শেষযাত্রা

শেষযাত্রা

বৃন্দাবন বসাক মারা যাচ্ছেন। বাড়িতে নয় হাসপাতালে। পয়সাকড়ি আছে। পয়সার জোরে সেরা হাসপাতালে স্থান পেয়েছেন। স্পেশাল নার্স নিযুক্ত করা হয়েছে, সর্বক্ষণ তদারকি করার জন্যে। বুড়ো ইদানিং খুব খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলে আর ছেলের বউরা মিলে হাসপাতালে ভরে দিয়ে এসেছে।

আত্মীয়স্বজন, পুত্র, পুত্রবধূ, ডাক্তার, নার্স, চারপাশে সবাই ছড়িয়ে রয়েছে। ডাক্তার এই শেষ সময়ে বিশেষ খোঁচাখুঁচি করতে চাইছেন না। ইংরেজিতে বলছেন—লেট হিম ডাই পিসফুলি। পুত্রবধূরা নানারঙের সিনথেটিক শাড়ি পরেছেন। সেন্ট মেখেছেন। চোখে কাজল টেনেছেন। গায়ে গন্ধ মেখেছেন। কায়দা করে খোঁপা বেঁধেছেন।

বড়োছেলে অল্প একটু দূরে দাঁড়িয়ে দামী সিগারেট খেতে খেতে মেজোকে বলছেন, বউবাজার থেকে ভাল দেখে একটা খাট আন, নিউমার্কেট থেকে ফুল আন। মেজো বলেছেন আনতে চলে গেছে।

মেজোছেলের চামড়ার কারখানা। কারখানার কর্মচারীদের এই সব কেনাকাটার কাজে লাগানো হয়েছে। ফোরম্যান নিজে তদারকি করছেন। তিনি খাট কিনতে কিনতে ভাবছেন—শালারা পাঁচ-শো টাকা মাইনে দেয়, এই মওকায় শ তিনেক ঝেঁপে নি। পাশে একজন মেকানিক দাঁড়িয়ে ছিল ল্যাংবোটের মতো। তাকে বললেন—রাজু টেম্পো বোলাও! ফার্নিচারের দোকান থেকে রাজু বেরিয়ে যেতেই মালিককে বললেন—খাটটার একটা ভাউচার করে দিন, পাঁচ-শো লিখবেন না, সাতশো লিখুন।

মেজোপুত্রবধূ বড়োবউকে বললেন—বড়দি গঙ্গাজল রেডি করো। বড়ো ছোটো হাত-আয়নায় মুখ দেখছিলেন। সেটাকে হাত ব্যাগে ভরে ছোটো একটা শিশি বের করলেন, তারপর ব্যাগটা হাঁটকে, পাঁটকে আক্ষেপের সুরে বললেন—ইস রুপোর চামচটা আনতে ভুলে গেছি রে মেজো। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন—একটা চামচে আনিয়ে দেবে! ডাক্তারবাবু ঘড়ি দেখে বললেন—চামতে আনবার আর সময় নেই। এই নিন ড্রপার।

মেজো বললেন, ভালো করে ধোয়া তো?

বড়োছেলে বললেন—এখন আর অত বাছা-বিচার কি? লাস্টমোমেন্ট? চলো এক ফোঁটা করে মুখে দিতে থাকি। লাস্ট রাইটস—শেষকৃত্য।

বড়ো ড্রপার হাতে বাপের কাছে এগিয়ে যেতেই বৃন্দাবন ফিস ফিস করে বললেন—তাড়া আছে?

বড়ো ছেলে চমকে সরে এসে ডাক্তারকে বললেন—হি ইজ টকিং।

ডাক্তার বললেন—সজ্ঞানেই মৃত্যু হবে। যে কলে মানুষ চলে তার সবই প্রায় থেমে এসেছে; স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরেই বেঁচে আছেন। ইচ্ছাশক্তির জোর কতটুকু বলুন? গেল বলে।

বড়োছেলে স্ত্রীর হাতে শিশিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন—না: ঝামেলা হয়ে গেল, সন্ধ্যের সময় আমার একটা ককটেল পার্টি ছিল।

বউ বললেন—আমারও তো এনগেজমেন্ট ছিল। কী আর করবে বল? কর্তব্য তো করতেই হবে।

বড়ো ডাক্তারের কাছে সরে এসে বললেন—মানুষের ইচ্ছাশক্তিটাকে মেরে ফেলা যায় না? ওটা কি ক্রিমিন্যাল অফেনস?

ডাক্তার বললেন—ওর যেমন বাইরে থেকে জন্ম দেওয়া যায় না, মারাও যায় না। ওটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। একটু ধৈর্য করুন। শক্তিটা অটোমেটিক কমে আসবে।

—মহা মুশকিল হল, বলে বড়ো ঘন ঘন সিগারেট টানতে লাগলেন।

এমন সময় মেজো ঘরে ঢুকে বললেন—দাদা খাট আর ফুল এসে গেছে। কত দেরি?

বড়ো আক্ষেপের সুরে বললেন—এখনও তো স্পষ্ট কথা বলছেন।

—মাই লর্ড? তাহলে কী হবে?

—তোরা থাক, আমি ঝট করে একটা কাজ সেরে আসি।

বড়ো বেরিয়ে গেলেন। মেজ শিশি আর ড্রপার হাতে বাপের কাছে এগিয়ে যেতে বৃন্দাবন সেই একই কথা বললেন—তাড়া আছে?

মেজো বিমর্ষ হয়ে ফিরে এলেন। বউকে বললেন, তোমরা থাক, আমি চট করে একটা কাজ সেরে আসি।

—এর মধ্যে যদি মারা যান?

—ভয় নেই, নীচে সব ব্যবস্থা করা আছে। লোকজন আছে।

বউমা তখন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? একটু তাড়াতাড়ি করা যায় না?

জন্ম-মৃত্যু কি বলা যায় মা। যখন হবার তখন ঠিকই হবে।

বড়ো বউ চেয়ারে বসে ম্যাগাজিন পড়তে লাগলেন। মেজোবউ উল বের করে সোয়েটার বুনতে শুরু করলেন। নার্সকে বললেন, সময় হলে বলবেন, মুখে গঙ্গাজল দিয়ে দেবো।

ডাক্তার বৃন্দাবনের নাড়িটা দেখতে লাগলেন, বৃন্দাবন ফিসফিস করে বললেন—ব্যস্ত হবেন না, আমি যাবার আগে একটু টাইম দিয়ে যাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *