শেষ দেখা হয়নি – ৪

দশ মিনিট, না এক ঘণ্টা, না একযুগ কাটল তা জানি না। এক সময় আমার পিঠটা ভারমুক্ত হলো। বাচ্চাটা আগে দৌড়ে পালাল, তারপর উঠে গেল সুশীলা।

আবার দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম।

পুলিশ এ–ঘরে শেষ পর্যন্ত এলো না? অপদার্থ, অপদার্থ একেবারে। দায়সারা ভাবে সামান্য দু’ একটা বাড়ি সার্চ করে চলে গেছে নিশ্চয়ই। শুধু কি বাসে ডাকাতি হয়েছে? বাস থেকে যে একটা জলজ্যান্ত মানুষও উধাও হয়ে গেছে, সে–কথা ঐ বাসের ড্রাইভার–কণ্ডাক্টর, অন্য যাত্রীরা কেউই জানায়নি পুলিশকে? পুলিশ তার খোঁজ করবে না? কিংবা, আমি জাঁদরেল কোনো ব্যক্তির আত্মীয় নই বলে আমায় নিয়ে পুলিশের মাথাব্যথা নেই? দেশে প্রতিদিন কত মানুষ মরছে, কত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, আমার মতন একটা এলেবেলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেলেও এসে যায় না কারুর কিছু।

অভিমানে বুকটা ভরে গেল আমার। কার ওপর অভিমান, পুলিশের ওপর? এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ কি কখনো পুলিশের ওপর অভিমান করেছে?

কার বিরুদ্ধে যে অভিমান, তা জানি না, তবু ছেলেবেলার মতন ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই আমার জীবনটা এলেবেলে? আমি হারিয়ে গেলে কারুর কিছু ক্ষতি নেই? কিন্তু আমার জীবনটা আমার নিজের কাছে যে খুব মূল্যবান।

আমার পিঠ থেকে বোঝাটা সরে গেলেও তখুনি আমার উঠে পড়তে ইচ্ছে হলো না। কম্বলগুলো সারাবারও উৎসাহ নেই। ঘামে গা ভিজে যাচ্ছে, যাক। এত গরমে এখন আমার শীত করছে। কী দরকার আমার এখন ওঠার? নতুন কী হবে? শালগ্রাম শিলার শোওয়া আর বসা।

সুশীলা আমার সঙ্গে একটাও কথা বলল না? এতক্ষণ আমার পিঠের ওপর শুয়ে রইল, চলে যাবার সময় কিছু একটা তো বলে যেতে পারত? আমাকে ধরার পর আমি কি কোনো ব্যাপারে ওদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছি? তার কোনো মূল্যই নেই।

নাঃ, এসব ভাবলে মনটা একেবারে ঘর–মোছা ন্যাতার মতন জবজবে হয়ে যাচ্ছে। অন্য কিছু চিন্তা করা যাক। আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময় কোন্‌টা কাটিয়েছি? চোখের সামনে ভেসে উঠল দিকশূন্যপুর…বন্দনাদি…রোহিলা… চাঁদের আলোয় নদীতে স্নান করতে যাওয়া….

এ–ঘরে আর কেউ আসবে না? এরা আমায় তিল তিল করে মারতে চায়…নাঃ, এবার একবার পালাবার শেষ চেষ্টা করতেই হবে। যদি পালাতে পারি, আমি মোটেই ঝাড়গ্রাম বা লোধাশুলিতে গিয়ে পুলিশে খবর দেব না…বছর খানেক বাদে এই গ্রামে আবার ফিরে আসব, তখন সব কিছু মিটে যাবে আশা করি, তখন এদের কাছে এসে বলব, তোমরা শুধু শুধু আমাকে অবিশ্বাস করেছিলে, বিনাদোষে আমায় শাস্তি দিয়েছিলে….

একটা একটা করে কম্বল সরিয়ে ফেললাম। একটা কাঁথা আর দুটো কম্বল। কাঁথাটা বাচ্চা ছেলের হিসির গন্ধে ম ম করছে। ভাগ্যিস এটা একেবারে ওপরে ছিল, তাই গন্ধটা আগে পাইনি।

ঘরটা একেবারে অন্ধকার, না আমি চোখে অন্ধকার দেখছি?

জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে গেছে, দরজাটাও বন্ধ। একেবারে অন্ধকূপ হত্যার কার্বন কপি। সত্যিই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

দরজাটা টেনে খুলতে গেলাম। বাইরে থেকে বন্ধ। এমনই অপূর্ব ব্যবস্থা, এ দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় না। আমি রাগ করেও দরজা বন্ধ করে দিতে পারব না। ওরাই শুধু ইচ্ছে মতন বন্ধ করবে কিংবা খুলবে।

প্রায় টলতে টলতে চলে এলাম জানলার কাছে। জানলার দুটো পাল্লা একটা নড়বড়ে হুড়কো দিয়ে আটকানো। একটু টানতেই খুলে গেল।

বাইরে এক চমকপ্ৰদ দৃশ্য।

বড় গাছটার তলায় যে বেদি, সেখানে চারজন লোক খেতে বসেছে। শালপাতায় দেওয়া হয়েছে ভাত, সুশীলাদি একটা গামলা থেকে ডাল তুলে দিচ্ছে। আরও একজন স্ত্রীলোক একটা ডেকচি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু ডাল ভাত নয়, আরও কিছু আছে। প্রত্যেক বাড়িতে আলাদা আলাদা রান্না না করে, এরা এক জায়গায় সকলের জন্য রেঁধে জ্বালানি বাঁচিয়েছে। যেন একটা পিকনিক

যারা খেতে বসেছে, তাদের মধ্যে বড়কাকাকে চিনতে পারছি। গোবিন্দ নেই ওখানে। কতখানি করে ভাত নিয়েছে রে বাবা। কয়েকদিন খেতে পায়নি বলে একদিনেই এত খেতে হবে? ডাকাতি করে ওরা কত টাকাই বা পেয়েছে, পয়সা ফুরিয়ে যাবে যে! কালোবাজারী ছাড়া অন্য কেউই আজকাল সঙ্গে ক্যাশ টাকা বেশি রাখে না। বড়লোক কালোবাজারীরা সাধারণ বাসে করে যাবে কেন, প্লেনে যাবে, কিংবা ট্রেনের এ সি ফার্স্ট ক্লাসে।

একটা বাস ডাকাতির টাকায় গোটা একটা গ্রামের লোকের কতদিনেরই যে খাবারের সংস্থান হবে!

সবাই বেড়াল–ডিঙোতে না পারা ভাত নিয়েছে। ধোঁয়া–ওঠা গরম ভাত। ভাতের মাঝখানের একটা গর্তে সুশীলাদি ডাল ঢেলে দিচ্ছে। আর একজনের ডেকচিতে কী আছে, মাছ নাকি? ওরে বাবা, শখ কত! ট্যাড়শের তরকারিও হতে পারে। ঝাড়গ্রামের একটা হোটেলে আমি যে–কবারই খেয়েছি, ঢ্যাঁড়শের তরকারি পেয়েছি। এ অঞ্চলে ঢ্যাঁড়শ বেশ পছন্দসই তরকারি মনে হয়।

বড়কাকা মুখ তুলে বলল, ওরে সুবল, কাঁচা লঙ্কা এনেছিস নাকি রে? দে না এক–দু’খানা।

লঙ্কা ছাড়া আমিও ভাত খেতে পারি না। গরম ডাল–ভাতের সঙ্গে আলু সেদ্ধ, শর্ষের তেল আর পেঁয়াজকুচি দিয়ে মেখে…।

বড়কাকা এদিকে মুখ ঘোরাতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কয়েক পলক যেন অবাক ভাবে দেখল আমাকে। আমার অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল নাকি? কী যেন বলতে গেল সুশীলাদিকে, তারপর কিছু না বলে, শালপাতার থালাটা একটু সরিয়ে, পেছন ফিরে বসল আমার দিকে।

আমিও জানলার কাছ থেকে সরে গেলুম চট করে। একেবারে মরমে মরে যাওয়ার মতন অবস্থা। আমাকে হ্যাংলা ভাবছে। ভাবছে বুঝি আমার নজর লেগে যাবে!

ট্রেনে যখন আমাদের খাবার দেয়, কোনো স্টেশনে থেমে থাকে ট্রেন, কামরার জানলায় ধারে এসে দাঁড়ায় ভিখিরি ছেলেমেয়েরা। তারা হাত বাড়িয়ে খাবার চায়, আমাদের ভাতের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তখন তাদের নজর এড়াবার জন্য আমরা জানলার কাচ নামিয়ে দিই। পেছন ফিরে বসি।

এখন জায়গা বদলাবদলি হয়ে গেছে।

এই অবস্থাতেও আমার হাসি পেল একটু। ছেঁড়া ইজের পরা, কালো কালো গা, নাকে সিক্লি, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একটা বাচ্চা ভিখিরির মুখখানা অবিকল আমার মতন। তবে ভিখিরির ছেলেরা কলের জলটা অন্তত পায়। এরা আমাকে একটু জলও দেয়নি। এদেশের গভর্নমেন্টের থেকেও এরা হৃদয়হীন।

শুধুমাত্র একটু বোঝার ভুল। বিশ্বাসের অভাব। মানুষ মানুষকে ভুল বোঝে, তাই যত বিপত্তি। এরা যদি আমায় বিশ্বাস করত, তা হলে সব কিছুই কত সরল হয়ে যেতে পারত। ওদের ঐ গাছতলার গরম ভাতের পিকনিকে যোগ দিতে পারতুম আমিও। আমাকে যদি ওরা বলত শ্রমের ভাগ নিতে, তা হলে উনুন . জ্বালাবার জন্য কাঠ চ্যালা করে দিতেও আমার আপত্তি ছিল না।

অন্যকে খেতে দেখলে খিদে বেড়ে যায়। পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। একটু যেন বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না! কাল দুপুরবেলা আমি কোলাঘাটে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে বেশ ভালোই খেয়েছি। তারপর আজ দুপুর পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকা এমন একটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অনেক সময় তো এরকম হতেই পারে।

তবু আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? জেলখানায় যারা অনশন করে, দিনের পর দিন, যতীন দাস বাষট্টি না তেষট্টি দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, গান্ধীজী যখন তখন অনশন করতেন…। আমার দ্বারা কোনো কালেই গান্ধীবাদী হওয়া হবে না!

স্বদেশী আমলের বিপ্লবীদের স্মৃতিকথায় পড়েছি, অনশনের প্রথম একটা– দুটো দিনই সবচেয়ে কষ্টকর! তারপর মুখটা তেতো তেতো হয়ে যায়, পেটের মধ্যে আর কোনো সাড়া শব্দ থাকে না। প্রথম একটা–দুটো দিন সবসময় ভালো ভালো খাবারের কথা মনে পড়ে।

খাওয়ার জন্য বাঁচা, না বাঁচার জন্য খাওয়া?

হঠাৎ এই অদ্ভুত প্রশ্নটা মনে এলো কেন? গাছ আগে, না বীজ আগে? বীজ না থাকলে গাছ কোথা থেকে আসবে? আর, গাছ না হলে, বীজই বা কোথায় পাওয়া যাবে?

মানুষ ভগবানকে সৃষ্টি করেছে, না ভগবান মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? ভগবানই যদি মানুষকে সৃষ্টি করে থাকেন, তা হলে ভগবানকে কে সৃষ্টি করল? ভগবানেরও বাবা আছে? তারও বাবা? তারও বাবা? তারাও বাবা? তারও…

এ কী, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? এসব কী ঘুরছে আমার মাথায়? যত সব গাঁজাখুরি ব্যাপার।

বাচ্চাদের আগেই খাওয়া হয়েছে, এখন পুরুষরা বসেছে, এর পর মেয়েদের ব্যাচ। পুরুষরা যা কাঁড়ি কাঁড়ি খাচ্ছে, মেয়েদের কম পড়ে যাবে না তো? আমাদের দেশের মেয়েরা সর্বংসহা। পুরুষদের ও মেয়েদের তো সমানই খিদে পাওয়ার কথা। তবু, এই যে সুশীলাদির মতন মেয়েরা, ওরাই তো খিদে চেপে রান্না করল, আগে বাচ্চাদের খাওয়াল, পুরুষদের পরিবেশন করল, এর পর নিজেরা খেতে বসে হয়তো দেখবে পেট ভরার মতন খাবার নেই। তবু কোনো প্রতিবাদ করবে না।

কিন্তু সুশীলাদি আমার সঙ্গে এমন নির্দয় ব্যবহার করল! একটা কথাও কি বলতে পারত না?

দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। কে আসছে, জল্লাদ, না পরিত্রাতা? একজন কেউ তো এসে বলতে পারে, আমাদের খুবই ভুল হয়ে গেছে, নীললোহিত, তোমাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছিলুম! এসো, বাইরে খোলা হাওয়ায় আমাদের সঙ্গে বসবে এসো।

দরজা খোলার পর দেখা গেল পাজামার ওপর নীল শার্ট পরা একজন বছর তিরিশেক বয়েসের যুবা, হাতে জ্বলন্ত বিড়ি, একটু আগে স্নান করেছে তাই মাথার চুলগুলো ভিজে। একে আমি আগে দেখেছি বলে মনে হয় না, মুখখানা দেখলে মনে হয়, কিছু লেখাপড়া জানে। সেটা আরও ভয়ের ব্যাপার

যুবকটি দু’ হাত তুলে সাড়ম্বরে বলল, নমস্কার। নমস্কার। আমার নাম ভবেন গাইন। মশাই আপনি জেগে আছেন?

আমি বললুম, নমস্কার, হ্যাঁ, আমি জেগেই আছি।

–তা হলে এখানে বসে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাক। আপনার আপত্তি নেই তো মশাই?

–না, আপত্তির কী আছে।

ভবেন গাইন এসে বেশ শব্দ করে খাটিয়ার ওপরে বসল। এইমাত্র খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছে মনে হলো। পেট ভর্তি খাওয়ার পর সাধারণত মানুষের মেজাজটা ভালো থাকে। সেইটুকুই যা ভরসা।

আমার দিকে পা ছড়িয়ে, আধো শোওয়া হয়ে ভবেন গাইন বলল, আপনি কলকাতায় থাকেন তো? কোথায় থাকেন? বালিগঞ্জ? ভবানীপুর। আমি কলকাতা ভালো করেই চিনি।

এটা গ্রামের লোকের একটা সাধারণ দুর্বলতা। যে–একবার কলকাতার মতন শহর ঘুরে গেছে, সে সেই শহরের লোক দেখলেই জানিয়ে দিতে চায় যে সে শহরও ভালো চেনে।

আমি বললুম, আমার বাড়ি বেহালায়।

কেন বেহালার নাম করলুম? ঐটাই প্রথম মনে এলো যে!

ভবেন গাইন কপাল কুঁচকে বলল, বেহালা? ডায়মণ্ডহারবার যেতে পড়ে না? একবার গেছি। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ চেনেন। সেখানে আমি এক বছর পড়েছি। আর্টস। তারপর চাকরি পেয়ে গেলাম।

আমি বিনীতভাবে বললুম, ও, আপনি চাকরি করেন বুঝি?

—করতুম, ঝাড়গ্রামে আটা কলে। সেটা উঠে গেল। তারপর একটা কাঠের কারবারে হিসেব লেখার কাজ পেয়েছিলুম, সেটাও চলে গেল দু’ বছর আগে, তারপর থেকে বেকার। মালিকের একটা হারামির বাচ্চা ভাইপো ছিল, সে…টা পেছনে লেগেছিল। মাগিবাজ শালা, রোজ রোজ মহুলপানি খেয়ে আমার কাছে টাকা চাইত। আমি দিতে না চাইলেই… লাথি কষাত। কী বুঝলেন?

আমি লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। ভবেন গাইন প্রথমেই জানিয়ে দিতে চায় যে সে এক বছর কলকাতায় কলেজে পড়েছে এবং সাধারণ ঠাকুর–চাকরের কাজ করেনি। তার ভাষায় গালাগালির স্টক বেশ ভালোই।

—আমি এই আংড়া গ্রামের লোক নয়, বুঝলেন। এখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। আমার শ্বশুর মারা গেল গত মাসে, বাড়িতে শুধু তিনটে বেওয়া মেয়েছেলে, তাই আমি এখানে এসে থাকছি। হাতে কাজ–কম্ম কিছু নেই। গোপীবল্লভপুরের একটু আগে একটা গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে একটা চাকরির চেষ্টা করেছিলুম, বুঝলেন মশাই, কুত্তার বাচ্চারা, …রা দু’হাজার টাকা চাইল। শালা বাপের জন্মে দু’ হাজার টাকা চোখে দেখিনি।

—মাস্টারির চাকরির জন্য টাকা দিতে হবে কেন?

—আকাশ থেকে পড়লেন। ন্যাকা নাকি? নাক টিপলে দুধ গড়ায়? মাস্টারির জন্য বিল্ডিং ফাণ্ডে কিংবা পার্টি ফাণ্ডে টাকা দিতে হয়, জানেন না?

–কী করে জানব বলুন? আমি তো গ্রামের মাস্টারির জন্য কখনো দরখাস্ত করিনি।

—আপনাদের গাণ্ডুমার্কা খবরের কাগজগুলোতে বুঝি লেখে না এসব কথা আপনি কী চাকরি করেন?

–আমি…আমিও আপনার ‘মতন বেকার, ভবেনবাবু।

—কলকাতায় এখন চালের দাম কত? মানে মোটা চাল মিনিমাম কত টাকা কিলোতে পাওয়া যায়?

—চালের দাম…মানে, আড়াই টাকা–তিন টাকা হবে বোধহয়। আমি ঠিক জানি না।

—রেশনের চাল খান?

—বাড়িতে বাজার টাজার অন্য একজন করে…আমি এগুলোর ঠিক খবর রাখি না।

–তার মানে বাপের হোটেল? কোথা থেকে চাল আসে, বাজারে কোন্ জিনিসের কত দাম, তা কিছুই খবর রাখেন না, এই তো? বাঃ, বেশ একখানা মনের মানুষ পাওয়া গেছে। এই রকম লোকই খুঁজছিলুম অনেকদিন। আমার পা–টা টিপে দিন তো। কাল রাত্তিরে বহুৎ দৌড়তে হয়েছে। দাবনায় ব্যথা হয়ে গেছে।

পা–টা আমার কোলে তুলে দিয়ে দু–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সে এক ধমক দিয়ে বলল, টেপ শালা, চুপ করে বসে আছিস কেন?

সিনেমায় ছাড়া আমি পা টেপার ব্যাপারটা কখনো দেখিনি। আমি কোনো মানুষকে দিয়ে পা টেপানোর, কথা কোনোদিন চিন্তা করিনি, আমাকেও এরকম অনুরোধ বা হুকুম করেনি কেউ কখনো

ভবেন গাইন লেখাপড়া জানা লোক হলেও সে খালি পায়ে হাঁটে। তার পায়ের পাতায় রাজ্যের ধুলো। এই পাজামাটা বোধহয় সে না কেচে দুতিন মাস ধরে পরেছে। আমি দু’হাত লাগালুম তার পায়ে।

আরামে প্রায় চোখ বুজে ভবেন বলল, কলকাতায় যখন পড়তে যাই, তখন মীর্জাপুরে একটা ভদ্দরলোকের বাড়িতে খায়িং–থাকিং–এর বদলে বাড়ির কাজ করতুম। ঘর ঝাঁট দেওয়া, রান্নাবান্না নয়, বাড়ির একটা কুকুর, এই শালা অ্যাত্ত বড় কুকুর, আর তিনটে এণ্ডিগেণ্ডি বাচ্চার দেখাশুনো। বাড়ির যে বা….কর্তা, সে এই হেভি লাশ, সাড়ে তিনমনি তো হবেই, করপোরেশনে কী যেন বড় কাজ করে। সেই মোটকুটা প্রত্যেক রোববার খাওয়া দাওয়ার পরেই হেঁকে বলত, এই ভবনা এদিকে আয়, পা টিপে দে। হারামির বাচ্চা, তোর বাড়িতে কুকুরের গু–মুত সাফ করি বলে তোর পা টিপতেও হবে? সেই থেকে মনে মনে ঠিক করেছিলুম কখনো যদি চান্স পাই, এক শালা ভদ্দরলোকের এঁড়েকে দিয়ে আমারও পা দুটো টেপাব। কি রে…, ঠিক বলিনি?

আমি কোনো উত্তর না দেওয়ায়, সে আমার কোমরে একটা মাঝারি লাথি কষাল।

আমি বললুম, এভাবে পা নাড়াচাড়া করলে টিপতে অসুবিধে হয়।

—ভালো করে টেপ শালা। দরদ দিয়ে। আমি এ গ্রামের জামাই, সবাই আমাকে খাতির করে।

–তা তো করবেই!

—তুই কী বুঝবি রে…তুই চালের দরই জানিস না। এরপর মরি আর বাঁচি, আজ তো পা টিপিয়ে মনের সাধ পুরিয়ে নিই।

আমার ছোটমামার ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের ভাড়াটে গোবিন্দর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল বলে আমার ওপর গোবিন্দর এত রাগ। সে আমাকে যখন তখন খুন করতে চায়। আর কলকাতায় মীর্জাপুর স্ট্রিটের এক করপোরেশনের বড়বাবু এই ভবেনকে দিয়ে পা টিপিয়েছিল বলে আমাকে ওর পা টিপে দিতে হচ্ছে। অন্য লোকের অপরাধে এরকম শাস্তি পেয়ে যেতে হবে আমায়? আমার কলকাতায় থাকাটাই এত দোষের?

এ নিয়ে কার কাছে অভিযোগ জানাব? এমন অনেক প্রশ্ন আসে জীবনে যার কোনো উত্তর নেই।

এ লোকটা গাইন না গায়েন? আমি গায়েন পদবী আগে শুনেছি। এ কি লেখাপড়া শিখেছে বলে গাইন হয়ে গেছে? কলকাতায় লেখাপড়ার চেয়ে গালাগালিটাই ও শিখেছে বেশি। গ্রামের লোকেরাও গালাগালি দিয়ে কথা বলে, কিন্তু তা একটু অন্যরকম। সেই যে একদিন গ্রামের লোক একজন জমিদারকে বলেছিল, হুজুর আমাদের মা–বাপ, আর আমরা তো সব শুয়োরের বাচ্চা!

ভবেন গাইন আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি ঐ বাসে করে যাচ্ছিলেন কোথায়?

—রাঁচি। একটা বিশেষ কাজে…

—কাজ মানে তো একটা কোর্টের রেজিস্ট্রি করা উইল নিয়ে যাওয়া। গোবিন্দর কাছে দেখেছি। অনেক টাকার ব্যাপার। সাড়ে পাঁচ লাখ। তুই তো শালা খুব মালদার লোক?

—ওটা আমার নয়, আমার নয়। আমার এক বন্ধুর। আমার ওপর শুধু পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল।

–কত কমিশন?

—অ্যাঁ?

—আপনার বন্ধুর এত লাখ টাকার মাল পৌঁছে দেবেন, আপনাকে কমিশন দেবে না? দশ হাজার? পনেরো হাজার।

—সেসব কিছু নয়। আমার কাজ শুধু একটা চিঠি পৌঁছে দেওয়ার মতন। বাস ভাড়া আর আড়াইশো টাকা হাত খরচ…

—চোপ শালা। ফের ঝুট বাত! মেরে তোর মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে দেব। কত টাকা পেয়েছিস ঠিক করে বল!

আমি ভবেনের চোখের দিকে কড়া ভাবে তাকালুম, যদি ব্যক্তিত্ব দিয়ে একে কিছুটা বশ করা যায়। ভয় পেয়ে আমার কোনো লাভ নেই।

এ লোকটি আমাকে একবার আপনি একবার তুই বলে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে। এক এক সময় এর কথার সুর বেশ নরম, আবার হঠাৎ হঠাৎ উগ্র হয়ে উঠছে। গ্রামের জামাই বলেই এরকম মেজাজ?

–কত টাকা পেয়েছিস বল তো….

—ভবেনবাবু। আপনি কলকাতায় লেখাপড়া শিখেছেন, আপনার বোঝা উচিত যে সামান্য একটা কাগজ পৌঁছে দেবার জন্য কেউ বেশি টাকা দেয় না!

–তোদের কলকাতায় লেখাপড়া শেখার নামে আমি মুতে দিই। একটা ছেলে ছিল আমাদের ক্লাশে। সেটার নাম ছিল সুখরঞ্জন, বেলেঘাটার ছেলে, সেটা যখন তখন আমায় চাঁটাত। একটা শালা মাস্টার ছিল, ভ্যাঙাতো আমার কথা শুনে, ইংলিশ বানান বলতে পারিনি বলে সে একদিন বলেছিল, মাথা মোটা ছেলে তোর লেখাপড়া হবে না, গ্রামে গিয়ে হাল চাষ কর। মুতে দিই, সব শালার মুখে মুতি দিই।

পাজামার মাঝখানে হাত দিয়ে সে তার মুত্রস্থানটিও দেখিয়ে দিল কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে।

আমি আমার কোল থেকে ওর পা নামিয়ে দিলুম। কলকাতার যতগুলো লোক ওর প্রতি অবিচার করেছে, তাদের সকলের হয়ে শাস্তি নেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ লোকটা দেখছি স্যাডিস্ট ধরনের। গ্রামের লোকেরও জটিল মনস্তত্ত্ব থাকে। ভাতটাত খেয়ে এসে এখন ও প্রায় অকারণে আমার ওপর অত্যাচার ও গালমন্দ করতে এসেছে।

– পা নামিয়ে দিলি যে? টেপ, টেপ ভালো করে…

—না। আমি আর পারব না।

একটা পা উঁচু করে তুলে চোখ পাকিয়ে সে বলল, পারবি না মানে? এবার তাহলে তোকে দিয়ে আমার পায়ের বুড়ো আঙুল চোষাব।

—ভবেনবাবু, তেষ্টায় আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আমি আর পারছি না। খাটিয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমি সরে গেলুম খানিকটা। ভবেনও উঠে পড়ে বলল, তেষ্টা পেয়েছে! তাহলে খা, আমার মুত খা!

দরজা খুলে সে ডাকল, এই লখাই, কানু, একটা গেলাস নিয়ে আয় তো! খেলাধুলো ছেড়ে ছুটে এলো আবার বাচ্চারা। আরও বেশি মজার খেলা দেখবে। একজন নিয়ে এলো একটা গেলাস।

বাচ্চাদের সামনেই পাজামার দড়ি খুলে সেই গেলাসের মধ্যে হিসি করল ভবেন। খানিকটা উপছে পড়ল মাটিতে। বাচ্চারা খিলখিল করে হাসছে। অতি সরল, নিষ্পাপ সেই হাসি।

আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। মনে মনে বারবার বলছি, এনাফ ইজ এনাফ। আমি কারুর সঙ্গে মারামারি করতে যাইনি কখনো, কলেজ জীবনে অন্যদের কাছে মার খেয়েছি বেশ কয়েকবার, তবু উল্টে কারুর গায়ে হাত তুলতে পারিনি। একসময় বন্ধুরা আমাকে মেয়েলি ছেলে বলত। কেউ কেউ বলত, নীললোহিত, তুই শাড়ি পরিস না কেন? যেন শাড়ি পরা মেয়েরা নিষ্ঠুর হতে জানে না!

কিন্তু এখন এই লোকটা আর একটু বাড়াবাড়ি করলেই আমি একে মারব। তারপর যা হয় হোক। ওর সঙ্গে আমার একলা একলা লড়াই হলে আমি ওর সবকটা দাঁত ভেঙে দিতে পারি। ও একটা পারভার্ট।

হিসি ভর্তি গেলাসটা চোখের সামনে তুলে ভবেন বলল, নে খা, তেষ্টা পেয়েছে বলছিলি যে?

—ভবেনবাবু, আর এক পা এগোবেন না। আমি এখন মরার জন্য তৈরি হয়ে গেছি।

–আরে বা…মরবি তো তুই বটেই। তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু এমনি এমনি কি মরবি? তার আগে কত কী হয় তাই দ্যাখ! তোকে মাটিতে চিৎ করে ফেলে বুকে পা রগড়াব। তোর মুখ জোর করে খুলে তাতে হিসি ঢেলে দেব। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে আবার বলল, এই সুবল, জগা, হারু ওদের ডাক তো! আর ঐ যে পেঁপে গাছতলায় পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে, ওকে আগে ডাক। কয়েক জন পুষ্প পুষ্প বলে চেঁচিয়ে উঠল। একজন তার হাত ধরে টেনে আনল।

পুষ্প একটা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে, খুবই রোগা, তার শরীরে কোনো খাঁজ নেই। মুখখানা একেবারে শুকনো। তার শাড়ির রং পাট পচা জলের মতন। ভবেন তাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে বলল, এই পুষ্পর হাত দিয়ে তোকে মুত গেলাব। এই পুষ্প কাজ খুঁজতে গেছল দুর্গাপুরে। এক চুতিয়া অফিসারের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ পেয়েছিল। দেখতে শুনতে ভদ্দরলোকের মতন, ফ্যামিলি আছে, তবু সেই…বাচ্চা, এই পুষ্পর ওপর কী করেছে শোন। বল না, পুষ্প, নিজের মুখে বল

পুষ্প আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছু বলল না।

—পুষ্প আমার সম্পর্কে শালী হয়। আগের বছরে ওর মরদটাকে সাপে কেটেছে। বৃষ্টির সময় বা…জোতদারের কথায় আল মেরামত করতে গেছল। সাপে কাটবার পর তার একটু চিকিৎসে পর্যন্ত করায়নি। তোকে দুর্গাপুরে কে নিয়ে গেল রে, পুষ্প?

পুষ্প কোনো উত্তর দিল না, বাচ্চাদের মধ্যে একজন বলল, বলাইদা, বলাইদা।

—দুর্গাপুরের সেই অফিসারটা পুষ্পর পেট করে দিল। থানায় ডায়েরি করা হলো। তার মধ্যেই সে শালা ভাগল। ট্রান্সফার। পুলিশ বলল, সে অন্য জায়গায় চলে গেছে, এখন আমরা কী জানি?

বাচ্চাদের সামনে এরকম প্রসঙ্গ আলোচনা করতেও লোকটার একটুও আটকাচ্ছে না। দুর্গাপুরের অফিসারটি পুষ্পর ওপর প্রতি রাত্রে কী রকমভাবে জোর করেছে, তাও সে সবিস্তারে বলতে চায়। যেন সে আদালতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ দাখিল করছে এবং আমিই সেই দুর্গাপুরের অফিসার

এবার আমাকে উত্তর দিতে হবেই। শহরের মানুষদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আমি একা কেন ঘাড় পেতে নেব?

আমি বললুম, এসব বাজে কথা কেন আমায় শোনাচ্ছেন? গ্রামে বুঝি ব্যাভিচার হয় না? গ্রামে কেউ অন্যের বউ–মেয়ের সঙ্গে…

— চোপ!

—শহরে তো কত মেয়েই চাকরি করতে যায়, সবারই মোটেই এরকম কিছু হয় না। একটা লোক কী করেছে না করেছে…

—…ব্যাটা। আগে শোন আমার সব কথা…

–না, আমি এসব নোংরা কথা আর শুনতে চাই না।

–তুই শুনবি না তোর বাপ শুনবে!

–আর একটা কথাও নয়। আপনি বেরিয়ে যান এ–ঘর থেকে!

—তবে রে। এই, এই সুবল–জগা–হারুদের ডাক তো…

—যাদের ইচ্ছে ডাকুন। গোবিন্দকে ডাকুন। সে এসে আমার গলা কেটে ফেলুক, আমি আর পরোয়া করি না।

লোকটা মুখে যতই তড়পাক, আসলে ভীতু। আমি ফুঁসে উঠতেই এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। ওকে একটা ঘুষি মারার অদম্য ইচ্ছে জাগছে আমার।

দরজার কাছে কখন সুশীলা এসে দাঁড়িয়েছে, আমি লক্ষ করিনি।

এবারে সুশীলা বলল, এই ভবেন, তোরা বাইরে যা, বাইরে যা!

সুশীলাকে দেখে আবার সাহস ও উৎসাহ পেয়ে ভবেন বলল, এই সুশীলা মাসি এই…টা গরম দেখাচ্ছে আমার ওপর। ওকে আজ আমার মুত যদি না খাওয়াই তো কী বলেছি।

সুশীলা ঠাণ্ডা গলায় বলল, এখন তোরা বাইরে যা। আমি এখানে শোব। এই পুষ্প, কড়াই দুটো মেজে ফ্যাল তো!

ভবেন অবাক হয়ে বলল, সুশীলা মাসি, তুমি এখানে শোবে? এই কুত্তার বাচ্চাটার সঙ্গে?

–হ্যাঁ, দুজন গ্রামসেবক এসেছে। এখানে চ্যাঁচামেচি করবি না। ওদের সঙ্গে কথা বলগে যা। কিছু যেন টের না পায়

আগে ছুটে গেল বাচ্ছারা। তারপর বেরিয়ে গেল পুষ্প। হিসির গেলাসটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে ভবেন বলল, এই তা হলে এখানে রেখে যাই এখন?

–কেন, পরে তোর মুত শুকিয়ে যাবে নাকি? নিয়ে যা ওটা।

ওরা চলে যেতেই সুশীলা আগে দরজাটা বন্ধ করল। তারপর দ্রুত আঁচলের তলা থেকে একটা কলাইকরা বাটি বার করে খাটিয়ার নিচে রেখে বলল, খেয়ে নাও, চট করে খেয়ে নাও। আমি একটু পরে জল এনে দিচ্ছি।

একটা বাটির মধ্যেই ভাত, ডাল আর আলুর ঝোল। একখানা আলু ও একটা কাঁচা লঙ্কা গোঁজা ভাতের মধ্যে।

একজন ক্ষুধার্ত মানুষ কি খাবার দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে? আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করল না। ভবেনের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার মাথায় এমন রাগ চড়ে গিয়েছিল যে খিদের বোধটা একেবারে চলে গেছে।

–আমি খাব না। আমার দরকার নেই!

—খেয়ে নাও গো, দেরি করো না।

–বলছি তো আমার দরকার নেই।

সুশীলা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমার চোখ সোজা তার চোখে।

একটু বাদে সে বলল, আমি আসছি, জল নিয়ে আসছি।

সুশীলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আমি ভাতের বাটিটার দিকে একবার তাকালুম। না, সত্যি আমার লোভ লাগছে না।

জানলার পাশে এসে, নিজেকে আড়াল করে তাকালুম বাইরে। ঐ গাছতলার বেদিটাই এ গ্রামের মিটিং–এর জায়গা। আমাকে এরা ভুল ঘরে রেখেছে, এখান থেকে সব দেখা যায়। জানলা বন্ধ রাখলেও কথাবার্তা শোনা যাবে।

বেদির ওপর দুজন অচেনা লোক বসেছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সাত– আটজন এ গ্রামের পুরুষ। বাচ্ছারা ধারে কাছে নেই। বাচ্ছাদের বোধহয় শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে দূরে থাকার জন্য।

গ্রামসেরক তো পুলিশ নয়। তারা কোনো বাড়ি সার্চ করবে না। হয়তো ডাকাতির খবর তারা জানেও না। জানলেও এই গ্রামের সঙ্গে সেই হাইওয়ের ডাকাতির সংযোগ খুঁজে বার করা তাদের কাজ নয়।

টুকরো টুকরো কথা কানে এলো।

গোপীবল্লভপুর আর ঝাড়গ্রামে সরকারি রিলিফ এসেছে কিছু কিছু। ফুড ফর ওয়ার্ক। তবে প্রতিদিন পঞ্চাশ জনের বেশি কাজ পাবে না। আগে গিয়ে লাইন দিতে হবে, যেতে হবে ভোর ভোর। একদিন কাজ না পেলে রাত্তিরে সেখানে পড়ে থেকে পরের দিনের জন্য চেষ্টা করতে হবে।

একজন রাগী গলায় প্রশ্ন করল, গোপীবল্লভপুর, কি ঝাড়গ্রামে গিয়ে লাইন দিতে হবে। যেদিন যাব, সেদিন যদি কাজ না পাই তো খাব কী!

আর একজন বলল, ও দ্যাখো গে, ওদিককার লোকরাই শুধু কাজ পাবে। আমাদের কপালে লবডংকা। আমরা ওদিকপানে যেতে গেলেই আমাদের ঠ্যাঙাবে।

গ্রামসেবকরা এ কথায় আপত্তি না করে বরং একজন সায় দিয়ে বলল, তা বটে! আদিবাসীরা বড্ড খেপে আছে গো। যাকে দেখছে তাকেই ঠ্যাঙাতে আসছে। আমাদেরই তাড়া করেছিল। ওরা তো একেবারেই খেতে পায় না এখন।

—আমরাই বা কী খেতে পাচ্ছি? মাঠে কোনো কাজ নেই…

সুশীলা ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, জানলাটা বন্ধ করে দাও, জানলাটা বন্ধ করে দাও!

সুশীলা একটা জলের মগ মাটিতে রেখে বলল, এই বারে খেয়ে নাও।

বললাম যে আমার খাবার দরকার নেই

—খাবে না?

—নাঃ।

জলের মগটার দিকে আমার চোখ আটকে গেছে। খিদেটা মরে গেলেও তেষ্টা যায়নি। জলের মগটা দেখে সেই তেষ্টা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। যতই নোংরা মগ হোক, হয়তো সকালের সেই বড় বাথরুমে যাবার একই মগ, তবু খানিকটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।

লাহোর জেলে যতীন দাস, ভগৎ সিং, অজয় ঘোষরা যখন অনশন করেছিলেন, সেই সময় ওদের মনের জোর নষ্ট করে দেবার জন্য সেলের মধ্যে জল আর দুধ ভর্তি কুঁজো রেখে দিত ব্রিটিশ সরকার। যতই খাদ্য প্রত্যাখ্যান করুক, চোখের সামনে জল আর দুধ রাখা থাকলে তারা তেষ্টার চোটে একসময় না একসময় জল দুধ খাবেই।

সেই প্রলোভন কাটাবার জন্য তারা আছড়ে আছড়ে কুঁজোগুলো ভেঙে ফেলেছিলেন!

আমারও ইচ্ছে হলো এক লাথি দিয়ে জলের মগটা উল্টে দিতে।

যতক্ষণ ওরা আমাকে খেতে দেয়নি, জল দেয়নি, ততক্ষণ আমি সত্যিই কষ্ট পাচ্ছিলুম। এখন দিয়েছে, এখন লোভ সামলানোর মতন মনের জোর কোথা থেকে এসে গেল কে জানে।

খাটিয়ার ওপর বসে পড়ে সুশীলা দু’বার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কাতর গলায় বলল, আমি কী করি বলো! আমি তো একটু আগেও ব্যাটাছেলেদের বললুম তোমায় ছেড়ে দিতে। একটা ভদ্দরলোককে কি গ্রামের মধ্যে আটক করে রাখা যায়? আমরা খাব, আর সে খাবে না, এ পাপ কখনো সহ্য হয়!

–কেন হবে না? শহরের লোকেরা পেট ভরে খায়, তোমরা খেতে পাও না। এতে তো তাদের কোনো পাপ হয় না!

–সে আমি জানি না বাপু! চোখের সামনে তো একজন না খেয়ে থাকবে, আর আমি খাব, সে আমি পারি না! তা ব্যাটাছেলেরা বললে, ওকে কখনো ছাড়া যায়? ছাড়লেই বিপদ। মনে করো, তুমি ভালোমানুষের ছেলে, তুমি পুলিশকে কিছু খবর দিলে না। কিন্তু যাওয়ার পথে তুমি যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাও! পুলিশ তখন তোমাকে মেরে মেরে এ গাঁয়ের খবর জেনে নেবে! পুলিশ তোমাকে গুঁতোলে তুমি কি পেটে কথা চেপে রাখতে পারবে? আমাদের যে বড় বিপদ!

আমি চুপ করে রইলাম। সুশীলার এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। আমি যদি বলি, কোনোক্রমেই আমি তোমাদের গ্রামের নাম ফাঁস করব না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? তাছাড়া, পুলিশ আমাকে আড়ং–ধোলাই শুরু করলে সত্যিই আমি সব কথা বলে দেব কি না তাই বা কে জানে? আমার তো আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

সুশীলা আবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কী বিপদেই যে পড়েছি! ছেলেপুলেগুলো খিদের জ্বালায় ট্যাঁ ট্যাঁ করছিল, তাদের মুখে দুটো ভাত দিতে পারিনি, আর ক’দিন সেরকম চললে একটাও বাঁচত না। ঐ রতন–গোবিন্দরা বলল বড় সড়কে গিয়ে বাস আটকাতে, তারপর যে এতদূর ব্যাপার গড়াবে কে জানত? এখন পেটে দুটো ভাত পড়েছে বটে, কিন্তু সবসময় থানা–পুলিশের ভয়। এদিকেও মরণ, ওদিকেও মরণ।

—সকালে কি পুলিশ এসেছিল?

—না। এমনি এমনি ভয় পেয়েছিল সবাই। কে যেন একটা গাড়ির আওয়াজ শুনেছিল! তবে সাবধানের মার নেই। পুলিশ নাকি রাতের বেলা আসে। ঘর থেকে বউ–ঝিদের টেনে বার করে। তুমি খাবে না? একটু খেয়ে নাও, তাড়াতাড়ি করো। নইলে কে আবার কখন এসে পড়ে।

—আমার দরকার নেই। তোমাদের খাবারে আমি ভাগ বসাব না।

—ঐ ভবেনের কথায় তোমার রাগ হয়েছে। ঐ হারামজাদাটা ঐরকমই। সব সময় ব্যাকা ব্যাকা কথা। অথচ এক ফোঁটা মুরোদ নেই। খাও একটু। মুখে কিছু না দিলে যে কেতরে পড়বে। তোমাদের তো অভ্যেস নেই!

বাইরে থেকে গোবিন্দর গলার আওয়াজ শোনা গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, ও সুশীলাদি, দরজা খোলো। তোমার সঙ্গে কথা আছে!

সুশীলা বলল, দরজা খোলাই আছে।

দরজা ঠেলে ভেতরে এলো গোবিন্দ। এবার তার হাতে অস্ত্র নেই। মুখে একটা ব্যস্ত–সমস্ত ভাব।

প্রথমেই তার নজর পড়ল ভাতের বাটিটার ওপর। চোখ যেন আটকে গেল সেখানে।

–সুশীলাদি, তুমি ওকে ভাত দিয়েছ? তোমাকে বারণ করা হলো…

—দিয়েছি তো আমার নিজের ভাগেরটা দিয়েছি। তাতে তোদের কী বলার আছে?

–তাই বা দেবে কেন? না খেয়ে থাকতে কেমন লাগে সেটা ও বুঝুক! ওকে কিছু দেওয়া হবে না।

—ওকে ভাত দেওয়া হয়েছে, তবু ও খায়নি। খাবে না বলছে!

–তুমি দিলে কেন, সেই কথা বলো!

–দ্যাখ গোবিন্দ, আমার ওপর বেশি চোপা করিসনি। তোকে কেউ সব ব্যাপারে সর্দারি করতে বলেনি। ওকে দিয়েছি তাও তো খাচ্ছে না। বাড়িতে একটা লোক উপোসী, আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি খেয়েছি।

–ও খেল না কেন?

–তুই আমায় কী বলতে এসেছিস, বল! চল, বাইরে চল!

– ও খেল না কেন, ঘেন্না? আমাদের হাতের রান্না খাবে না? এই হারামজাদার মামাবাড়িতে আমি দিনের পর দিন রান্না করে খাইয়েছি, গাধার মতন খাটনি খেটেও কোনোদিন একটা ভালো কথা শুনিনি।

গোবিন্দর সঙ্গে আমার আর কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এবার আর না বলে পারলুম না।

– দ্যাখ গোবিন্দ, মিথ্যে কথা বলবি না, আমার ছোটমামারা কোনোদিন তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি।

গোবিন্দ একেবারে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল, কোমরে দুই হাত। মুখ বিকৃত করে বলল, তোদের সব শালাকে আমার বেশ চেনা হয়ে গেছে। তোদের দেখলে আমার ঘেন্না হয়! তোদের কাছে মানুষের চেয়ে কুকুরের দাম বেশি। থুঃ!

এক দলা থুতু সে ছিটিয়ে দিল আমার খোলা বুকে।

সুশীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী যে কাণ্ড সব করিস তোরা। চল গোবিন্দ, বাইরে চল।

থুতুটা গড়িয়ে পড়ছে আমার বুক দিয়ে। তা আমি মোছার চেষ্টা করলুম না গোবিন্দর সামনে।

শান্ত গলায় বললুম, সুশীলাদি, ভাত নষ্ট করতে নেই। বাটিটা নিয়ে যাও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *