৬
সন্ধে হয়ে এসেছে, আকাশ যেন দ্রুত শুষে নিচ্ছে পৃথিবীর আলো। সন্ধেবেলার এই রঙটা দেখতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। কিন্তু আজ আমি রাত্রির আগমনটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, অন্ধকার হয়ে গেলেই একটা ভয়ংকর কিছু ঘটবে। দিনের আলোয় কোনো ভয়ংকর সম্ভাবনাকেই ততটা ভয়াবহ মনে হয় না।
আজকের রাতটা কাটবে তো?
বাইরের গাছতলাটা এখন ফাঁকা। হঠাৎ সবাই অন্য কোথায় চলে গেল? ময়না সেই একই জায়গায় হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। এতক্ষণ বাইরের লোকজনের কথাবার্তা শুনে কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিল সময়, এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাচ্ছারাও কাছাকাছি নেই মনে হচ্ছে।
একসময় একটা গান শোনা গেল। মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে কোনো বৃদ্ধের গলা। বোধহয় সুশীলাদির শ্বশুর। বুড়ো মানুষদের গান একটু দূর থেকে শুনলে কান্নার মতন মনে হয়। কিন্তু এটা গানই, দুটি লাইন মোটামুটি বোঝা গেল:
গোঁসাই আইলেন শ্বশুরবাড়ি মাছ ধরিতে যাবে কে
শ্বশুর গেছে গঞ্জের হাটে দৈ আনিতে যাবে কে….
গানটা ঠিক ধর্মের গান, না কৌতুক–গীতি তা ঠিক বোঝা গেল না। কোনো কোনো পল্লীগীতিতে গোঁসাই মানে শেয়াল। বুড়োর গলা খুব বেসুরো নয়। অনেকদিন পরে পেটে ভাত পড়েছে বলেই বোধহয় গলা দিয়ে গান বেরিয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষও কি গান গায়?
সন্ধে হলো, এই গ্রামের কোথাও তো শাঁখ বাজল না। এই গ্রামের মেয়েরা উলু দেয় না? এ বাড়িটায় কোনো ঠাকুর দেবতার মূর্তি কিংবা ছবি দেখিনি। গ্রামটারও যতটুকু দেখেছি তার মধ্যে কোনো মন্দির চোখে পড়েনি। এ গ্রামটার এমনই দৈন্যদশা যে একটা মন্দিরও বানাতে পারেনি এরা? ডোবাটার ধারে তেঁতুল গাছতলায় সিঁদুর মাখানো পাথর পড়ে ছিল কয়েকটা।
আরও একটা ব্যাপার মনে পড়ল। কলকাতার খবরের কাগজ পড়লে মনে হয়, রাজনীতি এখন প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। গ্রামে মারামারি–খুনোখুনি হলেই সেটা সি পি এম–কংগ্রেসের লড়াই। কিন্তু এখানে এদের সারাদিন কথাবার্তার মধ্যে একটাও তো রাজনীতির কথা শুনতে পাইনি, কারুকেই রাজনৈতিক কর্মী বলে মনে হলো না। অবশ্য এদের গালাগালির যে–রকম স্টক, তাতে যে–কোনো দলের হয়েই এরা তো গলাবাজি করতে পারত।
তাহলে এমন লক্ষ্মীছাড়া গ্রামও আছে, যেখানে এখনও রাজনীতি পৌঁছোয়নি, সরকারি প্রশাসনযন্ত্র কিছুই পৌঁছোয়নি, এমনকি ঠাকুর–দেবতারা পর্যন্ত আস্তানা গাড়তে আসেনি। এ গ্রামের লোকরা না খেয়ে থাকবে না তো কারা থাকবে? এ গ্রামে ছিটেফোঁটাও মধু নেই, তাই এদের কেউ গ্রাহ্য করে না।
কে যেন বলল, শবরদের গ্রামের অবস্থা এদের চেয়েও খারাপ? এর থেকেও খারাপ অবস্থা আর কী হতে পারে?
সারাদিন অসহ্য গরম, এখন গরম যেন আরও বেড়েছে। গ্রামের দিকে সন্ধে বেলা গরম বেশি লাগে। কাল রাতে আমি মশা টের পাইনি, আজ কানের কাছে পিনপিন করছে দু’একটা মশা। জুন মাস শুরু হয়ে গেছে, তবু বৃষ্টির দেখা নেই। এ বছর মেঘেরা কি পথ ভুলে গেল?
ঘামে আমার সমস্ত শরীর চটচট করছে। এদের গ্রামের ডোবাটায় এখনও কিছুটা জল আছে, এখন যদি ওরা একবার আমাকে স্নান করতে দিত!
ময়না এবার মুখ তুলে, হাত বাড়িয়ে নিল মগটা। ঢক ঢক করে খেতে লাগল জল। ঐ জলের মগটা আমার জন্য রাখা ছিল। আহা, বেচারার খুবই তেষ্টা পেয়েছিল। সেই যে ছেলেবেলা কার যেন গল্প পড়েছিলাম, ‘দাই নেসেসিটি ইজ গ্রেটার দ্যান মাইন!’ একটা বেশ আত্মত্যাগের আত্মপ্রসাদ ভোগ করা গেল।
সবটা জল খেয়ে ফেলল নাকি? ওকে জল খেতে দেখছি আর আমার গলাটা আরও বেশি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে চাই কতক্ষণ পারা যায়। কষ্ট সহ্য করার মধ্যেও একটা অহমিকা থাকে।
ময়না মগটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল, তারপর দরজার গায়ে চাপড় মারতে মারতে বলতে লাগল, খুলে দাও, এই খুলে দাও!
দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেছে নাকি? কখন দিল, আমি খেয়ালও করিনি। ওদের একটা আক্কেল নেই? এই মুহূর্তে রতন ফিরে এলে রাগের চোটে আমায় নিয়ে যে কী করবে তা ভাবতেই পারছি না। অথচ সম্পূৰ্ণ বিনা দোষে…ময়নার গায়ে হাত ছোঁওয়ানো তো দূরের কথা, আমি ওর দিকে ভালো করে তাকাইনি পর্যন্ত।
বিনা দোষে…আমি এ পর্যন্ত যত রকম শাস্তি পাচ্ছি, সবই তো বিনা দোষে! শুধু একটিই ভুল হয়েছিল, গোবিন্দর নামটা উচ্চারণ করা। নইলে এই সময়ে আমি রাঁচিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অবশ্য তপনের বড়মামার উইলটা না নিয়ে রাঁচি পৌঁছেও কি কিছু লাভ হতো?
ময়না দরজায় ধাক্কা দিয়েই চলেছে। কেউ শুনতে পাচ্ছে না নাকি? কাছাকাছি কেউ নেই, সেই বৃদ্ধেরও গান বন্ধ হয়ে গেছে।
ময়না এবার আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে করুণভাবে বলল, দরজাটা খুলে দিতে বলো না!
হায়রে আমার পোড়া কপাল! এ যে ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষে চাওয়া! আমার অবস্থা ময়নার চেয়েও অনেক খারাপ। ময়না এ গ্রামের বউ, তার ওপর ওদের সন্দেহ হলেও ওকে কেউ মেরে ফেলার কথা বলেনি। কিন্তু আমার যে এরমধ্যে অন্তত পাঁচবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে!
ময়না আবার বলল, দরজাটা খুলে দিতে বলো না! আমার কষ্ট হচ্ছে!
আমার যে–টুকুও বা বেঁচে থাকার আশা আছে, ময়নার একটি মুখের কথায় তা শেষ হয়ে যেতে পারে। দরজা খোলার পর ময়না যদি একটিবার মিথ্যে করে বলে, এই লোকটা আমার কাপড় ধরে টেনেছে, তাহলেই আর দেখতে হবে না, এ গ্রামের সব পুরুষরা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।
কিন্তু আমার ভয়–টয়গুলো কী করে যেন কমে যাচ্ছে। আজ সকালবেলার তুলনায় আমি এখন অনেক সাহসী।
গম্ভীর ভাবে ময়নাকে বললাম, তুমি দরজার কাছ থেকে সরে এসো, আমি দেখছি!
ময়না আবার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল, আমি দরজাটার ওপর দুম দুম করে কিল মারতে লাগলাম বেশ জোরে জোরে। সারাক্ষণ এই বাড়ির কাছাকাছি অনেককে জটলা করতে দেখেছি, এখন একজনও কি নেই?
ময়নার দিকে ফিরে আমি বললুম, কেউ যে খুলছে না!
ময়না বলল, আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। পেট ব্যথা করছে! খুব পেট ব্যথা করছে।
এবার আমি দড়াম দড়াম করে কয়েকটা লাথি মারলাম দরজায়। ওপরের দেয়াল থেকে খানিকটা মাটির চাপড়া খসে পড়ল। আর কয়েকবার এরকম লাথি কষালে দরজাটা যদিও বা না ভাঙে, দেয়ালটা ভেঙে পড়তে পারে।
ঝনাৎ শব্দে বাইরে থেকে শেকলটা খুলে যাবার শব্দ হলো। আমি সরে দাঁড়ালাম। দরজার ওপাশে সেই রোগা বউটি।
সে কিছু বলার আগেই আমি রুক্ষ কণ্ঠে বললুম, দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন? এই মেয়েটির যে পেট ব্যথা করছে!
ময়না ছুটে বেরিয়ে গেল, একটু পরেই শুনতে পাওয়া গেল তার ওয়াক– ওয়াক বমির শব্দ। রোগা বউটি আর একবার এ ঘরে এসে নিয়ে গেল জলের মগটা।
ময়নাকে আর ওরা এ ঘরে ফিরিয়ে আনল না। আমার সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ একটা রাত্রি। আমার জীবনে কি এই রাতটা ভোর হবে? থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, কালকের রাতটার চেয়ে আজকের রাত অনেক বেশি সঙ্কটজনক!
ঝিম মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। কোথাও আলো জ্বলেনি, তাই বাইরে কিছুই দেখা যায় না। দরজা খোলা, কাছাকাছি দু’একটি নারী ও বৃদ্ধ ছাড়া আর কেউ নেই, এখন একবার পালাবার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু উৎসাহ পাচ্ছি না। যে–কোনো অবস্থাতেই, যে–কোনো মানুষের বেঁচে থাকার একটা ইন্সটিংক্ট থাকে, আমি আমার মস্তিষ্কে সেই ইন্সটিংকটের কোনো তাড়া অনুভব করছি না। তাহলে নিশ্চয়ই এভাবে পালিয়ে বাঁচা যাবে না। এই ঘরটার মধ্যে তবু সুশীলাদির প্রশ্রয়ে বেঁচে থাকা যাচ্ছে, একবার পালাবার চেষ্টা করে ধরা পড়লে আর আমাকে ফিরিয়ে আনবে না এ ঘরে।
খানিকবাদে বাচ্ছাদের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। তারা দল বেঁধে ফিরছে। বেশ হাসিখুশিতে আছে মনে হচ্ছে। খুব কাছাকাছি আসার পর শুনতে পেলুম, বাচ্ছাগুলো খিচুড়ি নিয়ে আলোচনা করছে। কে কতবার খিচুড়ি নিয়েছে, একজন কার শালপাতা ফুটো হয়ে গিয়েছিল, সে চেটে নিয়েছে মাটি থেকে, আজকের মতন এত ভালো খিচুড়ি ওরা জীবনে খায়নি….ইত্যাদি।
এতক্ষণে বোঝা গেল রহস্যটা!
দূপুরের রান্না হয়েছিল সুশীলাদির বাড়িতে, এবেলার রান্না হয়েছে আর একটা কোনো বাড়িতে। তাই সবাই আগে থেকে সেখানে ভিড় জমিয়েছিল। খাওয়ার আগে রান্নার গন্ধ উপভোগ করা একটা উপরি পাওনা।
বাচ্ছাদের ব্যাচ আগে খাইয়ে দিয়ে এখন বসবে পুরুষরা। আমি যেন দৃশ্যটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। পুরুষরা শালপাতার থালা সামনে নিয়ে অধৈর্য হয়ে বসে আছে। ভাত আর ডাল আলাদা রান্না করার চাইতে খিচুড়িই তো ভালো, যদি তার মধ্যে কয়েকটা আলু আর গোটা পেঁয়াজ ফেলে দেওয়া যায়…গরম খিচুড়ির মতন সুস্বাদু আর কিছু হতে পারে না…
ময়নাকে ওরা একটু খিচুড়ি খেতে দেবে বোধহয়। আহা ওর বমি হয়ে গেল, এর পরেও খাওয়ার রুচি থাকবে কী? ময়নার কোনো বাচ্চা–কাচ্চা নেই নিশ্চয়ই, থাকলে সে প্রসঙ্গ উঠতই। ছেলেপুলে এখনো হয়নি বলেই তার স্বাস্থ্যটি ভালো আছে। এখনই কি সে সদ্য সন্তানসম্ভবা?
আমি দুপুরে ভাত–ডাল ফিরিয়ে দিয়েছি বলে রাত্তিরে গরম খিচুড়ি যদি দিতে আসে, তাও কি প্রত্যাখ্যান করব? ততটা মনের জোর থাকবে তখন? ধুৎ, আগেই এসব ভাবছি কেন, হয়তো আমাকে দেবেই না! গোবিন্দ, ভবেনরা টের পেয়ে গেলে কিছুতেই আমাকে দিতে দেবে না। তার চেয়ে খিচুড়ির চিন্তাটা মুছে ফেলাই ভালো।
প্যান্টটা আলগা আলগা লাগছে কোমরে। দেড়দিন না খেয়ে থাকলেই কি কেউ রোগা হয়ে যায়? অসুখ–বিসুখের সময়েও এতক্ষণ একটানা কিছু না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়নি জীবনে। তবে, এখনও আমি খেতে না– পাওয়া দলের মানুষ নই, স্বেচ্ছায় অনশনকারীদের একজন। ইচ্ছে করলে দুপুরে তো আমি উপোস ভাঙতে পারতুম!
