শের-এ-কাশ্মীর
ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) নেতারা এখনও বলেন, আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে শেখ আবদুল্লাহর অবদানের ওপর। আবদুল্লাহর বড় ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ কাশ্মীরের চিফ মিনিস্টার ছিলেন। তার ছেলে ওমর আবদুল্লাহও চিফ মিনিস্টার ছিলেন ২০০৯-১৪ সময়ে। বর্তমানে রাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা তিনি। আবদুল্লাহর আরেক ছেলে মোস্তফা কামাল যুগ্ম সম্পাদক এনসির। যদিও কাশ্মীরের সিংহভাগ মানুষের কাছে আবদুল্লাহ হলেন, হয় বিশ্বাসঘাতক অথবা বাস্তবতা বুঝতে
পেরে নেহরুর প্রতি আস্থা রেখে ভারতে যোগ দেওয়ার পর বারবার প্রতারিত হওয়া হতভাগা। স্বভাবতই, শেখ আবদুল্লাহকে বোঝার জন্য আরেকটু গভীর আলোচনা জরুরি। একজন বাংলাদেশি হিসেবে শেখ আবদুল্লাহকে (১৯০৫ – ১৯৮২) বুঝতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকেই (১৯২০ – ১৯৭৫) তার পাশে দাঁড় করিয়েছি। মনে রাখা দরকার, গবেষণায় তুলনা করা মানেই এক করে দেখা নয়। তুলনা মানে হলো মিল-অমিল উভয়ের পর্যালোচনা। আর সেটি করতে হয় একই মাপকাঠিতে রেখে।
এই দুই নেতাকে নিয়ে একটি তুলনামূলক গবেষণার প্রচেষ্টা করেছিলাম কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। সেটা করতে গিয়ে মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বকে বাংলাদেশের জাতীয় সীমানার বাইরে দক্ষিণ এশীয়ার জ্ঞানজগতে পৌছে দিতে সচেষ্ট হয়েছি। পাশাপাশি, শেখ আবদুল্লাহর অবদান আর সীমাবদ্ধতাগুলোকে উপলব্ধি করতে পেরেছি স্পষ্টভাবেই। দুই নেতাকে নিয়ে সেই বিষদ আলোচনার কিয়দাংশই তুলে ধরছি এখানে।
দুজন নেতারই নামের প্রথম শব্দ শেখ। উভয়ই জন্মেছিলেন মধ্যবিত্ত-মুসলিম পরিবারে। তারা বেড়ে উঠেছেন অমুসলিম প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের সঙ্গে। একদিকে যেমন সামাজিকভাবে বহু সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন অন্যদিকে তারা পেয়েছেন অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে। তবে, রাজনৈতিকভাবে ব্রিটিশ আমলে বাংলার যে পরিপকৃতা ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে শুরু হয়েছে তেমনটা কাশ্মীরের হয়নি। ফলে
শেখ আবদুল্লাহর বেড়ে ওঠার সময় কাশ্মীর ছিল সে অর্থে রাজনীতিশূন্য। শেখ আবদুল্লাহ মক্তবে ধর্মশিক্ষা নিয়েছেন, তারপর স্কুল-কলেজ পেরিয়ে রসায়ন শাস্ত্রে এমএ করেছেন আলীগড় থেকে। ২৫ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে তিনি কাশ্মীর ফিরে গিয়ে দেখেন সেখানে মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার। তিনি মুসলমানদের অধিকারের পক্ষে কাজ শুরু করেন। তার আগে মুসলমান যুবকেরা ছিল অশিক্ষিত। এবার নতুন সমস্যা হলো, মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত বেশ কিছু যুবক আছে।
কিন্তু, দেখা গেল শিক্ষিত হলেও তাদের চাকরির ক্ষেত্রে নানা রকম শর্তের অধীনে বঞ্চিত করা হয়। শেখ আবদুল্লাহ নিজেও মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই। চাকরিতেও তিনি একই বঞ্ছনার শিকার হন। সেই বাস্তবতায় ১৯৩১ সালে তিনি রিডিং রুম পার্টি নামে একটি যুবসংগঠন শুরু করেন। ওই বছরই মহারাজার বিরুদ্ধে প্রথম ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন শুরু হয়। সেখানে, উর্দু আর কাশ্মীরি ভাষায় পারদর্শী আবদুল্লাহ তার বাগ্মিতার বলে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শেখ আবদুল্লাহ দেশ ভাগের আগেই নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ছিলেন কেবল উদীয়মান এক ছাত্রনেতা। আবদুল্লাহ তার দলের নাম বদল করেছিলেন ১৯৩৯ সালে। পক্ষান্তরে, শেখ মজিবুর রহমান। তাঁর দলের নাম পরিবর্তন করেন অনেক পরে ১৯৫৫ সালে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগেরও আট বছর পর। মূলত, অসাম্প্রদায়িক চেহারা প্রমাণের জন্যই উভয় নেতা তাদের দলের নাম পরিবর্তন করেছিলেন। সেক্ষেত্রে শেখ আবদুল্লাহর উদ্যোগ ছিল র্যাডিক্যাল’। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে সেটা ছিল গ্রাজুয়াল’। ফলাফল হলো বাংলাদেশে এখনও অমুসলিমরা আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত।
পক্ষান্তরে আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রতীকীভাবে কিছু হিন্দু নেতা পেলেও বস্তুত তার দল হিন্দুদের আস্থা পায়নি কখনোই। বিজেপি, বিএইচপির (বিশ্ব হিন্দু পরিষদের) মতো সংস্থাই সবসময় হিন্দুদের জন্য কথা বলেছে, আস্থা পেয়েছে। ওই সব সংস্থা শেখ আবদুল্লাহকে তার ব্যক্তিগত ধার্মিকতার কারণে সন্দেহের তীরবিদ্ধ করেছে। মজার ব্যাপার হলো শেখ আবদুল্লাহ শুরু থেকেই পাকিস্তানকে অস্বীকার করেছেন। নেহরুর রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক ছিলেন তিনি। পক্ষান্তরে শেখ মুজিবুর রহমান আঁপিয়ে পড়েছিলেন জিন্নাহ,
সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের দাবির পক্ষে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ, পাকিস্তান, প্রতিষ্ঠায় এক ত্যাগী ও উদ্যোমী কর্মী হিসেবে। দেশভাগের পর দুজনের তুলনা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। আবদুল্লাহ ভারতকে মেনেছিলেন তার দেশ হিসেবে। ভারতের অধীনে থেকেই জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ছিল তার সর্বোচ্চ চাওয়া। স্বায়ত্তশাসনের চর্চা করতে গিয়েই তিনি চক্ষুশূল হলেন নেহরুর। নিক্ষিপ্ত হলেন জেলে। তারপর ক্রমান্বয়ে আরও আপস করেছেন, বা করতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্দিরার সঙ্গে দিল্লি এগ্রিমেন্ট করেন। তার আওতায় মূলত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন আরও সীমীত হয়।
তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। আগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এখন তো ৩৭০ অনুচ্ছেদকে অনেকে একটুকরা কাগজ ছাড়া কিছুই মনে করে না। আবদুল্লাহ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি অনুতপ্ত। এভাবে শের-এ-কাশ্মীর আজ কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষের কাছে গাদ্দার-এ-কাশ্মীর হয়ে পড়েছেন। বিপরীতক্রমে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করতে পেরেছিলেন। হয়েছেন বঙ্গবন্ধু’। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক গুল ওয়ানি আমার এই তুলনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব কেন আন্দোলন করেছেন তা স্পষ্ট। পাকিস্তান সাংস্কৃতিকভাবে বিপরীতমুখী বাঙালিদের সম্মান করতে পারেনি। স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোতে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু, দুঃখের বিষয় হলো, গণতান্ত্রিক ভারতও কাশ্মীরিদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে একই পথে হেঁটেছে।’ বঙ্গবন্ধু থেকে শের-এ-কাশ্মীর।
দুজনই তার মানুষের জন্য জেল খেটেছেন জীবনের বিরাট সময়। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু, দুজনের জীবনের সবচেয়ে বড় তফাৎ সৃষ্টি হয়েছে জাতীয়তা’র রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রশ্নে। দুজনই আলাদা জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শেখ আবদুল্লাহ সেই জাতীয়তাকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমান পেরেছেন। তিনি হয়েছেন জাতির পিতা’। সেখানে এসেই দুই নেতার মধ্যে তুলনা শেষ করতে হয়। কারণ, একজন একটি বিরোধপূর্ণ এলাকার পরাধীন নেতা। অন্যজন স্বাধীনতা অর্জন করে দেশ গঠনের শুরুতেই প্রাণ দিয়েছেন পথভ্রষ্টদের হাতে।
নোট/সূত্র
১. Kashmir and South Asia Studies বিষয়ে এমএ ডিগ্রির চূড়ান্ত সেমিস্টারে লেখক ওই থিসিস লিখেছেন। এর শিরোনাম হচ্ছে, Leadership in Political Movements: Comparative Study of Sheikh Mohammad Abdullah and Sheikh Mujibur Rahman, eta শত পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রটি কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
২. শেখ আবদুল্লাহর আত্মজীবনী আতশ-এ-চিনার (উর্দু) এর ইংরেজি অনুবাদের নাম Flames of The Chinar (1993)। হাজার পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ উর্দু বইটির ইংরেজি সম্পাদনা করেছেন খুশবন্ত সিং। ইংরেজি বইটি খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র ১৭২ পৃষ্ঠার। এই অধ্যায়ের তথ্যাবলী দেখুন তার পৃষ্ঠা ৪-৭, ১৭, ৪৬৫০, ৫৭, ১৬৪।