শেষ এসএমএস
নিস্তব্ধতা ভেঙে টিং—টং আওয়াজ করে ঢুকল একটা এসএমএস।
তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের হাতে ছিল মোবাইলটা। মুহূর্তের জন্য সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন তিনি। খানিক আগে ফোনের অপেক্ষাকৃত সহজ লক একবারের চেষ্টাতেই খুলে ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু এ সময় অনাহুতের মতো আসা বার্তা ওখানে দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে হল না তাঁর। ভাবছিলেন, লাশ মর্গে দিয়ে তারপর অফিস ফিরে খতিয়ে দেখবেন এর মধ্যে থেকে সত্যিই কিছু পাওয়া যায় কি না। তবুও ফোনটা নাড়াচাড়া করতে করতে আচমকা স্ক্রিনে গিয়ে চোখ আটকে গেল। আর তখনই নজরে এল সেই মেসেজটা। রোমান হরফে বাংলায় লেখা, ‘শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি। ফের যদি একই কথা বলতে হয়, তবে তা যে ভালো হবে না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু যেন ভাবুক হয়ে গিয়েছিলেন অফিসার। হুশ ফিরল ‘আদত সে মজবুর’ ডােমের বাজখাঁই গলায়, ‘সাব। ইয়ে আজ কা আখরি লাশ। অভি হামকো ঘর ওয়াপস যানা হ্যায়। থোড়া কুছ দিজিয়ে। লাশকাটা ঘরে দুভাগ্যক্রমে যাঁদের যেতে হয়েছে, তাঁদের কাছে অজানা বিষয় নয়, ওখানে ডােমেরাই ডন। ফ্রিজের মতো ঠান্ডা ঘরটায় বারবার ঢুকেও তাঁদের মেজাজ সর্বদা তিরিক্ষি থাকে কেন তা ওঁরাই জানেন। দোর্দন্ডপ্রতাপ যে কোনও পুলিশ অফিসারও ওই এলাকায় ডােমেদের প্রতাপে মুহূর্তে বশ হয়ে যান। দিজিয়ে’ মানে খুব স্পষ্ট কথা। অর্থাৎ, তিনি এখন বেরিয়ে যাবেন গেটে তালা ঝুলিয়ে। আর পুলিশ কর্তাকে নিজের পকেট থেকে দিতে হবে একটা মালের বোতলের দাম। না দিলে? আর রক্ষে নেই। ময়নাতদন্তের দফারফা হয়ে যাবে ওখানেই।
ইংরেজ আমল থেকে চলে আসা নিয়ম, সূর্য ডুবে গেলেই আর পোস্টমর্টেম হবে না। ফের সেই পরের দিন সূর্য ওঠার পালা। আর এখানে খুন এবং আত্মহত্যার যে ঘটনাটা ঘটেছে তা দুপুরে। ফলে সব হ্যাপা সামলে দুটো বডি আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছে ঢের।
যে মোবাইলটা অফিসারের হাতে রয়েছে আসলে সেটা তাঁর, গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় যাঁর মৃতদেহ কিছুক্ষণ আগে নিয়ে আসা হয়েছে লাশকাটা ঘরে। আনা হয়েছে কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রীর দেহও।
৬ জানুয়ারি। ২০০৮। দুপুরবেলা। একই ঘরে দু—দু’টি মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতনে।
কে পাঠাল এমন হুমকি বার্তা? অফিসারের সতর্ক দৃষ্টি ততক্ষণে আটকে গিয়েছে এসএমএসের নীচে ক্যাপিটাল হরফে লেখা AK—তে। আর ওই দুটি ইংরেজি অক্ষরের সৌজন্যে পুলিশের কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ এই তদন্তটা মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হল একটা জটিল ধাঁধায়। প্রশ্নের উত্তর আগাম তৈরি করে নিয়েছিলেন তদন্তকারী। অথচ একটা এসএমএস উলটপালট করে দিয়ে গেল পুলিশের ভাবনাচিন্তা সহ সবকিছু। অঙ্কটাও মিলতে গিয়ে আটকে গেল সিঁড়ির মাঝপথে এসে।
কে এই AK? কেনই বা সে এরকম একটা হুমকি ভরা বার্তা পাঠাল এক মৃত যুবকের মোবাইলে? রহস্যময় মেসেজটা আসার পর তাহলে ঘটনাটা কি একই থাকল, নাকি বাঁক নিল অন্যদিকে? ঠিক কী ঘটল? মামলার তদন্তে নামা দুঁদে পুলিশ কর্তা এসডিপিও দেবাশিস ধরের প্রথমেই মনে হল, তাহলে বিষয়টা কি অনেকটা ‘এক ফুল দো মালির’ চিত্রনাট্য? খুন এবং আত্মহত্যার পর যেটাকে কার্যত রুল আউট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক এসএমএসেই যেন কাহানি মে নয়া টুইস্ট।
এবং হ্যাঁ। পুলিশ এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই শুরু করল প্রাথমিক তদন্ত অর্থাৎ দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর কাজ।
এই ঘটনার চার বছর আগে কবি গৃহ থেকে নোবেল প্রাইজ চুরি যাওয়ার ঘটনায় বেআব্রু হয়েছিল বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা। তবে এবার আর ছিচকে চুরি নয়, বারবেলায় রীতিমতো গুলি চালানোর মত ঘটনা ঘটে গেল সঙ্গীত ভবনের হস্টেলের অন্দরে। তাও আবার ওয়েবলি স্কট ৯ এমএম পিস্তল থেকে। তদন্তকারীদের সাধারণ বুদ্ধি বলছে, এই পিস্তল তো ব্যবহার করার কথা খোদ পুলিশ অফিসারদের! তাহলে গুলি চালনার ঘটনায় মৃত ২৯ বছরের অমরেশ কুণ্ডুর হাতে এই আগ্নেয়াস্ত্র এল কী করে? নজর ঘুরে গেল সেদিকে। এদিক—ওদিক খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন জেলা পুলিশের কর্মীরা। ততক্ষণে টিভি চ্যানেলের পর্দায় ফুটে উঠেছে তিরিশ সেকেন্ডের একটা ফুটেজ। যেখানে দেখা যাচ্ছে একটা ঘরে পর পর দু’টি মৃতদেহ। একটি খাটের উপর শোয়ানো অন্যটি দরজার ঠিক পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা।
বিশ্বভারতী যখন এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড়, সে দিন বিকেলে টালিগঞ্জ থানার অতিরিক্ত ওসি কাজে এলেন। দুপুরে কানে এসেছিল শান্তিনিকেতনে সম্ভবত কোনও খুনের ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য মাথা ঘামাননি খুব একটা। নিজের এলাকার বাইরে কিছু হলে তা জেনে কী হবে, এটাই ভাবছিলেন সম্ভবত। থানায় ঢুকতেই কাজের ফাঁকে চোখ গেল টিভি চ্যানেলের দিকে। সেই দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন তিনি। আরে এতো অমরেশ বলে মনে হচ্ছে? পিস্তলটা কোথা থেকে পেল?’ সন্দেহটা প্রথমে একটু হালকা তারপর গাঢ় হতেই মনে যেন কু ডাকল। দৌড়ে দেখতে গেলেন থানার আরমারির বক্সটা। প্রাচীন প্রবাদ, অন্য সবার তুলনায় পুলিশের নাকে অপরাধের যে কোনও গন্ধ আগে আসে। এবারও এল, তবে একটু দেরিতে। খোঁজ করতে গিয়ে দেখতে পেলেন সার্ভিস পিস্তলটি বেমালুম উধাও থানা থেকে! আর দেরি করা যায় না। কনস্টেবল সুনীলকে ফোন করলেন। কিন্তু ফোন বেজে গেল তাঁর। রাগে গজগজ করতে লাগলেন, ‘কাজের সময় ফোনটা ধরে না। আজ আসুক, কেস খাওয়াতে হয় কেমন করে দেখতে পাবে। কিন্তু না, আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যায় না। নিয়ম মেনে থানাতে দ্রুত একটা জেনারেল ডায়েরি(জিডি) লিখতে বসে গেলেন অতিরিক্ত ওসি। লেখা হল, ‘প্রবাবলি মাই সার্ভিস রিভলবার ওয়াজ স্টোলেন ফ্রম পুলিশ স্টেশন।’
খুন এবং আত্মহত্যার ঘটনার পর প্রায় চার—পাঁচ ঘণ্টা ধরে তদন্তের সূত্র ঘোরাঘুরি করছিল শুধুমাত্র একটা জেলার মধ্যে। এবার তার শিকড় বোলপুর টপকে এগোতে লাগল কলকাতা শহরের দিকে। কীভাবে, সে কথায় পরে আসছি।
শুরু হল আরও বিস্তারিত খোঁজ খবর নেওয়ার পালা। আর তা নিতে নিতেই জানা গেল, মৃত অমরেশের আসল পরিচয়। কলকাতার টালিগঞ্জ থানার অতিরিক্ত ওসির পার্ট টাইম চালক সে। গ্র্যাজুয়েশন করার পর গ্রাম থেকে কলকাতা শহরে চলে এসেছিল একটা কাজের সন্ধানে। অবসর সময়ে গাড়ি চালানোটা শিখে নিয়েছিল। বুদ্ধিসুদ্ধি বেশ ভালো। চেহারাটাও মজবুত। বেশ একটা পুলিশ—পুলিশ ব্যাপার আছে। সেটাই বাড়তি সুবিধা জোগায়। অস্থায়ী হলেও নিয়ম মেনে ঠিকভাবে কাজও করছিল অমরেশ।
অথচ তার বাইরের চেহারার আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটা অন্য চরিত্র। কোনও একটা কারণে মনে জমা হওয়া একরাশ ঘৃণা থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা জেগেছিল এই চালকের। ঘটনার দিন ভোরবেলা সবার চোখ এড়িয়ে পিস্তল পকেটে নিয়ে চেপে বসে সকালের গণদেবতা এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরায়। গন্তব্য ছিল কলকাতা থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরের আনন্দ সদন। সেখানে দেখা করার কথা খুব পরিচিত একজনের সঙ্গে। হস্টেলের আবাসিক সঙ্গীত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মেদিনীপুরের ঘাটালের বাসিন্দা শাশ্বতী পাল। আগেও বেশ কয়েকবার ওই এলাকা এবং আশেপাশে অমরেশকে ঘুরঘুর করতে দেখেছেন আবাসিকরা। ফলে ওইদিন সকালে আলাদা ভাবে তাঁদের কিছুই মনে হল না। বেলা সাড়ে এগোরোটা নাগাদ হস্টেলের অনেকেই দেখতে পেলেন বারবার মোবাইলটা কানে নিয়ে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে ওই যুবক। এর ঠিক ঘন্টাখানেক বাদে হস্টেলের ঘর থেকে ভেসে আসে পর পর দুটি গুলির আওয়াজ। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে হস্টেলময়। উত্তেজনায় আবাসিকরা ছুটে ভিতরে গিয়ে দেখতে পান খাটের উপর রয়েছে শাশ্বতীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। ওই একই ঘরের ঠিক নীচে দরজার পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে রয়েছে গুলিবিদ্ধ অমরেশ কুণ্ডু। তারপর থেকে সেই ঘরে বিশ্বভারতীর কর্তা, পুলিশ, মিডিয়া আরও আরও ভিড়! রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ‘সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে।’
ঘটনার পর জোরকদমে এগিয়ে চলল তদন্ত। গোয়েন্দাদের মস্তিষ্কের কোষ দ্রুত কাজ করলে কী হতে পারে, তার প্রমাণও পাওয়া গেল হাতেকলমে। ফলস্বরূপ, পর্দা উঠল আসল ঘটনার।
এবার আসা যাক সেই ঘটনা পরম্পরায়। ছোটবেলা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে বড় হয়ে ওঠা শাশ্বতী এবং অমরেশের। কাছাকাছি বাড়ি দু’জনের। পড়াশোনাও একসঙ্গে। একটা সময় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তাঁরা। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রুজির সন্ধানে, স্নাতক পর্ব পেরিয়ে কলকাতায় এসে টালিগঞ্জ থানায় অস্থায়ী গাড়ি চালকের কাজ নেয় অমরেশ। তবু দু’জনের যোগাযোগ ছিলই। কলেজের পাঠ শেষ করে সঙ্গীত নিয়ে পড়তে চলে আসেন শাশ্বতীও।
পুলিশ এলাকার লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারে তাঁদের মধ্যে তিন বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুই বাড়ির লোকেরা দু’জনের মেলামেশার কথাও জানতেন। শাশ্বতীর বাড়ির লোকেদের এটা নিয়ে প্রথম থেকে প্রবল আপত্তি ছিল। যদিও সঙ্গীত নিয়ে শান্তিনিকেতনের পড়তে যাওয়ার অধ্যায় বদলে দেবে বাড়ির মেয়েকে, এমনটা ভেবে নিয়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য হলও তাই। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের গাড়ির চালকের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহ কমে গেল শাশ্বতীর। সেটা আবার বোঝা গেল ঘটনার ঠিক দিন তিনেক আগে। রাতে বেজে উঠল অমরেশদের বাড়ির ফোন। ওপারে রিসিভার তুলে হ্যালো বললেন সম্ভবত অমরেশের মা। শুনুন, আমি শাশ্বতী বলছি। আমি আগেও জানিয়েছি, আবারও জানাচ্ছি, আপনারা ওর বিয়ে অন্য কারও সঙ্গে দিয়ে দিন। আমার পক্ষে অমরেশকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’ কথা না বাড়িয়ে ‘ঠিক আছে’ বলে ফোন রেখে দেন অমরেশের মা। বাড়ির সবার খোঁজ নিতে ফোন করায় সেই খবর রাতের মধ্যে পৌছে যায় অমরেশের কানে। সমস্যার শুরুও ঠিক এখান থেকে। সম্পর্ক ভাঙার কথা জানতে পেরে অমরেশ মরিয়া হয়ে ফোন করা শুরু করে ছোটবেলার বান্ধবীকে। কিন্তু বেশ কয়েকদফা ফোন করলেও শাশ্বতী তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাননি। শেষ পর্যন্ত এসপার—ওসপার করতে প্রেমিকাকে চরম শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পুলিশের গাড়ির চালক।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে ঘটনার পর পর ছবি, ঘটনার দিন সকাল সকাল টালিগঞ্জ থানায় চলে আসে অমরেশ। থানায় নিয়মিত আসার সুবাদে তাকে চিনত সবাই। আর তারও জানা ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বাক্সটিতে বেশির ভাগ দিন তালা লাগানো হয় না, ওটি কার্যত অরক্ষিত অবস্থাতে থাকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় সে। আগের রাতে ডিউটি করে কনস্টেবল সুনীল মাঝি সকাল ছ’টায় বাড়ি যাওয়ার আগে অতিরিক্ত ওসির কাছ থেকে রিসিভ করা নাইন এমএম পিস্তলটি রেখে যান। ভুলে সেই বাক্সে তালা দেননি তিনি। সাত সকালে থানার পুলিশ কর্মীদের ডিউটি বদলের সময় সুযোগ বুঝে ওই পিস্তল পকেটে নিয়ে অমরেশ হাঁটা লাগায় থানার চৌহদ্দি ছেড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ অমরেশকে হস্টেল থেকে ১৫০ মিটার দূরে মাটি দিয়ে বানানো ব্ল্যাক হাউজের সামনে বেশ কিছুক্ষণ শাশ্বতীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। একসময় তর্কও শুরু হয় তাঁদের মধ্যে। রেগেমেগে ছাত্রীটি হস্টেলে ফিরে আসেন একা। কিন্তু, এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি ছিল না বছর ২৯—এর অমরেশ। সে দিন গেটে কোনও নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন না। ফলে অমরেশ অবাধে উপরে উঠে আসে। এমনিতে রবিবার হলেও বিশ্বভারতীতে ক্লাস চলার কারণে বেশির ভাগ ছাত্রী হস্টেলে তখন নিজের ঘরে ছিলেন না। আবার হস্টেলের সুপারভাইজার নাফিসা আলির ঘরও ছিল ফাঁকা। হুড়মুড়িয়ে অমরেশ উঠে আসে দোতলায়। হাতে জলের বোতল নিয়ে অন্য একটি ঘর থেকে নিজের ঘরের দিকে সে সময় যাচ্ছিলেন শাশ্বতী। আচমকাই অমরেশকে উপরে দেখতে পেয়ে হস্টেল পরিষ্কার করতে আসা সুইপার ফুচি বীরবংশীকে জানিয়ে দেন শাশ্বতী, ‘ওই ছেলেটিকে বলে দিন আমি আর কোনও কথা বলতে রাজি নই। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ও যেন হস্টেল ছেড়ে চলে যায়। ওই নিষেধটুকু শোনার মতো ধৈর্য্য সে সময় ছিল না অমরেশ কুণ্ডুর। সোজা ঘরের মধ্যে তীব্র গতিতে ঢুকে পড়ে সে। নিজের ঘরে জানলার সামনে তখন দাঁড়িয়ে ছাত্রীটি। মুখোমুখি হয়ে আর কোনও কথা না বলে তাঁর বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায় অমরেশ। বিছানায় ছিটকে পড়েন শাশ্বতী। বালিশ ভিজে যায় চাপ চাপ রক্তে। শান্ত। থাকা হস্টেলের বাইরে ততক্ষণে গুলির আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছে। সামান্য কিছুক্ষণের ব্যবধান। দ্বিতীয়বার ফের গুলির শব্দ। যাঁরা হস্টেলে ছিলেন ছুটে আসেন সবাই। ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিরাট পুলিশ বাহিনী, সঙ্গে তাঁদের ফটোগ্রাফার। দুটি মৃতদেহের যে ছবি তোলা হয়, তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় প্রথমে প্রেমিকাকে গুলি করে তারপরের গুলিটা নিজের মাথায় চালিয়ে দিয়েছে কলকাতা পুলিশের অস্থায়ী গাড়ির চালক। ফরেনসিক দল ঘুরে যাওয়ার পর মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেন তদন্তকারীরা। পুলিশের ভাষায়, ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ এই কেসে বীরভূম পুলিশের তদন্তে এখানেই কার্যত দাঁড়ি পড়ে যাওয়ার কথা।
তা আর হল কোথায়? অমরেশের মৃতদেহ মর্গে ঢোকানোর সময় তারই মোবাইলে যে হুমকি এসএমএসটি ঢুকল, পুলিশি তদন্তের অভিমুখ ঘুরে গেল এবার সেদিকে। মোবাইল নম্বরের সূত্র জানতে পুলিশ সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ছানবিনে উঠে আসে নম্বরটি বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা আইটি ইঞ্জিনিয়ার অঞ্জন কারক নামে এক যুবকের।
এই অঞ্জন আবার কে? এবার অবশ্য সাহায্য পাওয়া গেল মৃত শাশ্বতীর বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে। তাঁরা তদন্তকারীদের জানালেন, অমরেশের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার আগেই শাশ্বতীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত যুবক অঞ্জন কারকের সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে ফোনে নিয়মিত কথাবার্তাও হত। হবু স্ত্রী শাশ্বতী একদিন অঞ্জনকে জানান পূর্ব প্রেমিকের কথা। এও বলেন, তিনি পুরনো সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাইলেও অমরেশ তাতে রাজি হচ্ছে না। বরং নিজেকে পুলিশ কর্মী পরিচয় দিয়ে নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছে, ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টাও করছে প্রায় রোজ।
বেশ কয়েকদিন ধরে একই অভিযোগ শোনার পর শাশ্বতীর পাশে দাঁড়িয়ে অমরেশকে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য প্রথমে অনুরোধ জানাতে ফোন করেন অঞ্জন। তাতে কাজ না হওয়ায় হুমকি দিয়ে এসএমএস পাঠাতে থাকেন। তার আগে বারবার চেষ্টা করেও ফোনে কথা বলতে পারেননি তিনি।
ঘটনার পর পুরো বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশ ডেকে পাঠায় অঞ্জনকে। জেরা শুরু করেন তদন্তকারীরা।
‘কেন আপনি অমরেশকে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন? আপনাদের মধ্যে কোনও শত্রুতা ছিল কি?
অঞ্জন কবুল করেন, বার্তাটা তাঁর মোবাইল থেকেই গিয়েছিল। কিন্তু কেন? অমরেশ মারা যাওয়ার পরও… প্রশ্ন করেন পুলিশ অফিসার। জবাব আসে, না স্যার, ও যেদিন শাশ্বতীকে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ফোন করে হুমকি দিত, ঠিক সেই দিনগুলিতে শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য ওকে বুঝতে দিয়ে AK নাম দিয়ে এসএমএস পাঠাতাম। এর পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। দুজনের কেউ কাউকে সামনাসামনি কোনওদিন দেখিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ঘটনা ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এতে আমার কোনও হাত নেই।’ সেই বয়ান ক্রশ চেক করতে পুলিশকে এরপর বেশি পরিশ্রম আর করতে হয়নি।
অঞ্জনের এই একটি স্বীকারোক্তিতে পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল মেসেজে উল্লেখ করা AK আসলে কে। সেই থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই মামলার তদন্তের ফাইল।