শেরউড বনের পলাতক (ছোট গল্প)
০১. কালো ঘোড়ার সওয়ার
আজ থেকে বহু বৎসর আগেকার কথা। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ডের বুকে যখন প্রবল বিক্রমে শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে বিজয়ী নৰ্মান জাতি এবং তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওই দেশেরই আদিবাসী অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠী- সেই সময়, অস্ত্রের শাণিত ফলকে রক্তের অক্ষরে লিখিত ইতিহাসের পটভূমিতে আমাদের কাহিনির শুরু…
গল্প আরম্ভ করার আগে তৎকালীন ইংল্যান্ডের বিষয়ে কয়েকটা কথা বলা দরকার। যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন রিচার্ড প্ল্যান্টজেনেট ইতিহাস তাকে সিংহ-হৃদয় রিচার্ড নামে অভিহিত করেছে।
নামটা নিতান্ত বৃথা হয়নি। রিচার্ড ছিলেন সিংহের মতোই পরাক্রমশালী- যাকে বলে, পুরুষসিংহ। শোনা যায় তিনি নাকি তুলোয়ারের এক আঘাতে সওয়ার সমেত একটি ঘোড়াকে দুটুকরো করে ফেলতে পারতেন। হয়তো এটা অতিশয়োক্তি, তবে তিনি যে দেহে-মনে অসাধারণ শক্তিমান ছিলেন সে কথা ইতিহাসও স্বীকার করেছে। বিজয়ী নর্মান ও বিজিত অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি পরস্পরকে ঘৃণা করলেও এই সাহসী রণনিপুণ নৃপতিকে তারা সকলেই শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কারণ, নর্মান রাজবংশে জন্মগ্রহণ করলেও রিচার্ডের কাছে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ছিল না।
রিচার্ডের দেহের উচ্চতা ছিল ছয় ফুট চার ইঞ্চি, পরিধি ছিল দৈর্ঘ্যের অনুপাতে বিস্তৃত এবং পেশীর প্রাচুর্যে প্রচণ্ড। তার দেহ ছিল যেমন প্রকাণ্ড, অন্তঃকরণ ছিল তেমই প্রশস্ত, উদার। কয়েকটি স্বার্থান্ধ হীনচেতা মানুষ ছাড়া জাতি নির্বিশেষে সমগ্র ইংল্যান্ডবাসীর কাছে রিচার্ড ছিলেন একান্ত আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।
কিন্তু ইংল্যান্ডবাসী তথা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের দুর্ভাগ্য–রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজ্য পরিচালনার চাইতে তরবারি হাতে রণক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনার কাজটাই ছিল রিচার্ডের কাছে অধিকতর প্রিয়। তাই যুদ্ধের সুযোগ পেলেই রাজ্য পরিচালনার ভার প্রতিনিধির হাতে দিয়ে তিনি সসৈন্যে অবতীর্ণ হতেন যুদ্ধের প্রাঙ্গণে। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের যুদ্ধ চলছিল। রিচার্ড সেই যুদ্ধে যোগদানের সংকল্প করলেন। রাজ্য পরিচালনার ভার ভ্রাতা জন-এর হাতে দিয়ে রিচার্ড সৈন্য নিয়ে চলে গেলেন প্যালেস্টাইনে এবং সেখানে উপস্থিত অন্যান্য খ্রিস্টান রাজাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধে নামলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে।ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে ইতিহাসে খ্যাত পূর্বোক্ত যুদ্ধে রিচার্ড যে অদ্ভুত বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন, তাই নিয়ে বহু কিংবদন্তী রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাহিনির পটভূমি হচ্ছে ইংল্যান্ড, অতএব রিচার্ডকে প্যালেস্টাইনে রেখে আমরা ফিরে আসছি আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে, যেখানে রিচার্ডের অবর্তমানে রাজদণ্ড ধারণ করেছেন জন।
জন ছিলেন যেমন স্বার্থপর, তেমনই খল চরিত্রের মানুষ। তার রাজত্বকালে নর্মানরা তাদের অধীন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের উপর অত্যাচার শুরু করল। নতুন নতুন কর আর নানারকম অন্যায় দাবির দাপটে অস্থির হয়ে উঠল অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি। ফলে, বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল কয়েকটি স্থানে। যদিও নর্ম্যানদের প্রচণ্ড তরবারি অধিকাংশ স্থানেই রক্তের স্রোতে সেই আগুনকে নিবিয়ে দিল, তবুও স্ফুলিঙ্গ একেবারে নির্বাপিত হল না। অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠীর ভিতর থেকে আবির্ভূত হল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নাম, রবিনহুড। কিছু দিনের মধ্যেই তার নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বুকে আত্মপ্রকাশ করল এক বিদ্রোহী বাহিনী। রবিনহুডের নেতৃত্বে ওই বাহিনী সুযোগ পেলেই নম্যানদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করত। নর্মানরা ওই বাহিনীকে দুস্য আখ্যা দিল।
বিভিন্ন অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ ওই দস্যুদল নিয়ে রবিনহুড নর্ম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। নম্যানদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রবিনহুড ও তার দুস্যদলের পরাজয় ছিল অনিবার্য। কিন্তু দস্যুরা আঘাত হানত অতর্কিতে এবং লুণ্ঠন সমাধা করেই গা-ঢাকা দিত শেরউড নামক অরণ্যের অন্তঃপুরে।
নম্যান জমিদার ও শেরিফদের মধ্যে অনেকেই বিপুল বাহিনী নিয়ে রবিনহুডকে শায়েস্তা করতে শেরউড বনের মধ্যে অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। অজানা বনপথের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী নর্মান সেনাদল দ্রুত চলাফেরা করতে পারত না। গাছের আড়াল থেকে নর্ম্যানদের অগোচরে তাদের উপর লক্ষ রাখত রবিনহুডের অনুচরবর্গ- তারপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাত শত্রুপক্ষের উপর। আচম্বিতে অরণ্য ভেদ করে ছুটে আসত ঝাঁকে ঝকে তির এবং ব্যাপারটা ভালোভাবে বোধগম্য হওয়ার আগেই তিরবিদ্ধ হয়ে অধিকাংশ নম্যান সৈন্য হত ধরাতলে লম্বমান। তারপর হতচকিত ও ভয়ার্ত নম্যানরা যখন পলায়নের উদ্যোগ করত, তখন তরবারি হাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত রবিনহুড তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শেষ হতাহত সঙ্গীদের বনের মধ্যে ফেলে রেখে নগরের দিকে পলায়ন করত হতাবশিষ্ট নর্ম্যান সৈন্য।
বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর অত্যাচারী নর্মান জমিদার, ধর্মযাজক ও শেরিফের দল সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাছা বাছা অ্যাংলো-স্যাক্সন যোদ্ধার দল এসে রবিনহুডের দলকে ভারী করে তুলল। ওই দুস্যদল শেরউড বনে সংরক্ষিত হরিণ মেরে ক্ষুধা নিবারণ করত এবং সুযোগ পেলেই ধনী নর্ম্যানদের সম্পত্তি লুঠ করত মহোৎসাহে। বার বার মার খেয়ে শেরউড বনের ভিতর নর্মানরা আর প্রবেশ করতে চাইত না, তাদের কাছে শেরউড বন হয়ে দাঁড়াল মৃত্যুপুরীর মতোই ভয়াবহ।
দেশের যখন এই অবস্থা, সেই সময়ে স্যার স্টিফেন নামে এক দুর্ধর্ষ নর্ম্যান যোদ্ধা ঘোষণা করল রবিনহুডকে সে রাজা জনের কাছে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসবে– জীবিত অবস্থায় যদি তাকে আনা সম্ভব না হয়, তবে রবিনহুডের মৃতদেহকেই সে উপস্থিত করবে রাজদরবারে।
রবিনহুড সতর্ক হল। স্যার স্টিফেন মানুষ হিসাবে খুবই খারাপ বটে, কিন্তু সে ছিল দুর্জয় যোদ্ধা।
রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের যে প্রতিযোগিতা হয়, সেই প্রতিযোগিতায় পর পর ছয়বার জয়লাভ করে সে প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমকক্ষ যোদ্ধা রীবপ্রসবিনী ইংল্যান্ডেও নিতান্ত বিরল।
ওই ভয়ংকর যোদ্ধাকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হল রবিনহুড ও তার দস্যুদল, আয়োজনের কোনো ত্রুটি রইল না। স্যার স্টিফেনের নেতৃত্বে বিরাট নমানবাহিনী শেরউড বনে ঢুকে অনুসন্ধান শুরু করল। খুব বেশিদিন খোঁজাখুঁজি করবার দরকার হল না; হঠাৎ একদিন বনের আড়াল থেকে ঝক ঝক তির এসে কয়েক জন নর্মান সেনাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। নম্যান তিরন্দাজরাও ধনুর্বাণ ব্যবহার করতে লাগল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য হল ব্যর্থ। স্যার স্টিফেনের মৃত্যু ছিল অবধারিত শুধু উৎকৃষ্ট স্প্যানিশ বর্মের কল্যাণেই পূর্বোক্ত যোদ্ধা সেবার বেঁচে গেল। দস্যুদের তির ওই স্পেনদেশীয় বর্মের কঠিন আবরণ ভেদ করে স্যার স্টিফেনের দেহ স্পর্শ করতে পারল না।
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত তিরের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নর্ম্যান সৈন্যরা হয়তো দিশাহারা হয়ে ছুটতে শুরু করত, আর তাহলেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দস্যুদল তাদের কচুকাটা করে ফেলতে পারত অনায়াসে। কিন্তু স্যার স্টিফেনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নর্ম্যান সেনাদের ছত্রভঙ্গ হতে দিল না– শৃঙ্খলা বজায় রেখে তির ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা পিছিয়ে যেতে শুরু করল..
কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর বনের ভিতর একটা বিধ্বস্ত দুর্গের কাছে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন ও তার সৈন্যদল। এক সময় ওই দুর্গটি জনৈক অ্যাংলো-স্যাক্সন জমিদারের অধিকারভুক্ত ছিল। উক্ত জমিদারের মৃত্যু হয়েছিল স্যার স্টিফেনেরই হাতে। হত্যাকাণ্ড সমাধা করে দুর্গটিতে আগুন ধরিয়ে স্যার স্টিফেন স্থানত্যাগ করেছিল। অর্ধদগ্ধ ভগ্নাবশেষ তখনও বিরাজ করছিল শেরউড বনের মধ্যে। দুস্যদের আক্রমণের মুখে পিছিয়ে যেতে যেতে সেই দুর্গটির সামনে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন।
স্যার স্টিফেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা- এক নজর দেখেই সে বুঝল দুর্গের প্রাচীর দুই-এক জায়গায় ভেঙে গেছে বটে, তবু সেখানে আশ্রয় নিলে দুস্যদের কবল থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করা যাবে। দুর্গ-প্রাকার ও পাষাণ-স্তম্ভের সারি দস্যুদের নিক্ষিপ্ত তিরগুলিকে বিফল করে দেবে, কিন্তু দুর্গ আক্রমণ করতে গেলে সামনের ফাঁকা মাঠের উপর দস্যুরা নর্ম্যান তিরন্দাজদের তিরের মুখে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। অবশ্য দুর্গের ভিতর বেশি দিন আটকে থাকলে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে সৈন্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন প্রাণ বাঁচাতে হলে ওই দুর্গই হচ্ছে একমাত্র আশ্রয়। স্যার স্টিফেন ভেবে দেখল সৈন্যদের সঙ্গে যে খাদ্য ও পানীয় আনা হয়েছে, তাই দিয়ে এখন বেশ কিছুদিন চলবে, পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। অতএব, স্যার স্টিফেন সৈন্য নিয়ে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করার উদ্যোগ করল।
রবিনহুড বুঝল স্যার স্টিফেনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে নর্ম্যান-সেনা নাগালের বাইরে চলে যাবে– সে তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে নর্ম্যানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; অধিনায়কের নির্দেশে দুস্যরা ধনুর্বান ছেড়ে তরবারি হাতে অবতীর্ণ হল সম্মুখযুদ্ধে।
কিন্তু নানদের বাধা দেওয়া গেল না। তারা বুঝেছিল ওই দুর্গই এখন তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারে। প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতে তারা দুর্গের ভিতর ঢুকে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সিংহদ্বার এবং দুর্গের ভিতর থেকে ছুটে এল এক ঝাক তির দুস্যদের লক্ষ্য করে। হতাহত সঙ্গীদের নিয়ে দুস্যরা আবার বনের আড়ালে গা-ঢাকা দিল। তারপর নজর রাখতে লাগল দুর্গের উপর। দুর্গের চুড়া ও প্রাকার থেকে নান-সৈন্যরাও চারদিকে নজর রাখছিল। বাইরে অরণ্যগর্ভে আত্মগোপন করে দস্যুদলও বসে ছিল অতন্দ্র প্রহরায়। রবিনহুড জানত কিছুদিন পরেই নর্ম্যানদের খাদ্যাভাব ঘটবে, তখন হয় তারা অনশনে মৃত্যুবরণ করবে আর নয়তো বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকলেই দুস্যদের জয় অনিবার্য।
দুর্গ অবরোধ করে দস্যুরা খুব উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু আর একটা ভয়ংকর সম্ভাবনা সম্পর্কে রবিনহুড ছিল অতিশয় সচেতন– কোনো রকমে স্যার স্টিফেনের বিপদের খবর যদি বনের বাইরে নর্ম্যানদের কানে যায়, তাহলে তারা সৈন্যসামন্ত নিয়ে শেরউড বনে হানা দিতে পারে। সেরকম ঘটনা ঘটলে স্যার স্টিফেন তো মুক্তি পাবেই, উপরন্তু দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে দস্যুদের অবস্থা হবে শোচনীয়। অতএব, রবিনহুডের নির্দেশে বিভিন্ন অধিনায়কের নেতৃত্বে ছোটো-ছোটো দল বনের প্রবেশপথগুলির উপর ঘুরে ঘুরে নজর রাখতে লাগল..
দুর্গ অবরোদের পর প্রায় পনেরো দিন কাটল নিরুপদ্রবে। দুর্গের ভিতর থেকে নর্ম্যান-সেনা এবং বনের আড়াল থেকে দস্যুদল পরস্পরের উপর নজর রাখছে- কিন্তু কোনো পক্ষই এগিয়ে এসে তিরের মুখে আত্মপ্রকাশ করতে রাজি নয়। ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত রূপ ধারণ করে তেমনই এক ভয়ংকর স্তব্ধতা বিরাজ করছে শেরউড বনের বুকে…।
একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসে রবিনহুড চিন্তা করছিল নিবিষ্ট চিত্তে অকস্মাৎ বনপথ ভেদ করে সম্মুখে আবির্ভূত হল তারই অনুগত তিন দুস্যনেতা ও এক অশ্বারোহী নর্মান যোদ্ধা।
এখানে উল্লিখিত তিন দস্যুনেতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া দরকার। দস্যু তিনটির নাম লিটল জন, উইল স্কারলেট এবং ফ্রায়ার টাক। শেষোক্ত ফ্রায়ার টাক হচ্ছে এক পাদ্রি বা ধর্মযাজক। সে দস্যুদের কানে ভগবানের নাম পরিবেশন করত, আবার প্রয়োজন হলে অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও তার আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। ফ্রায়ার টাক ছিল খর্বকায়, কিন্তু বৃষস্কন্ধ ও বিশাল বপুর বিস্তারে তার দৈর্ঘ্যের অভাব পুষিয়ে গিয়েছিল। তার মাথায় ছিল একটা মস্ত চকচকে টাক এবং দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। তিরধনুক ও তলোয়ার চালাতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তবে লাঠি ছিল তার প্রিয় অস্ত্র।
উইল স্কারলেট ছিল ছোটোখাটো পেশীবহুল দেহের অধিকারী। অস্ত্রশস্ত্রে সুনিপুণ এই যুবক চিতাবাগের মতোই ক্ষিপ্র এবং মল্লযুদ্ধে পারদর্শী।
এইবার লিটল জন-এর কথা বলছি। নামে লিটল বা ক্ষুদ্র হলেও লিটল জন মোটেই ছোটোখাটো মানুষ নয় তার শরীর যেমন লম্বা তেমনই চওড়া, এবং সেই লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড শরীরের সর্বত্র কঠিন মাংসপেশীর স্ফীতি দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি অসাধারণ শক্তিমান। রবিনহুডের দলে তার মতো বলিষ্ঠ পুরুষ একটিও ছিল না। এই মহাবলবান মানুষটি অস্ত্রের ব্যবহার জানত ভালোভাবেই তির, তলোয়ার ও লাঠি চালাতে সে ছিল ওস্তাদ।
পূর্বোক্ত ভয়ংকর মানুষ তিনটির সঙ্গে যে নর্ম্যান অশ্বারোহীটি এসে রবিনহুডের সামনে দাঁড়াল, তার চোহারটিও দেখবার মতো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মে ঢাকা; বর্মের তলায় যোদ্ধার নাক, চোখ, মুখ আর দেহের গঠন অদৃশ্য হলেও দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার শরীরটি যে লিটল জনের মতোই প্রকাণ্ড সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। যোদ্ধার বাহন অশটির দেহের আয়তনও প্রভুর মতোই সুবিশাল। যোদ্ধার বর্ম ও ঘোড়র গায়ের রং কুচকুচে কালো।
বর্মাবৃত ওই ধরনের যোদ্ধাদের ইউরোপে নাইট নাম অভিহিত করা হত; আমরাও তাই রবিনহুড ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কালো বর্মের যোদ্ধাকে ব্ল্যাক নাইট নামেই ডাকব।
রবিনহুডকে উদ্দেশ করে লিটল জন বলল, মাস্টার রবিন! এই নর্মান নাইট এই দিকেই আসছিলেন। আমরা তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারি তিনি নাকি ইয়র্ক নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথ ভুলে শেরউড বনে ঢুকে পড়েছেন। আমরা তাকে আমাদের দলপতি রবিনহুডের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করলাম। উনি সম্মত হয়েছেন বলেই আমরা ওঁকে তোমার সামনে নিয়ে এসেছি।
ঘনকৃষ্ণ লৌহমুখোশের ভিতর থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, কথাটা সত্য বটে। তবে অনুরোধ করার সময়ে তিনটি ধনুক থেকে তিনটি বাণ আমার দিকে উদ্যত হয়েছিল। আর আমার এই দীর্ঘকায় বন্ধুটি জানিয়েছিল যে, সে এবং তার বন্ধুরা সকলেই দক্ষ তিরন্দাজ অনুবোধ রক্ষায় অসম্মত হলে আমার বর্মের খাঁজের ভিতর তিরে পাঠিয়ে দিতে তাদের নাকি বিশেষ অসুবিধা হবে না। এরকম অবস্থায় অনুরোধ রক্ষা না করে আমায় উপায় ছিল না।
রবিনহুড বিনীতভাবে অভিবাদন করে বলল, ব্লাক নাইট! আপনি রাগ করবেন না। এই বনে চলাফেরা করতে হলে আমার অনুমতি নিতে হয়। কারণ, এটা হচ্ছে আমার এলাকা।
তাই নাকি? ব্ল্যাক নাইট বললেন, আমার ধারণা ছিল এটা রাজার সম্পত্তি। রাজা রিচার্ডই এই বনের মালিক। আমি বহুদিন এদেশে ছিলাম না। এসে দেখছি অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে।
নাইট মহাশয়! রবিনহুড বলল, এটা রাজার সম্পত্তি তো বটেই। রাজা রিচার্ডই এই শেরউড বনের মালকি। কিন্তু তার অবর্তমানে আমাদের উপর অর্থাৎ অ্যাংলো-স্যাক্সনদের উপর যে অত্যাচার চলছে, সেই অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই আমরা এই বনে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। আমরা রাজভক্ত প্রজা, নিতান্ত বাধ্য হয়েই দুই-এক সময়ে হরিণ মেরে খেয়ে থাকি।
কী সর্বনাশ! রাজার হরিণ মারা যে বে-আইনি ব্যাপার। রিচার্ড একথা শুনলে খুশি হবেন না। তাঁর ভাই জন নিশ্চয়ই এইসব বে-আইনি কার্যকলাপের খবর রাখেন না?
রাখেন বৈকি, রহিনহুড হেসে বলল, তার অনুগত শেরিফ ও ব্যারনরা কয়েক বার সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে এখানে হানা দিয়েছে। তবে তারা আমাকে ধরতে পারেনি। আর রাজা রিচার্ডের অসন্তোষের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব সব কথা শুনলে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করবেন।
তারপর রবিনহুড নর্ম্যান অত্যাচারের কয়েকটি কাহিনি ব্ল্যাক নাইটকে শোনাল। রবিনহুডের দলভুক্ত কয়েকটি মানুষ এসে ঈশ্বরের নামে শপথ করে জানালো নর্ম্যান শেরিফ ও ব্যারনদের অত্যাচারে তারা আজ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত। সব কথা শুনে ব্ল্যাক নাইটের মুখভাবের পরিবর্তন হল কি না, বোঝা গেল না, কারণ, তাঁর মুখ ছিল লোহার মুখোশে ঢাকা- কিন্তু যখন তিনি কথা বললেন, তখন কণ্ঠস্বরে ক্রোধের আভাস ছিল স্পষ্ট।
মাস্টার রবিন। ব্ল্যাক নাইট ভয়ংকর স্বরে বললেন, তোমার কথা যদি সত্য হয়, এখানে যারা নির্যাতিত হয়ে সাক্ষ্য দিল তাদের কথা যদি সত্য হয় তাহলে জেনে রেখো, অত্যাচারীদের নিস্তার নেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাদের করতেই হবে।
দস্যুদল স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক। তাদের মনে হল একটা সিংহ যেন অবরুদ্ধ রোষে গর্জন করে উঠল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রবিনহুড বলল, নাইট মহাশয়! আপনি দীর্ঘকাল এখানে ছিলেন না বলছেন। কোথায় ছিলেন তাহলে?
প্যালেস্টাইনে।
প্যালেস্টাইন! যুদ্ধক্ষেত্রে?
–হ্যাঁ। আমি ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। দীর্ঘকাল পরে দেশে ফিরছি।
–নাইট মহাশয়! কিছু না দেখেও বলতে পারি সেখানে বহু মুসলমান সৈন্যই আপনার অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে.. কিন্তু মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে, আমরাও ক্ষুধার্ত; যদি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে ভোজনে বসেন তাহলে অত্যন্ত সুখী হব।
-সানন্দে। আমিও অতিশয় ক্ষুধার্ত।
.
০২. পরীক্ষা
ভোজসভায় যোগ দেওয়ার আগে ব্ল্যাক নাইট তাঁর শিরস্ত্রাণ ও লৌহমুখোশ খুলে ফেললেন।
দস্যুদের চোখের সামনে ভেসে উঠল একজোড়া উজ্জ্বল চক্ষু, তীক্ষ্ণ নাসিকা আর দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধর। মাথার উপর সিংহের কেশরের মতো নিবিড় কেশরাশির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুখের নিম্নভাগে অবস্থান করছে ঘন গোঁফ-দাড়ি সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য পৌরুষের দীপ্তি জ্বলছে সেই মুখের উপর…
ভোজনপর্ব শেষ হল। খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য ছিল না– প্রচুর পরিমাণে হরিণের মাংস আর এল নামক সুর জাতীয় পানীয়। ব্ল্যাক নাইট যে খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন সন্দেহ নেই। যে পরিমাণ মদ্য ও মাংস তিনি উদরস্থ করলেন তা দেখে দস্যুর দল তো চমকে গেলই, এমনকী, ভোজনপটু ফ্রায়ার টাকও মনে মনে স্বীকার করল, লোকটা খেতে পারে বটে!
ভোজনপর্ব সমাধা হলে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে ব্ল্যাক নাইট বললেন, মাস্টার রবিন। এমন একটি চমৎকার ভোজ খাওয়ানোর জন্য তোমাকে আর তোমার সহচরদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রবিনহুড সবিনয়ে বলল, নাইট মহাশয়! আমাদের মতো গরিব মানুষ কি আপনাকে এমনভাবে ভোজ খাওয়াতে পারে? খাওয়ার খরচটা আপনাকেই দিতে হবে।
অত্যন্ত বিমর্ষভাবে ব্ল্যাক নাইট বললেন, কিন্তু আমি যে এখন একেবারেই কপর্দকশূন্য।
রবিনহুড বলল, তাতে কি হয়েছে? আর এক সময় যখন আপনার হাতে টাকা থাকবে, সেই সময় মনে করে এখানে এসে ভোজের খরচটা দিয়ে যাবেন।
কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চিন্তা করলেন ব্ল্যাক নাইট, তারপর হঠাৎ তার ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? আমাকে তোমাদের দলে ভর্তি করে নিলে তো আর খাওয়ার খরচটা দিতে হয় না। আর আমিও ঋণশোধের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাই।
রবিনহুড বলল, আপনার মতো মানুষ যদি দলে আসে, তাহলে সে তো আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু আমরা তো সবাই অ্যাংলো-স্যাক্সন, আর আপনি নর্মান যোদ্ধা। আপনি কি আমাদের দলে আসবেন?
-কেন আসব না? তোমরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছ। নর্ম্যান জাতির বিরুদ্ধে তোমরা তো অস্ত্রধারণ করোনি। নাইটের কর্তব্য হচ্ছে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তাই তোমাদের দলে এলে আমি কতর্ব্য পালনের সুযোগ পাব ভালোভাবেই।
ঠিক কথা। আমাদের রাজা রিচার্ডও নর্মান বংশের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগই নেই। আমরা লড়াই করছি কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার, শেরিফ প্রভৃতি অত্যাচারী নৰ্মানদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে রিচার্ডের পরিবর্তে যিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করেছেন, সেই জনকেও আমরা পছন্দ করি না।
–মাস্টার রবিন! তোমার মতে তাহলে রাজা রিচার্ডই এখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনের যোগ্য অধিকারী!
-নিশ্চয়।
আমিও তোমাদের সঙ্গে একমত। তাহলে আমাকে এইবার তোমাদের দলে ভর্তি করে নাও।
আমাদের দলে ভর্তি হতে হলে আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিশ্চয়ই আপনাকে দলভুক্ত করা হবে।
-তোমার দলে আসতে হলে পরীক্ষা দিতে হয়?
-হয় বৈকি, নাইট মহাশয়। তা না হলে যত রাজ্যের চোর, ডাকাত আর ভিখারির দল এসে আমার দলে ভিড় করত। সেই জন্যই পরীক্ষার ব্যবস্থা। দক্ষ যোদ্ধা না হলে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। অবশ্য আপনি যে সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবু নিয়ম পালন তো করতেই হবে- কি বলেন?
-অবশ্যই। তা পরীক্ষাটা কি ভাবে হবে?
-তিরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা আছে। সেটা পছন্দ না হলে লাঠি অথবা খেঁটে, অর্থাৎ ছোটো লাঠি দিয়েও দ্বন্দ্বযুদ্ধে শক্তির পরীক্ষা করা যায়।
–প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কে?
আমিই অথবা আমার দলের যে-কোনো লোককে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।
–তিরধনুক, লাঠি বা খেটে নিয়ে আমি লড়াই করতে ভালোবাসি না। তোমাদের দলে কি এমন কেউ নেই, যে ব্যক্তি রণকুঠার, ভল্ল বা কটাবসানো লোহার গদা নিয়ে লড়াই করতে পারে?
-নাইট মহাশয়! আপনি যে অস্ত্রগুলির কথা বললেন, ওইসব অস্ত্র নিয়ে আপনার সঙ্গে যে-যোদ্ধা লড়াই করতে নামবে, সে আর পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না। সেই জন্যই তিরধনুকে নিশানার পরীক্ষা, অথবা লাঠি আর খেঁটের লড়াই-এর ব্যবস্থা করেছি।
ব্ল্যাক নাইট কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, রবিনহুডের লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা সম্পর্কে যে-সব কথা আমার কানে এসেছে, তাতে তিরধনুক নিয়ে তার সঙ্গে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় নামতে আমার সাহস হয় না। লাঠি নিয়ে পেটাপেটি করা নৰ্মান যোদ্ধার পক্ষে সম্মানজনক নয়। তবে গেঁটে বা ছোটো লাঠি নিয়ে লড়াইটা হতে পারে। তলোয়ারের খেলা শেখার সময়ে নর্ম্যান যোদ্ধাদের ওই ছোটো লাঠির খেলা শিখতে হয়। বাল্যকালে ও কৈশোরে অসিযুদ্ধ শেখার সময়ে আমিও ছোটো লাঠির লড়াইটা শিখেছিলাম। অনভ্যাসে হাত একটু আড়ষ্ট হলেও একরকম কাজ চালিয়ে নিতে পারব বলে মনে হয়। মাস্টার রবিন! তোমার দলের মধ্যে যে-কোনো ব্যক্তি আমার সঙ্গে ছোটো লাঠি নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে পারে আমি প্রস্তুত।
রবিনহুড বলল, লিটল জন আর ফ্রায়ার টাক আপনার মতোই লম্বা-চওড়া, দেহের ওজন ও শক্তিতে আপনার সমকক্ষ। ওরা দীর্ঘকাল ধরে ছোটো লাঠির ব্যবহারে অভ্যস্ত, কিন্তু আপনার ছোটো লাঠিতে অভ্যাস নেই। কাজেই ওদের কারও সঙ্গে আপনাকে ছোটো লাঠি নিয়ে শক্তিপরীক্ষা করতে আমি দেব না। কারণ, তাহলে আপনার প্রতি অবিচার করা হয়। আমিই এখানে আপনার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার লাঠি খেলা অভ্যাস আছে; আপনি তাতে অনভ্যস্ত হলেও দেহের ওজন ও শারীরিক শক্তি আমার চাইতে আপনার বেশি– অতএব সুবিধা অসুবিধা উভয়পক্ষে সমান সমান। আমার সঙ্গে ছোটো লাঠি নিয়ে আপনার দ্বন্দ্বযুদ্ধ হলে লড়াইটা ন্যায়সঙ্গত হবে।
দুটি শক্ত খেঁটে বা ছোটো লাঠি এসে গেল। ব্ল্যাক নাইট খাওয়ার আগে শিরস্ত্রাণ ও লোহার মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন, কিন্তু গায়ে বর্ম ছিল। এবার বর্ম খুলে তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।
বর্মের উপর থেকে ব্ল্যাক নাইটের দেহের উচ্চতা ও পরিধিরি কিছুটা আভাস পেলেও শরীরের সঠিক গঠন অনুমান করা যাচ্ছিল না। এইবার বর্ম খুলে ফেলতেই খাটো জামা আর অধোবাসের ভিতর থেকে যে-দেহটি আত্মপ্রকাশ করল, সেইদিকে তাকিয়ে দস্যুদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল!
আড়েবহরে প্রকাণ্ড শরীরের সর্বত্র ঠেলে উঠেছে স্ফীত মাংসপেশীর তরঙ্গ। তুচ্ছ পরিচ্ছদের আবরণ সেই পেশীবদ্ধ বলিষ্ঠ সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখতে পারছে না। দস্যুদল বুঝল শেরউড বনে আজ মানুষের ছদ্মবেশে এক দানবের আবির্ভাব ঘটেছে।
প্রতিদ্বন্দ্বীর চেহারা দেখে রবিনহুডও দস্তুরমতো চমকে গিয়েছিল। আত্মসংবরণ করে হাতের লাঠি বাগিয়ে ধরল। দুই হাতে লাঠি ধরে এগিয়ে এল ব্ল্যাক নাইট। শুরু হল লড়াই…
রবিনহুডের হাতে লাঠি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষের মাথায়, ঘাড়ে, হাতে, বুকে, পায়ে সর্বত্র পড়ছে লাঠির আঘাত। সেই প্রচণ্ড মার খেলে যে-কোনো মানুষই অজ্ঞান হয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ত- কিন্তু ব্ল্যাক নাইট নির্বিকার, তিনি আঘাত অগ্রাহ্য করে লাঠি চালাচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে। দুঃখের বিষয়, তার লাঠি একবারও প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্পর্শ করতে পারছে না। হঠাৎ একবার আঘাত এড়াতে লাফ দিয়ে সরে গেল রবিনহুড, লক্ষ্যভ্রষ্ট লাঠি এসে পড়ল একটা ওক গাছের উপর। সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে ভেঙে গেল লাঠি, গাছটাও দুটুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
কয়েক মুহূর্ত জ্বলন্ত চক্ষে হাতের ভাঙা লাঠিটার দিকে চেয়ে রইলেন ব্ল্যাক নাইট, তারপর সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, আর একটা লাঠি নিয়ে এস।
–না, না রবিনহুড সহাস্যে বলে উঠল, আর লাঠালাঠির দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে।
–আমি তাহলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি?
সগৌরবে।
এই যদি অ্যাংলো-স্যাক্সনদের শক্তিপরীক্ষার রীতি হয়, ব্ল্যাক নাইট ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, তাহলে আমি বলব নিয়মটা খুবই খারাপ। কোনো সম্মানিত ব্যক্তি এইভাবে শক্তিপরীক্ষা করে না। আমার সমস্ত গা ছিঁড়ে গেছে, ফুলে গেছে অথচ, আমি একবারও প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে লাঠি ছোঁয়াতে পারলাম না!
নাইট মহাশয়! রবিনহুড বলল, আপনার লাঠির এক ঘা খেলেই আমার প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত। আপনার দেহে অসুরের শক্তি।
ফ্রায়ার টাক বলল, এবার আমার কাজটা হয়ে যাক, কি বল মাস্টার রবিন?
রবিনহুড বলল, নিশ্চয়।
ব্ল্যাক নাইট প্রশ্ন করলেন, পাদ্রি মশাই-এর আবার কি কাজ?
রবিনহুড বলল, দলে নতুন মানুষ ভর্তি হলে ফ্রায়ার টাক তাকে স্নান করিয়ে ভগবানের নাম শোনায়।
রবিনহুডের কথা শেষ হতেনা-হতেই ফ্রায়ার টাক কোথা থেকে এক বালতি ঠান্ডা জল এনে হুড়হুড় করে ব্ল্যাক নাইটের মাথায় ঢেলে দিল, তারপর বাইবেলের শ্লোক আওড়াতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে।
আচম্বিতে এমন শীতল অভ্যর্থনা পেয়ে ব্ল্যাক নাইট চমকে গেলেন। ইংল্যান্ডের শীতে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ মাথার উপর কনকনে ঠাণ্ডা ঢাললে যে-কোনো মানুষেরই মেজাজ খারাপ হতে পারে ব্ল্যাক নাইটের দুই চোখ আগুনের মতো জ্বলে উঠল এবং দুই হাত হল মুষ্টিবদ্ধ। সকলে ভাবল, এই রে! ফ্রায়ার টাকের এবার দুর্ভোগ আছে!
কিন্তু ফ্রায়ার টাকের ভাগ্য ভালো, কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে হেসে উঠলেন ব্ল্যাক নাইট, তোমাদের দলে যখন ভর্তি হয়েছি, তখন দলের নিয়ম মানতে হবে বৈকি!
রবিনহুড বলল, নাইট মহাশয়! আমাদের লিটল জনের পোশাক আপনার গায়ে একরকম করে হয়ে যাবে। আপনি এখন ভিজে জামা ছেড়ে লিটল জনের একটি পোশাক গায়ে চড়িয়ে ফেলুন।
ব্ল্যাক নাইট বললেন, দরকার নেই। শীত বা গ্রীষ্ম আমাকে কাবু করতে পারে না। আর একটা কথা শোন– ঠান্ডার সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক হচ্ছে সুরা এবং সংগীত।
দস্যুদল সোৎসাহে তার কথায় সায় দিল। সুরার অভাব সেখানে ছিল না। পাত্রের পর পাত্র পূর্ণ হল, এবং শুন্য হল তৎক্ষণাৎ। সবচেয়ে বেশি পান করলেন ব্যাক নাইট। অ্যালান-আ-ডেল নামে রবিনহুডের এক সহচর ছিল গীতবাদ্যে পারদর্শী। বীণ বাজিয়ে সে গান গাইতে শুরু করল। অ্যালানের গান শেষ হতেই হঠাৎ লিটল জন বলে উঠল, এইবার নাইট মহাশয় একটি সংগীত পরিবেশন করে আমাদের আনন্দদান করুন।
ব্ল্যাক নাইটের আপত্তি হল না। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি গান ধরলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর অ্যালানের মতো মধুর নয়, সিংহ-গর্জনের মতো গুরুগম্ভীর। তবে দস্যুদল সেই গান শুনেই খুব খুশি।
গান শেষ হলে রবিনহুড বলল, এতক্ষণ আমরা আপনাকে ব্ল্যাক নাইট নামেই জেনেছি। কিন্তু এখন আপনি আমাদের দলের মানুষ, আপনার পরিচয় জানার অধিকার এখন আমাদের আছে। বলুন, আপনার নাম কি?
রহস্যময় হাসি হেসে ব্ল্যাক নাইট বললেন, আমার নাম যথাসময়েই তোমরা জানতে পারবে। সেজন্য ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
রবিনহুড বলল, বেশ, আমরা সেজন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু আমাদের আর একটি সমস্যা আছে; আমরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছি। আপনি এখন আমাদের দলভুক্ত, অতএব আমাদের সমস্যা সম্পর্কে আপনার অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আপনার পরামর্শ ও সাহায্য আমরা দাবি করতে পারি?
অবশ্যই। ব্ল্যাক নাইট বললেন, বল, কি তোমাদের সমস্যা; আমি সাধ্যানুযায়ী তোমাদের সাহায্য করব।
রবিনহুড সংক্ষেপে স্যার স্টিফেনের কিছু কিছু কুকীর্তি ও দুর্গ অবরোধের কথা ব্ল্যাক নাইটকে খুলে বলল। তিনি স্থির হয়ে সব শুনলেন, ধীরে ধীরে তার ললাটে জাগল ভ্রুকুটি-ভয়াল কুঞ্জন-রেখা…
মাস্টার রবিন! ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের বহু অন্যায় ও অপরাধের কথা এর আগেই আমার কানে এসেছে। যে-দুর্গে সে অবরুদ্ধ হয়েছে, সেই দুর্গের অধিপতিকে সে এক বৎসর আগে হত্যা করেছে বলে তুমি অভিযোগ করছ- এখন বল, ওই দুর্গাধিপের নাম কি ছিল। তাকে হত্যা করার কারণ কি?
দুর্গাধিপের নাম আলফ্রেড অব শেরউড। রবিনহুড বলল, তিনি অ্যাংলো-স্যাক্সন হয়েও নমানবংশী স্যার স্টিফেনের আদেশ পালন করেননি, এই অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
–আদেশ পালন করেননি বলে হত্যা করা হয়েছে? আদেশটা কি ছিল?
–স্যার স্টিফেনের মনোমত পাত্রের সঙ্গে আলফ্রেড তাঁর কন্যার বিবাহ দিতে সম্মত হননি। কী! সক্রোধে গর্জন করে উঠলেন ব্ল্যাক নাইট, আলফ্রেড আমার পরিচিত। অ্যাংলো-স্যাক্সন হলেও তিনি ছিলেন রাজা রিচার্ডের অনুগত প্রজা। সামান্য কারণে তাঁকে হত্যা করেছে স্যার স্টিফেন?
সামান্য কারণে নয়, রবিনহুড বলল, স্যার স্টিফেনের নির্বাচিত পাত্রটি ছিল তারই ভ্রাতুস্পুত্র। ওই বিবাহ সম্পন্ন হলে আলফ্রডের সমুদয় সম্পত্তি হত স্যার স্টিফেনের হস্তগত।
ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। এইভাবে অনির্দিষ্ট কাল দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকতে আমি রাজি নই। আর সময়ের মূল্য আছে। কালই আমি পাপীর দণ্ডবিধান করব স্বহস্তে।
কিন্তু কেমন করে?রবিনহুড বলল, দুর্গের ভিতর প্রবেশ করা অসম্ভব। সেই চেষ্টা করতে গেলে আমার দলের বহু লোক প্রাণ হারাবে। আমি দলের লোকের অপমৃত্যু দেখতে চাই না।
ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেন অত্যন্ত দাম্ভিক যোদ্ধা। তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলে সে নিশ্চয়ই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।
বিমর্ষকণ্ঠে রবিনহুড বলল, তা ঠিক। কিন্তু তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে কারও নেই। ছয়-ছয়বার সে রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে। মনে রাখবেন, ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা ওই প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিল। সমগ্র ইংল্যান্ডে তার সমকক্ষ যোদ্ধা এখন একটিও নেই।
আমি প্রমাণ করে দেব তোমার ধারণা ভুল, ব্ল্যাক নাইট দৃঢ়স্বরে বললেন, ছয়বার সে জয়ী হয়েছে বটে, কিন্তু এইবার সে পরাজিত হবে। মাস্টার রবিন! তোমাদের কারুকে যুদ্ধ করতে হবে না। আমি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করব।
.
০৩. দ্বৈরথ
দুর্গের উপর দণ্ডায়মান প্রহরীরা দেখল বনের ভিতর থেকে সাদা নিশান হাতে এগিয়ে আসছে দুটি মানুষ। সাদা নিশান হচ্ছে শান্তির প্রতীক, তাই প্রহরীরা তির না চালিয়ে প্রশ্ন করল, কি চাও? নিশানধারী মানুষ দুটি আমাদের পরিচিত– রবিনহুড ও লিটল জন। রবিনহুড বলল, আমরা স্যার স্টিফেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সংবাদ পেয়ে দুর্গের ছাতে উপস্থিত হল স্যার স্টিফেন। হাঁক দিয়ে বলল, কি বলতে চাও তোমরা?
রবিনহুড বলল, আমি তোমার কাছে একটি প্রস্তাব জানাতে এসেছি। আমাদের দলভুক্ত এক ব্যক্তি তোমার সঙ্গে কথা কইতে চান। তার সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমার হতে পারে।
উদ্ধত স্বরে স্যার স্টিফেন বলল, কোনো দস্যুর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।
যিনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি দস্যু নন। রবিনহুড বলল, তোমার সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। দুর্গের ভিতর বসে থেকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে পার, বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে পার, আর সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় সম্পর্কে আমাদের নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে পার। বলল, কি করবে?
স্বীকার করতে বাধা নেই যে, দুর্গে খাদ্যাভাব ঘটেছে, স্যার স্টিফেন বলল, তবুও একটা কথা জেনে রাখো। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে একটি প্রাণও বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করতে পারবেনা। আমরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবনা, শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।
তার দরকার হবে না, রবিনহুড বলল, আমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমাদের সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় হতে পারে।
বেশ, স্যার স্টিফেন বলল, আমি তোমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা কইতে রাজি আছি।
রবিনহুড তার কটিবন্ধে আবন্ধ শিঙা তুলে নিয়ে ফুঁ দিল। শিঙার আওয়াজের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই স্যার স্টিফেনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে অরণ্য ভেদ করে আবির্ভূত হল প্রকাণ্ড এক কালো ঘোড়ার পিঠে আপাদমস্তক বর্মাবৃত এক যোদ্ধা। যোদ্ধার বর্মের রং তার বাহনের মতোই কুচকুচে কালো। বলাই বাহুল্য, এই ঘোড়সওয়ার আমাদের পূর্ব-পরিচিত ব্ল্যাক নাইট।
তুমি দেখছি একজন নর্ম্যান নাইট, স্যার স্টিফেন বিস্মিত স্বরে বলল, নর্মান যোদ্ধা হয়ে একদল দস্যর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে লজ্জা হল না? ওরা তো ফাঁসির দডির জন্য অপেক্ষা করছে।
ওরা দীর্ঘকাল ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করতে পারে, ব্ল্যাক নাইট বললেন, তাতে তোমার বা আমার কিছু আসে যায় না।
তুমি কি বলতে চাও?
–তোমাদের খাদ্য ফুরিয়ে এসেছে। কত দিন আর এভাবে চলবে?
যত দিন চলে। বাইরে থেকে যে-কোনো সময়ে সাহায্য এসে পড়তে পারে।
তত দিনে তোমাদের অনাহারে মৃত্যু ঘটবে। তার চাইতে বরং আত্মসমর্পণ করো।
–কখনই নয়। অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি; কিন্তু দস্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করব না।
এই সমস্যা সমাধানের একটি মাত্র সম্মানজনক উপায় আছে।
–উপায়টা কি?
—দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
স্যার স্টিফেন চিৎকার করে উঠল, তুমি আমকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছ?
–হাঁ, এই তার নিশানা।
ব্ল্যাক নাইট তাঁর ডান হাতের লৌহ-দস্তানা খুলে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেললেন। তখনকার দিনে ওইভাবে যোদ্ধারা প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানাতেন।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল স্যার স্টিফেন, তারপর বলল, আমি যদি যুদ্ধে জয়লাভ করি, তাহলে সৈন্যদের নিয়ে নিরাপদে স্বস্থানে ফিরে যেতে পারব?
–নিশ্চয়।
–দস্যুকে বিশ্বাস কি?
রবিনহুড এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, আমরা দস্যু হতে পারি, কিন্তু কখনো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করি না। স্যার স্টিফেন! রবিনহুড কথা দিয়ে কথা রাখেনি, এমন একটি দৃষ্টান্ত কি তুমি দেখাতে পার?কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। তারপর স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল স্যার স্টিফেনের কঠোর কণ্ঠস্বর, আমি আহ্বান গ্রহণ করলাম। ব্ল্যাক নাইট! ঈশ্বরের কাছে শেষ প্রার্থনা জানাও। আমি আসছি। আজ তোমার শেষ দিন।
দুর্গচুড়া থেকে অন্তর্ধান করল স্যার স্টিফেন। ব্ল্যাক নাইটের ইঙ্গিতে রবিনহুডের এক অনুচর ভীষণদর্শন এক শূল ও ঢাল এনে তুলে দিল ব্ল্যাক নাইটের হাতে।
কিছুক্ষণ পরেই সশব্দে খুলে গেল দুর্গের সিংহদ্বার এবং অশ্বপৃষ্ঠে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল আপাদমস্তক লৌহবর্মে আবৃত জনৈক যোদ্ধা- স্যার স্টিফেন।
রোমাঞ্চকর এক রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল রবিনহুড ও তার সঙ্গীদল। এটা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের খেটে বা লাঠির লড়াই নয়এই লড়াই শূল ও তরবারি নিয়ে বর্মাবৃত নৰ্মান নাইটদের মৃত্যুপণ যুদ্ধ।
দুর্গ-প্রাকার ও ছাদের উপর ভিড় করে দাঁড়াল নর্ম্যান-সেনাদল। তাদের আগ্রহও কম নয়। যদিও তাদের অধিনায়কের জয়লাভ সম্পর্কে তারা ছিল নিশ্চিত, তবুও স্যার স্টিফেনের মতো দুর্জয় যোদ্ধাকে যে-নাইট দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে সাহসী হয়, তার রণকৌশল দেখার জন্য নৰ্মানরা ছিল অতিশয় উগ্রীব। প্রতিদ্বন্দ্বীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে প্রচলিত প্রথা অনুসারে একজন মধ্যস্থ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিচয় ঘোষণা করে, তারপর তুর্যধ্বনি করে যুদ্ধ আরম্ভের সংকেত দেওয়া হয়।
এখানে সে-সব কিছুই হল না। স্যার জিওফ্রে ম্যালপার্ট নামে একজন নর্মান নাইট তার হাতের রক্তবর্ণ রুমাল মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে যুদ্ধের নির্দেশ দিল– সঙ্গেসঙ্গে দুই দিক থেকে উদ্যত শূল হাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পরস্পরের দিকে।
দুর্গের সামনে উচ্চভূমির উপর একটা সমতলভূমি ছিল যোদ্ধাদের লক্ষ্যস্থল। ওই জায়গাটার উপর যুদ্ধ হলে কোনো পক্ষই বিশেষ কোনো সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না- যার রণকৌশল ও শারীরিক শক্তি বেশি, সে-ই হবে জয়ী। কিন্তু যে-যোদ্ধা প্রতিদ্বন্দ্বীর আগে সমতলভূমি অতিক্রম করে অপর পক্ষকে অক্রমণ করতে পারবে, তারই জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তলা থেকে যে ব্যক্তি উপর দিকে অশ্বারোহণে উঠেছে, তার পক্ষে উপর থেকে নেমে আসা ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠে উপবিষ্ট যোদ্ধার শূলের আঘাত সহ্য করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। ব্ল্যাক নাইট ও তার ঘোড়ার চাইতে বাহনসমেত স্যার স্টিফেনের ওজন অনেক কম, তাই স্যার স্টিফেনের ঘোড়া প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিকতর ক্ষিপ্র এবং দ্রুতগামী অতএব, দেখা গেল স্যার স্টিফেনের ঘোড়া যখন সমভূমি পার হয়ে নীচের দিকে নামছে, ব্ল্যাক নাইটের কালো ঘোড়া তখন ঢালু জমি বেয়ে উপর দিকে মাত্র অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।
প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে ঝড়ের বেগে নামতে লাগল স্যার স্টিফেনের সুশিক্ষিতি অশ্ব। তৎক্ষণাৎ দুর্গপ্রাচীর ও চুড়ার উপর জগল নৰ্মান বাহিনীর কণ্ঠে তুমুল উল্লাসধ্বনি।
শরীরী ঝটিকার মতো স্যার স্টিফেনের ঘোড়া এসে পড়ল ব্ল্যাক নাইটের সম্মুখে, পরক্ষণেই দুটি প্রকাণ্ড শূল সবেগে পরস্পরকে আঘাত করল।
ব্ল্যাক নাইটের ঢালের উপর প্রচণ্ড সংঘাত-ধ্বনি তুলে ভেঙে গেল প্রতিদ্বন্দীর শুল। সেই দারুণ আঘাতেও কিছুমাত্র বিচলতি হলেন না ব্ল্যাক নাইট, অশ্বপৃষ্ঠে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল তাঁর বিশাল দেহ।
কিন্তু তাঁর হাতের অস্ত্র ব্যর্থ হল না প্রতিদ্বন্দ্বীর ঢাল এড়িয়ে শূল অঘাত হানল। লৌহবর্ম ভেদ করে শূল বিদ্ধ হল স্যার স্টিফেনের কণ্ঠদেশে। পরক্ষণেই ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল স্যার স্টিফেন। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে এক লাফে নেমে এসে শত্রুর কাছে গিয়ে তার শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেললেন ব্ল্যাক নাইট, কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভূপতিত শত্রুর দিকে, তারপর ভীষণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, নৰ্মান সৈন্যগণ! তোমাদের অধিনায়ক মৃত। দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে তোমাদের বর্তমান সেনানায়ক এগিয়ে এসে আমার হাতে তার অস্ত্র সমর্পণ করুক।
নৰ্মান-সৈন্যদল বিস্ময়ে নির্বাক। স্যার স্টিফেনের পরাজয় তাদের কল্পনাতীত।
শূন্যে বদ্ধমুষ্ঠি আন্দোলন করে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, তোমরা এসে আমার কথা সত্য কি না পরীক্ষা করে দেখতে পার। আমি বলছি, স্যার স্টিফেনের দেহে প্রাণ নেই।
নর্ম্যানদের মধ্যে কেউ এগিয়ে এসে স্যার স্টিফেনের দেহ পরীক্ষা করার আগ্রহ প্রকাশ করল না। ভূপতিত দেহের অনড় অবস্থা এবং কণ্ঠনিঃসৃত রক্তধারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল ব্ল্যাক নাইটের কথা মিথ্যা নয়- স্যার স্টিফেনের আত্মা শূলের আঘাতে দেহ ছেড়ে পরলোকের দিকে যাত্রা করেছে, পড়ে আছে শুধু মৃতদেহ।
স্যার জিওফ্রে ম্যালপাৰ্ট নামে যে নর্মান নাইট দ্বৈরথ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিল, স্যার স্টিফেনের অবর্তমানে সেই হল নৰ্মান বাহিনীর অধিনায়ক। প্রথা-অনুসারে সে এইবার অস্ত্র সমর্পণ করতে এগিয়ে এল ব্ল্যাক নাইটের দিকে।
ম্যালপার্টের যুদ্ধাস্ত্র ছিল তদানীন্তকালে বিখ্যাত প্রকাণ্ড এক রণকুঠার। উক্ত কুঠার ছিল অতিশয় গুরুভার। ম্যালপার্ট অস্ত্রটিকে মাথার উপর তুলে ধরতে পারত না। কিন্তু এমন ভারী আর ধারাল ছিল সেই অস্ত্রটি, যে, কিছুটা তুলে আঘাত করতে পারলেই কার্যসিদ্ধ হত।
ম্যালপার্ট এগিয়ে এসে কুঠারটি সমর্পণের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিল ব্ল্যাক নাইটের দিকে, তারপর কম্পিত স্বরে বলল, হে বিজয়ী বীর! এই কুঠার গ্রহণ করুণ এবং প্রথা অনুসারে জনসমক্ষে আপনার নাম, ধাম ও সম্পূর্ণ পরিচয় ঘোষণা করুন।
বাঁ হাতে কুঠারটি ছিনিয়ে নিয়েই ব্ল্যাক নাইট অস্ত্রটিকে অবহেলাভরে দূরে নিক্ষেপ করলেন। সমবেত জনতা বিস্মিত নেত্রে দেখল সেই গুরুভার কুঠার শূন্যপথে আট-দশ হাত অতিক্রম করে মাটির উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল। এই অমানুষিক শক্তির পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল আর নর্মান সেনাবাহিনী।
ব্লাক নাইট বললেন, হ্যাঁ, অস্ত্র সমর্পণ করার সময়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে আমার পরিচয় জানার জন্য তোমরা আগ্রহ প্রকাশ করতে পার– সে অধিকার তোমাদের আছে।
একটু থেমে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, বন্ধুবর রবিনহুড এবং তার সহচরবর্গও আমার পরিচয় জানতে উদগ্রীব। আমি বলেছিলাম সময় হলেই স্বনামে আত্মপ্রকাশ করব। এবার সময় হয়েছে।
এক টান মেরে শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেলে ব্ল্যাক নাইট বললেন, ম্যালপার্ট! চেয়ে দেখ– বোধ হয় আমি তোমার অপরিচিত নই।
ব্ল্যাক নাইটের আবরণমুক্ত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ম্যালপার্টের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অস্ফুট আর্তনাদ।
পরক্ষণেই ভূমিতলে জানু পেতে বসে সে বলে উঠল, রাজা রিচার্ড! আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুণ।
গর্বোন্নত মস্তক তুলে ব্ল্যাক নাইট বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, নান সৈন্যগণ। তোমরা শ্রবণ করো আমার নাম রিচার্ড প্ল্যান্টাজেনেট। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের আমিই প্রকৃত অধিকারী। আমি যে প্যালেস্টাইন থেকে বহু বিপদ-আপদ অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছি, সেকথা এখনও জনসাধারণের অজ্ঞাত। কিন্তু আমার ভাই জন এবং রাজদরবারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমার গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেকথাও আমি জানি। যদি সহজে জন আমাকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন ছেড়ে দিতে রাজি না হয়, তাহলে আমি যুদ্ধ করব। সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে অনেকেই এক সময়ে আমার অধীনে যুদ্ধ করেছ। তবু তোমরা যদি আমাকে সমর্থন করে আমার অনুগামী হতে অনিচ্ছুক হও, তাহলে স্বচ্ছন্দে এই স্থান ত্যাগ করে যথা ইচ্ছা গমন করতে পার; কেউ তোমাদের বাধা দেবে না।
সৈন্যদের মধ্যে জাগল অস্ফুট কোলাহল, ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল সেই শব্দের তরঙ্গ, অবশেষে সমুদ্র-গর্জনের মতো প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল নর্ম্যান-সেনার উল্লাস, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
শূন্যে হাত তুলে রিচার্ড সেনাদের স্তব্ধ হতে ইঙ্গিত করলেন। জয়োল্লাস থামতেই রিচার্ড আবার উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন, সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক, তারা নির্ভয়ে স্থান ত্যাগ করতে পার। কেউ তোমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করবে না।
একটি প্রাণীও স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল না। শত শত কণ্ঠে আবার জাগল জয়ধ্বনি, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
একটু দূরেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবিনহুড। সেইদিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রিচার্ড বললেন, মাস্টার রবিন! এদিকে এস।
রাজার সামনে এসে নতজানু হয়েই অভিবাদন জানাল রবিনহুড। তাকে উদ্দেশ্য করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! দেশে এসে তোমার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা নানারকম কথা শুনে তোমাকে দেখার আগ্রহ হয়েছিল। তাই ব্লাক নাইটের ছদ্মবেশ ধারণ করে শেরউড বনে প্রবেশ করেছিলাম। যা দেখলাম, যা জানলাম, তাতে বুঝতে পারছি।
বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে মর্মভেদী দৃষ্টিতে রবিনহুডের দিকে তাকালেন রিচার্ড। ভূমিতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রবিনহুড স্থির হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল রাজার অভিমত শোনার জন্য তার সহচর দস্যুদলের চোখে-মুখে ফুটল শঙ্কার আভাস।
বুঝলাম, রিচার্ড তার অসমাপ্ত বাক্য সমাপ্ত করলেন, আমার পক্ষে তোমার মতো একটি মানুষের সাহায্য নিতান্তই প্রয়োজন।
তরবারি কোষমুক্ত করে সেই তরবারির অগ্রভাগ রবিনহুডের স্কন্ধে স্থাপন করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! আজ থেকে তুমি আর শেরউড বনের পলাতক নও। তোমাকে আমি নটিহাম নগরীর শেরিফের পদে নিযুক্ত করলাম। তোমার সঙ্গীরা এখন থেকে তোমার দেহরক্ষী সেনাদলে পরিণত হল। সবাইকে জানিয়ে দাও, এখন থেকে শেরউড বন রাজা রিচার্ডের সম্পত্তি- এই বনে হরিণ মারলে হরিণ-শিকারির প্রাণদণ্ড হবে।
উঠে দাঁড়িয়ে বিহ্বল কণ্ঠে রবিনহুড বলল, রাজা রিচার্ড। যতদিন বাঁচব ততদিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে রাজসেবা করব।
তারপরই কোষমুক্ত তরবারি ঊর্ধ্বে তুলে রবিনহুড চিৎকার করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল ও নর্ম্যান-সেনাবাহিনী রবিনহুডের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সমবেতভাবে গর্জন করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়।