শেখ হাসিনা আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, আমার দেশে প্রবেশে অন্যায়ভাবে বাধা দিচ্ছেন আজ বহু বছর, তারপরও দেশের কোনও রাজনীতিককে যদি সমর্থন করতে হয়, আমি শেখ হাসিনাকেই করি। কোনও দলের পক্ষে যদি দাঁড়াতে হয়, আমি শেখ হাসিনার দলের পক্ষেই দাঁড়াই। কারণ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা ছাড়া আমি আর কোনও রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিক দেখি না যাদের ওপর সামান্যও আস্থা রাখা যায়। হাসিনা আমার বিরুদ্ধে যত অন্যায়ই করুন, আমি বিশ্বাস করি তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে কোনও অন্যায় করবেন না। বিশ্বাস করি ক্রমশ অসুস্থ হতে থাকা সমাজটাকে সুস্থ করার দায়িত্ব তিনি নেবেন। দেশের মঙ্গল করার জন্য জীবন বাজি রাখতে হাসিনা ছাড়া আর কেউ পারবেন বলে আমি মনে করি না। হাসিনা প্রগতিশীল মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। তিনি দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। জঙ্গি দমন করছেন। তাঁকে গ্রেনেড ছুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা হত্যা করতে চেয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি, কিন্তু হাল ছাড়েননি। ভয় পেয়ে রাজনীতি ছেড়ে পালাননি।
কিন্তু এক পাল নারীবিদ্বেষী ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদীদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের যেভাবে সেদিন সংবর্ধনা এবং সম্মান জানিয়েছেন হাসিনা, দেখে আমি, সত্যি বলতে কী, চমকে উঠেছি। আসলে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মৌলবাদীদের সঙ্গে একই মঞ্চে আর যাকেই মানাক, হাসিনাকে মানায় না। কে শত্রু, কে মিত্র তা বোঝার বুদ্ধি হাসিনার নেই, তা আমি বিশ্বাস করি না। হেফাজতিরা এমন ক্ষুদ্র শত্রু নয় যাদের বশ করা যায়। তারা এখন হাসিনাকে ফাঁদে ফেলে দাবি আদায় করে নেবে। কিন্তু হাসিনা যদি ভেবে থাকেন, এই মৌলবাদীরা হাসিনাকে ভোটে জেতাবে, তাহলে তিনি ভুল করছেন। বঙ্গবন্ধু নিজের শত্রুদের বন্ধু ভেবে ভুল করেছিলেন, হাসিনাও কি তাই করতে যাচ্ছেন? হাসিনা নিজের আততায়ীদেরই দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন না তো! সত্যি বলছি, হাসিনার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
হাসিনা যতই আপস করুন মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে, ওরা কিন্তু নারী নেতৃত্বের বিরোধীই রয়ে যাবে। জাতশত্রুর সঙ্গে আপস করতে যাওয়া হাসিনার নির্বুদ্ধিতা, ওরা হাসিনার নির্বুদ্ধিতার সুযোগ এর মধ্যেই নিতে শুরু করেছে। হাসিনাকে দিয়েই ওরা সরিয়ে ফেলতে চাইছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য। ওরা এক এক করে সরাবে যত ভাস্কর্য আছে দেশে, সব। ওরা কালি লেপে দেবে দেশের সব শিল্পকর্মের শরীরে। হাসিনা আর কী সম্মোহিত করবেন, হাসিনাকেই বরং ওরা সম্মোহিত করে ফেলছে। মাদ্রাসায় পড়া লোকেরা হারিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বিদুষী নারীকে। আপস কিন্তু মৌলবাদীরা করছে না, তারা এসে বলছে না আমরা হাসিনার ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে মেনে নিচ্ছি। বরং হাসিনা গিয়ে মাথা নত করে তাদের বলছেন, তাদের পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতার আদর্শ তিনি মেনে নিচ্ছেন। হাসিনার কি ওই অপশক্তির কাছে হেরে যাওয়া উচিত? ওই অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই তো তাঁকে নির্বাচনে জিতিয়েছিল দেশের মৌলবাদ-বিরোধী মানুষ। আজ বন্ধু চিনতে হাসিনার অসুবিধে হচ্ছে কেন? মৌলবাদীরা চায় পাঠ্যপুস্তকের মুসলমানি করা হোক, হাসিনা তা করেছেন। মৌলবাদীরা চায় মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করা হোক, হাসিনা তাই করেছেন। ভাস্কর্য উপড়ে ফেলা হোক, হাসিনা সেটাই করতে চাইছেন। মুক্তচিন্তক ব্লগাররা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী, মৌলবাদীরা বলে। এ কথা হাসিনাও বলেন। ব্লগারদের ধরে ধরে তিনি জেলেও পুরেছেন। মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি, যে কথা জামায়াতী ইসলামী বলে, সেই একই কথা হাসিনা কেন বলছেন! হাসিনা একদিন বলেছিলেন, নারীদের অপমান করেছে যে আল্লামা শফী, তার বিরুদ্ধে দেশের নারীরা প্রতিবাদ করে না কেন! সেই হাসিনাকে যখন নারী হয়ে শফীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসে থাকতে দেখি, তখন অবাক হই। হাসিনা কী করে সম্মান করতে পারছেন এই লোকটিকে, যে লোকটি নারীকে চূড়ান্ত অসম্মান করতে দ্বিধা করে না। মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই অকৃতজ্ঞ মৌলবাদীদের ক্ষমতা এখন এত বেশি যে দেশের সর্বশক্তিময়ী প্রধানমন্ত্রীকেও পালন করতে হয় তাদের সমস্ত অসভ্য, অশোভন, অযৌক্তিক দাবি। কী হবে হাসিনা যদি পালন না করেন? তিনি প্রগতিশীলদের ভোট পাবেন, যেমন পেতেন। মৌলবাদীদের ভোট পাওয়ার জন্য যদি রাষ্ট্রের কাঠামো নষ্ট করতে হয়, শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশ করতে হয়, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ গুঁড়িয়ে দিতে হয়, নারীর সমানাধিকার বাতিল করতে হয়, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ছুট্টি দিয়ে দিতে হয়— তাহলে কী লাভ হাসিনার ক্ষমতায় থেকে! এসব কাজ তো যে কোনও জামায়াতী ইসলামীর নেতা বা হেফাজতি ইসলামের নেতারাই করবেন। হাসিনা হয়তো বুঝতে পারছেন না, ওরা যা করতে চায়, তা একশভাগ করে দিলেও ওরা হাসিনার অপসারণ চাইবে। ঠিক যেমন ওরা ভাস্কর্যের অপসারণ চায়। ইসলামে, ওরা বলে, ভাস্কর্য যেমন হারাম, নারী নেতৃত্বও হারাম। ওদের সমর্থন পাওয়ার আশায় দেশকে হাঙ্গরের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েও হাসিনা ওদের সমর্থন পাবেন না, মাঝখান থেকে প্রগতিশীল মানুষের সমর্থন হারাবেন। তারপরও আশা রাখি হাসিনার ওপরই। তারপরও বিশ্বাস করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন করছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন করছেন, ব্লগার হত্যার বিচারও তিনি তেমন করবেন। জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে দেশ, জঙ্গি উৎপাদনে বুঝে না বুঝে অনেক রাজনীতিক সহযোগিতা করেছেন, তারপরও আশা, দেশকে জঙ্গিমুক্ত হাসিনাই করবেন। তিনিই একদিন ধর্মনিরপেক্ষতার বিজয় নিশান ওড়াবেন, বাহাত্তরের সংবিধান তিনিই ফিরিয়ে আনবেন। হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর মতো খুন হয়ে যেতে আমরাই দেব না। খুনিদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমরাই নেত্রীকে অনুরোধ করবো। আশা করি নেত্রী আমাদের অনুরোধ রক্ষা করবেন। দেশকে বাঁচাবেন, নিজেকেও বাঁচাবেন।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ এপ্রিল, ২০১৭