৭
এটাই হাতিবাড়ির জঙ্গল কি না তা আমি জানি না। কোথাও কোনো আলো নেই, আকাশ অদৃশ্য।
শুকনো পাতার ওপর শুয়ে শুয়ে, শরীরে এত ক্লান্তি, তবু ঘুম আসে না। মাঝে মাঝেই গা চুলকোচ্ছে। ঠিক পিঁপড়ে নয়, অন্য কোনো পোকা। গায়ের ওপর দিয়ে যদি একটা সাপও চলে যায়, তাতেও তো করার নেই কিছুই। একটাই সান্ত্বনা, সাপেরা নাকি নিজে থেকে কামড়ায় না।
আমার আর দৌড়োবার শক্তি নেই। খিদেয় আমার দু’একটা নাড়ি–ভুঁড়ি হজম হয়ে গেছে বোধহয়। তেষ্টার চোটে শুধু গলা শুকিয়ে যায়নি, আমার হৃৎপিণ্ডটাও শুকিয়ে কুঁকড়ে গেছে খানিকটা।
কাছাকাছি শুয়ে আছে আরও কেউ কেউ। কারুর কারুর নিঃশ্বাসে ঘুমের শব্দ। ওদের অভ্যেস আছে, ওরা মাটিতে শুয়েও ঘুমোতে পারে।
আমি আংড়া গ্রামের লোকদের হাত এড়াতে পারিনি। একটা বিশাল বেড়াজালের মতন লাইন করে ওরা ছুটে আসছিল। আমি এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করেও পুকুরের মাছের মতন সেই জালে পড়ে গেছি।
কিন্তু আর একটা বড় চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তখন।
আমাকে বাগে পেয়েও কেউ আমাকে ধরবার চেষ্টা করল না। কেউ গ্রাহ্যই করল না আমাকে। যেন আমি একটা মাঠের মধ্যে গাছ, আমাকে এড়িয়ে দৌড়োতে লাগল ওরা।
আমি কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। ওরা আমার জন্য ছুটে আসেনি! তার মানে আরও বড় কোনো বিপদ ওদের তাড়া করেছে। পুরো গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে।
আমার পক্ষে তখন একটিই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। এই অন্ধকার মাঠের কোন্ দিকে কী বিপদ তা আমার জানা নেই। আংড়া গ্রামের মানুষদের তবু আমি চিনেছি, তারা আমাকে অনেক রকম গালমন্দ করলেও সত্যি সত্যি প্রাণে মারেনি। এতগুলো লোকের মধ্যে মিশে থাকলে তবু খানিকটা নিরাপদ বোধ করা যাবে।
আমিও ছুটতে শুরু করেছি ওদের পেছনে পেছনে।
আংড়া গ্রামের কারুর হাতে কোনো আলো বা মশাল নেই, তারা ছুটে ছুটে যাচ্ছিল নদীর খাতে নেমে। দূরে যে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছিল, সেগুলো আরও দূরে সরে গেল। ওরা শবর হলেও আংড়ার লোকদের আক্রমণ করার কোনো বাসনা তাদের ছিল না। ছুটতে ছুটতেই আমি ওদের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পেয়ে গেলাম। ময়নার স্বামী রতন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। জামসেদপুরের আগেই গালুডিতে ধরা পড়ে গেছে সে, তাকে আজ বিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে ঝাড়গ্রাম থানায়।
তখন বুঝতে পারলুম, আংড়ার লোকদের কাছে আমার অস্তিত্ব কেন হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে গেছে। রতন ধরা পড়ায়, সে কোন্ গ্রামের লোক তা পুলিশের জানতে বেশিক্ষণ লাগবার কথা নয়। আগের দিনে বাস লুঠ করেছিল কোন্ গ্রামের মানুষরা তা পুলিশরা এবার টের পেয়ে যাবেই, সুতরাং আমি আর পুলিশের কাছে গিয়ে নতুন কী নালিশ করব? ওদের যা বিপদ হবার হয়েই গেছে। আমার কাছ থেকে আর অতিরিক্ত বিপদের আশঙ্কা নেই।
গোবিন্দ আর ভবেন গাইনের ব্যক্তিগত কারণে রাগ আছে আমার ওপর, কিন্তু গ্রামের অন্য মানুষ আর আমার ওপর ক্রুদ্ধ নয়। আমি এ পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করিনি। এটাই তারা মেনে নিয়েছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেও আর তাদের আপত্তি নেই।
ওদের কাছেই শুনলুম, আজ দুপুরের বম্বে রোডের ওপর লুঠ হয়েছে একটা চালের লরি। সেটা অন্য কোনো গ্রামের মানুষের কীর্তি, কিন্তু প্রথম সন্দেহটা পড়বে আংড়া গ্রামের ওপর। পর পর দু’দিনের এরকম ঘটনায় পুলিশ খুবই ক্ষেপে গেছে, জেলার নানা জায়গা থেকে পুলিশের বড় সাহেবরা এসে গেছে এদিকে। আজ রাতেই আংড়া গ্রাম ধ্বংস হবে।
সুশীলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল, আজই পোড়ারমুখোরা চালের লরি লুঠ করল। আর দুটো দিন সবুর করতে পারল না? একটু দূরে গিয়ে ঐ কাজটা করতে পারত না?
এইসব গ্রামের লোক একেবারে নভিস ডাকাত। আসলে ডাকাতি করতে গেলেও দু’এক পুরুষের শিক্ষা লাগে। সারাজীবন চাষবাস করে, আধপেটা খেয়ে হঠাৎ কি একদিনে ডাকাত হওয়া যায়? একটা গ্রামের লোক বাস লুঠ করে একদিন পেট ভরে ভাত খেয়েছে দেখেই পাশের গ্রামের মানুষ প্রায় সেই একই জায়গায় আবার লুঠপাট করতে গেছে! গ্রামের পুলিশও যে আসলে শহুরে মানুষদের, শহুরে সরকারের সম্পত্তির পাহারাদার, তা তো এরা জানে না!
মানুষ না খেয়ে মরলে পুলিশের তা দেখবার দরকার নেই। সেটা তাদের ডিউটি নয়। কিন্তু না খেতে পাওয়া মানুষ মরিয়া হয়ে কারুকে মারতে যাক, কিংবা খাদ্য লুঠ করুক, অমনি পুলিশের কর্তব্যজ্ঞান জেগে উঠবে। আইন এমনই বিচিত্র।
একটা বড় কোনো পোকা পিঠে কামড়াতেই আমি ছটফটিয়ে উঠে বসলুম বিছেটিছে নয়, একটা চ্যাপটা ধরনের পোকা, সেটা দেখতে না পেলেও টিপে মেরে ফেললুম।
একটু দূরে কে যেন মুচড় মুচড়ে কাঁদছে। কোনো স্ত্রীলোক, এটা তীব্র কোনো শারীরিক কষ্টের কান্না। কে যেন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলল।
একটা বিড়ির আগুন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আরও কেউ কেউ জেগে আছে তা হলে। আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলুম, বিড়ির আগুনটা আমাকে পেরিয়ে গিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেল। তারপর আগুনটা নীচু হয়ে যেতে বোঝা গেল মানুষটা হাঁটু গেড়ে বসেছে।
একটি পুরুষ ফিসফিস করে বলল, ও সুশীলাদি, ওর পেট ব্যথা করছে, পেটে একটু সেঁক দেবে?
এবার সুশীলাদির গলা শোনা গেল, সেঁক দিয়ে কী কিছু হবে? এতটা পথ দৌড়ে এসেছে, ওটা আছে না গেছে কে জানে!
পুরুষ কণ্ঠটি গোবিন্দর। সে বলল, একটু সেঁক দিয়ে দ্যাখো না কমে কি না।
—এখন আগুন জ্বালবি? সেটা কি ঠিক হবে?
—কী আর হবে। কপালে যা আছে তা তো হবেই!
—কী বিপদের মধ্যেই ফেলল ভগবান। এখন সব যাবে! এর চেয়ে না খেতে পেয়ে মরাও ভালো ছিল রে! তোরা যে কী বুদ্ধি দিলি, গোবিন্দ!
পাশ থেকে আর একজন বলল, এই গোবিন্দ, রতন আর ভবেনের কথা শুনেই তো এই গুখুরির কাজ করেছি। এত পাপ কি সয়!
গোবিন্দ ধমকে উঠে বলল, নিমকহারামের মতন কথা বলো না। তখন সবাই রাজি হওনি? সবাই ঠিক ঠিক বলে লাফাওনি? খারাপটা কী হয়েছে? না খেয়ে মরার চেয়ে একটা দিন তো অন্তত ভালো করে খেয়েছ?
অন্য কণ্ঠটি বলল, আমরা তো মরবই, ছেলেপুলেগুলোনও শেষ হয়ে যাবে! সব যাবে!
স্ত্রী লোকটি আবার ডুকরে কেঁদে উঠতেই সবাই চুপ হয়ে গেল।
একটু পরে গোবিন্দ গম্ভীর ভাবে বলল, সুশীলাদি, আমি আগুন জ্বালছি। আরও দু’একজন উঠে বসে জড়ো করতে লাগল শুকনো পাতা। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি, এই জঙ্গলে শুকনো পাতার অভাব নেই। গোবিন্দ দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালল।
এবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল অনেকগুলি মুখ। যে মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সে ময়না।
সুশীলাদি স্নেহের স্বরে বলল, ও ময়না, একটু সেঁক দিয়ে দি? আরাম লাগবে। ও ময়না, একটু ফিরে শো!
উত্তরে ময়না শুধু উঁ উঁ উঁ উঁ শব্দ করল।
সুশীলাদি বলল, আটমাসের পোয়াতি! এই ধকল কি ওর সহ্য হয়! আমার আবার একটা চমক লাগল। ময়না সত্যিই সন্তানসম্ভবা? তার যে এতখানি অ্যাডভান্সড অবস্থা তা তার চেহারা দেখে একটুও বুঝতে পারা যায়নি। এই রকম অবস্থায় সে আট–দশ মাইল দৌড়ে এসেছে! সুশীলাদি সব সময় তার পাশেপাশে আসছিল বটে, মাঝে মাঝে ধরছিল তার হাত।
এবারে দুপুরবেলা ময়নার পালিয়ে যাবার চেষ্টার আসল কারণটা বোঝা গেল। মাতৃস্নেহ! প্রকৃতির সবচেয়ে জোরালো টান! পুলিশ আসবে, অত্যাচার করবে, সেই ভয়ে ময়না তার পেটের সন্তানটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। গর্ভবতী বেড়াল যে–জন্য ছাদের ঘরে লুকোয়।
এরা অনেকে সন্দেহ করেছিল, রতন গয়না বিক্রির সব টাকাটা একা হজম করে দেবে। যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে সাঁট করে রেখেছিল আগেই, দু’জনে মিলে পালাবে কোনো দূর দেশে।
এখন ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। রতন একা ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে সেখানে মার খেতে খেতে তার এখন কী অবস্থা, তা কে জানে! আর বিনা দোষে ময়নার ওপর নির্যাতন করেছে তার গ্রামের মানুষ।
এখন অনেকের মুখেই ফুটে উঠেছে একটা অপরাধ বোধ!
কী দিয়েই বা সেঁক দেওয়া হবে ময়নাকে? রবারের হট ওয়াটার ব্যাগ এরা বোধহয় কখনো চোখেও দেখেনি। একটা পেতলের ঘটি কিংবা কাচের বোতলও এদের সঙ্গে নেই।
সুশীলাদি প্রথমে আগুনের আঁচের ওপর একটা গামছা ধরে রেখে, সেই গামছাটা একটু গরম হতেই সে চেপে ধরে রাখতে লাগল ময়নার পেটে। আরও কয়েকজন মহিলা ওদের ঘিরে বসেছে। ঐটুকু গামছার আঁচে আর কতটুকু সেঁক হয়। একটু পরে অন্য মেয়েরা তাদের দু’হাত মেলে ধরতে লাগল আগুনের ওপর। সেই হাত গরম হয়, তখন মেয়েরা তাদের গরম হাত বুলিয়ে দেয় ময়নার পেটে, একজনের পর আর একজন। মেয়েরা তাদের হাত আগুনের এত কাছে নিয়ে যাচ্ছে, যেন ঝলসে যাবে, তবু তাদের ভূক্ষেপ নেই।
পুরুষেরা ওখান থেকে খানিকটা সরে এসেছে।
ভবেন গোবিন্দকে বলল, একটা বিড়ি দে তো, গোবিন্দ।
–আমার কাছে আর নেই বিড়ি। আর কার কাছে আছে দ্যাখ।
–ক’ বাণ্ডিল বিড়ি কিনেছিলি? এর মধ্যে ফুরিয়ে গেল।
–বলছি তো আমার কাছে আর নেই, কেন ঘ্যানঘ্যান করছিস?
—মেজাজ দেখাচ্ছিস কী? তোর বাপের পয়সায় বিড়ি কিনেছিলি, না কালকের পাবলিকের পয়সায় কিনেছিস?
–ভবেন, তোর যত বড় মুখ না, তত বড় কথা? কালকের টাকা আমি নিজে এক পয়সা ছুঁইনি, জিগেস করে দ্যাখ সুশীলাদিকে!
—সবাই সব টাকা জমা দেয়নি, আমার ঢের জানা আছে…
—শালা হারামী, তুই আমায় এই কথা বলছিস?
গোবিন্দ ঝাঁপিয়ে পড়ল ভবেনের ওপর, তারপর লেগে গেল দু’জনের ঝটাপটি। ওদের দু’জনের মধ্যে যে ভাব নেই তা আগেই বোঝা গেছে।
ভবেনের গায়ের জোর কম কিন্তু গলার জোর বেশি।
মারামারিটা বেশি দূর গড়াতে পারল না। আরও অনেকে এসে জোর করে ছাড়িয়ে দিল দু’জনকে। বড়কাকা ওদের মাঝখানে দাঁড়াল দুহাত ছড়িয়ে। গোবিন্দকে জোর করে বসিয়ে দেওয়া হলো আমার কাছাকাছি। সমাধান সূত্র হিসেবে অন্য কেউ দুটো বিড়ি দিল গোবিন্দ আর ভবেনকে!
ভবেনের অভিযোগটি কিন্তু গুরুতর। কালকে বাস–লুঠের টাকা এক জায়গায় জমা পড়ার কথা ছিল, তার থেকে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে কিছু কিছু সরিয়েছে।
বড়কাকা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানাতে লাগল যে, একথা সম্পূর্ণ মিথ্যে। সে নিজে সব টাকা জমা করেছে। গুনে–গেঁথে হিসেব করা হয়েছে পাঁচজনের সামনে। জমা রাখা হয়েছে সুশীলাদির কাছে। সেই টাকা থেকে কেনা হয়েছে চাল, বাকি টাকাগুলো যতক্ষণ থাকবে, সকলে মিলে সমান ভাবে খাবে। বিপদের সময় ঝগড়াঝাঁটি করলে বিপদ আরও বাড়ে ছাড়া কমে না।
গোবিন্দ বসে বসে ফুঁসছে। তার হাঁটু ধরে বসে আছে তার ঘনিষ্ঠ দু’একজন।
কান্না থামিয়ে এখন প্রায় সুর করে নিজের মনের আক্ষেপের কথা বলে যাচ্ছে ময়না। একবার তার গলা খুব চড়ে যাচ্ছে, আবার নামছে। তার কথাগুলি এইরকম। ওমা, মাগো, কোথায় তুমি… আমার ঘরের লোকটাকে এরা একা একা বিপদের মুখে পাঠাল…সে মানুষটা গোঁয়ার, এরা কেউ সঙ্গে গেল না…তাকে পুলিশে ধরেছে গো…ওমা, মাগো, তাকে পুলিশে পিটিয়ে মেরে ফেলবে…পুলিশে ধরলে কেউ বাঁচে না…ওগো আমার পেটের সন্তান তার বাপকে দেখবে না…হে ভগবান, তুমি আমায় কেন বাঁচিয়ে রাখলে, হে ভগবান….
একঘেয়ে ভাবে চলতে লাগল সেই বিষাদ গাথা। শুনতে শুনতে আমার মনে হলো, লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোকদের, সচ্ছল, খেতে পাওয়া মানুষদের জন্য একজন ভগবান আছে তা আমি জানি! কিন্তু গরিবদের কি কোনো ভগবান আছে? তা যদি থাকবে, তাহলে সেই ভগবানের ছেলেমেয়েরা খেতে পাবে না কেন? ময়না যাকে ডাকছে, সেই ভগবান থাকেন কত লক্ষ–কোটি মাইল দূরে। আংড়া গ্রামের মতন এলেবেলে গ্রামের দিকে কি তাঁর নজর পৌঁছোয়? ময়নার মতন মেয়েদের কান্নাও তিনি শুনতে পান?
কে যেন বলেছিল, এমনকি পিঁপড়ের পায়ের শব্দও শুনতে পান তিনি! এটা শিক্ষিত লোকদের সুন্দর করে বানানো কথা। পিঁপড়েরা লোকের পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা যায়, তা তিনি দেখেন না?
একসময় গোবিন্দ আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বড়কাকা, তোমরা এখানে থাকো, আমি একবার রতনের খবর নিয়ে আসি!
সবাই উৎকর্ণ হলো, রতন আছে ঝাড়গ্রাম থানায়, সেখানে গোবিন্দ যাবে কী করে?
বড়কাকা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী বললি?
– আমি রতনের খবরটা নিয়ে আসি!
—রতনের খবর তুই কোথায় পাবি?
–ঝাড়গ্রাম যাব। সেখান থেকে ঘুরে আসব!
–তুই পাগল হয়েছিস নাকি রে, গোবিন্দ? তুই সেধে সেধে থানায় যাবি?
থানার ভিতরে কি যাব? কাছ থেকে ঘুরে আসব। ঐ দিকে গেলেই হালচাল বোঝা যাবে। পুলিশ আমাদের গাঁয়ে গেসলো কিনা সে খবরটাও পাওয়া যাবে।
এসব খবর কে দেবে তোরে?
—এখানে বসে থাকলে কি কিছু জানা যাবে? চেষ্টা করতে হবে না?
– না–না, গোবিন্দ, তুই যাবি না, তুই আমাদের ভরসা। তুই না থাকলে আমাদের বল–বুদ্ধি দেবে কে?
—রতনের সাথে আমি যেতে চেয়েছিলুম, তোমরা দাওনি। জেলখানায় বসে বসে সে ভাবছে, আমরা তাকে ভুলে গেছি। আমি আসি, ঘুরে আসি, আমি একা গেলে কিছু হবে না!
সুশীলাদি চেঁচিয়ে উঠল, বড়কাকা ওরে আটকাও, ওরে আটকাও! গোবিন্দকে যেতে দিও না!
বড়কাকা গোবিন্দর হাত চেপে ধরলেও সে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। বাঘের গুহায় স্বেচ্ছায় গোবিন্দ গলা বাড়াতে যাচ্ছে দেখে অনেকেই বিচলিত আরও কয়েকজন বাধা দিতে গেল গোবিন্দকে। এমনকি আমারও মনে হলো, গোবিন্দর পক্ষে এটা স্রেফ পাগলামিই হচ্ছে।
গোবিন্দকে কেউ ধরে রাখতে পারছে না। সে এধার ওধার ছুটতে ছুটতে বলছে, আমি একা গেলে কোনো ভয় নেই। কেউ আমারে চিনবে না। আমি রতনের খবর আনতে যাবই!
অন্যদের হাত ছাড়িয়ে গোবিন্দ এসে হাঁটু গেড়ে বসল ময়নার কাছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, ময়নাবউ, আমি যাচ্ছি রতনের কাছে। তুমি কেঁদো না। আমার মন বলছে, রতন ভালো আছে। আমি ঝাড়গ্রামের পানুবাবুকে ধরব। পানুবাবু গরিবের কথা শোনেন।
ময়না উঠে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গোবিন্দর দিকে। তারপর বাচ্ছা মেয়ের মতন আবদারের সুরে বলল, তুমি ওরে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। তোমার সাথে করে নিয়ে এসো! বলো, তারে ফিরিয়ে আনবে তুমি?
গোবিন্দ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি যাচ্ছি, পানুবাবু উকিলের পায়ে ধরব, একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
ময়না গোবিন্দর বাহু ছুঁয়ে বলল, সে তো একলা কোনো দোষ করেনি। তবে কেন সে শুধু শাস্তি পাবে! তুমি বলো—
—ময়নাবউ, একটু মনের জোর ধরে থাকো। আমি যাই, গিয়ে দেখি কী করা যায়।
এই ছোট্ট দৃশ্যটির মধ্যে এমন একটা তীব্রতা আছে যা চুপ করিয়ে দিল সবাইকে। এবার আর গোবিন্দকে বাধা দিল না কেউ।
শুধু সুশীলাদি বলল, ও গোবিন্দ, তুই ওদিকে যাচ্ছিসই যখন, ময়নাকে তোর সাথে নিয়ে যা। ওর এই অবস্থায় এখন ওকে বিনপুরে বাপের বাড়ি পৌঁছোয়ে দিলে ভালো হয় না?
গোবিন্দ বলল, ওকে নিয়ে যাব? ওকি অতখানি হাঁটতে পারবে?
–ওকে বড় সড়কে নিয়ে গিয়ে বাসে উঠিয়ে দিবি। পয়সা তো আছে।
—সেটা কি ঠিক হবে?
ময়না দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, আমি যাব না! আমার এখন আর এক পাও চলার সাধ্য নেই। পেটে ভীষণ ব্যথা।
–তবে থাক। আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাব। আমার সাথে মেয়েমানুষ থাকলে অসুবিধা আছে।
বড়কাকা বলল, গোবিন্দ, তাইলে তুই কিছু টাকা নিয়ে যা। পানুবাবু উকিলকে কিছু দিতে হবে না? পুলিশকেও তো টাকা দিতে হয়।
গোবিন্দ সকলের মুখের দিকে তাকাল। এদিকে ওদিক ছড়িয়ে দাঁড়ানো সবাই একদৃষ্টিতে দেখছে গোবিন্দকে। টাকা যেন একটা ম্যাজিকের শব্দ
গোবিন্দ খানিকটা অসহায়ের মতন বলল, কত টাকা নেবে, কী দিতে হবে, তা তো জানি না। আগে আমি খবর নিয়ে আসি।
বড়কাকা বলল, একশোটা টাকা নিয়ে যা তুই। সাথে রাখ।
গোবিন্দ একটু চিন্তা করে বলল, অত টাকা…না আমাকে কুড়ি টাকা দাও, তার বেশি এখন নেব না!
অন্য একজন বলল, ও বড়কাকা, বারোয়ারির টাকা থেকে গোবিন্দকে আর পাঁচটা টাকা দেবে? ও তাইলে কয়েক বাণ্ডিল বিড়ি আনবে। বিড়ি ছাড়া কি থাকা যায়।
এই প্রস্তাবে কেউ কোনো আপত্তি জানাল না দেখে বড়কাকা বলল, দে সুশীলা, ওকে আরও পাঁচটা টাকা দিয়ে দে। গোবিন্দ, লাল সুতার বিড়ি আনিস! পাঁচ টাকা পুরা করেই আনিস।
রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আলো ফুটেছে একটু একটু। একটা ছায়ার মতন গোবিন্দ মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। এখান থেকে ঝাড়গ্রাম কতদূর কে জানে। এরা গ্রামের মানুষ, এদের হাঁটার অভ্যেস আছে। গোবিন্দ কি আর ফিরতে পারবে? পুলিশের মার খেয়ে রতন ইতিমধ্যে কী স্বীকারোক্তি দিয়েছে তার ঠিক নেই। আংড়া গ্রামের মানুষ হিসেবে চিনতে পারলেই গোবিন্দকে পুলিশ ক্যাক করে চেপে ধরবে না?
রতন জানে না, তার গ্রামের মানুষ এখন কোথায় লুকিয়ে আছে। কিন্তু গোবিন্দ তো জানে। যদি সেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, পুলিশের পিটুনি ও জেরার মুখে সে কি এই জঙ্গলের আস্তানার কথা গোপন রাখতে পারবে?
আমার এই উদ্বেগ প্রতিধ্বনিত হলো বড়কাকার কণ্ঠে। সে বলল, গোবিন্দ যে গেল, যাওয়াটা ঠিক হলো কি? পানুবাবু উকিল যদি গোবিন্দকেই পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়? তাইলে তো পুলিশ এখানেও আসবে!
ভবেন বলল, না–না, সে ভয় নেই। আমি ঝাড়গ্রামে চাকরি করেছি, পানুবাবু উকিলকে চিনি। উনি দেবতার মতন মানুষ। কত গরিবকে সাহায্য করেন। গোবিন্দ ওকে ধরলে কাজ হবে।
—তিনি কি রতনকে খালাস করে দিতে পারবেন?
—জামিনে খালাস করতে পারেন। পানুবাবুর মুখের কথায় অনেক কাজ হয়। জজ–ম্যাজিস্ট্রেটরা পর্যন্ত ওনার কথা মানে।
আমি চিৎ হয়ে শুয়ে ভোরের আলো দেখতে লাগলুম। জঙ্গলে সূর্যোদয় আগে দেখেছি বেশ কয়েকবার। হাতির পিঠে চেপে মানসের জঙ্গলে, জিপে করে সিমলিপালে, পায়ে হেঁটেও ভোরবেলা ঘুরেছি সাঁওতাল পরগণায়, কিন্তু বনের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের আলো–ফেরার দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আগে হয়নি। পেটের মধ্যে ধিকিধিকি খিদের আগুন না থাকলে এই দৃশ্যটা ভালো ভাবে উপভোগ করা যেত। খিদের চোটে শরীরটা অবসন্ন হয়ে গেছে, মুখে একটা তেতো তেতো স্বাদ।
রাত্তিরবেলার কালো কালো গাছগুলো আস্তে আস্তে সবুজ হলো। কতরকমের সবুজ। রাত্তিরবেলা যতটা ঘন অরণ্য মনে হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ততটা ঘন নয় এই জঙ্গল। মাঝে মাঝেই ফাঁকা ফাঁকা জায়গা, বেশ কিছু গাছও কাটা হয়েছে। এই জঙ্গলে কি এরা একদিনও আত্মগোপন করে থাকতে পারবে? কোনো জঙ্গলই ফাঁকা পড়ে থাকে না, দিনের বেলা কেউ না কেউ এখানে আসবেই। দেশ জুড়ে চোরাই কাঠের ঢালাও ব্যাবসা চলছে, তারা কি এই জঙ্গলটা ছেড়ে দেবে? গাছ কাটার চিহ্ন তো রয়েছেই!
পাখিদের মধ্যে প্রথম ঘুম ভাঙে বুঝি শালিকের? শালিকের ডাকই আগে শোনা গেল। বেশ দূরে আর একটা ডাক শুনে চমকে উঠলুম। মুরগির মতন না? এই জঙ্গলে বনমুরগি থাকা সম্ভব? কিংবা কাছেপিঠে মানুষের বসতি আছে? সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যেও মানুষের গ্রাম থাকে, টাইগার প্রজেক্টে বাঘ ও মানুষের সহাবস্থান, আর এ তো একটা এলেবেলে জঙ্গল!
এই জঙ্গল যদি কারুর ইজারা নেওয়া থাকে, তাহলে তারা তো এসেই এদের তাড়াবে। তখন এই লোকগুলো যাবে কোথায়? অন্তত গোবিন্দ ফেরার আগে এদের তো কোথাও যাওয়া চলে না!
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় আমরা দারুণ আফসোস হতে লাগল। গোবিন্দ চলে গেছে আধঘণ্টা আগে। তখন কেন এই কথাটা মনে পড়েনি! গোবিন্দর সঙ্গে আমারও যাওয়া উচিত ছিল। থানা থেকে ময়নার স্বামীর খবর জোগাড় করা গোবিন্দর চেয়ে আমার পক্ষেও অনেক সুবিধেজনক। হাজার হোক আমি তো একটা ভদ্দরলোকের ছেলে, শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি, পুলিসে হুট করে আমাকে অ্যারেস্টও করতে পারবে না, থানার দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেও পারবে না।
গোবিন্দ অনেক দূর চলে গেছে, এখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। গোবিন্দর সঙ্গে অতখানি রাস্তা কি আমি হাঁটতে পারতুম? গোবিন্দ কাল দু’বেলা ভাত খেয়েছে, আমি তো কিছুই খাইনি।
অবশ্য, গোবিন্দ আমাকে ঘৃণা করে। আমি ওর সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে ও কি রাজি হতো? বরং ভাবতে পারত যে শহরে পৌঁছে আমি নিজ মূর্তি ধারণ করব, ডাকাতির আর একটি আসামী হিসেবে ওকে ধরিয়ে দেব পুলিশের হাতে। সেরকম ভাবাটা কিছু ভুল নয়, গোবিন্দ আমাকে অনেক অপমান করেছে, সুযোগ পেয়ে তার ওপর প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে জাগা আমার পক্ষে অস্বাভাবিক নয় কিছু!
গোবিন্দ আমাকে কিছুতেই সঙ্গে নিত না, এই ভেবে আমি সান্ত্বনা দিলাম আমার বিবেককে।
এবার ঘুমে চোখ টেনে আসছে। এখন খানিকটা ঘুমোনোই দরকার। এক ঝাঁক টিয়া টি টি টি করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ডি এল রায়ের গান মনে পড়ে গেল। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি…। এই গানের মধ্যে কোথায় এক জায়গায় আছে না, তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে…? এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…আংড়া গ্রামটাও কি সেই ‘এমন দেশটি’র মধ্যে পড়ে?
সবে মাত্র চোখ বুজে এসেছে, এই সময় সুশীলাদি এসে বসল আমার পাশে। রীতিমত কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, তুমি বাড়ি চলে যাবে না? তোমার বাড়ির লোক চিন্তা করবে না?
আমি মহা আলস্যে শরীর মুচড়ে বসলুম, হ্যাঁ, যাব। খানিকটা পরে যাব!
–কে কে আছে তোমার বাড়িতে? মা বাবা আছে?
–মা আছেন, বাবা মারা গেছেন।
—আহা, তোমার খবর না পেয়ে মা নিশ্চয়ই চিন্তা করবে? আর কে আছে তোমার?
– ভাই বোন আছে। আমি তো কলকাতা থেকে বাঁচি যাচ্ছিলাম, বাড়ির লোক জানে আমি এখন রাঁচিতেই আছি।
–তোমার সেই কাগজটা গোবিন্দ ফেলে দিয়েছে। সেটার জন্য বুঝি খুব ক্ষতি হলো?
—হ্যাঁ, মানে, সেই কাগজটা পৌঁছোতেই আমি যাচ্ছিলাম, একটু অসুবিধে হবে।
—একটা কাগজ তো শুধু। আবার পাওয়া যাবে না? মানুষের বুঝি কোনো জিনিস হারিয়ে যেতে পারে না? তুমি ওদের বলবে যে সেই কাগজের বাক্সখানা তুমি বাসে ফেলে এসেছ।
এবার আমার একটু হাসি পেল, রাঁচি গিয়ে আমি কী কৈফিয়ৎ দেব, সেটাও সুশীলাদি আমাকে শিখিয়ে দিতে চায়।
কাল সন্ধে পর্যন্ত আমি ছিলুম ওদের শত্রু, নগর–সভ্যতার প্রতিভূ, এখন আমি একজন সাধারণ মানুষ হয়েছি, তাই সুশীলাদির কথায় মানবিক সম্পর্কের সুর ফুটে উঠছে। সে অনায়াসে আমার কোনো মাসি কিংবা পিসি হতে পারে। তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, আমার জন্য।
সুশীলাদি আবার বলল, আমাদের যা হবার তা তো হবেই, কপালের লেখা তো কেউ আর খণ্ডাতে পারবে না। তুমি বাপু এবার ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যাও। তোমাকে যে ওরা মারে ধরেনি…তাতে পাপের বোঝা আরও বাড়ত। ঐ গোবিন্দটা বড় গোঁয়ার।
—শোনো সুশীলাদি, আমি চলে যাবার পর কোনো এক সময় গোবিন্দকে ঠাণ্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি তার কোনো ক্ষতি করিনি। সে আমার মামার বাড়িতে কাজ করত, আমার মামারাও ওকে ছাড়িয়ে দেননি। ওর চাকরি গিয়েছিল অন্য কারণে। আচ্ছা সুশীলাদি, গোবিন্দর বউ নেই?
—গোবিন্দ তো বিয়ে করেনি। আমার এক ভাইঝির সঙ্গেই তো সম্বন্ধ করেছিলুম, তা ও রাজি হলো না কিছুতেই।…ছেলেটা গেল, এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে হয়। কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। একবার পুলিশের নজর যখন পড়েছে এই গাঁয়ের মানুষের ওপর…গত জন্মে কত পাপ করেছিলুম, তাই এই শাস্তি। তুমি বাছা, আমাদের মাপ করে দিও। তোমার কত টাকা ছিল? যদি ফেরৎ দিয়ে দিই।
– না, না, না, আমার টাকা লাগবে না! আমার বিশেষ কিছুই ছিল না!
সুশীলাদি এক দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বলল, গ্রামে একটা অতিথ এলে মানুষ ঘটি বাটি বাঁধা দিয়েও সেবা করে, তোমাকে আমরা দু’মুঠো খেতেও দিইনি….
পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য বললুম, তোমাদের গ্রামে আমি আবার বেড়াতে আসব, তখন তোমার হাতের রান্না খাইয়ো।
—হা আমার পোড়া কপাল! আর কোনোদিন কি সে গ্রামে ফেরা হবে? এতক্ষণে পুলিশ সেখানে কী করেছে কে জানে! তুমি তোমার টাকাটা ফেরৎ নাও, তোমার গাড়ি ভাড়া লাগবে, আমি সবাইকে পরে বুঝিয়ে বলব।
—আমার টাকাপয়সা কিছু ছিল না। বিশ্বাস করো। আমি চাকরি বাকরি কিছু করি না, আমার পকেটে টাকা থাকবে কী করে? গাড়ি ভাড়াও আমার লাগবে না, আমি বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে চলে যাব। সে রকম ভাবে অনেকবার গেছি।
—তুমি কিছু অন্তত রাখ।
–আমার দরকার নেই, সত্যি বলছি।
সুশীলাদি তবু তার কোমরের কষি আলগ্না করে একটা গেঁজে বার করতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা ঢ্যাঙা ছেলে এসে উঁকি মারল। এর নাম হারু, তেঁতুল গাছতলায় এ আমার পেটে লাথি মেরেছিল।
এখন ছেলেটার চোখে রাগ নেই, বরং সারা মুখে ভয় মাখানো। সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে পিসি?
সুশীলাদি তাড়াতাড়ি গেঁজেটা আবার লুকিয়ে ফেলেছে। বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, কিছু হয়নি। হ্যারে হারু, কাছেপিঠে জল আছে কি না খুঁজে দেখেছিস?
—হ্যাঁ দেখেছি। ঐ তো ঐ দিকে নদী আছে। ও পিসি, ময়নাবউ যে আবার কেমন কেমন করছে। গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। একবার দেখবে এসো—
অসহায় মুখ করে সুশীলাদি বলল, ওর পেটেরটা তো গেছেই, এখন নিজে বাঁচলে হয়। কী যে করি, কী যে করি!
সুশীলাদি ছুটে চলে গেল ময়নার কাছে।
আমার সামান্যতম ডাক্তারি জ্ঞান নেই। ময়নাকে আমি কোনো সাহায্যই, করতে পারব না! সে আর আমি কাল অনেকখানি সময় একঘরে কাটিয়েছি, সরাসরি কোনো কথাবার্তা না হলেও যেন অনেকটা চেনাশুনো হয়ে গেছে। সত্যি সে মরে যাচ্ছে নাকি? গোবিন্দ ফেরা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে পারবে না?
ময়নার মৃত্যুদৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
হারু একটা ভালো খবর দিয়েছে। নদী! যদি সুবর্ণরেখা হয় তাহলে তাতে এই গ্রীষ্মেও কিছু–না–কিছু জল থাকবেই। সুবর্ণরেখাকে আমি শীত–গ্রীষ্ম বর্ষায় অনেকভাবে দেখেছি। এই হাতিবাড়ি ডাকবাংলোতেই বন্ধুদের সঙ্গে এসে কত আহ্লাদ করে গেছি একবার। নদীতে মাছ ধরছিল জেলেরা, এক বন্ধু তাদের কাছ থেকে চিতল মাছ জোগাড় করে আনল। রান্না করে দিল বাংলোর চৌকিদার…সে বোধহয় আমায় দেখলে এখনো চিনতে পারবে, অবশ্য এই পোশাকে নয়…
হারু যেদিকে হাত দেখালো হাঁটতে লাগলুম সেই নিরিখে। পায়ের তলা এমন ছড়ে গেছে যে মাটিতে পা ফেলতে পারছি না। কাল রাত্তিরে অতটা রাস্তা খালি পায়ে দৌড়েছি, বেশি কিছু যে হয়নি, পাথরে পা কেটে যায়নি, বা মুচড়ে যায়নি সেটাই মহাভাগ্য বলতে হবে!
মিনিট দশেক হাঁটতেই নদী চোখে পড়ল। হ্যাঁ, সুবর্ণরেখা, উজ্জ্বল রঙের বালি। এখানে সুবর্ণরেখা একটা বাঁক নিয়েছে। এবারের সাংঘাতিক খরায় নদী অনেকটা শুকিয়ে গেলেও মাঝখানে রয়েছে জলের ধারা।
বুক থেকে যেন একটা আগুনের হল্কা বেরিয়ে এলো। ভেতরটা জ্বলে গেছে। আমি কতদিন এক বিন্দু জল পান করিনি। এখন চোখের সামনে যা দেখছি, তা কি সত্যিই জল, না মরীচিকা?
ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াই বোধহয় স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আমি বালির ওপর দিয়ে এগোতে লাগলুম এক পা এক পা করে। জলের রেখা যেন আমায় চুম্বকের মতন টানছে। বাতাস বইছে স্রোতের মতন। সূর্য এখনো জবাকুসুম বর্ণ। তকতকে ঝকঝকে আকাশ। ভোরবেলার পৃথিবী প্রত্যেকদিনই সুন্দর।
প্যান্ট খোলার কথা মনে এলো না। নেমে গেলাম হাঁটু জলে। আঃ কী ঠাণ্ডা জল! প্রথমে মুখে চোখে ছিটিয়ে দিলাম খানিকটা। তারপর আঁজলা করে তুলে ছোঁয়ালাম ঠোটে। এমন পবিত্র জল জীবনে কখনো পান করিনি।
জলটা যে গলা দিয়ে নামছে, তা টের পাচ্ছি। সত্যিই বুঝি তৃষ্ণার দাহে ভেতরের নল–টল খানিকটা ঝলসে গেছে।
দু’তিন আঁজলা পান করতেই আমার পেটটা মুচড়ে উঠল। খালিপেটে জল খেলে এরকমই তো হবার কথা। জল দিয়েই যদি পেটটা ভর্তি করে ফেলা যায়, তাহলে তো আর খালি পেটের প্রশ্ন থাকবে না। মোচড়ানি সত্ত্বেও এবার আমি নীচু হয়ে সুবর্ণরেখা নদীকে চুম্বন করলুম। যেন সত্যি সত্যি আমি কোনো নারীর অধর–সুধা পান করছি। এখন আমি অগস্ত্যের মতন একটা গোটা সমুদ্রও খেয়ে ফেলতে পারি।
চুম্বনের পর শরীর চায় মিলন। আমি শুয়ে পড়লুম নদীর সঙ্গে।
অল্প জল হলেও স্রোত আছে, এই জল জীবন্ত, সে খেলা করছে আমায় নিয়ে। একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছি। আরামে বুজে আসছে চোখ। গোটা অন্তরীক্ষ প্রত্যক্ষ করছে আমাদের মিলনদৃশ্য।
জীবন কত না নতুন অভিজ্ঞতার চমক এনে দেয়। এরকমভাবে কোনোদিন নদীর জল পান করিনি। এমন ভাবে নদীতে কখনো শুইনি। একদিন আগে যখন তখন আমার মৃত্যু ঘটে যেতে পারত, এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা কী চমৎকার! বেশ কিছুক্ষণ নদীতে কাটাবার পর ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। এ যেন রতি পরিশ্রমের পরের অবসাদ। জল ছেড়ে উঠে মাতালের মতন টলতে টলতে হেঁটে গেলুম কয়েক পা। আর যেতে ইচ্ছে করল না। শুয়ে পড়লুম বালির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।
ঘুম ভাঙল বাচ্চাদের গলার আওয়াজে। চোখ মেলে দেখি আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চার–পাঁচটা ছেলেমেয়ে। প্রথম কয়েক মুহূর্ত আমার মনে পড়ল না কোথায় শুয়ে আছি। চোখে লাগল চড়া রোদ। তারপরেই আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে শরীরটা সতর্ক হয়ে গেল।
এই সেই আংড়া গ্রামের ছেলেমেয়েরা। গতকাল সকালে এরা আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। আজ ঘুমের মধ্যে এরা কি মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল আমাকে? বাচ্ছাদের পক্ষে কিছুই বিচিত্র নয়।
ধড়মড় করে উঠে বসতেই একজন বলল, এই, তোমাকে ডাকছে! আমি রুক্ষ গলায় বললুম, কে ডাকছে? কাকে ডাকছে?
—সুশীলাপিসি তোমাকে ডাকছে।
–কেন ডাকছে।
—সুশীলাপিসি বলল, নদীর ধারে যে লোকটা শুয়ে আছে, তাকে ডেকে নিয়ায়। আমার মনে পড়ল ময়নার কথা। সে কি বেঁচে আছে এখনও? ময়নার জন্যই সুশীলাদি ডেকে পাঠিয়েছে আমাকে? কিন্তু এই ব্যাপারে সাহায্য করার কোনো ক্ষমতাই তো নেই আমার। গা থেকে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বললুম, আমি যাচ্ছি একটু পরে, তোমরা যাও।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? বালি তেতে গেছে এর মধ্যেই। ঘুমের মধ্যে আমার শরীরটা পাথর হয়ে গিয়েছিল, গরম বালির মধ্যে আরও কত পাথর তো চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। আমার ভিজে প্যান্টটা শুকিয়ে গেছে এরই মধ্যে।
আকাশে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনে হলো বেলা দশটা–সাড়ে দশটা হবে। নদীর ওপার দিয়ে লোক যাচ্ছে কয়েকজন। ঐ দিকে একটা রাস্তা আছে মনে হয়। জঙ্গলটা এ পারেই শেষ, ওপারে চাষের জমি।
আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলুম জঙ্গলের দিকে। দিক ভুল হবার প্রশ্ন নেই, শোনা যাচ্ছে মানুষের কলকণ্ঠ। এই জঙ্গলে আশি–নব্বইজন নারী–পুরুষ কী করে লুকিয়ে থাকবে? অসম্ভব ব্যাপার। ওপারের লোকেরা এর মধ্যেই জেনে যায়নি?
আংড়া গ্রামের মানুষগুলোর শেষ পর্যন্ত কী দশা হবে, তা না জেনে আমার পক্ষেও এখান থেকে চলে যাওয়া যেন অসম্ভব। আমি এদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।
গোবিন্দ ফিরে আসা পর্যন্তও ময়না বেঁচে থাকতে পারল না? অবশ্য গোবিন্দ কীই–বা সুখবর আনবে? ডাকাতির আসামী হিসেবে ধরা পড়েছে রতন, সোনার গয়নাগুলোও যদি তার সঙ্গে থেকে থাকে, তাহলে তো একেবারে বামাল সমেত গ্রেফতার। ক্রিমিনাল কেস। কোনো দয়ালু উকিলও তাকে চট করে জামিনে খালাস করতে পারবে না।
আর গোবিন্দও যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে এরা তো একেবারে দিশেহারা হয়ে যাবে। মোড়ল হলেও ঐ বড়কাকার তেমন বুদ্ধির জোর নেই। অন্য সবাই নেহাৎই সাদামাটা মানুষ। জমিতে খাটতে পারে, কিন্তু তার বাইরে বেশিদূর তাকাতে শেখেনি। একমাত্র সুশীলাদি কি একা সামলাতে পারবে সবাইকে!
পা চলতে চাইছে না, ময়নার মৃত মুখ দেখতে একটুও ইচ্ছে করছে না আমার!
জঙ্গলের ভেতরে এসে অবাক হয়ে গেলুম। এ কী ব্যাপার চলছে? মাটি খুঁড়ে, পাথর–টাথর জোগাড় করে এর মধ্যেই দুটো উনুন বানিয়ে ফেলেছে এরা। তাতে মাটির হাঁড়ি চাপানো, ধোঁয়া বেরুচ্ছে কাঁচা কাঠের। গ্রাম ছেড়ে পালাবার সময়েও এরা তা হলে একেবারে খালি হাতে আসেনি। হাঁড়ি–কুড়ি, চাল–ডাল– নুন সঙ্গে এনেছে।
এরই মধ্যে রান্না হয়ে গেছে, শুধু তাই নয়, এঁটো পাতা ছড়ানো দেখে বোঝা যায় খাওয়াও হয়ে গেছে এক ব্যাচের!
আর তো কিছুই করার নেই, খাওয়া ছাড়া! কখন কী বিপদ ঘটে, কখন পুলিশ এসে পড়ে, তার আগে খেয়ে নেওয়াই ভালো, এই এরা ভেবেছে? ভাবাটা কিছু ভুলও নয়। এই জঙ্গল থেকে যে–কোনো সময় অন্য লোক এসে ওদের তাড়িয়ে দিতে পারে। বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জঙ্গল, যেখানে সব মানুষেরই সমান অধিকার, সেরকম আর কোথায় আছে পৃথিবীতে? কেউ তাড়িয়ে দেবার আগে অন্তত ভাতটা খেয়ে নিলেও কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যাবে।
গোবিন্দ বলেছিল, অন্তত একটা দুটো দিন ভালো থাকাই বা কম কথা কী? সে ঠিকই বলেছে!
আমি একজনকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ময়না কেমন আছে? সে বলল, ময়না এখন ভালো আছে, ঘুমিয়েছে। তোমাকে সুশীলাদি ডাকছে।
–কোথায় সুশীলাদি!
সে হাঁক পাড়ল, ও সুশীলাদি, ও সুশীলাদি, বাবুটি এয়েছে গো!
দূর থেকে সুশীলাদি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। তার হাসি মুখ দেখেই বোঝা গেল, ময়নার এখন তেমন বিপদ নেই। একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক থেকে।
অন্য কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে সুশীলাদি বলল, এই তোরা বসে পড়, তোরা বসে পড়। এক হাঁড়ি ফুটে গেছে!
যেন জঙ্গলের মধ্যে একটা পিকনিক!
সুশীলাদি আমার হাত ধরে নরম গলায় বলল, এসো গো, আজ তুমি আমাদের সঙ্গে চাট্টি খাবে। আজ আর না বলো না। রাগ করে থেকো না।
পাশ থেকে এক বৃদ্ধ বলল, দুইদিন প্যাটে কিছু পড়েনি, ক্ষমা করে দাও বাবু আমাদের, আজ দুটি খাও!
এরকম নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মতন কঠিন হৃদয় নয় আমার। হৃদয়ের চেয়ে উদর আগেই রাজি হয়ে বসে আছে!
সুশীলাদি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল একটা গাছতলায়। গাছ থেকে কাঁচা শালপাতা ছিঁড়ে তাই দিয়েই থালা বানিয়েছে। এক লাইনে দশ বারোটা থালা সাজানো, আমার থালাটা একটু দূরে। আমি আমার থালাটা টেনে নিয়ে এলাম ওদের পাশে। আমার পরেই বসেছে হারু, এখন তার মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব।
আজও খিচুড়ি। উনুন থেকে হাঁড়ি নামিয়ে এনে তপ্ত খিচুড়ি পাতায় পাতায় পরিবেশন করে গেল সুশীলাদি। এই রমণীটির কী অসীম শক্তি। সারা রাত ঘুমোয় নি, একাই সে সব দিক সামলাচ্ছে। এই সে ময়নার সেবা করছে, এই সে রান্না করছে, এই সে থামাচ্ছে অন্যদের ঝগড়া।
হঠাৎ আমার গলাটা আটকে গেল। এক এক সময় চোখের জল চোখ পর্যন্ত আসে না, বাষ্প হয়ে গলার মধ্যে জমে থাকে। আমার বুকের মধ্যেও উথাল পাথাল চলছে।
কত কষ্টের অন্ন! এই অন্নের মধ্যে অশ্রু, রক্ত, উদ্বেগ মিশে আছে!
আট–দশ হাজার বছরের সভ্যতার পরেও মানুষ নিছক ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে অতিরিক্ত খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়, কোনো কোনো দেশে মানুষ না খেয়ে থাকে। একই দেশের মধ্যে খাদ্য–তৃপ্ত মানুষ মনেও রাখে না ক্ষুধার্ত মানুষদের কথা!
মহাশূন্য ফুঁড়ে উঠে যাচ্ছে মানুষের তৈরি রকেট, সমুদ্রের তলা দিয়ে যাচ্ছে পরমাণু চালিত সাবমেরিন, নগরে নগরে আকাশচুম্বী প্রাসাদ, মানুষের কত সরঞ্জাম, মানুষের কত প্রতিভা! তবু মানুষ পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সামান্য দু’বেলা শুধু আহারের সংস্থান করে দিতে পারল না এখনও।
আমি এদের এই এত কষ্টের অন্নে ভাগ বসাচ্ছি!
একজন কেউ আমাকে বলল, কী গো বাবু, খাও। হাত গুটিয়ে বসে রইলে যে!
আর একজন বলল, বড্ড গরম, একটু ঠাণ্ডা হতে দে।
আমি হাতে করে তুলে নিলাম একটুখানি, অনেকেই ব্যাগ্র ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার লজ্জা লাগছে এখন। মুখ নীচু করে খেতে শুরু করে দিলাম।
আজকের খিচুড়িটা ঠিক খিচুড়ি হয়নি। চাল আর মুসুরির ডাল আলাদা আলাদা হয়ে ছেতরে আছে। নদীর জলে ডাল ভালো সেদ্ধ হয়নি। ডাল জিনিসটা বেশ স্পর্শকাতর, তার জল বাছাবাছির খুব বায়নাক্কা।
শুধু এই ফোটানো চাল–ডাল ছাড়া আর কোনো পদ নেই, আশাও করা যায় না। হাপুস হাপুস শব্দে পাতেরটা শেষ করে কেউ কেউ বলতে লাগল, ও সুশীলাদি, বড্ড ভালো স্বোয়াদ হয়েছে গো, আর এট্টু দেবে?
সুশীলাদির আপত্তি নেই, যতক্ষণ হাঁড়িতে রয়েছে ততক্ষণ সবাই পাবে। মাঝারি সাইজের মাটির হাঁড়ি, তাতে রান্না হচ্ছে বারবার!
আমার পাতেরটা শেষ হবার আগেই হারু খিচুড়ি চেয়ে নিল দু’– তিনবার।
সুশীলাদি আমায় এসে বলল, তুমি নাও একটু, শেষ করছ না যে, নাও!
–না, না, আমার আর লাগবে না।
—তুমি লজ্জা করে খাচ্ছ। রয়েছে গো, এই দ্যাখো, আরও চেপেছে, কারুর কম পড়বে না।
–সত্যি আমার আর লাগবে না।
আমি দু’হাত চাপা দিলেও সুশীলাদি জোর করে দিয়ে দিল আর এক হাতা। নষ্ট করতে আমার গায়ে লাগবে। শহরের লোকরা যে ভাত–টাত কম খায়, তা এরা বুঝতে চায় না। মাছ মাংসের প্রোটিন খেলে বেশি ভাত খাবার যে দরকার হয় না। সাহেবরা বড় বড় মাংসের টুকরোর সঙ্গে দু’চামচে ভাত কিংবা এক টুকরো আলু নেয়।
হারু আমার চেয়ে বয়েসে ছোট হয়েও আমার থেকে কত বেশি খাচ্ছে, এতে কয়েকজন বিস্ময় প্রকাশ করছে। হারুর সমান খেতে গেলে আমার পেট ফেটে যাবে।
তাছাড়া দু’দিন উপোসের পর হঠাৎ যে বেশি খেতে নেই, সে খেয়ালও আমার আছে।
হঠাৎ খানিকটা দূরে একটা হৈ চৈ, চ্যাঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। আমরা চমকে উঠলাম সবাই। কিছু বিপদ ঘটেছে? মারামারি বাধিয়েছে কেউ, কিংবা কারুকে সাপে কামড়াল?
সুশীলাদি ছুটে গেল সেদিকে। খাওয়া শেষ হয়নি বলে আমি উঠতে পারছি না। বসে রইল আরও কয়েকজন আর একটু খিচুড়ি পাবার আশায়।
একটু পরেই সেখান থেকে ভেসে এলো আনন্দের হুল্লোড়, উলু দিয়ে উঠল কয়েকটি স্ত্রীলোক। হারু লাফাতে লাফাতে এসে খবর দিল, ময়না বউয়ের বাচ্চা হয়েছে গো, ছেলে হয়েছে!
একজন বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল, বলিস কি রে, বেঁচে আছে?
—হ্যাঁ গো, বেঁচে আছে?
–আর ময়না?
—সেও বেঁচে আছে। দেখবে এসো, ছেলে দেখবে এসো!
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম। আঁতুরের জায়গায় বাইরের পুরুষদের যেতে নেই!
কী জেদি মানুষের প্রাণ! ময়নার আট মাসের গর্ভের সন্তান, সবাই ধরে নিয়েছিল কাল ময়নার অত ধকলের পর সে আর বাঁচবে না। ময়নাও বাঁচবে কি না সন্দেহ। কিন্তু সেই শিশু মাতৃগর্ভ ছেড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে বাইরের বাতাসে নিশ্বাস নিতে।
গারদে–বন্দী রতন কবে বেরুতে পারবে তার ঠিক নেই। সে কিছুই জানে না। পুলিশের অত্যাচারে গারদের মধ্যেই তার মৃত্যু হওয়া অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কিছু নয়। তবু জীবন থেমে থাকে না, রতনের উত্তরাধিকারী এসে গেছে আবার লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য।
হাসপাতালে, নার্সিংহোমে কত সাবধানতার সঙ্গে, কত যত্নে জননীর শরীর থেকে বার করে আনা হয় শিশুদের। আর এখানে এই গাছতলায় ধুলো–ময়লার মধ্যে দিব্যি একটি মানবপুত্র এসে গেল। এরই মধ্যে তার ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত বিপদের মধ্যেও আনন্দ করছে ওরা সবাই। একটি শিশুর জন্মক্ষণে কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে না।
আংড়া গ্রামের ক্ষুধার্ত মানুষদের মধ্যে এসে গেল আর একটি অন্নের দাবিদার!