনা একটি গলা ফোন ধরে বলল, “একটু পরে ফোন করুন।”

সাম্যব্রতর ফোন চুরি হয়ে গিয়েছে নাকি? বিহান তড়বড় করে বলল, “যাঁর ফোন তাঁকে দিন। খুব জরুরি দরকার। আমি ওঁর জামাই বলছি।” কথাগুলো বলার সময়ে বিহান শুনতে পেল, ওদিক থেকে ভাষণের শব্দ আর স্লোগানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যে লোকটা ফোন ধরেছে, সে বলল, “বললাম তো! এখন উনি কথা বলতে পারবেন না। পরে ফোন করুন।”

বিহান চিৎকার করে বলল, “তা হলে ওঁর মেয়েকে ফোন দিন!” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদিকের লোকটা লাইন কেটে দিয়েছে। বিহান অবাক, বিরক্ত, চিন্তিত! সে সাম্যব্রতর নম্বরে রি-ডায়াল করতে গেল। কিন্তু সবুজ বোতাম টেপার আগেই দেখল মোবাইলে সনতের ফোন ঢুকছে।

বিহান লাইন কেটে দিতে গিয়েও দিল না। সনৎকে চটানো যাবে না। ফোন ধরে বলল, “বল।”

সনৎ পুরনো প্রশ্নটাই করল, “তুই এখন কোথায়?” বিহান শুনল ওদিক থেকে অনেক মানুষের চিৎকার আর গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। সনৎ কি বকুলতলার মোড়ে রাস্তা অবরোধ করেছে?

সনৎ কোথায় কী করছে না জানলেও চলবে। বিহান বলল, “দরিয়াকে বঙ্গবাসী হাসপাতাল থেকে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার করেছে। আমাকে যেতে হবে। বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার। সেকেন্ড ব্রিজ দিয়ে যেতে মিনিট দশেক লাগবে। কিন্তু কীভাবে যাব বুঝতে পারছি না। রাস্তায় মিলিটারি ঘুরছে। কোনও গাড়ি চলছে না। তোর এদিকে কোনও চেনাশুনো আছে রে? তুই তো নেতা মানুষ।”

সনৎ চুপ।

বিহান বলল, “আজ সকাল থেকে আমি তোর কাছে একের পর এক ফেভার চাইছি। প্লিজ় রাগ করিস না।”

সনৎ বিহানের কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু বলল, “বঙ্গবাসী হাসপাতালে মন্টু হাইত নামে একজন ওয়ার্ড বয় আছে। বয়স্ক মানুষ। ওর সঙ্গে যোগাযোগ কর। ওকে আমি ফোন করে দিচ্ছি। কোনও না কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে।”

“তোকে যে কী বলে ধন্যবাদ…” চুপ করে গেল বিহান। সনৎ ফোন কেটে দিয়েছে।

মন্টুর কাছে যখন সনতের ফোন এল, সে তখন শো কজ়ের চিঠি নিয়ে সুপারের চেম্বার থেকে সদ্য বেরিয়েছে। ফোন ধরতেই সনৎ বলল, “যে লোকটা তোমাকে বাঁশ দিয়েছে, তার জামাইকে তোমার কাছে পাঠিয়েছি। নাম বিহান চ্যাটার্জি। তুমি তাকে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে দাও।”

মন্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “বলেছি তো, রবিবারের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা তোমার হেস্টিংসের বাড়িতে পৌঁছে দেব। আবার ওইসব কেন? এর কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে নাকি?”

“যে নকশালটার জন্য শো কজ় খেলে তার পোঙায় বাঁশ দিতে ইচ্ছে করছে না?”

“করছে না আবার?” দাঁত কিড়মিড় করছে মন্টুর, “শালাকে জায়গা মতো পেলে আছোলা দিতাম!”

“জায়গা মতো যাতে পাও, তার ব্যবস্থাই করলাম। যা বলছি করো!” ফোন কেটে দিয়েছে সনৎ।

ঝোলায় মোবাইল ঢোকাতে গিয়ে মন্টু দেখল, একটা কমবয়সি ছোকরা আর একটা মাঝবয়সি লোক তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

মন্টুর কাছে এসে ছেলেটি বলল, “আপনিই মন্টু হাইত?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” কান এঁটো করা হাসি দিল মন্টু, “আপনাদের পরিচয়?”

“আমার নাম বিহান চ্যাটার্জি। ইনি আমার বন্ধু সুদাম মিস্ত্রি। সনৎ কুইলা আপনাকে আমার কথা বলেছে?”

“বলেছে বইকী বাবা! সেই জন্যই তো আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। তা না হলে কখন বাড়ি চলে যেতাম। তবে কি না, আমার সম্বল বলতে একটা ভাঙাচোরা বাইক। তাতেই যেতে হবে। এই অশান্তির দিনে অন্য কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। রাহাখরচ বাবদ আড়াই হাজার টাকা দিয়ে দিয়ো।”

সুদাম বলল, “একটু কমসম করলে হত না? আমরা গরিব মানুষ। অত টাকা কোথায় পাব?”

মন্টু হাতজোড় করে বলল, “আমিও গরিব মানুষ দাদা। তবে কি না, আমার প্রাণের একটা দাম আছে। রাস্তায় মিলিটারির গুলি খেয়ে মরে গেলে বউ বেধবা হবে, ছেলেমেয়েরা অনাথ। নেহাত সনৎ বলেছে তাই যাচ্ছি।”

বিহান বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা। ওই টাকাই দেব। আমাদের পৌঁছনো নিয়ে কথা।”

হাসপাতালের পিছনে পার্ক করা আছে মন্টুর সাড়ে তিনশো সিসির বাইক। বিহানের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে পকেটে পুরে বাইকের দিকে এগোতে এগোতে মন্টু ভাবল, সনৎ বলেছিল একজন যাবে। এ তো দেখি দু’জন। কী হবে তা হলে? এখন আর সনৎকে ফোনও করা যাবে না!

যাই হোক। সনৎ যখন বলেছে তখন এদের পৌঁছে দিয়ে আসা যাক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *