রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

শেখ মুজিবর রহমান (১৯২০–১৯৭৫) – বাংলাদেশের জাতির জনক

শেখ মুজিবর রহমান (১৯২০–১৯৭৫) – বাংলাদেশের জাতির জনক

যাঁর নিরলস সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের কল্যাণে বাঙালি জাতি বিশ্ব-মানচিত্রে প্রথম একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করেছে, জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman)। এই বিশ্বেবরেণ্য নেতার জন্ম ফরিদপুর জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান, মাতার নাম সাহেরা খাতুন।

বাল্যে গৃহশিক্ষক পণ্ডিত সাখাওয়াউল্লাহর কাছেই পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় শেখ মুজিবের। এরপর তিনি ভর্তি হন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে। শেখ মুজিব পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ছিলেন, আর ছিলেন দুরন্ত এবং বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। জীবনের শুরু থেকেই অন্যায়, অবিচার আর অসত্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখেছিলেন। দশ-এগারো বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন। তিনি কোনো ভুঁইফোঁড় রাজনীতিবিদ ছিলেন না। জীবনের শুরু থেকে ধাপে ধাপে একাগ্র আন্দোলন-সংগ্রামের পর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সুদৃঢ় ভিত্তি।

স্কুলজীবনে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম কারাবরণ করেন ১৯৩৯ সালে। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। এই মিশন স্কুলে থাকতেই শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয় তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে। এই সক্ষাৎকারও ছিল এক চমকপ্রদ ঘটনা।

শেখ মুজিব তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুল পরিদর্শন করতে আসছেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এবং খ্যাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি। স্কুলের সভা শেষ করে মন্ত্রীদ্বয় কর্মক্লান্ত হয়ে ডাকবাংলোয় ফিরছিলেন। তাঁদের সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

এমন সময় কয়েকজন সহপাঠীকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের পথ আগলে দাঁড়াল একটি হ্যাংলা-পাতলা গড়নের ছেলে। এই কিশোরই ছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিব। তাঁর দাবি ছিল তাঁরা যে হোস্টেলে থাকেন, তার ছাদ ফেটে গেছে। ফলে বর্ষার পানি পড়ে বিছানাপত্র নষ্ট হয়। তার দাবি, ফাটা ছাদ মেরামত করে দিতে হবে।

শেখ মুজিবের সাহস দেখে তো প্রধান শিক্ষক ভড়কে গেলেন। তাঁর স্কুলের ছেলেরা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বেয়াদবি করছে, না জানি এ অপরাধের কী শাস্তি হবে!

কিন্তু ছেলেটির সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা। তিনি তখন নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, এই ছেলে, তুমি কী বলতে চাও?

শেখ মুজিব তাঁদের ছাত্রদের দাবির কথা বললেন। শেরে বাংলা হেসে বললেন, তার আমি কী করব?

—হোস্টেলের ছাদ মেরামত করে না দিলে পথ ছাড়ব না।

—বেশ, এই ছাদ মেরামত করতে কত লাগবে?

–বারোশো টাকা।

শেরে বাংলা ছেলেটির সাহস দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো বাংলার এক ব্যাঘ্রপুরুষ সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিলেন ভবিষ্যতের আরেক সিংহশাবককে। ভবিষ্যতের বিপুল সম্ভাবনা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন সেদিন সেই কিশোরের চোখেমুখে। শেরে বাংলা ঘটনাসস্থলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেই তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে কিশোর শেখ মুজিবের দাবি মতো বারোশো টাকা মঞ্জুর করে দিয়েছিলেন স্কুল হোস্টেলের নামে।

কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ হল না। শেরে বাংলা ডাকবাংলোতে গিয়েই আবার ডেকে পাঠালেন শেখ মুজিব নামের সেই সাহসী ছেলেটিকে। সেই থেকেই শেখ মুজিব হলেন শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দির রাজনৈতিক শিষ্য। এই সম্পর্ক তাঁদের আজীবন অটুট ছিল। এরপর কলকাতায় এসে শেখ মুজিব ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। পরে তিনি এই কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে ওই কলেজ থেকেই তিনি বিএ পাশ করেন। কোলকাতার শিক্ষাজীবনে তিনি শহিদ সোহরাওয়ার্দির প্রিয় পাত্রদের একজন ছিলেন।

১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইসুর ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। গণভোটে শেখ মুজিবেরও ছিল সবিশেষ ভূমিকা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

এসময়ই তিনি নিজের উদ্যোগে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি দেরি হল না তাঁর। যে লক্ষ্যে নিয়ে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, অচিরেই টের পেলেন, তাঁর সে স্বপ্ন ভুল। দেখলেন, পূর্ব বাংলার মানুষেরা আর একটি নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এসে পড়েছে। শুরু হলো পশ্চিমাদের শাসন আর শোষণ।

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ মুজিব কারাবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁর ছাত্রজীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে প্রথম থেকেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিষ নজর পড়ে তাঁর ওপর। এরপর দেশে খাদ্যসংকটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কারাবরণ করেন।

১৯৫২ সালে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দান করেন রফিক, বরকত মতো তরুণেরা। ঐ সময় শেখ মুজিব ছিলেন কারান্তরালে। জেল থেকেই তিনি এই আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থন দান করেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। শেখ মুজিব এই মন্ত্রিসভায় পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তারপর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে সেখানে শেখ মুজিব শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্ৰী হন। এ মন্ত্রিপরিষদও বেশিদিন টেকেনি।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে বসেন এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য শুরু করেন নির্যাতন। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয় নানা অজুহাতে। শেখ মুজিবকেও গ্রেফতার করা হয়।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধিকারের বীজমন্ত্র তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা। তথাকথিত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৪৭-এর পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, স্বরূপ প্রকাশিত হতে থাকে। বাঙালিদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের উপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন আর শোষণ। শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঙালি জাতির স্বার্থ রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পেশ করেন তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা।

ছয় দফা গোটা বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে। তৎকালীন একনায়ক আইয়ুব খানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবও তাঁর সহযোগী নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে জেল, জুলুম ও নির্যাতন। শুধু তা-ই নয়, এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য শেখ মুজিবের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তথাকথিত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা। মামলায় জড়িয়ে শেখ মুজিবকে আসামি করে ঢোকানো হয় জেলে। কিন্তু এত করেও আন্দোলন দমন করা গেল না। বরং আরও প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ল গোটা বাঙালি জাতি। দায়ের করা মিথ্যে মামলার বিরুদ্ধে শুরু হয় আরও দুর্বার গণআন্দোলন। এবার আপামর জনতার সঙ্গে যোগ দিলেন দেশের তরুণসমাজ তথা ছাত্রসমাজ। ছয় দফার পাশাপাশি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকেও পেশ করা হলো তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি। শেষে ছয় দফা এবং ১১ দফার যৌথ দাবিতে শুরু হলো তীব্র আন্দোলন। এই আন্দোলন এবং প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাধ্য হয়ে মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে রেসকোর্সে ময়দানে আয়োজিত বিশাল জনসমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে এসে আবার নেতৃত্ব দিতে লাগলেন গণআন্দোলনের। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। তারপর ক্ষমতায় এলেন আরেক সামরিক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতায় এসে আন্দোলন রহিত করার কৌশল হিসেবে ঘোষণা করেন সাধারণ নির্বাচন।

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ লাভ করল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধুর এই বিপুল বিজয়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে উঠল। শেখ মুজিব যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন, তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের পিপল্স পাটির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রকাশ্যেই শেখ মুজিবের নায্য অধিকারের বিরোধিতা করতে লাগলেন। ইয়াহিয়াও চাইছিলেন না বাঙালি জাতির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। তিনি মুখে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা করলেও গোপনে চলতে লাগল ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১ মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলো। তখন বাঙালিমাত্রই হতবুদ্ধি হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা সহজে বাঙালিকে ক্ষমতায় যেতে দেবে না। মেনে নেবে না তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। কিন্তু বাঙালিরাই-বা সহজে নতি স্বীকার করবে কেন?

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আন্দোলন এবার রূপ নিল গণসংগ্রামের। সারা দেশে তাঁর নির্দেশে শুরু হলো তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। পথে, ঘাটে, কলে-কারখানায়, স্কুল- কলেজে, অফিস-আদালতে ছড়িয়ে পড়ল এই অসহযোগ আন্দোলন।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো এক বিশাল জনসভা। এই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

ইয়াহিয়া এবার যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠলেন। অস্ত্র প্রয়োগ করে বাঙালি জাতির আন্দোলনকে দমন করার জন্য জোর ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে গোপনে নামাতে লাগলেন অস্ত্রশস্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছদ্মবেশে আমদানি করতে লাগলেন সৈন্য, সবই বাঙালিকে দমন করার জন্য। আর এই ষড়যন্ত্র যাতে বাঙালিরা টের না পায় তার জন্য ইয়াহিয়া তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে ঢাকায় এলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আপস আলোচনার ছলচাতুরি করতে। দিন কয়েক চলল আলোচনা। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর দাবি থেকে এক পাও সরে এলেন না। ফলে আলোচনা ভেঙে গেল। কুখ্যাত ইয়াহিয়া খান সেদিনই, অর্থাৎ ২৫ মার্চ থেকে বাঙালি হত্যার নির্দেশ দিয়ে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন। সেদিন মধ্যরাত থেকেই হিংস্র পাকবাহিনী ঢাকায় শুরু করল তাদের নারকীয় হত্যালীলা।

ওই রাতে নিজের বাসবভন থেকে বঙ্গবন্ধুও বন্দি হলেন পাকবাহিনীর হাতে। তবে বন্দি হবার আগে তিনি দিয়ে গেলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, যা পরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল এবং ২৬ মার্চ ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এইভাবে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর নামে আর আদর্শে অনুপ্রাণিত গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধে।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার নতুন সংগ্রাম। তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন এবং চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করেন। এই চার মূলনীতি হলো : বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

১৯৭০ সালের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে তিনি গঠন করেন গণপরিষদ। এই গণপরিষদই দেশের জন্য প্রস্তুত করে এই সংবিধান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গণপরিষদে অনুমোদিত হয়।

বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে এবং বিশ্বমানবতার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে যেসব যুগান্ত সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই এবং গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোশাক প্রদান, ইসলাম-বিরাধী কাজ বিবেচনাকরে রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, টঙ্গিতে বিশ্ব-এজতেমার জন্য জমি বরাদ্দ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা, নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং ১শ বিঘা জমির সিলিং ধার্য করা, সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এছাড়া বিদ্রোহী কবি নিয়ে আসা এবং তাকে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা, সরকারি বেসরকারি অফিস-আদেশসহ সবধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে বাংলাভাষার প্রচলন বাদ্যতামূলক করা।

শুধু তাইনয়, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাপান সরকারের কাছে ওই সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করেন এবং তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বর্তমানে তা বাস্তবরূপ লাভ করেছে।

এছাড়া ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় পর্যায়ে মন্ত্রী হলে তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা তথা এফ ডি সি। ১৯৭৪ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে বাংলাভাষাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।

যুদ্ধের পর বাংলাদেশ এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তাঘাট, রেলপথ, মিল-কারখানা, সবকিছুই পাক হানাদার বাহিনী ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। দেশে অন্ন, বস্ত্র ও খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছিল। এছাড়া দেশি-বিদেশি শক্তির সক্রিয় সমর্থনে ছিল অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র। তিনি এসব সমস্যা দূর করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল তাঁর প্রতিকূলে। বিশ্বব্যাপী তখন শুরু হয় মুদ্রাস্ফীতি। সেই মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ এসে লাগে বাংলাদেশেও। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও শিকার হয় বাংলাদেশ। উপর্যুপরি বন্যায় দেশের বিপুল ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চারদিকে দেখা দেয় খাদ্যের অভাব। এই পরিস্থিতির মোকাবেলায় বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেও শেষমুহূর্তে কথা না রাখার ফলে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।

এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ তারিখে তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনি আনেন। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণা করার দুমাস পর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ জনসভা। সে দিন ছিল ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ।

তিনি তাঁর ভাষণে সেদিন বলেছিলেন,

“প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম্ অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। জনগণ বাছবে, কে ভালো, কে মন্দ। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র।”

কিন্তু তা আর হয়নি। তার আগেই নেমে আসে এক চরম আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে ক্ষমতালোলুপ কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন। ঘাতকদের নির্মমতার হাত থেকে তাঁর চার বছরের শিশুপুত্র রাসেলও রক্ষা পায়নি। এ ধরনের নিষ্ঠুর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে নজিরবিহীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *