1 of 2

শেষ দৃশ্য – প্রণব রায়

শেষ দৃশ্য – প্রণব রায়

ভারতী থিয়েটারে ভিড় আজ একটু বেশি। ভিড় অবশ্য বেশি হওয়ারই কথা, কেননা সাফল্যমণ্ডিত ‘নিয়তি’ নাটকের আজ দুশো রাত্রি।

বাংলা থিয়েটারের এই দুর্দিনে গত পাঁচ বছরের মধ্যে আর কোন নাটক পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগারে একটানা পঞ্চাশ রাত্রিও চলেনি। একমাত্র ‘নিয়তি’ নাটকখানাই বাংলা থিয়েটারের শুধু যে রূপ পাল্টে দিয়েছে। তা নয়, নাভিশ্বাস-ওঠা ভারতী থিয়েটারকে সতেজে খাড়া করে দিয়েছে। স্টাফের ছ’মাসের মাইনে চুকে গেছে, থিয়েটারবাড়িটি আগাগোড়া রং করা হয়েছে, মায় ছারপোকাওয়ালা সিটগুলো পর্যন্ত বদল করা হয়েছে।

এ হেন ‘নিয়তি’ নাটকের আজ জয়ন্তী উৎসব। আজও শ্রেষ্ঠাংশে বাংলা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুজন শিল্পী নেমেছেন—সুজাতা আর রঞ্জন। আজকের প্রধান অতিথি বাংলার রাজ্যপাল মাননীয় রাজনারায়ণ চক্রবর্তী। সুতরাং ভারতী থিয়েটারে আজ বিরাট ব্যাপার।

আপনাদের মধ্যে অনেকে হয়তো আজ বক্স-অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। হাউস ফুল, টিকিট নেই। তা হোক, ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন ভেতরে। ‘ফ্রি কমপ্লিমেন্টারি’ পাশ আজ বিশেষভাবে বন্ধ। তবু যেতে আমাদের আটকাবে না। কেননা, আমি ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার গল্প-লেখক, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মত সর্বত্রই আমার অবাধ গতিবিধি।

এখন রাত ন’টা বেজে দশ মিনিট। নাটকের বারো আনাই হয়ে গেছে। তা হোক, তবু শেষ দৃশ্যটা দেখবেন চলুন—নাটকের যেটা ‘ক্লাইম্যাক্স’।

তৃতীয় অঙ্কের যবনিকা উঠেছে। তৃতীয় অঙ্কই শেষ অঙ্ক। নায়িকা জয়শ্রীর শয়ন-কক্ষ। জানলা দিয়ে একফালি চাঁদ দেখা যায়। মধুরাত্রি। জয়শ্রীর পরনে বাসকসজ্জা, কবরীতে পুষ্পগুচ্ছ, ললাটে কুমকুম চন্দন।

প্রদীপ জ্বালতে জ্বালতে নায়িকা জয়শ্রী তন্ময় হয়ে গান গাইছে: মধুরাত্রি, তুমি আজ ভোর হয়ো না! প্রতি বৎসর চৈত্রশেষের এই তিথি আসে আমাদের মিলনোৎসবের লগ্ন বহন করে। আজও সেই তিথি, সেই লগ্ন এসেছে। তোমায় মিনতি করি মধুরাত্রি, তুমি ভোর হয়ো না! প্রিয় আমার আসবে, আমি রয়েছি তারই প্রতীক্ষায়।

গাইতে গাইতে জয়শ্রী জানলার ধারে গিয়ে একবার দাঁড়াল। তারপর এসে বসল সযত্ন-রচিত শয্যার ওপর। বিহ্বল কণ্ঠে সে গেয়ে চলেছে:

আকাশে জেগে থাক বাঁকা চন্দ্রলেখা, বাতাসে থাক পুষ্পসুরভি, আর আমার প্রতি নিশ্বাসে থাক মিলনের উষ্ণ মোহ। মধুরাত্রি, আজ তুমি ভোর হয়ো না। দয়িত আজ আমার আসছে, তারই প্রতীক্ষায় আমি প্রহর গুণছি!

জানলা দিয়ে দেখা গেল ধীরে ধীরে একখণ্ড কালো মেঘ চাঁদকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মেঘগহন আকাশে শুরু হল ঘন ঘন বিদ্যুকটাক্ষ!

নায়িকা জয়শ্রী আরো উঁচু পদায় গেয়ে উঠল:

না-না-না, ওগো মধুরাত্রি, অমন করে আঁধারে তুমি মুখ ঢেকো না। বিরূপ হয়ো না আমার ওপর, আমার মধু-যৌবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা দুলে উঠেছে প্রদীপ-শিখার মতন। মধুরাত্রি, আমার মিনতি রাখো, আজকের মিলন-তিথি তুমি অন্ধকার করে দিও না! প্রিয় আমার এখনো আসেনি, তারই প্রতীক্ষায় আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়ে উঠেছে—

কে?

গানের শেষে জয়শ্রীর উৎসুক প্রশ্ন শোনা গেল, কে তুমি?

দরজার কাছে ছায়ামূর্তি ঈষৎ নড়ে উঠল। ধরা-ধরা ভাঙা গলায় জবাব এল, অতীতের প্রেত।

ভয়ত্ৰস্তা জয়শ্রী সে কথার অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি করে উঠল, অতীতের প্রেত!

দরজা পার হয়ে শীর্ণ দীর্ঘ ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে প্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াল। তেমনি ধরা-ধরা ভাঙা গলায় বললে, হ্যাঁ।····চিনতে পারছ?

ভয়ে চিৎকার করে উঠল জয়শ্রী।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বনাশের সঙ্কেতের মত হু হু শব্দে শোনা গেল ঝড়ের বিলাপ।

প্রদীপের আলোয় আগন্তুককে স্পষ্ট দেখা গেল। জীর্ণ মলিন বেশ, রুক্ষ অবিন্যস্ত কেশে জটা পড়েছে, আর মুখ?

সমস্ত প্রেক্ষাগার শিউরে উঠল।

মানুষের যে ওরকম বিকৃতি ঘটতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। না জানি কোন্‌ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধেক মুখটা পুড়ে একেবারে বীভৎস হয়ে গেছে। মুখের সেদিকটায় শুধু শাদা আর লালচে মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। বাঁ দিকের চোখের মণিটা গলে বেরিয়ে এসেছে—একেবারে গালের ওপর! মুখের অপর দিকটা রুক্ষ কটা রঙের দাড়ি-গোঁফে আচ্ছন্ন।

দু-হাতে চোখ ঢেকে জয়শ্রী আর্তনাদ করে উঠল, কে তুমি?

শাদা শাদা দাঁত বের করে আগন্তুক নিঃশব্দে হাসল: বলেছি তো অতীতের প্রেত। তবে একদিন একটা নাম ছিল বটে। ধর, রমাপতি। রমাপতি সেন।

বিহ্বলের মত জয়শ্রী একবার চোখ তুলে তাকাল। তারপর আবার চিৎকার করে উঠল, না-না, এ মিথ্যে!

আগন্তুক বললে, আজ হয়তো মিথ্যে, কিন্তু একদিন সত্য ছিল। আজ থেকে সাত বছর আগে ডাক্তার রমাপতি সেনকে অনেকে চিনত। রমাপতির তখন স্বাস্থ্য ছিল, রূপ ছিল, দীপ্তি ছিল। ছিল না শুধু অর্থ। সবে ডাক্তারি পাশ করেছে, তখনও পসার জমেনি! সেই রমাপতি, ধর, একদিন সারপেন্টাইন লেনে এক রুগী দেখতে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখতে পায়। তার নাম ধর, কণা।

উইংসের পাশ থেকে প্রম্পটার চাপা গলায় বললে, কি বলছেন রঞ্জনবাবু, নাম যে ভুল হয়ে যাচ্ছে।

স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে শিল্পী সে কথায় কান দিল না।

জয়শ্রী বালিশে মুখ গুঁজে বললে, চুপ কর, ওকথা শুনতে চাই না—তুমি যাও—চলে যাও—

আগন্তুক এবার শব্দ করে হাসল: বললেই কি যাওয়া চলে? গল্প এখনও শেষ হয়নি যে। বাকিটুক শোন। দরিদ্র যুবক রমাপতির সঙ্গে ধনীর মেয়ে কণার হল আলাপ। ডাক্তারি-বিদ্যায় রমাপতির হাত ছিল ভাল, দিনকয়েকের মধ্যেই কণাকে সে সারিয়ে তুললে। রুগী আরাম হল বটে, কিন্তু ডাক্তার পড়ল অসুখে। কণাকে রমাপতি ভালবাসল। এমন ভালবাসা, যা কেউ কখনো বাসেনি। দরিদ্র রমাপতির সমস্ত হৃদয় মন্থন করে উঠেছিল সেই ভালবাসার অমৃত,—আর ধনী-কন্যা কণা সমগ্র চেতনা দিয়ে উপভোগ করতে লাগল সেই অমৃতের স্বাদ।

মিথ্যে—সব মিথ্যে!—জয়শ্রী তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল।

গল্প মিথ্যেই হয়, কিন্তু ঘটনা হয় সত্য! নয় কি?

আগন্তুকের কথাগুলো ব্যঙ্গের মত শোনাল।

দুই হাত পিছনে মুঠো করে সে ঘরের এধার থেকে ওধার অবধি হাঁটতে হাঁটতে বললে, তারপর শোন। দিন যেতে লাগল স্বপ্নে ভেসে। কণা রমাপতিকে কথা দিলে, তাকে বিয়ে করবে—যেদিন তার সংসার পাতবার সঙ্গতি হবে। নির্বোধ রমাপতি সরল মনে বিশ্বাস করলে। আর, সেই আশায় তার যথাসর্বস্ব বেচে, দেনা করে সে করলে একটি ল্যাবরেটরি—কিছু দেশী ওষুধ তৈরি করে ব্যবসা করবে বলে। টাকা চাই—চাই নীড় বাঁধার সঙ্গতি, যে নীড় সে বাঁধবে কণাকে নিয়ে। রমাপতি ডুবে গেল ল্যাবরেটরির মধ্যে, আর তার ওষুধ দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাজারে। এদিকে কিন্তু নাটক বদলাতে শুরু করেছে। সঞ্জয় বলে একটি ব্যারিস্টারের ছেলের আনাগোনা শুরু হয়েছে কণাদের ড্রইংরুমে। রমাপতি যখন জানতে পারল, তখন সঞ্জয়ের সঙ্গে কণার এনগেজমেন্ট পাকা হয়ে গেছে। ছুটে এল সে কণার কাছে। জিজ্ঞাসা করলে, এই যদি তোমার মনে ছিল, তাহলে আমায় কথা দিয়েছিলে কেন? মুখ ফিরিয়ে কণা জবাব দিলে, কালকের কথার দাম আজ আর থাকে না। চলে আসার আগে রমাপতি শুধু বললে, তোমার মায়ের কলঙ্ক-ইতিহাসটা সঞ্জয়ের বাপ বোধ হয় জানেন না, জানিয়ে দেওয়াটা কর্তব্য।

প্রম্পটার আবার বলে উঠল, কি বলছেন রঞ্জনবাবু, এসব কথা তো নাটকে নেই!

আগন্তুক তেমনি বলে যেতে লাগল, কিন্তু সে সুযোগ রমাপতি আর পায়নি। একদিন রাত্রে ল্যাবরেটরি থেকে ফেরবার সময় অন্ধকারে কে যেন তার মুখে অ্যাসিড-ভরা বাল্‌ব ছুঁড়ে মারলে। সে অ্যাসিড সংগ্রহ করা হয়েছিল তারই ল্যাবরেটরি থেকে—কে করেছিল জানো? কণা নিজেই।

উন্মাদিনীর মত জয়শ্রী চিৎকার করে উঠল, তুমি যাও—তুমি যাও বলছি; নইলে পুলিশ ডাকব—

ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে গলা মিশিয়ে আগন্তুক অট্টহাস্য করে উঠল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় বললে, উতলা হয়ো না, গল্প আর অল্পই বাকি আছে। হ্যাঁ শোন, ছ’মাস বাদে যখন রমাপতি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল, আর্শিতে মুখ দেখে নিজেকেই সে নিজে চিনতে পারেনি। জীবনে প্রথম ভালবাসার নিদারুণ বীভৎস স্মৃতি তার আধখানা মুখে নিষ্ঠুর ভাবে আঁকা!

স্তম্ভিত প্রম্পটার প্রায় চিৎকার করে উঠল, কি সব বলছেন রঞ্জনবাবু? আজ আপনার কি হয়েছে?

হঠাৎ মুখখানা জয়শ্রীর একেবারে কাছে এগিয়ে এনে আগন্তুক বললে, দেখ তো চিনতে পার কিনা?

নীলাভ ফ্ল্যাশ লাইট এসে পড়ল বিকৃত বীভৎস মুখখানার ওপর। দর্শকরা সভয়ে চোখ বুজল। আর, দু-হাতে মুখ ঢেকে জয়শ্রী যেন মৃত্যু-যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল।

আগন্তুক আবার অট্টহাস্য করে বলতে লাগল, হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর রমাপতি মনে মনে শুধু অপেক্ষা করে রইল, কবে কণার সঙ্গে দেখা হবে! জীবনের প্রথম ভালবাসা কি ভোলা যায়? সে যে মর্মান্তিক ভালবাসা! অবশেষে দেখা হল একদিন। নিয়তির চক্রান্তে! কত খুঁজে খুঁজে কত চেষ্টার পর রমাপতি দেখা পেল এক রাত্রে। তারপর এল তার বাঞ্ছিত প্রতিহিংসার মুহূর্তটুকু! তারপর—

আগন্তুক এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যেতে লাগল জয়শ্রীর কাছে—ক্ষুধিত শ্বাপদ যেমন করে এগিয়ে যায় শিকারের কাছে।

জয়শ্রীর মুখ ছাইয়ের মত বিবর্ণ। আতঙ্ক আর কান্নায় জড়িত স্বরে বলে উঠল, না, না, না—রমাপতি ক্ষমা কর—ক্ষমা কর আমায়—

সমস্ত প্রেক্ষাগার স্তব্ধ। একি অপূর্ব অভিনয়!

নিষ্ঠুর দুই হাতের থাবায় জয়শ্রীর কণ্ঠনালী চেপে ধরে ধরা গলায় আগন্তুক বললে, জীবনে বড় আশায় ছাই পড়লে কেউ কাউকে ক্ষমা করে না কণা—রমাপতিও আজ করবে না—

তীক্ষ্ণ কাতর এক আর্তনাদ করে উঠেই জয়শ্রীর কণ্ঠ হঠাৎ নীরব হয়ে গেল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্টেজের ওপরে ধীরে ধীরে নেমে এল কালো ভেলভেটের ভারী যবনিকা।

মিনিট দুয়েক যেন সূঁচ পড়লে শোনা যায়। তারপর বিপুল করতালির ধ্বনিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগার। দর্শকদল চিৎকার করে বলতে লাগল, আমরা শিল্পী সুজাতা আর রঞ্জনকে দেখতে চাই—অভিনন্দন জানাতে চাই—

ওদিকে যবনিকার ওপারে ম্যানেজার সত্যকিঙ্করবাবু হাঁকাহাঁকি শুরু করেছেন: ওঠো, ওঠো সুজাতা, তোমাকে আরেকবার অ্যাপিয়ার হতে হবে। সবাই দেখতে চাইছে তোমাকে—অভিনন্দন জানাবে। কই, রঞ্জনবাবু কোথায় গেলেন? কে আছিস রে, রঞ্জনবাবুকে তাড়াতাড়ি মেকআপ তুলে আসতে বল!

স্টেজের ওপর নিয়তি নাটকের শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী সুজাতা তখন চোখ বুজে বিছানায় লুটিয়ে।

সত্যকিঙ্করবাবু অধীর হয়ে উঠলেন: আঃ, দেরি করো না সুজাতা, উঠে এস—গভর্নর বাহাদুর নিজে তোমাদের মালা পরিয়ে দেবেন বলছেন····ওঠো, ওঠো সুজাতা—

সুজাতার কাছ থেকে কোন সাড়া নেই।

সুজাতার গায়ে ধাক্কা দিয়ে সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি সুজাতা? কি জ্বালা! দর্শকরা তোমায় দেখবে বলে ক্ষেপে গেছে—উঠে এস সু····

অকস্মাৎ সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের কথা হারিয়ে গেল। কপালে পড়ল রেখা, চোখ হল বিস্ফারিত। সুজাতার কপালে হাত রাখলেন তিনি, আবার ডাকলেন। তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, ডাক্তার, ডাক্তার····

সুজাতার দেহ বরফের মত ঠাণ্ডা!

ভারতী থিয়েটারের দীর্ঘ তিরিশ বছরের জীবনে এত বড় নাটক আর কখনো হয়নি।

মৃত্যুর অভিনয় এই স্টেজের ওপরে বহুবার হয়েছে। কিন্তু আজকের মত এমন মর্মান্তিক ভাবে সত্য হয়ে ওঠেনি কখনো। সত্যকিঙ্করবাবুর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল; কপাল উঠল ঘেমে।

একি হল! সুজাতা কি সত্যিই খুন হল?

পদার বাইরে উৎসাহী দর্শকদের চিৎকার তখন সমানে চলেছে। সত্যকিঙ্করবাবু একবার ভাবলেন, বাইরে গিয়ে এই মারাত্মক দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে দেন। কিন্তু না, জানানোটা উচিত হবে না। তাতে থিয়েটারের বদনাম হতে পারে। একজন অভিনেতাকে ডেকে বললেন, পাবলিককে বলে দাও সুজাতা ফিট হয়ে পড়েছে—এখন যেতে পারবে না, আপনারা ক্ষমা করুন!

খবর পেয়ে থিয়েটারের অনিমেষ ডাক্তার ততক্ষণে এসে পড়েছে। সুজাতাকে পরীক্ষা করে ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে উঠল। সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, মিনিট পনের হল মারা গেছেন শ্বাস বন্ধ হয়ে। কিন্তু কি করে এমনটা হল বলুন তো?

পাংশুমুখে সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না ডাক্তার। বরাবর যেমন প্লে হয়, আজও তেমনি হচ্ছিল। তবে আজকের প্লেটা অসম্ভব রকম জমে উঠেছিল! জমবার কথাই—দুশো নাইট আজ, আর্টিস্টদের মনে তাই জোর উৎসাহ ছিল। বিশেষ করে নাটকের লাস্ট সিনে—মানে জয়শ্রীর ডেথ্‌ সিনে—সুজাতা আর রঞ্জন যা প্লে করছিল, কী বলব ডাক্তার! এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ! আর রঞ্জনের অ্যাক্‌টিং যেন আজ আশ্চর্যরকম খুলে গিয়েছিল।····হ্যাঁ, দেখ তো রঞ্জনের মেকআপ তোলা হল কিনা! এখনো আসছে না কেন?

ভিডের ভেতর থেকে একজন সিন-সিফটার বললে, আজ্ঞে, গ্রীনরুমে মেকআপের জিনিসপত্র সব পড়ে আছে, কিন্তু রঞ্জনবাবু নেই।

আর কোথাও আছে, খুঁজে দেখ।

আজ্ঞে খুঁজে দেখেছি, থিয়েটারের কোথাও তিনি নেই।

থি-য়ে-টা-রে-র কো-থা-ও নে-ই!

পাকানো গোঁফজোড়া সমেত সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের হাঁটা ঝুলে পড়ল। সেকি! রঞ্জন তো না বলে কোনদিন যায় না! তাছাড়া আজ তার টাকা নিয়ে যাবার কথা—গেল কোথায় সে? আর কেনই বা হঠাৎ চলে গেল?

আশেপাশে স্ত্রী-পুরুষের যে ছোটখাটো জটলা জমে উঠেছিল, তাদের মধ্যে ফিসফিস করে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সকলের মুখে পড়ল আতঙ্ক, উদ্বেগ আর সন্দেহের ছায়া।····সুজাতা খুন হয়েছে, কিন্তু রঞ্জন—সে পালাল কেন?

অনিমেষ ডাক্তার বাঁ-চোখটা সংশয়ে ছোট করে বললে, ব্যাপার বড় সন্দেহজনক ঠেকছে ম্যানেজারবাবু। আমার মনে হয় পুলিশে খবর দেওয়াই ভাল।

পুলিশ!

সত্যকিঙ্করবাবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন: হা রামকৃষ্ণ! একি যাঁতাকলে ফেললে ঠাকুর! আমার থিয়েটার গেল, মান গেল, ইজ্জৎ গেল—

আমি একবার দেখতে পারি কী?

সত্যকিঙ্করবাবু চমকে পেছন ফিরে তাকালেন। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আধাবয়সী একটি অপরিচিত ভদ্রলোক। দীর্ঘাকার, ছিপছিপে, নাকটা খড়েগর মত উঁচু, তামাটে গৌর বর্ণ, মাথার সামনের চুলগুলি পাতলা, ঠোঁটের প্রান্তে নিবন্ত একটা পাইপ, বেশ-ভূষায় কিন্তু পুরো বাঙালি।

সত্যকিঙ্করবাবু বিহ্বলভাবে তাকালেন: দেখবেন! কী দেখবেন?

মৃতদেহ!

কেন, কেন দেখতে চাইছেন?

হয়তো আপনাদের কোন সাহায্যে লাগতে পারি।

আপনি কি ডাক্তার?

আজ্ঞে না, ডাক্তার নই।

তবে কে আপনি?

অপরিচিত ব্যক্তি মুখ থেকে পাইপটা নামাল। তারপর স্মিত বিনীত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বলল, আমার নাম প্রতুল লাহিড়ী। আমি আজ থিয়েটার দেখতে এসেছিলাম।

মিনিট খানেকের জন্য স্টেজের ভেতরটা কবরের মত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অনেক জোড়া চোখ সভয়ে এবং সকৌতূহলে একসঙ্গে এসে পড়ল প্রতুল লাহিড়ীর মুখের ওপর। আবার ঝুলে পড়ল পাকানো গোঁফ সমেত সত্যকিঙ্করবাবুর প্রকাণ্ড হাঁ।

অনিমেষ ডাক্তার বাঁ চোখ ছোট করে প্রশ্ন করলে, আপনি প্রতুল লাহিড়ী—মানে, যাঁর আশ্চর্য গোয়েন্দাগিরির কথা—

আজ্ঞে হ্যাঁ।—পকেট থেকে সে একখানা ছোট কার্ড, বের করে সামনের দিকে ধরল।

এতক্ষণে সত্যকিঙ্করবাবু হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। হাউমাউ করে চেঁচিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, ওঃ, আপনি একেবারে ঈশ্বরপ্রেরিত, প্রতুলবাবু! ঠিক সময়টিতে এসে পড়েছেন—পাকা গোয়েন্দার কাজই এই। দেখুন দিকি, আজকের দিনে কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড আমাদের থিয়েটারে! আর খুন হবি তো একটা হেজি-পেজি হ’, তা নয়, খুন হল কিনা একেবারে খাস হিরোইন সুজাতা! কী মারাত্মক ব্যাপার বুঝুন স্যার! আমি তো ধনে-প্রাণে মারা গেলাম, স্যার! রামলগন শেঠ—আমাদের থিয়েটারের মালিক—এ খুনের কথা যখন জানতে পারবে, তখন কী আর রক্ষে থাকবে? থিয়েটারে তো একটি পয়সাও দেবে না, উপরন্তু আমাদের সব কটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকে পুরে দেবে নির্ঘাৎ। হা মধুসূদন, বুড়ো বয়েসে শেষটায়—

সত্যকিঙ্করবাবুর খেদোক্তি কোথায় গিয়ে শেষ হত, তা বোধ করি মধুসূদনই জানেন। কিন্তু প্রতুল বাধ্য হয়েই তাকে থামিয়ে দিলে। বললে, অত অধীর হবেন না—এ সময়ে ধৈর্য হারালে চলে না। মৃতদেহটি আমায় একবার ভাল করে দেখতে দিন।

তারপর এগিয়ে গিয়ে সুজাতার পাশে বসল।

রূপসজ্জার দরুন দূর থেকে সুজাতাকে অল্পবয়স্কা মনে হলেও, কাছে থেকে লক্ষ্য করে প্রতুলের মনে হল স্ত্রীলোকটির বয়স হয়েছে। ঠিক অনুমান করতে না পারলেও বোঝা গেল, বয়সটা যৌবনের শেষ অঙ্কে এসে পড়েছে! আশ্চর্যরকম সুগঠিত দেহ। বড় বড় খোলা দুটি চোখে মৃত্যু-যন্ত্রণার বদলে আতঙ্কের চিহ্নই ফুটে আছে। গলার ওপরে তিনটে কালশিরা পড়েছে—তিনটি আঙুলের দাগ। প্রতুল বুঝতে পারল আঙুলগুলি রোগা লম্বাটে হলেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তারই কঠিন নিষ্পেষণে সুজাতার জিভের খানিকটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, ডান দিকের কষ বেয়ে নেমেছে খানিকটা রক্ত।

পরীক্ষা শেষ করে প্রতুল সত্যকিঙ্করবাবুকে বললে, গোটাকতক প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।

করুন স্যার।

একটু নিরিবিলি হলে ভাল হয়।

নিশ্চয়, নিশ্চয়!—সত্যকিঙ্করবাবু হঠাৎ বোমার মত ফেটে পড়লেন, এখানে রথ না দোল হচ্ছে যে ভিড় করে সবাই তামাসা দেখছ? যাও, যাও এখান থেকে সব!

অনিমেষ ডাক্তার ছাড়া ভিড় সরে গেল।

প্রতুল জিজ্ঞেস করলে, সুজাতা কতদিন আপনার থিয়েটারে কাজ করছিল?

সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, বেশি দিন নয়, বছর তিনেক।

তার আগে?

তার আগে থিয়েটার-ফিয়েটার করত না মশায়।

তবে কী করত?

কি আর করবে, ঘর সংসার। ঘরের বৌ ছিল কিনা—

বটে! ঘরের বৌ সুজাতা থিয়েটারে এল কেন?

শুনেছি, সুজাতার স্বামীটা ছিল পয়লা নম্বর মাতাল আর জুয়াড়ি! দুজনে বনিবনা হত না মোটেই। তাই ঘর থেকে সে চলে আসে। এসে থিয়েটারে জয়েন করে। মেয়েটার চেহারা ছিল চটকদার, আর গানের গলাও ছিল খাসা। পড়ে গেল রামলগন শেঠের নজরে। বড়লোকের নজর, বুঝতেই তো পারছেন—সখীর ব্যাচ থেকে একেবারে হিরোইন।

সুজাতার স্বামী বেঁচে আছে?

তা কেমন করে বলব মশায়। তবে বছরখানেক আগে কোট-পেন্টুল-পরা রোগা লম্বাটে একটা লোক মাঝে মাঝে থিয়েটারে আসত সুজাতার সঙ্গে দেখা করতে। লোকটাকে দেখতে একেবারে হ্যাগার্ড! সেই লোকটা তার স্বামী কিনা কে জানে?

সুজাতা থাকত কোথায়?

বৌবাজারে ফিয়ার্স লেনে—সাতের-বি নম্বর।

বাড়িটা কার?

ওই শেঠজীরই একটা ভাড়াটে বাড়ি। একতলা, দোতলায় কয়েক ঘর ভাড়াটে আছে আর তিনতলায় থাকত খালি সুজাতা।

নোটবই বের করে প্রতুল লিখে নিচ্ছিল। লেখা থামিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, এ খুন সম্পর্কে কাকে আপনার সন্দেহ হয়?

সত্যকিঙ্করবাবু এ প্রশ্নের জন্য বোধ করি তৈরি ছিলেন না। একটু থতমত খেয়ে বললেন, তা কেমন করে বলব স্যার? তবে····রঞ্জন····

রঞ্জনবাবুই খুন করেছেন বলে আপনার মনে হয় কি?

সত্যকিঙ্করবাবু আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন: রঞ্জন ছাড়া আর কাকেই বা সন্দেহ করব বলুন? ফিলিংসের মাথায় সুজাতার গলা হয়তো একটু বেশি জোরে টিপেছিল—তারই ফলে—

রঞ্জনবাবু কতদিন আপনাদের থিয়েটারে আছেন?

বছর দেড়েক হবে। মানে সুজাতা আসার পর। আগে নাকি চাকরি করত রেলের অফিসে। চাকরি যাওয়ার পর থিয়েটারে আসে।

কোন নেশা ভাঙ করতেন?

নেশা ভাঙ মানে—একটু-আধটু মদ—তা থিয়েটার লাইনে ওটা দোষের নয়। তবে হ্যাঁ, কোনদিন বদখেয়াল দেখিনি রঞ্জনের। হাজার হোক, লেখাপড়া জানা ছেলে তো!

প্রতুল হাসল: আজকাল লেখাপড়া জানা ছেলেরাই তো বিগড়ে যায় বেশি। আচ্ছা, আজকের অভিনয়ে নাটকের কথা ছাড়া আরও অনেক কথা রঞ্জন বানিয়ে বলেছিল, না? মানে যেসব কথা নাটকে নেই!

হ্যাঁ, তা বলেছিল বটে!

এইভাবে এক্সটেম্পোর ডায়লগ—মানে মুখে মুখে তৈরি করা কথা সে কি আগেও বলত?

না, স্যার। আজই প্রথম বলতে শুনলুম।

আজই বা কেন বলল, অনুমান করতে পারেন কি?

বোধ হয় লাস্ট সিনটাকে আরও জমাবার জন্যে।

প্রতুলের কপালে কয়েকটা রেখা পড়ল। সত্যকিঙ্করবাবুর উত্তরটা শুনে হয়তো সে খুশি হতে পারেনি। নিবন্ত পাইপটা ধরিয়ে আবার সে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, সুজাতার সঙ্গে রঞ্জনের সম্পর্কটা কেমন ছিল?

সম্পর্ক তো বাইরে থেকে ভালই মনে হত। আর খারাপ হবার যো কোথায়—রামলগন শেঠের যা কড়া নজর! প্লে-র দিন বুড়ো রোজ এসে উইংসের পাশে বসে সুজাতাকে কড়া পাহারায় রাখে। আজ দু’দিন নেহাৎ ব্যবসার খাতিরে ঝরিয়া যেতে হয়েছে—তবে চোরে-কামারে কখন যে ভাব হয়ে যায়, কিছুই বলা যায় না স্যার!

রঞ্জনের বাড়ির ঠিকানাটা দিতে পারেন?

পারি বৈকি! উনিশের-এক মদন মিত্র লেন!

নোটবইটা পকেটে ফেলে প্রতুল উঠে দাঁড়াল। বললে, রঞ্জনবাবু যে ঘরে মেকআপ করেন, সে ঘরটা একবার দেখতে চাই।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আসুন।

স্টেজের বাঁ দিকে সারি সারি অনেকগুলি ছোট ঘর। কাঠের পার্টিশন দেওয়া এগুলো সাধারণ আর্টিস্টদের সাজবার ঘর। স্টেজের পেছন দিক থেকে লোহার একটা ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। তারই পাশে দু’খানা মাঝারি সাইজের গ্রীনরুম। এ দুটি কেবল হিরো এবং হিরোইনের জন্যে। একটায় সুজাতা আর একটায় রঞ্জন মেকআপ করে।

প্রতুল সুজাতার মেকআপ রুমেই প্রথমে ঢুকল। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বড় আর্শির সামনে টেবিলের ওপর রূপসজ্জার মামুলি উপকরণ সাজান। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা থিয়েটারের রূপসজ্জা হয় চতুর্থ শ্রেণীর। সুতরাং হিরোইনের ঘরেও রূপসজ্জার উপকরণগুলি অত্যন্ত পুরোন ফ্যাশনের। আর্শির এক কোণায় একটা যুঁই-এর গোড়ে ঝুলছে। হয়তো কোন ভক্ত উপহার দিয়েছিল। পাশের আলনায় সুজাতার নিজস্ব মুর্শিদাবাদ সিল্কের ছাপা শাড়ি, ব্লাউজ আর পাতলা শিফনের স্কার্ফ ঝুলছে। টেবিলের ওপর প্রসাধন-সামগ্রীর পাশে ভায়োলেট রঙের প্লাস্টিকের একটা লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ। মেকআপ টেবিলের সামনে ছোট টুলের পাশে একজোড়া শান্তি-নিকেতনী চপ্পল। এটাও সুজাতার। সমস্ত ঘরটায় ক্রীম-পাউডারের সুগন্ধ। একপাশে একটা চেয়ারের ওপর খানদুয়েক ছাড়া জর্জেট শাড়ি। এগুলি থিয়েটারের পোশাক।

সুজাতার মেকআপ-রুমে চারদিকে ভাল করে চোখ বুলিয়েও এই ক’টা মামুলি জিনিস ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখা গেল না।

শুধু একটা জিনিস আপনাদের সামনে পরীক্ষা করতে চাই সত্যকিঙ্করবাবু।— বলে প্রতুল টেবিলের ওপর থেকে লেডিজ হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিল। হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে বেরোল রুপোর একটি জর্দার কৌটো, তিনটে হেয়ার পিন, কয়েকটা খুচরো টাকা, একটা পাউডার পাফ, একটা চাবির রিঙ আর কচি কলাপাতা রঙের একটা সিল্কের রুমাল; এক কোণে লাল সুতোয় লেখা ‘R’।

জিনিসগুলো যথাস্থানে রেখে প্রতুল বললে, চলুন, এবার রঞ্জনবাবুর মেকআপ-রুমটা দেখে আসা যাক।

পাশের ঘরটা রঞ্জনের মেকআপের জন্যে। ঘরের ভেতর ঢুকতেই স্পিরিট গামের তীব্র গন্ধ পাওয়া গেল। বেশি পাওয়ারের বাল্‌ব লাগানো বড় আর্শিটার সামনে টেবিলটা কটা রঙের কুচো ক্রেপে ভর্তি হয়ে আছে। রূপসজ্জার অন্যান্য সামগ্রী ছাড়াও টেবিলের একপাশে একটা পিজবোর্ডের খোলা বাক্সর মধ্যে এক বান্ডিল নতুন ক্রেপ আর একখানা কাঁচি পড়ে। রঙের কৌটোগুলো এলোমেলো ভাবে খোলা, দুটো ব্রাশ ছিটকে মেঝের ওপর পড়ে। স্পিরিট গামের শিশিটা কাৎ হয়ে আছে। একপাশে একটা কাঠের বেঞ্চির ওপর থেকে ডোরা-কাটা একটা শার্ট মেঝের ওপর ঝুলছে। টেবিলের পাশে একটা চেয়ার উল্টানো।

ঘরে ঢুকেই প্রতুল থমকে দাঁড়াল। তারপর বুকভরে একবার নিশ্বাস নিয়ে ঘরের বাতাসটা শুঁকলে।

সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, ও স্পিরিট গামের গন্ধ। লাস্ট সিনে রঞ্জনকে অদ্ভুত রকমের একটা মেকআপ নিতে হয়—দাড়ি-গোঁফের জন্যে ক্রেপের কাজও করতে হয় অনেকটা। তাই—

কিন্তু স্পিরিট গাম ছাড়াও আমি আর একটা গন্ধ পাচ্ছি।

কিসের গন্ধ বলুন তো?

প্রতুল বললে, ক্লোরোফর্মের।

বলেন কি স্যার?

সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের দু-পাশটা আবার ঝুলে পড়ল।

প্রতুল প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, রঞ্জনবাবু কি নিজে মেকআপ করতেন, না কোন মেকআপ ম্যান····

গোড়ার দিকটা নিজেই করতেন, খালি লাস্ট সিনের জন্যে বটু তাঁকে সাহায্য করত।

বটুকে একবার ডাকতে পারেন?

নিশ্চয়।

সত্যকিঙ্করবাবু বটুকে তখনই ডাকলেন। কিন্তু বটু জানাল, আজ রঞ্জনের মেকআপের জন্যে এসে সে দেখে, গ্রীনরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় ঘা দিয়ে ডাকতেই রঞ্জনবাবু বলেন, আজ তিনি নিজেই মেকআপ করে নেবেন।

প্রতুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না। রঞ্জনবাবু কি প্লে’র সময়ও ড্রিঙ্ক করতেন?

সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, না, কখনো তো দেখিনি। তাছাড়া মদ সে খেত প্লে সেরে বাড়ি ফেরবার পথে। কিন্তু একথা জানতে চাইলেন কেন প্রতুলবাবু?

ঘরের এলোমেলো জিনিসগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রতুল বললে, এগুলো দেখে মনে হয় না কি যে রঞ্জনবাবু ঠিক প্রকৃতিস্থ অবস্থায় আজ মেকআপ করেননি? অথবা—

প্রতুল হঠাৎ থেমে গেল। পকেট থেকে আইগ্লাশ বার করে কাঁচিটার হাতল দুটো পরীক্ষা করলে। তারপর সেটা রুমালে মুড়ে পকেটে ফেলে বললে, এটা আমার কাছেই থাক সত্যকিঙ্করবাবু।····আচ্ছা, এবার রঞ্জনবাবুর পাঞ্জাবির পকেটটা দেখা যাক।

আলনার হ্যাঙারে রঞ্জনের গিলে-করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি ঝুলছিল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের হল একটা জার্মান সিলভারের সিগারেট কেস, একটা আধময়লা সাধারণ রুমাল, শুভ্রা লন্ড্রীর একখানা বিল আর পাঁচ টাকা সাড়ে ন’আনা পয়সা।

আইগ্লাশটা দিয়ে প্রতুল জার্মান সিলভারের সিগারেট কেসটাও পরীক্ষা করলে। তারপর কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ হয়ে রইল।

রঞ্জনের সিগারেট কেসটাও প্রতুল সাবধানে পকেটে পুরলে। তারপর গ্রীনরুম থেকে বেরিয়ে সত্যকিঙ্করবাবুকে প্রশ্ন করলে, আপনি কি নিশ্চয় করে বলতে পারেন, আজকের নাটকের শেষ দৃশ্যে সুজাতার সঙ্গে রঞ্জনবাবুই নেমেছিলেন, না আর কেউ?

বলেন কি স্যার!—সত্যকিঙ্করবাবু চোখ দুটি গোল গোল করে বলে উঠলেন, রঞ্জন ছাড়া আর কে নামবে? ভূতে? এ আপনি কি বলছেন স্যার?

প্রতুলের কপালে দু-একটি রেখা দেখা দিল। বললে, আমার কথাটা হয়তো অদ্ভুত শোনাচ্ছে আপনার কাছে; কিন্তু আমার মনে হয়, আজ নাটকের শেষ দৃশ্যে রঞ্জনের বদলে অন্য কেউ মেকআপ করে নেমেছিল নিশ্চয়।

সত্যকিঙ্করবাবু ধপ করে ঘোরান সিঁড়ির একটা ধাপের ওপর বসে পড়লেন। তাঁর মুখ থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল: তাহলে খুনটা—

আর যেই করুক, রঞ্জন করেনি।

সত্যকিঙ্করবাবু উদ্‌ভ্রান্তের মত প্রশ্ন করলেন, খুন করেনি তো সে পালাল কেন? আর গেলই বা কোথায়?

আর একবার বুকভরা নিশ্বাস নিয়ে প্রতুল বললে, কোথাও যায়নি, এই থিয়েটারেই আছে।

কিছু বলার জন্যে সত্যকিঙ্করবাবু হাঁ করেছিলেন। তার আগেই প্রতুল বললে, আসুন আমার সঙ্গে।

তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে ব্লাড-হাউন্ড যেমন শিকারের সন্ধানে চলে, তেমনি করে চারপাশের আবহাওয়া শুঁকতে শুঁকতে প্রতুল লোহার ঘোরান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। বাধ্য হয়ে অনুসরণ করলেন সত্যকিঙ্করবাবু আর মেকআপ ম্যান বটু!

সিঁড়িটা উঠে গেছে দোতলার বারান্দায়। বারান্দা ঘুরে, ছাদের পশ্চিম কোণায় যে ঘরটার সামনে এসে প্রতুল দাঁড়াল, সে ঘরে থিয়েটারের বহুকালের পুরোন পোস্টারের গাদা জমা করে রাখা হয়। ছেঁড়া-খোঁড়া কিছু পুরোন আমলের ‘সিন’ও জড়ো করা আছে সেখানে। দরজায় তালা নেই, একটুকরো নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা। দড়ির বাঁধন খুলে প্রতুল জিজ্ঞাসা করলে, ঘরে বাতি আছে?

সত্যকিঙ্করবাবু জানালেন, দরজার বাঁ দিকে সুইচ।

পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বেলে প্রতুল ঘরে ঢুকল। তারপর বাঁ দিকে, সুইচটা খুঁজে ইলেকট্রিক বাতিটা জ্বেলে দিলে। ঘরখানা আকারে বড়, কিন্তু অত্যন্ত নিচু। লম্বায় পাঁচ ফুটের ওপর হলে মাথায় টিনের চাল ঠেকে যাওয়ার কথা। একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি জানি কেন প্রতুল হঠাৎ হেঁট হয়ে সেই ছেঁড়া সিনের জঞ্জাল ঘাঁটতে লাগল।

দরজার বাইরে থেকে সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, ওখানে কি করছেন মশাই?

প্রতুলের কাছ থেকে কোন জবাব এল না।

সত্যকিঙ্করবাবু আর একবার সাবধান-বাণী উচ্চারণ করলেন, শুনছেন, ও জায়গাটা ভাল নয় মশাই—সাপ, বিছে কত কি—

প্রতুল শুধু বললে, আসুন, দেখে যান—

উত্তেজনার মুহূর্তে ঢুকতে গিয়ে সত্যকিঙ্করবাবু ‘বাপ!’ বলে উঠলেন। নিচু সাইজের দরজার চৌকাঠে চোট খেয়ে তাঁর কপালে ততক্ষণে একটা মাঝারি আকারের নৈনিতাল আলু দেখা দিয়েছে।

কিন্তু সত্যকিঙ্করবাবুর আগেই পৌনে পাঁচ ফুট লম্বা মেকআপম্যান বটু ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতুলের পাশে। দেখা গেল, ছেঁড়া ‘সিনে’র স্তুপের আড়ালে গেঞ্জি আর লুঙ্গিপরা এক ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

বিস্ময়ে হতভম্ব বটু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, রঞ্জনবাবুকে পাওয়া গেছে ম্যানেজারবাবু—এই যে এখানে—

‘অ্যাাঁ!’ বলে সওয়া ছ’ ফুট লম্বা সত্যকিঙ্করবাবু দ্বিতীয়বার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে কপালে শুধু দ্বিতীয় দফা চোট পেলেন।

প্রতুল এবং বটু ততক্ষণে রঞ্জনের দেহটা ধরাধরি করে বাইরে এনে ফেলেছে।

রঞ্জনকে দেখে কপালের ডবল চোট ভুলে সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, পাওয়া গেছে রঞ্জনকে! জয় রামকৃষ্ণ!····ওরে কে আছিস, রঞ্জনকে নামিয়ে নিয়ে যা—

ঘোরান সিঁড়ি দিয়ে জনতিনেক থিয়েটারের লোক উঠে এসে প্রতুলের হাত থেকে নিশ্চেতন রঞ্জনকে তুলে নিল।

সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, এদিক দিয়ে আর নয়, বক্স-এর পাকা সিঁড়ি দিয়ে ওকে নামিয়ে নিয়ে যা—

রুমাল বের করে প্রতুল তখন গায়ের ধুলো আর ঝুল ঝাড়ছে।

সত্যকিঙ্করবাবু সোৎসাহে বলে উঠলেন, বলিহারি প্রতুলবাবু! ওঃ, একেই বলে গোয়েন্দাগিরি মশাই! খুঁজে খুঁজে ঠিক বার করলেন তো রঞ্জনকে—আমরা তো ভেবেছিলাম, খুন-টুন করে নির্ঘাৎ গায়েব হয়ে গেছে।····আচ্ছা, কিভাবে টের পেলেন স্যার, রঞ্জন এই ঘরে পড়ে আছে? খড়ি-পাতা বিদ্যে জানা আছে নাকি?

হেসে প্রতুল বললে, তাহলে তো হ্যারিসন রোড অঞ্চলে ঘর ভাড়া করে মস্ত বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বসতাম।

তবে জানলেন কি করে?

ক্লোরোফর্মের গন্ধে। গ্রীনরুম থেকে গন্ধটা লোহার ঘোরান সিঁড়ি পর্যন্ত গেছে টের পেলাম। তারপর দোতলার বারান্দায় উঠে দেখি, মেঝের ধুলোর ওপর একটা টানা দাগ একেবারে এই ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। ওই দেখুন সেই দাগ—ওই দাগ অনুসরণ করেই রঞ্জনকে আবিষ্কার করা গেল। গোয়েন্দাগিরিটা নিতান্ত সহজ বুদ্ধির ব্যাপার, খড়ি-পাতা বিদ্যে নয় সত্যকিঙ্করবাবু। চলুন নিচে যাই, রঞ্জনবাবুর অবস্থাটা দেখা যাক ভাল করে।

নিচে তখন অনিমেষ ডাক্তারের সাহায্যে আস্তে আস্তে রঞ্জনের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

সত্যকিঙ্করবাবু জার্মানীর কামানের মত একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্নের গোলা ছাড়লেন: ব্যাপার কি। হে রঞ্জন, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে কেন? আর এত জায়গা থাকতে দোতলায় ওই পোস্টারের ঘরে ঢুকলে কি মতলবে? সন্ধ্যে থেকে তো দেখলাম দিব্যি সিনের পর সিনে নামছ। শেষ দৃশ্যের পর হঠাৎ এমন গায়েব হয়ে গেলে কেন বল দিকি? ব্যাপারটা সব খুলে বল শুনি, কিছু লুকিও না টুকিও না বাপু। তাহলে পুলিশের হাত থেকে নিস্তার পাবে না কোনমতেই।····শরীরটা আজ কি তোমার খারাপ ছিল, না নেশা করে থিয়েটারে এসেছিলে? মাথা-টাথা ঘুরে গিয়েছিল বুঝি?

নির্জীবের মত রঞ্জন শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।

প্রতুল বললে, মাথাটা ওঁর আগে ঘোরেনি, আপনার প্রশ্নের বহর শুনে ঘুরছে। ক্লোরোফর্মের ঘোরটা ভাল করে আগে কাটতে দিন। তারপর কথা হবে। রঞ্জনবাবুর জন্যে আগে গরম দুধ আনতে বলুন তো!

আরও ঘণ্টাখানেক পরে।

রঞ্জনের চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল।

প্রতুল জিজ্ঞাসা করলে, এখন কেমন বোধ করছেন?

রঞ্জন বললে, অনেকটা ভাল, শুধু মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

ব্যাপার কি হয়েছিল, আপনার মনে আছে?

সবটা স্পষ্ট মনে পড়ে না।

যতটুকু মনে পড়ে, বলুন তো?

ভেলভেটের একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে রঞ্জন বলতে শুরু করল: শেষ দৃশ্যের আগে দুটো সিনে আমার অ্যাপিয়ার নেই। প্রায় আধ ঘন্টার ওপর ছুটি থাকে। প্রথম দিন থেকে নাগাড়ে প্লে করে এই সময়টা আমি একটু জিরিয়ে নিই। আজও আগের সিনে পোশাক ছেড়ে ফেলে মেকআপ টেবিলের সামনে বসে আরাম করে সিগারেট টানছিলাম, আর চোখ বুজে মনে মনে ভাবছিলাম, আজ শেষ দৃশ্যের অভিনয়ে কোথায় কিভাবে নতুনত্ব দেখানো যায়। ‘নিয়তি’ নাটকে আমার ১৯৯ রাত্রি করা, সুতরাং পার্টটা আমার কাছে জল-ভাত। কিন্তু দুশো রাত্রি উপলক্ষে আজ থিয়েটারে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির ভিড় দেখে প্লে করতে নতুন করে ভাল লাগছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, শেষ দৃশ্যে অভিনয়ের গতানুগতিক ধারার বদলে দু-একটা নতুন প্যাঁচ দেখাই—মেকআপেরও একটা নতুন কায়দা দেখাই। সিগারেট টানতে টানতে চোখ বুজে সেই চিন্তাই করছিলাম। হঠাৎ চমক ভাঙল একটা তীব্র গন্ধে। চোখ মেলতেই দেখি, একটা হাত আমার নাকে একখানা রুমাল চেপে ধরেছে—আর একটা হাত আমার ঘাড়ের ওপর। চিৎকার করতে গেলাম, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। দুটো হাতের যাঁতিকলের মধ্যে আমার নড়বারও কোন উপায় নেই! রুমালের সেই অদ্ভুত গন্ধে আমার সমস্ত চেতনা তখন রিমঝিম করছে—আমার ওপরে, নিচে, চারপাশে রাশি রাশি পেঁজা তুলোর মত নরম ঘুম, আর সেই ঘুমের সমুদ্রে আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি! চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার আগে আমি টের পেলাম, কে যেন আমার দেহটাকে তুলে একটা বস্তার মত কাঁধের ওপর ফেললে, তারপর আর কিছু মনে নেই, সব অন্ধকার····

পাকানো গোঁফ সমেত সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের হাঁ দু-পাশে ঝুলে পড়ল।

প্রতুল প্রশ্ন করলে, লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলেন?

না, দেখবার অবকাশ পাইনি, শুধু একটা হাত চোখে পড়েছিল।

হাতখানা কিরকম?

শির-ওঠা শক্ত চওড়া হাড়ওলা একখানা হাত—রোগা হলেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ, আর বিশ্রী খসখসে স্পর্শ।

হাতখানা দেখলে চিনতে পারবেন?

পারব বোধ হয়।

আচ্ছা, সুজাতার সঙ্গে আপনার কতটা আলাপ?

একসঙ্গে কাজ করতে গেলে যতটা আলাপ হওয়া স্বাভাবিক।

সুজাতার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল কোথায়?

এই থিয়েটারে। হঠাৎ রঞ্জন যেন সচকিত হয়ে উঠল। বললে, কিন্তু আপনি কে বলুন তো? সুজাতাকে নিয়ে আমাকে এত জেরা করছেন কেন? তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারেন!

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, কাকে জিজ্ঞেস করবেন? সুজাতা কি আছে! সে জিজ্ঞাসার বাইরে চলে গেছে!

রঞ্জন বললে, তার মানে?

শান্ত গলায় প্রতুল বললে, সুজাতা খুন হয়েছে।

খু-ন হ-য়ে-ছে!

পুতুলের মত ভাবলেশহীন চোখে রঞ্জন তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলে উঠল, কেমন করে খুন হল—কোথায় খুন হল?

এই থিয়েটারেই। শেষ দৃশ্যে অভিনয় করতে করতে।

উত্তেজনায় রঞ্জন সোজা হয়ে উঠে বসল। বললে, শেষ দৃশ্যের অভিনয় তাহলে হয়েছিল?

হয়েছিল বৈকি। আজকের অভিনয় অপূর্ব হয়েছিল।

বটে, বটে! আমার বদলে কে নেমেছিল?

সত্যকিঙ্করবাবু জবাব দিলেন, যম।

প্রতুল ধীরে ধীরে বললে, আজকের শেষ দৃশ্যে আপনার বদলে কে নেমেছিল, সেটা জানতে পারলেই তো এ খুনের কিনারা হয়ে যাবে। কিন্তু সেকথা এখন থাক, আপনি এখনো ভাল করে সুস্থ হননি রঞ্জনবাবু, আপনার বাড়ি যাওয়া দরকার। একলা যাবেন না, কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান।

রঞ্জন চলে যাওয়ার পর সত্যকিঙ্করবাবু ফোঁস করে আর একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। ছেড়ে বললেন, এখন কি করা যায় স্যার?

প্রতুল বলল, পুলিশে খবর দিন। তারা এসে সুজাতার লাশের বন্দোবস্ত করুক।

পুলিশের নাম শুনেই সত্যকিঙ্করবাবুর বুকের কাছটায় গুরগুর করে উঠল। করুণ কণ্ঠে বললেন, পুলিশ এলে কি সহজে আমাদের রেহাই মিলবে মশায়? কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা! তবে পুলিশ-ফুলিশ যেই আসুক,এই খুনের কিনারা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে স্যার; আপনার টাকা আমি শেঠজীর কাছ থেকে পাইয়ে দেব।

প্রতুল বললে, ধন্যবাদ। চেষ্টা করব।

সত্যকিঙ্করবাবু প্রতুলের হাত দুটো চেপে ধরে বললেন, চেষ্টা করব-টরব নয়, একটু ভরসা দিয়ে কথা বলুন স্যার!

হেসে প্রতুল বললে, ঘাবড়াবেন না। চেষ্টা করলে খুব সম্ভব এ খুনের কিনারা করতে পারব।

যাক, বাঁচলাম!—সত্যকিঙ্করবাবু হাঁফ ছাড়লেন।

দিন কয়েক পরে। কথা হচ্ছিল থিয়েটারে বসে।

খুনের কিছু কিনারা হল স্যার?

হয়নি। তবে আশা রাখি হবে।

প্রতুল একটা সিগারেট ধরাল। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, কাল আপনাদের কি বই আছে সত্যকিঙ্করবাবু?

কাল তো এই ‘নিয়তি’ নাটকই ছিল। বিজ্ঞাপনেও তাই ছাপা হয়েছে। কিন্তু এরপর কি করে তা সম্ভব বলুন? ভাবছি কাল ‘নিয়তি’র বদলে ‘মরীচিকা’ বইখানাই চালাব।

না। আগের প্রোগ্রাম অনুসারে কাল আপনাদের ‘নিয়তি’ নাটকই চালাতে হবে।

বলেন কি প্রতুলবাবু! রাতারাতি এখন হিরোইন পাব কোথায় বলুন? আছে বটে ঊষারাণী, জয়শ্রীর পার্টটা দু-এক রাত্রি করেও ছিল, কিন্তু সুজাতার ওই পার্ট সে কি জমাতে পারবে মশায়?

প্রতুল গলায় একটু জোর দিয়ে বললে, না পারলেও তাকে দিয়েই চালিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু তাতে থিয়েটারের বদনাম হবে যে!

তা হোক। তবু প্রোগ্রাম বদলাতে পারবেন না আপনি। আর শুধু কাল নয়, এখন থেকে এই ‘নিয়তি’ বইখানাই চালিয়ে যেতে হবে।

সত্যকিঙ্করবাবুর ভ্রূ দুটো কুঁচকে এল: কেন বলুন দিকি?

সুজাতার খুনের কিনারা করবার জন্যে।

সিগারেটে টান দিয়ে প্রতুল আরেকবার ধোঁয়া ছাড়ল।

থিয়েটারের ম্যানেজারী করে করে সত্যকিঙ্করবাবুর শুধু চুলই পাকেনি, গোঁফও পেকেছে। সুতরাং তাঁর অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে বৈকি!

ডান হাতের তর্জনি ও মধ্যমার মাঝখানে একটা গোটা জ্বলন্ত কাঁচি সিগারেট চেপে ধরে, হোস পাইপের জলের তোড়ের মত তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন: এমনটা যে হবে, আমি আগেই জানতুম। যে বই একবার জমে যায়, সে বইয়ে সামান্য একটা কাটা সৈনিকের পার্ট বদলালেও সেল কমে যায়। আর এ তো একেবারে খাস হিরোইন বদল। কোথায় সুজাতা আর কোথায় ঊষারাণী! চাঁদে আর চামচিকে! আরে মশাই, নিয়তি নাটকের দু’শো নাইটের মধ্যে একশো সাতানব্বইটা নাইট ফুল হাউস দিয়ে গেছে একা ওই সুজাতা। প্রত্যেক শনি-রবিবারে মফঃস্বল থেকে লোক আসত জয়শ্রীর পার্টে সুজাতার প্লে দেখতে। ভারতী থিয়েটারের লক্ষ্মী ছিল সে!

সত্যকিঙ্করবাবুর গলাটা ধরে এল। বাঁ-হাতে পকেট থেকে ফুলকাটা রুমাল বার করে তিনি চোখের এবং নাকের জল মুছে নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন: যাকগে, যা হবার হয়েছে, আসছে হপ্তা থেকে আর ‘নিয়তি’ নয়, ‘মরীচিকা’ নাটকখানাই চালানো যাক। আর, ওই সঙ্গে ‘প্রেমের তুফান’ বইটাও রিহার্স্যালে ফেলে দেওয়া যাক। এন্তার নাচ-গান আছে, চট করে জমে যাবে।

বুকিং অফিসের কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় একটি লোক এতক্ষণ নিঃশব্দে পাইপ টানছিল। এইবার মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে সে বললে, প্রেমের তুফান চালাতে চান, আমার আপত্তি নেই সত্যকিঙ্করবাবু, কিন্তু তার আগে আরো তিন-চার নাইট নিয়তিই আপনাকে চালাতে হবে।

সত্যকিঙ্করবাবু হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেলেন: আপনি বলছেন কি প্রতুলবাবু! থিয়েটারকে শেষ অব্দি লাটে তুলতে চান নাকি স্যার? জানেন, গত তিন নাইটে নিয়তির সেল কি হয়েছে?····দাও তো হে যোগীন, সেল-রিপোর্টখানা—

যোগীনের হাত থেকে খাতাটা এক রকম ছিনিয়ে নিয়ে সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, এই দেখুন—যেদিন থেকে ঊষারাণী নামছে, সেদিন থেকে সেলের অবস্থা দেখুন। ফার্স্ট নাইটে ১০২৸, সেকেন্ড নাইটে ৭৩৮৸·, আর আজ ৫৬।।· —

মাথা চুলকে যোগীন বলে উঠল, আজ্ঞে বক্সের একখানা টিকিট আজকে পরে বিক্রি হয়েছে। ওটা এখনও হিসেবে যোগ দেওয়া হয়নি।

তরমুজের বিচির মত কালো কালো পানের ছোপধরা দাঁতগুলো বের করে সত্যকিঙ্করবাবু খিঁচিয়ে উঠলেন, তবে আর কি, কেতাৰ্থ হয়ে গেলাম!

প্রতুলের দৃষ্টি হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। শান্ত গলায় প্রশ্ন করলে, পরে বিক্রি হয়েছে, একথার মানে কি যোগীনবাবু?

আজ্ঞে শো আরম্ভ হবার অনেক পরে।

কত পরে?

তা বোধ করি, দু’ অঙ্ক হয়ে যাবার পর।

অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার আগে, তাই না?

আজ্ঞে।

আচ্ছা, তৃতীয় অঙ্কই আপনাদের নাটকের শেষ অঙ্ক, না? এই অঙ্কেই তো নায়িকা জয়শ্রীর মৃত্যু হয়?

আজ্ঞে তাই।

প্রতুলের চোখের দৃষ্টি যেন দূরে ভেসে গেল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলে, আচ্ছা যোগীনবাবু, সাধারণত টিকিট বেচবার সময় আপনি ব্যস্ত থাকেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ বক্সের টিকিটখানা যখন বিক্রি করেছিলেন, তখন তো বুকিং অফিসে মোটেই ভিড় ছিল না। যে লোকটি বক্সের টিকিট কিনতে এসেছিল, আপনি তাকে ভাল করে দেখেছিলেন কী?

আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছিলাম বৈকি! আগেও দেখেছিলাম।

আগে দেখেছিলেন!

মানে, আগের দু’ নাইটেও লোকটা এসেছিল।

বটে! কোন সময়?

ওই একই সময়ে—প্লে আরম্ভ হবার অনেক পরে।

আর একটি গোটা কাঁচি সিগারেট মুখে ধরে সত্যকিঙ্করবাবু সযত্নে গোঁফ বাঁচিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করছিলেন। যোগীনের ওপর আবার তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, বাজে কথা ছাড়ো যোগীন! কাল থেকেই প্রেমের তুফান—

না।— শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় প্রতুল বললে, কাল এবং পরশু দু’দিনই নিয়তি নাটকের অভিনয় হবে। দরকার হলে আরও দু’দিন।

যৌবনে সত্যকিঙ্করবাবু ফিমেল পার্ট করতেন। সরু গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলে উঠলেন, পারব না মশাই, পারব না! সাড়ে ছাপান্ন টাকা সেলের পর আবার নিয়তি চালালে থিয়েটারে সেরেফ লালবাতি—

প্রতুল হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললে, আচ্ছা, আমি তাহলে আসি। আপনার থিয়েটারে খুন হয়েছে, পুলিশের সঙ্গে আপনিই বোঝাপড়া করবেন’খন।

বলেন কী!

পাকানো গোঁফের প্রান্ত দুটি ঝুলে পড়ল। খসে পড়ল মুখের কাঁচি সিগারেট। ধমক খাওয়া ছোট ছেলের মত কাঁদো-কাঁদো গলায় সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, বেশ, আপনার কথাই থাকবে স্যার!····সুজাতা তো একা মরেনি, আমাকেও মেরে গেছে!

সত্যকিঙ্করবাবু ঠিকই বলেছিলেন, এমন হলে থিয়েটার সত্যিই লাটে উঠবে। আজ শনিবার, মাসের প্রথম হপ্তা, তবু সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত মোট টিকিট বিক্রি ৪৯৮৸·= । যেটুকু বিক্রি হয়েছে, তাও বোধ করি একা রঞ্জনের নামে। নইলে ফ্রি পাশ দিলেও ঊষারাণীর নামে কেউ আসত না।

তর্জনি ও মধ্যমার মাঝখানে একটা জ্বলন্ত কাঁচি সিগারেট চেপে ধরে সত্যকিঙ্করবাবু বুকিং অফিসের বাইরে হন্যে হয়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন। সাড়ে ছ’টার পর থিয়েটারের লবী একেবারে ফাঁকা হয়ে যেতেই আর্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, ভারতী থিয়েটার এবার ডুবল, বুঝলে হে যোগীন, একেবারে ডুবল!

উত্তেজনার বশে সিগারেটে উপর্যুপরি টান দিতে দিতে সত্যকিঙ্করবাবু দোতলার সিঁড়ি ধরে অন্তর্ধান করলেন।

ফাঁকা লবীর এক কোণে দীর্ঘকায় একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছিল। সত্যকিঙ্করবাবুর খেদোক্তি শুনে সে একটু হাসল মাত্র। হেসে আস্তে আস্তে বুকিং অফিসের কাছে এগিয়ে এল। বললে, থিয়েটার ভাঙতে প্রায় দশটা বেজে যায়, না যোগীনবাবু?

বুকিং অফিসের ভেতর থেকে জবাব এল, আজ্ঞে না, পৌনে দশটায় ভাঙে।

তৃতীয় অঙ্ক কখন শুরু হয় বলতে পারেন?

সওয়া ন’টার থেকে। মাত্র একটাই সিন।

এখনও তাহলে দেরি আছে!

তৃতীয় অঙ্কটা আবার দেখবেন নাকি প্রতুলবাবু?

ইচ্ছে তো আছে। উপস্থিত একটু ঘুরে আসি।

থিয়েটার থেকে প্রতুল রাস্তায় নেমে গেল।

ন’টা নাগাদ যোগীন ক্যাশ মিলিয়ে সেদিনের সেল-রিপোর্ট তৈরি করছিল, এমন সময় বুকিং অফিসের বাইরে থেকে আওয়াজ এল: একখানা বক্সের টিকিট!

খাতাপত্তর থেকে মুখ তুলে যোগীন তাকালে। সেই মূর্তি! কাঁচা-পাকা চুলের মাঝখানে চেরা সিঁথি, মুখে আলমগীর প্যাটার্নের সযত্নে ছাঁটা দাড়ি, গোঁফের দুইপ্রান্ত কসমেটিক দিয়ে পাকানো। চোখে ঘন নীল রঙের প্যাঁশনে চশমা সরু কালো ফিতে দিয়ে বাঁধা। গায়ে মিহি গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি, পরনে জরির ধাক্কা-দেওয়া শান্তিপুরী ধুতি, গলায় পাকানো উড়ুনি কাপ্তেনী ঢঙে ফাঁস দিয়ে বাঁধা। আইভরি-বাঁধানো ছড়িটা বাঁ হাতে কনুইয়ের কাছে ঝুলিয়ে ভদ্রলোক মানিব্যাগ থেকে একখানা দশ টাকার নোট বার করে দিলেন।

লোকটা ষাট পার হয়েছে নিশ্চয়ই, তবু সৌখীনতা আজও যায়নি। কিন্তু লোকটাকে ভারি অদ্ভুত বলতে হবে। এই বয়সেও থিয়েটারের বাতিক অবিশ্যি অনেকেরই থাকে, কিন্তু এমন বাতিক যোগীন আর কখনও দেখেনি। আজ নিয়ে পর পর চারদিন সে বুড়োকে থিয়েটারে আসতে দেখছে!

একখানা পাঁচ টাকার নোট আর বক্সের একখানা টিকিট দিয়ে যোগীন বললে, নমস্কার, আজও এসেছেন দেখছি!

ভদ্রলোক মানিব্যাগটা পকেটে রাখতে রাখতে মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমার একটু থিয়েটারের নেশা আছে কিনা! তাছাড়া ওই যে আমাদের ঊষারাণী—একদিন এই দুলু মল্লিকেরই বাঁধা ইয়ে ছিল—মানে বুঝলেন কিনা—

আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি!

যোগীন মুখ টিপে হাসলে। তারপর প্রশ্ন করলে, কিন্তু রোজ আপনি লাস্ট সিনের আগে আসেন কেন?

বুড়ো চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে বললে, ঊষার গানখানা শুনতে। বেড়ে গায় মশাই! হবে না, হাজার হোক মাইফেলি গলা তো! এই দুলু মল্লিকের বাগান-বাড়িতে কত রাতের পর। রাত—হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ—

হাসতে হাসতে বুড়ো দোতলার সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে লবীতে দেখা গেল প্রতুলকে। বুকিংয়ের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে, তৃতীয় অঙ্ক এতক্ষণে শুরু হয়েছে বোধ হয়?

যোগীন বললে, হ্যাঁ, এইমাত্র।

একখানা টিকিট কেটে দিন তাহলে, ভেতরে গিয়ে বসি।

নিচে সামনের সীটেই দিই?

তার চেয়ে বরং দোতালর বক্সেই দিন—দুলু মল্লিকের পাশের বক্সে।

নিতান্ত অবাক হয়ে যোগীন বললে, আপনি কি করে জানলেন? আপনি তো ছিলেন না!

হেসে প্রতুল বললে, ছিলাম বৈকি! সামনের দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে এসে ওই থামটার আড়ালে সোফায় বসেছিলাম। দুলু মল্লিক লোকটি বড় রসিক, নয় যোগীনবাবু?

আজ্ঞে, তা আর বলতে!

পাইপটা ধরাতে ধরাতে প্রতুল দোতলার সিঁড়ি ধরলে।

দোতলায় উঠে প্রতুল যখন পাঁচ নম্বর বক্সে গিয়ে বসল, তখন তৃতীয় অঙ্কের ড্রপ উঠে গেছে। দুলু মল্লিক বসেছিল চার নম্বর বক্সে। জয়শ্রী-রূপে ঊষারাণী তখন গান ধরেছে:

মধুরাত্রি, তুমি আজ ভোর হয়ো না। প্রিয় আমার আসবে, আমি রয়েছি তারই প্রতীক্ষায়।

কণ্ঠ বটে ঊষারাণীর! প্রতুলের মনে হল, নায়িকার এমন কণ্ঠ শুনলে নায়ক এ জীবনে আর নায়িকার দরজা মাড়াবে না। ৫৯ টাকার টিকিট বিক্রি হওয়ার কারণটা প্রতুল এবার স্পষ্টই বুঝতে পারলে। কিন্তু বলিহারি দুলু মল্লিককে! এমন গান শুনতেও সে দিনের পর দিন গাঁটের পয়সা খরচা করে আসছে!

আবছা অন্ধকারে প্রতুল ভাল করে তাকাল চার নম্বর বক্সের দিকে। আশ্চর্য! দুলু মল্লিক অন্যমনস্ক হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।

দেখতে দেখতে ঝড়ের আওয়াজে গান গেল ভেসে। স্টেজের ওপর দরজার কাছে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল।

জয়শ্রী বললে, কে?

ধরা ধরা ভাঙা গলায় ছায়ামূর্তি জবাব দিল, অতীতের প্রেত।

আর, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে দুলু মল্লিক তাকাল স্টেজের দিকে।

তারপর শুরু হল অভিনয়। ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল ফুট-লাইটের সামনে। অতীতের প্রেতই বটে! অর্ধেক মুখটা পুড়ে একেবারে বীভৎস হয়ে গেছে। বিশ্রী হেসে জিজ্ঞেস করল, চিনতে পারছ?

দু-হাতে মুখ ঢেকে জয়শ্রী আর্তনাদ করে উঠল।

অতীতের প্রেত তখন বলে চলেছে: ললিতমোহনকে আজ চিনতে পারছ না জয়শ্রী? একদিন কিন্তু চিনতে। মনে করে দেখ সেই দিন—যেদিন দরিদ্র যুবক ললিতমোহনের সঙ্গে ধনীর মেয়ে লীলার হল আলাপ। লীলাকে ললিত ভালবাসল—এমন ভালবাসা, যা কেউ কখনো বাসেনি। দিন যেতে লাগল স্বপ্নে ভেসে। ললিতকে লীলা কথা দিলে, তাকে বিয়ে করবে—

প্রতুল লক্ষ্য করলে, দুলু মল্লিক যেন সমগ্র চেতনা দিয়ে অভিনয় দেখছে, শুনছে, আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বকছে:

ওদিকে স্টেজের ওপর অতীতের প্রেত তখন বলে চলেছে: ললিতমোহন সরল মনে বিশ্বাস করলে লীলার কথা। কিন্তু ললিতমোহন এম-এ পাশ করলেও নারী চরিত্রের অ-আ-ক-খ তার জানা ছিল না। তা যদি জানত, লীলাকে বিয়ে করার মত এত বড় ভুল জীবনে সে করত না। দরিদ্র, সরলচিত্ত ললিতমোহন কি করেই বা জানবে যে আধুনিক কালে মেয়েদের কাছে শিক্ষার চেয়ে শিক্ষার ভানটাই বেশি আকর্ষণীয়, একনিষ্ঠ ভালবাসার একঘেয়েমির চেয়ে বহু পুরুষের নিত্য নব স্তুতি বেশি কামনার বস্তু, স্বামীর চেয়ে স্বামীর গাড়ি-বাড়ি আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বড়! প্রেমে অন্ধ হয়ে ললিতমোহন ভুলে গিয়েছিল যে লীলাও আধুনিক কালের মেয়ে। তাই বিয়ের এক বছর পরেই নাটক বদলাতে শুরু করল—লীলার প্রেম-দরিয়ায় বইতে লাগল উল্টো স্রোত। তাই নয় কি জয়শ্রী?

উন্মাদিনীর মত জয়শ্রী চিৎকার করে উঠল: তুমি যাও—তুমি যাও বলছি—

অতীতের প্রেত অট্টহাস্য করে উঠল। প্রতুল শুনতে পেল, তারই সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিশ্রী চাপা আওয়াজে দুলু মল্লিকও হাসছে।

হাসি থামিয়ে অতীতের প্রেত বলল, যাব বলেই তো এসেছি; কিন্তু তার আগে গল্পের বাকিটুকু শুনে রাখো। —হ্যাঁ, এক বছর বাদে তাদের বিয়ের তারিখে যে ছোট্ট উৎসব হয়েছিল, সেই উৎসবে লীলা ললিতমোহনের সঙ্গে সুজিতের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। জাস্টিস সুপতি লাহিড়ীর ছেলে সুজিতকে ললিত জানত না। জানত না যে দু-দু’বার আই-এস-সি’তে ফেল করে বাপের পয়সায় বিলেত গিয়েছিল, কিন্তু নিখুঁতভাবে ‘টাই’ বাঁধা, প্রচুর মদ-খাওয়া আর কথায় কথায় ডাইভোর্স করা ছাড়া আর কিছুই শিখে আসতে পারেনি। স্ত্রীর বন্ধুকে ললিত নিজের বন্ধু বলেই মনে করেছিল। কিন্তু কে জানত, সুজিতের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে নাটক এত শিগগির বদলে যাবে? সেই রাত্রের কথা মনে পড়ে জয়শ্রী? সেই দেয়ালী রাত্রের কথা?

দু-হাতে মুখ ঢেকে জয়শ্রী ককিয়ে উঠল: কিছু শুনতে চাই না—তুমি যাও—

অতীতের প্রেত আবার হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুলু মল্লিক।

অতীতের প্রেত বলতে লাগল, অনেক চেষ্টার পর আসামের বন বিভাগে ললিত পেল একটা চাকরি। লীলাকে নিয়ে কর্মস্থলে রওনা হবার আগের দিন এল সুজিত। চোখ লাল, পা টলমল, কথা ঈষৎ জড়ানো। লীলা বললে, সুজিতের গাড়ি নিয়ে মার্কেট থেকে দু-একটা জিনিস কিনে আনি। ললিত কিছু বলার আগেই লীলা সুজিতের গাড়িতে উঠে বসেছে। সেদিন রাত্রে লীলার ফিরতে একটা বেজে গিয়েছিল। সুজিতই পৌঁছে দিয়েছিল তাকে।

পরের দিন লীলাকে নিয়ে আসাম রওনা হল ললিত। নাগা পাহাড়ের ধারেই তার কোয়াটার্স। বন বিভাগের চাকরি, জঙ্গলে জঙ্গলেই ললিতকে ঘুরতে হত বেশি। লীলা থাকত একা। তাই সেই দেয়ালীর রাত্রে লীলা বায়না ধরলে ললিতের সঙ্গে সে নাগা পাহাড়ে যাবে—নাগাদের নাচ দেখতে। ললিত আপত্তি করেনি, বরং খুশি হয়েই লীলাকে সে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নাগা-নাচ লীলার ভাল লাগল না। বললে, চল, বেড়াই।

বেড়াতে বেড়াতে দুজনে এসে যেখানে দাঁড়াল, সেটা পাহাড়ের একটা প্রান্ত। তার পরেই হাজার দেড়েক ফিট নিচে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। জঙ্গল সাফ করবার জন্যে আগের দিন গাছপালায় আগুন ধরানো হয়েছিল। দেড় হাজার ফিট উঁচু থেকে ঢেউ-খেলানো আগুনের স্রোত দেখা যায়।

মন্দ লাগছিল না ললিতের। পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সীমা যেন এখানে এসে ফুরিয়ে গেছে। দূর থেকে নাগাদের বুনো বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। মাথার ওপর দেয়ালীর কালো আকাশ মহাকালীর দিগন্তজোড়া এলোকেশের মত ছড়ানো।

মৃদু স্বরে ললিত একবার ডেকেছিল, লীলা!

ললিতের কাঁধে মাথা রেখে আবছা গলায় লীলা শুধু বলেছিল, উঁ—

তারপর—তারপর কি হল, তুমি বলবে জয়শ্রী, না আমিই বলব?

কান্নায় ভেঙে পড়ে জয়শ্রী বলে উঠল, ওকথা থাক, তুমি যাও—চলে যাও—

অতীতের প্রেত এবার হাসল না। চাপা কঠিন কণ্ঠে দ্রুত বলতে লাগল, গল্প আর অল্পই বাকি আছে। নিজের কাঁধের ওপর লীলার স্পর্শের আমেজ নিয়ে সেই দেয়ালীর রাত্রে ললিত স্বপ্নাচ্ছন্নের মত দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হল, পায়ের তলা থেকে পৃথিবীর সীমা যেন ফুরিয়ে গেছে, আর কোন্‌ অতলে সে তলিয়ে যাচ্ছে! দেড় হাজার ফিট উঁচু থেকে পড়তে পড়তেও তার মনে হয়েছিল, মৃত্যু কি লীলার মতই সুন্দরী?

কিন্তু নিয়তি যাকে বাঁচায়, তাকে মারবে কে? দেড় হাজার ফিট নিচে পড়বার আগেই ললিতের দেহ পাহাড়ের গায়ে একটা গাছের ডালে আটকে যায়। পরের দিন বন-বিভাগের কুলিরা তাকে উদ্ধার করে। প্রাণে সে বাঁচল বটে, কিন্তু জঙ্গলের আগুনের নিদারুণ উত্তাপে তার মুখের অর্ধেকটা পুড়ে বীভৎস হয়ে গেল। ছ’ মাস পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ললিত আর লীলার দেখা পায়নি। শুনতে পেল, সুজিতকে বিয়ে করে সে দেশান্তরী হয়েছে।

তারপর এক বছর দু’ বছর করে কেটে গেল সাতটা বছর। কত খুঁজেছে ললিত, কিন্তু লীলার দেখা সে পায়নি। অবশেষে নিয়তির চক্রান্তে দেখা একদিন হল। ললিত তখন অতীতের প্রেত, আর লীলা তখন জয়শ্রী। তবু তারা পরস্পরকে চিনতে পারল বৈকি! ভাল করে দেখ তো লীলা, সেদিনের সেই ললিতকে সত্যিই চিনতে পার কিনা!

অতীতের প্রেত হঠাৎ মুখখানা জয়শ্রীর একেবারে কাছে এগিয়ে নিয়ে গেল। নীলাভ ফ্ল্যাশ লাইট এসে পড়ল বিকৃত, বীভৎস মুখখানার ওপর। চিৎকার করে উঠল জয়শ্রী।

আর ক্রুদ্ধ জন্তুর মত চাপা গর্জন করে উঠল দুলু মল্লিক। প্রতুল লক্ষ্য করলে, তার হাতের সরু সরু আঙুলগুলো কেমন যেন নিশপিশ করছে।

আর্ত কণ্ঠে জয়শ্রী বলতে লাগল, আমি তোমায় ভুলতে চাই ললিত—আমি তোমায় ভুলতে চাই—আমায় ক্ষমা কর—

জয়শ্রীর দিকে এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে অতীতের প্রেত বললে, প্রতিহিংসা কখনও ভুলতেও পারে না, ক্ষমাও করতে পারে না। সেদিনের সেই ললিতমোহন আজ বেঁচে নেই, সেদিনের লীলাও আজ বেঁচে থাকবে না—

হঠাৎ নিষ্ঠুর শক্ত দুটো হাত জয়শ্রীর কণ্ঠনালী মুঠি করে ধরল। জয়শ্রীর কণ্ঠ চিরে বেরোল তীক্ষ্ণ কাতর এক আর্তনাদ—তারপর একেবারে স্তব্ধ!

ধীরে ধীরে নেমে এল কালো ভেলভেটের ভারী যবনিকা।

আলো জ্বলে উঠল প্রেক্ষাগারে। প্রতুলের চোখের দৃষ্টি পাশের বক্সে যেন আঠা দিয়ে আটকানো। শিরা-ওঠা সরু সরু আঙুলে দুলু মল্লিক সামনে কাঠের রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। কপাল বেয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। ক্লান্ত পশুর মত তখনও সে হাঁপাচ্ছে। মুখে কিন্তু অদ্ভুত পরিতৃপ্তির হাসি।

লোকটা সত্যিই থিয়েটার-পাগল!

হেসে প্রতুল বললে, চমৎকার অভিনয়! ঠিক যেন সত্যি, কি বলেন স্যার?

দুলু মল্লিক চমকে ফিরে তাকাল। তারপর রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললে, তা আর বলতে! মেডেল দিতে ইচ্ছে হয় মশাই!

ছড়িটি নিয়ে দুলু মল্লিক বক্স থেকে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বেরোল প্রতুল। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, আপনার বুঝি খুব থিয়েটারের শখ?

শখ?—বাঁ দিকের ভুরু তুলে দুলু মল্লিক বলে উঠল, বাতিক মশাই, বাতিক! একদিন এই দুলু মল্লিক থিয়েটারের পেছনে জলের মত পয়সা উড়িয়েছে—আমারই বাগান-বাড়িতে চার-চারটে হিরোইন—হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ—

মৃদু হেসে প্রতুল বললে, আপনি দেখছি গুণী লোক।

দুলু মল্লিক ততক্ষণে থিয়েটারের লবীতে এসে পৌঁছেছে। মুখ ঘুরিয়ে বললে, কিছু না, কিছু না, বাতিকে ধরলে মশাই এমনিই হয়, তা সে ঘোড়ার বাতিকই বলুন, মেয়েমানুষের বাতিকই বলুন, আর থিয়েটারের বাতিকই বলুন!—আচ্ছা, আসি। নমস্কার।

দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রতুল বললে, নমস্কার। কিন্তু ওদিকে নয়, এদিকে আসুন।

হাত বাড়িয়ে প্রতুল উল্টো দিকটা দেখাল।

রাস্তার এক পাশে একটা কয়েদী-গাড়ি অপেক্ষা করছে। আর, সামনে দাঁড়িয়ে একজন সার্জেন্ট ও জনকয়েক কনস্টেবল।

প্রতুল অত্যন্ত সবিনয়ে বললে, আসুন।

হতভম্ব হয়ে দূল মল্লিক বললে, এর মানে?

প্রতুল হেসে বললে, মানে আপনি মানী লোক, তাই রাজার অতিথি হিসেবে আপনাকে নিতে এসেছি।

বিষম চটে দুলু মল্লিক চিৎকার করে উঠল, ওসব ভাঁওতাবাজি রেখে দিন মশাই! ভদ্রলোকের সঙ্গে ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাননি? আমার একটা পোজিশান আছে, জানেন? আমি হলাম গিয়ে দুলু মল্লিক····

না, তুমি রমাপতি সেন।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতুল দুলু মল্লিকের একদিকের দাড়ি ধরে দিলে টান। একগোছা ‘ক্রেপ’ উঠে এল প্রতুলের মুঠোয়, আর বেরিয়ে পড়ল পুড়ে- যাওয়া মুখের একাংশ।

দুলু মল্লিক যেন পাথর হয়ে গেল। অত্যন্ত শান্ত গলায় বললে, চলুন, আমি যাচ্ছি।

প্রতুল বললে, এক মিনিট। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললে, সত্যকিঙ্করবাবুকে একবার ডাকুন যোগীনবাবু।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন সত্যকিঙ্করবাবু।

কি ব্যাপার? কি হল প্রতুলবাবু?

প্রতুল বললে, সুজাতার খুনের আসামী ধরা পড়েছে।

বলেন কি! ধরা পড়ল কোত্থেকে?

আপনাদের থিয়েটার থেকে। আসামীকে নিয়ে আমি চললাম। কাল লালবাজারে একবার আসবেন, আশা করি বাকিটা শুনতে পাবেন।

আসামীকে নিয়ে প্রতুল রাস্তায় নেমে গেল। আর, মুখের হাঁ ইঞ্চিখানেক ফাঁক করে লবীতে দাঁড়িয়ে রইলেন সত্যকিঙ্করবাবু।

বলিহারি প্রতুলবাবু! তাজ্জব করেছেন মশাই আপনি! থিয়েটারে নিত্যি কত লোক আসে, কত লোক যায়, তার ভেতর থেকে এই দুলু মল্লিক চীজটিকে কি করে যে আপনি চিনে ফেললেন, ভাবলে তাক্‌ লেগে যায় মশাই!

বিস্মিত সত্যকিঙ্করবাবুর তাক্‌-লাগা চোখ দুটো গিরগিটির চোখের মত গোল গোল হয়ে উঠল।

কথা হচ্ছিল লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের একটি ঘরে। প্রতুল, সত্যকিঙ্করবাবু এবং জনকয়েক পদস্থ পুলিশ কর্মচারী ছাড়া আর এক ব্যক্তি জানলার দিকে মুখ করে বসে ছিল। এদিক থেকে তার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু তার ঈষৎ অবনমিত পিঠের রেখায় অপরিসীম ক্লান্তির একটা কাহিনী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেখলে মনে হয় জীবন-যুদ্ধে পরাস্ত একজন হতভাগ্য সৈনিক।

গিরগিটির মত গোল গোল চোখের দৃষ্টি প্রতুলের মুখের ওপর ফেলে সত্যকিঙ্করবাবু আবার বললেন, এখন বলুন দিকি, খুনী আসামীকে আপনি কি করে চিনতে পারলেন? আপনি দৈবজ্ঞ নাকি মশাই!

পাইপে তামাক ভরতে ভরতে প্রতুল সত্যকিঙ্করবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাসি হাসলে। তারপর বললে, আমি দৈবজ্ঞ নই—গোয়েন্দা। তবে কখনো কখনো দৈব সহায় হন বটে! সুজাতার খুনের ব্যাপারে আমি আমার কমনসেন্স—সহজ বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করেছি মাত্র, আর তার সঙ্গে দৈবও খানিকটা সাহায্য করেছে বৈকি! নইলে সুজাতা খুন হওয়ার দিন আমিই বা ভারতী থিয়েটারে যাব কেন? থিয়েটার আমি বড় একটা দেখি না, তবু যে হঠাৎ সেদিন আমার থিয়েটার দেখার শখ, সেটা দৈবাৎ—দৈবের যোগাযোগ ছাড়া আর কি বলা যায় বলুন! শেষ দৃশ্যে সুজাতা খুন হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি গ্রীনরুমে উপস্থিত না হলে ক্লোরোফর্মের গন্ধ পেতাম না। টেলিফোনে পুলিশে খবর দেবার পর পুলিশ আসতে আসতে গন্ধটা মিলিয়ে যেতে পারত। আর, ক্লোরোফমের গন্ধ পাওয়া না গেলে স্টেজের দোতলায় সেই মালঘর থেকে রঞ্জনকে উদ্ধার করা তখন সম্ভব হত না। ফলে খুনের রহস্যটা জটিল হয়েই পড়ত। তাই নয় কি সত্যকিঙ্করবাবু?

গিরগিটি-চোখে তাকিয়ে সত্যকিঙ্করবাবু বললেন, বিলক্ষণ! আমার তো মনে হয়েছিল, সুজাতার বারোটা রঞ্জনই বাজিয়ে দিয়েছে!

পাইপটা ধরিয়ে প্রতুল বলতে লাগল, কিন্তু রঞ্জনকে খুঁজে পাওয়া যেতে খুনের রহস্য অনেকটা পাতলা হয়ে গেল। অন্তত এটুকু পরিষ্কার বোঝা গেল যে সুজাতাকে খুন থিয়েটারের কেউ করেনি। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে করেছে কে? যেই করুক, খুনের মোটিভটা তার নিতান্তই ব্যক্তিগত। টাকাকড়ি গয়নার লোভটাই যদি উদ্দেশ্য হত, তাহলে খুনী থিয়েটারের স্টেজের ওপর অমন নাটকীয় ভাবে খুন করবে কেন? শেষ দৃশ্যে সুজাতার গায়ে তো বিশেষ অলঙ্কার ছিল না! যাও দু-একখানা ছিল, তাও কেমিকেলের। সুতরাং বুঝতে পারা গেল খুনটা পেশাদার খুনী করেনি—করেছে এমন একজন যার জীবনের সুতো সুজাতার জীবনের সঙ্গে জট পাকিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে। সহজ বুদ্ধি দিয়ে মনে মনে বিচার করলে আপনারাও বুঝতে পারবেন যে এক্ষেত্রে খুনের আসল মোটিভটা প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়—সাধারণত যার জন্ম ব্যর্থ প্রেমের আঘাত থেকে। এখন কথা হচ্ছে, কে সে—যার আশাহত ভালবাসা এমন নাটকীয়ভাবে সুজাতার জীবনের ওপর বদলা নিল? কে দেবে তার সন্ধান? কোন্‌ সূত্র ধরে খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে?

পাকানো গোঁফের দুটি প্রান্ত ঝুলিয়ে সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, তাই তো, বিষম সমস্যা! কি হবে তাহলে প্রতুলবাবু?

প্রতুল বলে চলল, আপনার হয়তো মনে আছে সত্যকিঙ্করবাবু, রঞ্জনের মেকআপ-রুম থেকে একটা কাঁচি আমি পকেটে করে এনেছিলাম। তাতে ছিল আঙুলের ছাপ। সেই ছাপের ফটো তুলে রঞ্জনের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিলাম, এক নয়। সুতরাং পরিষ্কার জানা গেল যে রঞ্জনেরই মেকআপ-রুমে আর কেউ মেকআপ করে সেই রূপসজ্জার আড়ালে স্টেজের ওপর সুজাতাকে খুন করে গেছে। কিন্তু আঙুলের এই ছাপ যার, পৃথিবীর এই অনন্ত জন-সমুদ্রের মাঝে কেমন করে তাকে ধরব—যদি সে আপনা থেকে ধরা না দেয়?

তাজ্জব করে দিলেন মশাই! খুনী আসামী কি যীশুখ্রীস্টের চেলা যে আপনা থেকে পুলিশে ধরা দেবে?

সত্যকিঙ্করবাবুর মুখের হাঁ এবার সওয়া ইঞ্চিটাক ফাঁক হয়ে গেল।

প্রতুল আর একবার হাসলে। তারপর বলতে লাগল, পুলিশের ফাইলে পেশাদার অপরাধীদের আঙুলের ছাপের যে ফটো-অ্যালবাম আছে, এ ছাপ তার কোনটার সঙ্গেই মেলেনি। ফলে বোঝা গেল, খুনের ব্যাপারে আসামীর এই সবে হাতেখড়ি। অপরাধ বিজ্ঞানে বলে, প্রথম খুনের একটা নেশা আছে, সেই নেশা প্রথম খুনীকে বেশ কিছু দিন ধরে পেয়ে বসে। এবং সেই কারণেই খুন করার পর খুনী বার বার খুনের জায়গাটা—খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে অকুস্থল, সেটা দেখতে আসে। খুনের জায়গাটা যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মত তাকে টানে। অপরাধ বিজ্ঞানের এই থিওরির ওপর নির্ভর করে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় দেখলাম না। সেই কারণেই সত্যকিঙ্করবাবু, আপনার ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ভারতী থিয়েটারে নিয়তি নাটকখানাই চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, সুজাতাকে খুন করার পর খুনের মাদকতায় খুনী একদিন না একদিন থিয়েটারে আসবেই। হলও তাই। দুলু মল্লিকের ছদ্মবেশে আসামী একদিন নয়, দিনের পর দিন আসতে লাগল নিয়তি নাটক দেখতে। কিন্তু একটু ভুল করেছিল আসামী। সে আসত নাটকের গোড়া থেকে নয়, ঠিক তৃতীয় অঙ্কের আগে। তাই তাকে চিনতে বেগ পেতে হয়নি। এখানেও দৈব আমার সহায়! তাই দুলু মল্লিকের আড়াল থেকে সহজেই বেরিয়ে পড়ল রমাপতি সেন।

কিন্তু আসামীর নাম যে রমাপতি সেন, সেটা আপনি জানলেন কেমন করে?

প্রশ্ন করলেন একজন পুলিশ-অফিসার।

প্রতুল জবাব দিলে, কতকটা অনুমান—ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Guessing’ তারই ফলে। ‘নিয়তি’ নাটকের নায়কের নাম হচ্ছে ললিতমোহন। কিন্তু আসামী শেষ দৃশ্যে যে নাম বলেছিল, তা হচ্ছে রমাপতি সেন। আর সুজাতার ভ্যানিটিব্যাগ থেকে কচি কলাপাতা রঙের সিল্কের যে রুমাল বেরিয়েছিল, তারই কোণে লেখা ছিল ‘R’। এখন দুটি মিলিয়ে দেখুন।

পুনরায় গিরগিটির মত গোল গোল চোখ করে সত্যকিঙ্করবাবু শুধু বললেন, আশ্চর্য!

রমাপতিকে কেমন করে আমি খুঁজে পেলাম, সে বৃত্তান্ত আপনারা শুনলেন। এখন রমাপতির মুখে শুনুন খুনের ইতিহাস, আরও বিচিত্র মনে হবে। বল রমাপতি।

জানলার দিকে মুখ করে যে লোকটি এতক্ষণ পিঠ ঝুঁকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, এবার সে আস্তে আস্তে মুখ ঘোরাল।

শুধু সত্যকিঙ্করবাবু নয়, পুলিশ অফিসাররাও সে মুখ দেখে মুহূর্তের জন্যে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

লোকটির মুখের অর্ধেকটা কোন্‌ ভয়াবহ আগুনে পুড়ে একেবারে বীভৎস হয়ে গেছে। একটা চোখ গলে বেরিয়ে এসেছে। অর্ধেকটা মুখ জুড়ে লাল আর সাদা মাংসপিণ্ড। দেখলে সারা শরীর যেন শিউরে ওঠে।

পাথরের মত ভাবলেশহীন দুই চোখ মেলে লোকটি বলতে শুরু করলে, আমার নাম রমাপতি সেন। দরিদ্র ভদ্রসন্তান—এম-এস-সি পাশ করেছিলাম। আপনারা যাকে সুজাতা বলে জানেন, তার আসল নাম ছিল কণা। কণাকে আমি ভালবেসেছিলাম। আমার ভালবাসার ইতিহাস আর ধনীকন্যা কণার বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী আমি কিছুদিন আগে ভারতী থিয়েটারের স্টেজের ওপরই আপনাদের শুনিয়ে দিয়েছি। কণার হাতের অ্যাসিড বাল্‌ব কেমন করে আমার এই মুখ বিকৃত করে দিয়েছিল, তাও বলেছি। কণাকে আমি কেন খুন করেছি—কোন্‌ প্রতিহিংসার জ্বালায় মানুষ তার সবচেয়ে আপনার জনকে শেষ করে দিতে পারে—সেদিন শুধু আপনাদের নয়, পৃথিবীকে আমি শুনিয়ে দিয়েছি। তাই সে রাত্রের অভিনয়ে প্রম্পটারের কথার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা অনেকখানিই মেলেনি। কিন্তু কেমন করে খুন করবার সুযোগ জীবনে আমার এল, সেই কথাটাই আপনাদের আজ বলব। হাসপাতাল থেকে পোড়া মুখ নিয়ে যখন বেরোলাম, তখন কণার আর সন্ধান পাইনি। কত ঘুরেছি, কত খুঁজেছি, তবু তার দেখা পাইনি। অবশেষে তার দেখা পেলাম ভারতী থিয়েটারের এক হ্যান্ডবিলে। দেখলাম, কণা তখন অভিনেত্রী সুজাতা হয়েছে। গেলাম একদিন থিয়েটারে দর্শক হয়ে। দেখলাম কণাকে, আর দেখলাম ‘নিয়তি’ নাটকের সঙ্গে আমারই জীবন-নাটকের কি আশ্চর্যরকম মিল! শুধু দু-একটা ঘটনার তফাৎ ছাড়া ‘নিয়তি’ নাটক যেন আমার আর কণার জীবনের কাহিনী। নাটক দেখতে যাবার আগের দিন পর্যন্ত কণাকে খুন করবার কোন বাসনাই আমার মনে স্থান পায়নি। কিন্তু ‘নিয়তি’ নাটকের শেষ দৃশ্য দেখে মনে হল, আমারও জীবনের পরিণতি বুঝি তাই। কে যেন আমার কানে কানে বারবার বলতে লাগল, রমাপতি, তুমিই তো অতীতের প্রেত! প্রতিহিংসা মেটাও, অবিশ্বাসিনী প্রেমিকার ওপর প্রতিহিংসা মেটাও তুমি, এই তো সুযোগ! আর সেই রাত থেকে রমাপতি সেন সত্যিই হয়ে গেল অতীতের প্রেত। দিনে, রাতে, নির্জনে, লোকালয়ে সেই একই কথা ক্রমাগত আমার কানে বাজতে লাগল। এই তো সুযোগ; প্রতিহিংসা মিটিয়ে নাও। ভালবাসা কখনও আঘাত ভোলে না রমাপতি!

অতীতের প্রেতও ভোলেনি। তাই একদিন সে আবার গেল থিয়েটারে। এবার দর্শক হিসেবে নয়, লুকিয়ে থিয়েটারের পেছনের দরজা দিয়ে এসে ঢুকলাম। সেদিন ‘নিয়তি’ নাটকের দুশো-রাত্রির অভিনয়। দ্বিতীয় অঙ্কের পর যবনিকা পড়েছে। আমি নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম রঞ্জনের মেকআপ রুমে। ক্লোরোফর্মের গন্ধে তাকে অচেতন করে সরিয়ে দিলাম দোতলার একটি ঘরে। আমার উদ্দেশ্য ছিল, খুনের পর সন্দেহটা যাতে রঞ্জনের ওপর গিয়ে পড়ে। তারপর দরজা বন্ধ করে অপটু হাতে মেকআপ করতে লেগে গেলাম। বাইরে থেকে কে একজন ডাকতেই ভারী আওয়াজে বলে দিলাম, আমি নিজেই মেকআপ করে নোব। মেকআপ করার অবশ্য বিশেষ দরকার ছিল না। কেননা, রঞ্জনের মেকআপ করা পোড়া মুখের সঙ্গে আমার এই মুখের তফাৎ খুব বেশি নয়। তবু রঞ্জনের মত অল্প স্বল্প মেকআপ করে নিলাম, যাতে আমাকে রঞ্জন বলেই মনে হয়। কিন্তু স্টেজের কণা ওরফে সুজাতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুলে গেলাম যে আমি রঞ্জন। বুক থেকে গলা চিরে যেসব কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল, তা অভিনেতা রঞ্জন বা নায়ক ললিতমোহনের কথা নয়—সে সব রমাপতি সেনের। উইংসের পাশ থেকে প্রম্পটার বারবার বলছিল, ভুল বলছেন! কিন্তু তখন কণা ছাড়া আর কোন দিকেই খেয়াল ছিল না আমার। একটা অদ্ভুত উন্মাদনাও লাগছিল মনে মনে। আপনারা সে রাত্রে যা অভিনয় মনে করে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন, আমার কাছে তা অভিনয় ছিল না। ছিল রূঢ় বাস্তব; নিষ্ঠুর সত্য।

শেষ দৃশ্য এক সময় শেষ হয়ে গেল, আর স্টেজের যবনিকার সঙ্গে সঙ্গে কণার জীবনের ওপরেও যবনিকা পড়ে গেল চিরকালের মত।

কিন্তু প্রতুলবাবু ঠিকই বলেছেন। খুনের একটা নেশা আছে, আর এই নেশাই দিনের পর দিন আমাকে ঠেলে নিয়ে যেত থিয়েটারে—দুলু মল্লিকের ছদ্মবেশে। তারপর কেমন করে দুলু মল্লিকের ছদ্মবেশ থেকে খুনী-আসামী রমাপতি সেন বেরিয়ে পড়ল, তা তো আপনারা জানেন। ধরা না পড়লেও একদিন হয়তো আমি নিজেই ধরা দিতাম। কেননা, জীবনের ওপর মমতা আমার ফুরিয়ে গেছে। আমি আর রমাপতি সেন নই, আমি অতীতের প্রেত।

রমাপতি একবার থামল। সকলের মুখের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় সে আবার বললে, আমার আর কিছু বলার নেই, শুধু একটা অনুরোধ—’নিয়তি’ নাটক বন্ধ করে দিন। নিয়তির খেলা শেষ হয়ে গেছে।

সকলে স্তব্ধ।

শুধু সত্যকিঙ্করবাবু বলে উঠলেন, আশ্চর্য! দুনিয়াটাই একটা স্টেজ!

আর, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের দু’পাশে ঝুলে পড়ল পাকানো গোঁফের দুটি প্রান্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *