শেষবেলায়
নেত্য, নেত্যগোপাল সামন্তর বাড়িটা এদিকে কোথায় জানেন? ও মশায়—
রকে এক বুড়ো বসে। একটা তেলচিটে তুলোর কম্বল থেকে মুখখানা জেগে ওঠে। বড়ো বেশি খানা—খোঁদল মুখে, আর নারকেল ছোবড়ার মতো রুক্ষ দাড়ি—গোঁফ। শিরা—উপশিরা সব ভেসে উঠেছে। মরকুটে বুড়ো। চোখের কোণে মাখনের মতো পিঁচুটি জমেছে।
নেত্য?
নেত্যগোপাল।
সামন্ত বাড়ি? কী বললে?
তাই বলছি। নেত্য সামন্ত? দালাল!
হবে।
সে থাকে কোথা?
বুড়োটা ঘোলাটে চোখে একটু চেয়ে থাকতেই কপালের চামড়ার নীচে বান মাছের মতো একটা রগ সরে গেল একটু পিছলে। মরবে! পিত্ত কফ শ্লেষ্মা তিনটেই প্রবল। গলার ঘর্ঘরটা সামলাতে পারছেন না। বুকে বাতাস ডাকছে।
শেলেশশা। বুঝলে।
বুঝেছি।
অনেক নতুন নতুন লোক বসিয়ে নিশ্চিন্দায়। নতুন কালের মানুষ সব।
সবাইকে কী চিনি? হরেন চৌধুরী বুঝল, হবে না, বলল, কিন্তু খুব নামডাকের লোক। তিন চার রকমের দালালি।
রাখো তোমার দালালি। দালাল নয় কে? কী নাম বললে? নেত্যগোপাল?
নেত্যগোপাল! সামন্ত বাড়ি—
এই বাড়িটাই দেখিয়ে দিল একজন।
এই বাড়ি? বলে মাথা নাড়ে বুড়োটা, কিছু ঠাহর পাই না। এই মনে পড়ে।
ভুলে যায়। ঝুব্বুস হয়ে বসে গেছি বাপ, কে আর দেখে আমাকে! জাড়টাও বাড়ল খুব এবার।
হরেন হাসে— জাড় কোথা খুড়োমশাই দিব্যি বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে।
তোমার তো দিবেই। যার মাথায় হাত তার জাড়। শরীরে সেই কোন সকালে শীত ঢুকে বসে আছে। তাড়াই কত। যায় না।
তো নেত্য সামন্তর খোঁজ পাই কী করে? বাড়িতে কে আছে?
আছে অনেক। জ্ঞাতিগুষ্টি কী কম? তিষ্টোতে পারি না বাপ, বড্ড জ্বালায় ছেলেগুলি। নিত্যগোপালের ছেলে, আমার নাতি—
হরেন ঝুঁকে সাগ্রহে বললেন, কী নাম বললেন? আপনার ছেলে নিত্যগোপাল?
বুড়ো হতচকিত চোখে চায়, তবে কার ছেলে? ভুল বললুম নাকি?
তাহলে তো এইটেই নিত্যগোপালের বাড়ি।
এইটাই।
চেনেন না বললেন যে?
চিনি। আমার ছেলে। ভুল হয়ে যায় বাপ। আমি হচ্ছি গয়েশ সামন্ত। বলে বুড়ো মাড়ি আর মুখের ফোকর দেখিয়ে হাসে, এইবার মনে পড়েছে। সব হিসেবে ঠিকঠাক। সামন্ত বাড়ি, নেত্য।
নেত্যকে আমার দরকার।
যাও না ভেতরে। এটা কি সকাল বাপ? ক—টা বাজল?
বিকেল। চারটে। এ সময়ে থাকার কথা।
আছে বোধহয়। এখানেই থাকে। গয়েশ সামন্তর ছেলে হল নেত্যগোপাল, নেত্যগোপাল।
ছেলেপুলে তো কাউকে দেখছি না। কাকে দিয়ে ডাকাই! অচেনা লোক হুট করে ঢুকে পড়াটা কি ঠিক হবে?
ছেলেপুলে? নেত্যর? তারা সব গর্ভস্রাব।
গালাগালটা হরেনের শোনা। বাবা দেয়।
বলল, ছেলেগুলি জ্বালায় নাকি?
কিছু রাখে না। এক পুরিয়া চিনি লুকিয়েছি তোষকের তলায়। লোপাট। কিছু রাখে না। বড়ো এলাচ খেলে বুক ভালো থাকে, চিত্ত এনে দিয়েছিল একমুঠো। কড়মড় করে চিবিয়ে খেল। বউমারা সব যে পেটে এগুলি কী ধরেছিল, ছিঃ ছিঃ।
হরেন চৌধুরী দরজায় উঠে ‘নেত্যবাবু’ বলে ডাকতে লাগে।
ভেতরে শোনা যায় না। বুড়োটা বলে।
কেন?
সব অনেক ভেতরে থাকে। ছেলেগুলি সর্বক্ষণ খাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে, কিচ্ছু শোনা যায় না, ঢুকে যাও।
মেয়েছেলে রয়েছেন, যদি কেউ কিছু মনে করেন! উটকো লোক।
পর্দানশিন তো নয়। যখন গাল পাড়ে তখন তো ইয়ের কাপড় মাথায় উঠে যায়। মেয়েছেলে? যাও। সর্বক্ষণ লোক আসছে, এ বাড়ি হচ্ছে হাট।
তা হরেন চৌধুরী কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে ঢুকেই পড়ে। রক পেরিয়ে দরজা। ভেতরে একটা বাঁধানো জায়গা, বারান্দামতো। তারপর মস্ত উঠোন। বাড়িটার কোনো প্ল্যান ছিল না নাকি? যেখান—সেখান দিয়ে ঘর—বারান্দা সব গজিয়েছে। দেওয়ালে প্লাস্টারের বালাই নেই, ইট বেরিয়ে আছে। একপাশে ভারা বাঁধা, রাজমিস্ত্রির কাজ চলছে বোধহয়। কাণ্ডটা প্রকাণ্ডই। উঠোনের চারধারেই ঘর, ঘরের উপর ঘর উঠেছে কোথাও। একটাই বাড়ির খানিকটা একতলা, খানিকটা দোতলা, তেতলাও আছে। উঠোনের মাঝখানে কুয়ো, কুয়োর পাশেই আবার টিউবওয়েল। বিস্তর বাচ্চা—কাচ্চা, আর কয়েকটা মেয়েছেলে দেখা যায়। কুয়োপাড়ে বাসনের ডাঁই মাজতে বসেছে কুঁঁজো চেহারার কালো এক মেয়েছেলে। মাজতে মাজতে বকবক করছে। তার কাঁকালের ফাঁক দিয়ে বাঁদরের বাচ্চার মতো একটা বছর দেড়েকের মেয়ে ঝুলে আছে, তার মাথাটা বুকের মধ্যে সেঁদানো। মেয়েমানুষেরা পারেও! ভেবে একটু শিউরেও ওঠে হরেন।
হেঁকেই জিজ্ঞেস করে, নেত্যগোপালবাবুর বাড়ি তো এটা?
কেউ তাকালও না। উঠোন জুড়ে চিলচেঁচানি। খাপড়া ছুঁড়ে গুটিসাতকে ছেলেমেয়ে গঙ্গাযমুনা খেলছে। তাদের মধ্যে একজন এক ঠ্যাঙে লাফিয়ে তিন ঘর পেরিয়ে গেল, সবাই চেঁচাচ্ছে তাই!
এই হচ্ছে জয়েন্ট ফ্যামিলির ছবি। হরেনের চোখদুটো করকর করে উঠল। দুঃখে। একসময়ে সে এরকম একটা পরিবারে মানুষ হয়েছিল। সেসব ইতিহাস। আজ সামন্তমশাইয়ের কাছে এসেছে ছোট্ট একটা প্লট বা বাড়ির সন্ধানে। লোকটার হাতে বিস্তর জমির খোঁজ। কলকাতায় আর জমি নেই। যাও বা ছিল ঢাকুরে, যাদবপুর, বেহালা বা গড়িয়ায়— তাও টপাটপ ফুরিয়ে এল বলে। এরপর কলকাতার জমি বিক্রি হবে ঝুড়িতে। মানুষ তাই কিনে ঘরে সাজিয়ে রাখবে। দেখবার মতো জিনিস হবে একটা। তা সেই দুর্লভ জমি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হরেন একমুঠো চায়, ছোট্ট প্লট হলেই তার চলে যাবে। সংসার বড়ো নয়। বউ আর দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে। কাঠাখানিক কী দেড়েক হলেই তিনতলা তুলবে। সুবিধেমতো জায়গায় হলে একতলাটা হবে দোকানঘর, দোতলায় ভাড়াটে, তিনতলায় তাদের ছোটো সংসার।
ছোটো পরিবারই সুখী পরিবার বলে বটে, কিন্তু হরেনের মনে ধন্দটা যায়নি।
সামন্তমশাইয়ের বাড়ির দৃশ্যটা দেখে কী জানি কেন হরেনের বুকটায় মেঘ জমে ওঠে। এইরকম একটা হাটখোলায় সে মানুষ হয়েছিল। সুখে নয়, আবার তেমন সুখ আর পাবেও না।
দীর্ঘশ্বাস চেপে সে দু—কদম এগোল। বারান্দার নীচে নর্দমা, তাতে একটা নীল বল পড়ে আছে। উঠোনে ফাটা বেলুনের রবার ন্যাতার মতো, একটা ছাগল ঘাস থেকে মুখ তুলে হরেনের চোখে চোখ রাখে। কোন বিধবার রোদে—দেওয়া কাপড় অশুচি করেছে হতচ্ছাড়া কাক, বুড়ি দোতলার রেলিং ধরে ঝুঁঁকে চেঁচাচ্ছে, বলি নেন্তি, কাকে ছোঁয়া কাপড় মা, রাঁড়ি বলে তো আর মানুষের বাইরে যাইনি, তখন থেকে বলছি, ধো না হয় গঙ্গাজলের ছিটে দে…
হরেন নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।
বোঝা যায় যে, এ বাড়িতে লোকের যাতায়াত বিস্তর। সে যে ঢুকে এসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ গ্রাহ্যই করে না। যেন—বা বাড়ির লোক। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বাড়ির লোক আর বাইরের লোক চেনা ভারি মুশকিল। কেউ অচেনা এলে দাঁড়ালে ছোটোবউ ভাবে বড়োবউ—এর কাছে এসেছে, বাপ ভাবে ছেলের কাছে এসেছে, ভাই ভাবে দাদার কাছে এসেছে। কেউ গা করে না।
গলা খাঁকারি দিয়ে দিয়ে গলায় ব্যথা। বাচ্চাগুলিকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা বৃথা। তারা আরও ব্যস্ত।
মিনিটদশেক ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে একটা চলতি বাচ্চাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে হদিশ পাওয়া গেল। নেত্য থাকে দোতলার ঘরে। ‘ওই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান, ঘর খোলা আছে, কাকামশাই এ সময়ে অঙ্ক কষেন।’ বলে বাচ্চাটা উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
সিঁড়ি চটা ওঠা। হয় সিমেন্ট পায়ে পায়ে উঠে গেছে, নয়তো লাগানোই হয়নি। গোয়াল সকলের, ধোঁয়া দেবে কে?
দোতলার ঘরে নেত্য সামন্তর অফিস কাম বেডরুম। ঘরটায় তক্তপোশ আছে, টেবিল—চেয়ারও। কিন্তু দলিল—দস্তাবেজ, মুসাবিদা আর মামলার কাগজে ছয়লাপ। টেবিল—চেয়ারে ডাঁই, বিছানাও অর্ধেক দখল নিয়েছে কাগজেরা। থলথলে চেহারার কালো মতো নেত্যগোপাল মেঝেয় বসে চৌকির উপর গ্রীবা তুলে জিরাফের ভঙ্গিতে— হ্যাঁ— অঙ্কই কষেছ বটে। আসলে ফর্দ। কীসের ফর্দ তা অবশ্য দেখার চেষ্টা করে না হরেন।
কী চাই আজ্ঞে।
নেত্যগোপাল সামন্তমশাই কি আপনি?
আজ্ঞে।
এসেছিলাম একটু বিষয় ব্যাপারে—
নিত্য বা নেত্যগোপাল ঘাবড়ায় না। নিত্যকর্ম। ফর্দটা মুড়ে রেখে বলে, আসুন।
বসুন। বলে নেত্যগোপাল বিড়ি ধরায়। তারপর বলে বলুন।
একটু বাস্তুজমি।
জমি?
আজ্ঞে। হুবহু নেত্যগোপালের অনুকরণ করে হরেন বলে?
খরচাপাতি কীরকম? এলাকা? তৈরি বা পুরোনো বাড়ি চলবে না?
চলবে, তবে তিনতলার ভিত হওয়া চাই।
নেত্যগোপাল হাসল। হাতের বিড়িটা ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখল একটু। তারপর বলল, যারা বাড়ি করে তারা তিন কী চারতলার ভিতই গাঁথে, সে একতলা বাড়ি করলেও। শেষ পর্যন্ত আর তিন—চারতলা হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগই টাকার অভাবে য—তলার ভিত তার আদ্দেক উঠে ফুরিয়ে যায়। মাটির তলায় বৃথা টাকা খরচ।
হরেন চুপ করে রইল। তিনতলাটা তার চাই—ই।
আমাদের বাড়িরই সেই দশা। মাটির নীচে হাজার পনেরো—বিশ টাকা উপরেতে ঠেঙে ভূতে—পাওয়া বাড়ি। বলে হাসল নেত্যগোপাল।
হরেন হাসল। কারণ নেই। তারপর হঠাৎ দালালের সামনে বেশি হাসা উচিত নয় ভেবে গম্ভীর হয়ে বলল, তবে বাড়ির চেয়ে জমিই ভালো। পছন্দমতো করা যাবে।
কীরকম করতে চান?
একতলায় দুটো দোকানের প্রভিশন থাকবে, আর গ্যারেজ। দোতলায় দুটো ফ্ল্যাট, তিনতলাটা আমার। ওটা—
নেত্য বা নিত্যগোপাল বিড়িটা মন দিয়ে দেখে। চোখ ছোটো, কপালে লম্বা কোঁচকানো দাগ।
শুনছেন? হরেন সন্দেহবশত জিজ্ঞেস করে।
শুনেছি। বলে নেত্যগোপাল।
তিনতলাটায় চতুর্দিকে বারান্দা—টারান্দা হবে, চিলেকোঠার পাশে চারতলায় হবে ঠাকুরঘর।
নেত্যগোপাল শ্বাস ছাড়ল।
কথাবার্তায় আরও সময় গেল খানিক। আগামপত্তর করতে হল কিছু। পেয়ে যাবে হরেন। বর্ষার আগেই ভিত গেঁথে ফেলতে পারবে। নেত্যগোপালের দু—হাতের দশটা আঙুলের নখে নখে কলকাতার মাটি লেগে আছে। কলকাতার জমি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই একখামচা তুলে নিতে পারবে বলে ভরসা হয় হরেনের। একতলার দুটো দোকানঘরের একটাতে বসাবে গবেট বড়ো ছেলেটাকে। গ্যারেজটা অবিশ্যি খালিই পড়ে থাকবে এখন, যদি ভগবান কখনো সুদিন দেন…। গোরু পুষবার বড়ো শখ ছিল তার। হবে না। গোরু, সবজিখেত, হাঁসমুরগি এসবের জন্য মফস্সলের দিকে কাঁদালো জায়গাই পছন্দ ছিল তার, কিন্তু গিন্নির শখ কলকাতায় থাকবে। থাকো তাই। হরেনের গোরু তাই বাদ গেল। একটা শ্বাস পড়ে যায়। বাপ—দাদার সঙ্গে চিরকালের মতো ছাড়ান—কাটান হয়ে যাচ্ছে। যাক। এজমালি সংসারের লোভে মুখখানার হাঁ আর যে বন্ধই হয় না। বাবা গত এগারো বছর বসে আছে, দাদা হাইকোর্টে ফোলিও টাইপ করে বুড়ে হয়ে গেল। পরের ভাই মোটর মিস্ত্রি, তার ওপর লাভ—ম্যারেজের দজ্জাল বউ। থাকা যায় না একসঙ্গে। পয়সাকড়িতে রোজগারে, ওর মধ্যে হরেনেরই যা হোক একটু চিকিমিকি। বউ তাই রোজই সাবধান করে— এই বেলা ভেন্ন হও। নইলে সব তোমার ঘাড়েই হামলে থাকবে।
বুড়োটা নীচের বারান্দায় খেতে বসেছে। বাটিতে চিঁড়ের জাউ কিংবা সাগু— কিছু একটা হবে। সপসপে জিনিসটা হাতের কোষ তুলে ভয়ংকর মুখখানা হাঁ করে সড়াৎ করে টেনে নিচ্ছে। এই বয়সে খাওয়া বাড়ে। বাড়লেই বুঝতে হয়, তিন শেষ হয়ে আসছে। হরেন মুখটা ফিরিয়ে নেয়।
প্রশ্নটা এসে পড়ে মুখে, সামলাতে পারে না হরেন। জিজ্ঞেস করে, তা সামন্ত মশাই তো ইচ্ছে করলেই নিজের মতো একখানা বাড়ি করে ভিন্ন থাকতে পারেন। এই ক্যাঁচকেঁচির মধ্যে থাকা—
নেত্য বা নিত্যগোপাল হাত রসিদটায় চোষ কাগজ চেপে বলে, ভাবি মাঝে—মাঝে বুঝলেন! সাত ভাইয়ের সংসার, ছেলেপুলে মিলে একটা পুরো পল্টন। পয়লা তিন ভাইয়ের বিয়ে দেখেশুনে হয়েছিল, পরের চারজন কোথা থেকে একে একে সব বউ নিয়ে এসে পটাপট ঢুকিয়ে দিল বাড়িটায়। গুষ্টি বাড়ছে। ভাবি বুঝলেন!
আপনি ইচ্ছে করলেই তো হয়।
হয়। এক সদ্যবিধবার জমি পেয়েছিলাম সুবিধামতো। বায়না—টায়নাও হয়ে গেল। ঝপ করে দর পেয়ে ছেড়ে দিলাম। দালালি করার ওই অসুবিধে। দামটা সবসময়ে মাথায় বিঁধে থাকে। নিজের জন্য আর আমি ভাবতেই পারি না। কয়েকবার চেষ্টাও করে দেখেছি। ভাবি, চলে যাচ্ছে যখন যাক। তবে ভাবি মাঝে—মাঝে বুঝলেন! ভাবনাটা আছেই। বলে খুব হাসে নেত্য বা নিত্যগোপাল।
আজকাল আর জয়েন্ট ফ্যামিলি চলে না—
সে তো বটেই! একা থাকার যুগ পড়ে গেল। ছোটো সংসার সুপসাপ ঘরদোর, ছোটো হাঁড়ি, ছোটো পাতিল। এসবই চল হয়েছে। ইচ্ছেও করে খুব।
বুড়োটা হড়হড়ে পদার্থটা তরল করে গোটা দুই রুটি গুড় আর জল দিয়ে মাখছে। দাঁত নেই, তবু জলে গুলে খাবে। খাওয়াটা এই বয়সেই বাড়ে। হরেনের বাবারও বেড়েছে। দিনরাত খাওয়ার গল্প। হরেনের বউ করে খুব বুড়োর জন্য। আলাদা হয়ে উঠে গেলে কষ্ট হবে উভয়তই। বাবাকে কি নিজের কাছে নিয়ে যাবে হরেন? ভেবে আপন মনেই মাথা নড়ে। নেওয়াটা ঠিক হবে না। কেন ঠিক হবে না তা অবশ্য ভেবে পায় না সে। নিজস্ব ঘরবাড়ি, তার মায়া বড়ো সাংঘাতিক। বুড়ো মানুষ ঘরে হাগবে—মুতবে। তাছাড়া, হরেনের বউ—ই একটা জীবন করে গেল হরেনের বাপের জন্য। এবার অন্য ভাইয়ের বউরাও করুক। এসব ভেবেই হরেন আপন মনে মাথা নাড়ে।
নেত্য বা নিত্যগোপাল রসিদখানা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, কথা তখনই পাকা হয় যখন জায়গাটা হয়ে গেল। ভাববেন না চৌধুরীমশাই, টাকা যখন আগাম বায়না নিয়েছি ভাবনা এবার আমার।
হরেন ওঠে। উঠতে উঠতেই বলে, পরের ভাবনা তো ভাবলেনই। আমি ভাবছি আপনার কথা! কত জমি আপনার তাঁবে। লাখোপতি থেকে আমার মতো অভাজন ধরনা দেয়। সকলেরই জোতজমি করে দেন আপনি! অথচ নিজের বেলায়—
নেত্য বা নিত্যগোপাল ভ্রূ কোঁচকায়। অমায়িক মুখে বলে, আমিও ভাবি। ভেবে ভেবে কেটে যাক জীবনটা। আলাদা বাড়ি, আলাদা সংসার তার স্বাদই আলাদা। বউও বলে, খুব বলে। জলে জলে হাত—পা হেজে—মজে যায়, জায়েদের ছেলেপুলে টেনে কাঁখে ব্যথা, প্রলয় উনুনের ওপর বিশাল কুম্ভীপাকে রান্না করে করে মাথাধরার ব্যামো, অম্বল। সবই বুঝি মশাই। কিন্তু মাথার মধ্যে এমন এক দাঁও মারার মতলব বাসা বেঁধেছে যে কী বলব।
আরও দু—চারটে কথা বলে হরেন চৌধুরী বেরোয়।
রকে এসে আবার মুড়িসুড়ি দিয়ে বসেছে বুড়ো। হাতে বিড়ি। তাকে দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, ক—টা বাজে বাপ?
হরেন হাসে! ঘড়ি ঘড়ি টাই জানা চাই, যেন কত অফিস বা সিনেমার বেলা বয়ে যাচ্ছে! ঠাট্টা করে বলে, টাইম জেনে কী হবে খুড়োমশাই? ইষ্টচিন্তা করুন।
সময় কি ফুরিয়েছে বাপ?
হরেন হাসিটা গিলে বলে, বেলা তো ফুরিয়েই এল খুড়োমশাই!
বেলা ফুরিয়েছে? বলে খুড়ো একটু থমকে চেয়ে থাকে। মুখখানা তুবড়ে অদ্ভুত দেখতে হয়। ঠোঁটদুটো ফোকলা হাঁয়ের মধ্যে কচ্ছপের মুখের মতো ঢুকে বেরিয়ে আসে। বুড়ো বলে, এটা কি বিকেল?
তাই বটে।
তবে যে মেজোবউমা বড়ো চিঁড়ের জাউ খাওয়ালে? অ্যাঁ! জাউ তো আমি সকালে খাই। বিকেলে আজ হালুয়া খাব বলেছিলাম যে? অ্যাঁ!
হরেনের একটু কষ্ট হয় বুকের মাঝখানটায়। বলে, খাবেন, তাই কী? খাওয়া কী একদিনের?
চিত্ত সুজি এনে রেখেছিল, আমি নিজের চোখে দেখেছি। সে তাহলে ওই গর্ভস্রাবগুলিকে খাইয়েছে। বাপ ঝুব্বুস হয়ে বসে আছি,— এখন কে আর দেখে আমাকে! চিঁড়ের জাউ আমার বেহান বেলায় খাওয়ার কথা— নেত্যর বউ কিছু খেয়াল রাখে না বাপ। সাত—সাতটা বউ ইয়ের কাপড় মাথায় তুলে দিনরাত্তির ছেলেগুলিকে গেলাচ্ছে। বিড়িটা ধরিয়ে দাও তো বাপ, হাত বড্ড কাঁপে—
হরেন চৌধুরী গয়েশের বিড়িটা ধরিয়ে দেয় যত্ন করে। একটু হেসে বলে, হিসেব সব মেলে খুড়োমশাই?
হিসেব! কোন হিসেবের কথা বলছ?
এই যে আপনি গয়েশ সামন্ত, আপনার সাতটা ছেলে, সাত বউ, কত নাতি—নাতনি, তারপর এটা বেহান বেলা না সাঁজবেলা— এসব হিসেব?
বুড়ো বিড়িটা টেনে কাশতে কাশতে গয়ের তোলে গলায়। হাঁপির টান। বিড়ি খাওয়া বারণ নিশ্চয়ই, লুকিয়ে—চুরিয়ে খায়। খাওয়াটা আসল।
মেলে না বাপ ভুল পড়ে যায়। এই একটু আগে একজন কার খোঁজ করছিল।
আমিই।
হবে। বলে বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে। হরেন কান পেতে শোনে। বুড়ো হিসেব মেলাচ্ছে— আমি হলুম গে গয়েশ সামন্ত… সামন্ত বাড়ি… বড়ো ছেলে চিত্ত, মেজো নিত্য, আর কতকগুলি…
হরেন ঘড়িটা দেখে নিয়ে হাঁটা দেয়। রেললাইন বরাবর হেঁটে প্ল্যাটফর্মে ওঠে। পাঁচটা পাঁচে ট্রেন। সিগন্যাল দেয়নি এখনও। প্ল্যাটফর্মে কালো কালো কিছু মেয়ে—পুরুষ আর বাচ্চা সংসার পেতে আছে। পোঁটলা—পুঁটলি, ইটের উনুন, কৌটোর মগ ছত্রাকার। উকুন বাচছে, ছেলে ঠেঙাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। বিশ—ত্রিশখানা রুটি রোদে শুকোয় এরা কে জানে! একটা বাচ্চা হামা দিয়ে এসে হরেনের জুতো ধরে ফেলেছে। হরেন ঠ্যাং টেনে নেয়। সংসারটার দিকে একটু চেয়ে থাকে। ভারি নিশ্চিন্ত হাবভাব, দুনিয়াজোড়া জমি ওদের। যেখানে—সেখানে বসে যায়।
শীতের বেলা। রোদ মরে গিয়ে এ সময়টা বাতাসটা ভারী হয়ে ওঠে। মাটির ভাপ না ধোঁয়া মেঘের মতো গড়ায় মাটির ওপর। ওর ভারী বাতাস। দুঃখের শ্বাসের মতো জমে আছে পৃথিবীর ওপর।
সামন্তমশাই পাকা লোক। জমি একটা পেয়েই যাবে সুবিধেমতো। বর্ষার আগেই ভিত গেঁথে ফেলবে। ভারি একটা আনন্দ হয় হরেনের।
আবার কী জানি কেন রোদমরা বিকেলটার দিকে চেয়ে বুকটা হঠাৎ ঝাঁৎ করে ওঠে। কী একটা যেন মনে হয়, একটু ভয়—ভয় করে। বুকটায় বগড়ী পাখির মতো কী একটা গুড়গুড় করে ডাকে। পেটটা পাকিয়ে ওঠে।
ভিখিরিদের সংসার, প্ল্যাটফর্মের কৃষ্ণচূড়া গাছ, দূরের সিগন্যাল— এসবের ওপর দিয়ে আকাশ আর জমির মাঝ—বরাবর একটা অদ্ভুত আলো—আঁধারি ঘনিয়ে আসছে। ট্রেন রেল—পুল পেরিয়ে আসছে। হরেন চৌধুরী গাড়ির শব্দটা ঠিক শুনতে পায় না। সেই আলো—আঁধারিটার দিকে অন্যমনে চেয়ে থাকে।