শেফালির দোদুল দোলা

শেফালির দোদুল দোলা

খালের বাঁকে হিজলগাছের ডাল থেকে কাঠের পিঁড়ি ঝুলিয়ে দোলনা বানিয়ে দিয়েছিল বটু কাকা। দোলনাটা ছিল মাটি থেকে বেশ উঁচুতে, গাছের গুঁড়ি বেয়ে চার-পাঁচ হাত উঠে দোলনার মোটা দড়ি হাতে পেয়ে সাবধানে চড়তে হতো। প্রথম প্রথম শেফালির ভয় করত। গাছের গুঁড়িটা মোটাসোটা, বেয়ে ওঠা কঠিন ছিল না, হাত-পায়ের ভরে হামা দিয়ে কিছুটা উঠলেই দাঁড়ানোর মতো একটা দু-মুখো চওড়া ডাল পাওয়া যেত, ওখান থেকে দোলনার দড়িটা হাতের নাগালে। তবে নিজের ভর সামলে দড়ির ফাঁকে শরীর গুঁজে পিঁড়িতে বসতে সাহসের দরকার পড়ত। বটু কাকা সাহস দিত, ‘আমি আছি, তুই খালি দুই হাতে কিটমিটাইয়া দড়ি ধইরা থাকবি।’ শেফালির রাগ হতো, দোলনা যদি বানালই, আরও নিচুতে ঝোলালে কী অসুবিধা ছিল! নিজে নিজেই চড়তে পারত। বটু কাকা সে কথায় কান দিত না, বলত, ‘ডরাছ ক্যান? ডুল্লিতে উপরে বইসা দুলবি, হাওয়া খাইবি, দেখবি কত মজা। অ্যাই দ্যাখ’ বলে সে তার আড়াই-তিন বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে দোলনায় চেপে বসতে নিচে থেকে শেফালির কী চিল্লাচিল্লি, ‘বীণারে চাইপা ধরেন, পইড়া যাইব।’

সাত-আট বছরের শেফালির সে ভয় কাটতে বেশি দিন লাগেনি। বটু কাকা যেমন বলেছিল, পয়লা দিন তাকে সাবধানে পিঁড়িতে বসিয়ে আস্তে ঠেলা দিতে ভয় পেলেও মজা যা পেয়েছিল বলার না। ঠিকই তো, ওপর থেকে শূন্যে ভেসে চলার মজা কি নিচু ডুল্লি চড়ে পেত? দুই-তিন দিন চড়ার পর সাহস বেড়ে গিয়েছিল, নিজে নিজেই চড়ে বসত, আর গাছের ওই দু-মুখো ডালে বসে পিছন থেকে যে ঠেলা বা ধাক্কাটা দিত তার নামটা গাছের নামে নাম—হিজল, দুই বছরের ছোট ভাই। হিজল ধাক্কাগুলো দিত আস্তে, জোরে দিতে বললে বলত, ‘পইড়া যাইবি বুজি, মায় আমারে মারব।’ পড়ে গেলে শেফালির কী হবে সে কথা না ভেবে গাধাটা নিজের মার খাওয়ার ভয়েই থাকত।

শেফালি টই টই করে সারা দিনই ঘুরে বেড়াত। দোলনা পেয়ে সে টানা দুপুর বাতাসে ভেসে বেড়ায় আর এর মূল কারিগর যে বটেশ্বর ওরফে বটু পাল জানতে পেরে শেফালির বাবা মেরাজ আলী ফকির তাকে বকাঝকা করেছিল, ‘তর কেমন আক্কেল, কাচ্চা-বাচ্চারা সারাদিন ডুল্লি চইড়া নাচে, কুনদিন কুনটা পইড়া আত-পাও ভাঙব, তহন বুঝবি ঠ্যালা।’

খালপাড়ে দোলনায় চাপার মজা বড় হয়েও শেফালি ভুলতে পারত না। কী যে নেশায় পেয়ে বসত, একবার চাপলে নামতে মন চাইত না। শুরুতে যখন চড়ত, তখন তো গায়ে জামা-টামা থাকত না, শুধু কোমরের নিচে কুঁচি দেওয়া খানিকটা লম্বা ঝুলের প্যান্ট। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের ঝাঁ ঝাঁ গরমে আরামের ঠাঁই বলতে দোলনার ছোট পিঁড়ি, খালি গায়ে খালের পানি সাঁতরে ওঠা ঠান্ডা বাতাসে মনে হতো ঘুম চলে আসবে।

গায়ে জামা চড়াতে হলো মায়ের থাপ্পড় খেয়ে। সেদিনের কথা শেফালি ভোলে কী করে! দুপুরের রোদে উঠানে ঘর কেটে একা একাই লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা দোক্কা খেলছিল। তার খেয়াল নেই মা রুশনি বেগম দাওয়া থেকে অপলক চোখে তার কুতকুত লাফানো দেখছে। একটু পরে কাছে ডেকে বলা নেই কওয়া নেই, গালে ঠাস্ থাপ্পড়। কী দোষ, থাপ্পড় কেন, ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু কাঁদতে পারছে না—এ অবস্থায় মা তাকে হিড়হিড় করে ঘরে ঢুকিয়ে দড়িতে ঝোলানো সেবার রোজার ঈদে কেনা ফ্রকটা ছুড়ে দিয়ে কী বলবে ঠিক করতে না পেরেই যেন কটমটিয়ে তাকাল কাঠি কাঠি হাড়ে বোনা চাটাইয়ের মতো তার পলকা বুকের দিকে। গালে থাপ্পড়ের জ্বালা, আবার হাতে মাত্র দুই-তিনবার পরা প্রায় নতুন ফ্রক। শেফালি কান্না ভুলে মায়ের দিকে তাকাতে রুশনি বেগম ঝামটে উঠেছিল, ‘বেশরম মাইয়া, বুক উঠতাছে ঠার পাছ না!’ কী উঠছে? নিজের বুকে চোখ চালিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ফের মায়ের দিকে সাহসভরে চোখ তুলতে মা গলা নরম করেছিল, ‘আর খালি গতরে ঘুরবি না, খবরদার কুনু দিন যেন না দেখি। নে এইটা পিন।’

গরমের মধ্যে জামা, খালি গায়ে ছিল বলে থাপ্পড়—কোনো দিশা না পেয়ে শেফালি গলা গলিয়ে ফ্রকটা টেনে নামিয়েছিল। থাপ্পড়ের কারণ খুঁজে না পেয়ে ঘরের এক কোণে বসে বসে হঠাৎ কী মনে করে বুক উদোম করে এপাশ-ওপাশ পরখ করে নজরে পড়ার মতো কিছু না পেলেও এক টানে জামাটা টেনে নামিয়ে সেই যে শেফালি না জেনে না বুঝে বড় হতে লেগে গিয়েছিল, আর ঠেকায় কে!

অনেক বছর পর পৌষ মাসের এক হিম-হিম সকালে কোনো কারণ-টারণ ছাড়াই ঘটনাটা মনে পড়তে শেফালি ভাবল রুশনি বেগমের সেদিন তাকে থাপ্পড় মারাটা উচিত হয়নি। তাদের দুই বাড়ি তফাতে রুকিয়াকে তো তার মা মারধর দূরের, বুঝিয়ে বলেছিল। যে কারণে ছোটবেলায় রুকিয়ার গা-গতর কদাচিৎই উদোম দেখা গেছে। রুকিয়াদের অবস্থা তাদের চেয়ে ভালো, বাজারে রুকিয়ার বাবার মুদি দোকান, ওরা খায়-পরে ভালো। রুকিয়ার স্বাস্থ্য তার মতো টিঙটিঙে ছিল না, জামার ওপরে ওড়নাও ধরেছিল শেফালির বেশ আগে। তবে গায়ে জামা চড়ানো ও চড় খাওয়ার সেই ঘটনার পর শেফালিকে যে যন্ত্রণা পেয়ে বসেছিল তা দিনে অন্তত দুই-তিনবার বুক উদোম করে বা না করে মা-র কথাটা পরখ করা। এত দিন পর সেসব মনে করে হাসি পেলেও এই পৌষে আঠারো পাড়ি দেওয়া শেফালি বুক ভার-ভার আচনক শিউরানিতে প্রায় সময়ই চমকে চমকে ওঠে।

চমকে ওঠার বড় কারণ তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। যে রুকিয়া তার আগে ওড়না ধরেছে, তার বিয়ের নাম-গন্ধ নাই, এদিকে শেফালির বাবা মেরাজ আলী ফকিরের মাথাভরতি দুশ্চিন্তা, কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলে বিয়ের খরচ জোগাবে কী করে? সরাইলের যে বড় গৃহস্থ ঘর থেকে প্রস্তাব এসেছে তারা কি তার অবস্থা না জেনেই আগ বেড়েছে? এ কী করে হয়, বিয়ে বলে কথা, কেমন ঘর থেকে মেয়ে নিচ্ছে খোঁজ-খবর করবে না! দেখবে না ঘর-দুয়ার কেমন, রুজি-রোজগারের কায়দা কী? না হয় দেখতে-শুনতে শেফালির মতো মেয়ে পাঁচ-সাত গ্রাম ছুঁড়ে মিলবে না, তাই বলে মেরাজ ফকিরের যা জমাজমি তা থেকে যে সারা বছরের খোরাকি পর্যন্ত হয় না, এটা দেখার বিষয় না!

খবরটা চাউর হয়ে গেছে, সে বলেনি কাউকে। তবে রুশনি বেগম বলতে পারে, মেয়েমানুষের তো আবার গলায় গঙঘা নাই, পেটের কথা ওগরাতে সময় লাগে না। যে শুনেছে সে-ই অবাক হয়েছে। সরাইল জায়গাটা উন্নত, দুই ফসলি খেতে আমন, আউশ দুই-ই ভালো হয়, মানুষের অভাব-অনটন তেমন নাই। শুধু মানুষের কথা না, সরাইলের বাঘা কুকুরের যেমন সারাদেশে নাম-ডাক, তেমনি সরাইলের মোরগেরও। প্রথমে আত্মীয়-স্বজন, পরে গ্রামের অন্যরাও শামিল হলো। ঘটনা কি সত্য? মেরাজ ফকির মহাবিপদে, কী বলে? হ্যাঁ, আলাপ একটা এসেছে, তবে কে না জানে উড়ো আলাপে বিয়ের মতো ঘটনা ঘটে না, একশ একটা কথা হবে, তার পর সব ঠিকঠাক থাকলে, আর সব কথার শেষ কথা যদি খোদাতালার হুকুম হয় তবেই না। মেরাজ ফকির যতই পিছলাতে চায়, লোকজন ছাড়ে না। কথা বের করতে কৌতূহল যেমন, ভিতরে ভিতরে হিংসার জ্বলুনিও কম না। বড় ঘর, বড় ঘরের আদব-লেহাজ আলাদা, এমন ঘরে মেয়ে দিয়ে মেরাজ ফকিরের কি আর এ জীবনে মেয়ের মুখ দেখার কপাল হবে? বরপক্ষ ঘর আলো করা বউ চায়, ভালো, কিন্তু খালি রূপের রোশনাই-ই কি সব! লেখাপড়া তো নাই, ক্লাস ফাইভের বিদ্যায় রোশনাই কত দিন টিকবে? তার পর সমাজ আছে না, মেলামেশা আছে না? মেরাজ ফকির আর রুশনি বেগম যখন বেয়াই বাড়ি যাবে, নিজেদের জামা-কাপড় জোটাতে না একটা বাছুরকে হাটে তুলতে হয়!

পৌষ মাসের হিম ভোরে কাঁথার নিচে গুটিসুটি শুয়ে শেফালি ভাবে বিয়েটা কি এই পৌষেই হবে, শীত-কাঁথার ওম থাকতে থাকতে? পরপরই তার ভুল ভাঙে, সামনে পুরো মাঘ মাস। মাথায় তার এ পোকাটা ঢুকিয়েছে বছর চারেকের বড় মামাতো বোন হাসনা। দুই বছর আগে হাসনার বিয়েতে ঘরসুদ্ধ সবাই হাসনাদের কসবার বাড়িতে গিয়ে সুখ পায়নি। ভাদ্র মাস তখন। এই প্যাচপেচে গরম, এই আবার বৃষ্টি। গরমে গায়ে কাপড় রাখা মুশকিল, আর বৃষ্টি যদি হলো তাতেও শান্তি নাই, ফোঁটায় ফোঁটায় যা ঝরে তাতে শরীরের গরমটা আরও তাতিয়ে ওঠে। বিয়ের পর হাসনা তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে কানে কানে শুনিয়ে গেছে গরম কালে বউ হওয়ার জ্বালা। সেই সাথে এও বলেছে, করার কিছু নাই, শেফালির বিয়ের তারিখ তো তার মত নিয়ে হবে না, তবে দোয়া যেন করে শীতকালে যাতে হয়, দোয়ায় কী না হয়! এত কিছু থাকতে এই দোয়া? এমন দোয়া শুনে দুই কাঁধের দুই ফেরেশতা হেসে কূল পাবে না। তবে মনে মনে আশা ছিল, যদি হয়, হাসনাবু যেমন বলেছে, শীতকালে। কাঁথার নিচে পাশ ফিরে নতুন করে কুণ্ডলী পাকাতে গিয়ে মনে মনে বলল, মাঘ মাসের শীত কি কাঁথায় ধরবে!

.

খালপাড়ে আজকাল আর বাচ্চারা দোলনা চড়ে না। এক সময় জায়গাটা কী জমজমাট থাকত! বর্ষায় ভরা খালে বেপারিদের কারবারি নৌকা ভিড়ত। নৌকা বোঝাই হয়ে আসত কাঁঠাল, সুপারি, নারকেল, কলাই, খেসারি। কাঁঠালের ঘ্রাণে আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে থাকত। পাইকাররা এসে নৌকা থেকে মালামাল কিনত, দরদাম, হাসিঠাট্টার আওয়াজ দূর দূর থেকে পাওয়া যেত। পানি কিছুটা কমলে বেদে নৌকার বহর এসে ভিড়ত। এ নৌকাগুলো থাকত বেশ কিছু দিন। গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে যেত বেদেদের আসার খবরে। দাঁতের পোকা খসাতে বেদেনিদের শিঙা লাগানো তো ছিলই, সেই সাথে বাত, আধকপালি মাথাব্যথা, শূল বিষ কত ব্যারামই না ঝাড়-ফুঁক, জড়িবুটির কুদরতে সেরে যেত। কয়েক বছর হলো বেদে নৌকা আসা বন্ধ। আর আসবে বলেও মনে হয় না। পেছনে বড় ঘটনা আছে। অসুখ-বিসুখ সারানোর পাশাপাশি বেদেনিরা কারো কারো বুকে নতুন অসুখও পুরে দিত। সেসবও জড়িবুটির কেরদানিতে। তারা নামে এক বেদেনি কয়েক বছর আগে যে কাণ্ড ঘটিয়েছিল, মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয় শেফালির। বাইদানিকে সে দেখেনি, শুনেছে রূপ যেমনই হোক, ঠাক-ঠমক ছিল আর জড়িবুটির তার এমনই জোর, গ্রামের জোয়ানমর্দদের ভেড়া বানিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছিল। তার কাছ ঘেঁষতে কম-বেশি কায়দা-কানুন নাকি অনেকেই করেছে। তবে সেসব আসল কথা না। আসল যা—পুব পাড়ার ষাট বছরের আসমত হাজি তারার জন্য দিওয়ানা হয়ে পাঁচ-সাত দিন গ্রামছাড়া হয়ে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল আর তারাও সে সময় লাপাত্তা, এ খবরে গ্রামের লোকজন হুঁশ ফিরে পেয়ে বেদেদের ওপর চড়াও হয়েছিল, পোড়ানো হয়েছিল কয়েকটা নৌকা। আসলে মানুষের রাগটা নাকি আসমত হাজির ওপরেই ছিল, কী সাহস, পঁচিশ বছরের জোয়ানরা যা পারেনি তা চোখে আঙুল দিয়ে করে দেখাল ঘরে দুই বউ সামাল দেওয়া কামেল হাজি। কানাঘুষায় শেফালি এও শুনেছে বেদে বহর বিদায়ের পর গ্রামে কেউ কেউ মনের দুঃখে বিবাগি হয়ে গেছে, অন্তত একজনের কথা সবাই জানে—হাতেম ঘরামির ছোট ছেলে মেট্রিকফেল নওফেল।

খালের পানি এখন আর আগের মতো বাড়ে না। বর্ষার সময় পানি যা থাকে তাতে বড় নৌকা ভিড়তে চাইলে পারে, কিন্তু কেন ভেড়ে না শেফালি কারো কাছে জানতে চায়নি, হতে পারে অন্য কোনো ঘাট থেকে বেপারিদের মালামাল হাটে-বাজারে তুলতে সুবিধা। খালপাড় এখন বলতে গেলে বিরানই পড়ে থাকে, হাঁক-ডাক নাই, মানুষের সাড়াশব্দও না। মানুষের আনাগোনা, হাঁক-ডাকে মজা ছিল অন্য রকম। কোনো কারণ নাই, হঠাৎ হঠাৎ খালপাড়ে অনেক মানুষের সাড়া-শব্দে মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠত। এত জমজমাট জায়গাটা চোখের সামনে মরে গেল এজন্য শেফালির কষ্টই হয়। এখন শুকনার সময় পানি নেমে গেলে পলো দিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করে কাটে কয়েকটা দিন। বছর দুই আগে বড়দের সাথে হিজল পলো নিয়ে নেমে হাতে শিঙ মাছের গালা খেয়ে দুই দিন চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল।

বটু কাকা আর গাছে দোলনা ঝোলায় না। বটু কাকার মেয়ে বীণা দেখতে যেমন সুন্দর হয়েছে, পড়ালেখায়ও শেফালি শুনেছে ভালো। নিজের তার লেখাপড়ায় মন ছিল না, ইশকুলে যেত, রুকিয়া যেত বলে। তবে ফাইভের পরীক্ষা দেওয়ার পর রুকিয়া যেই মাইলখানেক দূরে জুনিয়র ইশকুলে যাওয়া শুরু করল, শেফালির বাবা-মা দুজনই রায় দিল, আর না। শুনে শেফালি ভাবল বাঁচা গেছে।

দোয়েল পাখি ও মনে রেখো ফটো স্টুডিও

ভোরের দিকে বিছানায় কুকড়েমুকড়ে থাকলেও বাইরে আলো ফুটতেই শেফালির কানে বাজে উঠানের কোণে খাট্টা আমগাছ থেকে একটা দোয়েলের টানা চিচিই চিইইওও ডাক। কী যে মজা পায় রোজ এই সময় কানের পর্দায় ঝিঁঝিঁ ধরিয়ে! সঙ্গে যদি আরেকটা থাকত, বোঝা যেত মনের সুখে এ ওকে ডাকছে, পুরুষটা মাদিকে ফুসলাতে কায়দাকানুন করছে। আসলে তো তা না। একটাই দোয়েল। লেজ তুলে গলা টানটান করে এত যে ডাকে, মুখে না রক্ত তুলে মরে।

ঘর ছেড়ে চাদরমুড়ি দিয়ে বাইরে এসে দোয়েলটাকে খুঁজল শেফালি। উঁচু ডালপালা ছেড়ে নিচের দিকে পাতাঝরা মরা ডালে বসে লেজ নাচাচ্ছে, যেন এতক্ষণ ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কীসের কী, চোখের পলকেই মরা ডাল ছেড়ে ওপরের দিকে ঝাঁকড়া ডালপালা-পাতায় হুটোপুটি জুড়ে দিল আর সেই চিচিই চিইইওও। এইটুকু পাখি, ভোরের সুনসান ভেঙে আওয়াজটা বুক চিরে চিরে যায়! রোজ ভোরে সে কোথা থেকে আসে, সারা দিনে আর তার সাড়া মেলে না। তবে এই গাছের একেবারে ওপরের দিকে আরেকজন এসে দুপুর বেলা ঠাঁই গাড়ে, থেমে থেমে ডাক শোনা গেলেও দেখা দেয় কদাচিৎ। বসন্তবাউরি কি রোদ সহ্য করতে পারে না বলে গাছের সব থেকে ঘন ঝোপে লুকিয়ে নিজের গাঢ় সবুজ শরীরকে পাতার সবুজে মিশিয়ে ফেলে?

উঠানজুড়ে গত সন্ধ্যায় মাড়াই করা ধানের স্তূপ। সারা রাত শিশিরে ভিজে সোঁদা মিষ্টি ভাপ ছড়াচ্ছে। এ বছর বন্যা হয়নি, বাবার মুখে শেফালি শুনেছে ধান ভালো হয়েছে। ধানে নাকি এবার পাক ধরেছে তাড়াতাড়ি। মেরাজ ফকির আর হিজল দুজনে কুলাতে পারছে না। হিজল এ বয়সেই লম্বা-চওড়া জোয়ান হয়ে উঠছে। ধান কাটতে বাপের সাথে হিজল হাত লাগায়, তবে নিজেরা সব বয়ে আনতে পারে না, কামলা লাগে। মাড়াইয়ের জন্য নিজেদের দুইটা বলদের সাথে ধারে আনা আরও দুইটাকে জুড়তে হচ্ছে।

সেই ছোটবেলা থেকে শেফালি দেখে আসছে ধান তোলার এ সময়টা সারা বছর থেকে একদম আলাদা। এ সময় বাতাসে একটা গন্ধ থাকে, সেটা যে সব সময় পাকা ধানের তা না। সেটা কি শীত-কুয়াশার গন্ধ, না কি যে ফুলের নামে তার নাম সেই শেফালি ফুলের, না কি আলাদা কিছু, না, সব মিলেমিশে মন কেমন করা এক চাপা, শিরশির নাকে টের-না-পাওয়া গন্ধ—শেফালি বলতে পারবে না। আর অন্য যে কারণে এ সময়টা আলাদা তা দুপুর গড়াতে না গড়াতে বাড়িতে বাড়িতে মাড়াইয়ের তোড়জোড়। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও বাদ যায় না। ছোটবেলা ঠুসি-মুখে চক্কর কাটা গরুর পেছন পেছন ঘোরা খেলা হিসাবে কম মজাদার ছিল না। মুখে ঠুসি বাঁধা থাকায় ধানে মুখ দিতে পারত না গরুগুলো, তবে এর মধ্যেও কোনো কোনোটা চালাকি করে ধানের স্তূপে মুখ ঘষে ঠুসির ফাঁকে কয়েক গাছি ধান চিবোতে লেগে যেত। গরুর পেছনে চক্কর কাটার খেসারত দিতে হতো রাতে শোয়ার সময়। চুলকানি আর চুলকানি। নারকেল তেল ঘষে কিছুটা কমলেও নখের লম্বা লম্বা টানে হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গুছি দড়ি দড়ি হয়ে ফুলে উঠত। এখনকার বাচ্চাদেরও কি সে রকম হয়?

রোদ উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমমুখো এ বাড়িতে রোদ ওঠে পেছন থেকে। পেছনের চাল বেয়ে সূর্য উঁকি দিতে লালচে রোদটা সামনের চাল গড়িয়ে দিনের শুরুতে উঠানে এলিয়ে পড়ে থাকে, ভেজা ধানে নড়েচড়ে চাঙ্গা হতে সময় লাগে। মা মুরগির খোঁয়াড় খুলে দিয়েছে, সবে রোদ লাগা চনমনে ধানের স্তূপে মোরগ-মুরগি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

হিজল এই শীতের মধ্যে শুধু একটা গেঞ্জি গায়ে কাঠকয়লার গুঁড়া দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরের দিকে যাচ্ছিল, একটা কঞ্চি তুলে মোরগ-মুরগির দিকে একবার তেড়ে গিয়ে পুকুরের পথে যেমন যাচ্ছিল, চলে গেল। সামনে ব্যস্ত দিন। মা-র অনেক কাজ। মাড়াই করা ধান সামলাতে দুপুর হয়ে যাবে। অন্যান্যবার মা-র সাথে শেফালি হাত লাগাত। এবার মা তাকে ধান ঝাড়াঝাড়ির কাজে ভিড়তে দিচ্ছে না। মা-র ভয় যদি চোখে বিঁধে? পুবপাড়ার শরীফার মা এসে মাকে সাহায্য করে।

বাড়িতে তার কদর বাড়ছে, এ আর বলার না। মা তাকে ধান ঝাড়তে দিচ্ছে না, চুলার কাছে যেতেও মানা করছে। মুখে কিছু বলছে না, তবে শেফালির তো জানতে বাকি নাই। সরাইল না কোথা থেকে যারা প্রস্তাব পাঠিয়েছে তাদের নাকি বিরাট অবস্থা। জমাজমি তো আছেই, আবার ব্যবসাও আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে, আর ব্যবসাটা যে চালায় সে-ই নাকি আসল, মানে বর। আরও যা শুনেছে, ব্যবসাদারের টাকার গুণই না শুধু, রূপও আছে। ভাবতে গেলে এই শীতেও শেফালির কপাল ঘেমে ওঠে। তার মন বলত গ্রামে যারা তার বয়সি তাদের মধ্যে রুকিয়ার বিয়ে হবে সবার আগে। রুকিয়া তার একমাত্র সই বলেই হয়তো এমন ভাবত। রুকিয়া পড়ালেখা চালিয়ে গেছে, এ বছর মেট্রিক দিয়েছে। আর দেখতে-শুনতেও খারাপ কী! শরীরটা যা একটু মোটার দিকে। শেফালির মাথায় আজকাল নতুন একটা পোকা—বউ হিসাবে সুন্দরী মেয়েদেরই সবার পছন্দ জানা কথা, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো না হলে কিসের সুন্দরী? পোকাটা তাকে এখানেই কুটকুট কামড়ায়। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে গায়ের রঙ ফরসা হলেও সে রোগা-পটকা, তা হলে এখন এই আঠারো পার হতে না হতে কী এমন হয়ে গেল, তার রোগা চেহারা-সুরত সেই সরাইলের ব্যবসাদার না মহাজনকে এই শ্যামপুরের খালপাড়ে এনে ভেড়াল! আরও যা আচানক খবর, ব্যবসাদার নাকি তার জন্য দিওয়ানা হয়ে আছে। এ খবরটাকে প্রথমে সে আমল দেয়নি, তাকে তো দেখেইনি, দিওয়ানা হবে কোন আক্কেলে! কিন্তু পরে যা শুনল তাতে তার নিজেরই আক্কেলগুড়ুম।

.

মেয়ে বড় হচ্ছে, একটা ফটো নাই ঘরে এ নিয়ে রুশনি বেগম প্রায়ই স্বামীর সাথে গজর গজর করত। বলত, ‘মাইয়ার বিয়া এমনে এমনেই অইব! আগের দিন আর নাই, এখন বিয়া দিতে ফটো লাগে, দেখাদেখি পরে, আগে ফটো দেখব পাত্রপক্ষ, তার পর ঠিক করব মাইয়া দেখতে আসব কি না।’

শেফালিরও মনে দুঃখ তার একটা ফটো নাই। রুকিয়ার তো এক এলবামভরা ফটো। মায়ের কথায় সে নেচে উঠেছিল, কিন্তু ধারেকাছে ফটো তোলার ব্যবস্থা কোথায়? বটু পাল শুনে বলেছিল সে তার বীণার ফটো তোলাতে নবীনগর যাবে, বীণা ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় বসবে, ফটো লাগবে। এত সহজে সমস্যা মিটে যাবে, শেফালি বা তার মা কারো মাথায় ছিল না।

ফটো তোলার উদ্দেশ্য যখন পরিষ্কার, শাড়ি না পরলে চলে? শেফালির একটাই শাড়ি। সেবার কসবায় হাসনার বিয়েতে গেল, শাড়িটা সে সময় তার মামি, হাসনার মা তাকে দিয়েছিল। হালকা গোলাপি জমিনের ওপর লাল-বেগুনি ডোরাকাটা টাঙ্গাইল। একবারই পরেছিল, তার পর মায়ের বাক্সে সেই যে তুলে রেখেছিল, খুলে দেখা হয়নি। ফটো তুলতে যাওয়ার দিন বাক্স থেকে শাড়ি বের করতে গিয়ে মন খুঁতখুঁত করছিল, পোকায় যদি কেটে থাকে, ন্যাপথলিন তো দেয়নি। শাড়িটা যেমন ছিল তেমন পেয়ে হাঁফ ছাড়লেও একটা ভালো ব্লাউজের অভাব মেটাতে রুকিয়ার কাছে হাত না পেতে উপায় ছিল না। রুকিয়া নানা রঙের গাদাখানেক ব্লাউজ দিয়ে বলেছিল তার যেটা পছন্দ যেন নেয়। শেষমেশ অবশ্য রুকিয়াই শাড়ির সাথে রঙ মিলিয়ে গোলাপি ছিটের একটা ব্লাউজ দিয়েছিল, আর সেফটিপিন গেঁথে ব্লাউজের কিছুটা ঢোলা হাতা এত সুন্দর আঁটো করে দিয়েছিল, বোঝার উপায় ছিল না। রুকিয়ার উপকারের যেন শেষ নাই, ব্লাউজ দেওয়ার পর নিজে সেধে দিয়েছিল একটা লাল টুকটুকে ব্যাগ, নাম যার ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগ হাতে কিভাবে ছবি তুলবে তাও দেখিয়ে দিয়েছিল, আর ব্যাগে ভরে দিয়েছিল গাঢ় গোলাপি পাউডারের ছোট কৌটা, কয়েকটা টিপ আর যা না হলেই নয়, কড়া লাল লিবিস্টিক।

শেফালির মন বলছিল ফটো যখন তুলবে, একটাতে কী হবে, তুলবে কয়েকটা। কোনোটা বসে, কোনোটা দাঁড়িয়ে। কিন্তু মনে রেখো ফটো স্টুডিওর কর্মচারী বা মালিক যে-ই হোক, সেই যে তাকে উড়ন্ত পরির ছবিওয়ালা বিশাল সিনারির সামনে টুল পেতে বসিয়ে, দাঁড় করিয়ে নিজের মাথা কালো কাপড়মোড়া বাক্সের ভিতরে ঢুকিয়ে, বের করে, আবার ঢুকিয়ে হাতল চেপে যাচ্ছিল তাতে ফটো তোলা যার-তার কাজ না এ ধারণা শেফালির মাথায় ভালোই গেড়ে বসেছিল। অবশ্য বীণা, যার প্রয়োজনেই বটু পালের সঙ্গে আসা, তার ফটো ঝটপট তোলা হয়ে গিয়েছিল।

পাঁচটা ফটোর কথা বলতে সেই মালিক বা কর্মচারী বলেছিল সে জানত একটা-দুইটায় মন ভরবে না, এত সুন্দর ফেস কাটিং, বেশ কয়েকটা সে তুলেছে, কয়টা ভালো হয় কে জানে, ভালো দেখে পাঁচটা ফটো আলাদা করে রাখবে। দুই দিন পরে যেন ডেলিভারি নেওয়া হয়। লোকটা ক্যাশমেমোর বই বাড়িয়ে নাম-ঠিকানা লিখে দিতে বলেছিল। বটু পালের ইশারায় শেফালি তার ও বীণার নাম-ঠিকানা লোকটার দেওয়া সুলেখা কলমে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিয়েছিল। লেখাটা সুন্দর হয়েছিল।

ফটো হাতে পেয়ে শেফালি সেই প্রথম বিশ্বাস করেছিল মানুষ যে তাকে সুন্দরী বলে, এমনি এমনি না। এক দৌড়ে রুকিয়াকে ফটো দেখাতে ওদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। ফটোগুলো সুন্দর হয়েছিল রুকিয়ারই কারণে। সেই যে গোলাপি পাউডার, রুজ না কি যেন নাম, এর জন্যই সাদাকালো ফটোতেও গালে চিক চিক রোশনাই ফুটেছে, আর কপালের টিপে চেহারা যেমন ঝলমলিয়ে উঠেছে, তেমনি লিবিস্টিকে ঠোঁটজোড়া যে তার না শবনমের বোঝার উপায় নাই। হিজল চিত্রালী পত্রিকা কেটে শবনমের বড় বড় রঙিন ছবি ভাত ঘষে ঘরের বেড়ায় লাগাত। কবরী, শাবানা, সুলতানার না, শুধু শবনমের। মা খেপে গিয়ে বলে, ‘এইগুলান লাগাস, নামাজ অইব আমার!’ হিজল শুনত না, পুরনো ছবি তুলে নতুন ছবি লাগাত, শবনমের। ছবিগুলো দেখে শেফালির মনে হতো শবনমের ঠোঁট গড়তে খোদাতালার না জানি কত খাটনি গেছে!

ফটোর ঘটনা ওখানে থেমে থাকেনি। মনে রেখো ফটো স্টুডিও-র লোকটা— এখন বোঝা যাচ্ছে কর্মচারী না, সে-ই মালিক—অর্ডারমতো পাঁচটা ফটো দিয়েছিল ঠিকই, তবে অন্য যে কাজটা করেছিল—দুইটা ফটো সে তার দোকানের কাচের শোকেসে বড় করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছিল। এতে নাকি দোষের কিছু নাই, তার নিজ হাতে তোলা ফটো, দোকানও তার, নিজের কাজ মানুষকে দেখাবে, এতে আপত্তির কী! না, আপত্তির কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং এ কে, কার ফটো, এমন ফেস কাটিং—এ নিয়ে লোকজনের কৌতূহল মেটাতে সে ক্যাশমেমোর বই খুলে ফটোর মালিকের ঠিকানাই শুধু না, হাতের লেখাও যে সুন্দর, দেখিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছিল। শেফালির যে আক্কেলগুড়ুম হয়েছিল তার শুরু এখান থেকেই।

শোকেসের ফটো কেনার জন্যও নাকি কেউ কেউ আবদার জুড়ত। কিন্তু কিভাবে কার মারফত ফটো গিয়ে পৌঁছেছিল দূরে সরাইল সদরের শাহ আলমের হাতে, এর চেয়ে আশ্চর্যের কী হতে পারে! ফটো আছে, সঙ্গে সুন্দর হাতে লেখা নাম-ঠিকানা, খুঁজে বের করা কঠিন কাজ না। এত দূর পর্যন্ত না হয় মানা গেল— দুনিয়ায় কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! তাই বলে ঠিকানা ধরে নিজে এসে দেখে গেছে, শেফালির বিশ্বাস হয় না, কিছুতেই না।

গাঁয়ে এসব নানা খবর রটাচ্ছে শীলবাড়ির নৃপেন ওরফে নিপেন।

রুশনি বেগমের হাতের জাদু ও কালো সানগ্লাস

মেরাজ ফকির যে ভয়টা পাচ্ছিল, তা-ই হলো। মেয়ের বিয়ে হবে, ভালো কথা, খুশির কথা, তাই বলে তার ভাঙা ঘরে আসমানের চান্দ—এতে রুশনি বেগম যতই নাচুক, তার জন্য ব্যাপার ভয়েরই।

মাত্র দুই দিন আগে খবর পাঠিয়ে পাত্রপক্ষের লোক হাজির। পাত্রের আপন দুই মামা, বড় বোন, বোনের বর আর বছর বারোর পাত্রের ছোট ভাই। খবর দিয়েছিল চারজন আসবে, তবে ছোট ভাইটা মনে হয় আসবে বলে জেদ ধরায় তাকে না এনে উপায় ছিল না। বাড়িতে চেয়ার নাই, এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়টা চেয়ার জোগাড় করা হলো, সঙ্গে থালা-বাসনও। হিজল কোথা থেকে দুইটা ছোট টেবিল এনে জোড়া দিয়ে ধোয়া বিছানার চাঁদরে ঢেকে দিতে উঠানের চেহারাটাই বদলে গেল।

বসার এন্তেজামে খুশি হয়ে মেরাজ আলী ভাবল তার হয়ে কথা চালানোর জন্য একজন সমঝদার মানুষ কোথায় পায়? গণ্যমান্য হলে খুব ভালো হয়, কিন্তু তার কথায় গণ্যমান্য কেউ আসতে রাজি হবে এমন ভরসা না পেলেও বাজার কমিটির মেম্বার আসাদ্দর আলীর কথা মনে পড়তে সাহস পেল। আসাদ্দর আলী তাকে চেনে-জানে, বিচার-সালিশে তাকে লোকে ডাকে, আর মেন্দি দেওয়া চাপদাড়ি ও মাথায় সাদা কল্লিদার টুপিতে তার চেহারায় যে নুর আছে দেখলেই বোঝা যায়। মেরাজ আলীর কপাল ভালো, তেমন কাকুতি-মিনতি ছাড়াই আসাদ্দর মেম্বার রাজি হয়ে গেল। পাত্রের বাপ-চাচার নাম শুনে একটু ভেবে বলল, ‘মাইয়ার তুমার কপাল ভালা, কিন্তু তুমারে যুদি নৌকা থাইকা নামতে কয়, কী করবা? সরাইলে কয়েক ঘর শুনছি কড়া মুসলিম লীগ, এরা এর মইদ্যে না কে কইতে পারে!

মেম্বার রাজি হয়েছে, মেরাজ আলী এতে মহাখুশি। ভোটে কে কোন মার্কায় ছাপ্পা মেরেছে এটা বড় ব্যাপার হলো? মুসলিম লীগের মার্কা কি সে জানেই না। আর ওরা যে নৌকা না, সেটাই-বা কী করে বলে! দেশে এবার নৌকা ছাড়া মানুষ আছে! নৌকা এত ভোট পেল খালি খালি!

ঘর-দুয়ার যতটা সম্ভব হিজল তার দুই সাগরেদ মিলে সাফসুতরা করল। শেফালিকে কেউ কিছু করতে বলল না। তবে সে একটা আরজি জানাল—রুকিয়া তো আসবেই, রুকিয়া ছাড়া চলবেও না, তবে সে চায় বটু কাকা আর বীণাকেও বলা হোক। বটু পালের বাবা-কাকার আমলে মুসলমান বাড়িতে খাওয়াদাওয়ায় কড়া নিষেধ ছিল। এখন ওরা খায়, তবে বড় খাসি মানে গরু বাদে।

মানুষ বেশি না, রুশনি বেগম অনেক দিন পর ভালোমন্দ রাঁধবে, তাও কুটুম খাওয়াতে, সে কোমর বেঁধে লেগে গেল। কথা বেশি বললেও রান্নায় সে জিনিসপাতি ঠিক পরিমাণমতোই দেয়। আর হাতের মজা বলে যে কথাটা চালু এ তার রান্নায় খুব খাটে। মেরাজ ফকির বউয়ের দশটা দোষ ধরলেও রান্নার নামে সে কাবু। রান্নার ধাতটা নাকি রুশনি বেগম পেয়েছে তার নানির কাছ থেকে, সেটা হয়তো ঠিক, তবে মেরাজ আলীর মতে তার হাতেই মজা। শুধু পানি আর লবণ দিয়ে শাকপাতা চুলায় চড়িয়ে নামালেই নাকি দুই থাল ভাত পেটে চলে যায়। হিজলকে দিয়ে রুশনি বেগম দোকান থেকে দুই দিন ধরে জিনিসপাতি আনিয়েছে। চিকন চাল, খাসির মাংস, ঘি, মসলাপাতি, কিশমিশ, বাদাম। মুরগি ঘরেই ছিল। পায়েসের জন্য দুধ, তাও ঘরের। তাজ্জব যা, খরচাপাতির জন্য তার নিজের জমানো টাকায়ই সব হয়ে গেছে দেখে মেরাজ ফকির লাজুক মুখে বলেছে টাকা তো সে জোগাড় করে রেখেছিল।

কোনো ঝুট-ঝামেলা, কথার মারপ্যাচ ছাড়া বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যাবে মেরাজ ফকির ভাবতে পারেনি। শেফালিকে ঘরের ভিতরে দেখানো হবে, না রুকিয়া ও বীণা তাকে উঠানে নিয়ে যাবে এ নিয়ে প্রথমে খানিকটা দোনোমনা থাকলেও শেষে রুকিয়ার কথাতে সাব্যস্ত হলো ঘরের চেয়ে বাইরে সুবিধা। খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুর গড়ানো বিকালের নরম আলোয় শেফালিকে দেখাবেও ভালো। শাড়ি-ব্লাউজের জোগান দিল রুকিয়া, সঙ্গে কিছু গয়নাপাতিও। রুকিয়াই সাজাল শেফালিকে।

পাত্রপক্ষ দেখল; পাত্রের বড় বোনের যেন চোখে পলকই পড়ছে না। তবে যার জন্য দেখা, সে যখন দিওয়ানা হয়ে আছে, তখন দেখাদেখি মানে আংটি পরানো, বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করা।

পাত্রপক্ষ বিদায় হতে বরের ব্যবসার কথা শুনে শেফালি কিছুটা অবাক হলো। ব্যবসা বলতে সে বুঝত দোকানদারি, বেচাবিক্রি। শাহ আলমের ব্যবসা সে রকম না। সে রাস্তা, পুল বানায়—মানে ঠিকাদার। শুনতে কানে খট্ করে লাগল। রুকিয়া বলল, ‘ইংলিশে কয় কনট্রাকটর। ঠিকাদারের চেয়ে কনট্রাকটর ভালা না?’

বীণা ছোট মানুষ, কিন্তু তাকেও তো কিছু বলতে হয়, বলল, ‘শেফালিদির জামাইয়ের ম্যালা টেকা না রুকিয়াদি? শাড়ি, সোনাদানার অভাব হইব না। বিয়াতে আমারে কিন্তু শাড়ি দেওন লাগব, তুমারে তো অনেক শাড়ি দিব, আমারে একটা দিবা, দিবা কিন্তু।’

শেফালি নিজেই রুকিয়ার শাড়ি পরে। বীণাকে শাড়ি দেওয়ার কথাটা কানে বাজলেও বিয়েতে সে অনেক শাড়ি পাবে এমন আগাম খবরে মনে মনে ঠিক করে ফেলল বীণাকে শাড়ি অবশ্যই দেবে। কিন্তু বরপক্ষ যে খেয়েদেয়ে এতক্ষণ খোশগল্প করে গেল, বরের ফটো দিল না যে! ওরা কি ফটো আনেনি, না আনলে কী কারণ, এমন কানাঘুষা যখন শীতসন্ধ্যার আগুয়ান আঁধারকে আগেভাগেই গাঢ় করে তুলছে, তখন হিজল দাঁত বের করে বুকপকেট থেকে আকাশি রঙের একটা খাম এগিয়ে দিতে রুকিয়া ছোঁ মেরে ‘আগে দেস নাই ক্যান’ বলে খাম থেকে ফটো বের করে চোখের সামনে নেড়েচেড়ে বলল, ইয়া আল্লা, এ তো বডি বিল্ডার আবার মোচও আছে। আন্ধা নাকি, সানগ্লাস পিন্দা কেউ ফটো তোলে!’

ফটোটা হাতে হাতে ঘুরল, শেফালির হাত বাদে। মেরাজ ফকিরের ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শুনে শেফালি কিছুটা শান্তি পেলেও রুকিয়া বিল্ডার না কী জানি বলল, আবার আন্ধাও বলল। এর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সে কী করে! তখন পর্যন্ত সে ফটোটা দেখেনি।

শেষপর্যন্ত এলো তার হাতে। রুকিয়া বলল, ‘কেমন?’

শক্ত-সমর্থ চেহারা, মাথাভরতি চুল, হ্যাঁ গোঁফ আছে, গোঁফ তো হিজলেরও উঠছে। শেফালি কী বলবে ভেবে পেল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তুই জানি কী কইলি, বিল্ডার?’

বীণা বলে উঠল, ‘বডি বিল্ডার, মানে কুস্তিগির।’

শেফালি চমকে উঠল। এরা এসব কী বলছে! তার তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না, না কি ফাজলামো করছে, এমনকি বীণাও! এ ছাড়া কালো চশমা দিলেই কি মানুষ কানা হয়ে যায় নাকি! ফটো তোলার সময় কালো চশমা পরার নিয়ম নাই? রুকিয়া বলল, ‘বডি বিল্ডার ক্যান বললাম, এই দ্যাখ শার্টটা কী টাইট, গলার নিচে বোতাম দুইটা কষ্ট কইরা লাগাইছে, মনে হইতাছে না শার্ট ছিড়া যাইব? ব্যায়াম-টেয়াম কইরা বডি বানাইছে। খ্যাত আছে।’

‘না গো দিদি, ইসমার্ট আছে। খ্যাত কও ক্যান?’ বীণা শাড়ি পাওয়ার লোভে কথাটা বলল কিনা কে জানে।

রুকিয়া ধমকে উঠল, ‘ছেমড়ি তুই ইসমার্ট আর খ্যাতের কী বুজোস!’

সন্ধ্যার পর ঘর খালি পেয়ে শেফালি ফটো নিয়ে বসল। কালো চশমার জন্য চোখ দেখা যাচ্ছে না, না হলে চেহারাটা ভালোমতো ফুটত। তবে গোঁফটা খারাপ কী! আর শরীর-স্বাস্থ্য ভালো এটা কি পুরুষ মানুষের খুঁত হতে পারে! তা হলে কি রুকিয়া তাকে হিংসা করেই এসব বলেছে? সন্দেহটা মনে উঁকি দিলেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না রুকিয়া তাকে হিংসা করবে।

কিন্তু বিয়ের তারিখ যে পৌষে না, মাঘেও না। ফাল্গুন মাসের শেষ শুক্কুরবার শুনে শেফালির হাসনার কথা মনে পড়ল। হাসনা বলেছিল বিয়ে হওয়া উচিত শীত থাকতে থাকতে, গরমকালে বিয়েতে সুখ নাই। ফাল্গুন মাসে কি গরম পড়তে শুরু করে, তাও ফাল্গুনের একেবারে শেষে—শেফালি কার কাছে জানতে চাইবে!

কপালে যা থাকে হবে। নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করে তারিখ ফেলা হয়েছে। এক দিক দিয়ে ভালোই হলো, তার বাবা কয়টা দিন সময় পাবে।

রাতে শুয়ে ঘুম কি আর হয়! বালিশের নিচে খামের ভিতরে শাহ আলম নড়েচড়ে, যেন তার গোঁফের খোঁচাও লাগে শেফালির গালে। কিন্তু উঠে যে হারিকেন ধরিয়ে ফটোটা দেখবে উপায় নাই। হাঁসফাঁস লাগে, মনে হয় চেহারাটা ভুলে গেছে, কালো চশমাটাই শুধু চোখে ভাসে। এদিকে রুকিয়ার কথায় মনে নানা খটকা। নাহ্, রুকিয়া তাকে হিংসা করতে যাবে কেন? রুকিয়া আর সে এক? রুকিয়া শিক্ষিত মেয়ে, ওর সম্বন্ধ আসবে আরও বড় ঘর থেকে, অনেক ধুমধাম করে ওর বাবা ওর বিয়ে দেবে।

জয়-পরাজয় মীমাংসা

একটানা বোঁ বোঁ আওয়াজটা কি বাতাসের? বক্স-কাম-গেস্টরুমের একমাত্র জানালার কাচে বাতাসের লুটোপুটি আধঘুমে কানে অচেনা ঠেকতে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে বাকি অর্ধেক ঘুমও কেটে যেতে জাফর সাদেকের ভুল ভাঙল। এটা তো আফগান বশির হামদানির বক্সরুম না। আওয়াজটা ফ্যানের, মশারির ওপরে অনেক উঁচু কংক্রিটের ছাদ থেকে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুরছে। শোয়া অবস্থায় জিরো পাওয়ারের ঘোর ঘোর আলোয় ঘরটাকে লাগছে মাঠের মতো, দেওয়ালগুলো দূরে- দূরে, ছোবড়ার শক্ত জাজিমপাতা নকশাকাটা খাটটা এতই চওড়া, অনায়াসে তিনজন হাত-পা ছড়িয়ে শুতে পারবে। ছোটবেলা থেকে খাটটাকে দেখে আসছেন নিচতলায় বাবা-মা-র শোবার ঘরে। হতে পারে মায়ের বিয়েতে এটা তার বাবা দিয়েছিলেন। জায়গাবদল করে খাটটা দোতলায় এলো কেন? এ ঘরে কি আজকাল কেউ শোয়? খুব সম্ভবত এটা বন্ধ থাকে, অনেক দিন দরজা-জানালা আটকানো ঘরে যে ধরনের মনমরা বাসি গন্ধ থাকে, সে রকম একটা নিস্তেজ গন্ধ নাকে লাগছে। পাল্লা-খোলা দুটো পাশাপাশি পর্দাহীন জানালার লোহার শিকে অন্ধকার চকচক করছে। দূরে কোথাও বিলীয়মান সাইরেনের শেষ টংকারের মতো একটা কুকুরের সরু গলায় ভয় তাড়ানো চকিত চিৎকার। রাত এখন কত? ঘরের দেওয়ালে ঘড়ি নেই। হাতঘড়ি খুঁজে সময় দেখতে ইচ্ছা করছে না। কেটে যাওয়া ঘুমটা মনে হচ্ছে ফিরে আসছে। চোখ বুজতে গিয়ে জাফর সাদেক নিজেকে আশ্বস্ত করলেন—তিনি এখন ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীর পৈতৃক বাড়ির মাঠের মতো ঘরের প্রকাণ্ড খাটে পুরনো সিলিং ফ্যানের বাতাসে ও গরমে ভোরের অপেক্ষায়।

‘তোর জিনিসপত্র কই? এই একটাই সুটকেস?’

বাইরে মে মাসের ঢাকার রোদ, ঘরের মধ্যে ভ্যাপসা গরম। দুপুর অনেকক্ষণ পার হয়ে এখন বিকাল, তাও রোদের দিকে তাকালে কপাল চিনচিন করে। জাফর সাদেক বসে আছেন সেই মাঠের মতো ঘরে হাতলওয়ালা বেতের চেয়ারে। ঠিক মুখোমুখি না, খানিকটা দূরত্বে খাটে পা ঝুলিয়ে বোন নওশিন। দুই বছরের বড় বোনকে ছোটবেলায় নাম ধরেই ডাকতেন, পরে মায়ের বকাবকিতে বা দু-একবার কান টানাটানিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপা ডাকটা মুখে না তুলে উপায় ছিল না। এত বছর বাদে সেটারই পরীক্ষা হয়ে গেল নওশিনকে দেখে অনেকটা অজান্তেই ‘কেমন আছো আপা’ বলে ফেলার পর। নিজের এই প্রায়-সাবলীল বলার ভঙ্গি জাফর সাদেককে কিছুটা হলেও চমকে দিল, যেন বিব্রতও করল। ‘কেমন আছো’-র পরে কী—এ চিন্তা থেকেই হয়তো নিজেকে হঠাৎ আড়ষ্ট লাগছিল। নওশিন তাকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করতেই যেন জিনিসপত্র, সুটকেসের কথা বলে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে দশ-এগারো বছরের দূরত্বকে এক ফুঁ-তে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘তার পর? সত্যিই এই এক সুটকেস নিয়ে বিলাতফেরত? রোগা হয়ে গেছিস কেন?’

এমন কথায় অন্য কেউ হলে যা করত, তিনিও তেমনি মুখে অর্থহীন হাসি টেনে তাকালেন। নওশিনকে মোটা লাগছে, তবে গায়ের রঙটা তো আগে ফরসাই ছিল, এখন বাঙালিরা আহ্লাদ করে যেমন বলে—উজ্জ্বল শ্যামলা, এর বেশি নয়। কলেজে জিওগ্রাফি পড়াতে গিয়ে দুনিয়া চষে বেড়ানোর ফল কি না কে জানে। এখন কোন কলেজে—ইডেনে, ঢাকা কলেজে না অন্য কোথাও? এত বছরে অন্তত দুটো প্রমোশন হয়ে যাওয়ার কথা। ওর বড় ছেলেটার নাম মনে আছে, রিংকু, ছোটটার ব্যাপারে কিছুই জানা নেই। হিথরোতে বোর্ডিং লাউঞ্জে ঢোকার আগে ডিউটি ফ্রি-তে চক্কর দিতে গিয়ে ইনস্টান্ট কফির বড়সড় জার আর একটা চকোলেটের টিন কিনেছিলেন। চেয়ার ছেড়ে খোলা সুটকেসে হাত দিতেই টিনটা পেলেন। নওশিনের হাতে দিতে গেলে নওশিন ভ্যাবাচেকা মুখ করে বললেন, ‘ওমা, ভাগনেদের জন্য? ওরা এলে তুই-ই দিস।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নওশিন আবার বললেন, ‘তার পর?’

এবার জবাব পেতেই প্রশ্নটা করা। জাফর সাদেক মুখ তুলে জানালায় ফালি ফালি রোদে তাকালেন, তার পর নওশিনের প্রশ্নের মতোই ছোট করে বললেন, ‘এসে পড়লাম।’

‘একেবারে?’

‘বলতে পারো।’

‘মা জানেন?’

‘কী?’

‘এই যে একেবারে…’

মায়ের সঙ্গে নাকি তেমন কথাবার্তা হয়নি?’

‘সময় পেলাম কই! গতকাল বিকাল থেকে ঘুমাচ্ছি, অবশ্য ঘুম-টুম হয়নি।’

‘যা গরম। তবু মায়ের সঙ্গে …’

পরিবারের একজনের সঙ্গে প্রথম মোকাবিলাটা এভাবে হয়ে যেতে জাফর সাদেক যেন জেটলেগের ঘোর থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলেন। মনে হলো নওশিনের উপস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে মোকাবিলা হয়ে গেলে ভালো।

এ বাড়িতে ফেরা যে তার জন্য পরাজয়, লন্ডনের পাট চুকানোর সময় তা খোঁচা দিলেও জাফর সাদেক জানতেন পরাজয় মেনেই তিনি যাচ্ছেন। নিজে যেমন বিশ্বাস করতেন দেশে ফিরবেন না, তার পরিবারেরও তা বুঝতে বাকি ছিল না। তারপরও এলেন, আসতে হলো। আসার আগে অনেক ভেবেছেন, এমনকি মনে আছে ইস্ট লন্ডনের ঘুপচি ট্রাভেল এজেন্সিতে টিকিট কাটতে বসেও ভেবেছেন। এখন এটা পরাজয় হোক বা অন্য কিছু, এসে যে পড়েছেন—এ-ই সত্য।

বাড়িতে বাবার সাথে সম্পর্কটা ছিল জটিল। পড়াশোনায় তার আগ্রহ নেই, সেটা হয়তো ছোটবেলায় বাবার দিক থেকে একটা কারণ ছিল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন কড়া শাসনে ছেলেকে বশ করবেন, তার কথায় ছেলে উঠবে-বসবে। পরিকল্পনাটা খাটেনি। স্কুলের ওপরের ক্লাসে উঠতে না উঠতে জাফর সাদেক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন—যার অনেকটাই ছিল বাবাকে দেখানো তিনি তাকে কতটা অগ্রাহ্য করেন বা করার ক্ষমতা রাখেন।

বাবা অ্যাডভোকেট আলতাফ চৌধুরী ছিলেন যাকে বলে হাইলি ডিসিপ্লিন্ড। সিভিল কেস করতেন। অহংকারী মানুষ ছিলেন, লোয়ার কোর্টে কোনো দিন যাননি। প্রথমে বাড়িতে, পরে মতিঝিলে চেম্বার করেছিলেন। অল্প দিনেই পসার বেড়েছিল, সঙ্গে খ্যাতি। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ছেলে একদিন তার চেম্বার আগলাবে। আলতাফ চৌধুরী বলতেন লিগ্যাল প্রফেশনটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। তার বাবাও ছিলেন এ পেশায়। মুর্শিদাবাদে অবশ্য তার বাবার তেমন পসার ছিল না, তবে পরিবারের সহায়-সম্পত্তি ছিল বিস্তর, আটচল্লিশ সালে নামমাত্র দাম ধরে বাড়ি-ঘর জমি-জমা এক্সচেঞ্জ করে এসে উঠেছিলেন ওয়ারীতে। রিফিউজি হয়ে ঢাকায় এসে সেই যে ছোটবেলা থেকে আলতাফ চৌধুরী নিজের পরিশ্রমে ভাগ্য গড়েছেন সে গল্পটা তাকে অনুপ্রাণিত করলেও জাফর সাদেককে তা টানত না, বিশেষ করে বাবার পিছু হেঁটে তারই তৈরি সাফল্যের মালা গলায় ঝোলাতে। বাবাকে বিগড়াতেই যেন হিউমেনিটিজ ছেড়ে কলেজে সায়েন্স নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় ফল ভালো করতেন না, তবে বুঝতেন একটু মন দিলে ভালো ফল করা কোনো ব্যাপার না। তার ইচ্ছা করত না। তবে বাইরের বই-টই প্রচুর পড়তেন ছোটবেলা থেকেই। আর শখ বলতে ছিল ফটোগ্রাফি। তখন সাদা-কালোর যুগ, তবে যেনতেন রকম না, তার ঝোঁক ভালো ছবি তোলায়। এ জন্য দরকার ছিল একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের সঙ্গে ভেড়া। সে সুযোগ পেয়েছিলেন তখনকার এক বন্ধুর সুবাদে, সেই বন্ধুর মামার স্টুডিও ছিল তোপখানায়, তুলতেন সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি। ভদ্রলোক কাজ জানতেন, আর তাকে আগ্রহ নিয়ে খুঁটিনাটি অনেক ব্যাপারে তালিম দিয়েছিলেন।

বাবার সঙ্গে বিবাদে ইন্ধন জুগিয়েছিল অন্য একটা ঘটনা। ছেলেকে দিয়ে যখন হলো না, তখন তার প্রিয় অ্যাসিসট্যান্ট শফিককে নানা কাজে, সম্ভবত অকাজেও, বাড়িতে ডেকে নওশিনের দিকে এগোনোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নওশিন তখন সবে জিওগ্রাফি অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। কয়েক দিন যেতে দেখা গেল, বাড়িতে প্রায় দিনই সন্ধ্যায় শফিক ও নওশিন চুটিয়ে গল্প করার নামে প্রেমে মশগুল। বাবার প্রশ্রয় তো ছিলই, সেই সঙ্গে মা-ও ভিড়েছিলেন শফিককে একাধারে হবু জামাই ও স্বামীর পেশার উত্তরাধিকারী বানাতে। বাবার পরিকল্পনা যে তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়া, জাফর সাদেককে তা সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াত। কোথাকার কোন লাফাঙ্গা তার বোনের সঙ্গে যখন খুশি সময় কাটাচ্ছে, ঘরে কাটাচ্ছে, বাইরে কাটাচ্ছে, আর বোনও তাকে নিয়ে যারপরনাই বিগলিত, ভাবতেই গা রি রি করত। ঘটনাটা তাকে এতই খেপিয়ে দিয়েছিল, খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছিলেন শফিক সাধারণ পরিবারের ছেলে, পরিবারে লেখাপড়া তেমন নেই, অনেক ভাই-বোন, আবার রোজগারে বলতে এক শফিকই। নওশিনকে বিয়ে করে বাবার নামি ল ফার্মের মালিক বনে যাওয়ার সুযোগ তার প্রায় হাতের মুঠোয়। মাকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি, যেন এ পরিবারের ভালোমন্দে নাক গলানোর অধিকার তার নেই। কথাটা হয়তো অস্বীকারের উপায় ছিল না, কিন্তু জ্বালাপোড়া যে হতো তার কী বিহিত! গুণ্ডা ভাড়া করে শফিককে পেটাবেন এমনও ভেবেছেন।

ততদিনে অবস্থা অনেক দূর গড়িয়েছে। দেরি করে লাভ কী, বিয়ে যখন হবেই, হয়ে যাক। হয়েওছিল, নওশিনের অনার্স পরীক্ষার মাসখানেক বাদে। বিয়ের আগে-পরে কয়েক দিন জাফর সাদেক বাড়ি ছেড়ে এক বন্ধুর সঙ্গে হোস্টেলে থেকেছেন। এর কয়েক দিন পরে হঠাৎ বাবার ম্যাসিভ স্ট্রোক, হাসপাতালে সপ্তাখানেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু শরীরের ডান পাশ পুরোপুরি অচল। এ অবস্থায় জাফর সাদেকের বাড়িতে ফিরে মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া করার কিছু ছিল না। সামনে তখন বিএসসি পরীক্ষা, পরীক্ষায় বসার ইচ্ছা ছিল না, সারা বছর বইয়ের ধারেকাছে যাননি। কী মনে করে বসলেন, টেনেটুনে পাসও করে গেলেন। বাড়ির পরিবেশ সে সময় তার জন্য অসহ্য। শফিক মেস ছেড়ে এসে উঠেছেন শ্বশুরবাড়িতে, শ্বশুরের সেবা-যত্নের পাশাপাশি মতিঝিলে চেম্বার চালানো সবই চলছে। নিজের বাড়িতে চোরের মতো জাফর সাদেক ঢোকেন, বের হন।

আলতাফ চৌধুরী বেঁচেছিলেন এর পর মাস ছয়েক। জাফর সাদেকের তখন মনে হলো আর না, এবার একটা কিছু করতে হয়। সেটা দেশের বাইরে যাওয়া ছাড়া আর কী হতে পারে! মা বাধা দিলেন, নওশিন খুব বললেন না যেতে, এমনকি গায়ে পড়ে তার বর শফিকুল ইসলামও।

ফিরবেন বলে তো যাননি। যাওয়ার সময় সত্যিকার অর্থে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হওয়ার চিন্তায় গলদ ছিল, সে তো যাওয়ার কিছু দিন পরেই বুঝেছিলেন। আর এই যে ফিরলেন, পরিকল্পনা ছাড়া?

নিজেকে বলার কিছু নেই, জাফর সাদেক শুধু এটুকু বোঝেন, ফিরেছেন মাথায় পোকা নিয়ে। আসার আগে মাস দুয়েক পোকারা তাকে পাগল করে রাখত, মনে হতো দেশে ফিরলে যদি পোকার দৌরাত্ম্য কমে। কিন্তু কী করে? সুটকেসে সেই পোকাগুলোকেই ভরে এনেছেন। নওশিনের কাছে অবাক লেগেছিল মাত্র একটা সুটকেস নিয়ে বিলাতফেরত, কিন্তু সুটকেসে যে নিজের মামুলি দু-চারটা জামাকাপড় বাদে সবই পোকা। খবরের কাগজের বান্ডিল বান্ডিল কাটিং, ছবি, দেশ-বিদেশের মানুষের বক্তৃতা-বিবৃতি, বই, লেখাপত্র। সেই সঙ্গে নিজের যখন যা মাথায় এসেছে তাও টুকে রাখায় পোকার বোঝা বেড়েছে কেবল। এসব পোকা তার মাথায় চরে বেড়াবে, মগজের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ডানা ঝাপ্টে দিশাহারা করে ছাড়বে, কয়েক মাস আগেও কি ভেবেছিলেন? যে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন ফিরবেন না বলে, সেখানে কীসের টানে ফিরলেন? টান, না জ্বালা?

দেশ বলতে কোনো দিন মাথায় কিছু ছিল না, দেশ মানে পিছু টেনে ধরা- এর বাইরে কিছু ভাবেননি। আর এখন দেশ বলতে? স্বাধীনতা কথাটা কি মাথায় নড়েচড়ে ওঠে, না পোকা-কিলবিল অন্য কিছু? লাখের কাছাকাছি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি ভারতীয় বাহিনীর হেফাজতে মহাআরামে দেশ ছেড়েছে, রেখে গেছে ক্যানসারের বিকট ম্যালিগন্যান্ট ফোঁড়া—তিন লাখ মেয়ের রক্ত-মজ্জা শুষে বাড়বাড়ন্ত ফোঁড়াটা ফাটছে।

জাফর সাদেকের এখানে কী কাজ? দেখতে এসেছেন? শেখ মুজিব নাম দিয়েছেন বীরাঙ্গনা, কার মাথা থেকে খেতাব বা তকমাটা এসেছে কে জানে! মেয়েরা এই খেতাব কপালে জ্বলজ্বলে টিপের গোল্লা বানিয়ে পরে গৌরব জাহির করবে! মনোয়ারা বেগম বীরাঙ্গনা, বেনুবালা বীরাঙ্গনা, নবীতুন বেওয়া! আরও বলেছেন বাবার নাম লিখতে গেলে মেয়েরা যেন শেখ মুজিবুর রহমান বসিয়ে দেয়। সংখ্যাটা বলা হচ্ছে তিন লাখ, তিন লাখে কতজন বেঁচে থাকবে কে জানে, যে কজনই থাকুক, তারা মন-প্রাণ উজাড় করে কী সুখই না পাবে সন্তানের বাবা বলে বিশ্বখ্যাত মানুষের নাম বসিয়ে! পত্রিকায় দেখেছেন যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের একটা তালিকা নাকি করা হয়েছে বা করার কাজ চলছে। কারা বেশি অপরাধী—যারা বেশি বেশি মানুষ মেরেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, না কি যারা রেপক্যাম্প পরিচালনা করেছে? হ্যাঁ, পরিচালনা বটে, ম্যানেজমেন্ট সব কিছুতেই লাগে, আর মিলিটারিরা যা করে তার পেছনে কঠোর শৃঙ্খলা থাকে যার একটা পোশাকি নামও রয়েছে—মিলিটারি অর্ডারলিনেস। কিন্তু চলে যে গেল সব কটা, একটাকেও ধরে আনা যাবে? যাওয়ার আগে বুক ফুলিয়ে বলে গেছে, ইট ওয়াজ ওয়ার, ইউ রেপ দ্য উইমেন।

জাফর সাদেক একটা চিঠির হদিস পেয়েছেন, এক পশতুন মেজর ঢাকা থেকে এক দেশোয়ালি বন্ধুকে লিখেছে—এখন বর্ষার মৌসুম, তার বন্ধু যেন নিজের সবজি খেতের যত্নআত্তি করে, আর সে অবশ্য এ সময় অন্য কাজে ব্যস্ত—টেইমিং দ্য বেঙলি টায়গ্রেসেস। টায়গ্রেস বলে সে না বুঝেই বাঙালি মেয়েদের মর্যাদা বাড়িয়েছে কি না কে বলবে, তবে জেনারেল নিয়াজি নাকি তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নানা সময় উসকে দিয়ে বাঙালি মেয়েদের সম্বন্ধে বলত, মাল-এ গনিমত। লুটের মাল, ওয়ার বুটি। নিয়াজির একটা বক্তৃতার টেপ পেয়েছেন জাফর সাদেক, পূর্ব পাকিস্তানের সব ডিভিশন কমান্ডারদের কনফারেন্সে বলেছে, ‘এটা কি হয় নাকি তুমি থাকবে এখানে, কাজ করবে এখানে, যুদ্ধ-যুদ্ধও এখানে, আর শরীরের তাকাজা মেটাতে ঝিলাম যাবে!’

ফলে সেই যে বলেছিল, ইট ওয়াজ ওয়ার, ইউ রেপ … এতে কিছুরই খেলাপ হয়নি। জেফ্রি ডেভিস, সেই অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি অফিসারের এই এক লাইনের বাণী দুনিয়ায় প্রচার করেছিল সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের মাধ্যমে আর জাফর সাদেকের বেকার, ঠনঠনে মাথাকেও ঠুকে ঠুকে বিগড়ে দিয়েছিল, সে কোথায়? লোকটা তো সাংবাদিক না, আনওয়ান্টেড প্রেগনেন্সি ঠেকানো বা টারমিনেট করা যার কাজ, সে এ দেশে এসে এই বিখ্যাত ওয়ানলাইনার সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েই বসে থাকেনি, শহর-গ্রাম ছুঁড়ে নিজে যেসব তথ্য বের করেছে তাতে ট্রেঞ্চে, বাংকারে, রেলের ওয়াগনে, পরিত্যক্ত স্কুলে, পোড়ো বাড়িতে, ওয়ারহাউসে নির্যাতিত মেয়েদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। সরকার বলছে তিন লাখ, জেফ্রির ধারণা আরও বেশি।

যা করছে, সব কি বিদেশিরা করছে? বাইরে থেকে যা শুনেছেন তাতে বিদেশিদের নামই এসেছে। কয়েকটা এনজিও রয়েছে, ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিরা রয়েছে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে, আর সাংবাদিকরা তো রয়েছেই। টেরেডেস হোমস, অক্সফাম গোড়া থেকেই আছে। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটি নাকি জোরেশোরে কাজে নেমেছে। ইসলামপুর রোডে অফিস খুলেছে, আর ওখানেই নির্যাতিতাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। নির্যাতিতা কথাটা দায়সারা শোনায়, আবার ধর্ষিতা কানে বাড়ি মারে। শিশু ভবন নামে মাদার তেরেসার আশ্রয়কেন্দ্রে মেয়েরা যেমন রয়েছে, তেমনি অনেক মেয়েরা তাদের নবজাতকদের ওখানে রেখে গেছে। কোনো একটা এনজিও-র সঙ্গে কি যুক্ত হওয়া সম্ভব? তাদের তো নানা ধরনের কাজ, যে কোনো কাজে যদি লাগতে পারেন। মাথায় যে এত পোকা, এগুলো ঝাড়ার একটা উপায় হতে পারে এদের কারো সঙ্গে ভিড়ে কাজ করা। তাদের কাজ, সেই সঙ্গে তার নিজের কাজও। লিখতে হাত নিশপিশ করছে, আর ফটোগ্রাফার তো হতে পারলেন না, এবার একটা সুযোগ পাবেন?

মান্তু, না কালসাপ

‘তুমি এই সব কী কও? সত্যই আমারে দেইখা পলাইছিলা?’

মান্তুর এ কথায় চম্পা কী বলবে! এবারই প্রথম ভেগে যেতে মনস্থ করেও শেষ দেখার অপেক্ষায় ভাগেনি। সেটা অবশ্য আম্মার কারণে, আম্মা যদি কড়া গলায় না শাসাতেন, সে ফ্যাক্টরিতেই যেত না। জবাকে রেখে যে দিকে চোখ যেত চলে যেত। আগে যতবারই জায়গাবদল করেছে বাধ্য হয়ে করেছে। তার মা যে বলত, এটুন দ্যাশ কই যাই, এর মতো খাঁটি কথা আর কী হতে পারে!

মান্তুকে দেখামাত্র তার যে মনে হচ্ছিল ভূমিকম্পে পা তলিয়ে যাচ্ছে, বুক ধড়ফড় করছে এ কি তাকে বলে বোঝানো যাবে! গত কয়েক বছরে যে ক-বার এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় ভেগেছে, কী অবস্থায় ভেগেছে সেসবের ফিরিস্তি ওকে শুনিয়ে কী লাভ! তবে এই যে মান্তু অবাক হলো শুনে তাকে দেখে চম্পা হাজিরার লাইন ভেঙে বস্তিতে চলে গিয়েছিল আর এ জায়গা ছাড়ার কথা ভেবেছে, তার মানে যা দাঁড়ায়—মান্তুকে নিয়ে তার ভয় নাই, মান্তু তার ক্ষতি করবে না। এ পর্যন্ত ভেবে বাকিটাও ভেবে রাখল, দেখা যাক কী হয়।

আজগরের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, মায়ের কথাটা চম্পার মাথায় ছিল না। এটুন দ্যাশে মা-র বিপদ হলেও চম্পার নিজের হবে না, মনে এ জোরটা কিভাবে এসেছিল ভেবে পরে অবাক হয়েছে। আজগর জানত তার বাপ-মা নাই, বাপ মারা গেছে তার জন্মের পরপরই কলেরায়—মা যেমন তাকে শিখিয়েছিল, আর মাকে সে নিজেই মেরেছিল। মায়ের মৃত্যুর গল্পে গোঁজামিল ছিল—কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে, তাও কোথায়—চিটাগাংয়ে। চিটাগাং কেন, এর জবাব সব সময় এক রকম হতো না। কখনো বলত চিটাগাংয়ে এক স্কুলে তার মা আয়ার কাজ করত, কখনো বলত এক বিদেশির বাসায় বাচ্চা দেখাশোনা করত। যে কুকুরটা কামড়েছিল সেটা কারো পোষা না, রাস্তার নেড়ি কুকুর, আর কামড়ের দাগ বলতে তেমন কিছু না, হাঁটুর নিচে পায়ের গুছিতে বোলতার হুল ফোটানোর মতো ছোট দুইটা ফুটো। দুই-তিন দিন ব্যথা ছিল, তার পর সেরে গিয়েছিল। সপ্তা দু-এক পরে দেখা দিল জলাতঙ্ক। কুকুরে কামড়ালে যে নাভিতে সুই নিতে হয় গুনে গুনে চৌদ্দটা না একুশটা, সেটা আগে কারো মাথায় আসেনি। মা মরল পানি পানি করে, কিন্তু পানি এনে দিলেই চিল্লাপাল্লা। আসলে জলাতঙ্কে মারা যাওয়া একজনের কাহিনি শুনে মা-র মৃত্যুর বানোয়াট কারণ হিসাবে কেন যে লাগসই মনে হয়েছিল চম্পা বলতে পারবে না। কিন্তু তার পর চিটাগাং ছেড়ে ঢাকায় কী করে, কার সাথে এলো, থাকত কোথায় এসবেও অনেক ভেজাল ছিল। সেসব নিয়ে আজগর খোঁচাখুঁচিতে যায়নি। সে তখন চম্পাকে তার পুবাইলের বাড়িতে বউ করে নিয়ে গেরস্তিতে মন দেবে এ স্বপ্নে মশগুল। বনানীতে এক বড়লোকের বাড়িতে নাইটগার্ডের চাকরি করত আজগর, আর চম্পা তখন সে বাড়িরই ম্যাডামের ফুটফরমাশ খাটত। ম্যাডামের ছিল একটা বুটিকের দোকান, মাঝেসাজে টুকটাক সেলাইয়ের কাজেও হাত লাগাত। সেলাই মেশিন ধরা তার ওখানেই শুরু, যদিও সে মেশিন আর গার্মেন্টের মেশিনে ম্যালা ফারাক।

‘শওরে এই সব কইরা কী ফায়দা! গেরামে তুমারে লইয়া গিরস্তি করুম, খেতকিষি করুম, গাই পালুম, ছুটুমুটু মুরগির খামারও তুমি চাইলে করতে পারি’— আজগরের এসব কথায় ঘর-গেরস্তির একটা স্বপ্ন যে চম্পাও দেখতে শুরু করেছিল তাতে কোনো ভেজাল ছিল না। আজগরের কথায় প্রথমে সায় দিত না, তবে নিজেকে বলত ঢাকায় থাকতে গেলে আজ এর পায়ে কাল ওর পায়ে—এই করেই পার করতে হবে। তার চেয়ে গ্রামে নিজের স্বাধীন সংসার। শুনে লোভ জাগত। আর আজগর মানুষটা ছিল ভালো। ঢাকায় কাজ খুঁজতে এসে নাইটগার্ডের চাকরি নিয়েছিল কিছু সুবিধার কথা ভেবে। খাওয়া-থাকা ফ্রি আর রাতে ডিউটি, দিনে কাজ খোঁজার সময় মিলত। কিন্তু মনমতো কিছু না পেয়ে, আর আসল কথা, চম্পাকে দেখে ঢাকায় থাকার ইচ্ছাটা মরে গিয়েছিল। চম্পাকে বলতও সে কথা। চম্পা সাড়া দিতে দেরি করছে ভেবে এক সুযোগে গ্রাম থেকে তার মা-কে এনে চম্পাকে দেখিয়েওছিল।

আজগরের গ্রামে এসে চম্পা বেশ অবাক হয়েছিল। কোন দুঃখে আজগর নাইটগার্ডের চাকরি করত! খেয়ে-পরে চলার অবস্থা তাদের ছিল, আর সেই যে আজগর বলত গেরস্তিতে মন দেবে, খেতকিষি করবে, গাই পালবে, চম্পা চাইলে মুরগির খামার—চম্পার মনে হতো লেগে থাকলে কোনোটাই অসম্ভব না।

শ্বশুরবাড়িতে আজগরের বাবা-মা আর ছোট এক ভাই। আজগরের বড় দুই বোন ছিল, পিঠাপিঠি বড় বোন ছোটবেলায় পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল, অন্য বোনের বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হওয়ার সময় সে মারা যায়, বাচ্চাটাও হয়েছিল মরা। সেসব অনেক আগের কথা। শ্বশুর-শাশুড়ি চম্পাকে পছন্দ করত, সে নিজেও চাইত তাদের ভালো রকম দেখভাল করতে। সেই সাথে উঠেপড়ে লেগেছিল গেরস্তি শিখতে, আয়-রোজগার বাড়াতে। আজগর কথা রেখেছিল, নিজে যেমন খাটত, চম্পাকেও সাহায্য করত। সরকারি কৃষি ব্যাংকে অনেক হাঁটাহাঁটি করে সুবিধা করতে না পারলেও এক এনজিও থেকে ধার পেয়েছিল মুরগির খামার করতে। খামার অবশ্য নামেই, মাত্র তিরিশটা ডিম পাড়া মুরগি দিয়ে চালু করলেও খাটনি বা খরচ কম ছিল না। চম্পা আশায় ছিল লেগে যদি থাকে, খাটনি বা খরচ উসুল হতে কয় দিন লাগবে! সেই সাথে তিরিশ থেকে তিনশ হতেও।

দিন কেটে যাচ্ছিল। মান্তু আসত সময় পেলেই। বয়স তখন তার কত হবে, ষোলো-সতেরো, কিন্তু মাথায় বিয়ের পোকা। মহল্লার ছেলেরা তাকে নিয়ে গান বাঁধে এ যেমন তার আমোদের খোরাক, তেমনি বিয়ে নিয়ে কিছু ভয়-ডরও যে ছিল না তা না। প্রথম প্রথম ভাবি ডাকলেও কয়েক দিন পরে সে ঘোষণা দিল, ‘ভাবি-ফাবি না, তুমারে চম্পাবু ডাকুম, ঠিকাছে?’

সেই মান্তুকে নিয়ে চম্পার ভয়, এ কথা মান্তুর নিজের কানে যত আজগুবিই লাগুক, চম্পা মনে মনে বলল, দেখা যাক। কিন্তু মান্তু নাছোড়, ‘সত্যই আমারে দেইখা ডরাইছিলা। ক্যান মনো অইছিল আমি তুমার বিপদ ডাইকা আনুম?’

কালাচন্দপুরে সেই গারো ড্রাইভার ফিলিপ ও অন্তির ঘর ছেড়ে দুই দিন হলো মান্তু এসে উঠেছে চম্পার ঘরে। চম্পা তাকে বলেছে, ‘চিন্তা করিস না, প্যাকিংয়ের কাম মন লাগাইয়া কর, দুইটা দিন যাউক, তর জইন্য একটা ভালা কাম ঠিক করুম।’

চম্পা বুঝতে পারছে মান্তু এ কয় বছর অনেক আঘাটায় ঘুরেছে। সে যে একটা কাজ পেয়েছে এতেই খুশি, তার ওপর চম্পাকে পেয়ে, চম্পার ঘরে এসে উঠে যেন ভাবছে ওর আর কিছু পাওয়ার নাই। ছেলের নাম বলল আবদুর রহমান, নয় বছরে পড়েছে। মাসে-দুই মাসে ছেলেকে দেখতে যায়। তার গ্রামেই এতিমখানা, গ্রামে গেলে চেনা-জানা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কেউ কেউ ঘরে নিয়ে যেতে টানাটানি করে, খেয়ে যেতে বলে, সে রাজি হয় না। আবদুর রহমানের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে চলে আসে। যাওয়ার ব্যবস্থা ভালো, ট্রেনে ঘণ্টা দুয়েক লাগে, পুবাইল ইস্টিশন থেকে মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। ছেলের জন্য এটা-ওটা নিয়ে যায়, তবে দিতে হয় লুকিয়ে-চুরিয়ে। সে অবশ্য খাওয়ার জিনিসই নেয়। ছেলের পছন্দ প্যাড়ার সন্দেশ, লাড্ডু। এতিমখানার এক হুজুরকে নাকি হাত করেছে, সামনের বার যখন যাবে হুজুরের জন্যও কিছু নিয়ে যাবে। কী নেবে ভাবছে, দুই প্যাকেট বিরিয়ানি নিলে কেমন হয়, একটা হুজুরকে দেবে, বলবে মানতের শিন্নি।

বলতে বলতে তার যেন হঠাৎ খেয়াল হয়, তার গ্রাম মানে তো চম্পার শ্বশুরবাড়ি, সে বাড়ির কী হাল সে খবরে চম্পার কি কোনো আগ্রহ নাই? চম্পা শুনতে চাচ্ছে কি না সেদিকে না গিয়ে সে বলে, ‘কী সুন্দর পুলটিরি করছিলা গো চম্পাবু, তুমি নাই, তুমার পুলটিরির মুরগি দ্যাখে কে! শুনছি ছয় মাসও যায় নাই ব্যাক মইরা সাফ।’ তার পর গোপন কথা বলছে এমনভাবে জানাল, ‘আজগর ভাই বিয়া করছিল তুমি যাওনের দেড়-দুই বচ্ছর বাদে, টিকে নাই, ক্যামনে টিকব? বিয়া যে করল, তুমার লগে তো তালাক হয় নাই। বিনা তালাকের বিয়া নাকি টিকে না। আর অবস্থাও তো পইড়া গেছিল, বাজারে পান-সিগারেটের দোকান দিছিল, এই দিয়া সংসার চলে! তুমি কিন্তুক আমার কতার জওয়াব দেও নাই।’

চম্পা চেয়েছিল এ নিয়ে কথা না বাড়াতে। বাধ্য হয়ে বলল, ‘তরে ডরামু না কুনু কারণ আছে, ক? কারে না আমি ডরাই! এক জাগা ছাইড়া আরেক জাগায় গেছি, চিনপরিচয়ের মানুষ দেইখা ভাগছি। আমার মায় কইত এট্টুন দ্যাশ, সবতায় সবতারে চিনে। অহন আমার ডর নাই, আমি একলা মানুষ, কিয়ের ডর! তুই ডর দেখাইলে দেখাইস।’

কথার জবাব পেয়ে মান্তু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ।

চম্পা বলল, ‘পুরান কাসুন্দি ঘাইটা কী অইব, ওই সব বাদ দে।’

অনেক কথা বললেও চম্পা একটা ব্যাপারে সাবধান ছিল। জবা কোথায় কার কাছে আছে এ নিয়ে তার এক কথা। মর্জিনার মাকে যা বলেছিল তা বদলানোর উপায় ছিল না, মান্তুকেও বলেছে তার এক দূরসম্পর্কের বোনের কাছে আছে জবা।

‘আজগর ভাই মানুষটা খারাপ না, মাইষ্যেরে কইছে তুমার বদদোয়ায় হে শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। তুমারে আর জবারে বুঝি অনেক বিছরাইছে।’

‘তরে না কইলাম পুরান কাসুন্দি থো।’

‘ধরো, যুদি আজগর ভাই তুমার ধারে মাফ চায়? জবারে নিতে চায়?’

শেষ কথায় চম্পা কটমট চোখে তাকাল। সে কি সেধে ঘরে কালসাপ ঢোকাল, ও কেন ঘুরেফিরে আজগরের কথা তুলছে, আর এখন জবার কথাও!

সে মান্ত্রর দিকে তাকাল, তাকানোয় কী ছিল সে বলতে পারবে না; তবে মান্তু নিশ্চয় এমন কিছু দেখে থাকবে, তার চোখ জোড়া ঝুলে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *