শেষ দেখা হয়নি – ৯

মানুষ এমনই নেশার দাস যে রতনের খবর নেবার আগেই কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, বিড়ি এনেছিস, ও গোবিন্দ, বিড়ি এনেছিস?

গোবিন্দর হাতে একটা কাগজের ঠোঙা তার থেকে বিড়ির বাণ্ডিলগুলো বড়কাকার হাতে বিলি করবার জন্য দিয়ে সে ঠোঙাটা তুলে দিল সুশীলাদির হাতে। বলল, এর মধ্যে কটা পান আছে গো, সুশীলাদি। ময়নাকে একটা দিও, ও পান ছাড়া থাকতে পারে না!

সুশীলাদি একগাল হেসে বলল, ও গোবিন্দ, দ্যাখ, ময়নার একটা খোকা হয়েছে। দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দর হয়েছে, একেবারে বাপের মতন গড়ন!

গোবিন্দ কয়েক মুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, অ্যাঁ, খোকা হয়েছে? বলো কি? ময়নার খোকা?

সুশীলাদি বলল, হ্যাঁ রে। মায়ে–পোয়ে দু’জনেই ভালো আছে। দেখবি আয়!

মাত্র কয়েক ঘণ্টার শিশুকে দু’হাতে তুলে অদ্ভুত আবেগময় চোখে দেখতে লাগল গোবিন্দ। এখনও যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ময়নাকেও দেখতে লাগল বারবার।

একটু বাদে সে শিশুটিকে নামিয়ে দিয়ে অন্যদের দিকে ফিরে বলল, রতন ভালো আছে। তার হাত–পা ভাঙেনি, সে ঠিক আছে। সব কথা পরে বলছি। বড় খিদে পেয়েছে গো সুশীলাদি, কিছু খেতে দেবে?

সুশীলাদি প্রায় হাহাকার করে বলল, আমি জানতুম ছেলেটার কিছু খাওয়া হবে না। আহা রে, বেলা পড়ে গেছে, না খেয়ে এতটা পথ যাওয়া–আসা, আয় গোবিন্দ, তোর জন্য খাবার রেখেছি। আগে খেয়ে নিবি আয়!

হাত ধোওয়া–টোওয়ার দরকার নেই, তক্ষুনি খেতে বসে গেল গোবিন্দ শালপাতার থালা বানাবার তর সইল না, সে খেতে লাগল সরাসরি হাঁড়ি থেকে। তাকে ঘিরে রইল অন্য সবাই।

দেশলাই বাঁচাবার জন্য একজনের বিড়ি থেকে ধরিয়ে নিচ্ছে অন্য একজন। পাঁচটা মোটে পান, সুশীলাদি একটু একটু ছিঁড়ে দিচ্ছে মেয়েদের। শুধু ময়নার জন্য সে রেখে দিল আস্ত একটা।

বড়কাকা নিজের বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, গোবিন্দ, তুই এত তাড়াতাড়ি গেলি এলি কী করে? ঝাড়গ্রাম কি কম দূর?

গোবিন্দ বলল, একটু পয়সা খরচ হয়েছে, বড়কাকা। যাবার সময় বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে একটা বাস পেয়ে গেলুম। ফেরার সময়ও অনেকটা বাসে এসেছি।

বড়কাকা বলল, তা হোক পয়সা খৰ্চা। তুই গোড়া থেকে বল। গিয়ে প্ৰথমে কী দেখলি?

—প্রথমেই আসল বড় খবরটা শুনে রাখো। রতন ধরা পড়েছে বটে, কিন্তু সোনার গয়নাগুলো পুলিশ পায়নি। সেগুলো আগেই রতন লুকিয়ে রেখেছে।

একসঙ্গে অনেক নিঃশ্বাস টানার শব্দ হলো। সোনার গয়না মানে দশ হাজার টাকা। স্বপ্ন নির্মাণের টাকা। সে টাকা সম্পূর্ণ জলে যায়নি, এখনো পাবার আশা আছে। নির্জীব লোকগুলোর মধ্যে যেন নতুন করে উদ্দীপনা জেগে উঠল।

গোবিন্দ বলল, রতনকে ধরে পুলিশ গোবেড়ন দিয়েছে, বস্তায় বেঁধে পিটিয়েছে, তবু রতন কিছু স্বীকার করেনি। ভাগ্যিস ময়না ঘুমিয়ে আছে, নইলে সব কথা খোলসা করে বলা যেত না। তবে রতন এখনও কানা খোঁড়া হয়নি, সে খবর পেয়েছি। পাকা খবর।

–কে তোকে এই খবর দিল? তুই থানার মধ্যে গেলি?

–না, থানার মধ্যে কী করে যাব? থানার সামনেই একটা পানের দোকান আছে দেখেছ? ঐ পানওয়ালারা সব জানে। ও আমার পিসেমশাইয়ের এক ভাই। আমায় একটু একটু চেনে। সে–ই বলল আমাকে

সুশীলাদি জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে গোবিন্দ, রতনের কাছে যদি সোনাদানা কিছু না পেয়ে থাকে, তা হলে পুলিশ ওকে সন্দেহ করে ধরল কী করে?

— পুলিশ কী করে ধরেছে, তা জানি না। তবে পুলিশ ঘাটশিলা থেকে একজন ব্যাটাছেলে আর মেয়েছেলেকে আনিয়েছে, তারা সেদিনকের বাসে ছিল, তারা রতনকে চিনতে পেরেছে!

– ইস! এইজন্য আমি বলেছিলুম মুখে একটু ভূষো কালি মেখে নিতে! তুই কোন্ সাহসে ওখানে ঘোরাফেরা করতে গেলি, গোবিন্দ? যদি তোকে চিনতে পারত?

— দ্যাখো সুশীলাদি, তোমাদের আমি তখন বলিনি, কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করেই গেসলুম রতন কেমন আছে, কী বৃত্তান্ত, সব খবর যদি না পাই, তা হলে আমি নিজেই ধরা দেব। জেলখানায় রতনের সঙ্গে একসঙ্গে থাকব! আমি তেমন নুন খাইনি কখনো যে বন্ধুর সঙ্গে নিমকহারামী করব!

—চুপ কর, ওসব অলুক্ষণে কথা বলিস না। তারপর কী হলো বল্। তুই পানুবাবু উকিলের কাছে গেসলি?

—হ্যাঁ গেলুম তো! তার বাড়িতে এই অ্যাত্ত বড় কুকুর। ঠিক যেন গুল বাঘা। ডাক শুনলে প্রাণ উড়ে যায়। তবু ঢুকে পড়লুম বাড়ির মধ্যে। সে কুকুর শুধু ডাকে। কামড়ায় না। গায়ের ওপর এসে হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে।

–আ মরণ, কুকুরের কথা বাদ দে। আসল কথা বল। বেশি সময় নেই।

–কেন, কী হয়েছে, সময় নেই মানে?

–সে কথা পরে শুনবি। এখন তুই রতনের কথা বল। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, সোনা আমার।

–পানুবাবু উকিলের পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়লুম। তা তিনি বললেন, কী কী হয়েছে সব সত্যি কথা বল। উকিলের কাছে লুকোতে নেই। আমি গড়গড় করে বলে দিয়েছি সব কথা। আমাদের এই নীলুদার কথাও বাদ দিইনি!

আমাকে দেখার পর প্রায় দুটো দিন পার হয়ে গেছে। এই প্রথম গোবিন্দ আমাকে নীলুদা বলল। হঠাৎ তার এই মতি পরিবর্তন? গোবিন্দর দুর্ব্যবহারে আমি প্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলুম।

রতনকে সনাক্ত করেছে ঘাটশিলার সেই দম্পতি। অবশ্য তারা স্বামী–স্ত্রী কি না কে জানে। সেই লাল ব্লাউজ পরা রমণী…এই দু’দিন ভুলেই গিয়েছিলুম ওদের কথা। ওরা যেন আংড়া গ্রাম আর শেঠ রামদেও–র জঙ্গলের পরিবেশের তুলনায় অন্য গ্রহের প্রাণী!

গোবিন্দ আবার বলতে লাগল, পানুবাবু উকিল সব শুনতে লাগলেন আর হুঁ হুঁ করতে লাগলেন। সব শেষটায় তিনি কী বললেন জানো, সুশীলাদি? জানো, বড়কাকা? সে কথা শুনে আমার বুকখানা দশ হাত ফুলে গেল। কোনো ভদ্দরলোকের মুখে এমন কথা শুনব ভাবতে পারিনি গো! আমার চক্ষে জল এসে গেসল গো!

বড়কাকা বলল, আহা, কী বললেন পানুবাবু উকিল, সেটা বলবি তো! আমরা শুনব না?

—হ্যাঁ বলছি। সব শুনে উকিলবাবু বললেন, বেশ করিছিস! যা করিছিস ভালো করিছিস! শুধু শুধু না খেয়ে মরবি নাকি? গরমেণ্ট কোনো রিলিফ দেবে না, কিছু না…

– পানুবাবু বললেন এই কথা?

–তবে কি আমি মিছে কথা বলছি!

সুশীলাদি বলল, তাই তো বলি, এখনও ধর্ম আছে বলে চন্দ্র–সূর্য উঠছে। এখনও এমন মানুষ আছে যে মানুষের দুঃখু বোঝে!

একটা হো–হো ধরনের আনন্দের শব্দ উঠল। এদের মনে যে পাপবোধ কাজ করছিল সেটা যেন অনেকটা কেটে গেল। একজন মান্যগণ্য ভদ্রলোক ওদের সমর্থন করেছে, এটা কি কম কথা?

পানুবাবু উকিল মশাইয়ের কৃতিত্বটার ভাগ আমারও কিছুটা পাওয়া উচিত ছিল। আমিও তো গোড়া থেকেই ওদের সমর্থন করেছি। এক মহিলার কান থেকে জোর করে দুল ছিঁড়ে নেওয়াটা আমার শুধু পছন্দ হয়নি, তা ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে তো আমার আপত্তি ছিল না। অবশ্য ওরা আমাকে বিশ্বাস করেনি। আমি তো মান্যগণ্য উকিল নই!

বড়কাকা জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর?

গোবিন্দ বলল, পানুবাবু উকিল তখন বললেন, তোদের কোনো ভয় নেই, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। রতন ছাড়া পেয়ে যাবে! তুই বোস এখানে!

একজন বৃদ্ধ বলল, ও গোবিন্দ, উকিলবাবু রতনকে ছাড়িয়ে দিয়েছে? তা হলে তাকে নিয়ে এলি না? কোথায় রেখে এলি?

গোবিন্দ বলল, আগে শোনো না সবটা কথা! উকিলবাবু বললেন, তুই বোস এখানে, আমি থানা থেকে ঘুরে আসছি। ওরে দশরথ, এই ছেলেটাকে এক কাপ চা দিস!

—দশরথ কে?

— উকিলবাবুর বাড়ির চাকর। সে ব্যাটা এমন বদমাস, শেষ পর্যন্ত আমাকে চা দিলে না। আমি বসে আছি তো বসেই আছি। পানুবাবু আর আসেন না। কুকুরটা ঘরের মধ্যে ঢুকে আমার কান চেটে দিচ্ছে। আমি আর কী করি, তখনও বিড়ি কিনিনি, বিড়িও খেতে পাচ্ছি না, চুপ মেরে বসে রইলুম…

আমার একটা জিনিস বেশ অদ্ভুত লাগল। গোবিন্দর কথার সুর শুনেই আমি বুঝে গেছি। তার অভিযান–কাহিনীর শেষটা মোটেই সুখকর নয়। ফেরার সময় তার ভঙ্গি ছিল ক্লান্ত ও বিষণ্ন। কিন্তু ঘটনার বর্ণনার সময় সে খুঁটিনাটি বাদ দিচ্ছে না। শেষটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছে না, ঠিক যেন মহাভারতের স্টাইল।

সুশীলাদি অধৈর্য হয়ে বলল, ও গোবিন্দ, একটু তাড়াতাড়ি কর। এই জঙ্গলে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

গোবিন্দ এবারে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ গো, এ জঙ্গলে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। পুলিশ সব জানে। পুলিশ এখানেও আসবে আমাদের ধরতে।

বড়কাকা বলল, পুলিশ? রামদেওবাবু এসেছিল, আবার পুলিশ আসবে কেন?

সুশীলাদি বলল, আঃ, চুপ করো না। পানুবাবু উকিল রতন সম্বন্ধে কী বললেন, সেইটে শোনো না!

গোবিন্দ বলল, দশরথ তো আমায় চা দিলই না। এক গেলাস জল চাইব ‘ সে সাহস নেই। পানুবাবু অনেক পরে ফিরে এলেন, তেনাকে তো আর চায়ের কথা বলা যায় না। দশরথ ব্যাটা বোধহয় নিজেই আমার নাম করে সেই চা খেয়ে নিয়েছে। তারপর শোনো, পানুবাবু ফিরে এলেন বড্ড গম্ভীর। আমায় বললেন, ওরে, তোদের জন্য তো এখন কিছু করা যাবে না! পরপর দুটো ডাকাতি হয়েছে, পুলিশের বড় বড় অপিসার এসে গেছে তাই জন্যে, এখন বেশ কিছু ধরপাকড় না করলে কলকাতায় পুলিশের বড় অপিস হুড়কো দেবে। রতন ডাকাতির কেসে ধরা পরেছে, বাসের দু’জন প্যাসেঞ্জার তাকে চিনিয়ে দিয়েছে, তার এখন ছাড়ান ছুড়িন নেই!

সুশীলাদি ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বললেন, যাঃ, তা হলে এখন কী হবে?

একজন বৃদ্ধ বলল, কপালে যা আছে তাই হবে। বললুম সেদিন অধর্মের পথে যাসনি। পুজো আচ্চা দে। বৃষ্টি নামলে খেতের কাজ পাব। মহাদেব সাউয়ের জমিতে লাঙল পড়লে আমাদের তো ডাকবেই।

বৃদ্ধকে অগ্রাহ্য করে গোবিন্দ বলল, এখন সবাই কাজের কথা শোনো! এই তো সন্ধে হয় হয়, আমাদের এখন এই জঙ্গল ছেড়ে বেরুতে হবে সবাইকে।

সুশীলাদি বলল, জঙ্গল তো ছাড়তেই হবে। রামদেও শেঠ শাসিয়ে গেছে। তুই তো সে কথা এখনও জানিস না!

এবারে গোবিন্দ মন দিয়ে রামদেওজীর বৃত্তান্তটা শুনল। এ কাহিনীর মধ্যে আমার সামান্য অংশও বাদ গেল না।

গোবিন্দ বলল, হুঁ, রামদেও আসবে, পুলিশও আসবে। শোনো, পুলিশ এসে আমাদের ধরার আগেই আমরা পুলিশের কাছে ধরা দেব!

বড়কাকা আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ, বলিস কি? সেধে ধরা দেব!

—শোনো বড়কাকা, আমাদের আর কোনো উপায় নেই। পুলিশ জেনে গেছে, এখন আংড়া গ্রামের কাউকে আর ছাড়বে না। ব্যাটাছেলেগুলোকে তো ধরবেই। কতকাল পালিয়ে বাঁচতে পারবে বলো? কোথায়ই বা পালাবে? এখন একটাই বুদ্ধি আছে। পানুবাবু উকিল সেই কথাই বলে দিয়েছেন। আজ একটু বেশি রাতে ঝাড়গ্রাম থানায় পুলিশ না গরমেন্টের একজন খুব বড় সাহেব আসবে। আমরা সবাই মিলে গিয়ে, মেয়েলোক, ব্যাটাছেলে, গুঁড়োগাড়া, বুড়ো–বুড়ি সব্বাই একসঙ্গে গিয়ে থানা ঘিরে থাকব। সেই বড় সাহেবকে আর্জি জানাব। তেনাকে বলব, সাহেব, আমরা খেতে পাইনি বলে বাধ্য হয়ে চুরি ডাকাতি করেছি, আমাদের দুটি খাবারের ব্যবস্থা করে দাও, আমরা আর কিছু করব না। বৃষ্টি নামার আগে পর্যন্ত আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দাও! আমাদের বাঁচতে দাও, আমরা অন্যের জিনিসে লোভ করব না।

ভবেন উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছিস, গোবিন্দ? আমরা এই কথা বললেই তারা শুনবে? থানার কাছে গেলেই বেধড়ক প্যাঁদাবে!…ডাণ্ডা ভরে দেবে। আমি পুলিশকে চিনি না?

গোবিন্দ বলল, তুই একবার জেল খেটেছিস, তুই পুলিশকে ভালো চিনিস কিন্তু পানুবাবু উকিল বললেন, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পুলিশ না গরমেণ্টের কোন্ বড় সাহেব আজ আসছেন, একমাত্র তিনিই আমাদের ছেড়ে দিতে পারেন!

বড়কাকা বলল, গোবিন্দ, পুলিশের সেই বড় অপিসার যদি জিজ্ঞেস করে যে এখন তোমরা যে সাহায্যের কথা বলছ, তা ঐ বাস আটকাবার আগে বলোনি কেন? তখন কী উত্তর দিবি?

—আগে কি কোনো বড় অপিসার এদিকে এসেছে? আমরা ডাকাতি করিছি বলেই তো এসেছে। আমরা বাধ্য হয়ে ঐ কাজ করিছি, সেটা বলতে পারব না! তিনদিন কিচ্ছু √াইনি, একটা দানা মুখে দিইনি, একটা বাচ্চা মরে গেল, তবেই না মরিয়া হয়ে বাস আটকিছি!

—আপিসার যদি আমাদের কথা না শুনে সব্বাইকে ফাটকে ভরে দেয়?

–সে ও হবে মন্দের ভালো। জেলখানায় খাবার দেবে তো, সবাই দুটি খেতে পাব!

ভবেন আবার বলল, বাজে কথা বলিসনি, গোবিন্দ। সবাইকে জেলে পুরে দিয়ে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে গভর্নমেন্টের বয়েই গেছে। বড় জোর তিন চারজনকে ধরবে। পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেবে, আর মেয়েছেলে–বাচ্চাগুলো না খেয়ে থাকবে!

—তা হলে তোমরা কী করতে চাও বলো? পানুবাবু উকিল আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছেন। পই পই করে বলেছেন, সবাই এককাট্টা থাকবি। কেউ পালাবি না। মেয়েছেলেদের সামনে এগিয়ে দিবি। তারপর দ্যাখ ভাগ্যে কী আছে!

একজন বৃদ্ধ বলল, পিটিয়ে যদি হাড়গোড় ভেঙে দ্যায়, তা হলে বৃষ্টি নামলে কাজে যাব কী করে গো?

সুশীলাদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওসব বাজে কথা ছাড়ো। আমরা সবাই থানায় যাব। রতনকে ছাড়িয়ে আনব। নইলে সবাই ধরা দেব। এই হলো সোজা কথা। রতন একা একা মার খাবে, আর আমরা বাইরে থাকব, এ কী হয়? কে কে যেতে চাও না বলো? যে–যে যাবে না, সে এক বাপের ব্যাটা নয়।

এবার একজনও কেউ আপত্তি করল না। ভবেন ছাড়া আর কেউ আলাদা মতামত দিতেই জানে না। ভবেনও চুপ করে গেছে এখন।

বড়কাকা বললেন, ময়না আর তার বাচ্চাটার কী হবে? ময়না তো যেতে পারবে না! কে থাকবে ময়নার সাথে?

কখন উঠে এসে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ময়না। সে অনেক কিছু শুনেছে। সে বলল, কারুর থাকতে হবে না। আমিও যাব!

সুশীলাদি ব্যস্ত হয়ে বলল, না–না, ময়না, তুই যাবি না। তোর কোলে রতনের ছেলে। তুই যাবি কী করে? তোকে কেউ তোর বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে! ঐ সুবল না হয় যাবে।

ময়না বলল, তুমি চিন্তা করো না সুশীলাদি। আমি ঠিক পারব। ছেলে তার বাপকে দেখবে না?

আরও কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর শুরু হলো যাত্রা। আমার সঙ্গে আর কেউ কোনো কথা বলেনি। আমি এদের মূল স্রোতের তো কেউ নই, আমি একজন দর্শক মাত্র।

সন্ধের আকাশ গাঢ় লাল রঙের। পাখিরা ফিরছে বাসায়। আর একদল মানুষ একটা আশ্রয় ছেড়ে চলেছে অনির্দিষ্টের দিকে। সবাই বেশ চুপচাপ, বাচ্চারাও বিশেষ কথা বলছে না। সাপ, বাঘ, পুলিশ সম্পর্কে গ্রামের মানুষের একটা আজন্ম ভীতি থাকে। এখন এই দলটি স্বেচ্ছায় যাচ্ছে পুলিশের কাছে।

কেউ দৌড়চ্ছে না, সবাই যাচ্ছে আস্তে আস্তে, কেননা অনেক দূরে যেতে হবে।

আমি হাঁটছি প্রায় সবার পেছনে। আমার বারবার মনে পড়ছে রামদেও নামে লোকটির কথা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আমি কী করতে পারি। কতটুকু ক্ষমতা আছে আমার? উগ্রপন্থীরা কী করে যে মানুষকে মারে তা যেন অনেকটা বুঝতে পারছি আমি। আমার কাছে যদি একটা রিভলভার থাকত, তাহলে আমি রামদেওকে হয়তো খুনই করে ফেলতাম ঝোঁকের মাথায়। তারপর আমার ফাঁসী হতো বা যা হতো গ্রাহ্য করতাম না। সে অন্য রাজ্য থেকে এখানে জঙ্গল কেটে কাঠের ব্যবসা করতে এসেছে, শুধু সে জন্যে রাগ নয়, মানুষের প্রতি তার যে অদ্ভুত অবজ্ঞার ভাব সেটাই সহ্য করতে পারছি না!

এমন কিছুই বড় জঙ্গল নয়। মোটামুটি আধ ঘণ্টার মধ্যে বড় রাস্তা। গাড়ি চলছে, বাস চলছে। একটা বাস জোর করে থামিয়ে, সেই বাসে সবাই মিলে ঝাড়গ্রামে গেলে কেমন হতো? বাস হাইজ্যাকিং তো করা যেতেই পারে! আমি নিজের জন্য ভাবছি না। আমার হাঁটতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না, আমি ভাবছি ময়না আর তার ছেলের কথা।

কিন্তু এরা যদি নিজেরা বাস না থামায়, আমার কিছু করার নেই। গ্রামের লোকদের মতিগতি বোঝা যে দুঃসাধ্য তা আমি টের পেয়েছি একবার। আমি এদের কিছু বোঝাতে গেলে তার ফল বিপরীত হতে পারে। তারচেয়ে আমার দর্শকের ভূমিকাটাই ভালো।

ময়না তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অবশ্য হেঁটে যাচ্ছে আগে আগে। সব মেয়েরাই সামনের দিকে। সেটাই এদের স্ট্র্যাটেজি। গোরুর বাচ্চা হলে একটু বাদেই বাছুরটি লাফাতে শুরু করে, তার মাও নিজের দৈনন্দিন কাজ শুরু করে দেয়। মানুষের বাচ্চা এবং জননীও যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আগে দেখিনি তো!

মাত্র কয়েক হাজার বছর আগেই মানুষ ছিল যাযাবর। পথ চলতে চলতে অনেক মায়ের সন্তান প্রসব হয়ে যেত নিশ্চয়ই। যীশু খৃষ্ট জন্মেছিলেন খড়ের গাদায়, কেষ্টঠাকুরও জেলখানার মধ্যে, জন্মাবার একটু পরেই তাঁকে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নদী পার হতে হয়েছিল। আমার বাবাও জন্মেছিলেন এক কাঁচা–মাটির উঠোনে। শুনেছি, তাঁর জন্মের একটু পরেই বৃষ্টিতে আঁতুরঘরে এক হাঁটু জল জমে গিয়েছিল।

অন্ধকার হয়ে গেছে, আমি আর রাস্তা চিনতে পারছি না। গোবিন্দই পথ নির্দেশক। কলকাতার একটি বাড়িতে রান্নার ঠাকুরের কাজ করার চেয়ে গোবিন্দর এখানকার ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ! প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া ও চাকরি হারানো তো গোবিন্দর পক্ষে ভালোই হয়েছে। তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয়েছে। যদিও, একথাও ঠিক, কলকাতায় পুষ্পর সঙ্গে গোবিন্দর প্রেমটা মোটেই অগভীর ছিল না। গোবিন্দ আর বিয়েই করেনি! রাগের চোটে সে দুটো–তিনটে বিয়ে করে ফেললেই পারত। পুষ্পর বিয়ে হয়ে গেছে তা জানি, সে কি এখনও গোবিন্দর কথা ভেবে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে?

রেললাইন পার হয়ে, খটখটে ডাঙা জমির ওপর দিয়ে কোনাকুনি চলেছে এই মানুষের স্রোত। মাঝে মাঝে গোবিন্দ হাঁক পাড়ছে, সামনে খানা আছে, ডাইনে ঘুরে এসো গো! এবার বাঁয়ের জঙ্গলটায় ঢোকো।

কোথাও বিন্দু বিন্দু আলো। সংসারী মানুষের বাড়িঘর। সেখানে খাওয়া–পরা– ঘুমোনো, স্নেহ–প্রেম–দয়া–মায়া মোটামুটি ঠিকঠাক চলছে। তারা কেউ জানে না, একটা হাড়হাভাতে নারী–পুরুষের দল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই সন্ধেবেলা এমন এক জায়গায় চলেছে, সেখানে এক–দু’ ঘণ্টা পরেই তাদের ভাগ্যে কী আছে তার কোনো ঠিক নেই। এরা যেন নিয়তির হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে নিজেদের।

এতগুলো মানুষকে কি মেরে ফেলতে পারে পুলিশ? এরা থানায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে রতনকে ছাড়িয়ে আনতে পারবে না? পুলিশ বা সরকারের কোনো বড়বাবু এদের দয়া করবেন? রাজনৈতিক দলগুলো কোথায় গেল, এদের সমর্থনে এগিয়ে আসবে না তাদের কেউ? পুলিশের গুলি খেয়ে দু’জন মরলে তখন একটা সোরগোল হবে, তখন হয়তো কোনো দল হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ে বলবে, এরা আমাদের লোক, এরা আমাদের লোক, বিচার চাই, বিচার চাই!

এই হাঁটার মধ্যে ক্লান্তি নেই, একঘেয়েমি আছে। কত দূর, আর কত দূর? মনে হলো যেন বম্বে রোড পার হয়ে এসেছি, তারপর তো কিছু কিছু পাকা ঘর– বাড়ি চোখে পড়া উচিত। এখনও বিদ্যুতের আলো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যে এই চরাচরকে আদিম পৃথিবী হিসেবে কল্পনা করা যায়। কিন্তু আদিম মানুষের জন্য ছিল অস্পর্শিত বনভূমি, ফলবান বৃক্ষ, সুলভ পশুমাংস, অদূষিত নদীর জল। সেখান থেকে আমরা কতদূরে চলে এসেছি!

একটা বাচ্চা বলে উঠল, ও মা, এলা খিচুড়ি খাব না?

তার মা তাকে বলল, চুপ, চুপ!

একজন বৃদ্ধ বলল, জেলখেনায় রুটি দেয়, না ভাত দেয় রে?

পাশ থেকে দু’জন চাপা গলায় বলল, চুপ করো গো, চুপ করো!

বৃদ্ধটি তবু বলল, হায় ভগবান, চত্তির মাসে যদি ক’ পশলা বৃষ্টি দিতে! সামনে থেকে গোবিন্দ বলল, কেউ বিড়ি খাবে তো এখানে ধরিয়ে নাও, আর বেশি দূর নেই।

গম্ভীর, দৈববাণীর মতন তার কণ্ঠস্বর। যেন সে এ জন্মের মত যার যা সাধ মিটিয়ে নিতে বলছে। এর পর আর কেউ বিড়ি খেতে পারবে কি না তার ঠিক নেই। বেশ কয়েকজন হিসি করতে বসে গেল।

আজ ঝাড়গ্রাম শহরের রাস্তাতেও আলো নেই। গাড়িঘোড়াও খুব কম। এমন কি বেশি রাত হয়েছে?

থানার সামনে আলো জ্বলছে, ভেতরে চার–পাঁচটা গাড়ি। কিন্তু গেট পেরিয়ে ঢোকা গেল না, দু’জন সেপাই বাধা দিল, গোলমাল শুনে দৌড়ে এলো আরও দু’জন লাঠিধারী। তারাই চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল বেশি।

গোবিন্দকে এখন পেছনে আনা হয়েছে, একেবারে সামনে সুশীলাদি, ময়না ও অন্য মেয়েরা। সুশীলাদি বলল, আমরা বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করব!

সেপাইগুলো কথা শুনতে চায় না, তারা লাঠিগুলো আড়াআড়ি করে ধরে সবাইকে গেটের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। তাদের কথা শুনে বোঝা গেল, এস পি সাহেব যে–কোনো মুহূর্তে এসে পড়বেন খড়্গপুর থেকে, তারা গেট পরিষ্কার রাখতে চায়।

গোবিন্দ চেঁচিয়ে বলল, পিছিয়ে এসো না, সুশীলাদি, পিছিয়ে এসো না!

পেছন থেকে চাপ দেওয়া হলো সামনের দিকে, কিন্তু পুলিশরা লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড করে রেখেছে। একজন ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, সে কাছে আসছে না, সে জানতে চাইছে না এতগুলো মানুষ কী চায়, খুব সম্ভবত সে এস পি সাহেব নামে এক দেবতার ধ্যান করছে। সে দূর থেকে হুকুম দিল, এই ক্লিয়ার করো, গেট ক্লিয়ার করো!

থানা পর্যন্ত এসে পড়াই হয়েছে যখন, তখন প্রতিবাদটা আরও সরব হওয়া উচিত ছিল। ভয় দেখানো উচিত ছিল পুলিশদের। সবাই মিলে একটা কিছু স্লোগান দিলে ভালো হতো না? এরা কিছুই জানে না। আমিই বা কী শেখাতে পারি?

তবু আমি অধৈর্য হয়ে পড়লুম। বড়কাকার হাত চেপে ধরে বললুম, সবাই মিলে চ্যাঁচামেচি করুন। নইলে ভেতরের বড় সাহেব শুনতে পাবে না! সেপাইদের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই!

বড়কাকা দুর্বল গলায় বলল, ওরে তোরা সবই বল, আমরা ভেতরে যাব! সবাই বল!

গোবিন্দ চেঁচিয়ে বলল, আমরা আংড়া গাঁয়ের মানুষ। আমরা ভেতরে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলব!

তারপর সবাই এক সঙ্গে গলা তুলল বটে, কিন্তু তাতে কিছুই বোঝা গেল না। একজন সেপাই বিরাট মোটা গলায় বলল, এখন হঠে যাও, এখন হঠে যাও, কালকে এসো!

আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এই ইডিয়েট সেপাইগুলো বুঝতে পারছে না যে এস পি সাহেব এদের জন্যই ছুটে আসছেন অন্য কাজ ফেলে!

আমি ঠেলে ঠুলে সামনে এগিয়ে গিয়ে একজন সেপাইকে বললুম, এই যে, শুনুন! কয়েকজনকে অন্তত ভেতরে যেতে দিন, ও সি’র সঙ্গে কথা বলতে হবে।

মেয়েদের গায়ে লাঠি ছোঁয়াতে ইতস্তত করলেও সেপাইটি আমার বুকে চওড়া করে লাঠিটা চেপে ধরল। এবার আমাকে ঠেলবে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আরও চারজন সেপাই, একবার লাঠি চালাতে শুরু করলে এরা থামবে না। গ্রামের লোক যদি একবার পালাতে শুরু করে, আর ফেরানো যাবে না তাদের।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টরটি। সিগারেট টানছে এদিকে চেয়ে। এটা ঝাড়গ্রাম শহর, আমার উচ্চারণ শুনেও পাত্তা দেবে না এরা। আমার পোশাক ভদ্রলোকের মতন নয়। খালি গায়ে মানুষ মানেই নগণ্য মানুষ। একমাত্র উপায় আছে ইংরিজি!

আমি গলা তুলে বললুম, এই ইন্সপেক্টরবাবু, শুনুন, উই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ। দিস ইজ এ ডেলিগেশান ফ্রম দা আংড়া ভিলেজ!

সেপাইটি আমাকে ঠেলে দিতে গিয়েও কয়েক মুহূর্ত থেমে গেল। ভুরু কুঁচকে গেল এস আই ভদ্রলোকের। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে সে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন? কী বললেন?

জয় ইংরিজি!

আমি বললুম, এরা আংড়া গ্রামের মানুষ। এদের একজনকে আপনারা অ্যারেস্ট করে রেখেছেন। এরা এস পি সাহেবের কাছে দাবি জানাতে চায়। গোবিন্দ, সুশীলাদি, তোমাদের কথা এবার বলো।

এস আই–টি বলল, আংড়া গ্রাম? বাস ডাকাতির কেস? এরা সেই ডাকাতগুলো? আমি ফ্যাকাসে ভাবে হেসে পেছন ফিরে তাকালাম। ডাকাতই বটে, কী সব ডাকাতের ছিরি! ছেঁড়া–ময়লা ঝুলি ঝুলি শাড়ি পরা কতকগুলো চিঁড়েচ্যাপ্টা চেহারার স্ত্রীলোক, রোগা রোগা খালি গায়ে কিছু পুরুষ, আর একগাদা বাচ্চা, তার মধ্যে একটার বয়েস একদিনও পুরো হয়নি!

সুশীলাদি বলল, ও বাবু, আমাদের রতনকে ছেড়ে দাও, নইলে আমাদের সবাইকে ধরো, আমরা কেউ এখান থেকে যাব না!

এস আই–টি পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে বলল, ডেকাইটি কেস! গোবিন্দ, নগেন, শিবু ভবেন, সুবল এই পাঁচজন এদের মধ্যে আছে? তোমরা এগিয়ে এসো! সেপাই, দু’জন গিয়ে এদের পেছনে দাঁড়াও!

আমি বললুম, না, এদের শুধু কয়েকজনকে ধরতে পারবেন না। এরা সবাই মিলে এস পি সাহেবের কাছে যা বলার বলবে!

সুশীলাদি দু’ হাত ছড়িয়ে অন্য মেয়েদের বলল, এই, হাতে হাত ধরে থাক, হাতে হাত ধরে থাক, হাতে হাত ধরে থাক…

এস আইটি একজন সেপাইকে বলল, এই, একে ভেতরে ধরে নিয়ে যা! আপনি কে মশাই, নক্‌শাল?

আমি আর কিছু বলার আগেই একজন সেপাই আমার পিঠে লাঠি ঠেকিয়ে বলল, চলো, চলো, ভেতরে চলো!

সেপাইটি আমাকে লাঠির বাড়ি মারতে পারে ভেবে মাথা শিরশির করতে লাগল আমার। আমি হোঁচট খেতে খেতে দৌড়োলুম ভেতরের দিকে। বড় অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে পারলে হয়তো বুঝিয়ে বলা সহজ হবে।

ও সি–র ঘরে অন্য দু’তিনজনের সঙ্গে ব’সে আছে সেই লাল ব্লাউজ পরা মহিলাটি এবং তার পুরুষসঙ্গী। আশ্চর্য, আজও মহিলার ব্লাউজটি লাল। মুখখানায় উদাসীনতা মাখানো। তার পুরুষসঙ্গীটি আমাকে দেখা মাত্র বলল, এই তো সেই ভদ্রলোক। আমাদের পেছনের সীটে বসেছিলেন। একে জোর করে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ইস, আপনার এই অবস্থা করেছে?

আমার দম নিতে খানিকটা সময় লাগল

ও সি একটা খালি চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলল, বসুন। এই, আর এক কাপ চা বেশি এনো! বসুন মশাই, বসুন, জামাকাপড় পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে? মারধোরও করেছে নাকি?

আমি চেয়ারটায় বসে সকলের দিকে চোখ বোলালুম, একটি পাতলা চেহারার যুবক আমার দিকে দু’হাত তুলে বলল, নমস্কার, আমি এখানকার এস ডি পি ও, আমার নাম সুখময় চৌধুরী। ইনি ও সি সাহেব, আর উনি এস ডি ও সাহেব। আপনার নাম নীললোহিত? কলকাতা থেকে আজই আপনার নামে এনকোয়ারি এসেছে আপনি মিসিং ছিলেন, আপনাকে ইমিডিয়েটলি খড়্গপুরে পাঠিয়ে দেবার কথা আছে, একজন সাম তপন সরকার সেখানে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। তিনি আবার ডি আই জি’র কী রকম আত্মীয় হন। এবার বলুন, আপনার কী হয়েছিল!

বইরে একটা আর্ত কলরব শুনে আমি বললুম, আপনারা কি ওদের ওপর লাঠিচার্জ করার অর্ডার দিয়েছেন? শুনুন, ওরা নিরীহ গ্রামের মানুষ…

এস ডি পি ও সুখময় চৌধুরী বলল, না–না, লাঠি চার্জ করব কেন? এস পি সাহেবের জন্য গেটটা ক্লিয়ার রাখতে বলেছি। ওদের সঙ্গে আপনি এলেন কী করে? ওরাই নিয়ে এলো?

-সবটা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে! শুধু আগে এইটুকু বলি, ওরা একটা বাস থামিয়ে কিছু সাহায্য চাইবার জন্য উঠেছিল, কেউ কিছু দেয়নি। তখন ওরা মরীয়া হয়ে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়েছে। আমি ওদের গ্রামে গিয়ে দেখেছি, ওরা একেবারে খেতে না পাওয়া মানুষ। কোনোরকম রিলিফের ব্যবস্থা নেই, বৃষ্টি হয়নি বলে ওরা মাঠের কাজ পায়নি, সবাই ভূমিহীন চাষী…

–আপনি কি নিজের ইচ্ছেয় ওদের সঙ্গে গিয়েছিলেন?

—হ্যাঁ।

আমার বাসের সহযাত্রী পুরুষটি বলল, মিথ্যে কথা। আমরা দেখেছি, আপনার চুল ধরে ওরা টেনে নামিয়েছে। তাছাড়া ওরা শুধু টাকাপয়সা নিয়েছে, আর কিছু নেয়নি?

এবার লক্ষ্য করলুম, লাল ব্লাউজ পরা তরুণীটির এক কানে খুব যত্ন করে বাঁধা, চুল দিয়ে প্রায় ঢাকা ব্যাণ্ডেজ। তরুণীটি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে।

ও সি বললেন, হ্যাঁ, সোনার গয়নাও নিয়েছে, এফ আই আর–এ আছে প্রায় তিরিশ–চল্লিশ হাজার টাকার গয়না। যে–ব্যাটাকে ধরেছি, সেটা এমন পাজি, কিছুতেই স্বীকার করছে না গয়নাগুলো কোথায় রেখেছে!

আমি বললুম, তবু আমি বলছি, ওরা ডাকাত নয়। অতি নিরীহ মানুষ। খেতে না পেয়ে মরার মুখে এলে মানুষ কত কী–ই তো করতে পারে!

সুখময় চৌধুরী বললেন, রিলিফের ব্যবস্থা হয়েছে। কাল থেকেই ঐসব গ্রামগুলোতে কিছুকিছু রিলিফ দেওয়া হবে। কী বলেন, এস ডি ও সাহেব?

ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠল। প্রথমে ও সি ধরে তারপর সেটা এগিয়ে দিল ডি পি ও–র দিকে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, ইয়েস স্যার, পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার, ঠিক আছে স্যার করতে লাগলেন, বাকি সকলে তখন নির্বাক।

মিনিট পাঁচেক পর ফোন ছেড়ে তিনি কপালের ঘাম মুছে বললেন, এস পি সাহেব, ওঁর আসতে আরও অন্তত এক–দেড় ঘণ্টা দেরি হবে। গ্রামের লোকগুলোকে বাইরেই ঘিরে রাখতে বললেন। ও সি সাহেব, আরও ফোর্স পাঠান, দেখবেন যেন কেউ পালিয়ে না যায়, আর হ্যাঁ….

আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, এস পি সাহেব আপনাকে এক্ষুনি খড়্গপুরে পাঠিয়ে দিতে বললেন, আপনার বন্ধু তপন সরকার ইমপেশেন্ট হয়ে গেছেন, আপনার কাছে কী সব জরুরি কাগজপত্র আছে…

–আমি এখন যাব না। পরে যাব। এস পি সাহেব কতক্ষণে আসবেন না আসবেন, ততক্ষণে ওদের আপনারা আটকে রাখবেন! ওদের মধ্যে বাচ্চা কাচ্চা আছে, তাদের মধ্যে একজন জন্মেছে আজই…

– আহা, আমরা কি মারধোর করছি? এস পি সাহেবের অর্ডার, তাই আটকে রাখছি! রিলিফের ব্যবস্থা হবে কাল থেকে। তবে ওদের মধ্যে যে–কটা ক্রিমিন্যাল, যারা গয়না স্ন্যাচিং করেছে, তাদের তো ধরে রাখতেই হবে।

-ওদের মধ্যে কেউই ক্রিমিন্যাল নয়!

এবারে এস ডি ও সাহেব নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, দেখুন, আমরাও তো মিডল ক্লাস ভদ্রলোকের ঘরের ছেলে। পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নিয়েছি। গ্রামের লোকের দুঃখ–কষ্ট বুঝি, সাধ্যমতন সাহায্য করি। কিন্তু আমাদের হাত–পা বাঁধা! আমাদের ক্ষমতা কতটুকু? এবারে খরা হয়েছে, ল্যাণ্ডলেস লেবারদের অবস্থা খুব খারাপ, তা জানি, তবু রিলিফ আসতে যদি দেরি হয়…

সুখময় চৌধুরী বললেন, আমরা পুলিশে চাকরি করি বলেই তো আর অমানুষ হয়ে যাইনি। গ্রামের লোকের ওপর যাতে অত্যাচার না হয়, সেদিকে স্টেপ্ নিচ্ছি। তা বলে ডাকাতিকে তো সাপোর্ট করতে পারি না। পারি, বলুন? ল’ অ্যাণ্ড অর্ডার মেইনটেইন করতে হবে না? এদিকে ডাকাতি খুব বেড়েছে, কয়েকটা এক্সেপ্লারি পানিশমেন্ট না দিলে…

হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ও সি সাহেব, গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে এনাকে খড়্গপুরে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিন…

ও সি বলল, গাড়ি রেডি আছে স্যার!

আমি বললুম, আমি এখন খড়্গপুরে যাব না। এস পি সাহেব আগে এসে পৌঁছান, আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব।

—খড়্গপুরে গিয়েই কথা বলবেন। আপনি পৌঁছে যাবেন এক ঘণ্টার মধ্যে। উনি তার আগে বেরুতে পারবেন না বললেন।

–আমি এখানেই, গ্রামের লোকদের সামনেই ওঁকে সব কথা বলতে চাই। এবারে সুখময় চৌধুরী মুখখানা কঠোর করে বললেন, আপনি যদি এরকম অবস্টিনেট হন, আপনাকে তা হলে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হবো। আমার ওপর অর্ডার এসেছে আপনাকে পাঠিয়ে দিতে হবে, আই মাস্ট ক্যারি দ্যাট আউট!

— আপনারা মশাই এই ঘরের মধ্যে বসে আছেন, আর কয়েকটা সেপাই দিয়ে ওদের আটকে রেখেছেন? কেন, আপনারা কেউ গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না?

—প্লিজ, আমাদের ডিউটি শেখাবেন না! ওসব লেকচার কলকাতায় গিয়ে দেবেন। দারওয়াজা! নিয়ে যাও একে!

লাল ব্লাউজ পরা তরুণীটি এবার বলল, উনি চা খেলেন না? চা–টা পড়ে রইল…

এটা সরাসরি আমাকে বলা নয়, তাই এর উত্তর দেওয়া যায় না। একজন লোক এসে আমার পাশে দাঁড়াল। আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই, আমি এখানে থাকতে চাইলেও নিছক শারীরিক শক্তি বা অস্ত্র শক্তি আমাকে এখান থেকে বার করে দেবে। তপন কোথায় যেন কলকাঠি নেড়ে বসে আছে।

বাইরে এসে দেখি, আংড়া গ্রামের মানুষগুলোকে রাস্তা থেকে এনে থানার কম্পাউণ্ডের একপাশে বসিয়ে রেখেছে। সেদিকটা অন্ধকার, আলাদা করে সুশীলাদি, গোবিন্দ, বড়কাকা, ময়নাদের চেনা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা মানুষের পিণ্ড। কতকগুলো ক্ষুধার্ত পেট আর অসহায় মস্তিষ্ক।

আমাকে ওঠানো হলো একটা গাড়িতে। সঙ্গে একজন বন্দুকধারী পাহারাদার। সুশীলাদিরা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে আমাকে। আমার সম্পর্কে এখন কী ভাবছে কে জানে! রামদেও–র কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছুটে এসেছিল, পুলিশের হাত থেকে আমাকে ছাড়াবার চেষ্টা করবে না! রতনকে ওরা ছাড়িয়ে নিতে পারবে?

ওদের কাছে এখন বিদায় নেবার চেষ্টা করাও আদিখ্যেতার মতন দেখাবে। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলুম পরাজিত মানুষের মতন।

থানার কম্পাউণ্ড ছেড়ে গাড়িটা পড়ল রাস্তায়। ঝাড়গ্রাম শহরটা একটুখানি পার হলেই দু’পাশে দীর্ঘকায় গাছের অরণ্য। অন্ধকারের মধ্যে হেড লাইটের তীব্র আলো।

আকাশে কখন মেঘ জমেছিল লক্ষ্য করিনি। কিংবা অন্য দেশ থেকে উড়ে এসেছে এই মেঘ। লোধাশুলির কাছাকাছি আসতেই বিদ্যুৎ চমকালো, বজ্ৰপাত হলো, তারপর ঝুপ ঝুপ করে নামল বৃষ্টি। বছরের প্রথম ধারাবর্ষণ। তৃষ্ণার্ত, শুকনো মাটি শোঁ শোঁ করে শুষে নিচ্ছে এই বৃষ্টির জল, যেন শুনতে পাচ্ছি সেই শব্দ। গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়—সবাই যেন এই বর্ষণকে স্বাগতম জানিয়ে বলছে, এসো, এসো, এসো!

হে মেঘ, সেই এলে, তবু এত দেরি করে এলে? এ বছর কি ভুলে গিয়েছিলে এদেশের কথা? যদি একটু তাড়াতাড়ি আসতে, যথাসময়ে আসতে, চৈত্র–বৈশাখে আসতে, তা হলে জমিতে শুরু হতে পারত কাজ, কতকগুলো মানুষ নিজের পরিশ্রমে দু’মুঠো ভাত উপার্জন করে নিত। তাদের বিবেক যাকে অন্যায় মনে করে, সেই পথে যেতে হতো না। সদ্যোজাত শিশুকে বুকে জড়িয়ে থানার কম্পাউণ্ডে বসে থাকতে হতো না এক জননীকে!

শেষ পর্যন্ত কী হবে ঐ মানুষগুলোর? অন্ধকারে দলা পাকিয়ে বসে বসে ভিজবে? একবারও কি ওদের মধ্যে দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *