প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

শেকসপিয়রের কলকাতা

শেকসপিয়রের কলকাতা

কলকাতার সমস্ত বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ বিদায় করাই ভালো। কী দরকার ওই বিচ্ছিরি ক্যাটক্যাটে ঝাঁঝাল আলোর! সরকারি বিদ্যুৎহীন ব্যবস্থায় এই প্রথম ধরা পড়ল অন্ধকার কলকাতা কত সুন্দর! অন্ধকারের অদ্ভুত ক্ষমতা বৈষম্য ঘোচানোর। নতুন বাড়ি, পুরোনো বাড়ি, পলেস্তারা-চটা নোনাধরা বাড়ি, অন্ধকারে একাকার, গায়ে-গায়ে লাগা শিল্যুয়েট। কোনও বাড়ির জানালা গলে বৈদ্যুতিক আলো বাইরে অসভ্যের মতো ছেতরে পড়ছে না। কাঁপা-কাঁপা মোলায়েম মৃদু আলো। জানালায় একটি ছায়ামূর্তি। রূপের বিচার, বয়সের বিচার নেই। কী ভীষণ রোমান্টিক সারা শহরটাই যেন রোমিও জুলেয়েট নাটকের স্টেজ। বহুকাল পার করে এসে রোমিও দাঁড়িয়েছে কোদলান ফুটপাথে। লতাবিতান নেই, ফিটন নেই, গ্যাসের মিটিমিটি বাতি নেই। পিয়ানোর সুর বাতাসে ভাসছে না। গাউনের লেস পাশ দিয়ে খসখস করে মৃত প্রেমিকের কবরের দিকে ক্রশ হাতে এগিয়ে যাচ্ছে না। তবু মনটা তো এখনও মরে যায়নি। তার এগোবার পেছোবার ক্ষমতা আছে। এই অন্ধকার ছায়া-ছায়া কলকাতা ছ’শো বছর আগের সেই রাতকে কত সহজে ফিরিয়ে এনেছে! ছিদাম মুদি লেন নয়, এ তো সেই ক্যাপুলেটর বাগিচা। গর্তে পড়ে পা মচকেছে। রোমিওর গা হাত পা ছড়ে গিয়েছিল লতা ধরে পাঁচিল টপকাতে গিয়ে। তখন :

He jests a scars, that never felt a wound.

জানালায় জুলিয়েটের ছায়া

What light through yonder window breaks?

It is the east, and Juliet is the Sun!

Arise, fair sun, and kill the envious moon.

Who is already sick and pale with grief.

‘অ্যা মা মুখে আগুন! রাস্তার মাঝখানে এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মড়া কী বিড়বিড় করছে দ্যাখো।’

‘সঅরি দিদিমা, আমি রোমিও।’

‘সেটা আবার কে বটেক! আমি তো ভেবেছিলাম গরু। তা গুঁতোল না যখন তখন ভাবলুম মানুষ। একটু একপাশে সরে দাঁড়াও বাছা। হোমিও বলে কি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াবে! ধাক্কা মেরে কি পয়সা বাড়ানো যায় বাছা।’

জুলিয়েটও সে রাতে রোমিওকে বলেছিল,

What man art thou. that thus be screened in night so stumblest on my counsel.

‘দিদিমা তুমিও এক সময় জুলিয়েট ছিলে। এখন বুড়ি হয়ে গেছ।’

‘হ্যাঁ বাছা, হোমিও করেই দ্যাখো, সারে কি না! পেটের রোগ আর মাথার ব্যামো এখন খুব হচ্ছে ঘরে ঘরে। আর হবে না, যা সব মা হয়েছে এখনকার? বিয়োলেই মা। না চেনে কালমেঘ, না চেনে গাঁদাল।’

She speaks /o speaks again.

‘কী করে তুমি এলে এই অন্ধকারে। টর্চ কিনেছ! না আজও ভুলেছ।’

‘চুপ। নো টর্চ। রোমিও জুলিয়েট নাইট।

With Love’s light wings did I o’er perch these walls;

For stony limits cannot hold love out.’

‘লাভ ফাভ ছাড়ো। ঘরমুখো গরু গোয়ালে আসবেই। বাপের বাড়িতে দেখেছি তো, মঙ্গলা গাই সন্ধের সময় কোত্থেকে ঠিক ফিরে আসত। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকত—হাম্বা।’

‘সে তো গাই! এ হল ষাঁড়, ষণ্ড ফিরে আসে লাভের টানে। লভ লভ। Love goes toward love, as school boys from their books. হেহে বুঝলে জুলিয়েট। জুলিই আই লাভ ইউ।’

‘এই নাও টিন, কেরোসিন তেল লে আও।’

‘হেডমাস্টার মশাইকা সার্টিফিকেট মাংগনা লাও।’

‘সে গুড়ে বালি মাই ডিয়ার। ছেলে হবে, বড় হবে, স্কুলে যাবে, হেডমাস্টারমশাই সার্টিফিকেট দেবেন তবে দু’লিটার কেরোসিন। টিনটা রং করে তুলে রাখি, মরচে না ধরে যায়।’

মোমবাতির আলোয় আমার তিনশো টাকা ভাড়ার খুপরিটি সহসা তাজ হোটেলের রম্যকক্ষে পরিণত হল। পায়ের তলায় নরম নরম গালচে নেই। পরোয়া নেহি কুছ। হাতে বাতি, মনে কল্পনা, কে আমাকে আটকাবে। ঝাড়লন্ঠনের বেলোয়ারি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ, নইলে বাতাসে বাতি হার্টফেল করবে। কলকাতা তার শব্দ, ধুলো, ধোঁয়া, সরীসৃপ শরীর নিয়ে যেন বহু দূর চলে গেছে।

—তুমি আমার ‘হেজেল আয়েড’ ইরানি প্রেমিকা। সিঁড়ির শেষ ধাপে ঘাগরা পরে দাঁড়িয়ে আছ। আমি খৈয়াম লটরপটর করতে-করতে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এগিয়ে চলেছি।

—আরে মেঝেতে মোম পড়ছে যে, মোজাইক নষ্ট হয়ে যাবে। ইউ ইনডিসেন্ট, কেয়ারলেস ইনডোলেন্ট হাজব্যান্ড।

—খবরদার! এই ঘোরান্ধকারা অমানিশায় সামান্য মোজাইকের মেঝের জন্যে তোমার ওই আর্ত চিৎকার! তুমি না মৈত্রেয়ী, গার্গীর দেশের মহিলা। বেদ-বেদান্ত পড়ো, পড়ে দ্যাখো, জীবনের সব কিছু অতি ক্ষণস্থায়ী। শাশ্বত হল আত্মা। জ্যোর্তিময় সেই লিঙ্গশরীর আমার হাতে কাঁপছে। আমি পশ্চিম বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, নির্মলেন্দুবাবুর মতো গলা কাঁপিয়ে-কাঁপিয়ে বলি : বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘোর ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা, কে তাকে দেখাবে আলো, তুমি ইরানিবালা, তুচ্ছ মোজাইক, হাহা। গেল গেল। যা: নিভে গেল। কৃতদাসী লেআও দিয়াশলাই, সিঁড়ির শেষ ধাপকটা এখনও উঠতে বাকি।

—কী বললে, কৃতদাসী? ইরানিবালা অবদি সহ্য করেছি। বাসনউলিদের দেখেছি তো মন্দ না, বেড়ে লচকে আছে। হু ইজ ইওর কৃতদাসী?

—সুন্দরী! ভুল কোরো না, আমরা এখন যুগ থেকে যুগান্তরে চলে গেছি। সিপাহী বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ, আকবরের সিংহাসনে আরোহণ, বিসমার্ক, ডিজরেলি, গোলাপের যুদ্ধ, ত্রুসেড, তখন তো অ্যারিস্টোক্র্যাটদের দাসদাসীই ছিল, হারেম ছিল, বুক-সেলফে টমকাকার কুটীর আছে পড়ে দ্যাখো কল্য দিবসে। আমার মনের সঙ্গে, কল্পনার সঙ্গে তোমার চেহারা ঘনঘন পালটাবে। কখনও জুলিয়েট, কখনও ইডিয়েট, কখনও ইরানিবালা, কখনও শকুন্তলা, আমি কী করব। চাবুক-ফাবুকও চালিয়ে দিতে পারি। কথায় বলে—যুগ পালটাচ্ছে, বলে না?

—যুগ পালটাচ্ছে মানে? ১৯৭৯ সাল। কত বছর অন্তর যুগ পালটায় শুনি?

—এক-এ পক্ষ, দুই-এ নেত্র—

—হয়েচে, হয়েচে আর চেষ্টা কোরো না, প্রথমেই ভুল। এক-এ চন্দ্র, ওতে যুগ নেই, দিক-এ গিয়ে শেষ হয়েছে, দশ-এ দিক। বারো বছরে এক যুগ হয়। তার মধ্যে যুগ পালটায় না।

—পালটাতে জানলেই পালটায়। পালটে যাওয়ার তো একটা গতি আছে। আমরা ড্রাইভারকে বলি—ওহে স্পিড বাড়াও, বলি না? সেই রকম স্পিডি চেঞ্জ। আমি এখন আরব দেশ থেকে ঘোড়া আনাব, লন্ডন থেকে বর্ম আনাব, স্পেন থেকে সোর্ড আনাব, ভারত থেকে দাসদাসী আনাব।

—সে আবার কী?

তুমি তো ভারতীয়, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যের কলকাতা শহরের একটি ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে আছ।

—হিহি, কলকাতা আবার শহর!

ঠিক হ্যায়! তাহলে আমি ভারতীয় ভাস্কো ডা গামা, ঠিকই তো, কবি বলেছিলেন, ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। আমি সেই কলোনিয়ালিস্ট, সেই মহাবীর, মহামতি আলেকসান্ডার। ওঁরা এসেছিলেন নীচের দিকে, আমি ঠেলে উঠব ওপরে, তুরস্ক-ফুরস্ক ভেদ করে সোজা সাদা চামড়ার দেশে। দ্যাখো, দ্যাখো, আয়া হুঁউউ ব্ল্যাক জাপান। তলোয়ার খুলে লড়ে যাব—লাইক বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার, ক্লার্ক গ্যাবল, গ্যারি কুপার। আমার প্যালেসে রাখব সাদা কৃতদাসী, তুমি হবে হেড দাসী। নাও ব্যবস্থা করে দিলুম। এবার খুশি তো! এইবার :

হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা

আমি চোখে যে ভালো দেখি না।।

কংক্রিট প্রকোষ্ঠে বাতি জ্বলছে কেঁপে কেঁপে। এতকাল আলো দেখেছি ওপর থেকে, সিলিং থেকে নীচে নামছে। এখন দেখছি নীচ থেকে ওপরে উঠছে। বাস্তব থেকে উঠে কল্পনার রাজত্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আহা তাই বোধহয় এত ভালো লাগছে! মাথার ওপর স্তব্ধ শ্বেত পাখা। অপ্সরার মতো ভাসছে। কল্পনায় ঘুরছে। বাস্তবের নোংরা ঘরের মেঝের চেয়ে ঈষৎ নীলাভ, ঘরের ভেতরের ছাদটি অনেক বেশি পবিত্র। এইভাবেই আমাদের মন যেন ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। আরোহণ, আরোহণ, অমৃতস্য পুত্রা:!

শৈশব ফিরে এসেছে যেন! ছায়া নিয়ে খেলা করি। ওহে শুনছ, ও মিনুর মা, শোভা, শোভা তোমার সঙ্গ আর আমি থোড়াই কেয়ার করি! আমার নিজের ছায়াই আমার সঙ্গী। ইচ্ছেমতো দেওয়ালের গায়ে নিজের ছায়াকে বাতির আলোয় বড় করি, ছোট করি। ছোট হতে-হতে যেন শিশুটি কচি খোকাটি! এইবার হামা দিলেই হয় মা মা করে। এইবার বড় করি, ক্রমশ বড় হচ্ছি, কিশোর, যুবক, বিশাল বড়, সব শিশুদের পিতা, ঘরের ছাদ ভেঙে, মচকে লতানে পিতার মতো লতিয়ে লতপত করছি। বা: বেশ মজা তো! বৈদ্যুতিক আলো কাজকর্মের আলো—খেটে-খাওয়া প্রাোলেটারিয়াটদের আলো, বাতির আলো—রোমান্টিকদের আলো, খেলু-খেলু করার আলো। ও আলো চাই না মাগো, আমায় মোমের আলো দে জননী/ ঘরে ফিরে একা-একা খেলা করি ছায়া নিয়ে।।

(সুর—রামপ্রসাদী। তাল—সুর ফাঁক তাল)

কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে ঘরের পরিবেশ। অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে, খাটের তলায়, ঘরের কোণে কোণে, টেবিরে তলায়। এসো চোর চোর খেলি। অনেকদিন খেলা হয়নি। বয়েস হয়েছে তো কী হয়েছে। মনের আবার বয়েস আছে না কি! তুমি ও ঘরে খাটের তলায় ঢুকে টু উ কি বলো। আমি খুঁজতে বেরোই।

আচ্ছা, বেশ একটা গা-ছমছম-করা ভূতের গল্প বলো। ভূত প্রেত ব্রহ্মদৈত্য ডাইনি সব ফিরিয়ে আনো একে-একে। ইলেকট্রিকের ভয়ে ওরা এতদিন দূরে দূরে ছিল। এখন আর ফিরে আসতে বাধা কী! কী হল, পা তুলে বসলে কেন? কী হল, পিঠে হাত দিচ্ছ কেন? ভালোই করেছ ভালোই করেছ। খাটের তলা হল চোর আর পরকীয়া- প্রেমীদের বড় প্রিয় স্থান। ভূত সাধারণত পিঠ বেয়েই উঠতে ভালোবাসে। ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা ঠান্ডা নিশ্বাস ফেলে। ওঁরা জেনারেটার, টারবাইন ইমপোর্ট করছেন, করুন। আমি হারুন অল রশিদের দেশ থেকে কিছু ভূত আমদানি করি। যখন শুয়ে থাকব গোটাকতক ভূত যদি সারা শরীরে ঠান্ডা নিশ্বাস ফেলতে থাকে রুমকুলারের কাজ হবে। তুমি তো ইউসলেস, হাতপাখাটাকেও টানতে পারো না, পেতনি আনাব না। তোমার সঙ্গে লাঠালাঠি বেধে যাবে। তেমন সার্ভিস দিতে পারবে না। আনাতে হলে রেনেসাঁস যুগের ভূতই আনাব। হাল আমলের ভূতেরাও ফাঁকিবাজ হবে। দেখি কাল সকালে আলমারি থেকে ঝেড়েঝুড়ে নামাই, এডগার অ্যালেন পো। হিচকক, কিরোর ভূতের গল্পের সংকলন। পড়তে পড়তেই তাঁরা এসে যাবেন, এসে দাঁড়ালেই চুল খাড়া, শরীর হিম, অন্ধকারে বসে কিংবা শুয়ে কাঁপতে থাকব, ভূভূভূউউ। পাখা ফিট করে কী হবে? ভূত ফিট করি।

শুনেছি পাগলদেরও শীত গ্রীষ্ম বোধ খুব কম। নেই-ই। আধপাগলা হয়ে আছি, কোনওরকমে ফুল ম্যাড যদি হতে পারতুম। ওই রেকর্ডটা একবার বাজাও তো : আমায় দে মা পাগল করে, ব্রহ্মময়ী দে মা পাগল করে। বাজানো যাবে না! কেন? ও ইলেকট্রিক! দেখি কাল চোরাবাজার থেকে দম দেওয়া, চোঙওয়ালা একটা গ্রামোফোন কিনতে পারি কিনা!

চলো, ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে তারা চেনাই। এমন আকাশ আগে কখন দেখছ! আহা, তারার খই ফুটছে। এতকাল নীচের আলোয়, নীচ আলোয় ওপরের আলো চাপা ছিল। শহরের আলোকে ফিনিশ করতেই—দ্যাখো-দ্যাখো রাতের আলো, তারার আলো, চাঁদের আলো কেমন খুলেছে। ওই দ্যাখো—ডিউক অব ওয়েলিংটন সেনেট থেকে প্যালেসে ফিরে আসছেন। কাকে কি বলছ? ও তো, আমাদের বিধু। ভ্যাট, দিনের বিধু রাতের মঞ্চে ঐতিহাসিক ব্যাপার। ওই দ্যাখ, প্রিন্স অব ভেরোনা আসছেন। ও তো আমাদের বিশু ঠাকুরপোর বড় ছেলে। চুল রেখেছে লম্বা লম্বা। ফাঁদাল ট্রাউজার পরে।

ও তোমার কম্ম নয়। প্রেসারের রুগির পক্ষে কিংবা স্নায়বিক দুর্বলতা থাকলে মোমবাতি বসাবার চেষ্টা না করাই ভালো। একটা বাতির দাম আশি পয়সা। দিলে তো মাজাটা ভেঙে! আর একটু হলেই টেবিল ক্লথে আগুন ধরে যেত। বাতির জন্যে চাই, স্ট্রেট আর স্ট্রং নার্ভ। চাই ধৈর্য। কোথায় সেই ধৈর্যশীলা মহিলা! প্রথমে পলতেটিতে আগুন ধরাও। প্রথমে দাউদাউ করে জ্বলেই নিবুনিবু হয়ে আসবে। উত্তেজিত হবে না। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করো। বলো, নিববি না, নিববি না। বাতিটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, ম্যানুপুলেট করে করে শিখাটিকে পণ্ডিত মশাইয়ের শিখার মতো করে তোলো। একে বলে, ম্যানুপুলেটিং অ্যান আপ-টু-ডেট ক্যান্ডেল। যুগটাই হল ম্যানিপুলেশানের।

এরপরই হল পুডলিং। বাতিটাকে যেখানে, যার ওপর বসাতে চাও, তার ওপর কাত করে ধরো। প্রথমে গলতেই চাইবে না। এক ফোঁটা দু-ফোঁটা। এই সময় নিজের মোমের ধাক্কায় নিজেই নিবে যেতে পারে। নিবলেও বিরক্ত হবে না। ধৈর্যের অপর নাম মোমবাতি! দু-তিন ফোঁটা গলে পড়ার পর সেই দুর্বল ভিতের ওপর বসাতে চেষ্টা করবে না। মোমবাতি আর মনুমেন্ট একই রকম দেখতে। বেশ জোরদার ফাউন্ডেশান চাই। এ যুগের বাতির সে যুগের বাতির মতো রস নেই, স্নেহ নেই, আলো নেই। এ বাতি, সে বাতি নয়। যে বাতিতে ম্যাকবেথ লেখা হয়েছিল। চোখ সরাও, এখনকার বাতি মাঝেমধ্যে ধমকে ওঠে। স্পিটিং লামার নাম শুনেছ! একরকমের জন্তু! ছিড়িক করে থুতু ছিটকে মানুষকে কানা করে দেয়। অতএব ফোঁটা দুয়েক কি তিনেক ভিতের ওপর বসিও না। প্রথমে বসবে তারপর তিনি শুয়ে পড়বেন কাত হয়ে। ফোঁটা ফেলতে থাকো, ফেলতে থাকো। দীক্ষা হয়েছে? মন্তর নিয়েছ? বেশ, এই ফাঁকে জপ করে যাও—অউম, অউম। যেই দেখবে বেশ পাঁক-পাঁক মোম-পুকুর তৈরি হয়েছে—কোয়গমায়ার, তখন থার্ড অপারেশন। অপারেশন স্ট্যাবিং। স্রেফ বসিয়ে দাও। পাকা খুনি বুকে যেভাবে ছোরা বসায় সেইভাবে বিগলিত মোমগর্ভে মোম কাণ্ডটিকে অকম্পিত হস্তে প্রাোথিত করো। বিড়ি খাও না সিগারেট ফোঁকো না, অন্য কোনও নেশা নেই তবু তোমার হাত কাঁপছে কেন? এ কি তোমার দিদিমার দাঁত পেয়েছ। নড়বে তবু পড়বে না। নির্ভীকভাবে বসিয়ে দাও। হাত সরিয়ে নাও। দ্যাখো কেমন দাঁড়িয়েছে। না প্লাম্বলাইন ফেলার দরকার নেই, একেবারে খাড়া বসেছে কিনা দ্যাখো। তালগাছের মতো হেলে থাকলে তোমার অর্থনীতিও হেলে পড়বে। নিমেষে গলে ফাঁক। এ তোমার পিসার লিনিং টাওয়ার নয়।

পরের বার তোমাকে হ্যারিকেন সম্পর্কে জ্ঞান দেব। ভবিষ্যৎ যেমন জানতে হয়, অতীত তেমনি শিখতে হয়। অ্যানসেন্ট সব ব্যাপার স্যাপার, ইতিহাস পড়ে জানতে হয়। বলো না তোমার ইলেকট্রিসিয়ানকে, সাবেক আমলের একটা গ্যাসের বাতি ফিট করতে। ফেল করবেন। স্টেট বাসের ড্রাইভার পারবেন গরুর গাড়ি চালাতে! অথচ আমরা হড়কে-হড়কে সেই গুড ওল্ড ডেজের দিকে নেমে চলেছি। তোমার নাম রেবা, পালটে পৌরাণিক করে দিলুম—বেহুলা। আমার নাম অরিজিৎ কি ওরিসুল নয়—লখিন্দর। এসো লোহার বাসর ঘরে সুখনিদ্রায় শয়ন করি। লোহার বাসরই তো। হাওয়া নেই, আলো নেই, তার ওপর মশারি। পাখাটা ঝুলছে দ্যাখো, যেন ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি। এসো ঘামতে-ঘামতে ঘুমোই।

কাত্যায়ন এ কী দু:স্বপ্ন? কে যেন আমার বুকে চেপে বসেছে। কে, কে। মহারাজ আপনার বুকে বসেছে অ্যাডমিনিসট্রেশান। ব্রঙ্কাইটিসের মতো দুরারোগ্য। এ কী আমার গলায় কে কলার বেল্ট বেঁধেছে। আমি কি কুকুর! হিজ ম্যাজেস্টি, কুকুর বড় বিশ্বাসী প্রভুভক্ত জীব। তবু ওটা কলার বেল্ট নয়, শয্যাসঙ্গিনীর গোদা হাত।

মশারি ফসারি ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছি। ঘুম নেই, ঘুম নাহি আঁখি পাতে। এ কী নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! নিথর প্রকৃতি!

Macbeth does murder sleep, the innocent sleep, sleep that knits up the ravelled sleave of care.

থামলে কেন?

ও তুমিও উঠে পড়েছ?

উঠব কি? জেগেই তো পড়ে আছি। ঘুমোয় কার পিতার সাধ্য! ওটাও বলো, Out damned spot! Out I say! one…two :

কীসের স্পট। আমি তো খুন করিনি?

নাই বা করলে! ভোট তো দিয়েছিলে? আঙুলের সেই কালির ফোঁটাটা…ড্যামড স্পট আউট আই সে।

নেমে এসো। ওটা তোমার ডায়ালগ লেডি ম্যাকবেথ। ওই দ্যাখো, কী অদ্ভুত শেকসপিয়রের কলকাতা, অন্ধকার ধোঁয়া ধোঁয়া—আই প্লে দি রোমান ফুল অ্যান্ড ডাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *