শেষ নাহি যে – ১০

“ক’টা বাজল গো?” জিজ্ঞেস করল সুদাম।

বিহান ট্রেনের মেঝেয় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সুদামের প্রশ্ন শুনে ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলে সময় দেখে মস্ত একটা হাই তুলে বলল, “দেড়টা বাজে। খিদে পাচ্ছে।”

সুদাম তার রঙিন ঝোলাব্যাগ থেকে মুড়ি আর চানাচুরের প্যাকেট বার করে বলল, “চলবে? কলকাতার ভদ্দরলোকেরা তো আবার মুড়ি পছন্দ করে না।”

বিহান কলকাতার ছেলে নয়, তার বাড়ি হাওড়ায়। বকুলতলায় গিয়ে সবাইকে সবসময় মুড়ি খেতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত— এনি টাইম ইজ় মুড়ি টাইম। আর কতরকম ভাবে যে মুড়ি খাওয়া যায়! কখনও বাদাম, চানাচুর বা শসা-পেঁয়াজ-ছোলা দিয়ে, তো কখনও ঘুগনি, শিঙাড়া, চপ বা আলুর দম দিয়ে। চা বা জল ঢেলেও মুড়ি খেতে দেখেছে সে। নিজে অবশ্য খায়নি। সুদামের কথা শুনে মুচকি হাসল বিহান। সুদাম একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ি আর চানাচুর ঢেলেছে।

বকুলতলার স্থানীয় ভাষায় পলিথিন বা প্লাস্টিকের প্যাকেটকে বলে ‘চিকচিকা’। সুদাম ঝোলা থেকে বার করেছে শসা, পেঁয়াজ আর ছুরি। নিপুণ হাতে শসা আর পেঁয়াজ কেটে চিকচিকায় ঢেলে দিল। তৈরি হয়ে গেল সুস্বাদু মুড়িমাখা।

খাওয়া শেষে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বিহান বলল, “টিকিয়াপাড়া পেরিয়ে গেলাম। সামনেই হাওড়া স্টেশন। এদিকে কোনও গন্ডগোল দেখছি না।”

“জয়গুরু!” চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকাল সুদাম। ঠিক তখনই ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল।

“কী হল?” চোখ খুলে জিজ্ঞেস করল সুদাম।

কিশোর আসন থেকে উঠে ট্রেনের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বললেন, “কয়েকজন লোক রেললাইন অবরোধ করছে।”

“এইখানে অবরোধ?” বিহান মেঝে থেকে উঠে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। তারা রয়েছে ট্রেনের প্রথম কামরায়। সেই কারণেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সামনে কী হচ্ছে। তাদের ট্রেন যে লাইনের ওপর দিয়ে যাবে, সেই লাইনেই শোওয়ানো হচ্ছে প্যান্টশার্ট পরা বছর তিরিশের একটি ছেলের মৃতদেহ। ছেলেটির জামাপ্যান্ট পুড়ে গেছে। শরীরময় পুড়ে যাওয়ার লালচে দাগ। শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। ছেলেটি রেল লাইনের উপরে মারা যায়নি। তার লাশ এখানে আনা হয়েছে ট্রেন অবরোধ করার জন্য। লাশের পাশে বসে বেঁটেখাটো একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

অবরোধ করছে খরাজ পার্টির ক্যাডাররা। একজন মৃতদেহের হাতে পার্টির ঝান্ডা গুঁজে দিচ্ছে। একজন মোবাইলে টিভি নিউজ় চ্যানেলের স্থানীয় সংবাদদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। একজন স্মার্টফোনে ভিডিয়ো তুলছে। চার-পাঁচজন স্লোগান দিচ্ছে, “খরাজ পার্টি জিন্দাবাদ! গণতান্ত্রিক মোর্চা মুর্দাবাদ!”

সুবীর চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করে হল দাদা?”

ভিডিয়ো-তোলা কর্মী বলল, “গণতান্ত্রিক মোর্চার কুত্তাগুলো আমাদের দলের সদস্যদের তাক করে বোম মেরেছে। বিধান স্পট ডেড। বাকিদের বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে।”

সুবীর বললেন, “মেরে শালাদের পাট করে দিন। আজ যেন ওদের একজন মেম্বারও বেঁচে বাড়ি না ফেরে।”

ট্রেনের কামরা থেকে কয়েকজন নিচু গলায় বললেন, “আহ! সুবীর! তুমি আবার পাগলদের সাঁকো নাড়া দিচ্ছ কেন?”

সুবীরের কথা শুনে কিশোরের মুখ গম্ভীর। তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বোমাবাজিটা কোথায় হল?”

সদ্যবিধবা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল, “হাওড়া কোর্টের সামনে।”

কিশোর নিচু গলায় বললেন, “সুবীর! খরাজ পার্টির অবস্থা দেখো। অন্য জায়গা থেকে লাশ এনে ট্রেন অবরোধ করছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, ছেলেটা খরাজ পার্টির সদস্যই নয়। বোমাবাজিতে মরেছে আর তোমার দল ‘ক্যাডার’ বলে দেগে দিচ্ছে। একটা শহিদ পাওয়া গেলে খেলাটা ভাল জমে!”

গলা খাদে নামিয়ে সুবীর বললেন, “মানুষ খুন করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন? জনগণ এই অন্যায় মেনে নেবে?”

ট্রেনের বাকি যাত্রীরা কিশোর আর সুবীরকে টেনে সিটে বসিয়ে দিল। বিহান দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, “বিধানবাবু মারা গেছেন হাওড়া কোর্টের সামনে। আপনারা রেললাইনে অবরোধ করছেন কেন? সব ট্রেন আটকে যাবে তো!”

“ট্রেন আটকানোর জন্যই তো অবরোধ করা হচ্ছে! মানুষের প্রাণের কোনও দাম নেই নাকি?” হুংকার দিল এক কর্মী। বিহান দেখল, টুকটুক করে রেলের পুলিশরা আসতে আরম্ভ করেছে। ক্যামেরা কাঁধে দৌড়ে আসছে মিডিয়ার ছেলেরা। রেললাইনের পাশের বস্তি থেকে চলে এসেছে চ্যাংড়া ছেলের দল। পরনে জিন্‌স আর রংচঙে টি-শার্ট। চুলে বিচিত্র রং করা। এক কানে দুল। মুখে গুটখা বা খইনি। এই জায়গাটা এখন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। লাভা তো বেরবেই। কখন হবে সেটা কেউ জানে না।

ট্রেনের কামরা থেকে অনেক যাত্রী লাফিয়ে নামছে। বড় বড় খোয়ার উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে হাওড়া স্টেশনের দিকে। স্টেশন সিকি কিলোমিটারের মধ্যে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে হেঁটে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সুদাম আপনমনে বলল, “আপ আর ডাউনে অনেক ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে মেল ট্রেনও আছে। পুলিশ এবার লাঠিচার্জ শুরু করবে।”

“একবার ওদের রিকোয়েস্ট করে দেখি। যদি ছেড়ে দেয়!” বলল বিহান। দরজা থেকে অনেকটা শরীর বার করে চেঁচাল, “দাদারা! আমার বউয়ের খুব শরীর খারাপ। বঙ্গবাসী হাসপাতালে ভরতি আছে। আপনারা প্লিজ় এই ট্রেনটা ছেড়ে দিন।”

“কে বে?” জিজ্ঞেস করল এক পার্টি কর্মী। চ্যাংড়া ছেলেগুলো লাইন থেকে পাথর তুলতে শুরু করেছে। সদ্যবিধবা মেয়েটা লাশের পাশ থেকে লাফিয়ে উঠে একটা খোয়া তুলে নিয়ে ট্রেনের দিকে ছুড়ে গলা ফাটিয়ে বলল, “আমি আমার মরা বরকে নিয়ে এখানেই বসে থাকব। যা পারিস করে নে।”

খোয়াটা ট্রেনের বডিতে লেগে ‘টং’ করে শব্দ হল। সুদাম পিছন থেকে বিহানকে চেপে ধরে ট্রেনের কামরার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। সুবীর বললেন, “এই ভাই! তুমি চুপ করো তো!” কিশোর বললেন, “তোমার জন্যে আমরা সবাই এখানে মুশকিলে পড়ব।”

মেয়েটির কথা শেষ হওয়া মাত্র শুরু হয়ে গেল পাথর আর খোয়া বৃষ্টি। রেলবস্তির ছেলেগুলো ট্রেন তাক করে ছুড়ছে। ট্রেনের কামরায় এসে পড়ছে একের পর এক। পুরো কামরা থরথর করে কাঁপছে। পাথর লাগার ঢংঢং শব্দ শুনে মনে হচ্ছে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টি বাজছে। কিশোর আর সুবীর মিলে কামরার জানলা বন্ধ করে দিচ্ছেন। যাত্রীরা ট্রেনের কামরা থেকে লাফ মারছে। বয়স্ক মানুষরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। কোনওরকমে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালাচ্ছে। যে ক’জন মহিলা ছিল, তারাও লাফ মেরেছে। কিশোর আর সুবীর একসঙ্গে বিহানকে বললেন, “তোমার জন্য এই ঝামেলায় পড়লাম।” তারপরে ট্রেন থেকে লাফ মারলেন।

সেই দেখে সুদাম বিহানের কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করল, “ট্রেন থেকে নামো। জলদি।”

সুদাম আর বিহান একসঙ্গে কামরা থেকে লাফ দিল। সামনে থেকে সদ্য বিধবা মেয়েটি চিৎকার করল, “ওই যে! ওই ছেলেটা! ছাড়িস না শালাকে!”

বিহান আর সুদামের দিকে ধেয়ে আসছে ইট, পাথর আর খোয়ার বৃষ্টি। তারই মধ্যে রেলের পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করল। পুলিশরা সংখ্যায় নেহাতই কম। রেলবস্তির ছেলেগুলো আর খরাজ পার্টির ক্যাডাররা পতাকার ডান্ডা দিয়ে তাদের সঙ্গে লাঠালাঠি করছে। তারই মধ্যে এক ছোকরা বিহানের দিকে একটা পাথর ছুড়ে চিৎকার করে বলল, “ইয়ে লে শালা!”

পাথরটা লাগল বিহানের ডান রগে। মুহূর্তের জন্য বিহানের মনে হল গরম একটা শিক তার রগ দিয়ে ঢুকে মাথার ঘিলু নেড়ে দিল। তার চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। যন্ত্রণায় পা থরথর করে কাঁপছে। দু’হাত দিয়ে রগ চেপে ধরে সে লাইনে বসে পড়ল। তার আর নড়ার ক্ষমতা নেই। সেই অবস্থায় সুদাম তার হাত ধরে টেনে তুলে বলল, “স্টেশনে গিয়ে বসবে। এখন দৌড়োও।” বিহানের এখন একটাই মুখ চোখের সামনে, তা হল দরিয়া। ওদের প্রথম সন্তানের জন্মের সময় বিহান দরিয়ার পাশে থাকতে না পারলে সে অভিমান করবে। মুখে না বললেও, মনের মধ্যে সেই অভিমান চেপে রাখবে দরিয়া। বিহান সেটা জানে।

বিহানের মনে পড়ল, দরিয়ার সঙ্গে ওর প্রথম মান-অভিমান হয় ‘ডিডিএলজে’ দেখা নিয়ে। সিনেমাটা অনেকদিন আগে রিলিজ় করেছিল। বিহান যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, তখন আবার মুক্তি পেয়েছিল রিভারসাইড শপিং মলের মাল্টিপ্লেক্সে।

* * *

দরিয়ার কলেজে অ্যাটেন্ডেন্সের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রিন্সি ম্যাডাম ডেকে পাঠান। বাড়িতে খবর দেওয়ার হুমকি দেন। মণিদীপা মাসখানেক আগে ধরা পড়েছিল। গার্জেন কল হয়েছিল। মণিদীপা তার ক্লাস ফাইভ পাশ মা আর ক্লাস টেন ফেল বাবাকে প্রিন্সির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

মণিদীপাদের পারিবারিক হোটেল ব্যাবসা। ওর বাবা দেখেন দার্জিলিংয়ের হোটেল, জ্যাঠা দেখেন মন্দারমণির হোটেল। কাকারা সামলান দিঘা আর পুরীর হোটেল। দার্জিলিং থেকে ফিরতে হয়েছে বলে মণিদীপার বাবা বেজায় বিরক্ত। তিনি প্রিন্সি ম্যাডামকে বলেছিলেন, “আমাদের ডাকার ‘পয়োজন’ নেই। কলেজে গন্ডগোল পাকালে কানের নীচে দেবেন এক টিক। শুধু দেখবেন যেন মরে না যায়!”

সেই ঘটনার পরে মণিদীপার গার্জেন কল বন্ধ হলেও বাকিদের ক্ষেত্রে বহাল আছে।

কিন্তু ‘ডিডিএলজে’ না দেখলেই নয়। টিভিতে বারকয়েক দেখেছে দরিয়া, মন ভরেনি। সরষেখেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হচ্ছে, ‘ঘর আ জা পরদেশি তেরে দেশ বুলায়ে রে’। শাহরুখ দু’হাত বাড়িয়ে ট্রেডমার্ক রমণীমোহন হাসিটা দিচ্ছে। উফ! পারা যায় না। দৃশ্যটা টিভিতে যতবার দেখে দরিয়া, ততবার উত্তেজিত হয়ে রিমোট আঁকড়ে ধরে। সাম্যব্রত বিরক্ত হয়ে বলেন, “ট্রেনের দৃশ্য দেখতে হলে ‘পথের পাঁচালি’ দেখ। অপু আর দুর্গা, কাশের ঝাড় আর ট্রেনের চলে যাওয়া। ওই জিনিস আর হবে না।” দরিয়া চুপ করে থাকে। সাম্যব্রতর মুখের উপরে কথা বলে না। কিন্তু সাদা-কালো আর্ট ফিল্‌মের প্রতি তার কোনও ভক্তি নেই।

বড় পরদায় ‘ডিডিএলজে’ দেখার জন্য কলেজ কাটার রিস্কটা দরিয়া নিয়েই ফেলেছে। গতকাল বিহানের সঙ্গে কথাও হয়ে গিয়েছে। বিহান তো কলেজের কোনও ক্লাসই করে না। দিনরাত সনতের পিছন পিছন ঘোরে আর রাজনীতি করে। তবে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। দু’জনে মিলে প্ল্যান করে ফেলেছে। ঠিক হয়েছে, দরিয়া আগে রিভারসাইড মলে এসে সিনেমার টিকিট কেটে রাখবে। ‘ডিডিএলজে’ দেখার পরে দু’জনে পিৎজা খাবে। উইন্ডো শপিং করবে। সবচেয়ে বড় কথা, দরিয়া আজ পর্যন্ত কোনও শপিং মলে ঢোকেনি। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমাও দেখেনি। বন্ধুদের কাছে প্রেস্টিজ পাংচার! আজ থেকে সে আর ‘মল ভার্জিন’ থাকবে না।

ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। জমিয়ে শীত পড়েছে। সীমার গায়ে শাল উঠেছে। সাম্যব্রতর গায়ে নস্যি রঙের চাদর। দরিয়াও নিয়মিত চাদর গায়ে দিয়ে কলেজে যাচ্ছে।

আজ বিশেষ দিন। দরিয়া সামান্য সাজগোজ করেছে। তার স্টকে একটাই জিন্‌স ছিল। সেইটা পরেছে। সঙ্গে সবেধন নীলমণি পোলো নেক সোয়েটার। পায়ে স্নিকার্স। চুলে টপ নট। বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে সীমা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথাও যাবি না কি? সেজেছিস কেন?”

“সেজেছি? আমি?” দরিয়া আকাশ থেকে পড়ল, “জিন্‌সটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। তাই আজ পরে নিলাম। আর এই কনকনে শীতে সোয়েটার না পরলে কবে পরব? বাবাকে বলে দিয়ো এইরকম সোয়েটার আর না কিনতে। এগুলো পরার মতো শীত এদিকে পড়ে না।”

“এত কথা বলছিস কেন?” বিরক্তি নিয়ে চোঁয়া ঢেকুর তুললেন সীমা। “ফেরার সময়ে অ্যান্টাসিড নিয়ে আসিস তো! বড্ড অম্বল হচ্ছে।”

দরিয়ার বয়েই গিয়েছে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে। সে অনেকবার সীমাকে বলেছে, “এগুলো মানসিক রোগ। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।” সীমা রেগে বলেছেন, “আমাকে পাগল প্রমাণ করলে তোদের কী সুবিধে হয়? আমি তো তোদের কোনও কাজেই আপত্তি করি না!”

বিরক্ত হয়ে এই নিয়ে সীমার সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে দরিয়া। শুধু সাম্যব্রতর জন্য খারাপ লাগে। দিনরাত ওষুধ আর অসুখের কথা শুনেও লোকটা মুখ বুজে থাকে। কতখানি ভালবাসা থাকলে এই জিনিস সম্ভব! বিহান এইরকম হয়ে গেলে সে তো দু’দিনও টলারেট করতে পারবে না!

সকালের শোয়ের টিকিটের দাম কম। দরিয়া ভেবেছিল স্কুল-কলেজ কাটা ছেলেমেয়েদের জন্য এই শো রাখা হয়েছে। রিভারসাইড মলের পাঁচতলায়, মাল্টিপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে তার ভুল ভাঙল। বয়স্ক লোকজন, ফ্যামিলি ম্যান, কলেজ-কাটা যুগল… সব রকমই মজুত। বেলা এগারোটার শোতে টিকিটের দাম একশো কুড়ি টাকা। দুশো চল্লিশ টাকা দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে গা কড়কড় করছে। কিন্তু কী আর করা! টিকিট সে কাটবে আর বিহান পিৎজ়া খাওয়াবে, এই রকম চুক্তি হয়ে আছে।

টিকিট কেটে নীচে নেমে রিভারসাইড মলের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দরিয়া। সাড়ে দশটা বাজে। বিহান এলে দু’জনে মিলে ঢুকবে। ও বেচারি কখনও এখানে আসেনি। তবু ওকে ছাড়া একা একা ভিতরে ঘুরতে ইচ্ছে করছে না। ওইসব আলো-ঝলমলে দোকান, দামি জামা-জুতো-ড্রেস, ইলেকট্রনিক গুডস চিরকাল তাদের সামর্থ্যের বাইরে থেকে যাবে। দৃষ্টিসুখটা অন্তত দু’জনে মিলে করা যাক।

শীতের রোদে পিঠ দিয়ে গাদা গাদা প্রেমিকযুগল বসে রয়েছে সামনের চত্বরে। দরিয়া একবার ভাবল, চেনা কেউ যদি এখানে তাকে দেখে ফেলে? তারপরে মনে হল, দেখলে কী অসুবিধে? সে তো কোনও অন্যায় করছে না।

চত্বরের এককোণে বসে সে নিজের সাদাকালো মোবাইল বার করল। কলেজে ভরতি হওয়ার পরে সাম্যব্রত মোবাইলটা কিনে দিয়েছেন। সবার হাতে দামি স্মার্টফোন। সবাই সেল্‌ফি, ডুয়াল্‌ফি বা গ্রুপ্‌ফি তুলছে। ওদের সামনে গাবদা ফোন হাতে নিতে লজ্জা করছে দরিয়ার। কিন্তু কী আর করা! বিহানকে ফোন করা জরুরি। ছেলেটা কতদূর এল কে জানে!

বিহানকে মিস্‌ড কল দিল দরিয়া। তাদের মধ্যে চুক্তি করা আছে। বিহান চায় না, দিনের বেলায় দরিয়া তাকে ফোন করে টাকা নষ্ট করুক। রাতে আনলিমিটেড ফ্রি কলের অপশন আছে। তখন দরিয়া ফোন করে।

মিস্‌ড কল দেওয়ার পাঁচ মিনিট পরেও বিহান ফিরতি ফোন না করায় অবাক হল দরিয়া। দশটা পঁয়ত্রিশ বাজে। হাতে এখনও অনেক সময় আছে। শিবপুর থেকে এখানে আসতে মিনিট দশ লাগে। বিহান বোধ হয় বাসে আছে। শুনতে পায়নি।

পৌনে এগারোটা। এবার একটু চিন্তা হচ্ছে দরিয়ার। আবার মিস্‌ড কল দিল। এবার বিহানের ফোন করা উচিত। কাছাকাছি চলে আসার কথা। হাওড়াগামী বাস আর মিনিবাসের দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দরিয়া। দেখছে কে কে নামল।

এগারোটা বাজতে পাঁচ। আর মিস্‌ড কল দেওয়ার রিস্ক নেওয়া যাচ্ছে না। দরিয়া রিং হতে দিল। বিহানের রিংটোন হল, ‘হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য, আশার হাত বাড়াই।’ এইসব গানকে কী করে রিংটোন করে কে জানে বাবা! ওর মা ফোন করে এই গানই শুনতে পায়। ছিঃ!

চার লাইন গান দু’বার বেজে থেমে গেল। বিহান ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। আবার বিহান ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। বিহান আবার ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। বিহান এবার লাইন কেটে দিল।

দরিয়া আবার ফোন করল। ও প্রান্ত থেকে যন্ত্রমানবী বলল, “আপনি যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন তাঁর মোবাইল এখন বন্ধ আছে।” যন্ত্রমানবী ‘বন্ধ’ শব্দটা বলার সময়ে জোর দিল। দরিয়ার মনে হল, মোবাইলের ভিতরে বসে থাকা মেয়েটা তাকে ব্যঙ্গ করছে।

আশা ছাড়ল না দরিয়া। ফোন করে যেতেই লাগল। তিনবার, চারবার, আটবার, একুশবার, একশোবার…

এগারোটা, সাড়ে এগারোটা, বারোটা, একটা, দুটো…

শপিং মলের সিকিয়োরিটির ছেলেটি দরিয়াকে জিজ্ঞেস করে গেল, “কারও জন্য অপেক্ষা করছেন?”

দরিয়ার রাগ হচ্ছে, ভয় করছে, কান্না পাচ্ছে। বিহান কেন এইরকম করল তার সঙ্গে? কেন? ও কি তাকে ডাম্প করল? নতুন কোনও গার্লফ্রেন্ড হয়েছে? বিহানের মায়ের শরীর খারাপ নয় তো?

বুকে পাথর বেঁধে দরিয়া বাড়ি চলে গেল। এবং বসবাস-এ ঢোকার আগে মায়ের জন্য অম্বলের ওষুধ কিনল। বাবা-মা ছাড়া আর কেউ কাছের মানুষ হয় না। সে আর কোনওদিনও বিহানকে ফোন করবে না। এবার থেকে তার মোবাইল সুইচ্‌ড অফ থাকবে।

* * *

বিকেল সাড়ে চারটের সময়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে মাথা খারাপ হয়ে গেল বিহানের। প্ল্যাটফর্মে লোক থিকথিক করছে। ট্রেন অবরোধের ফলে প্রতি মুহূর্তে লোক বাড়ছে। যে সব ট্রেনের হাওড়া ছেড়ে যাওয়ার কথা, সেগুলো যাত্রীতে ফাটো ফাটো অবস্থা। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘অবরোধের কারণে সমস্ত আপ ও ডাউন ট্রেনের চলাচল বন্ধ আছে।’ পুরো স্টেশনচত্বর যাত্রীদের টেনশন আর উত্তেজনায় দপদপ করছে। এই উত্তেজনা যে কোনও মুহূর্তে মব ভায়োলেন্সের চেহারা নিতে পারে।

আট নম্বর প্ল্যাটফর্মের গায়ে যে ক্যাব রোড আছে, সেই জায়গাটা একটু ফাঁকা। সেখানে দাঁড়িয়ে বিহান বলল, “সুদামদা, আমি এবার চলি। তুমি তো এই ট্রেনেই বকুলতলা ফিরবে।”

সুদাম বলল, “আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তোমার পক্ষে আজকের দিনটা ভাল নয়। একের পর এক গন্ডগোল হচ্ছে।”

“আমার সঙ্গে তুমি কোথায় যাবে? তা ছাড়া মিনুদি চিন্তা করবে।”

“ওকে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আর, আমার ইচ্ছে থাকলেও ফেরার উপায় নেই। ট্রেন তো চলছে না।”

“তা ঠিক।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টেশনের পুরনো কমপ্লেক্স থেকে বেরল দু’জনে। এখন আর বাসের চিন্তা করে লাভ নেই। রেল মিউজ়িয়ামের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বঙ্গবাসী হাসপাতাল যেতে দশ মিনিট লাগবে।

রেল মিউজ়িয়ামের সামনের সেই রাস্তা! বিহানের মনে পড়ে যাচ্ছে চুম্বনের স্মৃতি। দরিয়া এখন কেমন আছে কে জানে! সাম্যব্রতকে ফোন করা যাক। শেষ ফোনের পরে এত ঘটনা ঘটল যে বিহান আর একবার ফোন করার কথা ভুলে গিয়েছিল। সে ব্যাকপ্যাক থেকে মোবাইল বার করতেই সেটা বাজতে শুরু করল। কে ফোন করেছে? তাড়াতাড়ি মোবাইলে চোখ রাখে বিহান।

সনৎ! বিরক্তি চেপে বিহান বলল, “বল।”

“তুই এখন কোথায়?” সনতের গলার আওয়াজে জেরার আভাস।

বিহান বলল, “সবে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম। হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবাসী হাসপাতাল যাচ্ছি। তুই আমার ব্যাপারটা নিয়ে মিস্টার দাসের সঙ্গে কথা বলেছিস?”

উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল সনৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *