শেল্টার

শেল্টার

জায়গাটার নাম বলা বারণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যেমন, এখনো ঠিক তেমনি সংকটময় অবস্থান। মালিক বদলায়, জায়গা বদলায় না। এইটুকু বলি যে ভারতের উত্তর-পুব কোণের নাকের ডগা। দুদিকে ভারত, একদিকে বাংলাদেশ, একদিকে বর্মা। চারদিকে পাহাড়। সেইসব পাহাড়ের চাইতে উঁচু এই পাহাড়। ঠিক যেন ঝাণ্ডা তুলে বলছে— এই দেখ, এইখানে আমি! কী করতে পার, কর।

চমৎকার জায়গা। যেমনি অবস্থান, তেমনি আবহাওয়া। মশা নেই, মাছি নেই, আরশুলো নেই। তবে হ্যাঁ, সাপ আছে, শুঁয়োপোকা আছে; গুবরেপোকা, মাকড়সা, মৌমাছি, বোলতা, বনের গহনে ছোট ছোট রঙের ভালুক, বুনো কুকুর যারা নেকড়ের মতো হিংস্র, প্রকাণ্ড বাদুড়, প্যাঁচা, অজস্র পাখি— এ সমস্তই আছে। প্রকৃতির লীলাভূমিতে এরা থাকবে না-ই বা কেন? মানুষই বরং পরে এসেছে।

বন-সম্পদের তুলনা হয় না। ঝাউ, সরল, তুঁতফল, বাঁশঝাড়। গাছের ডালে অর্কিড ঝোলে। সেকালে সায়েবরা বিলিতী ফলের গাছ পুঁতেছিল— আপেল, পিচ, এপ্রিকট, ন্যাসপাতি। আরো নিচে আনারস, বাতাবি। তাছাড়া বাজারে বিদেশি জিনিস উপচে পড়ছে, খোদ্দেরে গমগম করছে। বেআইনী ছাড়া আবার কী! বলিনি স্রেফ নন্দনকানন!

অসীমের বড় মামা হলেন বন-বিভাগের মাঝারি কর্তা। ওইখানে সর্বেসর্বা। তিনি লিখলেন, “চলে আয়। স্বর্গের সঙ্গে কোনও তফাৎ নেই। কখনো যাইনি অবিশ্যি সেখানে। আমার কোয়ার্টারটাও একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার, অল্পদিনের মধ্যেই হয়তো স্বর্গীয় হয়ে যাবে। দেখতে চাস তো এই বেলা আয়। তাছাড়া চারদিকটা রহস্যে গজগজ করছে। নেহাৎ আমার সময় নেই। তোর শ্যামরতনদা এলে হাতে চাঁদ পাবেন। তাঁকেও আলাদা লিখছি। মোট কথা দুজনে চলে আয়। ইতি। বড় মামা। পুঃ— ছোড়দিকে বলে আমার জন্য আমসত্ত্ব আনিস। ঐটে পাইনে।”

কাজেই চলে গেল অসীম। একাই গেল। প্রায় ষোল বছর বয়স, ইলেভেনে পড়ে, যাবে না-ই বা কেন? শ্যামরতনদাদের বাড়ি রং হচ্ছিল। বললেন পরে যাবেন। অসীমের যদি সত্যি ভূ-বিদ্যায় আগ্রহ থাকে তাহলে এমন সুযোগ ছাড়ে না যেন। নাকি প্লেনে গেলে সুবিধা হত। সুবিধার সঙ্গে অসীমের কী? সুবিধার বড্ড খরচ। খানিকটা রেলে, পাহাড়ি পথে বাসে, তাই বা মন্দ কী। বেশ দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া গেল। পথটা খুব ভালো ছিল না, দেড় ঘণ্টা লেট্‌ হল। বড়মামা বাস আপিসে জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঐ বাসেই ওঁদের কিছু ওষুধপত্রও এল।

ঐ জিপে করে পাহাড়ের আরো খানিকটা ওঠা গেল। বন-বিভাগের ঘরবাড়িগুলো সুরক্ষিত বনের গা ঘেঁষে। সব কিছুর কেমন বিদেশি চেহারা। বড়মামা বিয়ে-থা করেননি। বিধবা বড় মাসিই বাড়ির গিন্নি। বেশ রেগে ছিলেন। বোধহয় লেট্‌ দেখে ভাবনা হচ্ছিল। অসীম প্রণাম করতেই চুক্‌ করে একটু আদর করে বললেন, “তাও ভালো। ভাবলাম আরো দুজন বুঝি নিখোঁজ হল।” অসীমের দু’কান খাড়া। বড়মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আঃ, দিদি! কী যে বাজে বক! ছেলেটা রেলেও বিশেষ খাবার-দাবার পায়নি।”

আর বলতে হল না। সঙ্গে সঙ্গে মাঝের ঘরের গোল টেবিলে ভুনি খিচুড়ি, আলু-মটরের চচ্চড়ি, বুনো হাঁস ভাজা আর শেষে বড় বাটি করে খোবানি দেওয়া ক্ষীর! বড়মাসি বললেন, “এই মগের মুলুকের একটা সুবিধা হল সারা বচ্ছর শীতের তরকারি পাওয়া যায়।”

খেয়েদেয়ে উঠতেই পশ্চিমের পাহাড়ের পেছনে সূর্য নেমে গেল, সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার। বড়মামা চিঠিপত্র নিয়ে বসলেন। অসীম সোয়েটার গায়ে দিয়ে ঘুরঘুর করে বাংলোটা দেখতে লাগল। এ ধরনের বাড়ির কথা আগেও শুনেছিল। একতলাটা দোতলার সমান উঁচুতে, বড় বড় গাছের গুঁড়ির ওপর বসানো। এমনি পাকা কাঠ যেন শক্ত পাথর, সহজে পেরেক ঢোকে না। চারদিকে জালে ঘেরা চওড়া বারান্দা। নিচের থেকে মজবুত কাঠের সিঁড়ি ঐ বারান্দায় উঠে এসেছে। সেটাকে আবার কপি-কলের সাহায্যে ভাঁজ করে তুলে ফেলা যায়। ভারী ইন্টারেস্টিং। বারান্দায় পড়ার টেবিলে বসা বড়মামা শীতের চোটে উঠে পড়লেন। বললেন, “সেকালে বুনো জানোয়ারের উপদ্রব ছিল তাই এই ব্যবস্থা। নিচে সায়েবদের টবের ফুলের সংগ্রহ দেখিস কাল সকালে। টবে স্ট্রবেরি করেছিল। মাশরুম করেছিল। এখনো হয়। যাই বলিস ব্যাটাদের গুণ ছিল। টিনের চালের তলা থেকে ঐ যে সারি সারি অর্কিড ঝুলছে, ওগুলোর বয়স কম করে পঞ্চাশ বছর! লং ডে হয়েছে তোর, এবার শুয়ে পড়া যাক। জানলায় জাল লাগানো, কাজেই বাদুড় ঢুকবে না। তবু বালিশের নিচে টর্চ রাখিস।”

ব্যস, এক ঘুমে রাত কাবার। চওড়া বারান্দায় পুবের রোদ। বড়মামা ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন। ভুট্টার পরিজ, ঘন লালচে দুধ, বিচি-ওয়ালা মিষ্টি কলা, টোস্ট, মাখন, ডিম সিদ্ধ, মাসির হাতের জ্যাম। বড়মামা বললেন, “বোস, খা। সারা রাতের না-খাওয়ার পর সকালে এইসব পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হয়। সকালে খাটবি। দুপুরে বড়দির ঘণ্ট চচ্চড়ি— সেগুলোও নট ব্যাড, এই আমি বলে দিচ্ছি— বিকেলে স্রেফ্‌ এক পেয়ালা চা, রাতে আর্লি ডিনার। তাহলে ৪৭ বছর বয়সেও আমার মতো ইয়ং থাকবি!” এই বলে সত্যি সত্যি নিজের বুকে গুমগুম করে দুটো কিল বসিয়ে দিলেন।

কাজে যাবার আগে বলে গেলেন, “সকালে বাড়ির চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখিস! লাঞ্চের পর সংরক্ষিত বনে নিয়ে যাব। আমার টোবি কুকুরটাকে সঙ্গে নিস, পথ হারালে খুঁজে দেবে।” এই বলে একটা টাট্টু ঘোড়া চেপে পাহাড়ে পথ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দুজন লোক সঙ্গে গেল।

বড়মামা চোখের আড়াল হলেই, মাসি বললেন, “তাই বলে শেল্টারের দিকে যাস না যেন।” অসীম অবাক হল, “শেল্টার? সে আবার কী বড়মাসি? মামু তো কিছু বললেন না।”

“তা বলবে কেন শুনি? বললেই তো সেখানে ছুটবি। যার কথা অজানা তাকে তো আর কেউ দেখতে যায় না। চালাক কম নাকি ঐ ছেলে! কিন্তু আমিও বলি যাসনে বাপু।”

“সব জিনিস দেখা ভালো। যাব না-ই বা কেন।”

“আরে সাপখোপ কত, আর তার চেয়েও খারাপ জিনিস আছে। তা ছাড়া পথও চিনিস না। কেউ যায়ও না ওদিকে। একা তো নয়ই।”

“একা তো যাচ্ছিনা, টোবি সঙ্গে যাচ্ছে।” মাসি চটে গেলেন, “পুরুষমানুষদের ভালো কথা বলা কেন! যা খুশি কর গে যা। তবে মোজা পায়ে দিস আর ওই সেঁপো লাঠিটা নিস।”

সেঁপো-লাঠিটা কোনো মজবুত লতার শেকড় দিয়ে তৈরি মনে হল। মুণ্ডুটা অবিকল সাপের মতো দেখতে। ওটা নেওয়া মন্দ হবে না। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসতেই দেখি লালবেহারী চৌকিদার ঝাঁকড়াচুল লাসা টেরিয়ার টোবিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকেও বড়মাসি কিছু বলে থাকবেন।

টোবির বকলস থেকে চেন খুলে অসীমের হাতে দিয়ে লালবেহারী বলল, “একতলার টবের বাগান, অর্কিড, সামনের বাগানের বিলিতী ফুলগাছ দেখে যান— গোড়ায় সায়েবরা লাগিয়েছিল। বছরে বছরে তার বিচি থেকে মালি নতুন চারা তোলে। ঐ মালিকেও সায়েবরা ট্রেনিং দিয়ে গেছে। তখন গাছে জল দেনেওয়ালা ছোকরা ছিল। এখন গোঁফ পেকেছে। তবে ফুলবাগানে কারো ঘোরা পছন্দ করে না।”

বাস্তবিকই তাই। মাথায় সাড়ে চার ফুট, পাকা দড়ির মতো চেহারা মালির। বাগান থেকে অসীমকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। ওরই মতো চেহারার আরেকটা লোকও ছিল। সে বলল, “এখানে কেন? যাও না ওপরে শেল্টার দেখে এসো। জব্বর জিনিস। ঐখানে সায়েবরা শেষ ঘাঁটি করেছিল। সবাই বলত তোজি পল্টন নিয়ে এই এল বলে! বোমা পড়বে। সব তচনচ হবে। সায়েবরা তখন জিনিসপত্র নিয়ে ওই শেল্টারে গিয়ে উঠল।”

অসীমের বেজায় কৌতূহল, “গেছ নাকি তোমরাও ওখানে? বল না কী ব্যাপার!” বুড়ো তো তাই চায়। তড়বড় করে এগিয়ে এসে বলল, “চল তোমায় এগিয়ে দিই। যাইনি আবার ওখানে! দিনে চল্লিশ বার যাওয়া-আসা করে জান বেরিয়ে যেত। ঘড়ি ঘড়ি বোতল লাও, সোডা লাও, মুরগি রোস্ট লাও। ক্লাস সিক্স অবধি পড়েছিলাম তো, ইংরেজি সড়গড় ছিল। আমাকেই সব বলত। হরকু মালির পিঠে জিনিস চাপিয়ে নিয়ে আসতাম।”

“তুমি এখানে কী করতে? পল্টনে ছিলে নাকি?” মংলু লোকটার কী হাসি৷ “আমি লিখতে পড়তে জানি, আমি পল্টনে যাব কেন? তাছাড়া ওই গোলাগুলির মধ্যে যেতে লামা মানাও করেছিলেন। আমি এখানে রসদ জোগাতাম। নিচে বাবার দোকান ছিল। হিসাবও রাখতাম। এখনো পেনশন পাই মিলিংটারি থেকে। নিচে দোকানদারিও করি। কিন্তু কথা বলবার লোক পাই না, তাই ওপরে আসি। আরও উঠবে নাকি?”

অসীম অবাক হল। “সে কী! শেল্টারে যাব না আমরা?” বুড়ো থমকে দাঁড়াল, “ও বাবা! আমি যাচ্ছিনে, আমার পায়ে গুপো আছে। শেল্টারে দেখবার আছেই বা কী? পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা। তার ধারে ধারে পাথর কেটে তাক করা। লোহার কড়ি-বর্গা দিয়ে ছাদে ঠেকা দেওয়া। এই যে খুদে নালাটা দেখছ, ওটাও ঐখান থেকে উঠেছে। ঝোপেঝাড়ে গুহার মুখ এমনি আড়াল করা যে উড়ো জাহাজ থেকেও কিচ্ছু মালুম দেয় না।

সবার কী ভয়! ঐ নেতাজি আসছে! লক্ষ লক্ষ জাপানী আর বন্দুক বোমা নিয়ে। ওপরে উড়োজাহাজ, ডাঙায় সেপাই আর স্নাইপার। ওরা জাদু জানত তা জান? বনের মধ্যে একবার ঢুকলে বেমালুম নিখোঁজ হয়ে যেত। এখানকার গ্রামবাসীরা সবাই ওদের দলে ছিল। নানাভাবে সংকেত দিত।’

অসীম বলল, “কী করে? দাঁড়াও একটু টুকে নিই।”

মংলু বিগড়ে গেল, “কিছু টুকেছ তো এই আমি চললাম। ও-সব চালাকি আমার জানা আছে। আমি কিছু সায়েবদের মিলিংটারি গোপন কথা বলিনি, বাবু।” অসীম বলল, “অত ভয় কীসের? ও-সব ১৯৪৭ সালে চুকেবুকে গেছে। এখন আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমাদের নিজেদের মিলিটারি, নেতাজির নামে পথঘাট হয়েছে, ওঁর মূর্তি আছে নানা জায়গায়— এখন সায়েবদের সে মিলিংটারি আর নেই।”

মংলু বলল, “শুনেছি। হতেও পরে তাই। সায়েবরা তো আর আসে না এদিকে। জিনিসপত্রের দামও বড্ড বেশি। মোট কথা আমি আর ওপরে যাচ্ছি না। তুমিও যেও না। কেউ যায় না। জায়গাটা খারাপ!” এই বলে দে-দৌড়!

খারাপ! এমন ভালো জায়গায় কেউ যায় না। এখান থেকে বাইনকুলার লাগালে একশো কিলোমিটার দেখা যাবে। এইখান থেকে বন শুরু। এটা বড়মামার সংরক্ষিত বন নয়। সেটা অনেক নিচে। আসবার সময় জিপে তার মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর। নানা জন্তু দেখা যায়। দেখেনি ওরা কিছু অবিশ্যি।

তবে কি যাবে না একা একা? একা মোটেই নয়। টোবি ছুটতে ছুটতে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। অগত্যা অসীমও চলল। গাছে ছাওয়া পথ, নিচের মাটি স্যাঁৎসেঁতে। গাছের গায়ে বুড়োদের দাড়ির মতো লাইকেন। এক-হাত চওড়া আধখানা থালার মতো ব্যাঙের ছাতা। আড়ালে খুদে ঝরনা লাফিয়ে নামছে, সব সময় কানে আসছে একটা ঝরঝর শব্দ। দেখা যাচ্ছে না।

পায়ে চলা পথে আগাছা হয়েছে। কেউ যায়নি এ পথে হয়তো ৪০ বছরের বেশি। খোলাখুলি না বললেও, মনে হয় এদের সব অশরীরীদের ভয়, স্রেফ ভূতের ভয়। তা এখানে কেন? এখানে তো আর ঝাঁকে ঝাঁকে নির্দোষ লোকদের কেউ মারেনি যে ছায়া হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু টোবিও একটু রোদ দেখে শুয়ে পড়ল।

শ্যামরতনদা এ রকম কথা শুনলে চটে যান; বলেন, “তাই যদি বল, কোন জায়গাটাতে ভূত নেই শুনি? ভূত অর্থাৎ মরা মানুষের আত্মা। তাদের শরীরগুলো তো পঞ্চভূতে মিশে যায়, তা সে পোড়াও আর পোঁত আর যাই কর। জান নিশ্চয়, বস্তুর এক কণাও নষ্ট হয় না। আগেও যতখানি ছিল পরেও ততখানিই থাকে। বরং বাড়ে বলতে পার, কারণ মহাকাশ থেকে সারাক্ষণ ঝুরঝুর করে মিহি বস্তুর গুঁড়ো অদৃশ্যভাবে পড়ছে তো পড়ছেই। শরীরের ধ্বংসাবশেষ নষ্ট হয় না আর শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখত যে শক্তি— তাকে আত্মাই বল কি যাই বল— সে ফুরিয়ে যায়!! এ কি একটা কথা হল? থাকবেই তো। চারদিকে গিজগিজ করে থাকবে। হয়তো মিলে গিয়ে একটাই বিরাট আত্মা হয়ে থাকবে। তাই বলে তাকে ভয় পাবি? তুই তাকে না ঘাঁটালে সে কিছু বলেও না, করেও না। তোর সহযোগিতা ছাড়া কিচ্ছু হয় না। খনিজ সম্পদ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি, এর বেশি জানি না।”

অসীমেরও তাই মনে হয়। এবার সে শেল্টারের ছায়ায় ঢাকা পথ ধরল। থাক পড়ে টোবি। ভূতের ভয় না আরো কিছু! স্রেফ কুঁড়েমি। সাবধানে উঠতে হচ্ছিল। পথের ওপর গোল গোল নুড়ি ছড়ানো। পা হড়কাবার ভয়। হয়তো কোনো কালে ছোট ঝরণাটা এই খাতে বইত, তারি নুড়ি। নয়তো মিলিটারি সায়েবরা ইচ্ছা করে ছড়িয়েছিল। যাতে কেউ এলে জানান দেয়। শত্রুরা যদি সত্যিই পাহাড় ভেদ করে বর্মা থেকে এসে হাজির হয়, এই শেল্টারটি হবে সায়েবদের শেষ আশ্রয়। কে জানে এর মুখটা বন্ধ করার কোনো উপায় থাকাও অসম্ভব নয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে কখন পথের শেষে পৌঁছে গেছে অসীম, নিজেই টের পায়নি। সামনে একটা স্বাভাবিক পাথরের দেয়াল। সেইখানেই পথ শেষ। তা হলে শেল্টারটা কোথায় গেল? উচিত ছিল পাথরের দেয়ালের আড়ালে, একটু উঁচুতে ঢুকবার রাস্তা করা। পাথরের খাঁজে দূরে দেখবার জন্য লুক-আউট রাখা। এই কথা ভাবতে ভাবতে ক্যাম্বিসের জুতোপরা পা পাথরের খাঁচে খাঁচে রেখে অসীম উঠে পড়ল। বেঁচে থাক অযোধ্যা পাহাড়ের ট্রেনিং।

ঐ উঁচু পাহাড়টা একটা স্বাভাবিক দেয়ালের মতো, ঠিক যা অসীম মনে করেছিল। ওতে ছোট ছোট ফাঁক আছে, অনেক দূরে চোখ যায়। বন্দুকের নলও যায়। ওপরে লতাগাছ একটা ছাদ তৈরি করে রেখেছে। জংগুলে ছাদ। প্রায় চল্লিশ বছরে যতটা হয়। পাথরের আড়ালে শেল্টারের মুখ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে স্বাভাবিক। সম্ভবত সত্যিই তাই। তবে তার ওপর যে কারিগরি করা রয়েছে, ভেতরে ঢুকতেই সেটা বোঝা গেল। শক্ত পাথর কংক্রিটের থাম্বা দিয়ে ছাদ ঠেকানো। মেঝেটা পাথরের চ্যাপ্টা চাঁই দিয়ে বাঁধানো, দেয়ালের কাছে জল বেরোবার নালি। ভেতর থেকে বাইরের দিকে ঢালু। বোমা ঠেকাবার ব্যবস্থা, তাই বলা বাহুল্য জানলা নেই। ঢুকবার দরজাতেও লোহার পাতের গেট বসানো। এখন অবিশ্যি খোলা। সব খালি ভোঁ— ভাঁ করছে।

ভেতর দিকে দরজার মাথায় পাথরের মাচার মতো। ব্যালকনিও বলা যায়। তাতে দুটি জানলা কাটা। তার লোহার পাল্লা খোলা। আলো আসছে। অসীম পাথরের গায়ে কাটা সিঁড়ি দিয়ে ব্যালকনিতে উঠে, জানলার কাছে গেল। পাথরে কাটা বসবার জায়গা। পাথরের তাক, পাথরের টেবিলের মতো।

জানলা বেশি উঁচু না। খুব চওড়া। দাঁড়ালে অসীমের মুণ্ডুটা তার ওপরে থাকে, কিচ্ছু দেখতে পায় না। পাথরের সিটে বসলে, গুহার সামনের পাথরের দেয়ালের ওপর দিয়ে দূর দিগন্ত অবধি চোখে পড়ে। বাইরে মাথার ওপরের পাথর একটু ঝুঁকে পড়েছে, তাই জানলাটা বাইরে থেকে চোখে পড়ে না।

এমন চমৎকার কারিগরি দেখে অসীম মুগ্ধ। সাধে কি আর ইংরেজরা অর্ধেক পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করেছে। কীরকম কার্যকরী মাথা ওদের।

হঠাৎ নাকে একটা চেনা সুগন্ধ এল। অসীম চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল। অন্য জানলার সিটে খাকি শার্ট প্যান্ট পরা কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা একটা গোরা! বছর ৬৫ বয়স হবে, পাকানো দড়ির মতো মজবুত শরীর। পাটকিলে চোখ, ঠোঁটে মৃদু হাসি। এখানে লোকের আনাগোনা আছে তাহলে। বন-বিভাগের এলাকা ছাড়াও অন্য পথ আছে নিশ্চয়। বেশ লাগল মানুষটিকে। বললেন, সমস্ত সমতলটা একটা মস্ত খাতার খোলা পাতার মতো। ঐখানে গাঁয়ের লোকরা সুভাষের জাপানি উড়োজাহাজের ঝাঁককে পথের নিশানা দিত।”

“কেমন করে দিত?”

“সে এক মজা। চারদিকে মিলিটারি গিজগিজ করছে। তারি মধ্যিখানে কাপড় কেচে ধোপারা একটা তীরের আকারে কাচা কাপড় শুকোতে দিত। যেদিকে ব্রিটিশ সৈন্য আছে, সেদিকে তীরের ফলা। তবে এই শেল্টারের কথা কেউ জানত না, এ বড় গুহ্য ব্যাপার ছিল। ছাদ অবধি বোমা বারুদ, গোলাগুলি জমা করা থাকত, এ আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

অসীম অবাক হল। তবে হতেও পারে। লোকটির হয়তো তখন ২৫ বছর বয়স ছিল। পাইপে দু-চারটে টান দিয়ে, ভকভক করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “অবিশ্যি এ-ভাবে পারেনি সুভাষ। অন্যভাবে জিতেছিল। ব্রিটিশরাজ পাততাড়ি গুটিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। আমাকেও গা-ঢাকা দিতে হয়েছে, সেই ইস্তক।”

অসীম বলল, “কেন?” লোকটি হাসলেন, “ওদের নুন খেয়েছি, বিশ্বাসঘাতকতা করতে তো আর পারা যায় না। খবর সরবরাহ করতাম। সবাই জানত খ্যাপা বিশুবাবু ওষুধ বিক্রি করে। লোকের মন ভাঙাবার জন্য মেলা টাকা দিয়েছিলেন স্টিল ওয়েল। তাঁর নাম শুনেছ বোধহয়? বীরত্বের আদর্শ ছিলেন। এ-কথা একশোবার বলব। অকালে মরেও গেলেন। বীররা বাঁচে না বেশি দিন। আমারও মাজা ভেঙে গেল। লড়াই শেষ হলে দেখি লক্ষ লক্ষ টাকা আমার হাতে রয়েছে।

অসীম তো হাঁ! টাকা? কোথায়?

ঐ তো তোমার মাথার ওপর, পাথরের ওই কুলুঙ্গিটার একেবারে ভিতরে। কেউ ওর খোঁজ পায়নি।’

“আপনি নিয়ে নিলেন না কেন? ওর তো দরকার ছিল না।”

মানুষটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “যুদ্ধে যে জয়ী হয়, এসব তার প্রাপ্য। দেশের প্রাপ্য। আমাকে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলতে পার, কিন্তু একটু আদর্শবাদী আছি। খোলাখুলি মুখ দেখাবার উপায় নেই আমার। তুমিই এই কাজটি করে দাও। আছ কোথায়?”

অসীম বড়মামার কথা বলতেই তিনি খুশি হয়ে গেলেন, “তবে তো ভালো কথা। খ্যাপা বিশুদা বললেই সে আমাকে চিনতে পারবে। বলবে তো?”

অসীম বলল, “নিশ্চয়।” ভারি ভালো ভদ্রলোক। কোথায় থাকেন, কী খান কিছু জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা হল। কথা দেওয়াতে ভারি নিশ্চিন্ত হলেন। সঙ্গে নিয়ে সমস্ত শেল্টারটা ঘুরিয়ে দেখালেন। কোথায় রসদ থাকত, বিছানাপত্র, কাপড়চোপড়, ওষুধ, অস্ত্র সব দেখালেন। শূন্য খাঁ খাঁ করছে। যুদ্ধ থামতেই যত রাজ্যের লুটেরা এসে চেঁচেপুঁছে সব নিয়ে গেছে। কুলুঙ্গির অন্ধকার মুখটা পাথর দিয়ে বন্ধ থাকাতে কারো চোখে পড়েনি। টাকাগুলো বেঁচে গেছে।

ততক্ষণে বেলা বেড়েছে, অসীমকে যেতে হয়। ওকে গুহার মুখ অবধি এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। এবার অসীম বলেই ফেলল, “চলুন আমার সঙ্গে নীচে। মাসিমার রান্না খেলে খুশি হবেন।” মাথা নাড়লেন। “সেই ইস্তক আগলাচ্ছি ওগুলো। ওর একটা বিহিত না করে আমার ছুটি নেই।” খাকি রুমাল নেড়ে বাই-বাই করে দিলেন।

শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেমে এল অসীম। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই যেমনি অবাক, তেমনি খুশি। শ্যামরতনদা বেতের চেয়ারে বসে বড়মামার সঙ্গে গল্প করছেন। তাড়া খেয়ে চানের ঘরে গিয়ে গায়ে মাথায় দু-মগ গরম জল ঢেলে, খাবার টেবিলে অন্যদের সঙ্গে জমায়েৎ হল।

বড়মামার আপিসের এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাই বুদ্ধি করে খাবার টেবিলে কিছু বলেনি অসীম। লোকটি এতকাল পালিয়ে বেড়িয়েছেন, এখন তাঁর অনিষ্ট করা অসীমের পক্ষে সম্ভব নয়। বড় ভালো লেগেছিল; তা হতে পারেন স্টিলওয়েলের ভক্ত। কিন্তু খাবার পর বড়মাসি যখন কাজ সেরে নিজে খাওয়াদাওয়া করতে চলে গেলেন, অসীম মুখে একটু ভাজা-মশলা ফেলে বলল, “খ্যাপা-বিশুদা বলে একজনের সঙ্গে দেখা হল।” বড়মামার হাত থেকে পান পড়ে গেল।

“কী যা-তা বলছিস! কোথায় দেখা হল?” তখন অসীম সব কথা খুলে বলল। একটা পিন পড়লে শোনা যায়। অসীম আরো বলল, “উনি চান ওই টাকা এনে দেশের কোনো কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়া হোক। নইলে ওঁর ছুটি নেই।”

বড়মামার মুখে কিছুক্ষণ কথা নেই। কিন্তু— কিন্তু উনি তো যুদ্ধের পর থেকেই নিখোঁজ! “চিনতে তাহলে?” কাষ্ঠ হাসলেন বড়মামা, “বাঃ, বিশুদাদাকে চিনব না? বাবার নিজের কাকা, যদিও সমবয়সী। সায়েবদের সঙ্গে ভিড়লেন। দেশের লোক ছি-ছি করত, এ আমার স্পষ্ট মনে আছে, যদিও তখন নিচের ক্লাসে পড়তাম। আছেন তাহলে এখনো! কী করা যায় বলুন দিকি শ্যামরতনদা?”

শ্যামরতনদা মুচকি হসলেন, “করবে আবার কী? চল, দুপুরে কাজকর্ম নেই এই সময়ে টাকাগুলো নিয়ে আসি। ওই খ্যাপা বিশুর সঙ্গে আলাপ করলে নিশ্চয় অনেক প্রত্যক্ষদশীর বিবরণী পাওয়া যাবে।”

গেলেন ওঁরা দুজন আর অসীম। বারণ সত্ত্বেও ওখানে গেছিল বলে কেউ অসীমকে বকলেন না। কিন্তু খ্যাপা বিশুর সঙ্গে দেখা হল না। কেউ ছিল না ওখানে। তবে অসীম ছোট একটা সাবল নিয়ে গেছিল। জানলার ওপরে যেখানটা ভদ্রলোক দেখিয়েছিলেন, সেখানে জোরসে দুটো খোঁচা দিতেই, ঝুরঝুর করে একরাশ নুড়ি, পাথরের কুচি, ভাঙা সিমেন্ট বেরিয়ে এল। তার পেছনের কুলুঙ্গিতে হাত গলাতেই একটা ভারি ওয়াটারপ্রুফ থলি বেরোল। সোনার মোহরে ঠাসা। ওই সময় ঘুস নিতে হলে নাকি কাগজের টাকা কেউ ছুঁত না। শ্যামরতনদা বললেন।

আর বেরোল বাঁকা একটা বিলিতী পাইপ। পাইপটার মুখের কাছে একটা সাদা দাগ। সকালেও অসীম সেটা লক্ষ করেছিল। আস্তে আস্তে সে পাথরের সিটে বসে পড়ল। পা কাঁপছিল।

অনেকক্ষণ পরে বড়মামা বললেন, “তাই বলি ১৯৪৩ সালে বিশুদাদার ৬৫ বছর বয়স ছিল। পাকা দড়ির মতো শরীর, খাকি শার্ট পেন্টেলুন পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গুপ্তচর বলে কেউ সন্দেহও করত না। ছোটবেলায় দেখেছি।”

তারপর অসীমের দিকে ফিরে বললেন, “তা হলে এখন তাঁর বয়স কত হয়? ১১২ না?”

অসীমের সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। শ্যামরতনদার মুখের দিকে তাকাতেই তিনি ওর পিঠে একটা হাত রেখে বললেন, “কী হল?” অসীম বলল, “তবে কি উনি সত্যি নন? শুধু ছায়া? স্পষ্ট দেখলাম, থুতনিতে কাটার দাগ, আইডিন লাগানো। আর এই টাকাগুলো, ঐ পাইপ, এ-সব তো বাস্তব।”

শ্যামরতনদা হাসলেন, “কাকে ছায়া আর কাকে বাস্তব বলবি জানিনে। বালিগঞ্জে আমাদের বাড়িতে সারি সারি কাচের জানলা। তার ভেতর দিয়ে মাঠের ওপারের সত্যিকার নতুন বাড়ি দেখা যায়, তৈরি শেষ হয়নি, খালি, রাতে ভুষো অন্ধকার। ওই জানলার কাচেই দেখতে পাই দূরে মোড়ের মাথার আলোজ্বালা লোক-গমগম বাড়ির ছায়া। ভুষো অন্ধকারময় খালি বাড়ি আর লোকজন-ভরতি আলোজ্বালা বাড়ি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোনটা সত্যি কোনটা ছায়া চিনতে পারি না। কাচের জানলা খুলে তবে বুঝতে পারি কোনটা কী। এবার ওঠ, ওঠ শিবু, উনি যা যা বলেছেন সেই মতো কাজটা তো করে ফেল!” হঠাৎ অসীমের মনটা ভালো হয়ে গেল। “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলা যাক, মাসি দুধপুলি করেছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *