শেষ দেখা হয়নি – ৩

শুনেছি, ফাঁসির আসামীও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

আধো–জাগা, আধো–নিদ্রায় আমারও রাতটা কেটে গেল। ঘরখানা অতি ছোট, মাঝখানে একটি খাটিয়া পাতা, তারপর আর বিশেষ নড়াচড়া করার জায়গা নেই, একটি মাত্র জানলা। ঘরের মধ্যে একটা অসহ্য ভ্যাপসা গন্ধ, মনে হয় কোনো ইঁদুর–পচা গন্ধের মতন। তবু ঘুম আসে।

ঘুম ভাঙার পরই সেই গন্ধটা এসে আবার নাকে লাগল। জানলা দিয়ে সকালের নরম আলো এসে পড়েছে। আমি প্রথমেই খাটিয়ার তলায় উঁকি দিয়ে দেখলাম, সেখানে কোনো ইঁদুর–মড়া আছে কি না। খাটিয়ার তলায় একগাদা ছেঁড়াখোঁড়া বস্তা, তার মধ্যে কিছু নেই। বোধহয় সুদিনের সময় এইসব বস্তায় করে ফসল জমিয়ে রাখা হতো এই ঘরে। এ বছর ইঁদুরেরও খাদ্য নেই।

ঘরের দরজাটা বন্ধ। কাল রাতেই লক্ষ করেছি, এ ঘর থেকে বেরুতে হলে আরও দুটি ঘরের মধ্যে দিয়ে বেরুতে হয়। সেই দু’ ঘরে সুশীলা, তার ছেলের বউ ও আরও তিনটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে শুয়ে থাকে। বাড়িতে কেরোসিন নেই। একটা চ্যালাকাঠ জ্বেলে সুশীলা ও হাবু আমাকে এই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

জানলাটা তেমন মজবুত নয়, কাঠের গরাদ দেওয়া, সে কাঠেরও অবস্থা শোচনীয়। মাঝরাতে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ঘরে, দমবন্ধ গরম ও ভ্যাপসা গন্ধের থেকে খানিকটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য আমি এক সময় উঠে বেশ কিছুক্ষণ ঐ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জ্যোৎস্নালোকে এক টুকরো গ্রাম্যদৃশ্য দেখে বেশ প্রথাসিদ্ধ সুন্দরই মনে হয়, বোঝাই যায় না যে আশেপাশে মৃত্যু থাবা উঁচিয়ে ওৎ পেতে আছে।

জানলা ভেঙে পালাবার মতন কোনো রোমহর্ষক ইচ্ছে আমার জাগেনি একবারও। মাথার মধ্যে একটা নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, এই সুশীলার কাছ ছেড়ে যাবার চেষ্টা করলেই আমার বেশি বিপদ হবে। জানলার বাইরের রাস্তায় সেই কুকুর দুটোকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি, গোবিন্দ–রতনরা এ–বাড়ির ওপর নিশ্চয়ই নজর রেখেছে। আমার আয়ু এখন সুশীলার হাতে।

সকাল হলেই আমাদের শহুরে গলায় চা–তেষ্টা পায়। এরা নিশ্চয়ই আমাকে চা দেবে না! ধ্যাৎ, যতসব অদ্ভতু চিন্তা, এদের বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থাই থাকার কথা নয়। এরা ভাত খেতে পায় না, চা খাবে? এ গ্রামে কি চায়ের দোকান আছে?

এরা আমার সিগারেট–দেশলাই কেড়ে নেয়নি। প্যাকেটে এখনও তিনটে সিগারেট আছে, এই তিনটে ফুরিয়ে গেলে…..যদি তার পরেও বেঁচে থাকি, তা হলে এই সুযোগে সিগারেট টানা ছেড়েই দেব। ধূমপান না বিষপান! নেশার দাসত্ব!

খালি পেটে একটা সিগারেট ধরিয়ে দু’ টান দিতেই পেটটা মুচড়ে উঠল। শরীরের নানা অঙ্গ অধিকাংশ সময়ই চুপচাপ থাকে। কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব দাবি আছে। যখন তারা জানান দেয়…এখন আমার প্রধান প্রয়োজন…

দরজাটা খুলে গেল। সুশীলাকে দেখেই আমি কাতর গলায় বললুম, এক গেলাস জল…

নিঃশব্দে ফিরে গিয়ে সুশীলা একটি কলাইকরা গেলাসে জল নিয়ে এলো। আমি ঢকঢক করে জলটা শেষ করার পর সে আমাকে আদেশের সুরে বলল, এবার বাইরে এসো।

মাঝের ঘরটিতে একটি ছেঁড়া কাঁথা মেলে তার ওপর শুয়ে আছে একটি রমণী। দেয়ালের দিকে মুখ ফেরানো। আন্দাজে বুঝলুম, সুশীলার ছেলের বউ, যার একটি সন্তান মারা গেছে কয়েকদিন আগে। সুশীলার ছেলে কোথায়?

পরের ঘরটি ফাঁকা। তারপর একটি ছোট দাওয়া ও উঠোন। উঠোনে কয়েকটি ছেলেমেয়ে খেলা করছে। মাটিতে চৌকো দাগ কেটে, সোডার বোতলের ছিপি ছুঁড়ে ছুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা। অভুক্ত শিশুরাও খেলাধুলো করে! কিংবা, আজ খাবার পাবে, সেই সম্ভাবনার আনন্দ সঞ্চারিত হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। বাস লুট করে ওরা খাদ্য পায়নি, টাকা পেয়েছে, সেই টাকায় চাল কেনা যাবে।

আমাকে দেখে বাচ্চারা খেলা থামিয়ে তাকিয়ে রইল। যেন আমি একটা অদ্ভুত প্রাণী। কোনো বন্দী তো দূরের কথা, এদের বাড়িতে আগে বোধহয় কোনো প্যান্ট– শার্ট পরা অতিথিও আসেনি।

এইসব গ্রাম্য উঠোনে সাধারণত হাঁস–মুরগি বা ছাগলছানা ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের কোনো চিহ্নও নেই। সম্ভবত সেসব আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। কোনো তরিতরকারির গাছও চোখে পড়ে না।

দাওয়ার এককোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বড়কাকা ও গোবিন্দ। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বৃদ্ধ। বড়কাকা ও গোবিন্দ খর চোখে তাকাল আমার দিকে, আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এই সকালেই কোনো খারাপ কথা শোনার একটুও ইচ্ছে নেই আমার।

সুশীলা সেই বৃদ্ধটিকে বলল, এরে মাঠে নিয়ে যাও গো। জলদি জলদি ফিরে এসো।

বৃদ্ধটির হাতে একটি টিনের মগ। মাটি থেকে আর একখানা জং–ধরা মগ্‌ তুলে সে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ছোট ছেলেমেয়েরা শুধু যে খেলা থামিয়ে দিয়েছে তাই–ই নয়, তারা একেবারে নিস্তব্ধ, চিত্রার্পিত। বাইরের রাস্তায় জমা হয়ে আছে আট–দশজন নারী–পুরুষ, তারাও হাঁ করে দেখছে। এদের পাশ দিয়ে যেতে, হবে আমাকে, এরা কি আমার গায়ে থুতু দেবে, কেউ লাথি–ঘুষি মারবে?

এতকাল মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে আমার স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে, মানুষের ঘৃণা কিংবা উপেক্ষা আমার একদম সহ্য হয় না। বিনা দোষে আমায় কেউ শাস্তি দিতে চাইলে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়, ছেলেবেলা থেকেই আমার এইরকম চোখের রোগ।

লোকেরা সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমি চটি রেখে এসেছি ঘরে, খালি পায়ে হাঁটা অভ্যেস নেই, কিন্তু এখন আর চটিটা নিয়ে আসার কথা বলা যায় না। খানিকটা দূর যাবার পর, আগের রাতের সেই তেঁতুলগাছের পাশের ডোবাটা থেকে আমার সঙ্গী বৃদ্ধের দেখাদেখি আমিও মগে জল ভরে নিলুম। যত না বয়েস, তার চেয়েও লোকটিকে বেশি বৃদ্ধ দেখায়, মুখে কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোটরগত চক্ষু, ঈষৎ কুঁজো হয়ে হাঁটে।

এই বৃদ্ধকে আমার পাহারাদার করে পাঠানো হচ্ছে গ্রামের বাইরে? নাকি এটাও একটা ফাঁদ? আমি পালাবার চেষ্টা করলেই একদল লোক রে–রে করে তেড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর!

ডোবাটার অন্যদিকে ঢালু জমিতে কিছুক্ষণ হাঁটার পর খানিকটা জায়গা জুড়ে আশশ্যাওড়ার ঝোপ। বৃদ্ধটি এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, এবার সে বলল, আমার সামনে জামা–পেণ্ট খুলে রাখো। সব খুলে আমার হাতে দাও। তারপর ঐ ঝোপের ঐ দিকে যাও!

জামা–প্যান্ট খুলে দিলে আমি আর উলঙ্গ অবস্থায় পালাতে পারব না, এটাই এরা ভেবেছে?

আমি দ্রুত জামা–প্যান্ট খুলতে লাগলুম আমার নিজের প্রয়োজনে। তার থেকেও দ্রুত আর একটা চিন্তা মাথায় খেলে যেতে লাগল। ফাঁকা মাঠে কাছাকাছি কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। আমি যদি এই বুড়োটার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে ওর মুখ আর পা বেঁধে ফেলি, তারপর দৌড় লাগাই, গ্রামের লোক আর আমাকে ধরতে পারবে?

কিন্তু মগটার দিকে তাকিয়ে আমি শিউড়ে উঠলুম। মগটা ফুটো, টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, প্রায় এক–চতুর্থ অংশ খালি হয়ে গেছে। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, আমাকে দ্রুত কাজ সারতে হবে! প্যান্ট–শার্ট বৃদ্ধটির গায়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি দৌড়ে চলে গেলুম।

খানিকবাদে বুড়োটি দু’ তিনবার চেষ্টাকৃত গলা খাকারির আওয়াজ করতে আমি বুঝতে পারলুম। সে আমাকে ফিরে আসার ইঙ্গিত জানাচ্ছে। আকাশের নিচে, খোলা মাঠের মধ্যে নিজের নগ্নতায় আমার একটুও লজ্জা বোধ হচ্ছে না। এর মধ্যেই রোদ্দুরে বেশ তাপ। মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে আর একটি গ্রাম।

ফিরে এসে দেখি বৃদ্ধটি আমার জামার পকেট সার্চ করে সিগারেটের প্যাকেটটি বার করেছে। খানিকটা লজ্জিত ভাব করে জিজ্ঞেস করল, নেবো একটা?

আমি ওদের বন্দী, আমার জান–মাল সবই ওদের অধিকারে, তবু একটা সিগারেটের জন্য ওর অনুমতি চাওয়ার মাধুর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম। এইসব ছোটখাটো ব্যাপারেই তো বেঁচে থাকার সুখ।

দু’জনে দুটি ধরিয়ে ফেলে দিলাম প্যাকেটটা। যাক, এ–জন্মের মতন সিগারেটের বিদায়! প্যান্টটা পরে নিয়ে জামাটা ঝুলিয়ে রাখলাম কাঁধে। এই গরমের মধ্যে জামা গায়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। গত রাত্রির ঘামে ভেজা জামা কোনোদিন সকালবেলা পরিনি।

আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বুড়োটি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের গেরামে এসেছ কেন গো?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর মুখের দিকে। এই বুড়োটা কি কিছু জানে না? যতদূর মনে হচ্ছে, ডাকাতির সময় এ গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি থেকে একজন দু’জন মানুষ উপস্থিত ছিল, যাতে সকলেরই সমান অধিকার থাকে। বুড়োটিকে নিয়ে যাওয়া হয়নি, কিন্তু রাত্তিরে আমরা ফেরার পরেও কি কিছু শোনেনি?

বুড়োর চোখ দুটি ঘোলাটে ঘোলাটে। হয়তো এর মাথার ঠিক নেই। খিদের জ্বালায় মানুষের পাগল হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

আমি বললুম, আমি তো নিজে আসিনি, ওরা আমাকে ধরে এনেছে।

—অনেক বছর আগে, তোমার মতন আরও জনাতিনেক ছোকরাবাবু এই গেরামে এসেছিল। তুমিও কি. তাদের দলের?

—কারা এসেছিল, আমি তো তা জানি না।

— তারা এসে মিটিন্ করত। তারা বলেছিল, জগন্নাথ মণ্ডলের জমিতে ঝাণ্ডা পুঁতে দিতে। আমরা শুনি নাই, ভয় পেয়েছিলাম। জগন্নাথের তিন তিনটে দামড়া– জোয়ান ছেলে, তাদের চোখের দিকি চাইলেই ভয় করে। এককালে ঐ জগন্নাথ মণ্ডলের বাড়িতে আমি মুনিষ খেটিছি, ঐ ছেলেগুলারে কোলেপিঠে নিয়িছি, এখন তা মানতে চায় না, আমারে দেখলে চোখ রাঙায়।…জগন্নাথ মণ্ডলের এক মেইয়ের বিয়ের দিনকে আমি চারখান মাছ খেয়েছিলাম। চার টুকরো মাছ, জীবনে আর খাইনি।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তুমি কি সেই ছোকরাদের দলের লোক?

আমি ভেবেছিলুম এ বুড়োর কথা আর শেষ হবে না। যে–ভাবে সে জগন্নাথ মণ্ডলের পারিবারিক কাহিনী বলতে শুরু করেছিল, তাতে কখন যে থামবে তা বোঝা যাচ্ছিল না। এবারে আমি একটু সুযোগ পেয়ে বললুম, না গো, খুড়ো, সে তো অনেকদিন আগেকার কথা! সেই সত্তর সালের নকশাল ছেলেদের কথা বলছ তো?

বৃদ্ধটি আমার মুখের দিকে কয়েক পলক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমারে খুড়ো বললে কেন? আমি তোমার কোন্ বাপকেলে খুড়ো? একটা কিছু ডাকলেই হলো? ডাকের মধ্যে একটা আক্কেল থাকবে না?