খিচুড়ি সাধারণত বর্ষার দিনে খায়, এই গরমে…। দুর্দান্ত ভালো খিচুড়ি খেয়েছিলাম একবার হলদিয়ায় এক বন্ধুর কোয়ার্টারে। পাতলা খিচুড়ি, তার সঙ্গে একটু মাখন আর গলদা চিংড়ির মুড়ো ভাজা। গলদা চিংড়ির অনেক দাম, আমার বন্ধুটি বাজার থেকে শুধু মুড়ো কিনে এনেছিল। সাহেবরা চিংড়ি খায়, কিন্তু মুড়ো খায় না, সাহেবরা কী বোকার জাত, গলদা চিংড়ির মাথার ঘিলুর যে কী স্বাদ তা বুঝলই না! আর একবার মনে থাকার মতন খিচুড়ি খেয়েছিলুম কোনারক মন্দিরের কাছে একটা ছোট হোটেলে। ওড়িয়ারা চমৎকার খিচুড়ি রাঁধে। নড়বড়ে কাঠের টেবিলে খেতে দিয়েছিল, কিন্তু খিচুড়ি যে রেঁধেছিল সে একেবারে আর্টিস্ট! আমার মা–ও খুব ভালো খিচুড়ি রাঁধে, শীতকালের খিচুড়ি, তার মধ্যে বড় বড় ফুলকপির টুকরো, কড়াইশুটি, সেই সঙ্গে বেগুন ভাজা আর পার্শে মাছ –ভাজা…
একী, আমার খিচুড়ির কথা ভুলে থাকার কথা ছিল না? মায়ের রান্না খিচুড়ির কথা মনে পড়তেই জিভে জল এসে যাচ্ছে। সারাদিন জল খাইনি তবু এখনো জিভে জল আসে কী করে!
এক ঘণ্টা বাদে আমার ডাক পড়ল!
ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে একবার একটানা চার মাস ছিলুম। চার মামাদের একত্র সংসারে সবশুদ্ধু উনিশ কুড়িজন লোক, তার মধ্যে আট–নটি কিশোর– কিশোরী ও শিশু। বড়মামা ছিলেন পড়াশুনোর ব্যাপারে খুব কড়া। বিকেল শেষ হলেই আমাদের দোতলার একটা বড় ঘরে পড়তে বসিয়ে দিতেন। বাইরের মাস্টার আসার কোনো ব্যাপার ছিল না, একটু বড়রা তাদের ছোটদের পড়াবে। সেই অনুসারে শাস্তির অধিকারও ছিল। যেমন আমাকে পড়াতে পড়াতে গাঁট্টা মারত আমার থেকে দু’বছরের বড় মানুদি, আবার মানুদি নিজের পড়া না পারলে তাকে চাঁটি মারত ফুলদি, আর ফুলদির বেণী ধরে টানত কান্তিদা। এক সময় বড়মামা সেই ঘরে ঢুকে কান্তিদার কান মুলে দিতেন।
খাওয়ার জন্য ডাক না পড়লে আমাদের ছুটি হতো না। আমরা অধীরভাবে সেই ডাকের প্রতীক্ষায় থাকতুম। রান্না হতো একতলার রান্নাঘরে। একসময় সে ঘরের বাইরে এসে বিনোদ ঠাকুর হাঁক দিয়ে বলত, ওগো খোকা–খুকুরা, খাবার দেওয়া হয়েছে, নীচে এসো গো! অমনি আমরা ডাক পড়েছে, ডাক পড়েছে, বলে চেঁচিয়ে উঠে বই–খাতা ছড়িয়ে, দুদ্দাড় করে ছুটে যেতুম সিঁড়ি দিয়ে।
রোগা বউটি এসে বলল, তোমায় ডাকছে।
তখুনি আমার মনে হলো, খিচুড়ি খাওয়ার আসরে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। যদি ওরা আমাকে সসম্মানে পংক্তি ভোজনে ডাকে, তাতে আমার আপত্তি করার কী আছে?
রোগা বউটির পেছন পেছন বেরিয়ে এলুম ঘর থেকে। মাঝখানের ঘরটায় কেউ নেই, তারপরের ঘরটায় কয়েকটি বাচ্ছা গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝেতে, আর কিছু একটা মজায় সবাই মিলে হাসছে খিলখিল করে। শুধু দু’বেলা দুটি ভাত আর খিচুড়ি খাওয়াতেই এত আনন্দ! আর, কলকাতায় কত বাড়ির বাচ্ছাদের দেখেছি, কিছু খেতেই চায় না। খেলনা দাও রে, গল্প বলো রে, গান শোনাও রে, তবু তারা দুধের বাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ঠেলে সরিয়ে দেবে আপেল– মর্তমান কলা, মায়েরা তাদের জোর করে মুরগির ডিমের হাফ বয়েল খাওয়াতে গেলে তারা বলবে, নাঁ ডিম খাঁবো নাঁ!
বাইরে ছাই ছাই রঙের জ্যোৎস্না উঠেছে এতক্ষণে। রোগা বউটি আমাকে মিনিট পাঁচেক হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। তারপর দেখি রাস্তার মাঝখানেই একটা জটলা। কাছাকাছি যেতেই সুশীলাদি, মেজ কাকা, গোবিন্দদের কয়েকজনকে চিনতে পারলুম।
তারা উত্তেজিত ভাবে কিছু একটা আলোচনা করছিল, আমাকে দেখে একসঙ্গে চুপ করে গেল সবাই। কয়েকজন টান দিতে লাগল বিড়িতে।
বড়কাকা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, বাবু, এবারে তুমি চলে যাও। তোমারে আর ধরে রাখা হবে না। তুমি যেখানে খুশি চলে যেতে পারো।
সুশীলাদি বলল, এরা তোমারে ছেড়ে দিচ্ছে। তুমি চলে যাও—ভয় নেই, কেউ পেছন দিক থেকে গিয়ে তোমাকে মারবে না!
ঘটনার এমন আকস্মিক পরিবর্তনে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলুম। মাঝখানে হঠাৎ এমন কী ঘটল যাতে এরা আমাকে এমন বেকসুর খালাস দিয়ে দিল? নাকি এটা একটা নতুন ফাঁদ?
এদের মধ্যে একমাত্র সুশীলাদির সঙ্গেই আমার যেন একটা আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। আমি তার দিকে চোখ ফেলে বললুম, কী হয়েছে, সুশীলাদি?
সুশীলাদি কিছু উত্তর দেবার আগেই ভবেন দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ফের আবার কথা বাড়াচ্ছিস কেন রে, শালা? তোর সাতপুরুষের ভাগ্যি যে তোকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন যা ভাগ!
আমি তবু সুশীলাদির দিকে তাকিয়ে বললুম, ছেড়ে দিলেই বা আমি যাব কী করে, রাস্তা চিনি না, এই অন্ধকারের মধ্যে…
আবার ভবেন বলল, বা…লবাব পুত্তুর! রাস্তা দেখাবার জন্য সঙ্গে লোক দিতে হবে? আমরা মরছি নিজেদের জ্বালায়।
বড়কাকা বলল, তুমি বাবু এখন যাও…
সুশীলাদি বলল, কাল যে ডোবার পাশ দিয়ে এসছিলে, তার ডান ধার দিয়ে ডাঙা জমি ধরে ধরে যাবে, তারপর নদীটা পেয়ে যাবে। সেই নদী ধরে ধরে পুব মুখে সোজা যাবে, একটুখানি জঙ্গল পার হলে পাকা রাস্তা দেখতে পাবে তবে শবরদের সামনে পড়ে যেওনি যেন। ওরা খুব ক্ষেপে আছে। ওরা ভদ্দরলোকের ছেলে দেখলে সন্দো করবে।
ভবেন বলল, শবরদের হাতে পড়ে ওর যদি কিছু হয় তার জন্য আমরা দায়িক হবো না। সে ও নিজে বুঝুক। যা যা যা যা, দূর হয়ে যা!
আর বাক্যব্যয় না করে আমি পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলুম। আমার ইন্সটিংকট এখনো সাড়া দিচ্ছে না। এই কি মুক্তি, তাহলে আনন্দ হচ্ছে না কেন? পা দুটো ছুটতে চাইছে না কেন? গোবিন্দ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ সে একটাও কথা বলেনি। গোবিন্দ এত সহজে আমাকে ছেড়ে লি?
খানিকটা গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। এ অবস্থায় তো আমার যাওয়া চলে না। সঙ্গে সঙ্গে ফিরলুম আবার।
কাছাকাছি গিয়ে শুনতে পেলুম, ভবেন বলছে, হাতিবাড়ি…ওদিককার জঙ্গলে যদি যাও, ঐ জায়গাটা বাংলার বাইরে, ওখানে বাংলার পুলিশ যাবে না। ঐ জঙ্গলটা —বাংলা–বিহার–উড়িষ্যা এই তিনটে রাজ্যের কোথায় একটা খোঁচ মতন, ওদিকে কোনো পুলিশ টুলিশই যায় না কক্ষনো। শবররাও ঝাড়গ্রামের জঙ্গল ছেড়ে বেরোয় না।
গোবিন্দ বলল, হাতিবাড়ির জঙ্গল তো এখেন থেকে দশ–বারো ক্রোশ দূর! : বড়কাকা বলল, না, পাঁচ–ছ’ ক্রোশের বেশি হবে না। আর একটা কথা কী জানিস, ওদিকটায় গেলে মোটামুটি জঙ্গলে জঙ্গলে যাওয়া যাবে। ঐ নদীতে জল আছে। তেষ্টায় অন্তত মরতে হবে না।
আমি চুপ করে শুনতে লাগলুম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। হাতিবাড়ি জায়গাটা আমার চেনা। একবার ওখানকার বাংলোতে থেকেছি। সুবর্ণরেখা নদীর ধারে অপূর্ব জায়গা। ভবেন ঠিক বলেছে, ঐখানে খানিকটা জঙ্গলের মতন আছে। ঐ বাংলোয় যেতে গেলে পশ্চিমবাংলা পেরিয়ে বিহারে ঢুকে, একটু পরেই উড়িষ্যার মধ্যে পড়ে আবার পশ্চিমবাংলায় ফিরে আসতে হয়।
কিন্তু এরা গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে চলে যেতে চাইছে কেন?
ভবেন চোখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, আরে, ঐ শুয়োরের বাচ্ছাটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে কেন? এই হারু, এই সুবল, ওটাকে প্যাদাতে প্যাঁদাতে হাটিয়ে দে তো! একদম মাঠ পার করে দে!
আমি তবু এগিয়ে এসে বললুম, আমাকে কাগজটা ফেরৎ দাও। ছোট বাক্সের মধ্যে যে কাগজটা ছিল।
গোবিন্দ গম্ভীর ভাবে বলল, সে কাগজ আমার কাছে নেই!
ভবেন মুখ ভেঙচে বলে উঠল, ঠিক জানি, শালা ঐ উইল থেকে কমিশ পাবে।…ছেলে, তোর এখনও এত নোলা? তোর পেন্টুলুন খুলে নিইনি সে যথেষ্ট!
একটি ঢ্যাঙা কিশোর ও একটি খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা লোক দু’পাশ থেকে এসে আমার হাত চেপে ধরল।
আমি দৃঢ় ভাবে বললুম, ঐ কাগজটা না নিয়ে আমি যাব না। ওটা রেখে তোমাদের কোনো লাভ নেই।
সুশীলাদি বলল, দে গোবিন্দ, দিয়ে দে না কাগজটা!
বড়কাকা বলল, হ্যাঁ, দিয়ে দে। কাগজ চেপে কী হবে?
গোবিন্দ বলল, সে কাগজ আমার কাছে নেই। কাল রাত্তিরে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছি। বাক্সটাও ফেলে দিয়েছি।
আমি জানি, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। দুপুরে ভবেন যে–ভাবে উইলটা সম্পর্কে কথা বলছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল, সেটা সে একটু আগেই দেখেছে। গোবিন্দ নিছক অকারণেই সেটা ফেরৎ দেবে না। এটাও তার আমার ওপর একটা প্ৰতিশোধ!
আমি আবার অনুরোধ করলুম, দাও! ওটা দিলেই আমি চলে যাব!
গোবিন্দ এবার এগিয়ে এসে আমার বুকে এক ধাক্কা মেরে বলল, আর একটা কথা বললে পুঁতে ফেলব! বিদেয় হ এখেন থেকে! তোর যেখানে খুশি যা! ইচ্ছে করলে তোর পুলিশ বাবাদের কাছে যা মনে চায় বলতে পারিস। আমরা পরোয়া করি না!
সুশীলাদিও এবার খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে বলল, আর কেন ঝামেলা করছ? বলছে তো কাগজটা নেই। এবার তুমি চলে যাও।
আমাকে যে–দু’জন ধরে আছে, তারা এবার পেছন দিকে ঠ্যালা মারতে লাগল। আর উইলটা ফেরৎ পাবার কোনো আশা নেই।
সুশীলাদি আমার হাত–ধরা দু’জনকে বলল, এই, ছেড়ে দে। মারধোর করবিনি। তোরা ইদিকে আয়, ও নিজের মনে চলে যাক।
আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলুম। ওরা আমাকে ছেড়ে দেবার পরেও আমি জোর করে তো আর এখানে থেকে যেতে পারি না! অনেক ছিঁচকে চোর, পকেটমারকে জেল থেকে মুক্তি দেবার পরেও তারা আবার জেলখানায় ফিরে আসতে চায়। কারাগারেই তারা ভালো থাকে।
আমি নিজে কোনোক্রমে পালাতে পারলেও একটা আনন্দ–গর্ব বোধ করতে পারতুম। কিন্তু এরকম বিনা ভূমিকায় মুক্তি দেওয়াটা যেন কী রকম অপমানজনক লাগছে। বন্দী হিসেবে আমার গুরুত্ব হঠাৎ এত কমে গেল ওদের কাছে?
ডোবার ধারে তেঁতুলতলাটুকু পর্যন্ত আমার চেনা। ডোবাটার উল্টো দিকে উঁচু বাঁধে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ছায়ামূর্তি। এদিকে পেছন ফেরা। ওরা দূরে কোনো কিছুর ওপর নজর রাখছে। এদের গ্রামে চাল আছে খবর পেয়ে শবররা কি এই গ্রাম আক্রমণ করবে? পাশাপাশি গ্রামে হাওয়ায় কথা চালাচালি হয়ে যায়। এই আংড়া গ্রামের মানুষ আজ দু’বেলাই খাবার খেয়েছে, ভাত ও খিচুড়ি, এই খবর জেনে অন্য গ্রামের অভুক্ত মানুষেরা ক্ষেপে উঠবে না?
শবরপল্লী কোনদিকে তা আমি জানি না। এইসব নিরীহ চাষীদের চেয়ে শবররা আরও হিংস্র হওয়া স্বাভাবিক। শবররা একসময় ছিল শিকারী, এখন শিকার করার মতন জন্তু জানোয়ার আর নেই। জঙ্গল থেকে এটা ওটা কুড়িয়ে এনে খায়। জঙ্গলও তো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। এখন শবরদের মধ্যে কেউ কেউ জনমজুরি খাটে, ঘাসের চাটাই, ঝুড়ি বোনে। জমি থেকে ফসল না উঠলে কে চাটাই ঝুড়ি কিনবে, কেউ–বা জনমজুর খাটাবে!
আমি শার্টটা আনিনি, চটি জোড়াও আনিনি। রোগা বউটি যখন আমায় ডেকে নিয়ে এলো, তখন আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে আমি খিচুড়ি খাওয়ার নেমন্তন্ন পেয়েছি। ওরা এমন চশমখোর, আমাকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেবার পরেও একপাতা খিচুড়ি খেতে দিল না?
শরীরটা এখন সত্যিকারের দুর্বল লাগছে। কতদূর হাঁটতে হবে? ছেড়েই যখন দিল, তখন আমার শার্ট আর চটি জোড়া ফেলে আসার কী মানে হয়? এখন চাইলে ওরা ফেরৎ দেবে না। আবার ফিরে যাব? ওরা ভাববে লোকটা কী হ্যাংলা, জীবনটা ফিরে পেল, তবু সামান্য জামা–জুতোর লোভ ছাড়তে পারল না! নাঃ, আমি এতটা নীচে নামতে পারি না।
শুধু একটা প্যান্ট পরা, খালি গা, খালি পা, এই অবস্থায় আমায় কেউ দেখলে ভদ্দরলোক বা শহরের লোক বলে কি চিনতে পারবে! গ্রামের অনেক ছেলেই ইদানিং প্যান্ট পরে। বাসে আসতে আসতেই এক জায়গায় রাস্তার ধারে দেখেছিলুম, দুটি ছোকরা এক পাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, দু’জনের পরনে প্যান্ট, হাঁটু অবধি গোটানো
আমিও প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম হাঁটু অবধি। এবার? মুখে কি একটা শহুরে ছাপ পড়ে গেছে? মুখে আর চুলে খানিকটা ধুলো মেখে নিলে কেমন হয়? এবার হয়তো লোকে আমাকে পাগল ভাববে। পাগলের সাত খুন মাপ!
অন্ধকারে শুকনো পাথুরে জমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার আর একটা চিন্তা মাথায় এলো। যদি কোনোক্রমে আমি বড় রাস্তাতে পৌঁছোতেই পারি, পকেটে একটাও পয়সা নেই, কলকাতায় বা রাঁচির দিকে যাব কী করে? উইলটা না নিয়ে রাঁচি যাবার কোনো মানে হয় না। উইলটা পাঠানো নিশ্চয়ই খুব জরুরি ছিল, তপনের বড়মামা হয়তো খুব অসুস্থ, দু’একদিনের মধ্যে যদি তিনি মারা যান, তাহলে তিনি আর সই করতে পারবেন না। তপনের বোধহয় কিছু ভাগ– টাগ পাবার কথা ছিল, তপন তাহলে আমাকে তুলোধোনা করবে!
কিন্তু আমি ভিকটিম অফ সারকামস্টান্সেস। তপনের কাছে অবিশ্বাসের কাজ তো কিছু করিনি। তবু মুশকিল হচ্ছে এই, তপন হয়তো সবটাই আমার বানানো একটা রোমহর্ষক গল্প বলে ধরে নেবে। আগে কিছু কিছু গল্প বানিয়েছি বটে, এখন এই কঠোর সত্যটাই কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
সে যাই হোক, এখন কলকাতায় ফেরা ছাড়া আমার গতি নেই। গাড়ি ভাড়া পাব কোথায়? বড় রাস্তায় কোনো গাড়ি থামিয়ে লিফ্ট চাইতে হবে। আমার এই চেহারা দেখে কেউ আমায় বিশ্বাস করবে? কিংবা যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি…তখন বাঁচবার একটিই উপায়, গড়গড় করে ইংরিজি বলা। ইংরিজিকে সবাই সম্মান করতে বাধ্য।
ইংরেজ চলে গেছে এদেশ থেকে, ফেলে গেছে তাদের এঁটো করা ইংরিজি। সেই এঁটো ইংরিজি ও ছিবড়ে ইংরিজিপনা নিয়েই চলছে গোটা দেশটা। এদেশের রাষ্ট্রপতি ভালো ইংরিজি না জানলে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়!
এই রাতে বড় রাস্তায় পৌঁছলেও আমাকে দেখে কোনো গাড়ি থামবে না। আমি একা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত তুলে লরি বা প্রাইভেট কার থামাবার চেষ্টা করলে তারা বরং রাগের চোটে আমাকে চাপা দেবার চেষ্টা করবে। গাড়িওয়ালাদের কাছে রাত্তিরের দিকে কোনো রাস্তাই নিরাপদ নয়। এই তো কয়েকদিন আগেই পুরুলিয়ার রাস্তায় এক মন্ত্রীর গাড়ি ডাকাতরা আটকেছিল। মন্ত্রীর গাড়ি বলে তারা চিনতে পারেনি অবশ্য। মন্ত্রীর সঙ্গের আমর্ড গার্ড গুলি চালাতে শুরু করলেই তারা পোঁ পাঁ দৌড় দেয়।
এদেশের অধিকাংশ ডাকাতও এখন এমনই গরিব যে তাদের বন্দুক কেনারও পয়সা নেই। কিংবা, যাদের বন্দুক নেই, তাদের কি সত্যিকারের ডাকাত বলা যায়?
সুশীলাদির নির্দেশ মতন এগিয়ে আমি নদীর পথটা পেয়ে গেলাম। আকাশের যা ময়লা ময়লা চেহারা তাতে কোনটা পুব দিক আর কোনটা পশ্চিম দিক, তা বোঝা দুষ্কর। তবে কাল কোনদিক থেকে এসেছি তা অনেকটা আন্দাজ করতে পারছি।
জিরোবার জন্য একটা পাথরের ওপর বসলাম। পাথরটাকে দেখতে অনেকটা প্রকাণ্ড কচ্ছপের মতন। দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশের নীচে গাঢ় অন্ধকার বনরেখা ঐ জঙ্গলটা পার হতে হবে। আংড়া গ্রামের মানুষ সত্যিই আমাকে ছেড়ে দিল? আজ রাতটা নিয়ে আমি এত ভয় পাচ্ছিলুম, অথচ এত সহজেই পাওয়া গেল স্বাধীনতা!
সভ্য জগতে পৌঁছোতে পারলে প্রথমেই আমার দরকার এক কাপ চা ও একটি সিগারেট। তারপর সাবান মেখে স্নান। একটা ধোপা বাড়ির কাচা পাজামা। নিজের গায়ের ঘামের গন্ধে আমার নিজেরই ঘেন্না লাগছে। শহুরে সমাজে জন্মেছি, সভ্যতার সব উপকরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাতে দোষেরও তো কিছু নেই, মানুষ তো সভ্যতার দিক থেকে পিছিয়ে যেতে পারে না!
মানুষ বললে অবশ্য গোটা মানব সমাজকেই বোঝায়। যদিও এই আংড়ার মতন অনেক গ্রামের মানুষের কাছে সভ্যতার ছিটেফোঁটাও প্রায় পৌঁছোয়নি। এমনই হতচ্ছাড়া এই গ্রাম যে কারুর একটা সাইকেল নেই, একটা ট্রানজিস্টার রেডিও পর্যন্ত নেই। সারা বছর ধরে প্রত্যেকদিন শুধু খাওয়ার চিন্তা। জন্তু– জানোয়াররাও তাই–ই করে।
একটু হাওয়া নেই, গরমে সারা গা জ্বলছে। নদীতে যদি জল থাকত, আমি প্যান্ট খুলে গা ডুবিয়ে দিতাম।
শীতকালে আমি এই আংড়া গ্রামে একবার বেড়াতে আসব। বাচ্চাদের জন্য আনতে হবে কয়েকটা খেলার বল, সুশীলাদির জন্য একখানা শাড়ি। আর গোটা কুড়ি টাকার চকলেট। এদের ভাত খাওয়াবার সাধ্য আমার নেই, তবু একটা অন্তত নতুন জিনিস তো খাওয়ানো যেতে পারে। সেটা ওদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে অনেকদিন। ভবেনকে যদি তখন দেখতে পাই, ওর গালে কষাবো একটা থাপ্পড় হ্যাঁ, মারবই। গোবিন্দর সঙ্গে সারা জীবনে আর আমি কথা বলব না ঠিক করে ফেলেছি। আমার ওপর ওর এত রাগ, প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে বলে কি সে মাথা কিনে ফেলেছে নাকি? ওরকম অনেকেই প্রেমের জন্য দুর্ভোগ সহ্য করে, আমাকে এরকম সইতে হয়নি?
দূরে কয়েকটা বিন্দু বিন্দু আলো দেখে আমার শরীরে আবার একটা ঝাঁকুনি লাগল। আলো না আগুন? বিন্দুগুলো নড়ছে। ওখানে মানুষ রয়েছে, মানুষের হাতে মশাল বা জ্বলন্ত কাঠ।
ওরা কি শবর? কী খুঁজছে, নিশ্চয়ই আমাকে নয়!
রাত্তিরের মাঠে দু’চারটে ইঁদুর বা সাপ বেরোয়। অনেক আদিবাসী ইঁদুর বা সাপও খায়। খিদের জ্বালায় ওরা সেইসব খুঁজতে বেরিয়েছে?
আলোগুলো যেন এগিয়ে আসছে এদিকে। ওরা জাত–শিকারী, লুকোবার চেষ্টা করলেও দেখে ফেলবে আমাকে। ডান দিকে খাঁ খাঁ মাঠ পড়ে আছে, ঐ দিকে গেলে হয়তো আমি বড় রাস্তা থেকে আরও অনেক দূরে সরে যাব, তবু ঐ দিকে দৌড়োনো ছাড়া গতি নেই।
আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে আমার শরীর সজাগ হয়ে গেল। শবররা আমার শত্রু নয়, আমিও ওদের শত্রু নই, কিন্তু তা বোঝাবুঝির আগেই যদি ওরা আমার বুকে তীর মারে!
পেছন দিকে আর একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম। মানুষের ছুটে আসার শব্দ। একজন দু’জন নয়, অনেক মানুষ। গোটা আংড়া গ্রাম যেন ধেয়ে আসছে আমার দিকে। ওরা আবার মত পালটেছে? আবার ধরতে আসছে আমাকে? এবার ধরতে পারলে কি আর এক মিনিটও বাঁচিয়ে রাখবে?