শেষ অশুভ সংকেত – ৮

আট

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। একঘন্টা যাবত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ব্রাদার বেনিটো। সুট পরে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছে সে। এসব কাপড়ে একে অভ্যাস নেই, তার ওপর প্যান্টটা কোমরের কাছে খুব আঁটা হয়েছে। কেন যে মানুষ এই কাপড়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে—এর চেয়ে তার আলখাল্লা অনেক আরামের। শেপহার্ডস্ বুশ-এর একটা মদের দোকান। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে তারই দরজায় দাঁড়িয়ে রাস্তার লোক গুনছে বেনিটো। ছুরিটা তার উরুর সাথে বাঁধা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাঁটের ওপর হাত বোলাচ্ছে বারবার।

ট্যুরিস্ট বাসটা স্টুডিওর গেটে এসে থামল। যাত্রীরা একে একে নেমে লাইন করে দাঁড়াচ্ছে। চুপিসারে টুপ করে রাস্তায় নেমে সবার শেষে লাইন ধরল বেনিটো গেটের গার্ড দু’জনকে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকে পড়ল। এবার ট্যুরিস্ট দলটা থেকে আলাদা হয়ে সুযোগ বুঝে একটা টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ভাগ্যের ফেরে যেন ধরা না পড়ে এজন্যে প্রার্থনা করল সে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সাহস ফিরে পেয়ে আবার বেরিয়ে এল বেনিটো। পনেরো মিনিট ঘোরাফেরা করে নোটিস বোর্ডের সামনে পৌঁছে জানল তাকে কোথায় যেতে হবে। চার নাম্বার স্টুডিওতে পৌঁছতে আরও দশ মিনিট লাগল। পিছন ফিরে কাউকে না দেখে দরজার হাতল ঘুরাল। খুলে গেল দরজা। চট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। প্রায় অন্ধকার ঘরটাতে কেউ নেই। দালানের খুঁটি আর যন্ত্রপাতির আড়ালে লুকাবার প্রচুর জায়গা রয়েছে। প্রকাণ্ড কামরার শেষ মাথায় পৌছে দ্বিতীয় পিলারের আড়ালে লুকাল বেনিটো। এবার প্রোগ্রাম শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা।

.

চল্লিশ মিনিট পরে পৌছল ডেমিয়েন। প্রযোজক আর কেট-এর সাথে একটু আলাপ করে মেকআপ রূমে ঢুকল সে। ওর দু’পাশে দু’জন সিকিউরিটি গার্ড। পিছনে হারভি ডীন।

মেকআপ মহিলা ডেমিয়েনের মুখে পাউডারের প্রলেপ লাগাতে ব্যস্ত হল। আয়নায় টেলিভিশন মনিটরটা দেখা যাচ্ছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইন ফোকাস’ প্রোগ্রাম শুরু হল। ফুলে ওঠা নদীর পাড়ে অসংখ্য শরণার্থীর ভিড়। দৃশ্য বদলে এবার আসওয়ান বাঁধের ফাটল দুটো স্ক্রীনে ভেসে উঠল। ফাটল দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। ডেমিয়েনের ঠোঁটে যে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তা কেউ খেয়াল করল না।

কেট রেনল্ডসের গলা শোনা গেল… ‘ইসরাইলী সরকার বারবার তাদের বিরুদ্ধে এই বিপর্যয় ঘটানোর অভিযোগ অস্বীকার করছে। এ পর্যন্ত এতে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মিশরীয় প্রাণ হারিয়েছে বলে জানা গেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা এর দ্বিগুণে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

‘ইতিমধ্যেই উদ্বাস্তুদের মধ্যে টাইফয়েড-এর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে নীল নদের পাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। একটা ব্যাপক মহামারি আসন্ন…’

আড়চোখে দরজার পাশে দাঁড়ানো গার্ড দুটোর দিকে চাইল ডেমিয়েন। টেলিফোন স্ক্রীনের দিকে চেয়ে আছে ওরা।

‘ক্যামবোডিয়ার মত এখানেও,’ বলে চলল কেট, ‘সরকারি পক্ষ কিংবা কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি—এসেছে আমেরিকান থর্ন কর্পোরেশন।

মেকআপ মহিলা একটু পিছনে সরে ডেমিয়েনকে খুঁটিয়ে দেখল। নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ব্রাশ তুলে নিল।

টেলিভিশনে থর্নের ইউনিটগুলোকে ব্যস্তভাবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। জাহাজ থেকে সোয়া নামাচ্ছে; খাবার, ওষুধ ইত্যাদি বিলি করছে।

‘এই সপ্তাহের মধ্যেই তারা আশি লক্ষ টন সোয়ার তৈরি খাবার বিলি করে ফেলবে।‘

ব্রাশ হাতে মহিলা চুল আঁচড়ে দেয়ার জন্যে ঝুঁকতেই মাথা সরিয়ে নিল ডেমিয়েন

‘থাক,’ বলল সে। ‘ওটা আমি নিজেই ঠিক করে নিচ্ছি।’

ব্রাশটা বাড়িয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা।

এই পেশায় অনেক ধরনের মানুষ দেখার সুযোগ তার হয়েছে, তাই অবাক হল না সে। ডেমিয়েনের চুলের আড়ালে লুকানো চিহ্ন দেখে ফেলেছিল বলেই রবার্ট থর্ন মারা পড়েছিল-কিন্তু এসব ওর জানার কথা নয়।

চুল ঠিক করে নিয়ে আবার টেলিভিশন দেখায় মন দিল ডেমিয়েন।

‘সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা ‘টাস’ এর সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই থর্ন কর্পোরেশনের নিন্দা করে বলেন যে ওরা মানুষের দুরবস্থা আর দুর্গতির সুযোগ নিয়ে মুনাফা লুটছে—কিন্তু আমরা মিশরীয় সরকারি সূত্রে জেনেছি বর্তমান বাজার দরের অর্ধেক দামে মিশরকে এই সোয়া সরবরাহ করছে থর্ন।

দরজায় একজন তরুণকে দেখা গেল। ডেমিয়েন তৈরি কিনা জিজ্ঞেস করল সে। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো ডেমিয়েন। হেসে মেকআপ মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেল। গার্ড দু’জন ওর দু’পাশে হাঁটছে।

খোলা দরজা দিয়ে করিডোরে কেট-এর গলা শোনা যাচ্ছে।

‘থর্ন কর্পোরেশনের এই পৃথিবীজোড়া সেবার মূলে যে মানুষটি আছেন তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন….

মৃদু হেসে দরজা খুলে অন্ধকার স্টুডিওতে প্রবেশ করল ডেমিয়েন। দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে কেট। আলোয় প্লাবিত তার দেহ। ওর মুখে ফোকাস করা রয়েছে তিনটে ক্যামেরা। হাসি মুখে ফ্লোর ম্যানেজার এগিয়ে এল— ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে ইশারায় বোঝাল এখানে কথা বলা যাবে না। সেট থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। অন্ধকারে ডীনকে দেখতে পেল ডেমিয়েন। ছোটখাট মানুষটা এগিয়ে এসে নিজের ঘড়ির ওপর টোকা দিল।

‘এখানে আধঘন্টা,’ নিচু স্বরে বলল সে। ‘তারপর পেরিফোর্ডে ফিরতে হবে। বুহের ফোনে ওখানে যোগাযোগ করবে। এরপর আছে ইসরাইলী কাগজপত্রের ব্যাপার।’

হলঘরটার অন্য প্রান্ত থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে বেনিটো। ডান হাত দিয়ে ছুরির বাঁটটা শক্ত করে ধরেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। বগল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে নিচে নামল।

‘গত সপ্তাহে,’ বলে চলল কেট, ‘মিস্টার থর্ন আমেরিকার অ্যামবাসেডর হয়ে বৃটেনে এসে পৌঁছেছেন। আমাদের সেইন্ট জেম্‌স্‌ কোর্টে তাঁর মত কম বয়সী অ্যামবাসেডর আর এর আগে আসেননি। একটু পরেই আমরা তাঁকে আপনাদের সামনে হাজির করব।’

লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে আবার পিছাল বেনিটো। ফ্লোর ম্যানেজার ডেমিয়েনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে কেট-এর উল্টো দিকে অতিথির সামনে বসাল।

‘কিন্তু তার আগে প্রয়াত জন এফ কেনেডির সাথে কেন তাঁর তুলনা করা হয় তা একটু খতিয়ে দেখা যাক…’

ডেমিয়েনের চেয়ার থেকে নিজের দূরত্বটা মনে মনে আঁচ করার চেষ্টা করল বেনিটো। বড় জোর দশ-বারো পা হবে। চোখ বুজে অল্প কথায় প্রার্থনা করে তৈরি হল সে।

‘কি চাই আপনার?’ কানের কাছে গলার স্বর শুনে চমকে উঠল বেনিটো। ঘুরে দেখল ক্লিপবোর্ড হাতে একটা লোক অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে।

‘অ্যা?’ ধরা পড়ে গিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল বেনিটো

‘এই প্রোগ্রামে তো আপনার কোন কাজ নেই—আছে?’ লোকটার জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিতে প্রশ্নের চেয়ে চ্যালেঞ্জের সুরটাই বেশি

‘আমি আট নাম্বার স্টেজ খুঁজছি,’ তাড়াতাড়ি জবাব দিল বেনিটো।

‘এটা চার নাম্বার,’ বিরক্ত স্বরে বলল লোকটা, ‘আট নাম্বার করিডোরের ওপাশে।’

কোনমতে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে অন্ধকারে সরে পড়ল বেনিটো। কেট-এর গলা শোনা যাচ্ছেঃ

‘ইয়েইল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে রোডস (Rhodes) স্কলার হিসেবে ডেমিয়েন থর্ন অক্সফোর্ডে পড়তে আসেন। সেই বছরই অক্সফোর্ডের ক্যাপ্টেন হয়ে বিখ্যাত বোট রেস আর পোলোতে ওয়েস্টচেস্টার কাপ জিতে ‘বেস্ট স্পোর্টসম্যান’ খেতাব অর্জন করেন।’

দরজার কাছে গিয়ে ফিরে চাইল বেনিটো। ক্লিপবোর্ড হাতে লোকটা এখনও ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে। কি করবে বুঝে না পেয়ে দরজা থেকে সরে যন্ত্রপাতির একটা স্তূপের আড়ালে লুকালো। কপালে হাত রেখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে লোকটা পাশের সঙ্গীকে কি যেন বলল, ‘তারপর দুজনে একসাথে দরজার দিকে রওনা হল।

আতঙ্কিত হয়ে অন্ধের মত ডানদিকে সরতে শুরু করল বেনিটো। দ্রুত ভাবছে কোথায় লুকাবে। ধরা পড়লেই বা কি বলবে? কাঁধে শক্ত কিসের সাথে যেন ধাক্কা লাগল। চেয়ে দেখল আলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য লোহার চেন দিয়ে তৈরি একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপর দিকে। ওটারই শেষ ধাপের সাথে ধাক্কা লেগেছে। চিন্তা না করেই দুহাতে বেয়ে উঠতে শুরু করল সে। বাদুড়ের মত ঝুলতে ঝুলতেই দেখল মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে লোক দুটো ওকে খুঁজছে।

‘১৯৭৮ সালে,’ বলে চলেছে কেট, ‘ডেমিয়েন থর্ন তাঁর চাচার ব্যবসার হাল ধরেন। মাত্র সাত বছরের মধ্যেই থর্ন ইণ্ডাস্ট্রি ফুলে ফেঁপে এখন পৃথিবীর বৃহত্তম আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে। নিউক্লিয়ার অস্ত্র থেকে শুরু করে সোয়াবীনের বিভিন্ন রকম খাবার—সবই তৈরি করে ওরা…’

লোক দুটো এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে কাউকে না দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সেটের দিকে ফিরে গেল। হাত টনটন করছে, তবু একটু একটু করে উপরে স্টীল প্লেটের ল্যাণ্ডিঙে নিজেকে টেনে তুলল বেনিটো। একটু বিশ্রাম নিয়ে নিঃশব্দে বুকে হেঁটে আবার সামনে এগোল সে।

‘এখন মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে ডেমিয়েন থর্ন রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশে করেছেন। শুধু আমেরিকার অ্যামব্যাসেডরই নন, তিনি ইউনাইটেড ইয়ুথ কাউন্সিলেরও প্রেসিডেন্ট…’

প্রতিবাদে মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট আপত্তিকর শব্দ করল বেনিটো। ওর কাছে এটাই গাল দেয়ার বিকল্প।

‘দুবছর পরেই মিস্টার থর্ন ইউ এস সিনেটর পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস থর্নই আগামীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।’

সোজা বিশ ফুট নিচে কেটকে দেখতে পাচ্ছে বেনিটো। কোন ভাবে ডেমিয়েনের মাথার ওপর নিজেকে নেয়া যায় কিনা বিচার করে দেখছে সে।

‘এত কম বয়সে এটা একটা বিরাট কৃতিত্ব,’ বলল কেট।

ডেমিয়েনের মন্তব্যের জন্যে ক্যামেরা ওর দিকে ঘুরল।

‘একটু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে,’ সৌজন্যের সাথে আপত্তি জানাল ডেমিয়েন আলেকজাণ্ডার ষোলো বছর বয়সে মেসিডোনিয়ার সৈন্য দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন।’

উত্তেজিত হয়ে নড়ে উঠল বেনিটো! ওর হাত লেগে একটা বাড়তি বল্টু গড়িয়ে নিচে পড়ল। একজন টেকনিশিয়ানের পায়ের কাছে পড়ল ওটা। দুজন লোক চেয়ে আছে উপর দিকে। উজ্জ্বল আলোয় বারবার চোখ মিটমিট করছে। না পেরে শেষে চোখ নামিয়ে নিল ওরা। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগে বাড়া শুরু করল বেনিটো।

‘অনেকেই আপনাকে বিংশ শতাব্দীর আলেকজণ্ডার হিসাবে দেখে,’ বলে চলেছে কেট। ‘তাদের মতে আপনার নেতৃত্বে পৃথিবী বর্তমানের পিছিয়ে পড়া অবস্থা কাটিয়ে সমৃদ্ধশালী সোনার যুগে প্রবেশ করবে।

হাসল ডেমিয়েন। আমার কমার্শিয়াল অ্যাডভারটাইজমেন্ট দেখে ওরা হয়ত প্রভাবিত হয়েছে।

‘কিন্তু সবকিছুতে ওই ভাবটাই যেন ফুটে ওঠে,’ জোর দিয়ে বলল কেট।

‘ওটা কর্পোরেশন হিসেবে থর্নের ইমেজ। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব আশাবাদী, আর সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে থর্ন কর্পোরেশনের একটা বিরাট ভূমিকা থাকুক—এটাই আমি চাই।’

থেমে আর একবার নিচের দিকে চাইল বেনিটো। ডেমিয়েনের মাথার ওপর পৌঁছে গেছে সে। ঠিক এই সময়ে মুভেবল প্ল্যাটফর্মটা ওকে সহ সেটের অন্যপাশে সরে গেল। এত কাছে এসেও ব্যর্থ হল। লাফিয়ে পড়লে নির্ঘাৎ ঘাড় মটকাবে নৈরাশ্যের জ্বালা চেপে অন্য উপায় ভেবে বের করতে চেষ্টা করছে। তবে কি শো শেষ হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে? গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে কি করিডোরে ডেমিয়েনের কাছে পৌঁছতে পারবে?-সম্ভাবনা খুব কম।

বেনিটোর নিচে, মেঝে থেকে প্রায় দশ-বার ফুট উঁচুতে সার বেঁধে বাতির গুচ্ছগুলো দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা বাতি নিয়ে ঝুলছে এক একটা বোট। দেখতে অনেকটা জাহাজের লাইফ বোটের মতই।

ঠোঁট দুটো পরস্পরের ওপর চেপে ধরে মুঠো পাকালো বেনিটো। উত্তেজনায় বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছে; চেনগুলো তার ওজন রাখতে পারলেই রক্ষা। হাত বাড়িয়ে সবচেয়ে কাছের চেনটা ধরল সে। সোজা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে ওটা। প্রভুর নাম নিয়ে এক পায়ে চেন জড়িয়ে দুহাতে শক্ত করে ধরে ঝুলে পড়ল বেনিটো। তারপর নিঃশব্দে বোটের ওপর নেমে উবু হয়ে বসল। ঊরুতে বাঁধা ছুরিটা বের করে তৈরি হল। পরের বোটটা মাত্র কয়েক ফুট দূরে। সহজেই দোল খেয়ে ওটায় যাওয়া যাবে—কেউ তাকে দেখে না ফেললেই হয়।

‘মিস্টার অ্যামব্যাসেডর, তরুণদের ব্যাপারে সবসময়েই আপনার অসীম আগ্রহ,’ প্রসঙ্গ পাল্টাল কেট, ‘ইয়ুথ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার পরিকল্পনা কি?’

‘অনেক,’ বলল ডেমিয়েন। ‘কিন্তু আমার বিশ্বাস তরুণরা এগিয়ে এসে যাতে পৃথিবীর আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার নিতে পারে এটা নিশ্চিত করাই হবে আমার প্রথম কাজ। বর্তমানে তাদের আমরা কোন সুযোগই দিচ্ছি না।’ মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল কেট, কিন্তু ডেমিয়েনকে এখন থামানো মুশকিল। ‘আমরা ওদের চেয়ে বেশি বুঝিঃ এমন মনে করা কি আমাদের উচিত?’

মাথা নাড়ল কেট, কিন্তু ওর জবাবের অপেক্ষা করল না ডেমিয়েন।

‘আমরা বলি ওদের বুদ্ধি পাকেনি,’ বলে চলল সে। ‘বলি, ‘আগে বড় হও তারপর তোমাদের কথা শুনব।’ কিন্তু আসলে আমরা বলতে চাই, ‘বুড়ো হও, তখন তোমরা আমাদের মতই ভাবতে শুরু করবে।’ বাধ্য হয়ে ওরা সরে দাঁড়ায়— আমরাও কোমর বেঁধে লেগে যাই ওদের গড়ে-পিটে বুড়ো বানিয়ে দলে টানার কাজে।

সেটের প্রত্যেকটা লোক অভিভূত হয়ে ডেমিয়েনের কথা শুনছে। ইন্টারভিউ দিতে এসে কেউ সাধারণত এতটা আবেগ দিয়ে কথা বলে না। সম্মোহিত হয়ে শুনছে সবাই-ওদের মাথার ওপর বেনিটোর নড়াচড়া কিছুই টের পেল না কেউ। একটা একটা করে লাইটং বোট টপকে ডেমিয়েনের ঠিক মাথার ওপর পৌঁছে গেল সে। সাবধানে ছুরিটার বাঁটে ভক্তিভরে চুমো খেয়ে শেষবারের মত চোখ বুজে প্রার্থনা করল। তারপর সাহস জড়ো করার জন্যে লম্বা একটা শ্বাস নিল

‘ওদের পরতে পরতে ঢুকিয়ে দিই আমাদের পুরানো চিন্তাধারা, বলে চলল ডেমিয়েন। আমাদের সীমিত ভোঁতা জ্ঞান দিয়ে শিক্ষিত করার চেষ্টায় ওদের চোখা তাজা মগজের ধার পুরোপুরি ছেঁটে ফেলে ওদের বানাই আদর্শ নাগরিক। অর্থাৎ, ‘ সরাসরি ক্যামেরার লেন্সের দিকে চেয়ে বলল ডেমিয়েন, ‘বাহুত্তুরে ধরা তরুণ—বুড়োর সৃষ্টি করে গোটা পৃথিবীর প্রগতি ঠেকিয়ে আমরা নিরাপদে থাকতে চাই।’

একটু কুঁজো হয়ে স্থির দৃষ্টিতে ডেমিয়েনের মাথার দিকে চেয়ে বসে আছে বেনিটো। উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে হেলে টাল সামলে লাফ দেয়ার জন্যে তৈরি হল সে। বোটটা দুলে উঠে ঝাঁকি খেয়ে একপাশে সরে গেল। বেশি টান লেগে একটা চেন ছিঁড়ে বোটটা একদিকে ঝুলে পড়ল। দ্বিতীয় একটা চেন ছিঁড়ল এবার। হাঁটু গেড়ে পড়ে পিছলে বোটের অন্যধারে গিয়ে পৌঁছল বেনিটো। মরিয়া হয়ে কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় ওর হাত লেগে কয়েকটা ক্ল্যাম্প খুলে গেল।

উপর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডেমিয়েনকে সাবধান করল কেট। কিন্তু ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডেমিয়েন। বাতির ঝাড়টা অল্পের জন্যে মিস করে ওর পাশ ঘেঁষে মাটিতে পড়ল। দুটো ছুটে যাওয়া আর্ক ল্যাম্প মেঝেতে বোমার মত শব্দ করে ফাটল। সেটের পিছন দিককার ভারি নাইলনের পর্দাগুলো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল—যেন পেট্রলে ভিজানো ছিল।

নিচে পড়ার পথে ইলেকট্রিক তার জড়িয়ে আকাশের দিকে পা দিয়ে শূন্যে ঝুলছে বেনিটো। সেটময় পেণ্ডুলামের মত দোল খাচ্ছে ওর দেহ।

চিৎকার করে উঠল বেনিটো। ভয়ে নয়, বিফল হয়ে রাগে গজরাচ্ছে। পাতলা কার্ডবোর্ডের পার্টিশন ভেঙে দোল খেয়ে ঝুলতে ঝুলতে সেটের অন্ধকার অংশে মিলিয়ে গেল সে। ক্ষোভে, লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। পুলিশ, হাজতে নিয়ে আটকাবে তাকে। ফাদার ডি কর্লোর সামনে আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ঝুল খেয়ে ফিরে সে পর্দার সাথে বাড়ি খেল এবার। জ্বলন্ত শিখায় তার চামড়া ঝলসে গেল, তবু আতঙ্কিত হল না—তার অনুভূতি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।

চুলেই প্রথম আগুন ধরল। এক গোছা শুকনো খড়ে আগুন লাগার মত নিমেষে পুড়ে গেল চুল। ভুরু আর চোখের পাঁপড়ি অদৃশ্য হয়ে মুখটা কালচে হয়ে গেল।

গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না—চেষ্টা করেও চ্যাঁচাতে পারছে না সে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে—দম আটকে আসছে, কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। পর্দায় পেঁচিয়ে গেছে বেনিটো। বাতাস ঢুকতে পারছে না, ভিতরে রোস্ট হচ্ছে ওর দেহ।

ডেমিয়েনের চোখের সামনে টেকনিশিয়ানরা দিশেহারা হয়ে ছুটাছুটি করছে। ওদের একজন ফায়ার ফাইটিং সিলিণ্ডার থেকে স্প্রে করে আগুন নেভানর চেষ্টা করছে। মেঝেতে একটা চকচকে কিছু পড়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে জিনিসটা তুলে নিয়ে আবার দরজার কাছে ফিরে এল ডেমিয়েন।

পিছন ফিরে চেয়ে দেখল পর্দাগুলো এখনও জ্বলছে। কিছুটা জায়গা জ্বলে যাওয়ায় লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে। পুড়ে কাঠ কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে—অমানুষিক দেখাচ্ছে। পা দুটো থেকে থেকে ঝাড়া দিয়ে উঠছে দেখে ডেমিয়েন একটা বিকৃত আনন্দ অনুভব করছে। হাত ধরে ওকে ওখান থেকে বের করে আনল ডীন।

পেরিফোর্ডের বাসায় ফেরার পথে ডেমিয়েনের বিরাট লিমোসিনে বসে দুজনের কেউ একটা কথাও বলেনি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উদাস ভাবে চেয়ে আছে ডেমিয়েন। ডীন শূন্য দৃষ্টিতে তার কোলের ওপর রাখা খবরের কাগজটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। প্রাসাদে ডেমিয়েনের স্টাডিতে পৌঁছে জিনের বোতল বের করে প্রথম মুখ খুলল ডীন।

‘একটা ড্রিঙ্ক না হলে আর আমার চলছে না,’ বলল সে। ‘বারবার কেবল ওই বীভৎস চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।’ গ্লাসে খানিকটা জিন ঢেলে নিয়ে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাকে দেব?’

মাথা নাড়ল ডেমিয়েন। কোট খুলে চেয়ারের ওপর রেখে ছুরিটা আলোর সামনে তুলে ধরল।

‘গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছিল লোকটা,’ শান্ত স্বরে বলল ডেমিয়েন।

বিস্ফারিত চোখে ডেমিয়েনের দিকে ঘুরে তাকাল ডীন।

‘বসো।’

স্থির হয়ে বসার পর ডেমিয়েন তাকে আশ্চর্য এক ইতিহাস শোনাল। নিয়শো বছর আগে বুগেনহাগেন নামে এক লোক শয়তানের সন্তানকে ধ্বংস করেছিল। শুরু থেকেই ওই পরিবারের লোকগুলো শয়তানের বিরুদ্ধে লড়ছে। ১৭১০ সালে ওরাই আবার ইবলিসের আর এক চেষ্টা বানচাল করে দেয়। ওই বুগেনহাগেনরাই হচ্ছে যীশুর অনুগত প্রহরী…

বোতলের জন্যে হাত বাড়াল ডীন।

‘মেগ্‌গাইডোর নাম শুনেছ?’ প্রশ্ন করল ডেমিয়েন।

মাথা নাড়ল ডীন।

‘জেরুযালেমের কাছে মাটির তলার শহর মেগ্‌গাইডো। আগে এরই নাম ছিল আরমাগেড্ডন। বিশ বছর আগেও বুগেনহাগেন ওখানে থাকত। এই ছুরিগুলো তারই আবিষ্কার। সে-ই এইরকম সাতটা ছুরি আমার বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল রবার্ট থর্ন। সাড়ে চার বছর বয়সে প্রথম আমি এগুলো দেখি বাবার হাতে। এই ভাবে উঁচিয়ে ধরেছিল আমার বুকের ওপর—আমার প্রকৃত বাবা সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিল।’

ছুরি উঁচিয়ে আঘাত হানার ভঙ্গিতে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছুরি নামিয়ে নিল ডেমিয়েন। তারপর গা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।

গ্লাস থেকে বড় এক ঢোক জিন গিলে শ্বাস ছাড়ল ডীন

‘সাতটা ছুরির কথা বললেন না?’ তাহলে আর ছয়টা কোথায়?’

‘সেটা আমাদের খোঁজ করে বের করতে হবে,’ বলল সে। ‘নিশ্চয়ই শিকাগোর জাদুঘর খুঁড়ে এগুলো উদ্ধার করেছে কেউ।’

বুঝতে না পেরে মুখ তুলে চাইল ডীন। ‘আগুন লেগেছিল,’ বলল ডেমিয়েন, ‘কিছুই বাঁচানো যায়নি—আমার চাচা-চাচীকেও না।’

‘আপনার চাচা মারা পড়েছিলেন?’

বয়লার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, বেজমেন্টে চাপা পড়ে মরেছে। ওরা যে ওখানে গেছে তা কেউ জানতো না।

‘তাহলে আপনি…?’ ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করে মাঝ পথেই থেমে গেল ডীন। কী বোকা সে–ডেমিয়েন না জানলে জানবে কে? কিছুই অজানা থাকে না ওর।

‘বোঝা যাচ্ছে ওই ছুরিগুলোই কেবল রক্ষা পেয়েছে,’ বলে চলল ডেমিয়েন। ‘আর সেগুলো এমন কারও হাতে পড়েছে যে আমার পরিচয় জানে।’

‘এটা জানলে ভবিষ্যদ্বাণীর কথাও নিশ্চয়ই সে জানে,’ বলে উঠল ডীন 1

‘হ্যাঁ, নাজারতবাসীর (নাজারত শহরে জন্ম বলে যীশু ওই নামেও পরিচিত) জন্মের দিন ঘনিয়ে এসেছে।’ ছুরির বাঁটে খোদাই করা প্রতিকৃতির দিকে চাইল ডেমিয়েন। তারপর ডীনের দিকে ফিরে বলল, ‘বুহের-এর সাথে যোগাযোগ কর। যত শিগগির সম্ভব ওকে শিকাগো যেতে হবে…আর ওকে বোলো…’

নকের শব্দে কথায় বাধা পড়ল। দরজায় বাটলারের মাথা দেখা গেল।

‘ক্ষমা করবেন, স্যার, হারলে স্ট্রীট হাসপাতাল থেকে মিস্টার ডীনের টেলিফোন।’

‘বারবারা,’ বলেই কপালে থাপ্পড় দিল ডীন। একেবারে ভুলেই গিয়েছিল ডেমিয়েনের দিকে ফিরল সে। ‘যদি অনুমতি দেন তো…’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল ডেমিয়েন। ‘গাড়িটা নিয়ে যাও, কিন্তু তার আগে এমব্যাসি থেকে বৃহেরকে ফোন কোরো।’

‘কিন্তু বুহের তো ইসরাইলী কাজ-কারবার নিয়ে ওয়াশিংটনে ব্যস্ত রয়েছে, ‘ আপত্তি জানাল ডীন। ‘শ্রোয়ডার আগামীকাল ভোর চারটায় আসওয়ান বাঁধের ব্যাপারে হাঁড়ি ফাটাবে—বুহেরকে ওই সময়ে হোয়াইট হাউসের হাতের কাছে…’

‘তুমি একটা গাধা!’ উত্তেজিত ভাবে ডীনের দিকে চাইল সে। ‘আমাকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে ওরা—বুঝতে পারছ না? আমাকে শেষ করলে সেই সাথে তোমরাও সবাই শেষ হবে…কেউ রেহাই পাবে না।’

ডেমিয়েনকে একা রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ডীন। উঠে ধীর পায়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল ডেমিয়েন

কেব্‌ল্ স্ট্রীটের বাড়িতে পাঁচজন মস্কের সাথে টেলিভিশনটাকে ঘিরে বসেছেন ফাদার ডি কার্লো। খবর শেষ হতেই ফাদারের নির্দেশে টেলিভিশন বন্ধ করে দিল পাওলো।

‘কই, ওখানে ছুরি পাওয়া গেছে বলে তো খবরে কিছু বলল না?’ প্রশ্ন করল সায়মন।

‘না,’ জবাব দিল পাওলো। মনে হচ্ছে ওরা এটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছে।

‘থর্ন ঠিকই জানে এটা কোন দুর্ঘটনা নয়,’ মন্তব্য করলেন ডি কার্লো।

অ্যান্টোনিও কি যেন বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে ফাদার বললেন, ‘এখন আমাদের সবচেয়ে প্রথম যা করা দরকার সেটা হচ্ছে পবিত্র শিশু—সন্তানকে খুঁজে বের করা। ব্রাদার সায়মন আর ব্রাদার অ্যান্টোনিও আজ আমার সাথে যাবার জন্যে তৈরি থেকো। প্রভু কোথায় জন্ম নেবেন সেটা আমরা নিশ্চিত জানার চেষ্টা করব। সময় ঘনিয়ে আসছে।

মাথা ঝাঁকাল ওরা। ওদের দুজনকে মনোনীত করায় ওরা প্রীত।

‘আমরা না ফেরা পর্যন্ত বাকি সবাই এখানেই অপেক্ষা করবে। ফিরে এসে আমরা ঠিক করব আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। দ্বিতীয়বার ভুল করলে আমাদের চলবে না।

আলোচনা শেষে প্রত্যেকে নীরবে ব্রাদার বেনিটোর আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *