চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

শেষ কথা কে বলবে

শেষ কথা কে বলবে

বিয়ের ব্যাপারটা ক্রমশই ট্যাকটিক্যাল ওয়ার ফেয়ার’-এর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দুপক্ষের দুই মেজর জেনারেলের বুদ্ধির লড়াই আর ক্রমান্বয় দর কষাকষি। পণপ্রথার বিরুদ্ধে সমাজ হিতৈষী মানুষের কষ্ট যতই সোচ্চার হচ্ছে ছেলেদের পক্ষের মেজর জেনারেলদের ততই নতুন-নতুন চাল ভাবতে হচ্ছে। যতই হোক চক্ষুলজ্জা বলে একটা জিনিস এখন তো একেবারে উবে যায়নি। শিক্ষিত মানুষের একটা সমাজ আছে। অসামাজিক কিছু একটা করতে হলে সোজাসুজি করা যাবে না। কায়দা করে করতে হবে। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি গোছের ব্যাপার।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে—You cannot choose your father but can choose your father in law. আগেকার দিনে প্রায় প্রকাশ্যেই ছেলেকে নিলামে তোলা হত। শাঁসাল শ্বশুরমশাইরা এগিয়ে আসতেন। টিপেটাপে, বাজিয়ে বুজিয়ে দেখতেন। অনেকটা বাড়ি কেনার মতো। ভিত বেশ পোক্ত, গঠন বেশ ভালো, মালমশলা খারাপ নয়, নোনা ধরবে না, বনেদিজমি, মনে হাওয়াবাতাস খেলে। ইচ্ছে হলে আরও গোটা দুই তলা ওপরে তোলা যায়। আচ্ছা, আমি এই দর দিলুম। দরদস্তুরের পর পিতা পুত্র-স্বত্ব বিকিয়ে দিলেন। তাতে নিজের লাভ না হলেও পুত্রের বরাত ফিরে গেল। শ্বশুরের পয়সায় বিলেত ঘুরে এল। শ্বশুরেই ফার্মেই অ্যাটর্নি হয়ে বসল। কি জুনিয়ার হয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করল অথবা বিলিতি ডিগ্রীধারী সার্জেন হয়ে ফোঁড়াই সেলাই আরম্ভ করে দিল। জন্মদাতা পিতা তখন বহুদূরের মানুষ। ছেলে হলেই যে এমনটি হবে তা নয়। ভালো ছেলে হতে হবে। ভালো চাকরির জন্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা চাই, বড়লোক, মানী শ্বশুরের জন্যেও তেমনি নিজস্ব কিছু পুঁজি থাকা চাই। শ্লেভ মার্কেটেরই নিয়ম। চেন দিয়ে বাঁধা কৃতদাসেরা দাঁড়িয়ে। আরব ব্যবসায়ীরা মোহরের তোড়া নিয়ে ঘুরছে। দরদাম করছে। ‘এ’ ক্লাসের এক দাম, ‘বি’ ক্লাসের আর এক দাম। গুণানুসারে কেউ যাবে নবারের হারেমে, কেউ যাবে তেল ব্যবসায়ীর পিপে ঠেলতে। চাইলেই কি আর শ্বশুর পছন্দ করা যায়? তবে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখতে আপত্তি কি?

এখন অবস্থা অন্যরকম। চাহিদা বাড়লে কানা বেগুন, পচা আলুও বাজারে বিকোয়। রং করা পটল তিনটাকা কিলো। তিরিশ পয়সায় একটা পাতিলেবু। রসা মাছই চব্বিশ টাকা কিলো। ঘরে-ঘরে মেয়ে। বাপ মায়ের চোখে ঘুম নেই। পদ্মলোচনরা যে যা পারছে দাম হেঁকে বসছে। অনেকের আবার এই ভাব কিছুই যখন করা যাচ্ছে না তখন একটা বিয়ে করেই দেখা যাক!

ছেলের সংখ্যা কম না হলেও, বিয়ে করে সংসার পাতার মতো ছেলের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বিয়ের বাজারে নামতে হলে সাকার হতে হবে। প্রেমের জগৎ বেকারদের হাতে থাকলেও, তাতে হাত মিলিয়ে একটি মেয়েকে ঘরে আনতে হলে খোঁটার জোর থাকা চাই। খোঁটাটি হল জীবিকা। জীবিকার স্তরভেদ আছে, উচ্চ, মধ্য, নিম্ন, অতি নিম্ন।

ছেলে জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত হলেই পিতার একটা তুরুপের তাস এসে গেল। আর একটি ক্যাশ সার্টিফিকেট। এইবার একটি বউমা আনতে হবে। অবশ্যই দেখে শুনে। ছেলে চলবে, চাকরে মেয়ে হলেই ভালো হয়। দুজনের রোজগারে গড়গড়িয়ে সংসার চলবে। কত্তার প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট হলে গিন্নিরটা খোলা, গিন্নিরটায় ধর্মঘট হলে কত্তারটা খোলা। এতে ট্রেড ইউনিয়ানের শক্তি বাড়বে। তার মানে মেয়ের তরফে আর একটি মাত্রা যুক্ত হল। শিক্ষিতা, সুদর্শনা, গৃহকর্মে সুনিপুণা, সঙ্গীতজ্ঞা, নৃত্যপটিয়সী এবং চাকুরিরতা। মানে রম্ভা, তিলোত্তমা, কুন্তি, দ্রৌপদী, গার্গী, মৈত্রেয়ী সব একাধারে ফেলে ঢালাই করা অষ্টধাতুর দেবী।

ছেলের পছন্দ আর ছেলের পক্ষের দাবি, দুয়ে মিলে তৈরি হয় কন্যাপক্ষের বিভীষিকা। দেখাদেখির মধ্যে মেয়ে দেখাটাই দেখা। ছেলে দেখাটা একটা প্রথা মাত্র। নিয়ম রক্ষার ব্যাপার। ছেলের আবার দেখাদেখি কি! চাকরি করে, দুটো হাত পা, একটা মাথা, আর কি চাই! দেখার কি আছে! ছেলে অষ্টাবক্র হোক, মর্কট হোক, সামান্য তোতলা হোক, একটু ট্যারা হোক, মাথায় সামান্য টাক হোক সব মানিয়ে যায়। ময়ূর ছাড়া কার্তিক পাবেন কোথায়! দেখতে হবে মেয়েকে। ভালো নাক চাই, টানাটানা চোখ চাই, এক আকাশ মেঘের মতো কালো চুল চাই, সুরে বাঁধা মিঠে গলা চাই, দুধে আলতা রং চাই, গজেন্দ্রগামিনী হওয়া চাই। এর যে কোনও একটা কম হওয়া মানেই অন্যদিকে মিটার চড়তে থাকা।

পাত্রের পিতা আরশোলার দাড়া নাড়ার মতো হস্তাক্ষরে পোস্টকার্ড লিখলেন, আপনার মেয়েটিকে আমাদের এক মেটে পছন্দ হয়েছে। এইবার দ্বিতীয় ব্যাচ যাবে, তারপর তৃতীয় ব্যাচে যাবে ছেলে আর ছেলের বন্ধুরা। ছেলের কোনও পছন্দ-অপছন্দ নেই। একটু সুন্দরী হলেই সে সন্তুষ্ট। তাছাড়া সে নিজে গান বড় ভালোবাসে। সর্বক্ষণই টুসকি মেরে আজকালকার গান গায়। প্রায় গানেরই এক লাইন করে তার জানা। ওরা দেখতে গেলে আপনার মেয়েকে আধুনিক কিছু গাইতে বলবেন, ওই সব মাথানত-ফত যেন না গায়। বন্ধু হিসেবেই আপনাকে এই টিপসটুকু দিয়ে রাখলুম। অবশ্য আমরা যা বলব তাই হবে, তবু বোঝেন তো আজকালকার ছেলে? আমরা আর ক’দিন আছি। সারাজীবন যার সঙ্গে ঘর করতে হবে তার কোনও খুঁতখুতুনি না থাকে। পিতা হিসেবে আমাদের সেটুকু দেখা কর্তব্য।

পাত্রী পছন্দের পর কিঞ্চিত দরাদরি। কথায় বলে, সহস্র কথা খরচ না হলে বিবাহ হয় না। পাত্র পক্ষ খুবই উদার। শিক্ষিতের ফ্যামিলি তো। দাবি কিছু নেই। আমরা চামার নই, বুচার নই! মেয়ের বাপের চামড়ায় ডুগডুগি বাজাতে চাই না। মেয়েটিই আসল। সম্পর্কটাই বড়। তবে হ্যাঁ, পাত্রীর পিতাকে আমরা ছোট করতে চাই না। তিনি যেন হীনমন্যতায় না ভোগেন। বাবা কিছুই দিতে পারলেন না বলে মেয়ে যেন শ্বশুরবাড়িতে এসে ভয়ে-ভয়ে না থাকে। আত্মীয়স্বজনরা যখন বলবে, কি গো ছেলের বিয়ে দিলে একেবারে হাঘরের সঙ্গে। তখন বউমা যেন মরমে না মরে যান। এসব ব্যাপারে জ্ঞাতিগুষ্টির মুখে তো আর স্টিকিং প্লাস্টার আটকাতে পারব না। আমাদের কোনও দাবি নেই, যা দেবেন সন্তুষ্ট। ছেলেও আমার কিছু চায় না। বাপকে বেটা, সিপাহিকো ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। কিন্তু একটা আছে মশাই। ছেলের বন্ধুরা যখন বলবে, দেখি, শ্বশুর ঘড়িটা কেমন দিলে। সোনার বোতামে হীরে আছে কি না? খাটটা খাঁটি সেগুনের পাক্কা সাত বাই সাড়ে সাত কি না? আলমারিটা সেই সেই সায়েব কোম্পানির মার্কামারা কি না? ড্রেসিংটেবলটা থ্রি ফোল্ড তো! ওয়ার্ডরোব দেয়নি? একটা টিভি দেওয়া উচিত ছিল। খাটে ছোবড়ার গদি, তুলোর তোশক? সে কি রে? এখন তো সব ফোমের গদি। তখন ছেলের মুখটি যে আমসি হয়ে যাবে। শ্বশুরের গর্বে বুক যদি দশহাতই না হল তা হলে উভয় তরফেরই সম্মান গেল।

আমাদের কোনও দাবি নেই। আপনি দিতে চান দেবেন। বাধা দোব না। আপনার ক্ষমতাকে আমরা কখনই ছোট করে দেখব না। সালঙ্কারে শ্বশুরালয়ে পাঠানোই এতকালের প্রথা। সোনা হল একটা মস্তবড় সিকিউরিটি। বিপদে-আপদে সংসারী মানুষের মস্ত বড় বল। বেচো, বাঁধা দাও। দুর্দিনের ভরসা। সোনা চিরকাল মেয়ের বাড়ি থেকেই আসে। ছেলে জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতে পারে। ছেলের বাপ সর্বস্বান্ত হয়ে ছেলে মানুষ করতে পারে। কেঁদেকক্বে ঘ্যানঘেনে স্ত্রীর একটা নাকছাবি করিয়ে দিতে পারে। বড়বাজারে গিয়ে ভরি-ভরি সোনা কিনতে পারে না। সোনা আসে। মেয়েরা, মা লক্ষ্মীরা নিয়ে আসে। সোনা হল প্রেস্টিন। আমার এত ভরি। ভাবতেও ভালো লাগে, বলতেও বুক দশ হাত হয়। পাঁচজনে সমীহ করে। প্রতিবেশির চোখ টাটায়। তাছাড়া আজকাল লকার হয়েছে। ষোলো, সতেরো ভরি যদি নাই দিলেন বউমা কেমন করে লকারে রাখতে যাবেন! ফ্যান, ফোন, ফ্রিজ, লকার হল স্ট্যাটাস সিম্বল। বউমা ঠোঁট উলটে কেমন যেন পাশের বাড়ির বউটিকে বলবেন, আমার ভাই সে ভয় নেই, ও লকার করে দিয়েছে, এই হাতের কটা রেখে সব সেফ ডিপজিট ভলটে ভরে দিয়েছি। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি। সোনাটা আপনি বিশেও তুলতে পারেন। আপনার মেয়েরই থাকবে। মেয়ের যখন মেয়ে হবে তখন আপনার মতো আতঙ্কে হার্ট ফেল করতে হবে না। ছেলের বাপের পায়ের তলায় নিলডাউন হয়ে বসে মুখ কাঁচুমাচু করে বলতে হবে না, বড়ই দু:স্থ, দয়া করে আমার মেয়েটিকে নিন।

এই উদার সমাজে পাত্রপক্ষের কোনও দাবি নেই। তবু একটি কন্যাকে ভালো ঘরে পাত্রস্থ করতে পঞ্চাশ হাজারও লাগতে পারে, ষাটেও হয়তো থই পাওয়া যাবে না, না, সান ইন ল-কে সাজিয়ে দিতে হবে। তিনি যেন পরে নিজের কোর্টে পেয়ে কন্যাটিকে তুলো ধোনা না করেন। দেখো বাবাজি! বছর-বছর তত্ব পাবে। শীতে স্যুট, কাশ্মিরী শাল, ষষ্টীতে আর এক প্রস্থ। সান না পেলেও ইন ল পাবে। পেলে না বলে আমার মেয়েটিকে ধামসো না। প্রথমে বাক্যবান, পরে অন্তর টিপুনি, তারপর কম্বল ধোলাই, তারপর আড়ং ধোলাই। সব শেষ কেরোসিন তেল, দেশলাই কাঠি, কিম্বা চ্যাংদোলা করে ওপর থেকে নীচে নিক্ষেপ।

সমাজে প্রগতির জোয়ার এসেছে, শিক্ষার আলো ফেটে পড়ছে। মানুষ আর বনমানুষ নয়। তবে বিবাহ তো একটা দ্রাবিড় প্রথা। মা বললেন, এবার তোর জন্যে একটা দাসী আনতে হবে বাছা। ভদ্র, নিরীহ মেয়েরা সংসারে মুখ বুজে মার খাবে, আর তেমন ডাকাবুকো জাঁহাবাজরা মার দেবে। যিনি আজকের দজ্জাল শাশুড়ি তিনিও একদা ঠোনাখাওয়া বউ ছিলেন। অকারণ র‌্যাগিং চলেছে, ঘরে-ঘরে। সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করছেন। মানুষ চাঁদে যাবে,। আণবিক বিস্ফোরণ ঘটাবে, লাসার, রাজার, কম্পিউটারে প্রগতির ইতিহাস লেখা হবে? তবু নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। অথচ নারী ছাড়া সংসার অচল। পুরুষ হার্মাফ্রোডাইট নয়, যে নিজেই নিজেতে সন্তান উৎপাদন করে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখবে! স্ত্রী বিয়োগে নাকে কাঁদবে। ইয়া ছবি বাঁধিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে মালা পরিয়ে, ধূপ জ্বেলে ‘আজ তুমি নেই, তুমি নেই’ করবে। অথচ যতদিন সেই দুর্ভাগা জীবিত ছিল ততদিন পরমানন্দে তাকে সাইকোলজিক্যাল, ফিজিক্যাল টর্চার করে মেয়ে-মদ্দ সবাই আনন্দ পেয়েছে। এই বিচিত্র সমাজে কন্যার পিতাদের চোখে তাই ঘুম নেই। ঘরে ঘরে আতঙ্ক, মেয়ে বড় হচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, কত হাজারে গিয়ে ঠেকবে কে জানে? অবশেষে কি হবে? সুখী হবে তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *