শেষ নাহি যে – ১১

বোমা পড়ার পরে কোর্টের সামনের রাস্তা শুনশান। সাম্যব্রত উঁকি মেরে দেখলেন, একটা অটো আর দুটো রিকশার পোড়া কঙ্কাল রাস্তার মাঝখানে পড়ে রয়েছে। কয়েকটা টায়ার একা-একা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আর কালো ধোঁয়ায় চারিদিক ভরিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় লেগে রয়েছে শুকনো রক্তের দাগ। এটা সত্তরের দশক? না নতুন শতকের দ্বিতীয় দশক? মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে সাম্যব্রতর। কিছুই বদলাল না? কিছুই বদলায় না?

সীমা ফোন করেছেন। ভুজুংভাজুং দিয়ে তাঁকে চুপ করালেন সাম্যব্রত। সীমাকে সত্যি কথা বলে কোনও লাভ হবে না। অকারণে বাড়িতে বসে টেনশন করবে। ফোন কেটে মোবাইলে সময় দেখলেন তিনি। দুপুর সাড়ে তিনটে। ডক্টর ব্যানার্জি তিনটের সময় বলেছিলেন, গাইনির ডাক্তার

ডলি সেনকে কলবুক দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি এখনও এলেন না তো!

ডক্টর সেনের কথা ভাবতে না ভাবতেই সার্জারি ওয়ার্ড থেকে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা শোনা গেল, “পেশেন্ট দরিয়া চ্যাটার্জির বাড়ির লোক অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।”

ডাক্তারবিবি অনেক কাল বাঁচবেন। আধপোড়া সিগারেট ছুড়ে ফেলে, ইনহেলারে একটা টান দিয়ে ওয়ার্ডের দিকে দৌড়লেন সাম্যব্রত।

দরিয়া বাবাকে দেখে ম্লান হাসল। সাম্যব্রত দেখলেন, স্যালাইনের বদলে মেয়ের শরীরে এখন ব্লাড চলছে। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বছর পঞ্চাশের দুই ডাক্তার। একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ।

ডক্টর ডলি সেন দরিয়ার টিকিটে লেখালিখি করছেন। অন্য ডাক্তারটি দরিয়াকে পরীক্ষা করছেন। ডক্টর সেন জিজ্ঞেস করলেন, “হৃষীকেশ, কী পেলি?” তারপর সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি পেশেন্টের কে হন?”

সাম্যব্রত বললেন, “বাবা।”

নিদানপত্র লেখা শেষ করে টিকিট হৃষীকেশের হাতে ধরিয়ে ডক্টর সেন বললেন, “আমি ডলি সেন, এই হাসপাতালের সুপার ছুটিতে আছেন বলে ওঁর প্রশাসনিক কাজও সামলে দিচ্ছি। আর উনি ডক্টর হৃষীকেশ বক্‌শি। অ্যানাস্থেটিস্ট।”

ডক্টর বক্‌শি ডলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “পেশেন্টের হিমোগ্লোবিন নাইন। ব্লাড প্রেশার নব্বই বাই ষাট। আমি একে অজ্ঞান করার রিস্ক নিতে পারব না।”

সাম্যব্রত বেকুবের মতো বললেন, “বাচ্চা হওয়ার জন্য অজ্ঞান করতে হবে কেন?”

ডক্টর বক্‌শি বললেন, “লেবার পেন শুরু হয়েছে সকালে। এখন দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে। লেবার এক চুলও প্রগ্রেস করেনি। পেশেন্টের একগাদা কমপ্লিকেশন আছে। এই অবস্থায় সিজ়ারিয়ান সেকশন ছাড়া গতি নেই। এবং এটা খুব রিস্কি আর কমপ্লিকেটেড সার্জারি। বঙ্গবাসী হাসপাতালের সেট আপে সম্ভব নয়।”

এইবার বুঝতে পেরেছেন সাম্যব্রত। এঁরা দরিয়াকে রেফার করে দিতে চাইছেন। ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’। নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিক থেকে বঙ্গবাসী হাসপাতাল। এখান থেকে কোথায় যেতে হবে? কর্পোরেট হাসপাতাল? বাড়ি বিক্রি করেও টাকা জোগাড় করতে পারবেন না সাম্যব্রত। উল্টে মেয়েটা মরে যাবে। উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন, “এই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?”

সাম্যব্রত রাগে ফুটছেন। সেটা বুঝতে পেরে ডক্টর সেন বললেন, “দুনিয়ার কোনও গাইনি আপনার মেয়ের নর্মাল ডেলিভারির রিস্ক নেবেন না। সিজ়ার করতেই হবে। পাশাপাশি এটাও সত্যি, ওকে অজ্ঞান করার মধ্যে অনেক ঝুঁকি। অপারেশন টেবিলে খারাপ কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া অন্য কোথাও ওর সিজ়ার হবে না।”

বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ বা বিএমসি। বাংলার সেরা মেডিক্যাল কলেজ। খুব একটা দূরেও নয়। ফোরশোর রোড ধরে খানিকটা গেলেই দ্বিতীয় হুগলি সেতু। সেটা পেরলেই বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। যেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগবে না।

সাম্যব্রতর রাগ কমেনি। সারাদিন মেয়েকে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়োদৌড়ি করেছেন। এখন আবার মেয়েকে নিয়ে দৌড়তে হবে। এটা হ্যারাসমেন্ট নয়? তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “সবই বুঝলাম। কিন্তু সত্যিটা হল এই যে একজন প্রেগন্যান্ট মাদারের ডেলিভারি বঙ্গবাসী হাসপাতালে হল না।”

“আমি আপনার সঙ্গে একমত। তবে সেই মাদারের পায়ে বোমার টুকরো লেগে হেভি ব্লাড লস হয়েছে। মাথায় চোট আছে। লেবার প্রগ্রেস করছে না। এগুলোও মাথায় রাখতে হবে।”

সাম্যব্রত বললেন, “রাস্তায় মানুষ খুন হচ্ছে। পুলিশি টহলদারি সত্ত্বেও গন্ডগোল বাড়ছে। এই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে কীভাবে যাব বলবেন? তা ছাড়া বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ ভিআইপিদের হাসপাতাল। ওখানে আমার মতো চুনোপুঁটিকে কেউ পাত্তা দেবে না।”

ডক্টর সেন বললেন, “বিএমসির গাইনিকলজির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে আমি ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি। রেফার কার্ডও ফিল আপ করে দিচ্ছি। মেয়েকে নিয়ে গেলেই ভরতি করে নেবে।”

সাম্যব্রত যে কথাটা বলতে চাননি, সেটা এবার বলেই দিলেন, “ম্যাডাম, মেয়েকে বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভরতি করার জন্য ছ’হাজার টাকা দিয়েছি। সেটা তা হলে ফেরত পাব?”

সাম্যব্রতর কথা শুনে ডক্টর সেনের ভুরু কুঁচকে গিয়েছে। তিনি বললেন, “ছ’হাজার টাকা কাকে দিয়েছেন?”

দরিয়া বেডে শুয়ে ইশারায় সাম্যব্রতকে বলছে মুখ না খুলতে। সেটা দেখতে পেয়ে ডক্টর সেন বললেন, “তোমার ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”

সাম্যব্রত বললেন, “এমার্জেন্সির ডক্টর ঘোষ নিয়েছেন তিন হাজার টাকা, ওয়ার্ড মাস্টার নিয়েছেন দু’হাজার টাকা, আর ট্রলি বয় মন্টুদা নিয়েছে হাজার টাকা। মন্টুদা তাও তো আমাদের জন্য এই ওয়ার্ড থেকে ওই ওয়ার্ড দৌড়ে বেড়িয়েছে…” চুপ করে গেলেন সাম্যব্রত। যা বললেন না, তা হল ডক্টর ঘোষ আর ওয়ার্ড মাস্টার তো কিছুই করেননি।

ডক্টর সেন মৃদু হেসে বললেন, “আপনি সবার হাতে টাকা দিয়েছেন?”

“তা কেন?” আপত্তি করলেন সাম্যব্রত, “আমি মন্টুদাকে ছ’হাজার টাকা দিয়েছি। ও সবাইকে ভাগ করে দিয়েছে।”

ডক্টর সেন মুখ ঘুরিয়ে সিস্টারকে বললেন, “সিস্টার, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করে মন্টুদা আর ওয়ার্ড মাস্টারকে এখানে ডেকে পাঠান।” তারপর হৃষীকেশ বক্‌শিকে বললেন, “তুই এমার্জেন্সিটা পাঁচ মিনিটের জন্য সামলে দে। আর ডক্টর ঘোষকে এখানে পাঠিয়ে দে।”

ডক্টর বক্‌শি কথা না বাড়িয়ে এমার্জেন্সির দিকে চলে গেলেন। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে সিস্টারের ঘোষণা শুরু হল।

বেডে শুয়ে দরিয়ার ভয় করছে। একে তো সে জেনে গিয়েছে, অন্য হাসপাতালে যেতে হবে। এখন সাম্যব্রত যদি হাসপাতালের স্টাফ এবং সুপারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন, তা হলে অশান্তি বাড়বে।

সবার আগে এলেন ওয়ার্ড মাস্টার। তারপরে ডক্টর ঘোষ। তিনি এসেই বললেন, “বলুন মহারানি। কী অন্যায় করেছি যে তলব করেছেন! গর্দান না হয় দেব, কিন্তু কারণটা জানলে ভাল হয়।”

ডক্টর সেন হেসে ফেলেছেন, “তোর সবসময় ফক্কুড়ি। এমার্জেন্সি সামলানো মানে শুধু পেশেন্ট দেখা নয়। হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজ করাও বটে।”

“কী হয়েছে?” জানতে চাইলেন ওয়ার্ড মাস্টার।

“মন্টুদা আসুক। ওর সামনে বলছি।” সংক্ষিপ্ত জবাব ডক্টর সেনের।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্টু হাজির। ডক্টর সেনকে নমস্কার করে মিহি গলায় বলল, “ডেকেছিলেন ম্যাডাম?”

“আপনি বলুন,” সাম্যব্রতকে বললেন ডক্টর সেন।

সাম্যব্রত বুঝতে পারছেন, কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। সেটা কী, ধরতে পারছেন না। তিনি বললেন, “মন্টুদা বলেছিল মেয়েকে হাসপাতালে ভরতি করতে হলে ছ’হাজার টাকা দিতে হবে।”

মন্টুর হাবভাব বদলে গিয়েছে। সে আর আগের মতো দরিয়ার

দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই। ডক্টর সেনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পেশেন্ট পার্টির কথায় একদম বিশ্বাস করবেন না ম্যাডাম। লোকটা খুব হারামি।”

সাম্যব্রত খেলাটা বুঝে গিয়েছেন। হিস্‌সার টাকা কে কত পাবে সেটা আর একবার শুনিয়ে দিলেন। শুনে ডক্টর ঘোষ বললেন, “মন্টুদা! আমার ভাগের টাকাটা দিয়ে দাও! টাকাও দেবে না, আবার ঘুষখোর প্রমাণ করবে… দুটো একসঙ্গে কী করে হয়?”

মন্টু উত্তেজিত হয়ে বলল, “লোকটা মিথ্যে কথা বলছে স্যর! বিশ্বাস করুন, ওর সঙ্গে টাকা নিয়ে কোনও কথাই হয়নি।”

ওয়ার্ড মাস্টার সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন হাসপাতালের সব জায়গায় সিসিটিভি বসে গিয়েছে। আপনি কোন জায়গায় টাকাটা দিয়েছিলেন? এমার্জেন্সির করিডরে? আমি দেখে নিচ্ছি।”

এই কথাটা শুনে মন্টুর হাবভাব বদলে গেল। সে সোজা ডক্টর সেনের পায়ে ড্রাইভ মেরে বলল, “মাফ করে দিন ম্যাডাম। আর কোনওদিনও হবে না। ভুল হয়ে গেছে।”

ডক্টর সেন পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “টাকাটা আগে ওঁকে ফেরত দাও। তারপর ক্ষমা চাও।”

“ঠিক আছে ম্যাডাম,” সুড়ুৎ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মন্টু। সাম্যব্রতর হাতে তিনটে দু’হাজার টাকার গোলাপি নোট ধরিয়ে দিল। দরিয়ার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মা জননী! কেন এই পাপ কাজ করেছি, তা যদি জানতিস! একমাত্র মেয়েটার বিয়ে আটকে গিয়েছে!”

দরিয়া মন্টুর দিকে তাকাবে না ঠিক করেছে। সে চোখ বন্ধ করে বলল, “তুমি বলেছিলে তোমার নাতি-নাতনি আছে। বলেছিলে, বয় আর গার্লের ঠাকুরদা হয়ে গেছ, কিন্তু ওয়ার্ড বয় উপাধিটা রয়ে গেছে।”

ডক্টর ঘোষ হাসতে হাসতে বললেন, “আমি এমার্জেন্সিতে গিয়ে হৃষীকেশকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ওয়ার্ড মাস্টার বললেন, “আমিও চললাম ম্যাডাম।”

মন্টু বলল, “আমি যাই?”

ডক্টর সেন বললেন, “আজ ডিউটি শেষ করে বাড়ি যাওয়ার আগে আমার চেম্বার ঘুরে যাবে। শো কজ় লেটার আমার টেবিলে রাখা থাকবে।”

মন্টু বলল, “ম্যাডাম! এটা কিন্তু আপনি ঠিক করছেন না।” তার বলার ভঙ্গিতে প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে।

“যাও!” গলা চড়িয়ে ধমক দিলেন ডক্টর সেন, “নিজের কাজ করো।” সিস্টারকে বললেন, “মেয়েটির ব্লাড ট্রান্সফিউশন শেষ হয়ে গেলে একটা নর্মাল স্যালাইন চালিয়ে ট্রলিতে তুলে দেবেন। ওয়ার্ড বয়কে বলবেন, যেন অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেয়।” তারপর সাম্যব্রতকে বললেন, “আমি রেফার কার্ড লিখে দিচ্ছি। ওয়ার্ড মাস্টার আপনার অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দেবেন।”

সবাই যে যার কাজে চলে গেল। বেডে শুয়ে আছে দরিয়া। তার পাশে এখন কেউ নেই।

চোখ বন্ধ করে দরিয়া। তার মনে পড়ে যায়, অনেক বছর আগের এক শীতকালের কথা। যখন সে এই বঙ্গবাসী হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে এসেছিল। প্রথমবার দেখা হয়েছিল বিহানের মা শ্রীরূপার সঙ্গে।

* * *

যেদিন ‘ডিডিএলজে’ দেখার কথা ছিল, তার পরের দিন দরিয়া কলেজে যেতেই মণিদীপা চেপে ধরে বলল, “হ্যাঁ লা বকুলফুল। সত্যি কতা বল দিকি। কাল থেকে তোর মোবাইল ফোন বন্দ কেনে? একটা মজার কতা বলতে ফোন করেছিলুম। বিএস ম্যাডামের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাচ্চে।”

গতকাল সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা মণিদীপাকে বলেনি দরিয়া। বললেই আজেবাজে প্রশ্ন করত। শিক্ষিকা সংক্রান্ত গসিপে জল ঢেলে দিয়ে দরিয়া বলল, “মোবাইলটা গন্ডগোল করছে। সারাতে দিয়েছি। এখন কয়েকদিন আমাকে ফোনে পাবি না।”

“কী হয়েচে বল দিকিনি,” দরিয়ার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছে মণিদীপা, “তোর চোখমুখ বাপু ভাল ঠেকচে না। বরের সঙ্গে ঝামেলি হয়নি তো?”

একেবারে বর-বউ তে চলে গিয়েছে। এই জন্যই মেয়েটাকে কিছু বলতে চায় না দরিয়া। সে বলল, “বাজে না বকে কাজের কথা বল। কাল প্রক্সিটা ঠিকঠাক দিয়েছিলি?”

“ওতে আমার কোনও গন্ডগোল হবেনি,” চোখ মেরে বলল মণিদীপা, “তুই আজ আমারটা মেরে দে। একটা মিনসে পাকড়েছি। নাম সুদীপ্ত। বডি বিল্ডার। তোর ভাতারের কলেজে পড়ে। ওর সঙ্গে ‘ডিডিএলজে’ দেকতে যাব।”

যাক! আজকের মতো আপদ বিদায় হল। মণিদীপার প্রক্সি দিয়ে মন দিয়ে সব ক্লাস করল দরিয়া। তার মধ্যে একফাঁকে দেখে নিল, কলেজের গেটের বাইরে বিহান দাঁড়িয়ে আছে।

রাগের চোটে দরিয়ার মাথায় আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হচ্ছে। লাভা গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর বেয়ে। আড়চোখে দেখল বিহান ইশারায় দেখাচ্ছে, মোবাইল কোথায়?

ক্লাসে ঢুকে গেল দরিয়া। কলেজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিএস ম্যাডামের স্পেশ্যাল ক্লাস করল। এতক্ষণে যদি আপদটা দূর হয়ে থাকে। ক্লাস শেষ হতে সন্ধে সাতটা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে কনকনে ঠান্ডা পড়বে।

কলেজ গেট থেকে বেরিয়ে দরিয়া দেখল বিহান দেবদাস মার্কা মুখ করে বৃষ্টিতে ভিজছে। পরনে হাফ সোয়েটার। এইসব ন্যাকামোকে একদম পাত্তা দিতে নেই। শালকিয়ার অটো ধরল সে।

পরদিন কলেজে ঢোকার সময়ে দরিয়া দেখল, বিহান ফুটপাথে একই পোশাকে দাঁড়িয়ে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে চা আর বিস্কুট খাচ্ছে। দরিয়া চুপচাপ কলেজে ঢুকে গেল। ক্লাসে বসা মাত্র মণিদীপা চোখ গোলগোল করে বলল, “বকুলফুল! তোর কত্তা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন লা?”

“বাজে কতা না বলে কেলাস কর,” এক ধমকে বান্ধবীকে থামিয়ে দিল দরিয়া।

সারাদিন ধরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। চাবুক চালাচ্ছে উত্তুরে হাওয়া। সারাদিন ধরে ক্লাস। কলেজ শেষ হয়ে গেলে বিএস ম্যাডামের কাছে স্পেশ্যাল

ক্লাস। আজ মণিদীপাও সেই ক্লাস করেছে। তাকে দেখে বিএস ম্যাডাম

চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুই এখানে? বাবা-মা বাড়িতে ঢুকতে দেননি?”

মণিদীপা করুণ মুখ করে বলল, “বাবা বলেছে আপনার ক্লাস না করলে শিয়োর ব্যাক পাব।” তারপরে দরিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। ভাবটা এই, “আজ আমি তোর পিছু ছাড়ছি না।”

সন্ধে সাতটার সময় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কলেজ থেকে বেরচ্ছে দরিয়া, উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিহান। সেও প্রবল ঠান্ডায় কাঁপছে। দরিয়াকে গেটের দারোয়ান বলল, “তোমার বন্ধু কাল থেকে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? ঝগড়া হয়েছে নাকি?”

“ও আমার বন্ধু নয়,” কঠিন গলায় বলল দরিয়া।

“হায় ভকোপান!” মণিদীপা আকাশ থেকে পড়েছে, “আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলুম। তোরা ভেন্ন হয়ে গিচিস!”

“নিজের চরকায় তেল দে,” বান্ধবীকে বলল দরিয়া।

দারোয়ান বলল, “ছেলেটা এখান থেকে সরে না গেলে আমি কিন্তু প্রিন্সি ম্যাডামের কাছে কেস খেয়ে যাব।”

“সরিয়ে দাও! তার জন্য আমার পারমিশন নেওয়ার কী আছে?” শালকিয়াগামী অটোতে ওঠার সময়ে দরিয়া দেখল, দারোয়ান লাঠি হাতে রাস্তা পেরচ্ছে।

পরের দিন রবিবার। মণিদীপার সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। মোবাইল সুইচ্‌ড অফ। দরিয়া পড়ার বই আর নোটস নিয়ে বসেছে। এমন সময়ে মণিদীপা এসে হাজির।

বান্ধবীকে দেখে রাগে হাড়পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে দরিয়ার। মেয়েটা স্কুলে পড়ার সময়ে এত গায়েপড়া ছিল না। কলেজে ভরতি হওয়ার পরে আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে খেলুড়ে টাইপের হয়ে গিয়েছে।

মণিদীপা প্রথমে দরিয়ার কাছে এলই না। সীমার শরীরের খবর নিল আধঘণ্টা ধরে। সাম্যব্রতর কাছে কাঁদুনি গাইল যে কলেজে লেখাপড়া ভাল হচ্ছে না। যেটুকু করার সেটা একমাত্র দরিয়াই করছে। কলেজের প্রিন্সি থেকে বিএস ম্যাডাম সবাই দরিয়ার কথা বলতে অজ্ঞান! সবার শেষে দরিয়ার কাছে এসে বলল, “ওঠ লা! আমার সঙ্গে বেরুতে হবে।”

“কেন লা?” পরিবেশ হালকা করার জন্য কলেজি বুলিতে ফিরে গিয়েছে দরিয়া, “নতুন কোনও মরদ জুটিয়েচিস?”

মণিদীপা কিছুক্ষণ আগুনচোখে দরিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে বলল, “মাথায় একফোঁটা বুদ্ধি নেই! ছেলেটার ওপরে ওইরকম অত্যাচার করার আগে একবার কথা বলতে পারলি না? ও সেদিন কেন সিনেমা দেখতে যেতে পারেনি, সেটা জানলে এটা করতিস না। ফাঁসি দেওয়ার আগে আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়।”

মণিদীপার ছলোছলো চোখ দেখেও দরিয়ার মন গলেনি। সে কঠিন গলায় বলল, “কী হয়েছিল?”

“সনৎ হারামি জানতে পেরে গিয়েছিল যে বিহান তোর সঙ্গে সিনেমা যাবে। ও বিহানকে পোস্টার লেখার কাজ ধরায়। সামনেই কলেজ ইলেকশন, বিহান ‘না’ বলতে পারেনি। ইউনিয়ন রুমে বসে একশোটা পোস্টার লিখেছিল সেইদিন। তোর ফোন ধরতে যেতেই সনৎ মোবাইল কেড়ে নিয়ে সুইচ অফ করে দেয়। পোস্টার লেখার কাজ শেষ করে বিহান ফোন ফেরত পেয়েছিল। তখন তোর মোবাইল সুইচ্‌ড অফ! পরদিন ও কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য। তুই কথা বলিসনি। না সকালে না বিকেলে। ওই ঠান্ডা আর বৃষ্টিতে ও তিনদিন বাড়ি ফেরেনি। মা’কে ফোন করে বলে দিয়েছিল বিশেষ কাজে দুর্গাপুর যাচ্ছে। সুলভ কমপ্লেক্সে বাথরুম সেরে নিত। ফুটপাথের দোকান থেকে খাবার খেয়ে নিত। কালকেও দাঁড়িয়ে ছিল। তোর সঙ্গে কথা বলার পরে কলেজের দারোয়ান ওকে লাঠি মেরে ভাগিয়ে দিয়েছে।”

দরিয়া এক ঝটকায় খাট থেকে উঠেছে। দ্রুত বাড়িতে পরার ম্যাক্সি বদলে বাইরে বেরনোর সালোয়ার কামিজ গলিয়ে নিচ্ছে। মোবাইলের সুইচ অন করছে। দেখে নিচ্ছে মানিব্যাগে টাকাপয়সা আছে কি না। তাকে এখনই বেরতে হবে।

“কোথায় যাবি?” মণিদীপার গলা থেকে অ্যাসিড বৃষ্টি হচ্ছে।

“বিহানের বাড়ি,” ঘর থেকে বেরিয়ে দরিয়া বলল। সীমাকে বলল, “আমি একটু বেরচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।” সীমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বসবাস থেকে বেরল ও।

মণিদীপা এতক্ষণ চুপ করেছিল। বাইরে বেরনো মাত্র প্রশ্ন করল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“বললাম তো! বিহানের বাড়ি।” অটোস্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছে দরিয়া।

“বিহানের নিউমোনিয়া হয়েছে। খুব খারাপ অবস্থা,” দরিয়ার পাশে হাঁটছে মণিদীপা, “গতকাল রাতে ওর মা ওকে বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভরতি করেছে। অক্সিজেন আর স্যালাইন চলছে।”

দরিয়া কাঁদছে। অটোয় উঠে শালকিয়ায় পৌঁছচ্ছে। সেখান থেকে অটো বদলে হাওড়া ময়দান। ছুটতে ছুটতে বঙ্গবাসী হাসপাতাল। মণিদীপা আর একটাও কথা বলেনি। কিন্তু সে দরিয়ার পাশে পাশেই আছে।

মেডিসিন বিভাগের বেডে শুয়ে থাকা বিহানকে দেখে কেঁদে ফেলছে দরিয়া। ছেলেটা রোগা হয়ে গিয়েছে। চোখের নীচে কালি, হাতে স্যালাইনের সুচ, নাকে অক্সিজেনের নল। অতিরিক্ত বাতাস শুষে নেওয়ার জন্য বুকটা হারমোনিয়ামের বেলোর মতো নড়াচড়া করছে। বিহানের বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে দরিয়া, বিহানের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “প্লিজ় আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কখনও এইরকম করব না। প্লিজ় ক্ষমা করে দাও!”

মণিদীপা তার কনুই খামচে ধরে হিসহিস করে বলল, “নাটক পরে করবি বকুলফুল! এখানে বিহানের মা রয়েচেন। তেনার সামনে কেন মুক পোড়াচ্চিস লা?”

মণিদীপার কথা শুনে নিজেকে সামলে নিচ্ছে দরিয়া। চোখের জল মুছে শ্রীরূপার মুখোমুখি হচ্ছে।

শ্রীরূপা দরিয়ার দিকে ফিরেও তাকালেন না। ছেলের বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বিহান আমার একমাত্র ছেলে। একটু বোকা। একটু নরম মনের। একটু অভিমানী। আমি জানি যে ও জীবনে বড় কিছু করতে পারবে না। সাধারণ একটা চাকরি করবে। ডালভাত খেয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে। আমি বা আমার ছেলে খুব সাধারণ। আমাদের একমাত্র সম্পদ আমাদের মানসিক শান্তি। সেটা কেড়ে নিয়ো না।” দরিয়া কথা না বলে মণিদীপার হাত ধরে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

* * *

সাম্যব্রতকে দেখে ওয়ার্ড মাস্টার বললেন, “আপনি যে অ্যাম্বুল্যান্সে করে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন সেটা এখনও হাসপাতাল চত্বরে রয়েছে। ওটা নিয়ে বেরিয়ে যান।”

“রাজুর অ্যাম্বুল্যান্স এখনও আছে?” খুশি হলেন সাম্যব্রত। যাক বাবা! চেনা চালক থাকলে দুশ্চিন্তা কমবে।

ওয়ার্ড মাস্টার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। একজন ওয়ার্ড বয় দরিয়াকে ট্রলিতে তুলে অ্যাম্বুল্যান্সের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। সিস্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাম্যব্রত ওয়ার্ড থেকে বেরলেন বিকেল সাড়ে চারটের সময়। করিডর দিয়ে যাওয়ার সময়ে খেয়াল করলেন, এককোণে দাঁড়িয়ে মন্টু মোবাইলে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। সাম্যব্রতকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সাম্যব্রত মন্টুকে পাত্তা না দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে এগোলেন।

“আমাকে বাঁচাও ভাইটি!” মোবাইলে কান্নাকাটি করছে মন্টু, “সামনেই রিটায়ারমেন্ট। এখন শো কজ় খেয়ে গেলে খুব বিপদ। পেনশন আটকে যাবে।”

“ঘুষ নিয়েছ বলে শো কজ় খেয়েছ। এখন আমার কাছে কেঁদে কী লাভ? আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না!” বলল সনৎ, “আমাদের পার্টি কোনওরকম কোরাপশন বরদাস্ত করে না। আগে দেশ, পরে ব্যক্তি।”

“সব জানি ভাইটি। পার্টি ফান্ডে প্রতি মাসে কত টাকা দিই বলো তো? মাইনের টাকা থেকে কি আর ওই জিনিস হয়?”

“তুমি ঘুষের টাকা পার্টি ফান্ডে ডোনেট করো? ছিঃ!” ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে সনতের গলায়।

“পার্টি আমার বাপ-মা! তার জন্য আমি সব করতে পারি,” বলছে মন্টু, “সব ঠিক ছিল, জানো ভাইটি। গন্ডগোল পাকালো শয়তান ডাক্তারগুলো। লেবার পেশেন্টের পায়ে বোমা লেগেছে। তাকে কোন ওয়ার্ডে

রাখবে, সার্জারি না গাইনি, এই নিয়ে ক্যাচাল শুরু হতে জানাজানি হয়ে গেল।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও!” মন্টুকে চুপ করিয়ে সনৎ বলল, “প্রেগন্যান্ট পেশেন্ট? পায়ে বোমার টুকরো? নাম কী বলো তো পেশেন্টের?”

“সে আমি জানি না।”

“টিকিট দেখে বলো।”

“আমি ওই টিকিটের কাছে আর ঘেঁষব না ভাইটি। ডলি ম্যাডাম শো কজ় করেছেন। যদি দেখেন যে আমি ওই মেয়েটার টিকিট ঘাঁটছি, তা হলে সাসপেন্ড করে দেবেন।”

“তুমি শালা ভিতুর ডিম!” সনৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, “পেশেন্টের সঙ্গে কে ছিল? মেয়েটার বাবা?”

“বাবাটাই তো কাঠি করল। বদমাশটাকে নকশালদের মতো দেখতে।”

সনৎ খুকখুক করে হাসছে। মন্টু বলল, “হাসছ কেন?”

সনৎ বলল, “নকশালদের মতো দেখতেই শুধু নয়। লোকটা নকশাল ছিল। ওর নাম সাম্যব্রত। মেয়েটার নাম দরিয়া। বাড়ি লিলুয়ায়।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ!” উত্তেজিত হয়ে বলল মন্টু, “ঠিকই বলেছ। মেয়েটার নাম একটু অদ্ভুত টাইপের। অ্যাম্বুল্যান্সটা লিলুয়া থেকেই এসেছে।”

সনৎ বলল, “তোমার খুব কপাল ভাল মন্টুদা। এইবারের মতো তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। রোববার পার্টি ফান্ডে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যেয়ো। তার পরে আমি সেন ম্যাডামের সঙ্গে বুঝে নেব।”

ডাক্তার আর ওয়ার্ড মাস্টারকে বখরা দিতে হবে। এই মিথ্যে কথা বলে মন্টু ছ’হাজার টাকা সাম্যব্রতর কাছ থেকে নিয়েছিল। সনৎও ঠিক সেই কায়দায় ডলি ম্যাডামের নামে মিথ্যে কথা বলে তার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিচ্ছে। মন্টু টাকাটা হজম করতে পারেনি। সনৎ হজম করে নেবে। এই হল বড় নেতার লক্ষণ।

টাকার পরিমাণ কমানোর চেষ্টায় মন্টু করুণ গলায় মিনতি করল, “পঞ্চাশ পারব না ভাইটি। একটু কম করো। পার্টির জন্যে জান কবুল।”

উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে সনৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *