শেষ কথা
সান্টা মনিকায় আমার ষোলো তলার শান্তিনীড়ে বসে লিখছি এই বইয়ের শেষ ক’টি পাতা। আমার পশ্চিমাস্য বারান্দার সামনে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এইমাত্র ডুবে গেছে সূর্য। সারা আকাশ জুড়ে, মেঘের স্তরে স্তরে, ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এই বিপুল সাগরের ওপর মহান সূর্যাস্তের উত্তরদীপ্তি। প্রশান্ত মহাসাগরের সূর্যাস্ত এই জগতের এক জাদুবাস্তব। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। চোখে দেখলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের লাইন— এ কী মায়া লুকাও কায়া! সঙ্গেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের আর একটি কথা— এ জগৎ স্বপ্ন নয়। সত্যিই তো আমার চোখের সামনে ঘটছে এই সূর্যাস্ত। প্রতিদিন ঘটে। এক-এক দিন তার এক-এক রূপ। সূর্য ডুবে যাওয়ার অনেক পরেও মেঘের গায়ে বিছিয়ে থাকে তার বিদায়বেলার বর্ণ। বদলে বদলে যায় সেই বর্ণের বুনন। ক্রমশ যেন সেই অনির্বচনীয় আলোর বিদায়বার্তা মিলিয়ে যায় আসন্ন রাত্রির আঁধারে। অনন্তকাল ধরে চলেছে এই রূপের হাট। সমুদ্রের নিরন্তর বিস্তৃতি, তার সৈকতে তরঙ্গের অন্তহীন কল্লোল, আমাকে এনে দেয় মহাকালের প্রতিভাস। শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে।
ওই সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে আরও এক কথা। যেন সত্যের অন্য মুখ দেখতে পাচ্ছি। এই মুহূর্তে যদি আমি এখানে না থাকতাম, যদি আমরা কেউ না আসতাম এই জগতে, যদি চেতনার কোনও অস্তিত্ব না থাকত এই মহাবিশ্বে, কী হত পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে যাওয়া এই অলৌকিক রূপবন্যার? এই রূপকে আমি আমার চোখ দিয়ে অন্তরে গ্রহণ করছি। এই রূপের বাণী যেন আমি আমার মনে-প্রাণে শুনতে পাচ্ছি। এই রূপ অনেক দূরের আকাশের তবু কী গহনভাবে স্পর্শময়! আমার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই যেন এক সুরে আমাকে বলছে, তাকিয়ে থাকো ওই আকাশের দিকে, উপভোগ করো ওই রূপ। আমার হৃদয় গেয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের গান:
গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব।
তুমি কত বেশে নিমেষে নিমেষে নিতুই নব॥
জটার গভীরে লুকালে রবিরে, ছায়াপটে আঁকো এ কোন্ ছবি রে।
মেঘমল্লারে কী বল আমারে কেমনে কব॥
সত্যিই, মেঘমল্লারের গায়েই যেন ঘটছে এই সূর্যাস্ত। যেন সত্যিই তার অন্তরে বহু কোটি বছর ধরে লুকিয়ে আছে এক গভীর বাণী। এই সূর্যাস্ত আমাদের বলতে চায়, তারও যে বড় প্রয়োজন আমাদের। তার ভাষার হয়তো সবটুকু আমরা বুঝি না— ‘মেঘমল্লারে কী বল আমারে কেমনে কব!’ কিন্তু তবু সেই ক্রমে আবছা হয়ে আসা সোনালি আলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, ‘সে সোনার আলো শ্যামলে মিলালো,… লুকালে ছায়ায় মেঘের মায়ায় কী বৈভব।’ ওই ‘বৈভব’ শব্দটিই অন্তরশব্দ।
সারা জগৎ জুড়ে এই যে বর্ণ-গন্ধ-রূপের খেলা চলছে, এই যে চারিদিকে এমন অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মেলা— কেন সৃষ্টি হল এই অনন্ত বৈভব? এই বৈভবের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে কোন বীজমন্ত্র? জগতে ছড়িয়ে থাকা রূপবৈভবের অন্তরের বাণীটির ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘দেখা’ প্রবন্ধে—
‘আলোক তাই প্রত্যহই আমাদের চক্ষুকে নিদ্রালসতা থেকে ধৌত করে দিয়ে বলছে, তুমি স্পষ্ট করে দেখো, তুমি নির্মল হয়ে দেখো, পদ্ম যেরকম সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে সূর্যকে দেখে তেমনি করে দেখো। কাকে দেখবে? তাঁকে, যাঁকে ধ্যানে দেখা যায়? না তাঁকে না, যাঁকে চোখে দেখা যায় তাঁকেই। সেই রূপের নিকেতনকে যাঁর থেকে গণনাতীত রূপের ধারা অনন্তকাল থেকে ঝরে পড়ছে। চারি দিকেই রূপ— কেবলই এক রূপ থেকে আর এক রূপের খেলা; কোথাও তার আর শেষ পাওয়া যায় না— দেখেও পাই নে, ভেবেও পাই নে। রূপের ঝরনা দিকে দিকে থেকে কেবলই প্রতিহত হয়ে সেই অনন্তরূপসাগরে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। সেই অপরূপ অনন্তরূপকে তাঁর রূপের লীলার মধ্যেই যখন দেখব তখন পৃথিবীর আলোকে একদিন আমাদের চোখ মেলা সার্থক হবে, আমাদের প্রতিদিনকার আলোকের অভিষেক চরিতার্থ হবে।’
অর্থাৎ জগতের বৈভব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বলছেন না রবীন্দ্রনাথ। বলছেন না মহাবিশ্বের এই রূপ মায়া, বলছেন না জগৎকে ত্যাগ করে আমাদের ব্রহ্মকে পেতে হবে। বরং ঠিক উলটো কথাই লিখছেন তিনি ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে ‘সৌন্দর্য’ প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন ব্রহ্ম সত্য, কিন্তু জগৎ নয় মিথ্যা।
‘তাঁর সত্যকে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। সত্যকে এতটুকুমাত্র স্বীকার না করলে আমাদের নিষ্কৃতি নেই। সুতরাং, অমোঘ সত্যকে আমরা জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু, তিনি তো শুধু সত্য নন, তিনি ‘আনন্দরূপমমৃতং’। তিনি আনন্দরূপ, অমৃতরূপ। সেই তাঁর আনন্দরূপকে দেখছি কোথায়?’
দেখছি সেই আনন্দরূপের প্রকাশ সারা বিশ্বে। সত্যকে জানতে সেই আনন্দরূপকেও উপভোগ করতে হবে, মায়া বলে ত্যাগ করলে ভুল হবে।
এই লেখার শুরুতেই বলেছি, মেঘমল্লারের গায়ে এই যে সূর্যাস্ত, যেন সত্যিই তার অন্তরে লুকিয়ে আছে এক গভীর বাণী। এই সূর্যাস্ত কিছু চায় আমাদের কাছে, মহাবিশ্বের সমস্ত প্রকাশই কিছু চায় আমাদের কাছে। সেই প্রকাশ সম্পূর্ণ নয় আমরা ছাড়া। আমরা যে তাকে দেখছি, এই দেখার প্রয়োজন আছেই তার কাছে। আমাদের উপভোগ ছাড়া, অংশগ্রহণ ছাড়া মহাবিশ্বের প্রকাশ অর্থহীন। লিখছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সৌন্দর্য’ প্রবন্ধে—
‘…এই যে অপরূপ রহস্যময় সৌন্দর্যের আয়োজন, এ আমাদের কাছে কোনো মাসুল কোনো খাজনা আদায় করে না, এ আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে চায়— বলে, আমাতে তোমাতে আনন্দ হোক; তুমি স্বত আমাকে গ্রহণ করো।’
মহাবিশ্বের অন্তর থেকে যেন একটি প্রেমের বাণী উৎসারিত হয়ে উঠছে। যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, সেই আদিসত্তা বহু হয়েছেন নানা রূপে, বিচিত্র বর্ণে— এই মহাজগৎ যেন আমাদের প্রতি সেই আদিসত্তারই প্রেমের প্রকাশ— এই ভাবটিই গান হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
এই-যে তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ,
এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন॥
এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ’পরে,
এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ॥
প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে,
এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।
এই মহাবিশ্ব সেই একমেবাদ্বিতীয়মের প্রকাশ। সেই আদি ‘এক’-কে সত্য বলে স্বীকার করলে, তার বিচিত্র প্রকাশকে মায়া ও মিথ্যা বলব কোন উপায়ে? সে-কথা রবীন্দ্রনাথ কত সহজে বলতে পারলেন—
মুগ্ধ নয়ন মম, পুলকিত মোহিত মন॥
বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর নতুন আবিষ্কার হয়তো এখনও অনেকের জানার সুযোগ হয়নি। তাই আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি একই উৎস থেকে যে সমগ্র বিশ্বজগৎ উৎসারিত— এ-শুধু উপনিষদের ধ্যানলব্ধ উচ্চারণ নয়, এ-কথা বিজ্ঞানপ্রমাণিত দৃঢ় সত্য। তা হলে সেই সত্যকে স্বীকার করে, সত্যের প্রকাশকে মিথ্যা বলব কেমন করে? আমরা দেখেছি কীভাবে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সমস্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে চিরন্তন অমূর্ত কোয়ান্টাম ক্ষেত্র থেকে। সমস্ত ক্ষেত্রের মূর্ত রূপকেই বলা যেতে পারে মহাবিশ্বের সৃষ্টির নিত্য খেলা। এই মূর্ত আর অমূর্ত্য সত্য পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত, অবিচ্ছিন্ন। বিজ্ঞানের চোখে তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টি দুই-ই সমানভাবে সত্য।
তবে একটি কথা এখানে মনে রাখতে হবে— আমি যখন বলছি এক এবং অদ্বিতীয় আদিসত্তা যে বহু হয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব রূপে প্রকাশিত এবং সেই রূপ, সেই সৌন্দর্য, সেই বৈভব আমাদের উপভোগ করা উচিত, কারণ আমাদের ভোগের জন্যেই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে— এ জগৎ ব্রহ্মের মতোই সত্য— তখন কিন্তু আমি ভোগবাদের প্রচার করছি না। আমি কোনওমতেই বলছি না আর সব কিছু ভুলে ভোগই জীবনের আদর্শ।
মহাবিশ্বকে এবং জীবনকে উপভোগ করার প্রসঙ্গে উপনিষদের বীজমন্ত্রটি আরও একবার স্মরণ করছি। রবীন্দ্রনাথ এই মন্ত্রটি সম্পর্কেই বলছেন— ‘উপনিষদে একটি সংকেত আছে— ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ, ত্যাগের দ্বারাই লাভ করো, ভোগ করো। মা গৃধঃ, লোভ কোরো না।’ ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’: অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা ভোগ— তার মানে কী? রবীন্দ্রনাথ ওই একই প্রবন্ধে (বিশ্ববোধ: শান্তিনিকেতন) দুটি মাত্র শব্দে ব্যাখ্যা করেছেন— ‘বীতরাগ হওয়া।’ অর্থাৎ ভোগের মধ্যেও আমাদের অনাসক্ত থাকতে হবে। যা আমার নয় তা লোভ করলে হবে না। অলোভী হতে হবে। জড়িয়ে পড়লে হবে না। নিরাসক্ত হতে হবে। লোভী হলেই সর্বনাশ। আসক্ত হলেই দুঃখ। ভোগ করো, মহাবিশ্বের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্যকে উপভোগ করো, কিন্তু কোনও কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে দুঃখ পেয়ো না। জড়িয়ে না-পড়া, আসক্ত না-হওয়া, লোভ না-করা— এই সবই হল ত্যাগ। এই সব ত্যাগের মধ্যে ভোগ করো— এই হল উপনিষদের বীজমন্ত্র। ত্যাগ মানে জগৎকে মিথ্যা বলেই ত্যাগ করা নয়।
এবার আসা যাক চেতনার সারাংশের প্রসঙ্গে। উপনিষদ বলছে, বিশ্বের আদিসত্তার মধ্যেই আছে চেতনা, তাই আদিসত্তা বা সৃষ্টির উৎস যেমন ছড়িয়ে আছে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে, তেমনি ছড়িয়ে আছে চেতনাও। ব্রহ্ম বা সেই আদিসত্তা সচেতনভাবে বহু হতে চেয়েছিলেন— তাই সৃষ্টি হল মহাবিশ্ব, তাঁরই প্রকাশ ঘটল বহুরূপে। এ-কথা উপলব্ধি উপনিষদের। কেন বহু হতে চাইলেন ব্রহ্ম? সৃষ্টির রস-উপলব্ধির জন্য। আদিতে তিনি ছিলেন একক সত্তা। সৃষ্টির মধ্যে তিনিই হলেন বহু সত্তা। সেই একক-সত্তার মধ্যে যে চৈতন্য ছিল তাই পরিব্যাপ্ত হল বিশ্বজুড়ে সৃষ্টির বুননে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বচেতনা প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির কথা বলেছেন অসামান্য ভাষায়। এই উদ্ধৃতি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বলে আগে ব্যবহার করেছি, এখনও করছি—
‘যে তেজোময় অমৃতময় আদিসত্তা সর্বানুভূ হয়ে আছেন তিনিই ব্রহ্ম। সর্বানুভূ, অর্থাৎ সমস্তই তিনি অনুভব করছেন… তিনি যে কেবল সমস্তের মধ্যে ব্যাপ্ত তা নয়, সমস্তই তাঁর অনুভূতির মধ্যে। সেই… অনুভূতি সমস্ত আকাশকে পূর্ণ করে সমস্ত জগৎকে সর্বত্র নিরতিশয় আচ্ছন্ন করে আছে। সমস্ত শরীরে মনে আমরা তাঁর অনুভূতির মধ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছি।… গায়ত্রীমন্ত্রে এই বোধকেই ভারতবর্ষ প্রত্যহ ধ্যানের দ্বারা চর্চা করেছে; এই বোধের উদ্বোধনের জন্যেই উপনিষৎ সর্বভূতকে আত্মায় ও আত্মাকে সর্বভূতে উপলব্ধি করে ঘৃণা পরিহারের উপদেশ দিয়েছেন…’
উপনিষদের মতো রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করেন, সারা মহাবিশ্বজুড়ে রয়েছে চেতনার উপস্থিতি। সর্ব বস্তুতে আদিসত্তার চেতনাও বিদ্যমান।
উপনিষদের মতো, রবীন্দ্রনাথের মতো এবং এ-যুগের কিছু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মতো আমি বিশ্বাস করি মহাবিশ্বের বুননের মধ্যেই পরিকীর্ণ হয়ে আছে চেতনা। চেতনার অবদান ছাড়া এমন সুন্দর, সুসংগত, বোধগম্য, সুচারু এক মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারত না। চেতনার উৎস এবং মহাবিশ্বের আদি-উৎস যে একই— তাও আমার বিশ্বাস। শুধু আমার নয়। কোয়ান্টাম তথ্যবিদ শ্রোডিঙ্গারের মতো আরও অনেক বিজ্ঞানীর মনেই এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে। বিখ্যাত গণিতবিদ রজার পেনরোজ় বলেছেন, ‘চেতনা হচ্ছে মহাবিশ্বের এক অংশ। সুতরাং যে-কোনও থিয়োরি যার মধ্যে চেতনার কোনও জায়গা নেই, সেই থিয়োরির পক্ষে মহাবিশ্বের যথাযথ বর্ণনায় পৌঁছোনো মূলত সম্ভব নয়।’
আমরা জানি এক অতি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে বহুর উৎপত্তি, কারণ এক বহু হতে চাইল। এ-কথা উপনিষদের। ওই অতি ক্ষুদ্র কোষ থেকে মহাবিশ্ব শুরু হতে পারত অসংখ্যভাবে। কিন্তু তা হল না। তার কারণ এই মহাবিশ্বসৃষ্টির অপরিহার্য শর্তই যেন ছিল একদিন এই বিশ্বে ধীশক্তিসম্পন্ন প্রাণীর আবির্ভাব। সেই মতবাদ অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের। পুনরায় বলছি, ভুবনবিখ্যাত চিন্তাবিদ পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার তাঁর ‘অ্যাট হোম ইন দ্য ইউনিভার্স’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘মহাবিশ্বের জন্মে অবশ্যই অংশগ্রহণ করেছে মহাবিশ্বের এই দর্শক।’ কে এই মহাবিশ্বের দর্শক? সেই দর্শক হল চেতনা! তাই বিশ্বাস করা যায় না কি যে এ-বিশ্ব চেতনা ছাড়া হত না উৎসারিত?
সৃষ্টির শুরু থেকেই মহাবিশ্বের বুননের সঙ্গে নিহিত ও পরিব্যাপ্ত এই চেতনা। আমরা, ধীশক্তিসম্পন্ন প্রাণীরা, সেই নিহিত চেতনার প্রকাশ মাধ্যম। একই চেতনাপ্রবাহের সূত্রে আমরা এক হয়ে রয়েছি, বিধৃত রয়েছি সেই আদিসত্তার সঙ্গে। আমরা বিচ্ছিন্ন নই। আমরা একই চেতনার আত্মীয়তায় আবদ্ধ। আমাদের চেতনার উৎস সেই আদিসত্তার চেতনা। এই বিশ্বাস উপনিষদ থেকে যেন নিয়ে এসে আমাদের মধ্যে বিতরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আদিসত্তা সচেতনভাবেই আমাদের মধ্যে পাঠাচ্ছেন তাঁর অন্তর-উৎসারিত বিশুদ্ধ আনন্দ। কারণ আমাদের সচেতন অংশগ্রহণ, উপভোগ ছাড়া যে তাঁর এই সৃষ্টি সম্পূর্ণ নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—
তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে—
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে॥
আদিসত্তারই সচেতন ইচ্ছা তরঙ্গ তুলছে আমাদের জীবনে বিচিত্ররূপে,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
সেই আদিচেতনা বা সত্তাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন রাজার রাজা। সেই রাজার রাজাও চাইছেন আমাদের প্রেম, আমাদের সচেতন স্বীকৃতি। ব্রহ্মের এই যে মনোহরণ রূপ, এই যে বিচিত্র প্রকাশ, সে তো আমাদেরই প্রেমের জন্যে। এই সৃষ্টির পূর্ণ রূপটি প্রকাশ পায় আদিসত্তার সঙ্গে আমাদের যুগলসম্মিলনে—
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তবু আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ বেশে,
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।
তাই তো, প্রভু যেথায় এল নেমে
তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে
মূর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥
ব্রহ্মের এই প্রকাশ উপনিষদের বর্ণনায় ‘মধুময়’। আনন্দরূপে আদিসত্তার আত্মপ্রকাশ— এই উপলব্ধি উপনিষদের। রবীন্দ্রনাথ সেই আনন্দরূপকে মিথ্যা বা মায়া বলে ত্যাগ না করে অমৃত বলে স্বাগত জানালেন। বললেন যুগে যুগে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন অরূপের রূপদর্শনে, অমৃতের রসবরষনে।
আমারও প্রার্থনা, যেন একদিন উপনিষদের জ্ঞানলব্ধ উপলব্ধির আলোয়, রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞালব্ধ মননের আলোয়, আর বিজ্ঞানের সন্ধানলব্ধ আবিষ্কারের আলোয় দাঁড়িয়ে আমরা সবাই বলতে পারি, ‘বেদাহং’। অর্থাৎ আমি জেনেছি আমি পেয়েছি।
কী জেনেছি?
ব্রহ্মকে, সেই আদিসত্তা, সৃষ্টির সেই উৎসকে।
কী পেয়েছি?
সত্যকে— সেই সত্য এই, ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য।
সেই আদিসত্তার কাছে ভুবনজুড়ে আমাদের সমবেত প্রার্থনা যেন আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়—
‘…দাও আমাকে রসে ভরে দাও;… তোমার যে রস হাটবাজারে কেনবার নয়, রাজভাণ্ডারে কুলুপ দিয়ে রাখবার নয়, যা আপনার অন্তহীন প্রাচুর্যে আপনাকে আর ধরে রাখতে পারছে না, চার দিকে ছড়াছড়ি যাচ্ছে… সেই তোমার নিখিল রসের নিবিড় সমষ্টিরূপ যে অমৃত তারই একটু কণা আমার হৃদয়ের মাঝখানটিতে একবার ছুঁইয়ে দাও।…তিনিই রস, যা কিছু আনন্দ সে এই রসকে পেয়েই।’
সূর্য প্রায় অস্ত গেছে। আকাশে আঁধার নামছে। তবু তার গায়ে ফুটে আছে আবিরের আভা। এ যেন অসীমের গায়ে আদিসত্তার বাণী। এই বাণী মনের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছে, এই যে দিগন্তভরা সৌন্দর্য, এই যে মহান সূর্যাস্ত, এই যে রসের প্লাবন— সব কিছু সেই আদিসত্তারই প্রকাশ। বায়ু মধু বহন করছে। নদী আর সমুদ্র মধু ক্ষরণ করছে। মধুময় বনস্পতি। মধুময় ঊষা। মধুময় রাত্রি। মধুময় পৃথিবীর ধূলি। মধুময় সূর্য। উপনিষদের বার্তায়: বায়ু মধু বহন করছে। নদী আর সমুদ্র মধু ক্ষরণ করছে। মধুময় বনস্পতি। মধুময় ঊষা। মধুময় রাত্রি। মধুময় পৃথিবীর ধূলি। মধুমান সূর্য।
মনে রাখবেন, এই প্রকাশকে, এই জগৎকে মিথ্যা বলছে না বিজ্ঞান, মিথ্যা বলছে না উপনিষদ, মিথ্যা বলছেন না রবীন্দ্রনাথ।
তাই মায়াবাদ যেন চিরদিনের জন্যে শেষ হয়। যেন কুহেলিকা দূর হয়। যেন আবরণ সরে যায়। যেন আঁধার কেটে যায়।
অপাবৃণু, হে জগৎ তুমি প্রকাশিত হও। খুলে ফেলো আবরণ। উন্মোচিত হোক তোমার অন্তরের সত্য। সরে যাক পরদা।
আঁধার ভেদ করে ফুটে উঠুক সত্যের আলো।
উপনিষদের বীজমন্ত্রটি জেগে উঠুক আমাদের হৃদয়ে। বিজ্ঞানের সত্যে গাঢ় হোক আমাদের বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ প্রাণিত করুক আমাদের সমবেত চেতনাকে।
ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য
একমেবাদ্বিতীয়ম্
এখন আবার সেই মজার কথা বলি, এ-যুগের অনেকেই মনে করেন ব্রহ্ম মিথ্যা, কিন্তু জগৎ সত্য। এই ভুলটিও ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’র মতোই চরম ভুল। এই ভুলটা আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকেই করছেন। তাঁরা মনে করছেন জাগতিক সাফল্যই জগতের একমাত্র উদ্দেশ্য। কাজ এবং কেরিয়ারের সেই চাপ ক্রমাগত নষ্ট করে মানসিক শান্তি, ফলে হয় শরীর ও মনের বিচিত্র অসুখ। তখন সেই চাপ আর ব্যস্ততার মধ্যে আমরা শান্তি চাই, আনন্দ চাই। রবীন্দ্রনাথ দেখান সেই শান্তির পথ—
কর্ম যখন প্রবল আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্তচরণে এসো॥
বিজ্ঞান বলছে, আমরা একই উৎস থেকে এসেছি। সেই উৎসও বিরাজমান সর্বত্র। সুতরাং আমরা যে-উৎস থেকে এসেছি সেই উৎসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে না কেন? বিজ্ঞান কিন্তু এখনও দেখাতে পারেনি কী পদ্ধতি বা উপায়ে সেই সংযোগ হতে পারে। প্রসংগত দলাই লামা নিউরো সায়েন্টিস্টদের চ্যালেঞ্জ করেছেন তাঁকে এমন একটি হেলমেট বা সেইরকম কোনও জিনিস দিতে যেটা তাঁকে নিয়ে যাবে সেই মানসিক অবস্থায় যা তিনি পান ধ্যানের পর। তিনি বলেছেন, যদি হেলমেট তাঁকে দিতে পারে সে-মানসিক অবস্থা তা হলে তিনি ধ্যান করে অত সময় নষ্ট করবেন কেন!
জানি না বিজ্ঞানীরা এ রকম হেলমেট কোনওদিন তৈরি করতে পারবে কি না। জানি কিন্তু আমাদের বেদ-উপনিষদের ঋষিরা বহু যুগ ধরে অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার ফলে উৎসের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পদ্ধতির সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই পদ্ধতিগুলির মধ্যে পড়ে যোগ ধ্যান প্রার্থনা পূজা কীর্তন ও সমবেত আরাধনা।
উৎসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সব পদ্ধতির মধ্যে একটি সাধারণ সূত্র আছে। স্বভাবতই আমাদের মন বহুপথগামী। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তাই আমরা সবাই জানি এই গান ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।’ মনটাকে বাঁধতে কিছুর ওপর ‘ফোকাস’ করতে হয় মনকে। মনের নিয়ন্ত্রিত ফোকাস ছাড়া উৎসের সঙ্গে সংযোগ সম্ভব নয়। বারবার চেষ্টা করতে করতে আমাদের চেতনা হঠাৎ এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ‘কোয়ান্টাম’ লাফ দিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এই গভীর অভিজ্ঞতা আসে এক অপ্রত্যাশিত সহজ পথে। এই উপলব্ধি যাঁর না হয়েছে তাঁর কাছে এটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। কিন্তু এই উপলব্ধি যে মনের ভ্রম নয়, বাস্তব সত্য, তা বিজ্ঞাননির্ভর নানা পদ্ধতির সাহায্যে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে— যেমন, ব্রেন-ইমেজিং, ব্রেন ওয়েভ স্ক্যানিং, স্কিন রেজিটেন্স, হার্টবিট কাউন্ট, রক্তের হরমোন লেভেল ও নিউরোট্রান্সমিটার সেরাটনিন লেভেলের পরীক্ষা। আমার সৌভাগ্য যে আমি উৎসের সঙ্গে এই একাত্মতাবোধে বারবার পৌঁছোতে পেরেছি। সারা বিশ্বে আমার অনেক পদার্থবিজ্ঞানী বন্ধুরাও পেরেছেন। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী ব্রায়ান জোসেফসন কুণ্ঠাহীনভাবে বলতে দ্বিধা করেননি যে তিনি ভারতীয় পদ্ধতিতে রোজ ধ্যান করেন। ধ্যান থেকে তিনি যদি উপকৃত না হতেন তা হলে এমন কথা বলতেন কি? নেহরুর মতো অ্যাগনস্টিকও স্বীকার করেছেন যে এই উপলব্ধির বর্ণনা যেহেতু সারা বিশ্বে বিচিত্র সময়ে, বিচিত্র দেশে, বিচিত্র ধর্মে বিস্ময়করভাবে এক যে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং আমাদের জীবনকে উন্নততর করার জন্যে যেন এই অমূল্য সম্পদকে আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে পারি। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, বা ব্রহ্ম মিথ্যা জগৎ সত্য, এই চরম ভ্রান্তিতে যেন জড়িয়ে না পড়ি।
দেখা যাচ্ছে, পশ্চিম ভুবনে এবং পূর্ব পৃথিবীর একটি বড় অংশ জুড়ে কাজের জগৎটাই এত বড় হয়ে উঠছে, সেই পার্থিব ব্যস্ততা গ্রাস করে ফেলছে আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় সত্য ব্রহ্মকে। আর ভারতবর্ষে ‘জগৎ মিথ্যা’ প্রচারের ফলে ক্রমে গড়ে উঠেছে সেই জীবনদর্শন যার মধ্যে পার্থিব কাজ ক্রমশ বঞ্চিত হচ্ছে তার যথাযথ স্বীকৃতি থেকে। একদিকে আধ্যাত্মিকতার জগৎ, অন্যদিকে কাজের জগৎ— দুই-ই সমান সত্য, এ-কথা মনে রেখে আমাদের পৌঁছোতে হবে সুচারু ভারসাম্যে, দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হবে ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য। আমরা যেন ‘ব্রহ্ম সত্য’ মেনে নিয়েও ‘জগৎ মিথ্যা’ এই ভ্রান্ত ধারণার আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে পারি আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে। যেন আমাদের ভাবনাতে জ্বালাতে পারি নতুন চেতনার আলো। যেন পৌঁছোতে পারি নতুন যুগের ভোরে। ‘ব্রহ্ম সত্য’— উপনিষদের এই ঘোষণা বিশ্বাস করেই যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি—
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।
চির শক্তির নির্ঝর নিত্য ঝরে
লহ’ সে অভিষেক ললাট’পরে।
বলতে পারি— ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য।
.
কৃতজ্ঞতাস্বীকার
প্রথমেই স্বীকার করছি বেদ উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণা ছাড়া এই বইটি লেখা সম্ভব হত না। রঞ্জনের সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস ও হাওয়াইয়ে এই বইটি লেখার সময়ে আমি যে ‘সিনার্জি’ উপলব্ধি করেছি তা হয় একমাত্র আমার বিজ্ঞানী সতীর্থদের সঙ্গে কাজ করার সময়ে। রঞ্জনের সঙ্গে আমি আগেও কয়েকটি বইয়ের কাজ করেছি। আমি বিজ্ঞানী হিসেবে perfectionist। সুতরাং অন্যবারের মতো এবারও এই বইটি লেখার সময়ে তার ধৈর্যপরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে।
সুন্দর ছবিগুলির জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ন্যাশনাল এরোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ ইউ এস এ (নাসা), স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট (STSCI), জেট প্রপালশান ল্যাবরেটরি (NASA/JPL— Caltech), হাবল সাইট, দ্য হাবল হেরিটেজ টিম (AURA/STSCI/NASA) ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (EAA) এবং অন্যান্যদের।
আমি কৃতজ্ঞ আনন্দ পাবলিশার্স-এর সুবীর মিত্র আর তাঁর সুদক্ষ সহকর্মীদের কাছে। তাঁদের আগ্রহ ও সযত্ন প্রচেষ্টা না থাকলে বইটি এত সুন্দরভাবে প্রকাশিত হত না।