বৃদ্ধের গলার তীক্ষ্ণতা দেখে একটু হকচকিয়ে গেলুম। একজন বৃদ্ধ লোককে খুড়ো বলে ডাকায় দোষের কী হয়েছে? আমতা আমতা করে বললুম, না মানে, তুমি বয়েসে অনেক বড়, সেইজন্য।

—বয়েসে বড় তো কী হয়েছে? তাইলে তো জ্যাঠা হতে পারি, ঠাকুদ্দা হতে পারি, শুধু খুড়ো বললে কেন?

—কাল রাতে তোমারই বয়েসী একজনকে সবাই বড়কাকা বলছিল, তাই ভাবলুম…

—ঐ সতীশ? ওডা তো আমার হাঁটুর বয়েসী। ওরে কাকা বললে তুমি আমারে বটঠাকুদ্দা বলবে না কেন?

– আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে। তোমাকে বটঠাকুদ্দাই বলব। বটঠাকুদ্দা তো ভালো। আসলে, তোমাকে খুড়ো বলে ফেলেছি, তার কারণ আমার নিজের এক কাকা ছিল, অনেকটা তোমার মতন দেখতে মুখখানা। তোমার থেকে বয়েসে অনেক ছোট ছিল অবশ্য। কিন্তু তোমাকে দেখে সেই কাকার কথা মনে পড়ল, তাই হঠাৎ খুড়ো বলে ফেললুম। আমার সেই কাকা মারা গেছেন।

এবার বৃদ্ধ যেন একটু নরম হয়ে বিড়বিড় করে বলল, আমার মত দেখতে ছিল। মরে গেছে!

আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, হ্যাঁ আমার সেই কাকা দারুণ ভালো লোক ছিল। গরিব–দুঃখীদের জন্য তাঁর মন কাঁদত। আমার কাকা গ্রামে গিয়েছিল জোতদার আর সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, অনেকদিন গ্রামে গ্রামে চাষীদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল, তারপর হঠাৎ পুলিসের হাতে ধরা পড়ে গেল। পুলিস তাকে থানাতেও নিয়ে গেল না, মাঠের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলল।

— পুলিস মেরে ফেলল?

—হ্যাঁ গো বটঠাকুদ্দা! তাকে মারার পর গোটা গ্রামের লোক ক্ষেপে গিয়ে পুলিসদের তেড়ে গেল…সেই থেকে পুলিসদের ওপর আমার এত রাগ…

আমার কাল্পনিক কাকার করুণ কাহিনী নিয়ে এই বৃদ্ধের মন ভেজাবার চেষ্টা করতে করতে আমি যেন আত্মপক্ষ সমর্থনেরও একটা রাস্তা পেয়ে গেলুম। পুলিসদের ওপর আমাদের যে পারিবারিক ভাবেই রাগ রয়েছে, সেটা যদি এদের বোঝাতে পারা যায়।

বৃদ্ধটি আবার জগন্নাথ মণ্ডলের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলল, জগন্নাথ মণ্ডল লোক তেমন খারাপ ছিল না, শরীলে দয়ামায়া ছিল একটু একটু, কিন্তু তার ছেলেগুলা যেন কথায় কথায় হাতে মাথা কাটে। একটা আছে নেরঞ্জন, সেডা একেবারে রাবণ রাজা, রোজ মাংস খায়, বন্দুক কিনেছে। আমরা ছিলাম ভাগচাষী, পাঁচ বছর আগে নাম খারিজ করে দিল। আমার একটা নাতি গেল থানায় নালিশ জানাতে, তা বড়বাবু তারে কী ভয় দেখাল কে জানে, সে সেই যে গোপীবল্লভপুরের দিকে পালিয়ে গেল, আর এলো না! তুমি নেরঞ্জন মণ্ডলরে চেনো?

—না বটঠাকুদ্দা। আমি তো এদিকের লোক না!

–তবে এদিকে এসেছ কেন?

—আমি বাসে করে রাঁচি যাচ্ছিলুম, তোমার গ্রামের লোক আমাকে ধরে এনেছে।

–আমাদের নিজেদের প্যাটে ভাত নেই। তোমারে খাওয়াবে কে?

–তা তো জানি না।

–এই গেরামে কাউর একটুকরা জমি নাই। যে–কয়জন ভাগচাষী ছিল, তাদের নাম খারিজ হয়ে গেছে। সরকার কী আইন করেছে, তাই জমির মালিকরা ভয় পেয়ে আর বর্গা রাখতে চায় না। চাষের সময় রোজ দিয়ে আমাদের মজুরি খাটায়। বৃষ্টি না হলে চাষ নাই, চাষ নাই তো আমাদেরও কাজ নাই। আর কাজ নাই তো খাওয়া নাই। হেঃ, কী যে ভগবানের বিচার।

–কেন, সরকার তোমাদের সাহায্য দেয় না?

— সরকার মানে পুলিস? সেধে সেধে কেউ পুলিসের কাছে যায়। হেঃ! –না, পুলিস কেন, সরকার মানে গভর্নমেন্ট।

— পুলিস ছাড়া আবার সরকার কোথায়? গভর্নমেন্ট তো থাকে কলকাতা শহরে। অরা আমাদের কথা জানবে কেমন করে?

–বি ডি ও অফিস নেই? সেখান থেকে সাহায্য করে না কিছু?

—তুমি কোথাকার ভূত হে? কিছুই জানো না? বিডিয়ো আফিস আছে, থাকবে না কেন, আছে, কুলতলী থানায় বিডিয়ো অফিস, তারা চাষীদের বীজধান দেয়, পোকা মারার ওষুধ দেয়, চাষের সময় টাকা হাওলাৎ দেয়। দেবে না কেন, দেয়। শুনিছি, দেয়।

–তোমরা সেগুলো পাও না?

– আরে রাম, কিছুই বোঝে না। বিডিয়ো আফিস চাষীদের দেয়, কিন্তু আমরা কি চাষী? আমাদের কি জমি আছে? আমরা অন্যের জমিতে খাটি। দিনমজুরি করি। জমির মালিক যদি আমাদের কাজ না দেয়, তবে ঐসব আফিস–টাফিস কী করবে? আকাশে বৃষ্টি নাই, আমাদের পেটে কিল! একটা খোকা তো মরেই গেল কয়দিন আগে।

কথা বলতে বলতে আমরা আবার সেই ডোবার কাছে তেঁতুলতলায় পৌঁছে গেলাম। এখানে কয়েকজন নারী–পুরুষ দাঁড়িয়ে। এরা এখানে স্নান করছে না, কাপড় কাচছে না, এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। সকালবেলা উঠে এদের কিছুই করবার নেই।

বটঠাকুদ্দা ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাল এসেছে? ওরে সিতু, এসেছে কিছু?

একজন উত্তর দিল, আনতে গেছে। আনতে গেছে।

—কে গেল? কোন্ বাজারে গেল?

—একজন যাবে কেন, চারজন গেছে ভিন্ন ভিন্ন বাজারে। একজন গিয়ে এক বস্তা চাল কিনলে লোকে সন্দেহ করবে না?

একটি স্ত্রীলোক আমার দিকে খরচোখে চেয়ে থেকে অন্যদের বলল, এই চুপ কর, চুপ কর, ঐসব কথা এখন থাক।

সবাই চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার গায়ে ফুটছে শত শত আলপিন।

বটঠাকুদ্দা বলল, এই সিতু, তোরা এই বাবুটাকে নিয়ে যা। সুশীলার কাছে গচ্ছিত করে দিবি। আমি একটু পরে যাব।

এদের কোনো কাজ ছিল না, এখন একটা কাজ পেয়ে গেল। শুধু সিতু একলা নয়, আমার পেছন পেছন এলো তিনজন। বৃদ্ধটির সঙ্গে আমার মোটামুটি ভাব জমে গিয়েছিল, তার কাছ থেকে “আরও অনেক কিছু জানার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আবার পড়লুম নতুন লোকের হাতে। মনটা খিঁচড়ে গেল আবার।

মাটির রাস্তা একেবারে খটখটে শুকনো। এটা জুন মাস, এই সময় গ্রামের রাস্তা কাদায় প্যাচপেচে হয়ে থাকার কথা। অনেক জায়গায় মাটি ফেটে ফেটে গেছে। মহাশূন্যে মানুষের তৈরি যে–সব রকেট উড়ছে, সেখান থেকে কি এইসব গ্রামের দৃশ্য দেখা যায়? এই গ্রাম থেকে ওপরের দিকে তাকালে রং–চটা আকাশ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না।

রাস্তাটা দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে এক জায়গায়। আমি অন্যমনস্কভাবে ডান পাশের রাস্তাটা ধরতেই সিতু আমার পিঠে একটা লাঠির খোঁচা মেরে বলল, এই হারামজাদা, ঐদিকে কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে ফের!

অপমানিত হবার বদলে আমার মনে পড়ে গেল আব্বাসউদ্দীনের একটি গান! বাদা মুড়াইয়া দাও ওরে চাষী ভাই…। সেই গানের মধ্যে হঠাৎ একটা গদ্য কথা আছে, ও বলদের পো, যাও কই! চাষীর বলদটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছিল, তাকে পাচনবাড়ি মেরে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। আমি সেই চাষীর বলদ!

প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই। আমার প্রত্যেকটি কথা আমার বিরুদ্ধে যাবে। গ্রামের মানুষরা সাধারণত সরল, সাদাসিধে, দয়ালু হয় এইরকমই জানতুম। দিনের পর দিন পেটের মধ্যে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা খিদে এদের হিংস্র করে তুলেছে। এই ছেলেগুলির হাতে কোনো কাজ নেই, এরা একটা মানুষ চরাবার কাজ পেয়েছে, তাতে সময় কাটরে খানিকটা।

এদের চাষের জমি নেই বলেই নিজস্ব হাল–বলদ নেই। গ্রামে একটাও গোরু দেখিনি, একটা মুরগির ডাক শুনিনি, একটাও ছাগলছানা ছুটে গেল না। সব বেচে দিয়েছে? গ্রাম ভর্তি শুধু কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ

গ্রামের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় সুশীলার বাড়িটাই বেশ বড়। এক সময় এদের অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল মনে হয়। এক সময় মানে কতদিন আগে তা কে জানে! এদের গোরু নেই বটে, কিন্তু শূন্য গোয়াল ঘর আছে। উঠোনের এক পাশে একটা ঢেঁকিঘর। তার পাশে কয়েক সার পেঁপে গাছ, কচি কচি পেঁপে ফলে আছে। এখনও খাবার মতন হয়নি। এদের বাড়ির সংলগ্ন ছোট একটি পুকুরও রয়েছে দেখছি। কাছেই একটা অশত্থ গাছের গোড়ায় মাটির গোল বেদি, সেটা একটা আড্ডার জায়গা মনে হয়!

বড়কাকা আর গোবিন্দ এখনো বসে আছে সুশীলার বাড়ির দাওয়ায়, সামনে একটি ছোটখাটো ভিড়।

গোবিন্দ একবার আমার চোখের দিকে তাকাতেই আমি সোজা এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তার হাত চেপে ধরলাম।

কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে। সবার সামনেই বলতে হবে।

–গোবিন্দ, তুমি তো আমায় চেনো। আমি কোনোদিন তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি, তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তোমায় যারা অপমান করেছিল, তাদের আমি চিনিই না…

গোবিন্দ এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কড়া গলায় বলল, সুশীলাদি, এর ব্যবস্থা করো, এখান থেকে হঠাও। নইলে রাগের চোটে আমি কী করে ফেলব তার ঠিক নেই।

দুটি ছেলে পেছন দিক থেকে আমায় চেপে ধরে টানল। তবু আমি চেঁচিয়ে বললুম, গোবিন্দ, একটা কথা শোনো। আমার সঙ্গে যে কাগজের বাক্সটা ছিল, সেই বাক্সটা তোমরা রেখে দাও, শুধু ভেতরের কাগজগুলো আমায় দিয়ে দাও, ওগুলো তো তোমাদের কিছু কাজে লাগবে না, তারপর আমি চলে যাব, পুলিসে খবর দেব না, বিশ্বাস করো, তোমাদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই…

তিন–চারজন ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে তুলে ফেলল শূন্যে, আমার কথা শেষ করতে দিল না, একজন জোরে জোরে চাপড় মারতে লাগল আমার মুখে। তারা আমাকে নিয়ে চলল ঘরের মধ্যে।

শুনতে পেলাম, গোবিন্দ চেঁচিয়ে বলছে, শালাকে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খেতে দিবি না!

ভেতরের সেই ছোট ঘরটার দরজার কাছে এসে ওরা আমাকে ছুঁড়ে দিল মাটিতে। খাটিয়ার পায়ায় ঠুকে গেল আমার কপাল। লাগল বেশ জোরে। উঠে বসবার পর কপালে হাত বুলিয়ে তরল কিছু ঠেকল না।

সেই অবস্থাতেও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলাম, যাক, মাথা তো ফাটেনি!

দরজাটা ওরা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেছে। জানলাটা তো খোলা আছে, কোনো একটা জানলাহীন অন্ধকূপেও তো এরা রাখতে পারত আমাকে! সব অবস্থারই একটা ভালো দিক থাকে।

কাল দুপুরের পর থেকে আর কিছুই খাওয়া হয়নি। কেন যেন আমার একটা ধারণা হয়েছিল, মাঠ থেকে ফিরে আসবার পর এরা মুড়িটুড়ি কিছু একটা খেতে দেবে আমায়। বন্দীদেরও খেতে দেওয়া হয়। এদের কি কিছুই নেই?

গোবিন্দর হুমকি শুনে আরও ভয় করতে লাগল। সারাদিন জল খেতেও দেবে না? উপোষ করে তবু থাকা যায়, কিন্তু একেবারে নির্জলা? এখনই আমার তেষ্টা পেতে শুরু করেছে!

যাঃ আর সিগারেটও নেই। সিগারেটের একটা উপকারিতা তো আছেই, বেশ খিদে কমিয়ে দেয়! আমার হ্যাণ্ডব্যাগের মধ্যে দু’ প্যাকেট সিগারেট ছিল, কোথায় সেই হ্যাণ্ডব্যাগ! এরা এনেছে, না বাসেই রয়ে গেছে? বাসে থেকে যাওয়ার চেয়ে এরা যদি আনে, তবে…তাতেই বা আমার কী লাভ হতো কে জানে!

প্রায় আধঘণ্টা খাটিয়ার ওপর চুপ করে বসে রইলুম। দিনের বেলা এরকম একটা সময় একেবারে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকার ঘটনা কি আমার জীবনে কখনো ঘটেছে? সব সময়ই তো কিছু না কিছু করি, হাতে একটু সময় থাকলেই চোখের সামনে বই বা পত্রিকা মেলে ধরি। চুপ করে কিছু চিন্তা করার সময়ও তো আমাদের নেই।…

আমার ছোটমামার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে একজন সরকারি অফিসার থাকেন। স্বামীস্ত্রী, কোনো কাচ্চাবাচ্চা নেই। দরজায় ভদ্রলোকের নাম লেখা দেখেছি, দু’– একদিন সিঁড়িতেও চোখাচোখি হয়েছে, আলাপ হয়নি। মুখ দেখলে নিরীহ ভালোমানুষ বলেই মনে হয়। ছোটমামার মুখেই শুনেছি, পরিবারটি নির্বিরোধী, কারুর সাতে পাঁচে থাকে না, কখনো ঐ ফ্ল্যাটের মধ্যে চ্যাঁচামেচিও শোনা যায় না।

সেই ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েটির নাম পুষ্প! সতেরো–আঠারো বছর বয়েস, অনেকটা শাবানা আজমীর মতন মুখের গড়ন।”পুষ্পকে আমি দেখেছি অনেকবার, কাজের মেয়ে হলেও সে বেশ ফিটফাট পরিচ্ছন্ন থাকে, মুখখানা হাসি মাখা, তার দিকে তাকাতে ভালো লাগে। ছোটমামাদের ফ্ল্যাটেও সে মাঝে মাঝেই আসত। টুকটাক এটা সেটা নেবার জন্য। পুষ্পর সঙ্গে কোনোদিন আমার একটাও কথা হয়নি, কিন্তু তাকে আমি চিনি। কাজের মেয়ে হোক বা যাই–ই হোক, সে একটি আকর্ষণীয় চেহারার যুবতী।

উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়ে পুষ্পর সঙ্গে ছোটমামার ফ্ল্যাটের রান্নার লোক গোবিন্দর যদি ভাব–ভালোবাসা হয়, সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। পুষ্পর বাবা–মা নেই, মনোহরপুকুরের এক বস্তিতে তার দিদি থাকে, সেই দিদিও একজন পেশাদার ঠিকে ঝি। আর গোবিন্দ মেদিনীপুরের এক গ্রামের গরিবের ছেলে।

দুপুরবেলা সরকারি অফিসার গাঙ্গুলিবাবু এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যান। ফ্ল্যাটে পুষ্প একলা থাকে, সে খুব বিশ্বাসী, দুপুরবেলা কোনো লোককে দরজা খুলে দেয় না। একদিন দুপুর দুটোর সময় গাঙ্গুলিবাবু অফিস থেকে হঠাৎ বাড়ি চলে এলেন। তাঁর শরীর খারাপ লাগছিল। প্রেসার বেড়েছে। দরজায় বেল দেবার পর দরজা খোলে না। তিনি কলিং বেলের বোতামে আঙুল টিপে রইলেন, উল্টো ফ্ল্যাটের লোকজনরা সেই আওয়াজে জেগে গেল। কিছুক্ষণ বাদে পুষ্প দরজাটা খুলে সামান্য ফাঁক করে ফ্যাকাসে গলায় জিজ্ঞেস করল, দাদাবাবু, আপনি…আপনি ফিরে এলেন?

বাড়ির মালিকের কি যে–কোনো সময়ে ফিরে আসার অধিকার নেই? দুপুরবেলা অন্য লোককে দরজা খুলতে নিষেধ করা হয়েছে বলে পুষ্প কি তার দাদাবাবুকেও ভেতরে ঢুকতে দেবে না? গাঙ্গুলিবাবু জোর করে দরজা ঠেলে ঢুকলেন এবং ঢুকেই তিনি বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধ পেলেন। গাঙ্গুলিবাবু সিগারেটই খান না। তাঁর নাকে এই সব গন্ধ বেশি লাগবেই।

নিজের বেডরুমে একবার উঁকি দিয়েই তিনি ছুটে গেলেন বাথরুমে। সেইখানেই জড়োসড়ো অবস্থায় গোবিন্দকে পাওয়া গেল। গাঙ্গুলিবাবু তার চুলের মুঠি ধরে টেনে আনলেন, তারপরই তুলকালাম কাণ্ড।

গোবিন্দ উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে চুরিটুরি করতে যায়নি। কোনো জিনিস খোয়া যায়নি সেখান থেকে। সে শুধু পুষ্পর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে গিয়েছিল। হয়তো সেগুলো কাজের কথা নয়, ভাব–ভালোবাসার কথা, হয়তো সে পুষ্পকে আদর–টাদরও করেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালিরা অত্যন্ত মরালিস্ট হয়, তাদের ধারণা, ঝি–চাকরদের প্রেম করার অধিকার নেই, ওদের কোনো শরীরের স্বাভাবিক ক্ষুধা নেই। বছরের পর বছর তারা এক বাড়িতে কাজ করে যাবে, অথচ তাদের কোনো যৌবন–জীবন থাকবে না!

গাঙ্গুলিবাবু গোবিন্দকে চড়চাপড় তো মারলেনই, হাঁকডাক করে সেই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের লোকদেরও জড়ো করলেন। তাঁর অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর, পুষ্প ও গোবিন্দ দুপুরবেলা তাঁর ফ্ল্যাটে ঢুকে ব্যাভিচার তো করেইছে, তাছাড়াও, তাঁর ধারণা, তাঁদের শয়নকক্ষের বিছানায় ওরা শুয়েছে। সে ঘরের দরজা খোলা ছিল এবং সে ঘরে তিনি বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধ পেয়েছিলেন।

পুষ্প এবং গোবিন্দ দু’জনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল বটে, কিন্তু কেউ তাদের কথায় কান দিল না, সেই সন্ধেবেলাতেই তাড়িয়ে দেওয়া হয় গোবিন্দকে। সে যখন তার টিনের সুটকেশটি হাতে নিয়ে যায়, তখন তার ঠোটের কোণে রক্ত জমে আছে, গায়ের জামাটা সম্পূর্ণ ছেঁড়া। পুষ্প তার সঙ্গে যাবার জন্য পাগলের মতন কান্নাকাটি করছিল, কিন্তু পুষ্পকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল একটি ঘরে।

সাতদিন পর পুষ্পর দিদি এসে জোর করে নিয়ে গেল পুষ্পকে। সে মোমিনপুরের এক মোটর মেকানিকের সঙ্গে বোনের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে গাঙ্গুলিবাবুদের নামে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে গেছে।

এইসব ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি কলকাতা শহরেই নেই, মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে ঘুরছি। ফিরে এসে ছোটমামার বাড়িতে যেদিন গেলুম, সেদিন দেখি যে গাঙ্গুলিবাবুদের ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। চায়ের জন্য গোবিন্দর নাম ধরে একটা হাঁক দিতেই ছোটমামা বললেন, সে তো আর নেই। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেছে, এদিকে কাজের লোক আর পাওয়া যাচ্ছে না…তোর মামিমা এমন অসুবিধেয় পড়েছে…

সব বৃত্তান্তটা শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, গোবিন্দ একটি মাত্র অন্যায় বা বোকামি করেছিল, গাঙ্গুলিদের ফ্ল্যাটে ঢুকে বিড়ি খাওয়ার দরকারটা কী ছিল তার? প্রেম করতে গিয়ে কিছুক্ষণ বিড়ি খাওয়া বন্ধ রাখতে পারেনি সে?

আমি ছোটমামাকে বললুম, পুষ্প আর গোবিন্দ প্রেম করেছে, তাতে কার কী ক্ষতি হয়েছে? তোমাদের নীতিবোধে যদি এতই লাগে, ওদের দু’জনের বিয়ে দিয়ে দিলেই পারতে?

ছোটমামা ফিসফিস করে বললেন, আমি একবার সে কথা বলেছিলুম, কিন্তু গাঙ্গুলিবাবু সে কথা কানেই তুললেন না। তাঁর শুধু এক কথা, তাঁর ফ্ল্যাটে ঢুকে ওরা বেলেল্লা করেছে, ওদের আর কিছুতেই এ বাড়িতে রাখা চলবে না।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, গোবিন্দ আর পুষ্পকে এক সঙ্গে তাড়ানো হলো না কেন? পুষ্পকে ঘরে আটকে রাখার কী মানে হয়? পুষ্পও তো চলে যেতে চেয়েছিল।

ছোটমামা বললেন, দ্যাখ না! কী স্বার্থপর লোক! আমাদের কাজের লোকটিকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়ালেন, নিজেরটিকে রেখে দিলেন।

ছোট মামিমা বললেন, এর মধ্যে আরও অনেক কিছু ব্যাপার আছে, তোর ওসব শুনে দরকার নেই!

গোবিন্দর এরকম অপমানের কথা শুনে আমি দুঃখিত হয়েছিলুম। আমি সব সময় প্রেমের সমর্থক। আমার নিজের কোনো প্রেমিকা না জুটুক, কিন্তু প্রেমের জন্য কেউ নির্যাতিত হলে আমি সবসময় তার পাশে দাঁড়াতে রাজি আছি।

সেদিনের ঘটনার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতুম, তা হলে প্ৰতিবাদ জানাতুম নিশ্চয়ই! হয়তো তাতে কোনো কাজ হতো না। আমি তো ও বাড়ির কেউ নই, ছোটমামার ভাগ্নে হিসেবে কেউ কি পাত্তা দিত আমাকে? মধ্যবিত্ত নীতিবাগীশ বাঙালি, আর কিছু পারুক না পারুক, ঝি–চাকরের চরিত্র নিয়ে চোটপাট করতে তাদের জুড়ি নেই। তবু আমার প্রতিবাদটা তো জানানো থাকত!

গোবিন্দ ভালো করেই জানে যে তার দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই। তবু আমার ওপর তার রাগ, আমাকে সে ঐ মধ্যবিত্তদেরই একজন প্রতিনিধি মনে করে? ছি ছি ছি! আমার বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন কেউ তো আমায় পছন্দ করে না। সবাই বলে বাউণ্ডুলে, লক্ষ্মীছাড়া!…

ঘরের দরজাটা খুলে গেল একটু একটু করে। একজন স্ত্রীলোক; মাথায় ঘোমটা টানা, রোগা, গাল দুটো শুকিয়ে গেছে। এরই ছেলে মারা গেছে কয়েকদিন আগে, কালকে কাঁদতে দেখেছি, আজ চোখে জল নেই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আস্তে আস্তে বলল, আমি ঘরের মধ্যে একটু যাব!

এটা কি আমার বাড়ি যে আমার কাছে অনুমতি নিতে হবে। আমি তো অতিথিও নয়, বন্দী। তবু জিজ্ঞেস করেছে যখন, আমি সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে, জানলার কাছে সরে গিয়ে বললুম, আসুন!

বউটি ঘরের মধ্যে ঢুকে খাটিয়ার তলা থেকে বস্তাগুলো টেনে বার করল। সঙ্গে সঙ্গে ধুলো উড়ল অনেকখানি। আমি জানলার গরাদে মুখ চেপে ধরলাম। বউটি বস্তাগুলো নিয়ে চলে গেল।

বোধহয় ঐ বস্তায় করে চাল আনা হবে। আনতে চলে গেছে যে বলল?

একটা হাসির শব্দ শুনে মুখ ফেরালুম। বউটি চলে গেছে, দরজা খোলা, এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চার পাঁচটি বাচ্চা। তারা অবাক হয়ে দেখছে আমাকে। আমি একটা চিড়িয়াখানার জন্তু! বনমানুষের বদলে শহুরে মানুষ।

একটি বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, এই, তোমার নাম কী?

আমি ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। বাচ্চারা সব জায়গাতেই এক। অনাহার ওদের মুখের লালিত্য অনেকটা কেড়ে নিয়েছে বটে, পাগুলো ব্যাঁকা ব্যাকা, পেট বড়, বুক ছোট, তবু চোখের মধ্যে যে টলটলে ভাব, টাটা–বিড়লাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের চোখেও ঠিক ঐ ভাবই থাকে বোধহয়।

বাচ্চাদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে আমার ভালোই লাগে। বনমানুষ সেজে নাচানাচি করে ওদের আনন্দ দিতে পারতুম। আমার দিদির ছেলেটা তো আমাকে দেখলেই ঘোড়া হতে বলে। আমাদের পাড়ার বাচ্চারা গত বছর সরস্বতী পুজোর সময় থিয়েটার করেছিল, তারা আমাকে এসে বলেছিল, নীলুদা, তুমি আমাদের নাটকে একটা বটগাছের পার্ট করবে। তুমি শুধু দু’ হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, নড়াচড়া করতে পারবে না…

–এই, তোমার নাম নেই?

—তুমি কোথায় থাক? দ্যাখ দ্যাখ পেন্টুলটা ছেঁড়া!

আমি হাসতে পারছি না, দুই ঠোটে যেন অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়েছে। খিদেয় জ্বলছে পেট, মাথার ওপর ঝুলছে একটা অদৃশ্য খাঁড়া, এই অবস্থায় আমি যদি শিশুদের সঙ্গে কৌতুক করতে না পারি, তবে কি সেটা খুব দোষের। বরং হঠাৎ যেন আমার চোখ ঠেলে কান্না এসে গেল, জোর করে ফেরাতে চাইলুম সেই কান্না।

–এই, নাম বলবি না? মার খাবি?

আগে লক্ষ করিনি, বাচ্চাগুলোর হাত ছিল পেছন দিকে মুঠি করা। এবার ওরা হাত সামনে আনল। কচি কচি হাতে একটা করে পাথর, একজনের হাতে একটা ছাতার সিক

এই বয়েসী বাচ্চারা এক এক সময় খুব হিংস্র হতে পারে। যৌন চেতনা পুরোপুরি আসবার আগে নাকি দয়া–মায়ার বোধও ঠিক মতন হয় না।

বাচ্চাদের অনেক কিছুই বলতে হয় না, তারা এমনি এমনি বুঝে যায়। ওরা ঠিক বুঝে নিয়েছে যে আমি ওদের শত্রু। চিড়িয়াখানার বাঁদরকে বাচ্চারা কাঠি দিয়ে খোঁচা মারে, আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারা ওদের পক্ষে একটুও অস্বাভাবিক নয়।

এই অবস্থায় কোনোক্রমে দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারলে হয়। আমি দরজার দিকে এগোতেই ওরা প্রথমে ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল, তারপর একজন পাথর ছুঁড়ে মারল। তারপর আর একটা।

দু’ হাতে চোখ মুখ চাপা দিয়ে আমাকেই পিছিয়ে আসতে হলো। একটা পাথর আমার কানে লেগেছে। গোলায়াথের মতন দৈত্যকেও বাচ্চা ডেভিড খতম করে দিয়েছিল পাথর ছুঁড়ে।

আমি সরে গেলুম দরজার আড়ালে। আমার হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা জল। আমার সারা বুকে কাঁপুনি দিয়ে আসছে কান্না। মানুষ কোন্ কোন্ অবস্থায় আত্মহত্যার কথা ভাবে, এখন যেন বুঝতে পারছি।

বাচ্চাগুলো দরজার কাছে এসে উঁকি মেরেছে আবার। তাদের পাথর ফুরোয়নি। এই টাঁড় ভূমিতে পাথরের অভাব নেই। ওরা হাসছে খলখল করে। বড়োরা সবাই বাইরে, ওদের কেউ শাসন করবার নেই। একবার ইচ্ছে হলো ওদের দিকে তেড়ে যাই…

এই অবস্থাতেও বুঝতে পারলুম, আমি যদি রাগের মাথায় কোনো একটা বাচ্চার গায়ে হাত তুলি, তা হলে আমার আর রক্ষে নেই। আমার অপরাধের বোঝা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। সুশীলাও আর আমাকে দয়া করবে না।

একটা আট ন’ বছরের শাড়ি পরা মেয়ে, ঠিক পুতুলের মতন দেখতে, এই সময় বাইরে থেকে ছুটে এসে নাচতে নাচতে বলতে লাগল, ভাত। ভাত। ভাত। ভাত। ভাত হয়েছে। ভাত হয়েছে।

এই খেলা ছেড়ে সব কটা বাচ্চা ছুটে চলে গেল বাইরে। আমার বুক থেকে বিরাট একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। এই রকম ধরনের বিপদে জীবনে আর কখনো পড়িনি।

এত তাড়াতাড়ি ভাত রান্না হয়ে গেল? কোথা থেকে ওরা চাল কিনে আনল? আমাকে কি একটু ভাত দেবে?

গোবিন্দ বলেছে, আমাকে এক ফোঁটা জলও দেওয়া হবে না। গোবিন্দ শুধু ক্ষুধার্ত মানুষদের নেতা নয়, সে একজন ব্যর্থ প্রেমিকও। তার শরীরে দু’ রকম রাগ

বাইরে বাচ্চাদের সোরগোল শোনা যাচ্ছে। ওদের বুঝি উঠোনে খেতে দিয়েছে? ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, তার গন্ধ যেন এসে লাগছে আমার নাকে।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আমি খাটিয়ার ওপর বসলুম। আবার চোখ মুছতে হলো। হাতের তালুতে যে জলের ফোঁটা তা জিভে ঠেকালুম। এক সময় হিন্দু বিধবাদের একাদশীর দিন নিরম্বু উপোষ দিতে হতো, তখন নাকি তারা তেষ্টার জ্বালায় নিজের চোখের জল চাটত।

ছোটমামার বাড়িতে যতদিন কাজ করেছে, ততদিন গোবিন্দর এরকম গলার আওয়াজ কক্ষনো শুনিনি। সে ছিল অতি বিনীত ও নম্র। সে যে এরকম হুংকার দিতে পারে, তা তখন কল্পনাই করা যেত না।

কলকাতায় যত ঝি–চাকর, অফিসের পিওন, বাজারের সবজিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, মুচি এদের আমরা একরকম চোখে দেখি, এদের নিজস্ব পরিবেশে যে এদের একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে, সে–কথা খেয়াল থাকে না।

আমার মনে পড়ল মেদিনীপুরেরই আর একটা গ্রামের কথা। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলুম, এই রকমই মাটির বাড়িতে থাকতে হয়েছিল যদিও, কিন্তু খাতির যত্ন পেয়েছিলুম কত। সেই গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে একটি বেগুনের খেতের পাশে একজন লোককে দেখেছিলুম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুঁকো টানতে, ধুতিটা লুঙ্গির মতন পরা, খালি গা, মুখে একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তির ভাব। আমার বন্ধুটি তাকে দাদা বলে ডাকল, সেই লোকটি তার বেগুন খেত আমাদের গর্বের সঙ্গে দেখাল ঘুরে ঘুরে।

পরে জানলুম, ঐ লোকটি রাইটার্স বিল্ডিংসের পিওন, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। শুনে বিশ্বাসই করা যায় না। রাইটার্স বিল্ডিংসের টুলে বসা পিওন আমি অনেক দেখেছি, তাদের কারুর সঙ্গেই সেই হুঁকো–হাতে পরিতৃপ্ত লোকটিকে কিছুতেই যেন মেলানো যায় না। গ্রামে সে একটি সংসারের অধিপতি।

সমস্তিপুরেও একবার দেখা হয়েছিল ঝরি সিং–এর সঙ্গে, সে আমাদের পাড়ার একজন ডাক্তারের ড্রাইভার। কিন্তু কলকাতার ড্রাইভার ঝরি সিং আর সমস্তিপুরের ঝরি সিং যেন দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। সে আমাকে দেখে নমস্কার করেছিল বটে, কিন্তু তারপর সে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যখন আমাকে মাখানা ভাজা খাওয়াল, তখন মনে হলো এখানে সে ডাক্তারবাবুটির চেয়ে কম কিছু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ নয়।

গোবিন্দ কিছুদিন শহরে কাটিয়ে এসেছে বলেই এখানে নেতৃত্ব দেবার অধিকার অর্জন করেছে। গোবিন্দর চেয়েও রতন নামে লোকটার তেজ বেশি, কিন্তু কাল রাত থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় গেল? আমাকে খুন করার ব্যাপারে তার খুব ঝোঁক ছিল, সে কি আগে দু’একটা খুন–টুন করেছে? রতন জামসেদপুরে যাবে, এরকম একটা কথা কাল একবার শুনেছিলাম। এবার তার কারণটা যেন আন্দাজ করা গেল।

ওরা বাস থেকে শুধু টাকাপয়সা লুট করেনি, গয়নাগাটিও নিয়েছে। টাকার চেহারা দিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায় না, কিন্তু গয়না দিয়ে যায়। সেইসব গয়না এই গ্রামে রাখা নিরাপদ নয় একেবারেই। রতন নিশ্চয়ই সেই গয়না নিয়ে চলে গেছে জামসেদপুরে। সেখানে ওগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করবে। ঠিকঠাক দাম পাবে তো? গ্রামের মানুষ, শহরে গিয়ে না ঠক–জোচ্চোরদের পাল্লায় পড়ে।

এরা বোধহয় প্রথমেই ডাকাতির কথা ভাবেনি। যাদের একটু মাথা ঠাণ্ডা, তারা বাস থামাবার পর ওপরে উঠে কিছু কিছু টাকা সাহায্য চেয়েছিল। সবাই যদি কুড়ি–পঁচিশ টাকা করেও দিত, তা হলে হয়তো পরের ঘটনাটা এড়ানো যেত। কেউ দিতে চাইল না। ভিখিরি ভেবে ওদের দূর দূর করে উঠল।

এরা তো ডাকাত নয়, ভিখিরিও নয়, সত্যিকারের গ্রামের নিরীহ গরিব মানুষ, খেতে না পেয়ে মরীয়া হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্যসীমা বলে কী নাকি একটা রেখা আছে, তার নীচে দেশের অর্ধেক মানুষ। কয়েক মাস পরেই সারা দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উৎসব হবে। আমেরিকা–রাশিয়ায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভারত–উৎসব হচ্ছে। সেখানে নাচ–গান চলেছে খুব।

সরকারি সাহায্য এসে না পৌঁছোক, ঐ বাসের যাত্রীরা কি কুড়ি–পঁচিশ টাকা করে দিতে পারত না? এমন কি কষ্ট হতো?

আমি তো দিতে আপত্তি করিনি। আমার যে–কটা টাকা ছিল দিয়ে দিয়েছি অবশ্য একথা ঠিক, প্রথমবার চাইবার সময় আমিও দিইনি। আমার কাছ পর্যন্ত তো থলি হাতে আসেনি। অন্য কেউ দেবার আগেই কি আমার দেওয়া উচিত ছিল? কোনো ব্যাপারেই তো জীবনে ফার্স্ট হইনি আমি। হঠাৎ নাটকীয় কিছু করে ফেলতে আমার লজ্জা করে।

অন্যরা যখন কেউ দিচ্ছিল না, তখন উঠে দাঁড়িয়ে আমার উচিত ছিল সবাইকে বুঝিয়ে বলা? আমি যদি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতুম…। নেতা হবার মতন গুণ কি সবার থাকে? জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমার এই মিনমিনে গলায় একেবারেই আসে না। আমার কথা শুনলেই কি অন্যরা রাজি হতো? আমাকে নিয়ে ঠাট্টা–ইয়ার্কি করত সবাই।

ওরা মেয়েদের কানের দুল ধরে টানাটানি করার পরই আমি একটু প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলাম, ওরা যখন অন্যদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছিল, তাতে আপত্তি করিনি। ওদের প্রতি মনে মনে আমার যেন খানিকটা সমর্থনই ছিল। গোবিন্দ সেটা বুঝতে পারল না?

এখন যদি চেঁচিয়ে বলি, ওগো, আমি তোমাদের পক্ষে, তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবার ইচ্ছে আমার একটুও নেই, তোমরা যা করেছ, ঠিকই করেছ– আমাকে ওরা বিশ্বাস করবে? ওরা বরং আমাকে বলবে, ভণ্ড, সুবিধেবাদী, নিজের স্বার্থে এখন আমি গরিবের বন্ধু সাজছি।

ভণ্ড, সুবিধেবাদী, স্বার্থপর এমন অনেক গরিবের বন্ধু কি আমরা দেখিনি? তাদের কায়দাটা আমার জানা নেই।

এখন উপায় কী? এরা কতদিন আমাকে এখানে আটকে রাখবে?

চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, এর মধ্যেই আমি অধৈর্য হয়ে উঠছি? দশ–পনেরো

দিনের মধ্যে যদি আর একটা ডাকাতি ঘটে যায়, তা হলে পুলিশ এই ঘটনাটা ভুলে যাবে। তখন এরা আমাকে ছেড়ে দিতে পারে নিশ্চয়ই। ততদিন কি জল খেতেও দেবে না? আমাকে খুন করার দরকার নেই, আমি এমনিই শেষ হয়ে যাব।

দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল। হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল সুশীলাদি, গোবিন্দ আর একজন। গোবিন্দর হাতে শাবল, অন্য লোকটির হাতে রামদা, দু’জনেই অস্ত্র উঁচিয়ে বলল, শুয়ে পড়, শুয়ে পড় হারামজাদা।

পুলিশ? তা হলে কি সত্যিই পুলিশ এসেছে?

চিন্তা করার সময় পেলাম না। গোবিন্দ আমার দিকে এক পা এগোতেই আমি মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম। প্রথম আঘাতটা যেন আমার চোখে না লাগে। এক আঘাতেই কি শেষ হয়ে যাব?

দু’জন আমার পা ধরে টেনে সোজা করে দিল। তারপর ঝপ ঝপ করে আমার গায়ের ওপর পড়তে লাগল কাঁথা–কম্বল জাতীয় জিনিস। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হলো।

গ্রামের লোকেরা বস্তার মধ্যে শুয়োরকে ভরে তারপর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারে। যাতে শুয়োরের চামড়াটা নষ্ট না হয়, রক্ত না পড়ে। কিন্তু শুয়োর মারে তো খাওয়ার জন্য। গ্রামে পুলিশ ঢুকে পড়লে এরা আমাকে এভাবে মারবে কেন? কম্বল চাপা দিয়ে পিটিয়ে মেরে তারপর বলবে, আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে?

আর একটা কিছু ভারি জিনিস পড়ল আমার শরীরের ওপর। ভারি, অথচ নরম। একজন কেউ শুয়ে পড়েছে। আমাকে আষ্টেপিষ্টে কাঁথা–কম্বলে চাপা দিয়ে একজন কেউ তার ওপর শুয়েছে।

কে একজন শাসিয়ে বলল, একটু যদি নড়িস, শুয়োরের বাচ্চা, এ ঘর থেকে জ্যান্ত বেরুতে পারবি না।

একটু পরে বুঝতে পারলুম ঘর থেকে অন্যরা চলে গেছে, আমার ওপর শুধু শুয়ে আছে একজন। খুব সম্ভবত স্ত্রীলোক, সঙ্গে একটি শিশু। সেই শিশুটি খুঁ খুঁ করে কাঁদছে।

এবারে আন্দাজ করতে পারলুম ওদের কায়দাটা। পুলিশ যদি এ ঘরে খুঁজতে আসে, দেখতে পাবে শিশু কোলে নিয়ে শুয়ে আছে এক অসুস্থ মহিলা। আর কেউ নেই। পুলিশ বড় জোর খাটিয়ার তলাটা উঁকি দিয়ে দেখে চলে যাবে।

এই বুদ্ধিটা কার, সুশীলাদির, বড়কাকার, না গোবিন্দর? পুলিশের আগমন টের পেয়ে আমি যদি নড়াচড়া করে উঠি? পুলিশের সামনেও কি ওরা আমাকে মারতে পারবে?

অসহ্য গরমের মধ্যেও ওরা আমার ওপর তিন–চারখানা কম্বল চাপা দিয়েছে। আমার সারা গা ফুঁড়ে বেরুচ্ছে গরমজল। চোখে শুধু অন্ধকার দেখছি। তবু আমার কষ্টবোধ হচ্ছে না। মাথাটা অদ্ভুত হাল্কা লাগছে।

আচমকা গোবিন্দ আর ঐ লোকটা দুটো অস্ত্র তুলে ঢুকে পড়ায় মনে হয়েছিল, সেটাই আমার শেষ সময়। আর কোনো আশা নেই। কিন্তু আমি এখনো মরিনি, বেঁচে আছি, আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকব। যতই কষ্ট হোক, বেঁচে থাকা, শুধু বেঁচে থাকাই এত আনন্দের!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *