শেষ দেখা হয়নি – ২

এই অঞ্চলে মাঝে মাঝেই ছড়ানো ছেটানো রয়েছে জঙ্গল। খুব একটা বড় নয়, তেমন ঘনও নয়, তবু জঙ্গল তো বটে। বাগানের আয়তন দিয়ে যেমন ফুলের সৌন্দর্য বিচার করা যায় না, সেইরকমই অরণ্যের দৈর্ঘ্য–প্রস্থ দিয়ে আরণ্য পরিবেশের রূপ যাচাই হয় না।

আমার মনে হচ্ছে যেন এই জ্যোৎস্নাহীন রাতে আমি এক দুর্গম, ভয়াল অরণ্যে বসে আছি। কাছেই একটা মশাল জ্বলছে। এ ছাড়া সব দিকে চাপ চাপ অন্ধকার। মেদিনীপুরের এই প্রান্তসীমায় শাল গাছের বাড় বেশ ভালো; সরল, উন্নত বৃক্ষগুলির বিশেষ একটা গাম্ভীর্য আছে।

সব জঙ্গলের মধ্যেই কিছু কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। এখানে মশালটা মাঝখানে পোঁতা, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কুড়ি–পঁচিশজন নারী– পুরুষ, কেউ কেউ সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। এক জায়গায় কয়েকজন মুরুব্বি হিসেব করছে লুটের মালের।

আমার হাত–পা ওরা বাঁধেনি। শুধু বসিয়ে রেখেছে একটা পাথরের ওপর। কিন্তু এখন পালাবার চেষ্টা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। স্থানীয় মানুষরা এই জঙ্গল নিশ্চিত খুব ভালো চেনে। আমি কোনো জায়গায় লুকোবার চেষ্টা করলেও আমাকে খুঁজে বার করতে ওদের পাঁচ–দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। তারপর রামদা বা টাঙ্গির এক কোপে কুচুৎ করে আমার গলাটা কেটে দেবে। গোবিন্দ সেইরকমই শাসিয়ে রেখেছে।

আমার না পালানোর আরও একটা বড় কারণ এই যে তপনের দেওয়া চৌকো বাক্সটি না নিয়ে আমি রাঁচিও যেতে পারব না, কলকাতাতেও ফিরতে পারব না। বাক্সটার মধ্যে ঠিক যে কী আছে, তা এখনো জানা হয়নি। বাক্সটা গোবিন্দ নিজের কাছে কব্জা করে রেখেছে।

বাসটা লুট করে এরা শুধু টাকাপয়সা ও গয়নাগাঁটি পায়নি, বাসের মাথা থেকে পেয়েছে এক কাঁদি কলা, দু হাঁড়ি স্পঞ্জ রসগোল্লা ও কয়েক শিশি আচার। রাঁচির আত্মীয়স্বজনের জন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছিল। একটু আগে ওরা সেই সব ভাগ করে খেয়েছে, এমনকি আচারও।

এরা যে পেশাদার ডাকাত নয়, এই প্রথম ওদের এই কাজে হাতেখড়ি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেয়েদের কাছ থেকে জোর করে গয়না কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে ওদের মধ্যে মতভেদ ও বচসা হয়েছে, তা একটু আগে শুনেছি। একটি মেয়ের কান থেকে দুল টেনে খোলার সময় তার কান ছিঁড়ে গেছে, রক্তপাত হয়েছে, এ ঘটনা অবশ্য আমাকে বাস থেকে ফেলে দেবার পরে। রমেনের সঙ্গিনীর নাকি?

গোবিন্দ এদের দলে বেশ পাণ্ডাগোছের, উঁচু গলায় দাবড়ে বেড়াচ্ছে। গোবিন্দর এরকম ব্যক্তিত্বের পরিচয় আমি আগে কখনো পাইনি। হাজরা রোডে আমার ছোটমামার বাড়িতে রান্নার কাজ করত গোবিন্দ, তার রান্নার হাত মোটেই ভালো ছিল না, নুন–জ্ঞানটা ছিল খুবই খারাপ, টাটকা ইলিশ মাছ রাঁধলেও সেটা হয়ে যেত নোনা ইলিশ, কিন্তু সে ছিল বিনীত ও নম্রভাষী, আমার ছোট মামিমার হাজার বকুনিতেও সে রা কাড়ত না, রান্নার অযোগ্যতা সত্ত্বেও তাকে রাখা হয়েছিল, তার কারণ সে ছিল খুব বিশ্বাসী। কতবার গোবিন্দর হাতে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে ছোটমামারা পুরী–রাজগীর–শিলং বেড়াতে গেছেন।

,

আমার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল গোবিন্দর। ছোটমামার বাড়িতে গিয়ে আমি নিজে থেকে চাইবার আগেই গোবিন্দ জিজ্ঞেস করত, নীলুদা, চা খাবেন তো? একবার আমি ও বাড়িতে একটা সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছি, তাতে মোট সাতটা সিগারেট ছিল, আমার ছোটমামা সিগারেট খান না কিন্তু গোবিন্দ বিড়ি–টিড়ি খেত, পাঁচদিন পরে ও বাড়িতে আবার গেলে গোবিন্দ আমাকে সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়ে বলল, নীলুদা, এটা আপনার না? তার থেকে একটা সিগারেটও কমেনি।

আমার ছোট মামিমা খুবই ভুলোমনা। কখন কোথায় চাবি রাখছেন, টাকাপয়সা রাখছেন, গয়না রাখছেন তার কিছু ঠিক নেই। সব সময় বাড়িতে একটা কোথায় গেল, কোথায় গেল রব। এই সব বাড়িতে অনেক সময় একটা অবিচারের ঘটনা ঘটে। একটা কোনো দামি গয়না হঠাৎ একদিন খুঁজে পাওয়া যায় না; বাড়িতে নানারকম আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আসে, তাদের মধ্যে দু’একজন কি চোর হতে পারে না? কিন্তু তাদের কিছু বলা যায় না, প্রথমেই সন্দেহ পড়ে ঝি–চাকরের ওপর! সন্দেহের পর জেরা, তারপর শাসানি, তারপর হয় তারা কাজ ছেড়ে চলে যায় কিংবা তাদের পুলিশে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর জানা যায় যে গয়নাটা আছে ব্যাঙ্কের লকারে, কিংবা অমুকের বিয়েতে গৃহিণীর ছোট বোন অতিরিক্ত সাজগোজের জন্য সেটা পরতে নিয়েছিল, কিংবা সেটা যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।

আমার ছোটমামার বাড়িতে অবশ্য সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, গোবিন্দকে কোনোদিন চোর অপবাদ দেওয়া হয়নি, গোবিন্দ কাজ ছেড়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তবু আমার ওপরে তার এত রাগ কেন? সে আমায় কুৎসিত গালাগালি দিয়ে, চুলের মুঠি ধরে…

হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল চারজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক। লাল পাড় শাড়ি পরা এই স্ত্রীলোকটি বাস থামবার পর প্রথম দফায় উঠেছিল, অন্যরা একে সুশীলা বলে ডাকে। বয়েস হবে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, গায়ের রং মাজা মাজা, মুখখানা ঝাঁঝালো ধরনের, তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে কোনোরকম নারীসুলভ নম্রতা নেই, পুরুষশাসিত সমাজেও এই ধরনের মেয়েরা নেত্রী হয়। গোবিন্দ ছাড়া আর তিনজন পুরুষের মধ্যে একজন বেশ বৃদ্ধ, মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, অন্য দু’জন বেশ জোয়ান।

পাকা দাড়িই প্রথম অন্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই ছোকরা বাবুটাকে নিয়ে তাইলে এখন কী করতে চাস?

গোবিন্দ বলল, এরে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ আমারে চিনে ফেলেছে। আমার নামঠিকানা জানে।

আমি প্রতিবাদ করে বললুম, না গোবিন্দ, আমি তোমার ঠিকানা তো জানি না!

গোবিন্দ এক পা এগিয়ে এসে হাতের টাঙ্গিটা তুলে বলল, চোপ!

অন্য একজন বলল, এ জাতরে বিশ্বাস করা যায় না। এরে ছেড়ে দিলেই এক দৌড়ে থানায় যাবে, সেখানে গিয়ে গোবিন্দর নাম, আমাদের গেরামের নাম বলে দেবে!

বৃদ্ধটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা ঠিক কথা বটে। আমরা এখন গেরামে ফিরে গিয়ে চুপচাপ দরোজা এঁটে ঘুমালে পুলিশ আমাদের সন্দো করবে কোন্ আক্কেলে,! কিন্তু এই বাবুটি যদি পুলিশের কাছে গেরামের নামটা বলে দেয়….

আমি বললুম, আমি পুলিশে যাব না খবর দেব না, বিশ্বাস করুন। আমার চৌকো বাক্সটা ফেরৎ দিন। আমি চলে যাক সোজা…

গোবিন্দ আমাকে আবার ধমক দিলেও বৃদ্ধটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা করুণ গলায় বলল, তোমারে বিশ্বাস করা যায় না, এটা আমাদের মরণ– বাঁচনের ব্যাপার। আগে তোমাদের কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলাম, তোমরা কিছু দ্যাও নাই, এখন জোর করে কেড়ে নিয়েছি, এবারে থানা পুলিশ হবেই।

গোবিন্দর পাশের লোকটা বলল, বড়কাকা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এর গলাটি কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই!

যেন বাড়ির সামনের কলাগাছটি কেটে ফেলা হবে কি হবে না, এমন একটা দ্বিধার সুরে বৃদ্ধটি বলল, রতন, একেবারে প্রাণে মেরে দিতে চাস?

—তবে কি অর্ধেক বাঁচায়ে রাখব? তাতে লাভ কী? একটুখানি জ্ঞান থাকলেও তো পুলিশের কাছে জবানবন্দী দেবে! শত্তুরের কখনো শেষ রাখতে নাই।

—কে মারবে? কোপটা কে বসাবে?

—আমরা সকলে মিলে কোপ বসাবো। তোমরা যদি ভয় পাও তো আমি আর গোবিন্দ মিলেই ওরে শেষ করে দিতে পারি।

–দ্যাখ, চুরি–ডাকাতির শাস্তি একরকম, আর খুনের শাস্তি হইল ফাঁসি!

—এই জঙ্গলের মধ্যে মেরে রেখে গ্যালে কে টের পাবে? লাশটা নদীতে ফেলে দিলে তো আর কোনো ঝামেলাই নাই।

–নদীতে কি জল আছে যে ভেসে যাবে? নদীতে যদি জল থাকত, আকাশ থেকে যদি বৃষ্টি নামত, তা হইলে তো এই সব পাপের কাজ করতেই হতো না।

—ওসব কথা ছাড়ো তো বড়কাকা! যা হবার তা তো হইয়েই গিয়েছে। আমরা কি না খেয়ে মরব? যতই আকাল হউক আর জমি ফাটুক, এইসব বাবুদের গায়ে তো আঁচড়ও লাগে না। নদীতে জল নাই তো এর লাশ মাটিতে পুঁতে রেখে যাব!

—মাটিতে পুঁতলেও শিয়ালে খুঁড়ে বার করবে।

আমারই লাশ বিষয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো। এখনো জলজ্যান্ত মানুষটা বসে আছি, নাক দিয়ে নিঃশ্বাস পড়ছে, পেট চুঁই ছুঁই করছে খিদেতে, আর এরা আমার মৃতদেহটি নিয়ে কী করবে, সেই সমস্যায় চিন্তিত!

এরকম একটা সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও আমি ফস করে একটা সিগারেট ধরালুম। ওরা বুঝুক যে আমি ওদের গ্রাহ্য করছি না। যদি মরতেই হয়, বীরের মতন মরব! যদি জিজ্ঞেস করে, তোমার শেষ ইচ্ছে কী, আমি বলব, আমাকে একটা গান গাইতে দাও…

আমাকে ছেড়ে দেওয়া যে ওদের পক্ষে বিপজ্জনক, তা আমিও স্বীকার করছি। আমি যতই শপথ করি যে পুলিশের কাছে যাব না, তা ওদের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কেনই বা আমাকে বিশ্বাস করবে? আমি যদি ওদের মতন গ্রাম্য ডাকাত হতুম, তা হলে কি ভদ্রলোকদের একজন প্রতিনিধিকে বিশ্বাস করে মুক্তি দিতুম?

বৃদ্ধটি অন্য সকলের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা হলে তোমরা সবাই কী বলো? একে মেরে ফেলাই হবে?

কেউ উত্তর দেবার আগেই এবার স্ত্রীলোকটি জোর গলায় বলল, না! আমরা কি খুনে, না ডাকাত? আমি আগেই বলেছিলাম, রক্তারক্তির মধ্যে যেও না। শুধু শুধু নিরীহ মানুষকে মারলে সে পাপ সইবে না।

রতন বলল, নিরীহ! তুমি কি বলছ গো সুশীলাদি! গোবিন্দকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, এ ছোড়াটা একটা কেউটে সাপ!

গোবিন্দ বলল, ওরা সবাই এক!

আমার সঙ্গে কেউটে সাপের তুলনাটা আমি খুবই অপছন্দ করলুম। কী হিসেবে বলল কথাটা? আমার গায়ের রং কি অতটাই কালো? কিম্বা আমি সাপের মতন রোগা–হিলহিলে? অথবা বিষ…বিষের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! নাঃ…এইসব গ্রামের লোকেরা একেবারে যা–তা উপমা দেয়!

রতন বলল, রাত বেড়ে যাচ্ছে শুধুমুদু, কাজ শেষ করে এখন ছড়িয়ে পড়া দরকার। বড়কাকা, তাহলে দিই শেষ করে? আয় গোবিন্দ।

সুশীলা দুপা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, না, খুন–জখম চলবে না। এনারে আমাদের সাথে গেরামে নিয়ে চলো। আমাদের কাছে ধরে রাখলে তো আর থানায় গিয়ে খপর দিতে পারবে না!

—কী পাগলের মতন কথা বলছ, সুশীলাদি! গ্রামে নিয়ে গিয়ে দুধ–কলা দিয়ে কালসাপ পুষব! পুলিস যদি দৈবাৎ সার্চ করতে আসে, তখন তো এই হারামজাদা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে!

–আরে নাঃ! একে আমি এমন জায়গায় সেঁধিয়ে রাখব যে পুলিসের বাপ– চোদ্দপুরুষও টেরটি পাবে না।

–কী বড়কাকা, তুমি কী বলো? মেয়েছেলের বুদ্ধি নিলে শেষ পর্যন্ত মরণ হবে আমাদের।

বড়কাকা বাঁ হাত দিয়ে নিজের চিবুক ঘষতে ঘষতে বলল, তাইলে এক কাজ কর। রতন, তুই বরং এরে তোর সাথে জামসেদপুরে নিয়ে যা! সেখানে কোথাও ওকে ছেড়ে দিবি!

রতন আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? তুমি বলো কী, ওকে আমি একা একা সাথে নিয়ে যাব?

গোবিন্দ বলল, তা হলে আমাকেও রতনের সাথে যেতে হয়। সেই ভালো, ওকে এখান থেকে তো সরিয়ে নিয়ে যাই। তারপর আমরা দুজনে মিলে ওকে নিয়ে কী করি, সে তোমাদের জানার দরকার নেই। ওর হাত দুটো বাঁধ রতন।

সুশীলা আবার জোর দিয়ে বলল, না, গোবিন্দ, তোর যাওয়া চলবে না। তোদের মতলোব আমি বুঝেছি। বড়কাকা, আমার কথাটা শোনো। আরও যে এতসব মানুষ আছে, তাদের জিজ্ঞেস করে দ্যাখো। খুন জখমের দায় কেউ নিতে চাইবে না। সবারই পেটের দায় আছে, তা বলে কি প্রাণের ভয় নাই?

বড়কাকা বলল, তাইলে নলিনী, বিষ্ট, হারান এদেরও ডেকে জিজ্ঞেস করো না কেন, ওরা কী চায়?

রতন বলল, পাঁচজনে পাঁচরকম মত দেবে, তাতে কিছু কাজের কাজ হবে না। বড়কাকা, তোমারে লীডার করেছি, তুমি যা বলবে, তাই হবে! আর সময় নষ্ট করা যাবে না, তুমি বিচার করে বলে দাও…

বড়কাকার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতেই সে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। বৃদ্ধটি মনঃস্থির করতে পারছে না। আমি সুশীলার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। নারী জাতির ওপর আমার অনেক ভরসা। মেয়েরা এর আগেও আমাকে অনেকবার বাঁচিয়েছে।

আমি বললুম, খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল দেবেন?

রতন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তোর মুখে ইয়ে করে দেব, শালা!

সুশীলা বেশ জোরে তার মুখের ওপর একটা থাপ্পড় কষাল। তারপর আমাকে বলল, এখানে জল নাই, আমাদেরও গলা শুকিয়ে গেছে।

এই সময় একজন লোক ছুটতে ছুটতে এসে বলল, একখান গাড়ি আসছে, এদিকে একখান গাড়ি আসছে।

বড়কাকা দারুণ ভয় পেয়ে বলে উঠল, অ্যাঁ? এসে গেছে? তাইলে কী হবে? অ্যাঁ?

রতন বলল, তোমরা দৌড়াও! জঙ্গলের আরও ভিতরে সেঁধিয়ে যাও, সবাইকে নিয়ে যাও…

রতন আর গোবিন্দর মাঝখানের যে লোকটি এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, সে এবার এগিয়ে এসে আমার ঘাড় ধরে বলল, চ্যাচালে এক কোপে শ্যাস করে দেব। টু শব্দটি করবে না।

সুশীলা আমার একটি হাত চেপে ধরে বলল, দৌড়াও আমাদের সাথে, আমরা যদি ধরা পড়ি, তুমি বাঁচবে না।

গোবিন্দ বলল, তোমরা পা চালাও, আমি আর রতন নজর রাখছি, মনে হয় উটকো গাড়ি…কেউ কোনো শব্দ করো না।

সুশীলা আর রতন দু’দিক থেকে আমাকে ধরে রেখে ছোটা শুরু করল। যাক, তা হলে আয়ু পাওয়া গেল আরও কিছুক্ষণ। এতখানি সংকটের মধ্যেও আমার মনে একটা প্রশ্নই ঘুরছে বারবার, আমার ওপর গোবিন্দর কেন এত রাগ? আমি তো তার সঙ্গে সজ্ঞানে কোনো খারাপ ব্যবহার করিনি। সে আমাকে মোটামুটি চেনে, আমি কি বিশ্বাসঘাতক টাইপের মানুষ!

অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ছুটেই আমি বেশ হাঁপিয়ে গেলুম। আমার জন্য সুশীলা ও অন্য লোকটিরও অসুবিধে হচ্ছে। তিন জোড়া পা একসঙ্গে মিলিয়ে দৌড়োন সহজ কথা নয়। অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের পেছনে ফেলে। আমার ঘাড়ের কাছে একটা অদ্ভুত অনুভূতি, ঐ রতন নামের লোকটা কেমন যেন রক্তপিপাসু ধরনের, আমাকে মারার খুবই ইচ্ছে ওর, এখন এই সুযোগে যদি সে পেছন দিক থেকে এসে আমার ঘাড়ে একটা কোপ মারে? এই বুঝি মারল, এই বুঝি মারল।

দু’তিনবার পেছন ফিরে তাকালুম। পুলিসের গাড়ি বা অন্য কোনো গাড়ি আমাদের তেড়ে আসছে না। অন্ধকার একটুও ফুটো হয়নি।

জঙ্গল ছেড়ে আমরা নেমে পড়লুম একটা শুকনো নদীর খাতে। এটা খুব ভালো লুকোবার জায়গা। নদীর দু’ পাড় উঁচু, মাঝখানে কোনো মানুষ থাকলেও দেখা যাবে না। এবারে সবারই গতি কমে এলো। সুশীলা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁপাচ্ছে। ভালো করে খেতে পায়নি অনেকদিন; এদের কারুর শরীরেই জোর নেই। যে–লোকটি আমাকে ধরে আছে, তার শরীরের খাঁচাখানা বড়, কিন্তু শরীরে হাড় ছাড়া আর কিছুই নেই। গায়ের জোরে এ লোকটা হয়তো আমার সঙ্গে পারবে না। একমাত্র রতনেরই ডাকাত–ডাকাত চেহারা।

এক জায়গায় খানিকটা জল চকচক করছে। সুশীলা সেখানে থেমে পড়ে বলল, এই যে জল, খেয়ে নাও!

স্রোতহীন বদ্ধ জল, শহুরে মানুষদের এ জল খেতে হলে অভক্তিতে বমি আসবে। আমার আসলে তেমন তেষ্টা পায়নি, তখন জল চেয়েছিলুম এক রমণীর মন ভেজাবার জন্য। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সেই জলই আঁচলা করে তুললুম খানিকটা, জলের মধ্যে কী যেন ছোট ছোট জ্যান্ত জিনিস নড়াচড়া করছে, মাছ হতে পারে না, খুব সম্ভবত ব্যাঙাচি। ঠোটের কাছে একটু ছোঁয়ালুম শুধু, সবটা জল ঢেলে দিলুম নিজের বুকে। ঘামে আমার জামা ভিজে গেছে এমনিতেই

সুশীলা নিজেও সেখানে বসে পড়ে সেই জল বেমালুম খেয়ে নিল দু’ তিন ঢোক। খাদ্য হিসেবে ব্যাঙাচি খুব খারাপ নয় বোধহয়, সাহেবরা ব্যাঙ খায়, আমিও দু’ তিনবার ব্যাঙের ঠ্যাঙ ভাজা খেয়েছি।

সুশীলা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, রতন আর গোবিন্দ কোথায় গেল, ওরা এলো না?

আমার পাশের লোকটি বলল, আসবে, আসবে। ওদের জন্য ভেবোনি। এখন চলো, ঘুমে আমার চোখ টেনে আসছে।

ক্লান্তিতে অনেকেই বসে পড়েছে বালির ওপর। অদ্ভুত এক ডাকাতের দল, যাদের বেশিদূর ছোটারও শক্তি নেই।

বড়কাকা সবাইকে তাড়া দিতে লাগলেন, এই ওঠ ওঠ, আর তো মোটে একটুখানি, যে–যার বাড়িতে গিয়ে জিরোবি। চল রে…

বম্বে রোড থেকে আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি। সব মিলিয়ে দশ– বারো কিলোমিটার তো হবেই। যদি কেউ খবর না দিয়ে দেয় তা হলে পুলিসের পক্ষে এতদূরের একটা গ্রামে এসে হানা দেওয়া খুব একটা সম্ভাব্য ব্যাপার নয়। পুলিসজাতি এত ব্যস্তবাগীশ নয় মোটেই।

নদীর খাত ছেড়ে আমরা উঠে পড়লুম একটা কাঁচা রাস্তায়, এদিকে ধূ ধূ করছে মাঠ। অন্ধকারের মধ্যেও এক জায়গায় বেশি অন্ধকার, খুব সম্ভবত ঐদিকেই গ্রাম।

এত গরমের মধ্যেও আমার শরীরে যেন একটা শীতের কাঁপুনি লাগল। আমি কোথায় যাচ্ছি? আমার নিয়তি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে? একটু আগে জঙ্গলের মধ্যে আমার মনে হচ্ছিল, ওরা যখন তখন আমায় মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তখন আমার তেমন ভয় করেনি। একেবারে চোখের সামনে মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখলে বোধহয় এরকমই হয়। কিন্তু এরা এখন আমাকে খানিকটা সময় দিয়েছে, এখন ধক্কক্ করছে আমার বুক। আমার চোখ, নাক, কান সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিই গুটিয়ে আসছে। আমি কোনো অন্যায় করিনি, তবু আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যারা আমাকে মারতে চায় তারাও খুনে–গুণ্ডা নয়, সাধারণ গ্রামের মানুষ।

ঐ যে সেই গ্রাম, অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম

গোবিন্দ মেদিনীপুরের ছেলে, শুধু এইটুকুই আমার জানা ছিল। তার গ্রামের নাম আমি জানি না। আমি কি ইচ্ছে করলেও গোবিন্দকে ধরিয়ে দিতে পারতাম পুলিসের হাতে? ডাকাতদের একজনের নাম জানলে পুলিসের পক্ষে তাকে খুঁজে বার করা বোধহয় অসম্ভব নয়। যদি সেরকম উদ্যমী পুলিস হয়। প্রায় তো এখানে সেখানে ডাকাতির খবর কাগজে পড়ি, পুলিস ক’জনকে ধরে? ওদের অত গরজ নেই।

পুলিস নিয়ে আগে অনেক ঠাট্টা ইয়ার্কি করেছি বটে, কিন্তু এখন মনে হলো, একমাত্র পুলিসই আমায় বাঁচাতে পারে। যদি ঐ বাসযাত্রীদের মধ্যে কোনো মন্ত্ৰী বা নেতা–টেতাদের আত্মীয়স্বজন কেউ থাকে, সে যদি জেলার এস পি–কে হুমকি দেয়, তাহলে পুলিস চটপট কিছু একটা করতে চাইবেই। পুলিস সত্যি সত্যি চেষ্টা করলে এই কয়েকটা অ্যামেচার ডাকাতকে ধরতে পারবে না? জঙ্গলের মধ্যে যেখানে বসে এরা কলাগুলো খেয়েছে, কলার খোসাগুলো তো সেখানেই ফেলে এসেছে, এক জায়গায় এক কাঁদি কলার খোসা, একেবারে জাজ্বল্যমান প্রমাণ…

কিংবা এমনও হতে পারে, দূর থেকে পুলিসের দলকে আসতে দেখলেই এরা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে! আমিই তো সবচেয়ে প্রকট একটি লুটের মাল। আমি কিছু বলি আর না বলি, আমাকে দেখলেই পুলিস বুঝবে যে এরাই ডাকাত। আমাকে জ্যান্ত অবস্থায় লুকিয়ে রাখার চেয়ে আমাকে মেরে আমার লাশ গায়েব করা অনেক সহজ। আমাকে মেরে তারপর এদের গ্রামের শ্মশানে যদি আমার দেহটা পুড়িয়ে দেয়, তাহলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।

হঠাৎ যেন দেখতে পেলুম, একটা জ্বলন্ত চিতায় কয়েকজন ধরাধরি করে আমাকে ছুঁড়ে দিচ্ছে, তখনও আমি ভালো করে মরিনি, হাত–পা ছুঁড়ছি…

কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠল বেশ হিংস্র ভাবে। পৌঁছে গেছি গ্রামে। একটা ডোবার পাশে, ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের নিচে অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দুটো কুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল, সুশীলা তাদের তাড়া দিয়ে বলল, যাঃ যাঃ! বড়কাকা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, এই ছোকরাটা একবারও পালাবার চেষ্টা করেছিল নাকি রে হাবু?

হাবুর বদলে সুশীলা উত্তর দিল, না, কিছু করেনি!

বড়কাকা ভুরু তুলে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, চুপচাপ ভালোমানুষের মতন তোদের সঙ্গে সঙ্গে এলো?

সুশীলা বলল, হ্যাঁ গো, তাই তো এলো!

আমি ভাবলুম, গুড কনডাক্‌টের জন্য আমার প্রতি কিছু একটা দয়া দেখানো হবে নিশ্চয়ই। কিছু খেতে–টেতে দেবে কি?

বড়কাকা চিবুক ঘষতে ঘষতে বলল, তবেই বুঝে দ্যাখো, এর মতলোব কত খারাপ। মানে বুঝলে তো, আমাদের গেরামটা ভালো করে চিনে নিতে চায়। কোনোক্রমে ছাড়া পেয়ে গেলেই সোজা দৌড়ে থানায় গিয়ে পুলিস লেলিয়ে দেবে!

হাবু বলল, এই ভদ্দরলোকদের জাতকে কোনো বিশ্বাস নাই!

আমি আকাশ থেকে পড়লুম। ভালো থাকাটাও অপরাধ? আমি পালানোর চেষ্টা করলে আমাকে তক্ষুনি খুন করার একটা সহজ যুক্তি ওরা পেয়ে যেত। ওদের বিবেক পরিষ্কার থাকত। আমি যতক্ষণ বেঁচে থাকব, ততক্ষণই ওদের ঝামেলা! আমার জীবনটাই যে অন্য মানুষদের বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে, তা ভেবেই আমার দারুণ অপমান বোধ হলো!

একটা পনেরো–ষোলো বছরের ধ্যাড়েঙ্গা চেহারার ছেলে তার হাঁটু দিয়ে আমার পেটে একটা গুঁতো মেরে বলল, মারো না, মেরে দাও না!

এই বয়েসী ছেলেরা খুব নিষ্ঠুর হয়। এরা কারুকে মারতে বা নিজেরা মরতে দ্বিধা করে না। পৃথিবীর সব দেশের নেতারাই এই বয়েসের ছেলেদের ক্ষেপিয়ে নিজেদের কাজ উদ্ধার করতে চায়। এই ছেলেটার হাতেও একটা টাঙ্গি, এ প্ৰথমেই টাঙ্গির কোপ না মেরে হাঁটু দিয়ে মেরেছে!

সুশীলা ছেলেটিকে ঠেলে দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই সুবল, তোর বড় বাড় বেড়েছে না? আমরা থাকতে তুই গায়ে হাত দিচ্ছিস যে? যা ঘরে যা, শুয়ে পড়গে যা।

গলা চড়িয়ে সুশীলা বলল, তোমরা সবাই যে–যার ঘরে চলে যাও, চ্যাচামেচি হৈ চৈ যেন না হয়।

পেছন থেকে কেউ একজন বলল, আমাদের টাকাপয়সার হিসেব দিলে না? আমরা তো হাতে কিছু পেলুম না কেউ!

বড়কাকা বলল, ওসব কথা কাল সকালে হবে! হাতে কেউ এখন নগদ কিছু পাবে না, চাল–ডাল পাবে। সে ব্যবস্থা কাল হবে। এখন সব বাড়ি যাও। তক্ষুনি কেউ গেল না, ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন চলল। ডোবাটার ওপাশে দেখা গেল একা একজন মানুষকে। সুশীলা বলল, ঐ তো গোবিন্দ এয়েছে। আর রতন কোথা গেল?

বড়কাকা বলল, রতন গেছে একটা কাজে। তুই এই মানুষটাকে তাইলে তোর বাড়িতেই রাখবি? কে ওকে রাতভোর পাহারা দেবে?

সুশীলা বলল, সে ভাবনা তোমাদের ভাবতে হবে না। হাবু, তুই আমার সাথে আয়।

হাবু আমার হাত ধরে টানতেই আমি একটা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতন হাঁটতে শুরু করলুম। কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। ভিড়ের লোকেরা সবাই কি আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছে? মানুষের ঘৃণা পাবার মতন কোনো কাজ কি আমি জীবনে করেছি!

দুটো কুকুর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। এ গ্রামের কোনো ঘরেই আলো জ্বলছে না, তবে আকাশ একেবারে অন্ধকার নয়। রাস্তা দেখা যায়।

হাবু জিজ্ঞেস করল, পিসি, এডারে কি হাত–পা বেঁধে রাখবে?

সুশীলা সংক্ষেপে বলল, না।

–তবে রাখবে কোথায়? গোয়াল ঘরে?

—না। সে ঘরে কি কোনো মানুষ শুতে পারে?

—তবে তুমি কী করবে এডারে নিয়ে?

–সে আমি বুঝব!

—পিসি, তুমি এতখানি বোঝা নিজের ঘাড়ে নিও না। তোমারে এ গেরামের পাঁচজনে মানে, তোমার কথা শোনে, কিন্তু এই লোকটা যদি কোনো বিপদ ডেকে আনে, তাহলে তোমারে কেউ ছেড়ে কথা কইবে না। মানুষজন যেভাবে রেগে তিরিক্ষি হয়ে আছে…

হঠাৎ থমকে গিয়ে সুশীলা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সোজা আমার চোখে চোখ মেলে অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, আমরা চাষীবাসী মানুষ, চুরি–ডাকাতি দূরে থাক, কোনোদিন অধর্মের কাজ করিনি। আমাদের কত লোক ভাতে মেরেছে, পেটে মেরেছে, তবু আমরা মানুষজনকে কখনো মারতে যাই না…কিন্তু ভগবানেরও দয়া নেই আমাদের ওপরে…পরপর দু’ বছর অজম্মা, এ গাঁয়ের কাউর হাতে একটা পয়সা নেই, কোনো ঘরে একদানা চাল নেই, মহাজনের কাছে জমি বন্ধক পড়েছে, কেউ আর ধার–বাকি দেয় না…এতগুলোন মানুষ কি না খেয়ে মরে যাবে? কোনোদিন যা করিনি, ভিক্ষের জন্য হাত পেতেছিলুম তোমাদের কাছে, তোমরা কেউ কিছু দিলে না…প্রাণের দায়ে লুটপাট করেছি। কাউকে মারধোর করার কথা ছিল না…আমার একটা নাতি পরশু দিনকে মরে গেছে, বউটা কেঁদে কেঁদে গড়াচ্ছে, হালের গোরুটাও বেচে দেবার আগেই মরে গেল…এখন তোমার যদি ধর্ম হয়, তুমি পুলিস ডাকবে, আমাদের ধরিয়ে দেবে, থানা পুলিসে গ্রামে এসে আগুন জ্বালাবে…তবে তুমি তাই দাও..কপালে যদি তাই থাকে তো হবে… এতগুলান মানুষের প্রাণ এখন তোমার হাতে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *