৫
মমতাজের বি.এ. পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন সে আর আগের মতো বন্ধু- বান্ধবীদের নিয়ে খেলাধুলা করে না। তাদের সঙ্গে মেলামেশাও কমিয়ে দিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে শিহাবের সঙ্গে বেড়াতে যায়। তার কাছ থেকে ধর্মীয় বই নিয়ে পড়ে ক্রমশঃ যেমন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তেমনি শিহাবের দিকেও ঝুঁকে পড়ছে। কারণে অকারণে তার কাছে গিয়ে নানারকম আলোচনা করে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলল, আচ্ছা শিহাব ভাই, আজকাল ছেলে মেয়েরা যে প্রেমে পড়ে এবং প্রেম করে বিয়ে করে, এই সম্বন্ধে আপনার মতামত কি?
মমতাজ যে ক্রমশঃ ধর্মের দিকে ও তার দিক ঝুঁকে পড়ছে শিহাব তা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। সে নিজেও তাকে ভীষণ ভালবেসে ফেললেও চিন্তা করে, যে ফুপা-ফুপু তাকে ছেলেরমতো স্নেহ করেন, যারা তাকে উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন এবং মাকে সংসারের খরচ দিয়ে আসছেন, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মমতাজকে ভীষণ ভালবাসলেও কঠোরভাবে নিজেকে সংযত রেখেছে। মমতাজ যতই তার সঙ্গে ঘণিষ্ঠ হতে চায়, সে ততই তাকে এড়িয়ে চলে। আজ তার মুখে প্রেমের কথা শুনে শঙ্কিত হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে বলল, আজকালের ছেলে মেয়েরা প্রেম কি জিনিস জানে না। একসঙ্গে মেলামেশা করে একে অপরের প্রেমে পড়ে। এটাকে ঠিক প্রেম বলে না। দুটো ছেলে মেয়ের মধ্যে অনেক দিনের ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও অন্য ভালো ছেলে মেয়ে পেয়ে তারা পূর্বের ভালবাসার কথা ভুলে যায় এবং অন্যকে ভালবাসে। এমন কি তারা বিয়েও করে। দেখা গেছে, যারা ভালবেসে বিয়ে করে, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক সুখী হতে পেরেছে। আবার অনেকে সুখী হলেও অশান্তিতে ভুগছে। আসলে মানুষের মন বড় বিচিত্র। সে কিসে সুখ শান্তি পাবে তা নিজেই জানে না। যতটুকু জানে, তা সারাজীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষ আজ যা পেলে সুখী হয়, কিছু দিন পর সেটাই তার কাছে অসুখী হয়ে দাঁড়ায়। তবে যারা ধর্মীয় জ্ঞানে গুণী এবং ধর্মীয় আইনের অনুশীলন করে থাকেন, তারা তকদীরের উপর বিশ্বাস করে সবকিছু মেনে নেয়। তারা অসুখী হলেও হতাশ হয় না অথবা অনুশোচনা করে না। তারা তকদীরকে বিশ্বাস করে সব কিছু মেনে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। তাদের কাছে ইহজগতের চেয়ে পরকালের সুখ শান্তি পাওয়াটাই বড়। আর একটা কথা, ছেলে- মেয়েরা তাদের অপরিপক্ক জ্ঞানের দ্বারা যা কিছু ভালো মনে করে, পরিপক্ক জ্ঞান হওয়ার পর সেগুলোকে আর ভালো মনে করতে পারে না। ভালবাসার মধ্যে পার্থিব স্বার্থ জড়িত। বিয়ের পর যখন সেই স্বার্থ পূরণ হয় না তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ কলহের সৃষ্টি হয়। ইসলামে ছেলে মেয়ের মধ্যে যেমন মেলামেশা নিষিদ্ধ তেমনি প্রেম ভালবাসা করাও নিষিদ্ধ। কারণ যুবক-যুবতীদের বয়সটা এমন, যা কোনো বিধি নিষেধ মানতে চায় না। যতই তারা শিক্ষিত ও চরিত্রবান হোক না কেন, শয়তান তাদের পিছনে সব সময় লেগে থাকে। যে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। “শয়তান যে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু” একথা আল্লাহ কুরআনের অনেক জায়গায় বলিয়াছেন। যেমন তিনি এক জায়গায় বলিয়াছেন, “হে আদম সন্তানগণ (এবং হে জ্বিনগণ), তোমরা শয়তানের পূজা করিও না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর ইহা (-ও) যে, তোমরা কেবল আমারই ইবাদত কর; ইহাই সরল পথ।” [সূরা- ইয়াসীন, পারা- ২৩, আয়াত- ৬১]
কিন্তু আমি তো শুনেছি প্রেম পবিত্র।
হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু সেই প্রেম আজকালের ছেলে মেয়েরা যে প্রেম করে, তা নয়। সেই প্রেমের কথা আজকালের ছেলে মেয়েরা জানে না। সেটা আল্লাহ প্রদত্ত প্রেম। সেখানে না আছে কোনো স্বার্থ, না আছে কোনো পাপ পঙ্কিলতা। সেখানে যেমন দৈহিক মিলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, তেমনি পার্থিব স্বার্থেরও কোনো সম্পর্ক নেই। সেইরকম প্রেমের কথা খুব কম সংখ্যক ছেলে মেয়ে জানে।
মমতাজ হঠাৎ মনের তাগিদে বলে ফেলল, আপনি যে প্রেমের কথা বললেন, কোনো মেয়ে যদি সেরকম প্রেম আপনাকে নিবেদন করে, তা হলে আপনি কি করবেন?
শিহাব কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, এই হতভাগাকে কোনো মেয়ে প্রেম নিবেদন করবে, এটা খুবই হাস্যকর ব্যাপার।
আপনি নিজেকে এত ছোট ভাবেন কেন?
আমি যে তাই।
কিন্তু আপনি একজন স্কলার ছাত্র। ভবিষ্যতে তো আর তাই থাকবেন না।
সেটা আল্লাহপাক জানেন। যা আছি, তার চেয়ে আরো ছোটও তো হতে পারি?
বড়ও তো হতে পারেন? আল্লাহ ইচ্ছা করলে গরিবকে ধনী এবং ধনীকে গরিব করতে পারেন। এটা আমি কুরআনের ব্যাখ্যায় পড়েছি।
হ্যাঁ, তোমার কথা অবশ্য ঠিক। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
তা হলে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
সেরকম কোনো মেয়ে যদি সত্যি প্রেম নিবেদন করে, তা হলে পরীক্ষা করে দেখব, তারপর ডিসিশান নেব। এবার আমি যদি বলি, হঠাৎ প্রেমের কথা তুললে কেন? তুমি কি কারো প্রেমে পড়েছ?
সে কথা বলব না, তবে আমাকে একজন প্রেম নিবেদন করে চিঠি দিয়েছে।
তাই নাকি? তা তার চিঠির উত্তর দিয়েছ?
না, দিই নি।
কেন? ছেলেটা কি তোমাদের সমাজের উপযুক্ত নয়?
আমাদের সমাজের উপযুক্ত হলেও আমার কাছে নয়।
তা হলে পরিচিত ছেলে?
হ্যাঁ, পরিচিত।
তা হলে তাকে প্রত্যাখান করার আগে পরীক্ষা করে দেখ।
পরীক্ষা করার দরকার নেই। ছেলেটা ভালো। অনেক দিন থেকে তাকে চিনি। কিন্তু আমার মন যে ধরণের ছেলেকে পছন্দ করে, সে সেধরণের নয়। তা ছাড়া আমার মনের মতো ছেলের সন্ধান আমি পেয়েছি।
দেখ মমতাজ, মনের মতো সব কিছু পাওয়া তকদীরের ব্যাপার। তারাই পায়, যারা খুব সৌভাগ্যবান। সেরকম মানুষ দুনিয়াতে খুব কম। আজ যাকে তোমার মনের মতো মনে হচ্ছে, কিছুদিন পর তার থেকে আরো ভালো ছেলের সংস্পর্শে এলে তাকে আর সে রকম মনে হবে না।
আপনার কথা হয়তো ঠিক। তবে সবাইকে এক চোখে বিচার করা বোধ হয় ঠিক নয়।
তাও অবশ্য ঠিক। তোমার পছন্দের ছেলেটা কি জানে, তুমি তাকে ভালবাস?
বলতে পারব না।
আমার কথা রাখবে?
বলুন, নিশ্চয় রাখবো।
ছেলেটাকে আরো ভালো করে পরীক্ষা কর। যদি পজেটিভ হয় এবং বুঝতে পার সে তোমাকে সত্যিকার ভালবাসে, তা হলে অপেক্ষা করে দেখ, সে অগ্ৰভূমিকা নেয় কি না। খবরদার, তুমি অগ্রভূমিকা নেবে না।
ছেলেটাকে যতটুকু জানি, মনে হয় না সে অগ্রভূমিকা নেবে।
তবু তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে ছেলেরাই অগ্রভূমিকা নেয়। তা ছাড়া তুমি অগ্রভূমিকা নিয়ে তার কাছে ছোট হতে যাবে কেন?
আমি তাকে অনেকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, সারাজীবন অপেক্ষা করলেও সে অগ্রভূমিকা নেবে না।
শিহাব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কি বলবে ভেবে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।
মমতাজ অধৈর্য্য গলায় বলল, কিছু না বলে চুপ করে আছেন কেন?
আমার জ্ঞানে যা ছিল, তা সব বলেছি। আর কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।
আচ্ছা, আপনি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েন নি? অথবা কোনো মেয়ে কি আপনাকে প্রেম নিবেদন করেনি? আপনি বরাবর স্কলার ছাত্র। এ রকম ছেলেদেরকে তো মেয়েরা বেশি পছন্দ করে।
একটু আগে বললাম না, জেনেশুনে এই চাল-চুলোহীন ছেলেকে কে প্রেম নিবেদন করবে? তবে যারা আমার আর্থিক অবস্থার কথা জানে না, তাদের কেউ কেউ আমার দিকে এগোতে চেয়েছে। আমি বুঝতে পেরে তাদেরকে পাত্তা দিইনি। আমার সামনে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমত লেখাপড়া, দ্বিতীয়ত স্বাবলম্বী হওয়া এবং তারপর বোনের বিয়ে দেয়া।
কেউ যদি ততদিন আপনার অপেক্ষায় থাকে?
শিহাব হেসে উঠে বলল, সেটা তক্বদীরের ব্যাপার। তকদীরে যা আছে তা তো মেনে নিতেই হবে। এমন সময় আসরের আযান শুনে বলল, এবার এসব কথা থাক। তুমি এখন যাও, আমি নামায পড়তে মসজিদে যাব।
মমতাজ শত ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারল না, শিহাব ভাই, আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করবো। চিন্তা করল, আজ তাকে কোনো পার্কে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে কথাটা বলবে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নামায পড়ে আসুন, বেড়াতে যাব।
শিহাব বলল, আজ নয়, কাল যাব।
কেন?
আজ অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নামায পড়ে এসে একটু পড়াশোনা করব। মমতাজ কিছু না বলে চলে গেল।
.
মাস দুই হল রোজিনার বাবা আসফাক সাহেব লন্ডনের পাট চুকিয়ে স্বপরিবারে দেশে ফিরে নিজের বাড়িতেই ক্লিনিক খুলেছেন। ওনার বড় ছেলে হান্নান ডাক্তারী পাস করে বাবার ক্লিনীকেই কাজ করছে। হান্নান কয়েক বছর আগে যখন দেশে এসে রোজিনাকে নিয়ে মমতাজদের বাড়িতে এসেছিল তখন তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সেই সময় ভেবেছিল, মমতাজকে বিয়ে করবে। তারপর এবার যখন তারা একেবারে লন্ডন ছেড়ে চলে এল এবং রোজিনাকে সঙ্গে নিয়ে মমতাজদের বাসায় গিয়েছিল তখন তাকে দেখে সেই আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এই দু’মাসের মধ্যে বেশ কয়েকবার মমতাজের সঙ্গে একান্তে আলাপ করার জন্য এসেছে; কিন্তু সেরকম সুযোগ পাইনি। তাই একদিন নিজের মনের কথা জানিয়ে মমতাজকে একটা চিঠি লিখে রোজিনাকে বলল, তোকে একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না ম বল।
রোজিনা বলল, বলতে নিষেধ করছ যখন, বলতে যাব কেন?
তোর বান্ধবী মমতাজ কেমন মেয়ে বলতে পারিস? হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
মনে হল তাই জিজ্ঞেস করলাম। তা অমন করে চেয়ে আছিস কেন?
তোমার কথা শুনে আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
কি সন্দেহ হচ্ছে?
মমতাজকে তোমার পছন্দ হয়েছে।
তোর সন্দেহটা ঠিক, তবে মমতাজ যদি আমাকে পছন্দ না করে?
সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি জানব কি করে? তবে তুমি যদি বল, তা হলে জানার চেষ্টা করতে পারি।
না, তোকে কিছুই করতে হবে না। আমি যা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দে।
ছোটবেলা থেকে সে আমার বান্ধবী। তার সবকিছুই আমি জানি। পাত্রী হিসাবে তার কোনো খুঁৎ নেই। শুধু একটু অহঙ্কারী ও রাগি।
সেই জন্যেই তো তোকে জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, ওদের বাড়িতে যে ছেলেটা থাকে, সে কে বলতে পারিস?
ওর মামাতো ভাই শিহাব। খুব গরিব। মমতাজের মা-বাবা ওকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। খুব স্কলার ছাত্র। পলিটিক্যালসাইন্সে মাষ্টার্স করছে। নিচের ক্লাস থেকে কোনো দিন সেকেণ্ড হয়নি।
তাই নাকি? তা হলে তো সত্যিই ছেলেটা খুব স্কলার।
হ্যাঁ তাই; তবে এতদিন শহরে উচ্চ সোসাইটিতে থেকে লেখাপড়া করলেও সেকেলে রয়ে গেছে। কারো সঙ্গে বড় একটা মেলামেশা করে না। আর খুব ধার্মিক। তুমি লক্ষ্য করেছ কি না জানি না, ওর সংস্পর্শে এসে মমতাজদের বাড়ির সবাই বেশ ধার্মিক হয়ে গেছে। সবাই নামায পড়ে। মেয়েরা বাইরে যাওয়ার সময় চাদর বা ওড়না ব্যবহার করে। তবে মমতাজ তাকে একদম পছন্দ করে না। বলে পাড়াগাঁয়ের আনকালচার্ড অহঙ্কারী ছেলে।
ছেলেটার আবার অহঙ্কারও আছে?
মমতাজ তো তাই বলে। ওর মুখে শুনে আমি একদিন তার সঙ্গে আলাপ করে ছিলাম। ছেলেটা সত্যিই জিনিয়াস। পাড়াগাঁয়ের আনকালচার্ড ছেলে হলেও তার মধ্যে অহঙ্কারের কিছু দেখলাম না। আসলে ছেলেটা খুব ব্রিলীয়েন্ট। কোনো বিষয়েই মমতাজ তাকে হারাতে পারে না। তাই তাকে হয়তো অহঙ্কারী ভাবে।
যাকগে, তার কথা বাদ দে। তোকে একটা চিঠি দেব। সেটা তুই মমতাজকে দিতে পারবি?
কেন পারব না।
হান্নান পকেট থেকে চিঠিটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, খুব সাবধান, একথা তুই আর আমি ছাড়া কেউ যেন না জানে। মমতাজকে বলবি, আমার চিঠি পড়ে খুশি অখুশি যাই হোক না কেন, কাউকে যেন না বলে। আর বলবি, তার মতামত জানিয়ে উত্তর দিতে?
ঠিক আছে, তাই বলব।
ঐ দিন বিকেলে হান্নান রোজিনাকে নিয়ে মমতাজদের বাড়িতে গেল।
আজ মমতাজ শিহাবকে নিয়ে মার্কেটিং করতে গিয়েছিল। হান্নান ও রোজিনা ওদের বাড়িতে আসার পরপর মমতাজ ও শিহাব ফিরল। কুশল বিনিময়ের পর মমতাজ রোজিনাকে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় বলল, শিহাব ভাই, আপনি হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করুন, আমি এগুলো ভিতরে রেখে আসছি।
ওরা চলে যাওয়ার পর হান্নান শিহাবকে বলল, শুনেছি আপনি মমতাজের মামাতো ভাই এবং খুব ভালো ছাত্র। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আপনার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়নি।
শিহাব তার সামনের সোফায় বসে মৃদু হেসে বলল, বেশ তো আজ যখন সুযোগ হল তখন আলাপ করা যেতে পারে।
আপনার পরিচয়টা বললে খুশি হব।
নাম শিহাব খন্দকার। বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী গ্রামে। আমরা দু’ভাই বোন। বোনটা ছোট। তার নাম আতিয়া। বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। ফুপা-ফুপু সাহায্য না করলে আমার লেখাপড়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত। এবার আপনারটা বলুন।
আমার নাম হান্নান চৌধুরি। আমি ও আমার বাবা ডাক্তার। বাবা একটা ক্লিনিক খুলেছেন। আমি সেখানেই কাজ করি। রোজিনা আমার একমাত্র বোন। আমাদের আর কোনো ভাই বোন নেই। আপনি তো খুব ভালো ছাত্র। পড়াশোনা শেষ করে কি করবেন ভেবেছেন?
ভেবে আর কি করব, তকদীরে যা আছে তা তো হবেই।
তবু প্রত্যেকের নিজের একটা ইচ্ছা থাকে।
সময় সুযোগ পেলে উচ্চ ডিগ্রী নিতে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। তা যদি না হয়, এখানেই সাবলম্বী হওয়ার চেষ্ঠা করব।
এদিকে এরা যখন আলাপ করছে ওদিকে তখন রোজিনা চিঠিটা মমতাজকে দিয়ে বলল, এটা ভাইয়া তোকে দিয়েছে? পড়ে উত্তর লিখে আমার হাতেও দিতে পারিস, অথবা তুই নিজেও দিতে পারিস। কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে বলবি না।
মমতাজ যেমন খুব অবাক হল, তেমনি রেগেও গেল। বলল, এতে কি লেখা আছে তুই জানিস?
না।
কিন্তু হান্নান ভাই নিজে না দিয়ে তোর হাতে দিল কেন?
তা আমি কি করে বলব? তবে তার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, তোকে তার খুব পছন্দ। তুই কিছু মনে করিস না, আমি তো ভাইয়াকে চিনি, মনে হয় না আজে বাজে কিছু লিখেছে।
মমতাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে বলল, ঠিক আছে পরে পড়ব। এখন চল ওরা বসে আছে।
ফেরার পথে হান্নান রোজিনাকে জিজ্ঞেস করল, কিরে চিঠিটা দিয়েছিস?
হ্যাঁ দিয়েছি।
দেয়ার সময় কিছু বলেনি।
বলল, ‘হান্নান ভাই নিজে না দিয়ে তোর হাতে দিলেন কেন?’ আমার মনে হয় মমতাজ ঠিক কথাই বলেছে। তোমারই দেয়া উচিত ছিল।
প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু ওকে একাকি পাই না। তা ছাড়া দিতে গেলে যদি ডিনাই করে? তাই তোর হাতে দিলাম। চিঠি পড়েনি?
না। রেখে দিয়ে বলল, পরে ‘পড়ব’।
মনের ভাব বুঝতে পারিস নি?
মনে হল আমার হাতে দিয়েছ বলে একটু রেগে গেছে। তুমি যদি বলো, তা হলে তোমার সঙ্গে একাকি দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারি।
তার আর দরকার নেই। চিঠির উত্তর পেলে আমিই সে ব্যবস্থা করব।
শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেছ?
হ্যাঁ করেছি। তোর কথাই ঠিক। ছেলেটা ব্রিলীয়েন্ট।
রোজিনা আর কিছু বলল না।
ওরা চলে যাওয়ার পর মমতাজ নিজের রুমে এসে চিঠিটা পড়তে শুরু করল-
মমতাজ,
তুমি আমার বোনের বান্ধবী। তোমাকে আমি তার মতই দেখতাম। কিন্তু লন্ডন থেকে গতবারে এসে তোমাকে যখন দেখলাম তখন তুমি আমার মনে দাগ কাটলে। সেই থেকে তোমাকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখেছি। যে কয়েক বছর লন্ডনে ছিলাম, তোমার কথা এক সেকেণ্ডের জন্যও ভুলতে পারিনি। এবারে যখন বাবা সেখানকার পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে এলেন তখন তোমাকে ঘন ঘন দেখতে পাব ভেবে খুব খুশি হলাম। তারপর তোমাকে দেখার জন্য রোজিনাকে নিয়ে কয়েকবার তোমাদের বাড়িতে আসি। এতদিন পর যখন তোমাকে দেখি তখন তোমাকে একান্ত করে পাওয়ার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে উঠে এবং মনের কথা জানাবার জন্য অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু সে সুযোগ পাইনি। তাই এই চিঠি লিখি। চিঠিটা নিজেই তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুযোগের অভাবে দিতে পারিনি। তা ছাড়া চিন্তা করলাম, যদি তুমি চিঠিটা না নাও, তা হলে সে লজ্জা ঢাকব কি দিয়ে। তাই রোজিনাকে আমার মনের কথা জানিয়ে তার হাতে দিলাম। তুমি আমাকে কতটা পছন্দ কর জানি না, তবে আমি তোমাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে না পেলে আমি হয় তো চিরকুমার থেকে যাব। তবে একটা কথা জেনে রেখ, তুমি যদি আমাকে পছন্দ না কর, তা হলে আমাকে জানিও। কথা দিচ্ছি আমি আর কখনও তোমাকে বিরক্ত করব না। আর এই ব্যাপারটা চিরকাল গোপন রাখব। বেশি কিছু লিখে তোমাকে বিরক্ত করব না। তোমার মতামত যাই হোক না কেন, অবশ্যই জানাবে।
ইতি-
.
চিঠি পড়ে মমতাজ রাগতে গিয়েও পারল না। বরং মেয়েদের স্বভাব সুলভমতো গর্ব অনুভব করল। ভাবল, সুন্দরী মেয়েদের প্রতি ছেলেদের দুর্বলতা তো থাকবেই। তখন তার জন্মদিন পালনের কথা মনে পড়ল। সে যখন শিহাবকে রাগারাগি করবে বলে তার ঘরে বসে ফেরার অপেক্ষায় বসেছিল তখন শিহাব ফিরে এসে যে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল, সে কথা মনে পড়লেই তনু মনুতে শিহরন বয়ে যায়। শিহাবের সেই দৃষ্টি তাকে পাগল করে দিয়েছে। তাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। তার জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছে। শিহাবকে না পেলে তার জন্মই বৃথা মনে হয়। তাই শিহাবের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কাল তাকে প্রেমের কথা জিজ্ঞেস করেছে। শিহাব নামায পড়তে চলে যাওয়ার পর নিজের রুমে এসে চিন্তা করেছে যেমন করে হোক তাকে মনের কথা জানাতেই হবে। একবার ভাবল, চিঠি লিখে জানালে কেমন হয়? আবার ভাবল, তারচেয়ে সামনা সামনি বলাই ভালো।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় হঠাৎ হান্নানের চিঠির কথা মনে পড়ল। ভাবল, হান্নান ভাইয়ের চিঠির উত্তর দেয়া উচিত, নচেৎ মনে কষ্ট পাবে। কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল।
হান্নান ভাই,
প্রথমে আমার সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, রোজিনা আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী। আপনি তার বড় ভাই। আমার কোনো বড় ভাই নেই। তাই আপনাকে আমি বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করি। আপনি চিঠিতে যা লিখেছেন, সেটা অন্যায় বলে আমি মনে করিনি। কারণ কারো মনের সদিচ্ছাকে মর্যাদা দেয়া প্রত্যেকের উচিত। আপনার মনের ইচ্ছা আপনি জানিয়েছেন, এটা খুব ভালো কথা। নিজের সদিচ্ছা জানাবার অধিকার প্রত্যেকের আছে। থাকাও উচিত। মা-বাবা এই প্রস্তাব পেলে লুফে নেবে। কারণ পাত্র হিসাবে আপনি অত্যন্ত যোগ্য। আপনাদের বাড়ির পরিবেশও উপযুক্ত। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আপনি সব দিক দিয়ে উপযুক্ত হলেও আমি আমার মন থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি না। কেন পাচ্ছি না এখন বলতে অপারগ। আপনি বোধ হয় জানেন, প্রত্যেক ছেলে মেয়ে নিজের মনের মতো জীবনসঙ্গি বা সঙ্গিনী পেতে চায়। আপনার দৃষ্টিতে হয়তো আমি তাই। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে আপনাকে তা ভাবতে পারছি না। কথাটা খুব অপ্রিয় হয়ে গেল। কিন্তু তবু না বলে পারলাম না। এটাও বোধ হয় জানেন, সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রিয় হয়। আর ভালবাসার কথা যে বলেছেন, সেটা মনের ব্যাপার। আপনার ভালবাসার মূল্য দিতে আমি অক্ষম। পরিশেষে জানাই যে, আপনাকে আগে এবং এখন যেমন শ্রদ্ধা করি, ভবিষ্যতেও তেমনি করব। এখন এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। আমার মতামত জেনে আপনি হয়তো দুঃখ পাচ্ছেন, তবু আশা করব, ছোট বোনের বান্ধবী হিসাবে আমাকে ক্ষমার চোখে দেখবেন।
ইতি-
মমতাজ।
.
চিঠি লেখা শেষ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়ে ভাবল, ডাকে পাঠাবার দরকার নেই, রোজিনা এলে তার হাতেই দেবে।
হান্নান চিঠি দেয়ার কয়েকদিন পর একদিন রোজিনাকে বলল, মমতাজ চিঠির উত্তর দিল না কেন বলতে পারিস?
রোজিনা বলল, তা আমি কি করে বলব। তারপর তো ওদের বাড়িতে যাইনি।
আজ বিকেলে ড্রাইভারকে নিয়ে তুই যা। যদি তোর হাতে উত্তর দেয়, তা হলে ভালো, নচেৎ তুই তার মতামত জেনে নিকি।
ঠিক আছে, তাই যাব।
বিকেলে রোজিনা যখন মমতাজদের বাড়িতে এল তখন সে শিহাবের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল।
রোজিনা মমতাজের রুমে গেল।
মমতাজ তাকে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, আমি ও শিহাব ভাই বেড়াতে যাচ্ছি, তুইও আমাদের সঙ্গে চল।
রোজিনা বলল, বেশ তো যাব। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
কর।
ভাইয়ার ছিঠির উত্তর দিলি না যে?
সেজন্যেই কি এসেছিস?
একরকম তাই।
উত্তর লিখে রেখেছি। তারপর ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোর ভাইয়ার চিঠিটা তুই পড়েছিলি?
না। সে তোকে দিয়েছে, আমি পড়ব কেন? তবে ভাইয়া যে তোকে পছন্দ করে, সে কথা তো তোকে সেদিনই বলেছি।
এই চিঠিটা অবশ্য তুই পড়তে পারিস।
তোর চিঠি আমি পড়তে যাব কেন? তবে কি লিখেছিস শুনতে পারি।
আচ্ছা, তুইও কি আমাকে তোর ভাবি হিসাবে পছন্দ করিস?
তা বলব না; তবে ভাবি হলে, আমি খুব খুশি হব।
তুই ননদ হলে আমিও খুব খুশি হতাম; কিন্তু তোর ভাইয়াকে আমিও ভাইয়ার মতো মনে করে শ্রদ্ধা করি। তাকে স্বামী হিসাবে পেতে মনে সাড়া পাচ্ছি না। তুই আমার সব থেকে অন্তরঙ্গ বান্ধবী। তোকে বলতে বাধা নেই, তোর ভাইয়া সবদিক থেকে সুযোগ্য জেনেও তার ডাকে সাড়া দিতে পারছি না। শুনে তুই হয় তো দুঃখ পাবি, তবু বলছি, জীবনসঙ্গি হিসাবে যে রকম ছেলের কথা চিন্তা করেছি, তোর ভাইয়া সে রকম নয়। তোকে যে কথাগুলো বললাম, তোর ভাইয়াকে চিঠিতে সেইগুলোই জানিয়েছি। চিঠি পড়ে সেও হয়তো দুঃখ পাবে।
রোজিনা বলল, পছন্দ অপছন্দ ব্যক্তিগত ব্যাপার। দুঃখ পাব কেন? ভাইয়া তোকে ভালবাসে। সে হয় তো দুঃখ পাবে। অবশ্য পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু বলব, ভালবাসা জোর করে হয় না। তোকে একটা কথা বলি, ভাইয়ার ব্যাপার নিয়ে তুই আমাকে ভুল বুঝবি না।
মমতাজ বলল, কথাটা আমিও তোকে বলতে চেয়েছিলাম। তোর ভাইয়াকে বলিস, সে আমাকে ক্ষমা করে যেন, তোর মতো আমাকে দেখে।
ঠিক আছে বলব। তুই বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছিলি না? তোরা যা, আমি যাব না।
মমতাজ তখন ভদ্রতার খাতিরে রোজিনাকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছিল। আসলে রোজিনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় না। আজ মনের কথা শিহাবকে বলবে বলে তাকে নিয়ে পার্কে যেতে চায়। রোজিনার কথা শুনে বলল, ঠিক আছে, তোর যখন যেতে মন চাচ্ছে না তখন আর কি করা
এমন সময় কাজের মেয়ে জয়তুন এসে মমতাজকে বলল, ছোট আপা, ড্রইংরুমে নাস্তা দেয়া হয়েছে। সেখানে শিহাব ভাই অপেক্ষা করছেন।
মমতাজ রোজিনাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এল।
রোজিনা শিহাবের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে বলল, শিহাব ভাই কেমন আছেন?
শিহাব বলল, ভালো, আপনি কেমন আছেন?
ভালো বলে রোজিনা বলল, শুনলাম বেড়াতে যাচ্ছেন, পড়ার ক্ষতি হবে না?
শিহাব মৃদু হেসে বলল, রাত জেগে পুষিয়ে নেব।
রোজিনাও মৃদু হেসে বলল, ভালো ছাত্ররা অবশ্য তাই করে।
মমতাজ নাস্তা পরিবেশণ করে রোজিনাকে বলল, এখন কথা বন্ধ করে নাস্তা খেয়ে নিই আয়।
নাস্তা খেয়ে রোজিনা চলে যাওয়ার পর মমতাজ শিহাবকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। আজ মমতাজ ড্রাইভারকে না নিয়ে নিজে গাড়ি চালাচ্ছে। শিহাব তার পাশে বসেছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মমতাজ তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, কি ভাবছেন?
শিহাব বলল, তুমি গাড়ি চালাতে পার, তা জানতাম না।
আপনি গাড়ি চালাতে পারেন না?
না।
ইচ্ছা করে না?
করে।
তা হলে শেখেন নি কেন? তারপর মমতাজ হেসে উঠে বলল, আপনি কিন্তু একদিন বলেছিলেন, ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়।
কথাটা অবশ্য ঠিক; তবে মানুষের সব ইচ্ছা কি পুরণ হয়?
তবু চেষ্টা করা উচিত।
শিহাব কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কিছু বলছেন না যে?
সময় সুযোগ হলে নিশ্চয় চেষ্টা করব।
মমতাজ আর কিছু না বলে সাভারে এসে একটা কাঁঠাল বাগানের পাশে গাড়ি থামিয়ে বলল, আজ আমি আপনাকে গাড়ি চালান শেখাব।
হঠাৎ আমাকে গাড়ি চালানো শেখাতে সখ হল কেন?
আচ্ছা, আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুন তো?
তুমি যা, তাই ভাবি।
সেটাই তো জানতে চাই।
কেন? তুমি কি নিজেকে জান না?
জানলেও আপনার মুখে শুনতে চাই।
তুমি আমার ফুপাতো বোন। যে নাকি খুব সুন্দর, স্মার্ট ও বিদূষী।
তা হলে আমি কিছু বললেই তার কারণ জানতে চান কেন?
ওটা আমার একটা বদ অভ্যাস মনে করতে পার।
বদ অভ্যাসটা ছাড়া যায় না?
চেষ্টা করব।
কথাটা মনে রাখলে খুশি হব। তারপর মমতাজ গাড়ি থেকে নেমে বলল, আপনি ড্রাইভিং সিটে বসুন।
শিহাব ড্রাইভিং সিটে বসার পর মমতাজ অন্যপাশের দরজা দিয়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি চালাবার কায়দা কানুন বুঝিয়ে দিল। তারপর তার গা ঘেঁষে বসে স্টার্ট দিয়ে সেও স্টীয়ারিং হুইল ধরে কি করতে হবে বলে দিতে লাগল। গাড়ি কিছুটা যাওয়ার পর গিয়ার চেঞ্জ করা শিখিয়ে দিল। তারপর ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড গিয়ার চেঞ্জের কলা কৌশল দেখিয়ে স্পীড বাড়াবার কথা বুঝিয়ে দিল।
মমতাজ গা ঘেঁষে বসার ফলে এবং গীয়ার চেঞ্জ করে সব কিছু দেখানোর সময় তার শরীরের সঙ্গে শিহাবের শরীরের বারবার ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে। তাতে শিহাব খুব সংকোচ বোধ করে ঘেমে উঠল। একটা যুবতী মেয়ের সঙ্গে এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ। সে কথা চিন্তা করে বলল, তুমি সরে বসে আমাকে বলে দাও, আমি নিজে চালাবার চেষ্ঠা করি
মমতাজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অল্প একটু সরে বসলেও স্টীয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাল না।
এভাবে কিছুক্ষণ শেখাবার পর গাড়ি পার্ক করে বলল, আজ এই পর্যন্ত থাক। এখন চলুন কিছুক্ষণ বসে আলাপ করা যাক। তারপর গাড়ি থেকে নেমে দু’জনে একটা গাছের ছায়ায় বসল।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। মমতাজ মনের কথা জানাবে বলে আজ তাকে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। কথাটা কিভাবে বলবে চিন্তা করতে লাগল।
গাছে গাছে বিভিন্ন সাইজের কাঁঠাল ঝুলছে। শিহাব সেদিকে তাকিয়ে আল্লাহর কুদরত চিন্তা করছিল।
মমতাজ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলুন। শিহাব তার মুখের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। মমতাজের চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু দেখতে পেল, যা দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
বেশ কিছুক্ষণ ঐভাবে তাকিয়ে থেকে মমতাজও তার চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু দেখল, যা দেখে তার সংকোচ কেটে গেল। বলল, শিহাব ভাই, একটা কথা আপনাকে জানাতে চাই।
মমতাজের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে শিহাব দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, বল, কি বলতে চাও।
আমি আপনাকে ভালোবাসি।
শিহাব অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল, মমতাজ একদিন এই কথা বলবে। তবু এখন তার কথা শুনে চমকে উঠল। তার মনে আনন্দের শিহরণ বয়ে যেতে লাগল। চিন্তা করল, আমরা দু’জন দু’জনকে ভালবাসলেও এর পরিণতি কোনো দিন ভালো হবে না। ফুপা-ফুপু জানতে পারলে আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাববেন। না-না, এ আমি কখনও হতে দিতে পারি না। আম্মাও মনে ভীষণ ব্যাথা পাবে। আবার চিন্তা করল, এখনই যদি না সূচক কিছু বলি, তা হলে মমতাজ যা রাগি মেয়ে, তুলকালাম কিছু করে বসবে।
মমতাজ কথাটা বলে এতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তাকে মাথা নিচু করে এতক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কিছু বলবেন না?
শিহাব বলল, মনে হয়, তুমি কথাটা চিন্তা-ভাবনা না করেই বলেছ। আমার কিছু ভালো গুণ তোমাকে হয়তো আকৃষ্ট করেছে। তাই আবেগের বশবর্তি হয়ে বলে… থেমে গেল।
না শিহাব ভাই না, এটা আবেগের কথা নয়, আমি আপনাকে অনেক আগে থেকে ভালবাসি। কিন্তু আমার স্বভাবের কারণে আপনাকে চোটপাট দেখাতাম। আপনি কি আমাকে ভালবাসেন না?
দেখ মমতাজ, ছেলে মেয়েদের এই বয়সটা খুব ডেঞ্জারাস। ভালো হলে খুব ভালো। আর খারাপ হলে খুব খারাপ। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা নিজের মতামতকে সবার থেকে ভালো মনে করে। কিন্তু এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমঙ্গল ডেকে আনে। চার-পাঁচ বছর পর তখন আর এরকম মনোভাব থাকে না। তখন তাদের জ্ঞান আরো পাকা হয় এবং ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতাও বাড়ে। তখন আগের মতামতের জন্য তাদের অনুশোচনা জাগে।
আপনি খুব বিজ্ঞ লোকের মতো কথা বলেছেন। কিন্তু আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন না। আমি আপনার সব কথা স্বীকার করছি। এখন আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।
দেব, তার আগে বল, ভালবাসারও যে প্রকার ভেদ আছে, তা জান কি না?
জানব না কেন? মা-বাবা ছেলে মেয়েকে ভালবাসে, ভাইবোনের মধ্যেও ভালবাসা থাকে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ভালবাসা থাকে। আবার দু’টো ছেলে মেয়ের মধ্যেও ভালবাসা থাকে। আমি কিন্তু শেষের ভালবাসার কথা জিজ্ঞেস করেছি।
তুমি খুব কঠিন প্রশ্ন করেছ, উত্তর দিতে সময় লাগবে।
কেন?
কোনো কিছু বলার বা করার আগে চিন্তা করা উচিত। এটা হাদিসের কথা।
তা আমিও জানি এবং ভেবে চিন্তেই কথাটা বলেছি।
যদি বলি তোমার চিন্তাটা ভুল।
তা আপনি বলতে পারেন; কিন্তু আমি জানি আমারটা ভুল নয়।
তুমি বললে তো হবে না, মানুষ নিজের ভুল নিজে ধরতে পারে না। বড়রা সেই ভুল ধরতে পারে। তবে তোমার আমার মধ্যে যে ভালবাসা জন্মেছে, তা যদি মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারি, তা হলে কোনো দোষের কথা নয়। কারণ এরকম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কাজে পরিণত করতে চাই, তা হলে দু’জনেরই অন্যায় হবে।
মমতাজ একটু রেগে গিয়ে বলল, ঐ রকম ভালবাসার মূল্য কি?
মূল্য নিশ্চয় আছে। একে অপরের মঙ্গল কামনা করা প্রকৃত ভালবাসার মূল। স্বার্থের জন্য যারা ভালবাসে, তারা সত্যিকার ভালবাসতে জানে না। এরকম ভালবাসা পাপ। আর এ রকম ভালবাসা মিলনের পর বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তখন অনুশোচনার আগুনে জ্বলতে হয়।
আমি কিন্তু আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসেছি। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
তা হলে আমি যা বলব, তা শুনবে?
নিশ্চয়, বলে দেখুন। তবে তার আগে আপনাকে বলতে হবে, আমাকে ভালবাসেন কি না? বাসলে কতটা বাসেন?
যদি বলি তুমি আমাকে যতটা না ভালবাস, তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি ভালবাসি? মমতাজ চমকে উঠে আনন্দে বিভোর হয়ে শিহাবের ডান হাত ধরে চুমো খেয়ে হাতটা ধরে রেখে বলল, এবার আপনি যা বলবেন, ইনশাআল্লাহ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
শিহাব হাতটা টেনে নিয়ে বলল, এখন যা করলে তা যে অন্যায়, সেটা নিশ্চয় জান?
হ্যাঁ জানি।
তবু কেন করলে?
ভুল হয়ে গেছে, আর করব না।
কথাটা মনে রেখে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিও। আর শোন, আমাদের ভালবাসার কথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না। নিষ্পাপ ভালবাসার পথ বড় বন্ধুর। সেই পথ অতিক্রম করে গন্তব্যস্থানে পৌঁছান খুব কঠিন। এত কঠিন যে, অনেকে পথের কাঠিন্যতা দেখে ফিরে এসেছে। আজকাল যেসব ছেলেমেয়ে প্রেমে পড়ে অবাধ মেলামেশা করে, আমি তাদের দলে নই। আমাকে সে রকম ভাবলে ভুল করবে। আমি তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি; কিন্তু ইসলামের আইন লঙ্ঘন করতে পারি না। প্রত্যেক মুসলমানদের কাছে প্রথমে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) এর আইন, তারপর সবকিছু। তুমি তো ধর্মীয় বই অনেক পড়েছ, আমার কথাগুলো তাঁদের, না আমার নিজের, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
পারছি।
আর একটা কথা, আমি স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
করব।
আলহামদুল্লিাহ বলে শিহাব মৃদু হেসে বলল, প্রথম পরীক্ষায় তুমি উৰ্ত্তীৰ্ণ হয়েছ। দোয়া করি, আল্লাহ যেন পরবর্তী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তওফিক তোমাকে দেন।
মমতাজ বলল, আমিন।
শিহাব বলল, চল তা হলে এবার ফেরা যাক।
আর একটু বসুন। আচ্ছা, আপনি কি ভার্সিটিতে পার্টি করেন?
না। ছাত্র জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের পার্টি করা আমার প্রিন্সীপলের বাইরে।
তা হলে পলিটিক্যাল সাইন্সে পড়ছেন কেন?
পলিটিক্যাল সাইন্সে পড়লেই পার্টি করতে হবে, এই ধারণা ঠিক না।
তা হলে লেখাপড়া শেষ করে কি রাজনীতিতে নামবেন?
নামার তেমন ইচ্ছে নেই, তবে প্রয়োজন হলে নিশ্চয় নামবো।
কিন্তু আমি তো জানি, যারা ধার্মিক তারা রাজনীতি করেন না। তা ছাড়া রাজনৈতিক নেতারা বলেন, ধর্ম আর রাজনীতি আলাদা জিনিস।
তোমার জানাটা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোটা ঠিক নয়। ধার্মীক লোকেরা আল্লাহকে অত্যন্ত ভয় করেন। রাজনীতি করতে গেলে যদি ধর্মীয় আইনমতো তা করতে না পারেন, তা হলে গোনাহগার হয়ে যাবেন ভেবে তারা ঐ পথে পা বাড়ান না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ধার্মিক লোকদের রাজনীতি করা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ ধার্মিক লোকরা রাজনীতি না করার ফলে অধার্মিক ও অসৎ চরিত্রের লোকেরা রাজনীতিতে ঢুকে দেশের ও দশের ভীষণ ক্ষতি করছে। সমাজের চরিত্র বলতে কিছু নেই। দেশ ও দশের উন্নতির দিকে লক্ষ্য না করে নিজেদের আখের গুছাবার তালে রয়েছে। আর তুমি যে নেতাদের কথা বললে, তা আদৌও ঠিক নয়। কারণ কুরআনের মধ্যে দেশ শাসন করার সমস্ত আইন কানুন রয়েছে। সেই মতো শাসন চালু করলে দেশে কখনও অরাজকতা আসবে না। দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে। যে সব নেতারা এইকথা বলছেন, তারা আল্লাহর শাসন ব্যবস্থা পছন্দ করেন না। আল্লাহর শাসন মেনে চললে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি হবে না। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলতে পারবেন না। পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ বন্ধ হয়ে যাবে। গরিবদের শোষণ করতে পারবেন না। তাই তারা জেনে অথবা না জেনে এই কথা বলেন। চল এবার ফেরা যাক।
মমতাজ বলল, হ্যাঁ চলুন।
ফেরার পথে মমতাজ বলল, আমার কাছে গাড়ি চালান শিখবেন তো?
শিখবো, এবার থেকে আমাকে তুমি বলবে।
মমতাজ গাড়ি চালাতে চালাতে একবার তার দিকে তাকিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চুপ করে রইল।
কি বলবে না?
বলব? কিন্তু সবার সামনে বলতে পারব না।
সেটা তোমার খুশি।
এরপর তারা মাঝে মাঝে বেড়াতে যায়। শিহাব মমতাজের কাছে ড্রাইভিং শিখেছে। দিনের পর দিন তাদের ভালবাসা গাঢ় থেকে গাঢ় হয়েছে।
এভাবে আরো চার বছর পার হয়ে গেছে। শিহাব মাস্টার ডিগ্রীতে ফাৰ্ষ্টক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করে ফুপা-ফুপুর অনুরোধে তাদের বীজনেস দেখাশোনা করছে। এর মধ্যে আতিয়া এইচ.এস.সি. পাশ করার পর তার বিয়ে নিজেদের গ্রামের একটা ভালো ছেলের সঙ্গে দিয়েছে।