শেয়ালের গর্তে

শেয়ালের গর্তে 

আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। মেজর জেনারেল ফিরোজের বাড়ি থেকে বেশ কয়েক মিটার দূরের একটা ঝোপের ভেতরে বসে আছেন শংকর। এক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে বাড়িটাকে। এখন পর্যন্ত কাউকে বাড়ি থেকে বের হতে কিংবা ঢুকতে দেখেননি তিনি। অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো দোতলা বাড়িটা। একেবারে নিস্তব্ধ। যেন কেউ নেই বাড়িটায়। 

অভিজাত আবাসিক এলাকা। তাই প্রতিটা মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। শংকর ইচ্ছা করলেই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। ফিরোজের বাড়ির সামনেই তিন রাস্তার মোড়। সেখানে দুইটা সিসিটিভি দেখা যাচ্ছে। শংকর সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। 

আরও দশ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরে একটা হাইলাক্স পিকআপ ট্রাক আসতে দেখল শংকর। ট্রাকটা কাছাকাছি আসতেই ট্রাকের আড়ালে দৌড়ে ফিরোজ হকের বাড়ির সীমানা প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন তিনি। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে প্রাচীর টপকে বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়লেন। 

বাড়ির সামনে একটা এলইডি বাল্ব কিছুটা জায়গা আলোকিত করে জলছে। বাকিটা আঙিনা অন্ধকারে ডুবে আছে। পাঁচ বছর আগে যেমন দেখেছে ঠিক তেমনই আছে বাড়িটা। একজন মেজর জেনারেলের বাড়ি এমন সাদামাটা হতে পারে, কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। 

প্রাচীর ঘেঁষে লাগানো ফুল গাছের পাশ দিয়ে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে গেলেন শংকর। দোতলার জানালাগুলোতে নজর রাখলেন। কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে আস্তে আস্তে বাড়ির পেছন দিকে গেলেন শংকর। বাড়ির পেছন দিকটা খানিকটা আলোকিত করেছে উল্টো দিকের রাস্তা থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলো। 

বাড়ির পেছনে দরজাটা স্বাভাবিকভাবেই আটকানো। শংকর আশেপাশে শক্ত কোন জিনিস খুঁজতে লাগলেন। যেটা দিয়ে দরজাটায় চাড় দেওয়া যায়। একটু দুরেই দেয়ালের সাথে একটা শাবল আর একটা কাঠের ক্রেট ঠেস দিয়ে রাখা। শংকর ক্রোবারটা দিয়ে দরজাটায় একটা চাড় দিলেন। দরজাটা চাপা একটা আর্তনাদ করে খুলে গেল। শংকর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন কোথাও কোন দ্বিতীয় শব্দ হয় কিনা। 

দ্বিতীয় কোন শব্দ হল না। মানে কেউ কিছু শুনতে পায়নি। 

একটা ছোট সরু করিডোর। একটা পঁচিশ পাওয়ারের টাংস্টেনের বাল্ব জ্বলছে। করিডোরের শেষ মাথায় দুইটা দরজা দেখতে পেলেন শংকর। একটা ডানে, আরেকটা বামে। দুই হাতে শাবলটা আঁকড়ে ধরলেন। ঘামে ভেজা হাতের তালুজোড়া শাবলটাকে জড়িয়ে ধরল। যেকোন একটা দরজা খুলে কেউ বেরিয়ে আসলে প্রথমে শংকরকেই দেখতে পাবে। শংকরের লুকানোর কোন পথ নেই। যেই বের হোক, তাকে এই শাবল দিয়ে আঘাত করতে হবে। 

হঠাৎ বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দ হল। কেউ একজন বাড়িতে ঢুকছে। শংকর তাড়াতাড়ি বাম দিকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দরজা আটকে দিলেন। একটা চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। শংকর কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন কণ্ঠটা কার সেটা বোঝার জন্য। শুনতে পেলেন কণ্ঠটা বলছে, “করোলার চাবিটা দাও তো রুস্তম।” এটা কি মেজর জেনারেল ফিরোজ হকের গলা? এত চাপা কণ্ঠস্বর যে ফিরোজ চিনতে পারলেন না। পেছনে দুই পা পেছাতে গিয়েই ঠাড করে একটা শব্দ হল। শাবলটা একটা গাড়ির সাথে বাড়ি খেয়েছে। শব্দটা বেশ জোরেই হয়েছে। এটা গ্যারেজ। শংকর গ্যারেজে ঢুকে পড়েছেন। 

হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ গ্যারেজের দিকে আসতে লাগল। শংকরের সামনে দুইটা পথ খোলা। এক, যে আসছে তাকে সজোরে শাবল দিয়ে আঘাত করা। আর দুই, গাড়ির নিচে লুকিয়ে পড়া। 

শংকর গাড়ির বনেটের ওপরে দুই হাত দিয়ে ভর দিতেই ক্লিক করে একটা শব্দ হল। গাড়ির ডিকিটা খুলে গেল। পায়ের শব্দ খুব কাছে চলে এসেছে। শংকর তাড়াতাড়ি ডিকির ভেতরে ঢুকে ডিকিটা লাগিয়ে দিলেন। 

খড়খড় করে গ্যারেজের শাটার ওঠার শব্দ হল। পায়ের শব্দটা আস্তে আস্তে গাড়ির কাছে এলো। তারপর গাড়িতে উঠে দরজা লাগানোর শব্দ হল। একটা কণ্ঠ বলল, “গেটটা লাগায়ে দাও রুস্তম।” কণ্ঠটা শংকরের কাছে একেবারেই অচেনা মনে হল। এটা আর যারই হোক, ফিরোজের না। কিন্তু এই কণ্ঠটা কোথাও যেন শুনেছেন বলে মনে হলো তার। 

গাড়িটা স্টার্ট নিতেই শংকর ভয় পেয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে এখনি বের হওয়া দরকার। তার কাজ এই বাড়িতে। এই গাড়ি কোথায় যাবে তার জানা নেই। 

শংকর গাড়ির ডিকিটা খোলার চেষ্টা করতেই বুঝলেন, এই ডিকিটা শুধু বাইরে থেকে খোলে। ভেতর থেকে না। শংকর ডিকির ভেতরে বন্দী হয়ে গিয়েছেন। 

গাড়িটা একটু কেঁপে উঠে চলা শুরু করল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *