শেখ আবদুর রহিম
উনিশ শতকের বাংলা দেশে নবজাগরণ এসেছিল প্রধানত কলকাতা শহর ও হিন্দু সমাজকে আশ্রয় করে। এই নবযুগের একটি লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল ধর্ম-বিষয়ক আলোচনায়। রামমোহনের ধর্মান্দোলন ও বিদ্যাসাগরের সংস্কারপ্রচেষ্টা, ধর্মসভার রক্ষণশীলতা ও ব্রাহ্মসভার আধ্যাত্মিকতা, ইয়ং বেঙ্গলের বিদ্রোহ ও বঙ্কিমচন্দ্রের তত্ত্বদৃষ্টি—এসবের মূলে ধর্ম সম্পর্কে একটা নতুন উপলব্ধি ক্রিয়াশীল ছিল। এই চেতনাপ্রকাশের মাধ্যম ছিল নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলা গদ্য। এই ভাব-আন্দোলনে তাই বাংলার সাহিত্য সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
একই সময়ে উত্তর ভারতে কিংবা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মুসলমানেরাও ধর্ম সম্পর্কে একটা নতুন উপলব্ধিতে আলোড়িত হয়েছিল। ওয়াহাবী আন্দোলন এবং তিতুমীর ও শরিয়তউল্লাহর সংগ্রামে তারই প্রকাশ। এসব আন্দোলন রাজশক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ায় অনেকখানি স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। ইংরেজের নতুন রাজধানী থেকে দূরবর্তী এলাকায় এ-আন্দোলনের প্রসার হয়। উত্তর ভারতে এর বাহন ফারসি ও উর্দু ভাষা; কিন্তু বাংলাদেশে হয়তো তা বিস্তৃতিলাভ করে প্রধানত বক্তৃতার মাধ্যমে। এ নিয়ে পুরোনো ধারার পদ্য লেখাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু নতুন গদ্যে কোনো রচনার সন্ধান পাইনে। মুসলমানের সামগ্রিক পশ্চাৎপদতা, আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা, কিংবা বর্তমান সম্পর্কে তার পূর্ণ ধারণার অভাবের ফলেই হয়তো এসব আন্দোলন বাংলার সামগ্রিক সমাজজীবনে অতটা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি।
উনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙালি মুসলমান যখন আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট হলো, তখন নতুন চেতনাবিকাশের উপায় হিসাবে সে ধর্মালোচনায় আবার প্রবৃত্ত হয়েছে। এবারে কিন্তু তার আলোচনার বাহন বাংলা ভাষা এবং প্রধানত বাংলা গদ্য। মাতৃভাষায় শাস্ত্রীয় গ্রন্থের অনুবাদ ও ধর্মালোচনায় রক্ষণশীলদের বাধা উপেক্ষা করে তাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। পূর্বযুগের হিন্দু চিন্তাশীলের মতোই সমাজসংস্কার প্রচেষ্টায় যেমন সে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তেমনি তাকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যাকারীদের সঙ্গেও তাকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়েছে।
কুরআন শরিফ ও শাস্ত্রীর গ্রন্থের অনুবাদে মোহাম্মদ নইমুদ্দীন (১৮৩৮—১৯০৮), মহাপুরুষ-জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস-রচনায় শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯—১৯৩১), পণ্ডিত রেয়াজ-অল-দীন আহ্মদ মশহাদী (১৮৫৯—১৯১৮) ও মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ (১৮৬২—১৯৩৩) এবং ধর্মবিষয়ক বিতর্কে মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১—১৯০৭) ও শেখ জমিরুদ্দীনের (১৮৭০-১৯৩৭) নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।
নবযুগের উদ্যোগী পুরুষদের মতো পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় এঁদের ছিল না, তাঁদের নাগরিক বৈদগ্ধও প্রায় অনুপস্থিত। কিন্তু তাঁদের মতো এঁদের অনেকেই ধর্মালোচনার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক জীবনের অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। সামাজিক আচার ও ধর্মীয় অধিকার, রাজনৈতিক অবস্থা ও শাসনকার্যের প্রণালি, শিক্ষার ব্যবস্থা ও সাহিত্যের স্বরূপ—এসব বিষয়ে চিন্তা করতে এবং সে-চিন্তার স্বাক্ষর রেখে যেতে এঁরা আগ্রহশীল ছিলেন। সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র এ-চিন্তাপ্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম বলে বিবেচিত হয়েছিল। এ-যুগের মুসলমান লেখক ও সাংবাদিকদের মধ্যে শেখ আবদুর রহিমের বিশিষ্ট স্থান তাই তাঁর বৃহত্তর সচেতনতার পরিচায়ক।
দুই
চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত মোহাম্মদপুর গ্রামে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ আবদুর রহিমের জন্ম হয়। তাঁর পিতা মুনশি শেখ গোলাম এহিয়া সামান্য অবস্থার পাঠশালা-শিক্ষক ছিলেন। শৈশবে আবদুর রহিমের মাতৃবিয়োগ হলে গোলাম এহিয়া পুনরায় দারপরিগ্রহ করেন। বিমাতার সংসারে আবদুর রহিমের অসুবিধা হতে পারে, এই ভেবে তাঁর মাতুল মুনশি গোলাম কিবরিয়া তাঁকে নিজের সংসারে নিয়ে আসেন। গোলাম কিবরিয়া ছিলেন টাকীর পাঠশালার শিক্ষক; উত্তরকালে উচিত কথা১ নামে তাঁর একটি রঙ্গ-ব্যঙ্গ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি টাকীর জমিদার ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রাধামাধব বসুর পরিবারে গৃহ-শিক্ষকতাও করতেন। এই সূত্রে বসু মহাশয়ের সঙ্গে আবদুর রহিমের যোগাযোগ ঘটে এবং এই উদারহৃদয় ব্রাহ্ম ভদ্রলোকের আগ্রহে তিনি বসু-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হন। শৈশব থেকে কর্মজীবনে প্রবেশের সময় পর্যন্ত আবদুর রহিম এই পরিবারেই লালিত হয়েছিলেন এবং আজীবন তাঁদের সৌহার্দ্য লাভ করেছিলেন। হজরত মহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির প্রথম সংস্করণের২ ভূমিকায় আবদুর রহিম লেখেন :
আর আমার চিরশুভাকাক্সক্ষী বিদ্যোৎসাহী শ্রীযুক্ত বাবু রাধামাধব বসু ডিপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয় এই পুস্তক প্রণয়নকালে আমাকে নানা উৎসাহ দিয়াছিলেন, এবং তাঁহারই ঐকান্তিক যত্নে আমি নির্বিঘ্নে এই দুরূহ কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছি।
বইটি সম্পর্কে ইংরেজিতে লেখা রাধামাধব বসুর একটি অভিমত ওই সংস্করণে মুদ্রিত হয়। এতে তিনি এই গ্রন্থপ্রকাশে দরিদ্র লেখককে সাহায্য করবার জন্যে সকলকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
টাকীতে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে আবদুর রহিম স্থানীয় মধ্য বাঙ্গালা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে মাসিক চার টাকা বৃত্তি পেয়ে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর কলকাতার সিটি স্কুলে প্রবেশ করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রাক্কালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সে-পরীক্ষা আর তিনি দিতে পারেননি এবং এখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে (১৮৭৫ বা ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে)।
এর অব্যবহিত পরবর্তীকালে আবদুর রহিমের জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সে-জীবন যে কলকাতায় অতিবাহিত হয়েছে, তা জানা যাচ্ছে। তাঁর পক্ষে একাল হয়তো পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা ও গ্রন্থরচনার শিক্ষানবিশির কাল। রাধামাধব বসুর পুত্র মুনীন্দ্রমোহন বসু কলকাতায় মিলন যন্ত্র নামে একটি মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ-প্রেসের সঙ্গে আবদুর রহিমের যোগাযোগ ছিল।
কলকাতায় তিনি যাঁদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন, তাঁদের মধ্যে তাঁর আত্মীয় মৌলভি মেয়ারাজউদ্দীন আহ্মদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি কলকাতার ডভ্টন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আরবি ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এঁর সাহায্য নিয়ে আবদুর রহিম হজরত মুহম্মদের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত-রচনায় মনোযোগী হন। কলকাতা মাদ্রাসার সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অধ্যাপক পণ্ডিত রেয়াজ-অল-দীন আহ্মদ মাশহাদি এবং পরবর্তীকালের ইসলাম প্রচারক-সম্পাদক মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহ্মদের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়।
এ সময়ে বাংলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো কোনো মুসলমান স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান বা ব্রাহ্ম হয়ে যান। এর প্রতিক্রিয়ায় এঁরা চারজনে স্থির করেন যে, ইসলামের মর্মবাণী সংকলন করে পুস্তিকা প্রণয়ন করবেন। এই পরিকল্পনার ফলে দু খণ্ড এসলাম তত্ত্ব প্রকাশিত হয় (১৮৮৮ ও ১৮৮৯)। আবদুর রহিমের হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি প্রকাশিত হয় ১৮৮৮-তে। তার পরের বছর অনেকটা যৌথ প্রচেষ্টায় সাপ্তাহিক সুধাকর পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে।
তিন
সুধাকর বের হয় ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। প্রথম প্রকাশকালে এর সম্পাদক কে ছিলেন, এ নিয়ে এখন একটা বিতর্ক উপস্থিত হয়েছে। কোনো কোনো পুরোনো তালিকায় সম্পাদক হিসেবে আবদুর রহিমের নাম পাওয়া যাাচ্ছে।৩ মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ লিখেছেন যে, আবদুর রহিম সম্পাদক হয়েছিলেন পরে, কিছুদিনের জন্যে। তাঁর ভাষায় :
১২৯৬ সালের আশ্বিন মাসে আমরা “সুধাকর” নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ৯০ নং ওল্ড বৈঠকখানা রোড হইতে বাহির করিলাম। এই সংবাদপত্রের ইতিহাস বহু বিস্তৃত। চৈত্র মাস পর্যন্ত ছয় মাস কাল আমরা ইহা চালাইয়াছিলাম। ১২৯৭ সালের বৈশাখ মাসে হাইকোর্টের তদানীন্তন স্বনামপ্রসিদ্ধ উকীল মৌলবী (পরে নওয়াব) ছেরাজল এছলাম খান বাহাদুর ইহার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। ঐ সময় আমি উহার বেতনভোগী সম্পাদক ছিলাম। ছয় মাসকাল চালাইয়া প্রায় ২১/২২ শত টাকা ক্ষতিবহন করিয়া তিনি কাগজখানি বন্ধ করিলেন।
…হাইকোর্টের উকীল মৌলবী (পরে নওয়াব স্যার) ছৈয়দ শমসুল হোদা এম-এ, বি-এল ছাহেব ও তাঁহার পরম বন্ধু মৌলবী মোহাম্মদ আমজদ ছাহেব… “সুধাকর” চালাইবার ভারও… গ্রহণ করিয়াছিলেন…।
এক বৎসর পরে নওয়াব ছাহেব ছাপাখানা ও “সুধাকর” সংবাদপত্রের সংস্রব ত্যাগ করেন।… কিছুদিন পরে “সুধাকর” চিরদিনের জন্য বন্ধ হইয়া যায়।৪
অন্য মতে, সুধাকর বের হয়েছিল আবদুর রহিমের সম্পাদনায়; ৪ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে অবস্থিত মিলনযন্ত্রে এটি মুদ্রিত হতো এবং পত্রিকার কার্যালয় ছিল এটাই।৫ মিলনযন্ত্রের স্বত্বাধিকারী ছিলেন পূর্বোক্ত মুনীন্দ্রমোহন বসু; রেয়াজুদ্দীন আহ্মদ তাঁর স্মৃতিকথায় এটাকে আবদুর রহিমের ছাপাখানা বলে ভুল করেছেন।
সুধাকরের প্রথম সংখ্যা দেখার সুযোগ হওয়ায় এখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, প্রকাশকালে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহ্মদ।
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে সুধাকর বন্ধ হয়ে যায় বলে মনে হয়। ওই বছর মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ ইসলাম প্রচারক নামে এক মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন যে, প্রথম বর্ষে এই পত্রিকার সঙ্গে আবদুর রহিমের ঘনিষ্ঠ সংস্রব ছিল।৬ যাহোক, ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে (আশ্বিন ১২৯৮) আবদুর রহিম প্রচার করেন ‘বিবিধ বিষয়িনী মাসিক পত্রিকা’ মিহির। মুনীন্দ্রমোহন বসু এটি প্রকাশ করেন ৪ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে এবং ওই ঠিকানায় মিলনযন্ত্রে তিনিই মুদ্রণ করেন। এই পত্রিকাপ্রকাশের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্পাদক লেখেন :
মাসিক পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য সচরাচর সাহিত্যচর্চা। কিন্ত বঙ্গদর্শন, আর্য্যদর্শন, বান্ধব, ভারতী প্রভৃতির পরেও যে এদেশে আবার সাহিত্যচর্চার আবশ্যকতা আছে, এমন কথা যিনি মনে করেন, তাঁহার বুদ্ধির বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে লোকের মনে স্বতঃই নানা প্রকার গোলযোগ উপস্থিত হয়। বাঙ্গালাকে একটা ভাষা বলিতে যাও, তাহাতেই অনেকের আপত্তি আছে। বিশেষ ও পাড়ার কয়েকজন নবাব বাহাদুর, খাঁ বাহাদুর, ডাক্তার, কবিরাজ ও অনেক বড় বড় ঢ, ণ, ত এরা পর্য্যন্ত ইহাকে এখনও ভাষা বলিতে স্বীকার করেন নাই। সুতরাং তাহার সাহিত্য এবং তাহার আবার চর্চা; এ সম্পূর্ণ বাতুলতা। এ কথা যে বলে সে দোষী ত বটেই, অধিকন্তু ক্ষমারও অযোগ্য।… আমাদের লেখাকে যদি পাঠকবর্গ অনুগ্রহপূর্ব্বক সরল সাহিত্য বলিয়া বিবেচনা করেন, তবে আর আমাদের সাহিত্যচর্চার স্পর্দ্ধা নিতান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
সাহিত্যের পর ইহাতে আমাদের মাসে মাসে বিজ্ঞানের চর্চা করার অভিলাষ ছিল। অভিলাষে কি হয় ? এ দেশীয় বিলাতি ভাষার বড় বড় পণ্ডিতেরা সকলেই একবাক্য বলিতেছেন যে, এ ভাষায় বৈজ্ঞানিক শব্দ পাওয়া যায় না, এ ভাষা বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। বাস্তবিকই এই বাংলা ভাষাটা যেমন বিতিকিচ্ছি তেমনই দুষ্ট; এ বরাবর হইতেই অবগত আছে যে, আমাদের মৌলিক নির্ম্মাণক্ষমতা একেবারেই নাই; তাহা সত্ত্বেও সাহিত্য, অলঙ্কার, বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিষয়ে যাবতীয় আবশ্যক শব্দে সুসমৃদ্ধ হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে এ কিছুতেই স্বীকৃত হয় নাই।… তবু আমরা দেশি ভাষায় যতদূর পর্য্যন্ত পারি, তাপ, তড়িৎ, উষ্ণতা, আলোকগতি, বল, রসায়ন, আকর্ষণ প্রভৃতি এবং তৎসহ অন্যান্য বিজ্ঞানসম্মত বিষয় সর্ব্বদা প্রকাশে যত্নবান থাকিব।…
পুরাবৃত্ত প্রকাশ সম্বন্ধে আমরা সবিশেষ মনোযোগ করিব;…
রাজনীতি বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিব।… বিশেষ যে দেশে বসিয়া আমরা রাজনীতির আলোচনা করিব, সে দেশের নীতিজ্ঞান অনেক দিন অজীর্ণতা ও দুর্ব্বলতা ভোগ করিয়া অবশেষে মারা গিয়াছেন।…
…ধর্ম্মশাসনের বাহিরে লৌকিকতার যে অংশ অবস্থিত, আমরা অবসর পাইলেই তৎসম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিব। ইহাই আমাদের সমাজতত্ত্ব বা social question…৭
এই লক্ষ্যসাধনে সচেষ্ট হয়ে মিহির একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যপত্রিকারূপে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। সম্ভবত দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ-সপ্তম যুগ্মসংখ্যা প্রকাশের পর প্রচার রহিত হয়।৮
একথা বললে অন্যায় হবে না যে, বাঙালি মুসলমান-পরিচালিত সাহিত্য-পত্রিকাসমূহের মধ্যে মিহিরই প্রথম একটি বিশিষ্ট চরিত্রের অধিকারী হয়েছিল। আবদুল কাদির সংগতভাবেই লক্ষ করেছেন যে, মিহিরে প্রকাশিত ডাক্তার হবিবর রহমানের ‘চন্দ্রশেখরে দলনী বেগম’ বাঙালি মুসলমানের লেখা সাহিত্য-বিচারমূলক প্রথম প্রবন্ধ।৯ ওয়াশিংটন আরভিংয়ের The Alhamra গ্রন্থের Pilgrim of Love উপাখ্যান-অবলম্বনে রচিত আবদুর রহিমের ‘প্রণয়যাত্রী’ অংশত প্রকাশিত হয়েছিল মিহিরের প্রথম দু সংখ্যার। আরভিংয়ের একই গ্রন্থ অবলম্বনে আলহামরা নামে আবদুর রহিম যে-বইটি লেখেন, তাও আংশিকভাবে প্রথম সংখ্যা মিহিরে পত্রস্থ হয়েছিল। তাছাড়া ‘পুরাতত্ত্ব’ নামে আবদুর রহিমের একটি রচনার দুই কিস্তি মিহিরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এতে রোটাসগড়, শেরগড়, চৈনপুর, হাড়োয়া, নারিকেলবাড়িয়া, কাজীপাড়া ও বাসরার পুরাবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে।১০
মিহিরের যুগেই আবদুর রহিম একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এর নাম হাফেজ এবং এর আত্মপ্রকাশের কাল ২ নভেম্বর ১৮৯২। ৪ সীতারাম ঘোষের স্ট্রিট থেকে এটি প্রকাশিত হয় এবং ওই ঠিকানায় মুনীন্দ্রমোহন বসু কর্তৃক মিলনযন্ত্রে মুদ্রিত হয়। ডিমাই ১/৪ মাপের চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকার দাম ছিল দু পয়সা, ছাপা হতো ৫০০ কপি। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় বলা হয়েছে যে, এর কবিতাগুলি মুসলমানি বাংলায় রচিত।১১ এ পত্রিকা নিতান্তই স্বল্পায়ু ছিল।
১৮৯৪-তে বিলুপ্ত সুধাকর ও মিহির পত্রিকার নাম মিলিয়ে সাপ্তাহিক মিহির ও সুধাকর প্রচারিত হয়। আবদুর রহিম এর সম্পাদক ছিলেন। ২৫ রায়বাগান স্ট্রিট (হেদুয়ার ধার) থেকে ভারত-মিহির যন্ত্রে এটি মুদ্রিত হতো। আবদুর রহিম তখন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর সৌজন্যে তাঁর আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে বাস করতেন; সম্পাদকীয় দপ্তরও ছিল ওই ঠিকানায়। বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র অধিকাররক্ষায় মিহির ও সুধাকরের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সম্ভবত এই কারণেই ভারত-মিহির যন্ত্রের স্বত্বাধিকারীরা কিছুকাল পরে মিহির ও সুধাকর মুদ্রণ করতে অস্বীকার করেন। পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখার জন্যে আবদুর রহিম বিত্তশালী মুসলিম সমাজনেতাদের শরণাপন্ন হন। নবাব সলিমুল্লাহ এককালীন পঁচিশ হাজার টাকা দান করেন এবং সেই অর্থ দিয়ে একটি প্রেস ক্রয় করা হয়। আর নবাব আবদুস সোবহান চৌধুরী তাঁর মেটকাফ স্ট্রিটের বাড়িতে এই প্রেস প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন এবং তখন মিহির ও সুধাকর-এর কার্যালয়ও সেখানে স্থানান্তরিত হয়। পত্রিকা-তত্ত্বাবধানের অনেকখানি দায়িত্ব গ্রহণ করেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। সম্ভবত ১৯০৫ সালে তাঁর সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় আবদুর রহিম মিহির ও সুধাকরের সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন।১২ তখন তাঁর আত্মীয় সৈয়দ ওসমান আলীর (লেখক সেখ ওসমান আলী বি-এল নন) সম্পাদনায় পত্রিকাটি বছরখানেক চলে বন্ধ হয়ে যায়। মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন যে, ১৩১৫ সালে তিনি মিহির ও সুধাকরের সহযোগী সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং তার কিছুকাল পরে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।১৩ এই তারিখ অভ্রান্ত হলে আবদুর রহিমের সঙ্গে মিহির ও সুধাকরের সম্পর্কচ্ছেদের তারিখ ধরতে হবে ১৯০৭। মিহির ও সুধাকর বন্ধ হয়ে গেলে ওই প্রেস মওলানা মোহাম্মদ আলীকে দেওয়া হয়—তাঁর কমরেড ছাপার জন্যে।
মিহির ও সুধাকরের আয়ুষ্কালে শেখ আবদুর রহিম হাফেজ নামে আরেকটি বিবিধ বিষয়ক মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। এটি আত্মপ্রকাশ করে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। প্রথমে ১৯ মীর জাফরের লেন, পরে ১৪ মেটকাফ স্ট্রিট, থেকে এটি প্রকাশিত হয়। কেদারনাথ রায় এটি মুদ্রিত করতেন ওই ঠিকানায়, লতিফ যন্ত্রে। আকারে ও প্রকারে হাফেজ ছিল মিহিরের সগোত্র এবং এ-পত্রিকাও উচ্চমানের সাহিত্যপত্রিকা হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ছ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েই এটি বন্ধ হয়ে যায়।১৪
প্রথম সংখ্যা হাফেজের সম্পাদকীয় ‘আভাষ’ এখানে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হলো :
সর্ব্বশক্তিমান বিশ্বপালক করুণাময়ের পবিত্র নাম স্মরণ পূর্ব্বক আজ আমাদের বহুদিনের সঙ্কল্পিত “হাফেজ” কে বঙ্গীয় মুসলমান ভ্রাতাগণের নিকট উপস্থিত করিতে সক্ষম হইলাম। এখন দয়াময়ের নিকট সকাতরে করপুটে প্রার্থনা যে, তিনি যেমন তাঁহার অধম দাসকে অনুরূপ ক্ষমতা প্রদানে হাফেজকে সর্ব্বাঙ্গ সুন্দররূপে পরিচালিত করিতে সক্ষম করেন এবং ইহাকে সকলের হৃদয়গ্রাহী করিতে আমাদিগকে যথোচিত ক্ষমতা প্রদান করেন। হে দয়াময়। আমাদের বঙ্গীয় মুসলমান ভ্রাতাগণকে বিদ্যার চর্চা ও বিদ্যোৎসাহী হইতে বঞ্চিত করিও না। কারণ বঙ্গীয় মুসলমান ভ্রাতাগণ ঘোর আলস্য শয্যায় শায়িত হইয়া যেরূপ ভোগবিলাসে জীবন অতিবাহিত করিতেছেন, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সময় থাকিতে যদি তাঁহাদিগকে ভোগবিলাসরূপ ঘোর নিদ্রা হইতে জাগরিত না করা হয়, তাহা হইলে তোমার পবিত্র মনোনীত ধর্ম্মের উপাসক মণ্ডলীর অনুদিন কি দুর্দ্দশা হইবে, তাহা তুমিই বই আর কাহারও বুঝিবার ক্ষমতা নাই। হে সর্ব্বান্তর্য্যামিন! হাফেজ সেই ভোগবিলাস সুখাভিলাষী নিদ্রিত বঙ্গীয় মুসলমানদিগকে তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষদিগের অতীত গৌরব ও ধর্ম্মভক্তি কাহিনি এবং পবিত্র ধর্ম্মের পবিত্র রীতিনীতি শুনাইয়া জাগরিত করিবার জন্য তোমারই আশ্রয়ে ও অনুগ্রহে আজ বঙ্গের চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে বহির্গত হইল। তুমিই হাফেজের একমাত্র বল ও সহায়।
এক্ষণে আমাদের বঙ্গীয় মুসলমান ভ্রাতাগণের নিকট প্রার্থনা যে, হাফেজ প্রকাশে বিলম্ব হেতু আমাদের যে দোষ হইয়াছে, তাহা মার্জ্জনা করিবেন, কেননা এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত সংসারচক্রের ভীষণ বাত্যাঘাতে আমরা কখন নিমজ্জিত কখন উত্থিত হইতেছিলাম। এখন সেই সর্ব্ববিঘ্ন বিনাশক জগৎ পিতার কৃপায় তীরদেশ প্রাপ্ত হইয়া উপলখণ্ডের উপর উপবেশন পূর্ব্বক তাঁহারই পবিত্র নাম স্মরণ করিতে করিতে হাফেজকে বাহির করিয়া আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। আপনারা সকলে কায়মনোবাক্যে আশীর্ব্বাদ করুন, আমরা সুদৃঢ়ভাবে উপবেশন করিয়া আমাদের বহুদিনের সঙ্কল্পিত বিষয়গুলি হাফেজে প্রকাশ করিতে সক্ষম হই। এবার আপনাদের আগ্রহ নিবারণের জন্য তাড়াতাড়ি হাফেজ প্রকাশ করিলাম।
আজ ৭/৮ মাস হইতে হাফেজ প্রকাশের জন্য আমাদের মুসলমান ভ্রাতাগণ আমাদিগকে যেরূপ অনুরোধ করিয়া আসিতেছেন, এখন হাফেজকে তদনুরূপ সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করিলে হাফেজ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হইয়া মুসলমান ভ্রাতাগণকে অনেক বিষয় শুনাইতে সক্ষম হইবে।
হাফেজের মূল্য বেশী হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়, অনেকে আপত্তি করিলেও করিতে পারেন। কিন্তু সকলের ইহা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, মাসিক পত্রিকা সম্পাদন কার্য্য বড় সহজ কথা নহে। সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সম্পাদন কার্য্য অপেক্ষা মাসিক পত্রিকা সম্পাদন কার্য্য বড় গুরুতর। সহৃদয় চিন্তাশীল ব্যক্তিই তাহা সহজে উপলব্ধি করিতে পারেন, সে বিষয়ে অধিক লেখা বাহুল্য মাত্র। পূর্ব্বে ইচ্ছা ছিল, আকার কিছু ছোট করিব, কিন্তু ছোট আকারের কাগজে পাঠোপযোগী কিছু থাকিবে না বলিয়াই একেবারে আকার বড় করিলাম। সকলের সাহায্য ও উৎসাহ পাইলে আরও এক ফর্ম্মা বৃদ্ধি করিব, ইচ্ছা রহিল।
এই বঙ্গে হিন্দু ভ্রাতাগণ পরিচালিত যে কয়েকখানি উচ্চ অঙ্গের মাসিক পত্রিকা আছে, তাহাদের কোনখানিই কম মূল্যের নহে। কিন্তু তথাপিও প্রত্যেকখানির গ্রাহক সংখ্যা কম নহে। আর আমাদের মধ্যে এই একখানি মাত্র মাসিক পত্রিকা, ইহার উন্নতি ও স্থায়িত্ব কল্পে বঙ্গীয় প্রত্যেক মুসলমান ভ্রাতার প্রাণপণে সাহায্য করা কি উচিত নহে ? অবশ্য আমাদের মুসলমান ভ্রাতাগণ হাফেজ প্রাপ্ত হইয়া জাতীয় গৌরবের চিহ্ন মনে করিয়া প্রীতি প্রফুল্ল মনে ইহার উন্নতি সাধনে চেষ্টা করিবেন বলিয়া আমাদের বেশ বিশ্বাস জন্মিয়াছে, তাই আমরা, আজ এই দুর্দ্দিনে হাফেজ বাহির করিয়া মুসলমান ভ্রাতাগণের হস্তে অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত রহিলাম। সকলে মিলিয়া সামাজিক কার্য্য মনে করিয়া হাফেজের উন্নতি সাধনে যত্নবান হইবেন; ইহাই একান্ত অনুরোধ। কিমধিক মিতি।
হাফেজ পত্রিকায় খোন্দকার ফজলে রব্বি খান বাহাদুরের হকিকতে মুসলমানানে বাঙ্গালা বইটির আংশিক অনুবাদ করেছিলেন শেখ আবদুর রহিম। বাঙ্গালার মুসলমান নামে প্রকাশিত এই রচনার ভূমিকায় অনুবাদক বলেন :
মুসলমানের সংখ্যা বাঙ্গালায় যত অধিক, ভারতবর্ষের অপর কোনও অংশেই তত অধিক নহে। এই আধিক্যের কারণ নির্দ্ধারণ করিবার জন্য অনেকেই অনেক চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু ইতিপূর্ব্বে এতৎসম্বন্ধে কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নাই। মুসলমানের সংখ্যা বাঙ্গালায় এত অধিক কেন, তাহার প্রকৃত কারণ না জানিয়া, অনেকে অনেক প্রকার স্বকপোলকল্পিত কারণ নির্দ্দেশ করিতেন। পরিশেষে নবাব-বাহাদুর অব মুর্সিদাবাদ জি, সি, আই, ই বাহাদুরের দেওয়ান খোন্দকার ফজলে রব্বি খাঁন বাহাদুর মহোদয়, ইহার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করিবার জন্য বিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, অনেক ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত উদঘাটন করিয়া এতৎসম্বন্ধে অনেক অবশ্য জ্ঞাতব্য তত্ত্ব সংগ্রহ করেন। কেবল ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত নহে, এতৎসম্বন্ধে তিনি অন্যবিধ উপায়ে আরও অনেক তত্ত্ব সংগ্রহ করেন। তিনি অনেক পরিশ্রমের পর, ঐ সকল তত্ত্ব সংগ্রহে কৃতকার্য হইয়া, প্রথমতঃ উর্দ্দূ ভাষায় “হকিকতে মুসলমানানে বাঙ্গালা” নামে পশ্চাতে ইংরাজী ভাষায় “The Origin of the Musalmans of Bengal” নামে একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন।
গ্রন্থখানি ইংলণ্ড, আমেরিকা, ভারতবর্ষের বিদ্বৎসমাজে সাদরে গৃহীত, সমাদৃত ও সুখ্যাতির সহিত সমালোচিত হইয়াছে। বাঙ্গালার মুসলমান ভ্রাতাদের জন্য উল্লিখিত উৎকৃষ্ট গ্রন্থের বাঙ্গালা অনুবাদ একান্ত আবশ্যক মনে করিয়া আমরা তাহার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। খাঁন বাহাদুরের গ্রন্থের গৌরব রক্ষা করিতে পারিব, এরূপ সাহস আমাদের কিছুমাত্র নাই। তবে আমাদের প্রতি সাধারণের যথেষ্ট সহানুভূতি ও অনুগ্রহ আছে জানিয়া এরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতেছি। কিন্তু কতদূর কৃতকার্য্য হইব, জানি না, বিদ্বান সমাজ ইহার বিচার করিবেন।
বাঙ্গালার বিদ্বান সমাজের নিকট নিতান্ত বিনয়ের সহিত আমাদের আর একটি বক্তব্য আছে। সম্পাদকীয় দায়িত্ব অতিশয় গুরুতর। মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিপত্র “মিহির ও সুধাকর” সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় গুরুভার মস্তকোপরি রক্ষা করিয়া সম্পাদকীয় সহস্র ভাবনা সত্ত্বেও উক্ত গ্রন্থের অনুবাদ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি। সুতরাং এই অনুবাদে যে কোনও রূপ ত্রুটি পরিলক্ষিত হইবে না, একথা কখনও সাহস করিয়া বলিতে পারি না। যদি কাহারও চক্ষে কোনও রূপ ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, গুণগ্রাহী ব্যক্তিগণ, নিজ গুণগ্রাহিতাগুণে তাহা মার্জ্জনা করিবেন, ইহাই বিনীত প্রার্থনা।
হাফেজ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় অনামে শেখ আবদুর রহিমের ইসলামে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্ত্তব্য কর্ম্ম (১ম পরিচ্ছেদ) প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে প্রকাশিত কোরআন ও হাদিসের উপদেশাবলী পুস্তিকা এরই পরিবর্ধিত রূপ।
হাফেজ পত্রিকা কেবল উচ্চমানের সাহিত্যপত্রিকাই ছিল না, এতে সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যারও আলোচনা করা হতো। এ ধরনের রচনার মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত সেখ ওসমান আলির ‘কংগ্রেস ও মুসলমান জাতি’ প্রবন্ধটি খুবই উল্লেখযোগ্য। এতে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্যে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল।
মিহির ও সুধাকর ছেড়ে দিয়ে আবদুর রহিম মোসলেম প্রতিভা নামে একটি মাসিকপত্রের সম্পাদনভার গ্রহণ করেন। মাসিক মিহির এবং পাক্ষিক ও মাসিক ‘হাফেজে’র স্বত্বাধিকারী ছিলেন তিনি নিজে। কিন্তু মোসলেম প্রতিভার স্বত্বাধিকারী ছিলেন আফতাবউদ্দীন আহমদ নামে এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মোসলেম প্রতিভার প্রথম সংখ্যা বের হয়। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় সম্পাদক হিসেবে আবদুর রহিমের সঙ্গে মোজাম্মেল হকের নামও পাচ্ছি।১৫ পত্রিকাটি ৩০ মুসলমানপাড়া লেন (স্বত্বাধিকারীর বাসস্থান) থেকে প্রকাশিত হয় এবং শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী কর্তৃক কালিকা প্রেস, ১৭ নন্দকুমার চৌধুরীর দ্বিতীয় লেনে মুদ্রিত হয়। এ-পত্রিকাও স্বল্পায়ু ছিল। এ-পত্রিকা সম্পর্কে একটি বিবরণীতে বলা হয়েছে, যে, ‘সূতিকাঘর হইতে বাহির হইবার পর একমাসও জীবিত ছিল না’।১৬
মিহির ও সুধাকর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাঙালি মুসলমান সমাজের একটি মুখপত্রের অভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়। এই অভাব মেটাবার উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক মোসলেম হিতৈষীর প্রতিষ্ঠা হয়। এই পত্রিকার সূচনা সম্পর্কে মোজাম্মেল হক লিখেছেন :
“মিহির ও সুধাকর” বন্ধ হওয়ার পর বঙ্গীয় মোস্লেম-সমাজে জাতীয় সংবাদপত্রের অভাব হইয়া পড়ে, এবং তদ্ধেতু জাতীয় অভাব-অভিযোগ বা অপর কোনও সামাজিক কথা সদাশয় গভর্নমেন্টের গোচর করিয়া প্রতীকার-প্রার্থনা এবং সমাজের সহানুভূতি লাভ করিবার উপায় ছিল না। … অবশেষে সেই দারুণ অভাবের কথা জনাব মাওলানা [ফুরফুরার পির আবুবকর] সাহেবের কর্ণগোচর করা হয় এবং তাঁহারই পরামর্শে সমাজ-হিতৈষী মাননীয় মৌলবী ওয়াহেদ হোসেন বি, এল উকিল সাহেব, সৎসাহিত্যিক মুন্শী শেখ আবদুর রহিম ও অপরাপর কতিপয় সমাজসেবকদের প্রযত্নে ১৩১৭ সালের ৮ই মাঘ তারিখে কলিকাতার গ্রীয়ার পার্কে আঞ্জমনে ওয়ায়েজিনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। সেই সভায়… একখানি জাতীয় সংবাদপত্র প্রচার করা সর্ব্বাগ্রে কর্ত্তব্য স্থির করেন…। তিনি সহর্ষে সেই সঙ্কল্প অনুমোদন করেন ও তাহার পৃষ্ঠপোষকরূপে দণ্ডায়মান হইতে স্বীকৃত হয়েন। তাঁহার সেই সম্মতির ফল, আমাদের জাতীয় সংবাদপত্র এই মোসলেম হিতৈষী।… তাঁহার পবিত্র নাম ললাটে স্থাপন করিয়া মোসলেম-হিতৈষী আজ সমাজের কুশল-সাধনে ব্যাপৃত আছেন।১৭
এই সভায় সংগৃহীত অর্থ এবং অন্যত্র চাঁদা সংগ্রহ করে মোসলেম হিতৈষীর প্রেস স্থাপিত হয় ১৮ হ্যারিসন রোডে। ১৯১১ সালে এই সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আত্মপ্রকাশ করে আবদুর রহিমের সম্পাদনায়। মিহির ও সুধাকরের মতো মোসলেম হিতৈষীও বাঙালি মুসলমান সমাজের একমাত্র মুখপত্র হয়ে উঠেছিল এবং সমাজসেবায় বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিল। ১৯১৪ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে মোসলেম হিতৈষীর ছাপাখানা ও কার্যালয় সম্পূর্ণ দগ্ধীভূত হয়। অনেকের ধারণা, কোনো সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফলেই এ-অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। এর ফলে মোসলেম হিতৈষীর প্রকাশ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। কিছুকাল পর মোল্লা আতাউল হক ও মোল্লা এনামুল হক নামে দুই ব্যবসায়ী ভ্রাতার অর্থানুকূল্যে খর্বকলেবর মোসলেম হিতৈষী পুনরায় প্রকাশলাভ করে। তখন এর কার্যালয় ছিল ৭ মহারাণী স্বর্ণময়ী রোড। খুব সম্ভব, ১৯২০ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশ অব্যাহত ছিল।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে আবদুর রহিমের সম্পাদনায় মাসিক ইসলাম-দর্শন পত্রিকা প্রচারিত হয়। সম্পাদক কর্তৃক তাঁর বাসস্থান ২১ আন্তনীবাগান লেন থেকে এটি প্রকাশ পায় এবং এম. শফি কর্তৃক ইসলামিয়া প্রেস, ১৩৪ বৈঠকখানা রোড থেকে মুদ্রিত হয়। চার সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটি প্রায় এক বছর বন্ধ থাকে। তারপর আর দুটি সংখ্যার প্রকাশ-সংবাদ পাচ্ছি।১৮ সম্ভবত এই ছ সংখ্যার পর ইসলাম দর্শন আর বের হয়নি। পরে, ১৯২০ সালে, মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ও নূর মোহাম্মদের সম্পাদনায় যে ইসলাম-দর্শন প্রকাশিত হয়, সেটি স্বতন্ত্র মাসিকপত্র।
আবদুর রহিমের সাংবাদিকজীবনে পূর্ণচ্ছেদ পড়েছিল এখানেই। সংবাদপত্র ও সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের যে-উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সমাজচেতনা-আনয়নে ও সাহিত্যিক রুচিগঠনে তা বিশেষ কার্যকর হয়েছিল।
চার
আবদুর রহিমের প্রথম একক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল এসলাম-তত্ত্বের প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে। এসলাম তত্ত্ব সম্মিলিত উদ্যোগে প্রকাশিত হয়; গ্রন্থকার হিসেবে কারো নাম এতে মুদ্রিত হয়নি। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় এসলাম তত্ত্বের প্রথম খণ্ডের (১৮৮৮) লেখক হিসেবে মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহ্মদের এবং দ্বিতীয় খণ্ডের (১৮৮৯) লেখক হিসেবে রিয়াজুদ্দীন আহ্মদ (পণ্ডিত মাশহাদি ?) ও শেখ আবদুর রহিমের নাম আছে; তবে প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণের বিবরণীতে লেখক (ও স্বত্বাধিকারী) হিসেবে মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীনের সঙ্গে শেখ আবদুর রহিমের নাম পাচ্ছি।১৯ এসলাম তত্ত্ব অনুবাদমূলক রচনা। ‘মওলানা জামালউদ্দীন আফগানী রচিত ‘নেচার ও নেচারিয়া’র অনুবাদ হলো প্রথম খণ্ড, আর মওলানা আবদুল হক হক্কানী সাহেবের ‘তফসিরে হক্কানী’র উপক্রমণিকা ভাগের অনুবাদ এর দ্বিতীয় খণ্ড।’২০ প্রথম খণ্ডের আলোচ্য বিষয় ‘নাস্তিকতা’, ‘এসলাম’ ও ‘বিশ্বাস’; দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচিত হয়েছে ‘কোরাণ শরিফ’ ও ‘খোদাতালার প্রেরিত পয়গাম্বর’। নাস্তিকতাপ্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন দেশকালের মতাদর্শ আলোচিত হয়েছে : এপিকিউরিয়ান দর্শন থেকে রুশো-ভোলতেয়ারের চিন্তাধারা এবং সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট ও নিহিলিস্টদের কর্মধারা। কুরআনপ্রসঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ব্রাহ্মমতের বিচার আছে। স্বল্প পরিসরে এই বিস্তৃত বিষয়বস্তুর আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই অসম্পূর্ণতা আছে; কিন্তু মূল গ্রন্থের অনুসরণে বৃহত্তর বিশ্বের ভাব-আন্দোলন সম্পর্কে অনুবাদকদের সচেতনতা লক্ষ করা যায়। এসলাম তত্ত্বের মূল সুরটি রক্ষণশীল; ধর্ম-বিষয়ে দৃষ্টি স্বভাবতই আত্মগত। কিন্তু বিষয়বস্তুর বিস্তারের জন্যে এ-বই এখনো পাঠযোগ্য। এর ভাষার সারল্য ও সহজ প্রকাশক্ষম ভঙ্গি প্রশংসাযোগ্য।
আবদুর রহিমের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি (১৮৮৮) প্রকাশলাভের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশংসা অর্জন করেছিল। তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি মুসলমান হজরতের জীবনচরিত রচনা করেননি। এই বইতে তাঁর অসাধারণ পরিশ্রম ও নিষ্ঠার স্বাক্ষর আছে। এ-গ্রন্থরচনায় তিনি ‘প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ আরবী ও পারসী গ্রন্থ’ ছাড়াও র্সা সৈয়দ আহ্মদ ও সৈয়দ আমীর আলীর রচনাবলির সাহায্য গ্রহণ করেন এবং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতামতের আলোচনা করেন। পরবর্তী সংস্করণসমূহে কৃত পরিবর্তন-পরিবর্ধনে যাঁদের রচনাদির সাহায্য নেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ, শিবলি নোমানি, চিরাগ আলী, মওলানা মুহম্মদ আলী ও টি. ডব্লিউ. আর্নল্ডের নাম উল্লেখযোগ্য। এ-বইয়ের যে ‘ষষ্ঠ সংস্করণ’ আমাদের হাতে আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শিবলি নোমানির সিরাতুন্নবীর উপরে তিনি বিশেষভাবে নির্ভর করেছেন এবং শিবলির আলফারুক ও আলকালাম থেকেও অনেক বক্তব্য চয়ন করেছেন। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, ইসলাম জগতে যেসব ভাব-আন্দোলন ঘটেছিল, তার সঙ্গে আবদুর রহিমের শুধু পরিচয় ছিল না, সেই পরিবর্তনশীল ভাবধারার প্রভাবাধীনও তিনি হয়েছিলেন। তাই এই জীবনচরিতে যেমন ইসলামের আদি বিশুদ্ধতার সন্ধান আছে, তেমনি আছে যুক্তিধর্মী চিন্তার প্রয়াস।
যে-পরিবেশে তিনি জীবনচরিতটি রচনা করেছিলেন, তাতে হজরত মুহম্মদের জীবন সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তি তিনি উপেক্ষা করতে পারতেন না। আবদুর রহিম তা পারেননি, কিন্তু সেগুলো নির্বিচারে স্বীকার করতেও সমর্থ হননি। তাই যেখানে প্রচলিত মতামতের উল্লেখ করেছেন, সেখানে টীকা সন্নিবেশ করে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন, সুবিখ্যাত সুরা ফিলের অনুবাদ করে এবং এই সুরায় কথিত ঐতিহাসিক ঘটনা বিবৃত করে তিনি টীকায় বলেছেন :
কেহ কেহ বলেন যে, বসন্ত রোগাক্রান্ত হইয়া আবরাহার সৈন্য বিধ্বস্ত হয়। পক্ষীর কঙ্কর নিক্ষেপ বিষয়ে সুরা ফিলে যে বর্ণনা আছে, তাহা রূপক বর্ণনা।২১
লেখক স্পষ্ট করে না বললেও, আমরা বুঝতে পারি যে, এই মত তিনিও সমর্থন করেন।
অন্যত্র তিনি আরো স্পষ্টভাষী। কথিত আছে যে, হজরতের জন্মমাত্র তাঁর স্কন্ধে ‘মোহর-নবুয়ত’ বা প্রেরিত পুরুষের অভিজ্ঞান দেখা গিয়েছিল। আবদুর রহিম এটিকে ‘গল্প’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, হজরতের স্কন্ধে যে-বর্ধিত মাংসপিণ্ড ছিল, তাকে কেন্দ্র করেই ‘পরবর্তী আলেমগণ উহা কল্পনা করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন’।২২ জনশ্রুতি এই যে, প্রেরিত পুরুষের জন্মলগ্নে সমুদয় পৃথিবী কম্পিত হয়, কাবাগৃহের প্রধান দেবমূর্তি ভূমিসাৎ হয়ে যায়, পারস্যের রাজপ্রাসাদের চূড়া ভগ্নদশা লাভ করে, জোরাস্টারবাদীদের পূজ্যবহ্নি নির্বাপিত হয় এবং এ-ধরনের আরো কয়েকটি অনৈসর্গিক ঘটনা ঘটে। আবদুর রহিম স্পষ্ট বলেছেন যে, ‘এই সকল ঘটনা সম্বন্ধে কোন বিশ্বাসযোগ্য হাদিস নাই’।২৩ ‘কুমারের ভারপ্রাপ্ত হালিমা বিবি অনেক অমানুষিক ঘটনা দর্শন করিয়াছিলেন, অনাবশ্যক বোধে তাহা লিখিত হইল না’ বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি; হজরতের আগমনে বিবি হালিমার গৃহে যেসব বৈষয়িক উন্নতি ঘটে বলে কিংবদন্তি আছে, সেগুলোর ‘অনুকূলে অন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য হাদিস পাওয়া যায় না’, একথা লেখক যোগ করেছেন।২৪ বহিরা নামক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী হজরতের নবুয়ত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন বলে যে-প্রসিদ্ধি আছে, সে-সম্বন্ধেও লেখক ‘সহি হাদিসের অভাব’ লক্ষ করেছেন।২৫ হজরতের বক্ষবিদারণ তাঁর কাছে রূপক বর্ণনা, কেননা, ‘ইহা প্রকৃত বলিয়া স্বীকার করিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়’।২৬ মেরাজকে তিনি বাস্তবিক বলে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হননি; তাঁর ধারণায়, ‘ঘুম ও জাগ্রতের মধ্য অবস্থার অর্থাৎ ‘যোগাবেশ’ অবস্থায়’ এই ভ্রমণ সম্পন্ন হয়।২৭
এই ধরনের কাণ্ডজ্ঞান ও সত্যানুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় হজরত ইসার জন্মরহস্য সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তে। যিশু যে মানবপুত্র, সে-সিদ্ধান্তের সমর্থনে মানবজন্মরহস্য সম্পর্কে কুরআনের বাণী তিনি উদ্ধৃত করেছেন।২৮ স্রষ্টার প্রতি সমর্পিতচিত্ত হওয়ার প্রসঙ্গে আবদুর রহিম সুফিদের সাধনপ্রণালির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথা বলতে ভোলেননি যে, ‘এরূপ আদর্শ ইসলাম-অনুমোদিত নহে’; কেননা সংসারত্যাগের যে-আদর্শ সুফিদের জীবনে গৃহীত হয়েছিল, সে-ব্যবস্থা সাধারণ মুসলমানের জন্যে নির্দিষ্ট হয়নি।২৯
সমসাময়িক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার ফলে আবদুর রহিম তাঁর গ্রন্থে প্রতিপক্ষের যুক্তিখণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। হজরতের বিরুদ্ধে তরবারিবলে ইসলামপ্রচার এবং বহুবিবাহের যেসব অভিযোগ ইওরোপীয় পণ্ডিতেরা উত্থাপন করেছেন, সকল মুসলমান ঐতিহাসিকের মতো তিনিও চেষ্টা করেছেন সেসব অভিযোগের অসারতা প্রমাণ করতে।৩০ মিশনারিদের প্রচার-পুস্তিকার জবাব তিনি দিয়েছেন এবং ইসলামের সমালোচকদের মতামতের ভ্রান্তিপ্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন।৩১ তিনি দাবি করেছেন যে, ইসলামই নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করেছে।৩২ প্রসঙ্গান্তরে তিনি একথাও বলেছেন যে, ইসলামের সাম্য ও ন্যায়নীতির আদর্শের কাছে বলশেভিকদের ‘ভোগনীতির সাম্য’ ম্লান হয়ে যায়।৩৩
বলা বাহুল্য যে, ভক্ত ও বিশ্বাসী মনের পক্ষে যুক্তিবাদের যে-সীমাবদ্ধতা আছে, লেখকের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য ছিল। কেননা, সকল ব্যাপারে প্রশ্ন করা ও যুক্তিপ্রয়োগ করা এই জাতীয় মনের প্রবণতার বিরোধী। অনেক স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিয়েই এঁদের পক্ষে যুক্তিপ্রয়োগ করা সম্ভব। উনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি যখন নতুন নতুন বিস্ময় রচনা করেছিল, আবদুর রহিম তখন এই গ্রন্থ রচনা করেন। বিজ্ঞানের সে-জয়যাত্রার কালে অবৈজ্ঞানিক মন হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুরু করেছিল। জীবনচরিতে এরই সমান্তরাল চেষ্টা দেখা যায়। ঐশীবাণীর প্রমাণ উপস্থিত করার জন্যে এতে ‘তড়িৎ বার্ত্তাবহ’, ‘তারহীন টেলিগ্রাফ’, ‘টেলিফোন’, ‘গ্রামোফোন’ প্রভৃতির আলোচনা করে বলা হয়েছে যে, এগুলো সম্ভব হয়ে থাকলে ঐশীবাণী অসম্ভব হবে কেন ?৩৪ আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে লেখক বিজ্ঞানের অসম্পূর্ণতা ও সৌরজগতের রহস্য সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। স্বীকার করতেই হবে যে, বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লেখকের ছিল না। সে জ্ঞান থাক বা না থাক, তাঁর এই প্রচেষ্টা যে অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় ও অসার্থক, সেকথা মনে না হয়ে পারে না।৩৫
কিন্তু সামগ্রিক বিচারে হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য রচনা। উপকরণ-সমাহারে, পরিবেশন-নৈপুণ্যে এবং রচনারীতির গুণে এ-গ্রন্থ বিশিষ্ট। তৎসম শব্দপ্রধান ধ্বনিময় গদ্যরচনায় লেখকের সিদ্ধি এতে বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে।৩৬
হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯১৩ ও ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম সংস্করণ ছিল ডিমাই মাপের, পৃষ্ঠাসংখ্যা চারশর কিছু বেশি। দ্বিতীয় সংস্করণ ক্রাউন মাপের সাত শতাধিক পৃষ্ঠার বই; তৃতীয় সংস্করণের আকার একই, পৃষ্ঠা সংখ্যা এক হাজার। এই দু সংস্করণে কী কী নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে, তার সম্পূর্ণ তালিকা শেখ আবদুর রহিম গ্রন্থাবলীর প্রথম খণ্ডে (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৬৫) পুনর্মুদ্রিত ‘হজরত মুহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’র দ্বিতীয় ও পঞ্চম (আসলে তৃতীয়) সংস্করণের ‘বিজ্ঞাপনে’ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত বিষয়ের মধ্যে ‘ঐশীবাণীর প্রমাণ-আলোচনা’মূলক (বর্তমান সংস্করণের চতুর্থ) পরিচ্ছেদ, ‘হজরতের যুদ্ধালোচনা’ (বর্তমান সংস্করণের ষোড়শ পরিচ্ছেদ) এবং ‘ইসলামে স্ত্রীলোকদের অবস্থা’ (বর্তমান সংস্করণে দ্বিতীয় খণ্ডের চতুর্থ পরিচ্ছেদ) প্রধান। তৃতীয় সংস্করণে বইটি দু খণ্ডে (জীবনচরিত ও ধর্মনীতি) বিন্যস্ত হয়। ‘ইসলামের বিশেষত্ব’ ইত্যাদি, ‘হজরতের বহুবিবাহও তাঁহার সহধর্মিণীদের বিবরণ’, খ্রিষ্টান পাদরিদের মতামত-খণ্ডন এবং ‘হজরতের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি সম্বন্ধে’ সাধারণ আলোচনা যুক্ত হয়। উপরে যে-সমস্ত টীকা-সংযোজনের উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে সুরা ফিল-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দ্বিতীয় সংস্করণে আছে। বাকি সবগুলি ব্যাখ্যা আছে তৃতীয় সংস্করণে। তাঁর যুক্তিবাদের বিকাশ প্রধানত এই সংস্করণেই হয়েছে। আরো এক-আধটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম দুই সংস্করণে বলা হয়েছিল :
কথিত আছে যে, হজরত মহম্মদ তিন মাস বয়ঃক্রমকালে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে ও সাতমাস বয়ঃক্রমকালে দৌড়াদৌড়ি করিয়া বেড়াইতে পারিতেন; আটমাস বয়ঃক্রমকালে সকলে তাঁহার বাক্যাবলী বুঝিতে পারিত ও নয় মাস বয়ঃক্রমকালে বেশ পরিষ্কার সারগর্ভ বাক্য বলিতেন। আর তিনি সর্বদা বলিতেন ‘লা এলাহা এল্লেল্লা আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর আলহামদোলেল্লাহে রব্বেল আল আমিন,’ ইহা শুনিয়া সকলে আশ্চর্যান্বিত হইত।
তৃতীয় সংস্করণে এ-অংশ পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রথম দু-সংস্করণে ‘বিবাহরাত্রেই আমেনা খাতুনের গর্ভসঞ্চারের’ কথা বলা হয়েছিল। তৃতীয় সংস্করণে তাও বাদ পড়েছে।
এখানে একটি বিষয়ে উল্লেখ করা দরকার। প্রথম তিন সংস্করণের মধ্যে ব্যবধান যথাক্রমে পঁচিশ ও বারো বৎসরের। অথচ, তৃতীয় ও ষষ্ঠ সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য মাত্র দেড় বছরের। এটা নিতান্তই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। এত বড় বই ছাপাতে কম সময় লাগবার কথা নয়। উল্লেখযোগ্য যে, চতুর্থ ও পঞ্চম সংস্করণের কোনো বই আমরা দেখি না। ষষ্ঠ সংস্করণ বলে যা প্রচারিত তা যে আসলে চতুর্থ সংস্করণ, এর আরেকটা বড় প্রমাণ আছে। ষষ্ঠ সংস্করণে ‘পঞ্চম বারের বিজ্ঞাপন’ বলে যা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, তা আসলে ‘তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন’রূপেই তৃতীয় সংস্করণে মুদ্রিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তৃতীয় সংস্করণের সামান্য ভাষাগত পরিবর্তন সাধন করে ষষ্ঠ তথা চতুর্থ সংস্করণের পাঠ নির্মিত হয়েছে।
প্রথম সংস্করণে বইটি সম্পর্কে কলকাতা মাদ্রাসার আলেমদের মতামত (উর্দুতে) সন্নিবিষ্ট হয়। দ্বিতীয় সংস্করণে তার সঙ্গে যুক্ত হয় নদিয়া আঞ্জমনে এত্তেফাকে এসলামের সম্পাদক সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী সাহেবের (বাংলা) প্রশংসাপত্র। তৃতীয় সংস্করণে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, খান বাহাদুর মুহম্মদ ইবরাহীমের অভিমত (ইংরেজিতে) এবং ফুরফুরার পির আবুবকর সাহেবের (বাংলায়) প্রশংসাপত্র পাচ্ছি।
হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির পরে আবদুর রহিম লেখেন ধর্ম্মযুদ্ধ বা জেহাদ (১৮৯০), ইসলাম (১৮৯৬), নামাজ-তত্ত্ব (১৮৯৮) ও হজবিধি (১৯০৩)। ধর্ম্মযুদ্ধ বা জেহাদ এখন দুষ্প্রাপ্য । ইসলামের (পৃ ২+১১৬) একটি কপি ব্রিটিশ মিউজিয়মের সংগ্রহে আছে; হজবিধি আছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্গ্রন্থাগারে। নামাজ তত্ত্ব/বা/নামাজ বিষয়ক যুক্তিমালার তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে, কলকাতার মোখদুমী লাইব্রেরী থেকে (পৃ ৮+১৯২; দাম এক টাকা)। এর ‘উপক্রমণিকা’ অংশে আবদুর রহিমের গদ্যরীতির পরিচয় আছে :
যিনি আমাদিগকে সামান্য মৃত্তিকা হইতে সৃজন করিয়াছেন, যিনি আমাদিগকে সৌন্দর্য্য, বল, জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকশক্তি প্রদান করিয়াছেন, যিনি আমাদিগকে সুখ স্বচ্ছন্দতার জন্য নানাবিধ জীবজন্তু ও বৃক্ষলতাদিতে পৃথিবী পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছেন, যিনি আমাদিগকে জগতের শ্রেষ্ঠ জীবরূপে সৃষ্টি করিয়া অন্যান্য জীবজন্তুর উপর আধিপত্য প্রদান করিয়াছেন, যাঁহার অপার মহিমায় আমরা পার্থিব অশেষবিধ সুখৈশ্বর্য্যরে অধিকারী হইয়াছি, যিনি আমাদের পরকালের শান্তির জন্য, আমাদিগকে পবিত্র পথের পথিক হইবার জন্য, শেষ প্রেরিত মহাপুরুষ হজরত মহম্মদ মোস্তফা আলায়হেস্ সালামকে মর্ত্ত্যধামে প্রেরণ করিয়াছেন যাঁহার আগমনে আমরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম্মে অনুপ্রাণিত হইয়াছি, সেই বিশ্বপালক, পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্ত্তার স্তব ও আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি এবং যাঁহার অনুগ্রহে আমরা খোদাতায়ালাকে চিনিবার ও এবাদত করিবার প্রশস্ত পথ প্রাপ্ত হইয়াছি, সেই শেষ-প্রেরিত মহাপুরুষের পবিত্র আত্মার শান্তি ও কুশলের জন্য এবং তাঁহার বংশধরগণের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। পৃ ১-২]
এ বইতে তিনি বলেছেন :
পূর্ব্বকালীন মুসলমানদিগের ন্যায় মনের ভক্তি ও দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত আমরা এখন নামাজ পড়ি না বলিয়াই আমাদের এই দুরবস্থা। আল্লাহতায়ালার উপর ভরসা করিয়া নিশ্চয়রূপে বলা যাইতে পারে যে, যদি আমরা পূর্ব্বোল্লিখিত নিয়মে নামাজ পড়ি এবং সমুদয় কার্য্যে কোর-আন শরিফের আদেশ প্রতিপালন এবং পয়গম্বর (দরুদ) সাহেবের অনুকরণ করি, তাহা হইলে আমাদের এরূপ দুর্দ্দশা কখনই থাকিবে না; আমরা আবার সেই প্রাথমিক যুগের মুসলমানদিগের ন্যায় পৃথিবীতে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও পরাক্রমশালী জাতি হইয়া দাঁড়াইব। [পৃ ১৭৫]
মনে হয়, ক্ষণিকের জন্যে হলেও, এখানে তিনি বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়েছেন আধ্যাত্মিকতার দিকে।
‘জাতীয় ইতিহাসে অভিজ্ঞতা না থাকিলে কোন জাতি স্বীয় অবস্থার উন্নতি করিতে সক্ষম হয় না’, এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি প্রণয়ন করেন ইসলাম ইতিবৃত্ত। হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির পরিপূরক গ্রন্থ হিসেবে এটি পরিকল্পিত হয় এবং খণ্ডে খণ্ডে এর প্রকাশের আয়োজন হয়। এর দুটি মাত্র খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে, কলকাতার মোখদুমী লাইব্রেরী থেকে। এই খণ্ড দুটিতে হজরত আবুবকরের খিলাফতের বিবরণ আছে—তাও সম্পূর্ণ হয়নি। ডক্টর মমতাজুর রহমান তরফদার দেখিয়েছেন যে, ওয়াকিদী-রচিত ইতিহাস বলে সুপরিচিত ফতুহুশ্শাম গ্রন্থ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে ইসলাম-ইতিবৃত্ত লেখা হয়।৩৭ ইতিপূর্বে মাসিক মিহিরে প্রকাশিত পণ্ডিত রেয়াজ-অল-দিন আহ্মদ মশহাদীর সুরিয়া-বিজয় নামক রচনাটি পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত আকারে আবদুর রহিম প্রকাশ করেন (১৮৯৫)। সুরিয়া-বিজয়ের কিছু উপাদান ইসলাম-ইতিবৃত্তে আছে; অসম্ভব নয় যে, সুরিয়া-বিজয় পুস্তকাকারে প্রকাশকালে আবদুর রহিম তার কিছু পরিমার্জনা করেন। ফলে দু বইয়ের মধ্যে কিছু ঐক্য আছে।
আজকের বিচারে ইসলাম-ইতিবৃত্ত ইতিহাস হিসেবে ত্রুটিমুক্ত নয়। এর একটা কারণ, লেখকের অবলম্বিত গ্রন্থ ইতিহাস হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, আবদুর রহিম পেশাদার ইতিহাসবিদ ছিলেন না এবং তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল অতীতের যশোগান করে মুসলমানের মনে একটা আবেগময় আত্মগৌরবের ভাব এনে দেওয়া।
ইসলামের অনুশাসনের ব্যাখ্যা করে আবদুর রহিম এরপরে লেখেন নামাজ-শিক্ষা (১৯১৭), ইসলাম-নীতি (১৯২৫), কোরআন ও হাদিসের উপদেশাবলী (১৯২৬), রোজা-তত্ত্ব (১৯২৬) ও খোৎবা (তৃ-স; ১৯৩২)। এর সবগুলিই মখদুমী লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনেকগুলোই বাংলাদেশের মক্তবসমূহে পাঠ্য ছিল।
নামাজ-শিক্ষা/অর্থাৎ/অজু, নামাজ, রোজা ও জাকাত প্রভৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণীর অষ্টাবিংশ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে, কলকাতার মোসলেম পাবলিশিং হাউস থেকে। ইসলাম-নীতি/অর্থাৎ/ইসলাম ধর্ম্মকর্ম্ম, আচার-ব্যবহার ও আদব-কায়দা প্রভৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের অন্তত চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নামাজ-শিক্ষা ও ইসলাম-নীতি-রচনায় আবদুর রহিমকে সাহায্য করেন ডেপুটি ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস কাজি মমতাজউদ্দীন আহ্মদ। পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে/কোরআন ও হাদিসের উপদেশাবলী ক্ষুদ্র পুস্তিকা। রোজা-তত্ত্ব প্রথমে রোজা নামে প্রকাশিত হয়; তাতে ‘রোজার আবশ্যকতা ও উপকারিতার প্রমাণ’ এবং ‘রোজার মসলাদির বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত’ হয়েছিল। রোজা-তত্ত্বে সেইসঙ্গে যোগ করা হয় ‘বিভিন্ন ধর্ম্মে রোজার বিষয় এবং রোজা সম্পর্কে আপত্তি খণ্ডন’। খোৎবা/অর্থাৎ/জুম্মা, ঈদল ফেতর, ঈদজ্জোহা ও বিবাহের খোৎবায় বাংলা ভাষায় খোৎবা প্রচারের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন খোৎবার বঙ্গানুবাদ সংযোজিত হয়েছে। এটিও ক্ষুদ্র পুস্তিকা।
ধর্মগ্রন্থের বাইরে আবদুর রহিম দুটি বই রচনা করেছিলেন : আলহামরা ও প্রণয়-যাত্রী (১৮৯২)। ওয়াশিংটন আরভিংয়ের ঞযব অষযধসৎধ (১৮৩২) অবলম্বনে এই বই দুটি রচিত হয়। দুটিরই অংশবিশেষ মিহিরে প্রকাশিত হয়েছিল। উপাখ্যান-রচনায় আবদুর রহিমের প্রবণতা স্বভাবজ নয়। তবে মুসলমানদের গৌরব যুগের পটভূমিকায় রচিত বলে এই উপাখ্যান দুটির অনুবাদে তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। আলহামরা এখন দুষ্প্রাপ্য। প্রণয়-যাত্রী মূলের সার্থক পুনর্সৃষ্টি।৩৮
পাঁচ
আবদুর রহিমের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বেশি তথ্য আমাদের জানা নেই। তিনি বিবাহ করেছিলেন চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমা-শহরের শেখ আবদুল্লাহর কন্যা জারিয়া খাতুনকে। তিনি চার পুত্র ও চার কন্যার জনক ছিলেন। তিনি বক্তৃতায় অপটু ছিলেন, কিন্তু তাঁর সদালাপ ও সহৃদয়তার খ্যাতি ছিল। তাঁর আশ্রয়ে অনেকে জীবনে উচ্চশিক্ষালাভে সমর্থ হয়েছিলেন।
আবদুর রহিম চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন কমিটি ও পরে কলকাতার টেক্সট্ বুক কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। র্সা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে তিনি দীর্ঘকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরীক্ষক ছিলেন।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে মীর্জা শুজাত আলী বেগের সভাপতিত্বে গঠিত ‘কলিকাতা মহাম্মাদান ইউনিয়নে’র তিনি সদস্য ছিলেন। আঞ্জুমনে ওয়ায়েজীনে ইসলাম, বাঙ্গালার প্রথম সম্পাদক পদ তিনি লাভ করেছিলেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য ও পরে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩৩০) ‘মরহুম ডাক্তার হবিবর রহমান’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। নবনূর পত্রিকা-প্রতিষ্ঠায় উৎসাহদাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
আবদুর রহিমের প্রকৃত পরিচয় তাঁর সাংবাদিক ও লেখক জীবনে নিহিত। সে জীবনের লক্ষ্য তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন :
যখন আমি নিজের ক্ষীণ শক্তিটুকু লইয়া সম্পূর্ণ নিরবলম্বন ও নিঃসহায় অবস্থায় বাঙ্গালার সাহিত্য-আসরে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলাম, তখন একটি মাত্র প্রবল চিন্তা আমার সমস্ত দেহ-মন অধিকার করিয়া লইয়াছিল। সে চিন্তাটি এই যে—কেমন করিয়া আমার প্রিয়তম স্বজাতি বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মধ্যে বাঙ্গালা ভাষার অবাধ প্রচার করিব,—কেমন করিয়া তাহাদের ভ্রান্ত কুহেলিকা ও জড়তা মোচন করিয়া তাহাদিগকে মাতৃভাষার পুণ্য-মন্দিরে লইয়া আসিব—এবং কেমন করিয়া তাহাদের মনের মধ্যে মাতৃভাষার সাহায্যে জাতীয় সাহিত্য গঠনের প্রেরণা জাগাইয়া দিব ?
এ-উদ্দেশ্যসাধন সহজ ছিল না। কারণ :
সমাজেরই বা তখন কি ঘোর অন্ধবিশ্বাস! কি শোচনীয় দুরবস্থা! ইংরাজী ও সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালাও তখন কাফের ভাষা হইয়া গিয়াছে—সুতরাং উক্ত উভয় ভাষাই অস্পৃশ্য ও অব্যবহার্য্য। বাঙ্গালা ভাষায় কোরআন হাদিস বা ধর্ম্মগ্রন্থ লিখিলে সে স্পষ্ট ধর্ম্মদ্রোহী হইবে।… বাঙ্গালা ভাষায় হজরতের জীবনী বাহির করিতেও তখন আমার মাদ্রাসার মৌলবী সাহেব দিগের সার্টিফিকেট লইতে হইয়াছিল।…৩৯
এই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। সে-জয়ই তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সচেতনতাসৃষ্টিতে তাঁর সক্রিয় ভূমিকাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়।
যুগের তুলনায় তিনি অগ্রসর ছিলেন। হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতিতে যে-যুক্তিবাদী চিত্তের পরিচয় আছে, তাই তার প্রমাণ। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোস্তফা-চরিত প্রকাশের পূর্বে মুসলমান-রচিত হজরতের জীবনচরিত-রচনার যে-ধারা, তার মধ্যে আবদুর রহিমের রচনাটি এই যুক্তিবাদিতায় বিশিষ্ট। মিহির ও সুধাকরে নাটকাভিনয়ের সমালোচনা প্রকাশ করেও তিনি রক্ষণশীলদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।৪০ কেননা, তখন মুসলমান-সম্পাদিত পত্রিকায় নাটকাভিনয়ের সংবাদ প্রকাশ আপত্তিকর বিবেচিত হতো। কিন্তু যুগপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই প্রাগ্রসর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ পেয়েছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজে নবীন চিন্তাধারার যে-সূচনা হয় এ-শতাব্দীর গোড়ার দিকে, তার সঙ্গে তাঁর সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল না বলে মনে হয়। এই অনুমানের সপক্ষে একটি উদ্ধৃতি দিই :
১৯১৯ সালের ২৯শে নভেম্বর তারিখে [বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য] সমিতির সাধারণ সভার এক অধিবেশন হইয়াছিল।… আমাদের মনে পড়ে সভার সংবাদ প্রকাশ করিতে যাইয়া “মোসলেম হিতৈষী” পত্রিকায় ভুল বিবরণ দেওয়া হইয়াছিল। আবুল হোসায়েন সাহেব তাঁহার প্রবন্ধের কোনও জায়গায় এমন কোন কথা বলেন নাই যে “কোরআন” এর যে যে “আয়েতে” সুদ নিষিদ্ধ সেই “আয়েৎ” গুলির পরিবর্ত্তন হওয়া উচিত। এমন কথা কোন মুসলমান বলিতে পারেন না। তিনি বলিয়াছিলেন উক্ত আয়েৎ অবতীর্ণ হওয়ার সময় যে রকম সুদের প্রথা প্রচলিত ছিল তাহাতে অধমর্ণ সর্ব্বস্বান্ত হইয়া যাইত। অধমর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হইয়া উপকৃত হয় এইরূপ সুদ গ্রহণে আপত্তি করা উচিত নহে। “মোসলেম হিতৈষী” পত্রিকার সম্পাদক মুনশী আবদুর রহিম সাহেব সভায় উপস্থিত থাকিয়াও যে কিরূপে এমন ভুল বিবরণ ছাপিলেন তাহা আমাদের ধারণার অতীত।৪১
তবু সাংবাদিক ও গ্রন্থকাররূপে বাঙালি মুসলমান সমাজে তাঁর বিশিষ্ট আসন স্বীকৃত। কিছুকাল রোগভোগের পর ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই তারিখে স্বগ্রামে তাঁর মৃত্যু হলে The Mussalman পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়েছিল :
As editor of Mihir-O-Sudhakar and subsequently of Muslim Hitaishi he was rather the pioneer among Muslim journalists in Bengal, and his services to the cause of journalism towards the latter part of the last century will be ever remembered as something unique for that time.42
.৪২
আর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘one of the distinguished Muhammadan writers of Bengal’৪৩ বলে। এই মন্তব্যদুটিতে আবদুর রহিমের সত্য পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
টীকা
১. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (দ্বিতীয় সংস্করণ; ঢাকা, ১৯৬৪) পৃ ১২১-২২।
২. কবি আবদুল কাদিরের সৌজন্যে হজরত মহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির প্রথম তিন সংস্করণের বই দেখতে পেয়েছি। সেজন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্র ও উৎসর্গপত্রটি নেই। ভূমিকার শেষে স্বাক্ষর আছে— ‘শ্রীসেখ আব্দররহিম।’ ‘পরিবর্দ্ধিত ও পরিবর্ত্তিত’ দ্বিতীয় সংস্করণ ‘কলিকাতা ১১৫ নং অপার চিৎপুর রোড হইতে শ্রীগিরিশ চন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ।’ লেখকের নাম ‘শেখ আব্দর রহিম’ মুদ্রিত হয়েছে। উৎসর্গপত্রটি এরূপ : ‘যিনি এই দুর্দ্দিনে অধঃপতিত মুসলমান সমাজের/উন্নতিকল্পে অগাধ পরিশ্রম ও অজস্র অর্থব্যয়/করিতেছেন, সেই স্বজাতিবৎসল স্বধর্ম্মানু/রাগী, বিদ্যোৎসাহী ও সমাজগতপ্রাণ/অনারেবল/মিঃ গোলাম হোসেন কাসেম আরিফ/সাহেবের পবিত্র করকমলে ভক্তি/ও শ্রদ্ধার দীন চিহ্নস্বরূপ/এই গ্রন্থখানি উৎসর্গীত/হইল।/গ্রন্থকার।’ তৃতীয় সংস্করণের প্রকাশক—মোহাম্মদ মোবারক আলি, মখ্দুমী লাইব্রেরী, ২৭নং কলেজ স্ট্রীট, কলিকাতা; প্রকাশকাল ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ। লেখকের নাম লেখা হয়েছে ‘শেখ আবদুর রহিম’। উৎসর্গপত্রটি এরূপ : ‘বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষার উন্নতিকল্পে যাঁহার হস্ত মুক্ত/সমাজ ও স্বজাতিহিতৈষণা যাঁহার জীবনের লক্ষ্য/জলপাইগুড়ির সেই স্বনামধন্য দানশীল/বিদ্যোৎসাহী জমিদার ও চা-কর/খান বাহাদুর মৌলবী মশাররফ হোসেন/বি,এল সাহেবের/পবিত্র করকমলে/তদীয় অজ্ঞাতসারে/গ্রন্থকার কর্তৃক/ভক্তি, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ/এই গ্রন্থখানি/সাদরে উৎসর্গীকৃত হইল।’ ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘ষষ্ঠ সংস্করণ’ও মোখদুমী লাইব্রেরী-প্রকাশিত। এ-সংস্করণ উৎসর্গ করা হয় নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-গ্রন্থাগারে দ্বিতীয় সংস্করণের একটি বই আছে।
৩. রাজবিহারী দাস, ‘বঙ্গীয় সংবাদপত্র’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৩০৪, পৃ ১১৫; রামগতি ন্যায়রত্ন, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য-বিষয়ক প্রস্তাব (চতুর্থ সংস্করণ; চুঁচুড়া, ১৩৫১), পৃ ৩৪৭; যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার ও রাখালরাজ রায়, সাহিত্যপঞ্জিকা (কলিকাতা, ১৩২২), পৃ ১২৭।
৪. মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, পাক পাঞ্জতন (কলিকাতা, ১৩৩৬), ‘ভূমিকা’ পৃ তেরো-চোদ্দ।
৫. ডাঃ এ. টি. এম. মোয়াজ্জম, ‘সুধাকর’, মাহে নও, অক্টোবর ১৯৫৫।
৬. মোহাম্মদ ইদরিস আলী, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহ্মদ (ঢাকা, ১৩৬৫), পৃ ১৯-এ উদ্ধৃত।
৭. কাজী আবদুল মান্নান, আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা (রাজশাহী, ১৯৬১), পৃ ২১৪-১৮তে সম্পূর্ণ সম্পাদকীয় উদ্ধৃত।
৮. এ-সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : আবদুল কাদির, ‘মিহির’, মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র (ঢাকা, ১৯৬৬)। প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সংখ্যা মিহির বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্ গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে।
৯. আবদুল কাদির, ‘মিহির’, মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র (ঢাকা, ১৯৬৬)।
১০. ঐ।
১১. Bengal Library Catalogue of Books for the fourth quarter ending 31st December, 1892.
১২. সৈয়দ মোর্করম আলী, ‘প্রবীণ সাহিত্যিক মুনশী শেখ আবদুর রহিম’, মিনার, আষাঢ় ১৩৪৬।
১৩. রেয়াজুদ্দীন, পৃ ১।
১৪. সাহিত্যপঞ্জিকা, পৃ ৯২। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্গ্রন্থাগারে দ্বিতীয় সংখ্যা হাফেজ রক্ষিত আছে। এর প্রথম সংখ্যা দেখেছি জনাব আফজল-উল-হকের সৌজন্যে। বিস্তৃত আলোচনার জন্যে আবদুল কাদির, ‘হাফেজ’, মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র (ঢাকা, ১৯৬৬) দ্রষ্টব্য।
১৫. Bengal Library Catalogue of Books for the first quarter ending 31st March, 1908.
১৬. সাহিত্যপঞ্জিকা, পৃ ১০৬।
১৭. মোজাম্মেল হক, মাওলানা-পরিচয় (কলিকাতা, ১৩২১), পৃ ৩৪-৩৬।
১৮. Bengal Library Catalogue of Books for the second quarter ending 30th June, 1916;—for the third quarter ending 30th September 1916;—for the third quarter ending 30th September, 1917.
১৯. Bengal Library Catalogue of Books for the fourth quarter ending 31st December, 1888;—for the third quarter ending 30th September, 1889;—for the second quarter ending 30th June, 1889.
২০. মোহাম্মদ ইদরিস আলী, পৃ ৩৪।
২১. শেখ আবদুর রহিম গ্রন্থাবলী, প্রথম খণ্ড (ঢাকা, ১৯৬৫) পৃ ৪৯টী।
২২. ঐ, পৃ ৫৬টী।
২৩. ঐ, পৃ ৫৬টী।
২৪. ঐ, পৃ ৬০টী।
২৫. ঐ, পৃ ৬৭টী।
২৬. ঐ, পৃ ৬১টী।
২৭. ঐ, পৃ ১৫০-৫১টী।
২৮. ঐ, পৃ ৯৮-৯৯টী।
২৯. ঐ, পৃ ৫৯০টী।
৩০. ঐ, পৃ ৪৫৫-৫৬; পৃ. ৪৯১-৫১০।
৩১. ঐ, পৃ ৫৫০-৭০ এবং অন্যত্র।
৩২. ঐ, পৃ ৪৬১ এবং পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ।
৩৩. ঐ, পৃ ৬১১।
৩৪. ঐ, পৃ ১০২-১১৮।
৩৫. প্রথম সংস্করণ, পৃ ৫০-৫১; দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ৭৮।
৩৬. প্রথম সংস্করণ, পৃ ৪৬; দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ৭০।
৩৭. মমতাজুর রহমান তরফদার, ‘শেখ আবদুর রহীম-রচিত হজরত আবুবকর’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৭০।
৩৮. এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য : আনিসুজ্জামান, ‘প্রণয়-যাত্রী’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭০। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের একটি কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-গ্রন্থাগারে আছে। মোল্লা এনামুল হক ও মোল্লা আতাউল হককে এ-গ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়।
৩৯. শেখ আবদুর রহিম, ‘বঙ্গভাষা ও মোসলমান সমাজ’, মোহাম্মদী, আশ্বিন, ১৩৩৬।
৪০. ‘মিহির ও সুধাকরের রুচিবিকার’, ইসলাম প্রচারক, মার্চ্চ-এপ্রিল ১৯০০।
৪১. ‘সমিতি সংবাদ’, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মাঘ ১৩২৬।
৪২. The Mussalman, July 18, 1931.
৪৩. হজরত মহম্মদের (দঃ) জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতির তৃতীয় ও ‘ষষ্ঠ’ সংস্করণের মুদ্রিত প্রশংসাপত্র।
১৯৬৭; পরিবর্তন ২০১৬