‘শেষের পরিচয়’ – এর অপ্রকাশিত অংশ
ষোল
সারদাকে অপমান করিয়া তাহার ঘর হইতে ফিরিয়া রাখাল বাসায় আসিল। দাসী তখনো বাড়ি যায় নাই, কুকারে রান্নার সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত করিয়া তখনো সে অপেক্ষা করিতেছিল। রাখাল বলিল, আজ খাবো না নানী, ক্ষিদে নেই। রান্নার দরকার হবে না।
ঝি রাগ করিয়া বলিল, সে হবে না বাবু। আলিস্যি করে রাঁধবে না, না খেয়ে উপোস করে শুয়ে থাকবে, সে আমি কিছুতেই সইবো না। দিন দিন দেহটা কি রকম হয়ে যাচ্ছে একবার চেয়ে দেখো দেকি। এই বলিয়া সে একটা ছোট আরশি আনিয়া সুমুখে ধরিতেছিল। রাখাল সলজ্জ হাস্যে হাত দিয়া সরাইয়া দিয়া বলিল, বুড়ো হয়ে তোমার চোখের দৃষ্টি খারাপ হয়ে যাচ্চে,—আমি ত ভালই আছি।
না, তুমি ভাল নেই দাদাবাবু, আমার মাথা খাও, আগের মতো খাওয়া-দাওয়ায় আবার দৃষ্টি দাও। না হয় আমাকে ছুটি দাও, দেখতেও আসবো না, বলতেও যাবো না।
রাগের ওপর আমাকে ত্যাগ করবে নানী? তুমি ছাড়া আমার ত সংসারে কেউ নেই। এই বলিয়া সে জোর করিয়া হাসিয়া কুকারে খাবার চড়াইয়া দিল। ক্ষুধার প্রয়োজনে নয় এই পুরাতন দাসীটিকে কেবল খুশি করার জন্যই।
রাখাল মুখে যাই বলুক, মনে মনে বুঝিতে পারে পূর্বের মতো সে আর নাই। কিসে যেন তাহার মুখের লাবণ্য প্রতিদিন ম্লান করিয়া আনিতেছে। আনন্দের পাত্রে ঠিক কোনখানে যে চিড় খাইয়াছে ধরিতে পারে না; কিন্তু সঞ্চয় ধীরে ধীরে কমিতেছে টের পায়।
উৎসবে যোগদানের নিমন্ত্রণ, বেগার খাটার আবেদন, কর্তব্য পালনের আহ্বান আজও তেমনি আসিয়া পৌঁছে, যায় না, করে না তাও নয়, তিরস্কারের দাবী যাহাদের কর্তব্য অবহেলার অপরাধে তিরস্কার তেমনি করে, ভর্ৎসনার উত্তরে আজও রাখাল তেমনি সবিনয়ে ক্ষমা করে, ভিক্ষা করে, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়া তেমনি উৎসাহে কাজে নামে, তবু যেন কেমন করিয়া এই কথাটা প্রকাশ পায় সে-রাখাল ও এ-রাখাল ঠিক এক মানুষই নয়। কাজ করার হঠাৎ কোন ফাঁকে তাহার মনের ঔদাসীন্য এমনি ধরা পড়ে যে সে অপ্রতিভ হইয়া যায়,—উত্তর দিতে পারে না। এতদিন এইভাবেই তাহার কাল কাটিতেছিল। মনের তলদেশ কি দিয়া কেমন করিয়া ধীরে ধীরে আচ্ছাদিত হইতেছিল, যাচাই করিয়া, জেরা করিয়া দেখে নাই, আজ সারদার সঙ্গে কলহ, কথা কাটাকাটির ফলে ভিতরের পঙ্ক উপরে উঠিয়া হঠাৎ সমস্ত স্থানটা এমনি ঘুলাইয়া কলুষিত করিয়া দিল যে, সে নিজেই একেবারে অবাক হইয়া গেল। নতুন-মার বাড়ি হইতে চলিয়া আসার সময়ে তাহার মনের মধ্যে এই ছিল যে, সারদার অশিষ্ট দুর্বিনয়ের জবাব সে নিঃশব্দে উপেক্ষায় দূরে রাখিয়া দিবে, কোন সম্বন্ধই আর রাখিবে না। কিন্তু নিজের বাড়িতে ফিরিয়া সংকল্প স্থির করিতে পারিল না। মন তিক্তকণ্ঠে বারবার বলিতে লাগিল, সারদার আচরণ ক্ষমার অযোগ্য, যাহা বলিয়াছে সে শুধু কৃতঘ্নতাই নয়, নিরতিশয় অপমানকর। অথচ এই উত্তেজনা তাহার কানে কানে কে দিতে লাগিল রাখাল ভাবিয়া দেখিল না, বিচার করিল না সারদা কি বলিয়াছে, কেন বলিয়াছে এবং কেমন করিয়া অপমান করিয়াছে। কৃতঘ্নতা তাহার কোন্খানে। প্রতিহিংসার আগুন এক নিমেষে যেন তাহাকে পাগল করিয়া দিল।
চুল্লীর উপর কুকার চড়ানো রহিল, গায়ের চাদরটা আলনা হইতে টানিয়া লইয়া সে ঘরে তালা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
এ বাড়িতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন পাশাপাশি ঠাঁই করিয়া দিয়া তারক ও বিমলবাবুকে সারদা খাইতে দিয়াছে। অনতিদূরে বসিয়া সবিতা এবং একধারে দাঁড়াইয়া সারদা। তাহার প্রতি চোখ পড়িল সকলের আগে সবিতার, তিনি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, রাজু যে, ব্যাপার কি? তাঁহার মুখ সংশয়ে পাংশু হইয়া গেল।
এইমাত্র সে গিয়াছে, এখনি ফিরিয়া আসার হেতু নাই, অকারণে আসা-যাওয়া তাহার প্রকৃতিও নয়—ভয় হইল স্বামী ও মেয়ের জন্য, হয়ত ইতিমধ্যে কি-একটা খবর আসিয়াছে। এবং তাহাই জানাইতে সে আসিয়াছে। বলিলেন, বাড়িতে সবাই ভালো আছে রাজু? রেণু, তার বাবা?
আমি কি করে জানবো নতুন-মা?
সবিতা ধীরে ধীরে বলিলেন, একা তুমিই ত তাঁদের খবর রাখো বাবা।
আগে রাখতাম যখন তাঁরা এখানে ছিলেন। নানা কাজে এখন আর বড় সময় পাইনে।
সকলেই মৌন হইয়া রহিলেন, এ কথায় অভিযোগ করিবার কিছু নাই, কিন্তু আঘাত যেখানে লাগিবার সেখানে লাগিল।