শেষের সেদিন

শেষের সেদিন

মল্লিকা ওয়ার্ডরোব থেকে একটা একটা করে শাড়ি বের করছে। চোখের সামনে তুলে ধরে দেখছে। তারপর খাটের উপর ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। ফেলে দেওয়ার সময় নাকটাকে ঘেন্নায় এমনভাবে কোঁচকাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে শাড়ি নয়, ওয়ার্ডরোব থেকে সে মরা ইদুর বের করছে।

জুঁইয়ের সামনে ইতিহাস বই খোলা। ঠিক একমাস তিনদিন পরে টেস্ট পরীক্ষা। চারমাস ন’দিন পরে মাধ্যমিক। হিসেবমতো এই সময় তার বই থেকে মুখ সরানোর কথা নয়। কিন্তু সে মুখ সরিয়ে মুগ্ধ চোখে দিদির দিকে তাকিয়ে আছে। দিদি এখন যা করছে, তাকে সংক্ষেপে বলা হয় পাগলামি। অমন সুন্দর শাড়িগুলোকে নাক সিঁটকে ছুড়ে ফেলার কাজ সাধারণ পাগলামিতে অসম্ভব। এর জন্য সিরিয়াস পাগলামি দরকার। দিদির সিরিয়াস পাগলামি দেখতে জুঁইয়ের বেশ মজা লাগছে।

মল্লিকা চোখ তুলে বোনের দিকে তাকাল। কড়া গলায় বলল, ‘এদিকে কী দেখছিস? নিজের কাজ কর। তোর না সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা?’

জুঁই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোরও তো সামনে ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরীক্ষা দিদি, তুই কী করছিস? শাড়ি ছুড়ে ছুড়ে ফেলার উপর তোর নিশ্চয়ই কোনও অনার্স পেপার নেই। যাক গে, আমি কি তাকে সাহায্য করব? ওয়ার্ডরোব খালি করতে গিয়ে তুই মনে হয় টায়ার্ড হয়ে পড়বি। মায়ের ঘরের আলমারি দুটোতেও কিন্তু ঠাসা শাড়ি। সেগুলোও ফেলবি নিশ্চয়ই!’

মল্লিকা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তোকে কে বলেছে আমি শাড়ি ফেলছি? মোটই আমি শাড়ি ফেলছি না। শাড়ি বাছছি। জঘন্য কতগুলো শাড়ি দিয়ে তুই আর মা মিলে আলমারিটাকে ভরতি করে রেখেছিস। এগুলো রং হল? একটাও পছন্দ হচ্ছে না!’

‘জুঁই সন্দেহে ভুরু কোঁচকাল। একটাও পছন্দ হচ্ছে না! অথচ এর মধ্যে অনেকগুলোই দিদি নিজে ঘুরে ঘুরে কিনেছে। এখন বলছে জঘন্য রং! নাঃ, পাগলামি যত কঠিন বলে মনে হচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি সিরিয়াস। আর একটু বাড়াবাড়ি হলে বাবাকে অফিসে ফোন করতে হবে।

আসল ঘটনা কিন্তু একেবারে উলটো।

এই সবকটা শাড়িই মল্লিকার ভীষণ পছন্দের। যেমন সুন্দর রং, তেমন চমৎকার ডিজাইন। বুটিক খুঁজে এগুলো কিনতে তার অনেক পরিশ্রম হয়েছিল। শাড়িগুলো যতবার দেখে, ততবারই তার মন ভরে যায়। এখনও যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু আজ তার সুন্দর শাড়ির দরকার নেই। আজ তার দরকার এমন একটা শাড়ি, যার রং হবে বেগুনি। যেমন তেমন বেগুনি নয়, ক্যাটকেটে বেগুনি। বিকেলে মল্লিকা সেই শাড়ি পরে প্রিতমের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। বেগুনি শাড়ির সঙ্গে পরবে বেগুনি পাথর বসানো দুল। কপালে বেগুনি টিপ লাগাবে। একটু বড় দেখেই লাগাবে, তা হলে চোখ এড়ানোর সুযোগ থাকবে না। এখানেই থামবে না মল্লিকা। সে বেগুনি রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ জোগাড় করবে। বিকেলে সেই ব্যাগ থেকে বেগুনি রঙের রুমাল বের করে। মাঝেমধ্যে মুখ মুছবে।

মল্লিকার এই বেগুনি পরিকল্পনা শুনলে মনে হবে, বেগুনি তার প্রিয় রংগুলোর একটা। একেবারেই তা নয়। বরং বেগুনি রং তার যথেষ্ট খারাপ লাগে। তবে বেগুনি রং তার চেয়েও বেশি অপছন্দ করে প্রিতম। বেগুনি রং বেশিক্ষণ দেখলে প্রিতমের মাথা ধরে যায় রগের পাশে টিপটিপ করতে থাকে। তার উপর প্রিতম পছন্দ করে না মল্লিকা শাড়ি পরুক। ও মনে করে শার্ট প্যান্ট পরলে মল্লিকাকে দুরন্ত দেখায়। একেবারে হলিউডের নায়িকাদের মতো। চোখ ফেরানো কঠিন। একদিন বাসে মল্লিকাকে দেখে প্রিতম নাকি চমকে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, আরে দক্ষিণেশ্বরের মিনিবাসে পেনেলোপ ক্রুজ উঠল কী করে! যদিও গল্পটা বিশ্বাস করার মতো নয়, কিন্তু মল্লিকা করেছিল। আজ মনে হচ্ছে, বিশ্বাস করে ভীষণ ভুল করেছিল। আজ মল্লিকা সেই ভুল শোধরাতে চলেছে। বেগুনি রঙের শাড়ি পরছে। এতে প্রিতমকে দু’ভাবে জব্দ করা যাবে। তাকে শাড়ি পরতে দেখে প্রিতম খুব বিরক্ত হবে, আবার বেগুনি রঙের জন্য তার মাথাও ধরবে। মাথা ধরার ব্যাপারে মল্লিকা কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। তাই বেগুনি টিপ, দুল, ব্যাগ আর রুমালের ব্যবস্থাও রাখছে।

শেষপর্যন্ত বেগুনি শাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে। ভয়ংকর বেগুনি। এ জিনিস দেখলে মাথাধরা তো কোন ছার, প্রিতমের বুক পর্যন্ত ধড়ফড় করতে পারে। শাড়ি হাতে নিয়ে সে আনন্দে একপাক নেচে নিল।

জুঁই ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দিদি, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? ডলি খাবি?’

মল্লিকা একগাল হেসে নিজের ঘরে চলে এল। জুঁইয়ের ফালতু কথার উত্তর দেওয়ার মতো সময় তার হাতে হাতে নেই। তার এখন অনেক কাজ। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে সে মনে মনে কাজের তালিশ তৈরি করেছে। লিখে রাখলে ভাল হত, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সবকটাই গোপন কাজ। গোপন কাজ কখনও লেখা যায় না।

যেমন চিঠির ব্যাপারটা।

গত আড়াই বছরে প্রিতম তাকে হাতে গুনে মোট পাঁচখানা চিঠি দিয়েছে, হিসেব করলে ছ’মাসে একটা চিঠি। সংখাটাকে কম বললে ভুল হবে, বলা ভাল একেবারে নচাণ্য এবং খুবই অপমানজনক| এই পাঁচের মধ্যে একটা আবার একেবারে সাদা কাগজ। ভীষণ রেগে গিয়ে মল্লিক প্রিতমকে এর মানে জিজ্ঞেস করেছিল। দু’দিন পর প্রিতম তার হাতে আর একটা ভাবীমতো খাম দিল। হাসিমুখে বলল, ‘এটা রাখো মল্লিকা, এর মধ্যে আমার সাদা চিঠির মানে লেখা আছে।’ বাড়ি ফিরে চুপি চুপি দরজা আটকে সেই চিঠি পড়ল মল্লিকা। অতবড় কাগজে একটা মাত্র শব্দ। আর কী শব্দ! সেই শব্দ পড়ে লজ্জায় মল্লিকার গাল লাল হয়ে, ঠোঁট শুকিয়ে, কপালে ঘাম জমে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। চিঠি কোথায় লুকোবে বুঝতে পারছে না। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি! একবার ড্রয়ারে রাখছে, খানিক পরে ড্রয়ার থেকে বের করে হাতব্যাগে ঢোকাচ্ছে, আবার ব্যাগ থেকে নিয়ে ক্লাসনোটসের খাতায় রাখছে, সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আগাথা ক্রিস্টির পেপারব্যাকে লুকোচ্ছে! জায়গামতো চিঠিটা লুকোনোর পর খানিকটা নিশ্চিন্ত হল মল্লিকা। এসব খুব সাংঘাতিক জিনিস। হাতে ধরে ফেলা যায় না, আবার রাখাও যায় না। আজ পাঁচটা চিঠিই প্রিতমকে ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কী সর্বনাশ! চিঠি গোছাতে গিয়ে মল্লিকা দেখল, বাকিগুলো আছে, শুধু সেই গাল লাল করা চিঠিটা ভ্যানিশ! গেল কোথায়? কোথায় লুকিয়েছিল? মনে পড়ছে না, ইস মনে পড়ছে না। পড়ার টেবিলে কোথাও? ক্যাসেট সিডির র‍্যাকে? জুঁইয়ের কম্পিউটার ডেস্কে নয় তো? ও চিঠি পেতেই হবে। নইলে প্রিতম ভাববে, ওই চিঠিটাই সে ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছে। মল্লিকার ইচ্ছে করছিল বাড়ি তোলপাড় করে ফেলতে।

ইচ্ছে করলেও বাড়ি তোলপাড় করতে পারল না মল্লিকা। সব জিনিস নিয়ে চেঁচামেচি করা যায় না। তোষকের তলা, পোশাকের ভাঁজ, এমনকী জুতোর তাক পর্যন্ত হাতড়াল মল্লিকা। না, নেই।

চিঠির পর ছবি। চিঠির মতো ছবিও আজ ফেরত যাচ্ছে প্রিতমের কাছে। তবে সেখানেও সমস্যা রয়েছে। অদ্ভুত সমস্যা।

ছবিতে প্রিতমকে খুব বিচ্ছিরি দেখায়। অমন ভরাট গালদুটোকে দেখে মনে হয় তুবড়ে গেছে। লম্বা নাকটাকে চাপা লাগে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হল, কানদুটোকে মনে হয় বড়। সেই কারণে মল্লিকা প্রিতমের ছবি রাখে না। ছবি দেখলেই মনে হয় ছিঁড়ে ফেলি। সত্যিই তো, প্রেমিকের কান-বড় ছবি কারই বা সহ্য হয়?

এই একটা ছবিই রেখেছিল মল্লিকা! আশ্চর্যভাবে এই ছবিতে প্রিতমকে দারুণ দেখাচ্ছে। ছবিটা দার্জিলিংয়ে তোলা। হালকা সবুজ শার্ট পরে প্রিতম ম্যালের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে একটা বাদামি রঙের রোগা ঘোড়া। ঘোড়াটা ক্যামেরার দিকে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। পিছনে টানা হিমালয়ের রেঞ্জ। পাহাড়ের মজা হল, এখানে সবাইকেই রোমান্টিক দেখায়। প্রিমকেও দেখাচ্ছে। গম্ভীর অথচ উদাসীন। তাকানোয় একটা কবিকবি ভাব। এমনকী ঘোড়াটার চোখদুটোও যেন ঢুলুঢুলু। ছবিটা মল্লিকা নিয়েছিল। রোজ রাতে ঘুমোবার আগে। একবার করে দ্যাখে। টুকটাক দু’-একটা কথা বলে। কোনও কোনও দিন মনে হয় একটা চুমু খেলে ভাল হত। কিন্তু লজ্জা করে। রমলা শুনে বলেছিল, ‘ওমা, ছবিতে চুমু খেতে লজ্জার কী আছে মল্লিকা? ঠিক আছে, চোখ বুজে খাবি, তা হলে আর লজ্জা করবে না।’ রমলার পরামর্শ ভাল, কিন্তু ছবিতে ঘোড়া থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। ছবির এই জিনিসটা মল্লিকার একদমই পছন্দ নয়। কথাটা প্রিতমকে বলতে সে গম্ভীরমুখে বলল, ‘তুমি বোধহয় জানেন না মল্লিকা, হংকংয়ের সিলমাছ আর দার্জিলিংয়ের ঘোড়া— এই দুটি প্রাণী ছবি তুলতে বিশেষ রকম ভালবাসে। ছবি তোলার সময় ওদের কখনও বাদ দিতে নেই। তাতে ওরা দুঃখ পায়।’

অগত্যা শুকনো ‘গুড নাইট’ বলে ছবি খামে ভরে শুতে যায়। প্রায় এক বছর ধরে এই ছবিকাণ্ড চলছে।

কাল রাতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। অভ্যেসমতো খাম খুলে ছবিটা বের করল মল্লিকা। করেই চমকে উঠল। আশ্চর্য তো! প্রিতমের মুখে হালকা একটা হাসি না! ঠিকই তো, হাসিই মনে হচ্ছে! হাসির মধ্যে একটা মিটিমিটি ধরন। এ হাসি এল কোথা থেকে? ছবির মুখ তো ছিল গম্ভীর। কালও তাই দেখেছে। তবে? বিষয়টা হাসির হলেও মল্লিকা খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। ভয় পাওয়া দোষের নয়। গম্ভীর ছবি যদি হাসিহাসি হয়, তবে তো ভয় লাগবেই। মল্লিকা তাড়াতাড়ি ছবিটা খামে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। না, হয়নি। একটু আগেও একই ঘটনা ঘটেছে। এক নয়, ঘটনা বরং বেশিই বলা উচিত। বেগুনি ভ্যানিটি ব্যাগে ছবিটা পোরার সময় মল্লিকা শেষবারের মতো খামের ভিতরে উঁকি দেয়। ওরে বাবা, হাসি আরও বেড়েছে যে!

শাড়ি চিঠি ছবির পর মল্লিকার তালিকায় রয়েছে গান।

গানের ব্যাপারটা মল্লিকার অনেক ভেবে ঠিক করা। প্রিতম ইংরেজি আর হিন্দি গানের পোকা। তার সিড়ি লাইব্রেরিতে কী নেই! সায়গল থেকে নোরা জোন্‌স— সব। তবে বাংলা গালি সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। শুনলেই কানে আঙুল দেয়। মল্লিকা অনেকবার আপত্তি তুলেছে। বলেছে, ‘এ কেমন কথা, বাঙালি বাংলা গান ভালবাসে না?’ প্রিতম হাত জোড় করে বলেছে, ‘দুঃখিত, বাংলা গানে আমার অ্যালার্জি আছে। কারও চিংড়িমাছে হেচকি ওঠে, কারও ফুলকপিতে সদি হয়, আমারও তেমনই। তোমাদের ন্যাকা ন্যাকা বাংলা গান শুনলে আমার মাথায় আগুন জ্বালে।’ মল্লিকা সেই আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছে। সুযোগ যদি পায়, তা হলে ছাড়বে না কিছুতেই। অপমান দু’কলি গান সে গাইবেই গাইবে। জ্বলুক আগুন! জ্বলতে জ্বলতে প্রিতমের মাথাটা একটা উনুনের মতো হয়ে যাক।

খুব সকালে অজান্তাকে টেলিফোন করল মল্লিকা। বন্ধুমহলে আজন্তার নাম ‘মাননীয়া গানসুন্দরী।’ গানের এত স্টক খুব কমজনের থাকে। সমস্যা একটাই, মেয়েটা বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। ফোন ধরে ঘুমজড়ানো গলায় বলল, ‘গান! কী বলছিল মল্লিকা! ফার্স্ট পেপারে গান কোথায়? ফার্স্ট পেপার তো ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন! সেখানে গান বলতে ন্যাশনাল অ্যানথেম। আর সেকেন্ড পেপারে…

মল্লিকা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ঘুম থেকে ওঠ অজন্তা। উঠে বাথরুমে যা, ঢোখেমুখে জল দে। কানেও একটু জল দিবি। টেলিফোনে কানটাই ইমপর্ট্যান্ট। আমি ঠিক দশ মিনিট পরে আবার তাকে ফোন করছি। এই দশ মিনিটের মধ্যে তুই একটা গান ঠিক করে রাখবি। টেলিফোনেই আমি সেই গান লিখে নেব। দরকার হলে সঙ্গে স্বরলিপি দিবি। যা, দেরি করিস না। ঠিক দশ মিনিট টাইম, ওনলি টেন মিনিটস। আর হ্যাঁ, বিরহটিরহর গান বাছবি না কিন্তু! আনন্দের গান চাই। কী হয়েছে? পরে ডিটেলসে বলব। শুধু জেনে রাখ, আজ একটা খুব আনন্দের ঘটনা আছে। সেখানে আমি গান গাইব। আনন্দের ঘটনা, তাই আনন্দের গান।’

মল্লিকাকে ফোন করতে হল না। ঠিক ন’মিনিটের মাথায় অজন্তা নিজেই করল। গান বলে তো দিলই, টেলিফোনে গুনগুন করে গেয়ে সেই গান মল্লিকাকে তুলিয়েও দিল। গান ভোলা হয়ে গেলে মল্লিকা বলল, ‘আমাকে তোর একটা ধন্যবাদ জানানো উচিত অজন্তা। আজ আমার জীবনে একটা স্মরণীয় দিন। যাকে বলে, ‘মেমোরেবল ডে’। তাই তোর উপকারটাও একটা স্মরণীয় উপকার হয়ে গেল। উপকার করার সুযোগ অনেক আসে, কিন্তু স্মরণীয় উপকার করার সুযোগ বেশি আসে না। তুই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিস।টা টা।’

মল্লিকার তালিকায় শেষ বিষয়টি সবচেয়ে শক্ত অথচ সবচেয়ে জরুরি। হাসিখুশি থাকা।

আজকের দিনের সঙ্গে হাসিখুশির কোনও সম্পর্ক নেই। বরং উলটোটাই ঠিক। আজ দুঃখ পাওয়ার দিন। এমন দিনে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে হয়। কেউ খেতে ডাকলে বলতে হয়, ‘খাব না, মাথা ধরেছে।’ কান্নাকাটি করে চোখ ফুলে যাওয়ার কথা। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ একটা ভয়ংকর মনখারাপের দিন।

মল্লিকা ঠিক করেছে, আজ কিছুতেই সে তার মনকে খারাপ হতে দেবে না। মুখ এক মিনিটের জন্যও গোমড়া করবে না। সিদ্ধান্তু যখন একটা নেওয়া হয়েই গেছে, তখন কীসের মুখ গোমড়া! কীসের চোখ ছলছল! প্রিতম যেন কোনওভাবে না ভেবে বসে যে, মল্লিকা ভেঙে পড়েছে। অত নরম মাটি সে নয়। বেগুনি রং, চিঠি, ছবি আর বাংলা গান দিয়ে প্রিতমকে রাগানোর সমস্ত রকম ব্যবস্থা যেমন করা হয়েছে, তেমনই সে নিজেও থাকবে হাসিখুশি। এতে প্রিতম অবাক হবে, আরও রাগবে। মনে কোনওরকম দুর্বলতা থাকলে সেটাও দূর হবে।

হাসিখুশি থাকার জন্য পরিকল্পনামতো কাজও শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ হল মল্লিকা যে-কোনও ব্যাপারে হাসতে শুরু করেছে। একটু আগে মাছের কালিয়ায় ঠিকমতো মিষ্টি হয়েছে কিনা চাখতে গিয়ে একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়েছে রান্নাঘরে। সেজমাসি দিল্লি থেকে ফোন করেছিল। সেখানে নাকি এবার খুব গরম পড়েছে। তাতে এত হেসেছে যে, বিষম খেয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড। মা খুব অবাক হয়ে বড় মেয়ের হাসি দেখেছে। জুঁই ফিসফিস করে বলছিল, ‘মা, বাবার অফিসে কি ফোন করব? তোমার মনে হচ্ছে না, সামথিং ইজ রং’?

এখানেই ব্যবস্থা শেষ নয়। আরও আছে। বিকেল পর্যন্ত হাসি ধরে রাখতে হবে। পি জি উহাইস, শিবরাম চক্রবর্তীর বই, চার্লি চ্যাপলিনের সিডি, সবই বের করে রাখা হয়েছে।

আহা, শেষদিন শেষবারের মতো দেখা করতে এসে প্রিতম বাছাধন কেমন নাকালটাই না হবে!

প্রিতমের বিপদে পড়া বিরক্ত রাগী মুখের কথা কল্পনা করে সারাদুপুর মল্লিকার হাসি পেল। হাসার জন্য তাকে আলাদা কিছু করতে হবে না।

ঠিক বত্রিশ মিনিট হতে চলল, মল্লিকা আর প্রিতম চুপ করে বসে আছে। তাদের পাশেই কাচের বিশাল জানলা দিয়ে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। এই কফিশপটার মজাই এই। কিছুক্ষণ বসলে মনে হবে গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছি। সামনের টেবিলে কফির মগ। কফি ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। তবু প্রিতম মাঝে মাঝে মগে এমন সতর্কভাবে চুমুক দিচ্ছে যে, মনে হচ্ছে কফি এখনও আগুন গরম। ধোঁয়া উড়ছে। মনে হয়, ঠান্ডা-গরম বোঝার ব্যাপারে প্রিতমের কোনও গোলমাল হয়ে গেছে।

আসলে ঘটনাও তাই। প্রিতমের সব গোলমাল হয়ে গেছে। বেগুনি শাড়ি পরলে মল্লিকাকে এত সুন্দর লাগে, ও জানত না। মনে হচ্ছে, মল্লিকা নয়, তার সামনে। একরাশ ঝুমকোলতা ফুল মাথা নামিয়ে বসে আছে। এত সুন্দর যে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। প্রিতম মুখ ফিরিয়ে নিল। মল্লিকার অবস্থাও সুবিধের নয়। তার হিসেব মিলছে না। কথা ছিল, প্রিতম রেগে আগুন হয়ে যাবে। কিন্তু একী! সে অল্প অল্প হাসছে কেন। ঠিক যেন ছবিতে হঠাৎ ফুটে ওঠা হাসিটার মতো! ছবির কথা মনে পড়তেই আরও একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে গেল মল্লিকার। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল সে।

প্রিতম গঙ্গার দিকে মুখ ঘোরানো অবস্থায় বলল, ‘কাল কখন দেখা হবে?’

চমকে উঠল মল্লিকা। বলল, ‘কাল! কাল আবার কীসের দেখা? আজই তো। শেষদিন।’

মুখ না ফিরিয়েই প্রিতম বলল, “উফ, এই তোমার একটা বড় দোষ মল্লিকা। তুমি। জানো না, সন্ধের সময় নদীর কাছে এসে কোনও বাজে কথা বলতে নেই? এতে নদী বিরক্ত হয়। কাল কখন দেখা হবে, সেটা বলো তো। আমি কি তোমাকে ফোন করব? চুপ করে আছ কেন? কিছু একটা বলো!”

মল্লিকা চুপ করে আছে। সে কিছু বলতে পারছে না। কী করে বলবে? ঠিক করেছিল হাসিখুশি থাকবে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। কান্না পেলে কি কিছু বলা যায়? তা হলে এখন কী করবে সে? লাফাবে? নাচবে? নাকি গলা ছেড়ে অজন্তার শেখানো গান ধরবে?

‘আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে…।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *