শৃণ্বন্তু বিশ্বে— একমেবাদ্বিতীয়ম্

শৃণ্বন্তু বিশ্বে— একমেবাদ্বিতীয়ম্

এ-যুগের স্যার গালাহাডের কথা বলতে গিয়ে অন্য যুগের গালাহাডের গল্পটা বোধহয় আগে বলা উচিত। এ-যুগের গালাহাডের সঙ্গে পৌরাণিক গালাহাডের মিল অনেক জায়গায়। একজন ছিলেন ব্রিটেনের রাজা আর্থারের যোদ্ধা। অন্যজন বিজ্ঞানের যোদ্ধা। গালাহাডের সন্ধান তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনেক দূরের দেশে। অন্যজনের সন্ধানও তাঁকে নিয়ে এল বিদেশে। একজনের চোখে ছিল পৌরাণিক বীরত্বের আলো। অন্য মানুষটির চোখে এ-যুগের প্রজ্ঞার উদ্ভাস। দু’জনেই খুঁজেছিলেন ‘হোলি গ্রেল’, পবিত্র পাত্র। একজনের সন্ধান যিশুর ‘হোলি গ্রেল’। অন্যজনের ‘বিজ্ঞানের হোলি গ্রেল’।

‘হোলি গ্রেল’ খুঁজতে খুঁজতে পৌরাণিক গালাহাড পৌঁছেছিলেন এক অসুস্থ রাজার রাজত্বে। গালাহাড রাজার কাছে জানতে চাইলেন, কোন অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, কোন অসুখ কষ্ট দিচ্ছে তাঁর রাজত্বকে?

সেই মুহূর্তে সেটাই ছিল সঠিক প্রশ্ন। সঠিক প্রশ্নটির সঙ্গে সঙ্গে গালাহাডের মানসচক্ষে ভেসে উঠল পবিত্র গ্রেলের ছবি। ঠিক এইভাবেই সঠিক প্রশ্নটি করেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন— কীভাবে চলছে এই মহাবিশ্ব? এই সঠিক প্রশ্নটি করার ফলেই যেন আইনস্টাইনের চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল মহাবিশ্বের বিস্ময়কর সৌন্দর্য আর সুচারুতার ছবি।

আমি আইনস্টাইনের কথা যত ভাবি ততই বিস্মিত ও মুগ্ধ হই। কারণ, তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যাঁর ব্যাখ্যার আলোয় মহাবিশ্ব যেন ফুলের মতো ফুটে উঠল, আমরা বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তাকালাম মহাবিশ্বের বিশুদ্ধ সৌন্দর্য আর সুচারুতার দিকে। আইনস্টাইন তাঁর ব্যাখ্যায় খুঁজেছিলেন সমস্ত ফিল্ডের একীকরণ। এই সন্ধান ক্রমশ যেন গ্রাস করে ফেলেছিল তাঁর সমগ্র কল্পনাকে। আইনস্টাইন তাঁর গহন মনন, গভীর উপলব্ধির মধ্যে এমন এক মহাবিশ্বকে নিরীক্ষণ করলেন যে মহাবিশ্বে সমস্ত ক্ষেত্রই আসলে এক। শুধু আপাতভাবেই ক্ষেত্রগুলি পৃথক। তা হলে তো সবক’টি ক্ষেত্রের একটি সাধারণ উৎস থাকা চাই। এমন একটি ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরিও থাকা উচিত যা ক্ষেত্রগুলি একসূত্রে বাঁধবে। আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন এমন এক মহাবিশ্বে যাকে সহজে বোঝা যাবে যার সুপরিকল্পিত সুচারু সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। জীবনের শেষ তিরিশটি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন এমনই এক মহাবিশ্বের অনুসন্ধানে। কিন্তু এই স্বপ্নবিশ্বের নাগাল পাওয়ার আগেই শেষ হল তাঁর জীবন। সম্প্রতি তাঁরই কল্পবিশ্ব বাস্তব হয়ে উন্মীলিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে।

কী করে তা সম্ভব হল? সম্ভব হল একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে করতে। সেই প্রশ্নটি খুবই সহজ— যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই তৈরি সেই জিনিস দিয়ে যার নাম এনার্জি, তা হলে প্রকৃতি কেন তৈরি করল এত বিচিত্র ক্ষেত্র যেখানে এনার্জি দেখাতে পারে তার জাদুলীলা? এ তো অহেতুক বাহুল্য। কী প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানী এখন বিশ্বাস করেন। যাদের আপাতত মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র, তারা কিন্তু একই ক্ষেত্রের বহুরূপ। যেসব ফিল্ডের কথা আইনস্টাইন ভাবেননি এবং এখন বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, তারাও একই ফিল্ডের ভিন্ন ভিন্ন বর্হিপ্রকাশ।

বাস্তবের এই স্তরে যা ঘটছে তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পেতে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে অভিকর্ষ ও তড়িৎচুম্বকত্বের অস্তিত্বে। তবে সাব-অ্যাটমিক স্তরে এমন কিছু ক্ষেত্রের কাজ প্রমাণিত সত্য যা আমাদের পরিচিত ক্ষেত্রগুলির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তাদের গুরুত্বও ধরতে হবে। ভাবা যাক প্রতিটি অ্যাটমের নিউক্লিয়াস বা পরমাণু। প্রথমেই যে-প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবে উঠবেই তা হল, ওদের পজ়িটিভলি চার্জড প্রোটনগুলি কেন্দ্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে না কেন? কী বা কোন বলতাদের ধরে রেখেছে? অবশ্য হাইড্রোজেন পরমাণুর বেলায় ওটা কোনও সমস্যা নয়। কারণ হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত একটি ধনাত্মক প্রোটন আর বাইরে একটি ঋণাত্মক ইলেকট্রন। কিন্তু হিলিয়ামের মতো একটি মৌলিক গ্যাস পেতে অবশ্যই প্রয়োজন দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গলন ও মিলন। সঙ্গে চাই দুটি নিউট্রনকেও। প্রশ্ন হল, দুটি ধনাত্মক প্রোটন বসে আছে পাশাপাশি। তারা তো স্বাভাবিকভাবে পরস্পরকে ঘৃণাই করবে। কারণ তারা দু’জনেই ধনাত্মক। অথচ তারা ছিটকে যাচ্ছে না পরস্পরের কাছ থেকে। কেন তারা পরস্পরের সঙ্গে এমন নিবিড় বন্ধুত্বে মজে আছে? তার কারণ নিউক্লিয়ার ফোর্স বা কেন্দ্রিক বল ধরে রেখেছে নিউক্লিয়াসগুলিকে এবং তাদের উপাদান-কোয়ার্কগুলিকেও। কত জোর নিউক্লিয়ার ফোর্সের? যে-মহাকর্ষ বল চাঁদকে ঘোরাচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে তার চেয়ে অকল্পনীয় বেশি এই নিউক্লিয়ার ফোর্সের ক্ষমতা।

এ ছাড়াও কাজ করছে আরও একটি বল— উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স বা দুর্বল কেন্দ্রিক বল। খুবই সীমিত এই দুর্বল ফোর্সের আধিপত্য। একটি প্রোটনকে এক হাজার ভাগে ভাগ করলে যতটুকু পাওয়া যায়, তারই মধ্যে সীমিত উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের প্রভাব। এই দুর্বল ফোর্স কোন কাজে লাগে? কিছু নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঘটছে তেজষ্ক্রিয় ক্ষয়। এই ক্ষীণ ফোর্স সেই ক্ষয়ের মাত্রা ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে। এবার একটা দরকারি খবর দিই। সূর্যের মধ্যে ক্রমাগত কেন্দ্রিক মহাবল হাইড্রোজেন থেকে তৈরি করছে হিলিয়াম। সূর্যই পৃথিবীতে প্রাণের উৎস। ক্ষীণ নিউক্লিয়ার ফোর্সের একটা খুব বড় কাজ সূর্যের মধ্যে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করছে যে মহাবল তাকে সাহায্য করা। ঠিক কত ক্ষমতাবান এই দুর্বল ফোর্স, একটি প্রোটনের হাজারভাগের একভাগে সীমিত হয়েও? এক কথায় এই দুর্বল ফোর্সটি মহাকর্ষের চেয়ে মিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়নের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান। যে-কথাটি এখানে না বললেই নয়, তা এই— ফোর্সের এই বৈষম্য, কম-বেশি, ক্ষীণ-সবল না থাকলে মহাবিশ্বে প্রাণের উৎপত্তি হত না। কেন হত না? একটা উদাহরণ দিই। গ্র্যাভিটির বল যদি অন্যান্য ফোর্সের তুলনায় প্রাত্যহিক পৃথিবীতে এতটাই দুর্বল না হত, তা হলে সেইসব পরমাণু যা দিয়ে তৈরি মানুষ কিংবা গ্রহ-নক্ষত্র, সব একে অন্যের ওপর উপুড় হয়ে পড়ত! আসলে এইসব ফোর্সের ক্ষেত্রে এতটুকু হেরফের হলে পৃথিবীতে মানুষের জন্মই হত না। এসব কথা জানতে জানতে মনে হয়, মহাবিশ্বের বুননের মধ্যে যেন সুপ্ত ছিল এই আনুষঙ্গিক সত্য যে মানুষ একদিন আসুক এই মহাবিশ্বে। সে একদিন তার গভীর উপলব্ধি থেকে, তার প্রসারিত চেতনা থেকে উত্তীর্ণ হোক এই মহাজাগতিক উচ্চারণে—

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥

অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে

নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥

এইবার সেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্যটি আপনাদের জানাবার সময় উপস্থিত। সেই তথ্য এবং সত্য হল, পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল ইলেকট্রিক এবং ম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ডকে এক করে দেখিয়েছিলেন। তার নাম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড। এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রায় একশো বছর পরে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি জানলেন যে, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক আর উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের উৎস হল এক। তার নাম দেওয়া হল ইলেকট্রোউইক ফোর্স। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের বহু বছরের কুণ্ঠা ভেঙে দিল। তাঁরা এখন বিশ্বাস করতে প্রস্তুত হলেন সমস্ত ক্ষেত্রের একই উৎস হওয়া সম্ভব! বলতে পারি, হাজার হাজার বছর আগে উপনিষদের ধ্যানলব্ধ ঘোষণা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’-এর বৈজ্ঞানিক সমর্থনের দরজা খুলে গেল। স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেল মহাসৃষ্টির আদি উৎস এক এবং অদ্বিতীয়! হঠাৎ যেন অন্ধকার দূর হল। হঠাৎ যেন আলো ফুটে উঠল সৃষ্টিরহস্যের আঁধার থেকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ এক অনির্বচনীয় সন্ধিক্ষণ। মানুষের সমস্ত মন-প্রাণ সেই আলোর দিকে তাকিয়ে যেন বলে উঠল—

ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়।

তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়, তোমারি হউক জয়॥

এখানে এই উদার অভ্যুদয়ের একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এতগুলি ফোর্সের ঐক্যসাধন করতে আমাদের কথা বলার প্রয়োজন প্রকৃতির মধ্যে যে সিমেট্রিগুলি আছে তাদের প্রসঙ্গে। সাধারণত আমরা ‘সিমেট্রি’ বা প্রতিসাম্য বলতে কী বুঝি? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক একটা বিরাট প্রাসাদে একই রকম অনেকগুলি স্তম্ভ। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলি, কী সুন্দর। কেন বলি— সিমেট্রির জন্যে। স্তম্ভগুলির পারস্পরিক সামঞ্জস্য আমরা তারিফ করি। এদের সামঞ্জস্যের ব্যাপারটা নির্ভর করছে এক লাইনে চমৎকার সারিবদ্ধতার ওপর। একটি স্তম্ভের জায়গায় যদি অন্য একটি স্তম্ভ বসানো যায়, তা হলে সেই বদল সারিবদ্ধতার সামঞ্জস্যে কোনও তফাত আনবে না। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে যখন সিমেট্রি বা সামঞ্জস্যের কথা বলি তখন কিন্তু শব্দটির সংজ্ঞা বদলে যায়। তখন আর বস্তুটির একই রকম থাকার কথা বলি না। প্রাকৃতিক সামঞ্জস্যের মানে হল, মৌলিক ফোর্স এবং মৌলকণা তাদের বিশেষ ‘চিহ্ন’গুলিকে ত্যাগ করে এমন ব্যবহার করে যে মনে হয়, একই প্রাকৃতিক নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা আছে তারা। সুতরাং প্রকৃতির সামঞ্জস্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ফোর্স এবং তাদের আলাদা আলাদা ফিল্ড। তা হলে ক্ষেত্রগুলিকে কী করে এক করা যাবে? যদি ভাঙা-সামঞ্জস্যকে এক করে আবার স্থাপন করা যায় তা হলেই তো ক্ষেত্রগুলিও এক হয়ে যাবে। ক্ষেত্রগুলির এককরণের চাবিকাঠিই খুলে দেয় সবকিছুর এক অদ্বিতীয় উৎসকে বোঝার রাস্তা। আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই গান— প্রথম আদি তব শক্তি— আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে।

ম্যাক্সওয়েল যে কাজ করেছিলেন বিদ্যুৎ এবং চুম্বকত্ব নিয়ে, সেই কাজ প্রায় একশো বছর পরে করলেন উইক এবং ইলেট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স নিয়ে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, আবদুল সালাম এবং শেলডন গ্লাশো। ওঁরা প্রমাণ করলেন অতি উঁচু তাপমাত্রায় বা সমতুল্য ছোট দূরত্বে (·০০০,০০০,০০০, ০০০, ০০০,১ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রোটনের থেকে ১০০০ গুণ ছোট!) ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এবং উইক ফোর্সের মধ্যে বিভেদরেখা মুছে যায়। তার কারণ ওই অতি উঁচু তাপমাত্রায় অথবা এই ছোট্ট পরিসরের মধ্যে প্রকৃতির কিছু ফাউন্ডেশনাল সিমেট্রি পুনঃস্থাপিত হয়। এর ফলে একই রকম আচরণ করছে উইক এবং ইলেট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স। নতুন পথ খুলে দিয়েছিল এই আবিষ্কার। তিন বিজ্ঞানীই পেয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ।

১৯৮৩ সাল। কার্লো রুবিয়া আর সাইমন ভ্যান ডার মির জেনেভা CERN-এ এক গবেষণাগোষ্ঠীর নেতৃত্বে গবেষণা করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করলেন ইলেকট্রোউইক এককরণের। দু’জনেই হলেন নোবেল বিজয়ী। এতদিন প্রবল কুণ্ঠা বা বাধা ছিল পদার্থবিজ্ঞানীদের মনে প্রকৃতির এককরণের বিরুদ্ধে। তাঁরা মনে করতেন এই ঘটনা অসম্ভব। যে-মুহূর্তে একতা আবিষ্কার হল প্রকৃতির বিচিত্র ফোর্সের মধ্যে, বিজ্ঞানীরা মুক্ত হলেন মানসিক বাধা থেকে। সেই সঙ্গে আমরাও আর এক পা বাড়ালাম মহাবিশ্বের একই উৎসের দিকে। এই পদক্ষেপকে বিজ্ঞানীরা বললেন, গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিয়োরি। সংক্ষিপ্ত নাম GUT। এই থিয়োরির মধ্যে সাধিত হয় ঐক্য তড়িৎচুম্বকীয় ফোর্সের সঙ্গে সবল নিউক্লিয়ার ফোর্স এবং দুর্বল ফোর্সের। কিন্তু সরাসরি প্রমাণ দেওয়া সম্ভব নয় এই গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশনের। তার কারণ, এই এককরণ ঘটে উইক ফোর্সকে যে ডাইমেনশনে ইলেট্রোম্যাগনেটিজ়ম যোগ দেয় তার ১-এর পিঠে ১৪টি শূন্য কম ডাইমেনশনে। তবে গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশনের এক প্রমাণ হতে পারে এই যে আমাদের এবং সব কিছুর অস্তিত্ব মহাবিশ্বে সম্ভব হয়েছে তার কারণ, সৃষ্টির আদি যুগে মহাবিশ্বে অ্যান্টিম্যাটারের তুলনায় ম্যাটার বা পদার্থ কিঞ্চিৎ বেশি ছিল। বিজ্ঞানী শাখারভের মতে, এটাই সম্ভব হত না যদি না গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশনের মতো কোনও ফিল্ডের এককরণ থাকত!

এই এককরণের একটা দৃঢ়বদ্ধ, অবিচলিত গাণিতিক সূত্র আবিষ্কার করার সন্ধান চলছে। কাজটা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। যদিও স্টিফেন হকিং, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, মুরে গেলমানের মতো বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করছেন, কাজটি সম্ভব হবেই। কিন্তু গণিত এখনও যে এককরণের সূত্রটি পুরো নাগালে পায়নি, তা পেয়েছিল উপনিষদের ধ্যান। বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে চতুর্থ ব্রাহ্মণে আছে এই উক্তি— ব্রহ্ম বৈ ইদম্ অগ্রে আসীৎ একম এব। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথমে এই জগৎ বর্তমান ছিল এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম রূপে।

ফোর্স-ফিল্ডগুলির এককরণে কেন বিজ্ঞানীরা এতটাই আশাবাদী? তাদের আশাবাদী হওয়ার কারণ, এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের কথা এই যে, বিভিন্ন ফোর্সফিল্ডের ক্রিয়ার ক্ষমতা পরস্পরের সমকক্ষ হয়ে যায় মহাশূন্যের বুননের কাছাকাছি এক ডাইমেনশনে। প্রকৃতির এই ডাইমেনশনকে ধরতে পেরেছিলেন ১৮৯৯ সালে বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক। তাই সেগুলির নাম প্লাঙ্ক’স ডাইমেনশনস। প্লাঙ্ক’স ডাইমেনশনস সম্পর্কে প্রথম কথাটাই আমাদের সজোরে ধাক্কা দেয়— প্লাঙ্কের দৈর্ঘ্য ততটাই ছোট যতটা বড় এই মহাবিশ্ব আমাদের তুলনায়। সত্যি কল্পনা করা যায় না কত ছোট। কী করে বিজ্ঞান পেল এই অতি ক্ষুদ্র ঠিকানার হদিশ?

খুব সাধারণ একটি ভাবনা দিয়ে শুরু করা যাক। যে-বাড়ির মধ্যে বা ঘরের মধ্যে বসে এই লেখাটা পড়ছেন সেই বাড়ি বা ঘর তৈরি কি সম্ভব হত দূরত্ব, ভর এবং সময়ের নির্ধারিত একক ছাড়া? তা হলে এত বিশাল যে একটা মহাবিশ্ব তৈরি হল তার জন্যেও নিশ্চয় প্রয়োজন হয়েছিল প্রকৃতিরও কিছু নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড বা মাপ। মাক্স প্লাঙ্ক প্রকৃতির সেই নির্ধারিত মাপটাই আবিষ্কার করলেন, যা কাজে লেগেছিল বিশ্বসৃষ্টিতে। এবং তিনি প্রকৃতির মধ্যে আবিষ্কার করলেন এমন কিছু মাপন-ইউনিট যা সারা বিশ্বজুড়ে একই রকম! সেই আবিষ্কারের জন্য ব্যবহার করলেন ভ্যাকুয়ামে আলোর গতি; নিউটনের গ্র্যাভিটেশনাল কন্সট্যান্ট এবং তাঁর নিজের প্লাঙ্ক’স কন্সট্যান্ট। প্লাঙ্ক’স কন্সট্যান্ট নির্ধারণ করে অনেক কিছুই। তার একটা হল, কোয়ান্টাম কণিকার পরিসর। Gravitational constant gives a measure of the strength of gravity. এই তিনটি natural constant কাজে লাগিয়ে প্লাঙ্ক আবিষ্কার করলেন প্রকৃতির নিজস্ব নির্ধারিত মাপ।

আমরা প্লাঙ্কের ডাইমেনশনস ব্যবহার করি গভীরতর সাব-অ্যাটমিক রাজত্বে। ব্যবহার করি কোঅর্ডিনেটস বা স্থানাঙ্ক হিসেবে। এবার কিন্তু আপনাদের স্তম্ভিত হতে হবে। প্লাঙ্ক কোন স্কেল বা মাপনমাত্রায় কাজ করেছেন জানেন? ভাবুন আমাদের শরীরের ছোট্ট একটি কোষকে। এবার সেই কোষের পাশে রাখুন মহাবিশ্বকে। এবার ওই কোষের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে সমস্ত মহাবিশ্বের দৈর্ঘ্যের তুলনা করুন। মহাবিশ্বের দৈর্ঘ্যের তুলনায় আমাদের কোষের দৈর্ঘ্য যতটা ছোট, প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য আমাদের এই কোষের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ততটাই ছোট! অকল্পনীয় এই ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য— যা প্লাঙ্কের আবিষ্কার। প্লাঙ্ক’স লেংথ বলতে বোঝায় এই অকল্পনীয় মাপ। প্লাঙ্কের দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য আমরা জানি না। ‘স্পেস’-এর ক্ষুদ্রতম আকার ওটাই, ওটাকেই বলে প্লাঙ্কের ইউনিট অফ লেংথ, মহাবিশ্বের দৈর্ঘ্যের একক।

আমাদের কোনও সরাসরি উপায় নেই প্লাঙ্কের ডাইমেনশনস-এ পৌঁছোবার। কারণ তার জন্যে দরকার এমন একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র যার আকার সৌরজগতের চেয়েও বৃহৎ হবে। এমন অণুবীক্ষণ যন্ত্র যেহেতু সম্ভব নয়, তাই বোঝার কাজ চলছে পরোক্ষভাবে। এ রকম পরোক্ষ এক প্রমাণ পাওয়া গেছে নিউট্রিনো অসিলেশন থেকে। তা ছাড়া আজকের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আমরা দেখতে পাই যে প্লাঙ্ক-ডাইমেনশনের কাছে সমস্ত ফোর্স-ফিল্ডের ইন্টারঅ্যাকশন সমান সমান। বুঝতে পারছেন তো, ক্রমশই আমরা চলে আসছি আমাদের লক্ষ্যের খুব কাছে— সে-লক্ষ্য হল মহাবিশ্বের আদি উৎস যে এক সেই সত্যকে খুঁজে পাওয়া।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী উইলচেকের একটি উদ্ধৃতি এখানে ব্যবহার না করে পারছি না—

‘মহাকর্ষ তার অনেক কম ক্ষমতা থেকে ক্রমশ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে থাকে এবং প্লাঙ্কের দৈর্ঘ্যের কাছে মহাকর্ষ হয়ে ওঠে অন্যান্য বলক্ষেত্রের সমকক্ষ। যদিও পুঙ্খানুপুঙ্খ থিয়োরি বা তত্ত্ব আজও প্রতিষ্ঠিত নয় তবু স্পষ্ট সংকেত আমরা পেয়েছি যে সমস্ত বলক্ষেত্র উৎসারিত একই উৎস হতে।’ প্লাঙ্কের মাত্রার কাছাকাছি সবল বলক্ষেত্রকে আর মনে হয় না ইলেকট্রোউইক ফোর্স বা গ্র্যাভিটির থেকে আরও বেশি ক্ষমতাবান। মনে হয় সমস্ত বলক্ষেত্রই যেন একই ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক।

আমরা এনার্জিকে এতগুলি ফর্ম বা আকারে ভাগ করি কেন? যেমন, মেকানিকাল, কেমিকাল, ইলেকট্রিকাল, হিট এনার্জি, লাইট এনার্জি— এই ভাগগুলো করেছি আমাদের নিজেদের সুবিধের জন্যে। তেমনি প্রকৃতির চারটি শক্তিক্ষেত্রের মধ্যেও যে-বিভেদ, যেমন গ্র্যাভিটি, ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স এবং উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স— এগুলোও মানুষের তৈরি বিভেদ। আইনস্টাইনই প্রথম ব্যবহার করলেন এই তিনটি শব্দ একসঙ্গে— ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সমস্ত ফিল্ডকে একত্র করবেন। চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি একসূত্রে গাঁথা, সহজবোধ্য মহাজগৎ। আইনস্টাইনের এই ভাবনার অনুসরণ করে সমস্ত ফিল্ডের ‘সাধারণ’ উৎসকে কিছু পদার্থবিজ্ঞানী বলেছেন ‘ইউনিফায়েড ফিল্ড’। আমরা যেন এ-কথা না ভাবি যে এটা কোনও নতুন ফিল্ড। ‘ইউনিফায়েড ফিল্ড’ শুধু বোঝাচ্ছে যে মহাবিশ্বের সমস্ত ফিল্ডের একই উৎস। তাই এটিকে ‘ইউনিফায়েড ফিল্ড’ না বলে প্রাইমারি ফিল্ড বা আদিক্ষেত্র বলাই ভাল। এই ইউনিফিকেশনের আরও একটি নাম হয়েছে— ‘থিয়োরি অফ এভরিথিং’। সম্প্রতি সেই বিষয়ে গবেষণামূলক অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে নোবেল কমিটিও ব্যবহার করেছে ‘থিয়োরি অফ এভরিথিং’ কথাটি। এতে বিজ্ঞানীগোষ্ঠীরও বিশ্বাস বেড়েছে।

এই আদি বা প্রাথমিক ফিল্ড ছড়িয়ে আছে মহাশূন্যের বুননের মধ্যে। এই প্রাইমারি ফিল্ড বা আদিক্ষেত্রের মধ্যেই ছিল সমস্ত মহাবিশ্বের ‘প্ল্যান’, সেই ফিল্ডই ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হয়েছে মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করতে। সুতরাং বিজ্ঞান পরিষ্কার আভাস দিচ্ছে সবকিছু এসেছে একই উৎস থেকে। এই আদিবিশ্ব উৎসই বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হয়েছে, বলছে উপনিষদ।

কিন্তু এখনও বাকি আছে আরও কিছু প্রমাণসূত্র ধরে আরও কিছু পথ চলার। যে-পথ আমাদের নিয়ে যাবে এক ফ্যাশন-শোয়ে। আমরা দেখব গারমেন্টস অফ রিয়েলিটি। বাস্তবের বিচিত্র পোশাক! উপনিষদে একটি শব্দ আছে— ‘অপাবৃণু’। বলা যেতে পারে শব্দটি উপনিষদের কোরক-শব্দ। শব্দটির অর্থ হল, অনাবৃত হও, উন্মোচিত হও, আড়াল সরিয়ে ফেলো, উপরের ঢাকনা খুলে ফেলো, অর্থাৎ খুলে ফেলো পোশাকের আবরণ। আমাকে দেখতে দাও ভিতরের রূপ। আমরা এবার বাস্তবের ভিতরের রূপ দেখব। এই স্তরে আমরা বাস্তবের ভিতরের চেহারাটা দেখতে চাই, উপনিষদের দৃষ্টিতে নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে। আমাদের যেন দিব্যদৃষ্টি উন্মোচিত হবে। এতদিন বাস্তবে আমরা অন্যভাবে দেখেছি। এবার জগৎকে দেখব, চিনব, বুঝব সম্পূর্ণ অন্যভাবে। আমাদের বিশ্ববোধ নতুনভাবে জন্মাবে। এইভাবে জগৎকে না দেখলে জগৎ সত্য না মিথ্যা তা সঠিকভাবে বুঝতে পারব না। এবার জগৎ সম্পর্কে যে নতুন দৃষ্টি, নব উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হতে চলেছি তার আলোয় নতুনভাবে বুঝি চলুন, জগৎ সত্য না মিথ্যা।

শুরু হতে চলেছে এমন এক ফ্যাশন-শো যার সুপারমডেল মহাবিশ্ব। এই সুপারমডেল মহাবিশ্ব রঙিন জামাকাপড়ের আড়ালে স্তরে স্তরে ঢেকে রেখেছে তার অন্তরের রহস্য। ফলে তার অনেকটা চেনা হয়েও অনেকটাই অচেনা। সুপারমডেল মহাবিশ্বের ফ্যাশান-শোয়ের শুরুতে অনেক পোশাক। কিন্তু একে একে খসে পড়বে পোশাক, সরে যাবে আড়াল, খুলে যাবে রহস্যের ঢাকনা, কেটে যাবে কুয়াশা। আমরা বুঝতে পারব কেমন করে এই মহাজগৎ এসে পৌঁছোল আজকের রূপে। রবীন্দ্রনাথ একেই হয়তো বলেছেন ‘কুয়াশাজয়ের দীক্ষা’। কুয়াশাজয়ের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আমাদের ধীরে ধীরে এক ডিটেকটিভের মতো দীর্ঘ বিবর্তনের পথ ধরে পৌঁছোতে হবে মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে, দেখতে হবে কেমন ছিল তখন এই সুপারমডেলের আঁতুড়ঘরের অবস্থা, বুঝতে হবে সব সন্তানের জন্মই যেমন মায়ের পেটের ওপর রেখে যায় সরু সরু জন্মদাগ, তেমনি সুপারমডেলটির জন্ম কোনও দাগ বা স্ট্রেচমার্ক রেখে গেছে কি না! মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে না পৌঁছোতে পারলে তার অন্তর-রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটিত হবে না আমাদের কাছে।

এই বর্ণময় বিচিত্র ফ্যাশন-শোয়ের প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে ১৯২০ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের পাঁচ হাজার ফুট উঁচু মাউন্ট উইলসন পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি মহাশূন্যের এক নিমগ্ন তপস্বীকে। তিনি পাহাড়চূড়ার এক নিঃসঙ্গ মানমন্দিরে সেই সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবিনটি ফোকাস করলেন মহাশূন্যে এক সুদূর নীহারিকার ওপর। সেই তপস্বী জ্যোর্তিবিজ্ঞানীর নাম এডুইন হাবল। হাবল পরিষ্কার দেখতে পেলেন ওই নীহারিকা আসলে আর একটি ছায়াপথ। তিনি বিস্মিত হলেন দেখে মহাশূন্যে ভাসমান দ্বীপের মতো আরও অনেক ছায়াপথ— ‘আইল্যান্ড ইউনিভার্সেস’। সত্যি এ এক অপূর্ব বিস্ময়। মাত্র একশো বছর আগে হাবলের সময় পর্যন্ত আমরা জানতামই না, পৃথিবীর ছায়াপথের বাইরে আরও অনেক ছায়াপথ আছে। না জানার প্রধান কারণ, হাবলের আগে এমন দূরবীক্ষণই ছিল না যার দেখার ক্ষমতা ছিল আমাদের ছায়াপথ পেরিয়ে। হাবল দেখতে পেলেন যেন এক নতুন অপরিচিত মহাবিশ্ব— যেখানে ছায়াপথগুলি চলছে। শুধু চলছে না, তারা পরস্পরের কাছ থেকে খুব দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকেও। আরও বেশি দূরে যারা, আরও দ্রুত সরছে। মহাবিশ্ব এইভাবেই ক্রমে আরও বিস্তারিত হচ্ছে।

হাবলের এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের তাৎপর্য বোঝা গেল প্রায় বিশ বছর পরে। জর্জ লেমাৎ, জর্জ গ্যামোর মতো বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করলেন হাবলের আবিষ্কারের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব: যদি এ-কথা সত্যি হয় যে ছায়াপথেরা পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তা হলে এ-কথাও সত্যি সুদূর অতীতে এক সময়ে তারা কাছাকাছি ছিল। প্রশ্ন হল কত কাছে? পাওয়া গেল উত্তর। এতটাই কাছে যে তারা সবাই এক বিন্দুতে ছিল। এই একতার ধারণায় আইনস্টাইনের সমীকরণ পৌঁছেছিল কয়েক দশক আগে,— একেই বলা হয় সিঙ্গুল্যারিটি। যে সিঙ্গুল্যারিটির মধ্যে মহাবিশ্বের নিয়মকানুন আর খাটে না, ভেঙে পড়ে। এখন কিন্তু বোঝা যাচ্ছে নিয়মকানুন ভেঙে পড়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কারণ প্লাঙ্ক’স ডাইমেনশনের থেকে কোনও ছোট বিন্দুতে যাওয়া যায় না।

সংকুচিত হতে হতে নীহারিকাগুলি এতটাই কাছে যে তারা এক হয়েই ছিল। এইভাবে সংকুচিত হলে পদার্থের তাপমাত্রা যে কোন ডিগ্রিতে পৌঁছোতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সেই প্রচণ্ড তাপমাত্রার ফলেই মহাজাগতিক বিস্ফোরণ এবং সেই বিস্ফোরণের মোমেন্টামে মহাবিশ্বের ক্রমাগত প্রসার— আজও যা চলছে। ব্রিটিশ জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল মহাবিস্ফোরণের নাম দিলেন ‘বিগ ব্যাং’। এই মজার নামটাই থেকে গেল।

ফ্যাশন-শোটা কেমন লাগছে? এবার আমরা চলে আসছি ১৯৪০ সালে। জর্জ গ্যামো বললেন, বিগ ব্যাং তৈরি করেছিল এক ভয়ংকর অগ্নিগোলা। সেই অগ্নিগোলার ‘আফটার গ্লো’ মহাবিশ্বের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকলেও, সেই চিহ্ন আজও আছে। গ্যামোই গণিতের সাহায্যে দেখালেন কীভাবে অগ্নিগোলার তাপমাত্রা কমেছে মহাবিশ্বের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে। এরপর কেটে গেল পঁচিশ বছর। ১৯৬৫ সাল। দুই জ্যোর্তিবিজ্ঞানী, আরনো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন কাজ করছিলেন নিউ জার্সির বেল ল্যাবস-এ একটা নতুন হর্ন অ্যানটেনা নিয়ে। ওঁরা চাইছিলেন বাইরের কোনও সংকেত ছাড়া যন্ত্রটির নিজস্ব রেডিয়োসংকেতকে ন্যূনতমভাবে ধরতে। কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। তাঁরা শুনতে পাচ্ছিলেন মাইক্রোফোনের মধ্যে ক্রমাগত একটা হিসিং শব্দ মহাবিশ্বের চারপাশ থেকে আসছে। আসলে পেনজিয়াস এবং উইলসন যেটা শুনতে পেয়েছিলেন তা ছিল মহাশূন্যে বিগ ব্যাং-এর রেখে যাওয়া মাইক্রোওয়েভস-এর শব্দ! গ্যামো বিগ-ব্যাং-এর এই মাইক্রোওয়েভ আফটারগ্লোয়ের কথাই বলেছিলেন! দেখতে চান নিজে? তা হলে টিভি খুলে চলে যান সেই চ্যানেলে যেখানে কোনও প্রোগ্রাম নেই, সিগন্যাল নেই। দেখবেন টিভির পরদায় খেলা করছে অজস্র বিন্দু। বিন্দুগুলি নাচছে। ওদেরই একটা অংশ মহাবিশ্বের জন্মের মাইক্রোওয়েভ-আফটারগ্লো।

এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়ে রাখি। বিগ ব্যাং থিয়োরি যে ভয়ংকর তাপমাত্রার কথা বলে, সেই তাপমাত্রায় ছিল শুধুই এনার্জি। আর ধুলোর মতো বিভিন্ন মৌলকণা। তারপর যতই মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে আর ঠান্ডা হচ্ছে, ততই এনার্জি জমাট হল পদার্থের মৌলকণায়। এখানেই সত্যতা আইনস্টাইনের সমীকরণের: এনার্জি হয়ে যাচ্ছে পদার্থ। অর্থাৎ এক অমূর্ত হয়ে উঠছে মূর্ত। যা ছিল অমূর্ত তাই প্রকাশিত হচ্ছে বাস্তব কায়ায়। এই জগৎকে মিথ্যা বলব কেমন করে? মনে রাখতে হবে, বিগ ব্যাং-এর তিন-চার মিনিটের মধ্যেই হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের মতো হালকা অ্যাটমিক এলিমেন্ট জন্মেছিল। তারপর নক্ষত্রদের চুল্লিতে সৃষ্টি হল অপেক্ষাকৃত ভারী অ্যাটমিক এলিমেন্ট, লোহা পর্যন্ত। এরপর সুপারনোভা নামে তারা-বিস্ফোরণের ফলে যে শকওয়েভ তৈরি হল তারই মধ্যে জন্মাল মহাবিশ্বের আর সব পদার্থ।

এবার আরও গভীর কিছু প্রশ্ন— বিগ ব্যাং-এর বিস্ফোরণ থেকে এরকম মহাবিশ্বই বা হল কী করে? বৃহৎ মাপনমাত্রায় এই মহাবিশ্ব ‘মসৃণ’। অথচ ‘স্থানীয়’ মাপনমাত্রায় এই মহাবিশ্ব নক্ষত্র এবং গুচ্ছ গুচ্ছ ছায়াপথ নিয়ে এলোমেলো, স্তূপীকৃত! কেন? কী করে মহাবিশ্ব এত বছর বেঁচে আছে? মহাকর্ষের টানে নিজেই তো নিজের ওপর ভেঙে পড়তে পারত। অথবা প্রসারণের প্রচণ্ড গতির টানে ঠিকরে বেরিয়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারত। তা ছাড়া, বিগ ব্যাং-এর মতো ঘটনা ঘটানোর জন্যে বিশাল এনার্জি এল কোথা থেকে?

১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান গুথ তাঁর ইনফ্লেশনারি থিয়োরির সাহায্যে উত্তর দিয়েছিলেন এইসব প্রশ্নের। উত্তর দিতে গুথ আইনস্টাইনের সাহায্য নিয়েছিলেন। অনেক বছর আগে বলেছিলেন আইনস্টাইন, কোনও কোনও অবস্থার মধ্যে মহাকর্ষ বিপরীত বল প্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ মহাকর্ষ না টেনে ঠেলে দিতে পারে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে গুথের অনন্য গবেষণা হয়েছিল বিশ্বের নবজাগরণেরই পরে। সেই জাগরণ আমাদের সামনে প্রথম খুলে দিল এমন বিশ্বকে যার এক আদিম সামঞ্জস্য একেবারেই অক্ষত— এই আদিম সামঞ্জস্যের সূত্রটির নাম গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিয়োরি। আমাদের সামনে প্রথম উন্মোচিত হল সেই মহাবিশ্ব যার আকার একটি পিনের ডগার থেকেও ছোট— কত ছোট কল্পনা করাও শক্ত। এতই ছোট যে সেটাকে ‘জায়গা’ বলাই যায় না। একটি প্রোটনকে প্রথমে বিলিয়ন খণ্ডে ভাগ করে সেই ভাগের একটি খণ্ডকে একশো মিলিয়ন খণ্ডে ভাগ করলে তবে সেই ক্ষুদ্রতার একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। কত বড় একটি প্রোটনের সাইজ? একটি বালুকণাকে হাজার বিলিয়ন ভাগে ভাগ করলে তবে পাওয়া যাবে একটি প্রোটনের সাইজ। এতক্ষণে কি কিছুটা বোঝা গেল মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল কত ক্ষুদ্র অবস্থায়? এখানে জানিয়ে রাখি, বিস্মিত হতে হয় ভাবলে হাজার হাজার বছর আগে আমাদের বেদ বলেছিল, সৃষ্টির আদিতে মহাজগৎ ছিল বিন্দুর মতো ছোট অবস্থায়, তার নাম ছিল ‘দহর’। সেই ‘দহর’ হল ব্যাপ্ত বহুরূপে। আজকের বিজ্ঞানের সত্য এত বছর আগে কীভাবে প্রাচীন ভারত পেয়েছিল তার ধ্যানলব্ধ উপলব্ধিতে!

গুথ এক অসামান্য ভাবনা ভাবতে পেরেছিলেন। এই ভাবনাই নিয়ে এল আমাদের বিশ্বভাবনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন। ভাবনাটি এই: মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে ঠান্ডা হচ্ছে। তারই ফলে ভেঙে গেল ইউনিফায়েড ‘গাট’ সিমেট্রি। এবং সমস্ত মহাবিশ্ব যেন তার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে থেমে গেল হঠাৎ। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘a pregnant pause’। আসলে একটি মুহূর্ত তৈরি হল ফলস ভ্যাকুয়ামের। এর ফলে জন্মাল কিছুটা নেগেটিভ গ্র্যাভিটি।

পরেই শুরু হয়ে গেল মহাবিশ্বের স্ফীতি। এই স্ফীতির গুণনীয়ক ১-এর পিঠে অন্তত ৩০টা শূন্য। মহাবিশ্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়ে গেল এই সংখ্যাটি দিয়ে এক সেকেন্ডকে ভাগ করতে যতটুকু সময় পাওয়া যাবে তার মধ্যে। অকল্পনীয় এনার্জি উৎসারিত হল ওই স্ফীতি থেকে। এই স্ফীতিকালে মহাশূন্য প্রসারিত হয়েছিল আলোর চেয়েও বেশি গতিতে। আমার কথা শুনে অনেকেই হয়তো বলে উঠবেন, কোনও কিছুর পক্ষেই আলোর গতিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আইনস্টাইনের স্পেশাল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি মহাবিশ্বের ওপর যে স্পিডলিমিট চাপিয়ে দিয়েছে তা মহাশূন্যের প্রসারের গতির ওপর প্রযোজ্য নয়। প্রযোজ্য শুধু বস্তুর ওপর।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি বিষয়ে সাধারণত এক মত— মহাবিশ্বের মতো এই বিশাল বস্তুটি সৃষ্টি হয়েছিল অকল্পনীয়ভাবে ক্ষুদ্রতম বিন্দু থেকে। ‘গাট’-সিমেট্রি ভাঙতেই তৈরি হয়েছিল মুহূর্তের অনবস্থা। আর তারই ফলে জাত হল বিগ ব্যাং অগ্নিগোলার সমস্ত এনার্জি। এবং এই মুহূর্তেই তৈরি হয়ে গেল মহাবিশ্বের সমস্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। মহাবিশ্বের জন্মের ১ সেকেন্ডের বিলিয়নথ-বিলিয়নথ-বিলিয়নথ ভাগের একশো মিলিয়ন ভগ্নাংশে তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্বের সমস্ত নিজস্ব চিহ্ন। ইনফ্লেশন থিয়োরি বলছে মহাশূন্য প্রসারিত হচ্ছে আমরা যে মহাবিশ্বকে জানি তারও বাইরে। আমরা কোন মহাবিশ্বকে জানি— যে-মহাবিশ্ব একটি ক্ষুদ্রতম বিন্দু থেকে প্রসারিত হতে হতে এতই বৃহৎ যে তার ছায়াপথের সংখ্যাই অন্তত একশো বিলিয়ন। এতবড় একটা জিনিসকে আমাদের ধারণা করার ক্ষমতা সত্যিই নেই।

ওই ছোট্ট তাত্পর্যপূর্ণ বিরতি বা pregnant pause-এর আগে যেহেতু মহাবিশ্বের আকার ছিল অকল্পনীয় ক্ষুদ্র, তার ভিতরে যা-কিছু ছিল, তা ছিল একটি থার্মাল ব্যালান্সের মধ্যে। এর থেকে বোঝা যায়, কেন মহাবিশ্বের মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ ব্যাকগ্রাউন্ড বিকিরণে এমন সমরূপ। এবং কেন মহাবিশ্বের সেই সময়ে সবে তৈরি উপাদানগুলি মোটামুটি সমবণ্টিত।

প্রায় চোদ্দো বিলিয়ন বছর ধরে যে মহাবিশ্ব ধ্বংস হল না তার কারণ মহাবিশ্বের প্রসারে অসামান্য ‘টিউনিং’। এই টিউনিং-এর সূক্ষ্মতা অসামান্য। এই টিউনিং-এর গন্ডগোল সামান্যতমও যদি হত, তা হলে মহাবিশ্ব ভেঙে পড়ত কিংবা ছিটকে বেরিয়ে যেত। মহাবিশ্বের এই ভারসাম্য বজায় রাখছি আর সব কিছুর সঙ্গে আপনি আমিও। তাই মহাবিশ্ব আমাদের ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। সেই জগৎকে মিথ্যা বলব কী করে, কোন উপায়ে?

কোবি আর WMAP স্যাটেলাইটের তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে কী কী উপাদান দিয়ে। মহাবিশ্বের ৪ শতাংশ তৈরি হয়েছে সাধারণ পদার্থ দিয়ে। যা থেকে আমরাও তৈরি। মহাবিশ্বের ২৩ শতাংশ ‘ডার্ক’ ম্যাটার বা কৃষ্ণ পদার্থ। এর গঠন সম্পর্কে আজও আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। আর মহাবিশ্বের ৭৩ শতাংশ হল এক রহস্যময় উপাদান, যার নাম ‘ডার্ক এনার্জি’। এই ডার্ক এনার্জির উৎস সম্পর্কে আজও সঠিক কোনও ধারণা নেই আমাদের। আজকের সৃষ্টিতত্ত্বের পরম সন্ধানের বিষয়— ডার্ক এনার্জির উৎসকে স্পষ্টভাবে বোঝা। এই রহস্যময় শক্তি আজও আঁধারে।

ইনফ্লেশনারি থিয়োরি কিছু নতুন কথা বলেছে এনার্জি সম্পর্কে। বিগ ব্যাংয়ের আদি পজিটিভ এনার্জির সবটাই তৈরি হয় মহাস্ফীতির সময়ে। সেই সঙ্গে সমপরিমাণ নেগেটিভ এনার্জিও তৈরি হল। মনে রাখতে হবে, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা একে অন্যকে টানছে। গণিতের বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, মহাবিশ্বে পজ়িটিভ এনার্জির এবং নেগেটিভ এনার্জির যোগফল সমান। ফলে পজ়িটিভ নেগেটিভ কাটাকুটি হয়ে মহাবিশ্বে মোট এনার্জির পরিমাণ দাঁড়াল শূন্য! এত বিশাল এক মহাবিশ্ব। অথচ সেখানে শূন্য এনার্জি? কী করে সম্ভব? সম্ভব হতে পারে— যদি মহাবিশ্বের স্ফীতি ও প্রসারের এনার্জি-উৎস হয়ে থাকে এমন কিছু যার মূল্যও ‘শূন্য’!

মহাবিশ্বের বয়েস ১৩.৭ বিলিয়ন বছর। মহাবিশ্বের মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনে কোবি স্যাটেলাইট যে স্ট্রেচ মার্কস দেখতে পেয়েছে সেগুলি আসলে কসমিক রোজেটা (Rossetta) স্টোন। মহাবিশ্বের সঠিক বয়েস যে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর, তা বোঝা গেছে ওই স্ট্রেচ মার্কস থেকে। কিন্তু এই মহাবিশ্বের জন্মের মুহূর্তেই কী ঘটেছিল, তা আমরা জানি না। মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে প্রথম মুহূর্তটিকে ইনফ্লেশন এক বিপুল জলপ্রপাতের মতো আমাদের চোখের সামনে থেকে সব মুছে দিয়েছে। তার মধ্যে থেকে আমরা আমাদের সুপার মডেল মহাবিশ্বের ‘ভ্রূণ’-টিকে শনাক্ত করব কী করে?

এইখানে এসে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে সৃষ্টির দর্শনশাস্ত্রে। বিজ্ঞান যেন নিরুত্তর হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় মৃত্যুর ক’দিন আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটি:

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নতুন আবির্ভাবে—

কে তুমি,

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল

পশ্চিমসাগরতীরে

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—

কে তুমি,

পেল না উত্তর।

আমরা জানি না, কোনওদিন বিজ্ঞান সব আড়াল কাটিয়ে, সব আঁধার পেরিয়ে, সব রহস্যের পরদা সরিয়ে মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তের একেবারে শুরুতে, ওই এক সেকেন্ডের অন্তিম ভগ্নাংশে পৌঁছোতে পারবে কি না। আমরা শুধু এইটুকু জানি এই চূড়ান্ত জ্ঞানের এষণায় যেন ক্রমে মুছে যাচ্ছে ফিজিক্স আর মেটাফিজিক্স, পদার্থবিজ্ঞান আর অধিবিদ্যার বিভেদ রেখা। আইনস্টাইনের সমীকরণকে ব্যবহার করে, বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ রজার পেনরোজ় এবং বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, স্পেসটাইম শেষ পর্যন্ত কোল্যাপস করে বা ভেঙে পড়ে এমন এক বিন্দুতে যার ‘ডাইমেনশন’ বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধের মাপ একত্রে শূন্য! কিন্তু এই জিরো ডাইমেনশনে পৌঁছোনোর আগে প্লাঙ্ক’স ডাইমেনশনের কাছাকাছি এলেই তো কাজে লেগে যাবে ‘কোয়ান্টাম এফেক্টস’ উদ্ধারের। তা হলে কী দেখব আমরা?

আমরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি, প্লাঙ্ক-এর ডাইমেনশনের কাছে প্রকৃতির সব ক’টি ক্ষেত্রের ক্ষমতা সমান হয়ে যায়। এবং ওদের ব্যবহার দেখে মনে হয় যেন একই প্রাইমারি ফিল্ডের বিভিন্ন দিক ওরা। পদার্থবিজ্ঞানী এবং সৃষ্টিতাত্ত্বিকরা একসঙ্গে বলছেন— যতই আমরা সৃষ্টিরহস্য ভেদ করতে পিছনের দিকে যাব, যতই কাছাকাছি যাব সৃষ্টির জন্মলগ্নের, ততই দেখব এককরণ বা ইউনিফিকেশনের বিভিন্ন পর্যায়।

সুতরাং এতক্ষণে আমরা এই ধারণায় পৌঁছোতেই পারি বিজ্ঞান ও দর্শনের সমবেত সমর্থনে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল সমস্ত ক্ষেত্রের মহামিলন থেকে। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী মুরে গেলম্যানের মতে, এই পর্যায়ে মৌলকণা এবং মহাবিশ্ব প্রসঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মৌলিক মনন মিশে গিয়ে হয়ে ওঠে এক সূত্র। একদিকে ক্ষুদ্রতম কণিকার বিজ্ঞান। অন্যদিকে মহাশূন্যের জন্মলগ্নের বিজ্ঞান। তারা এই পর্যায়ে এসে হয়ে ওঠে একই বিজ্ঞান। সন্ধান দেয় এই মূল সত্যের যে মহাবিশ্বের একই উৎস। একমেবাদ্বিতীয়ম্। এক এবং অদ্বিতীয়।

এখন দেখা গেল বিজ্ঞান কত আত্মবিশ্বাসী প্রমাণের সঙ্গে সমর্থন করছে বেদ ও উপনিষদের এই বাণী যে মহাবিশ্বের সবকিছুরই সৃষ্টি একই উৎস থেকে এবং সেই উৎস রয়েছে মহাবিশ্বের সর্বত্র। বেদ ও উপনিষদের মতে যে উৎস বা আদিসত্তা যার নাম ব্রহ্ম তার আছে আর এক গুণ সেটা হল চেতনা। বিজ্ঞান যাকে বলছে মহাবিশ্বের উৎস তার মধ্যে কি বিজ্ঞানের মতে ব্রহ্মের মতো চেতনা আছে? চেতনা নিয়ে নিয়মবদ্ধ অনুধাবন বিজ্ঞান শুরু করেছে এবং সেই কাজ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। আজকে সেই বিজ্ঞানীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে যাঁরা মনে করেন মহাবিশ্বের এক প্রাথমিক অঙ্গই হল চেতনা।

আমরা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলের কথা আগেই বলেছি। ‘দি ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’ গ্রন্থে স্টিফেন হকিং বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন, ‘অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপলকে গণিতের সাহায্যে আরও স্পষ্ট যথাযথ গঠন দেওয়া যেতে পারে এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে সেটা আবশ্যিক।’ একেবারে প্রাথমিক অবস্থায়, সমস্ত মহাবিশ্বটা একটা অ্যাটমের থেকেও অনেক ছোট ছিল। সুতরাং তখন বিশ্ব চলতে বাধ্য ছিল কোয়ান্টাম ফিজিকসের তথ্য অনুসারে। ফলে, আমাদের মহাবিশ্ব শুরু হতে পারত অসংখ্যভাবে। কিন্তু তা হয়নি। তা হলে হলটা কী? অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল-এর মতে এই বিশ্বে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণীর আবির্ভাব ছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টির অপরিহার্য শর্ত। তাই আমরা এলাম।

বিখ্যাত চিন্তাশীল বিজ্ঞানী জন হুইলার আর একভাবে সমর্থন করেছেন এই ভাবনা। তিনি এক ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’ পেশ করেছিলেন যার নাম ‘ডিলেড চয়েস এক্সপেরিমেন্ট’। সেটা এখন ল্যাবরেটরিতে প্রমাণ করা গেছে। তিনি কুণ্ঠাহীনভাবে বলতে পেরেছিলেন— It is incontrovertible that the observer is a participator in genesis. কে এই মহাবিশ্বের দর্শক? সেই দর্শক হল, চেতনা। এই চেতনা মহাবিশ্বের বুননের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল শুরু থেকেই। আমরা হলাম সেই নিহিত চেতনার প্রকাশমাধ্যম। এই প্রকাশিত চেতনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, চেতনা একই সঙ্গে উপলব্ধ হয় এবং উপলব্ধি করে। জগতে এমন আর অন্য কিছু নেই যার এই গুণ আছে। সুতরাং কঠিন হবে অস্বীকার করা যে মহাবিশ্বের বাস্তবের এক অপরিহার্য অঙ্গ হল চেতনা।

চেতনা এবং আদিক্ষেত্রের যুগপৎ স্থিতি কি বিজ্ঞান সমর্থিত? কোয়ান্টাম জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্যে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি পারস্পরিক গুণাবলীর যুগপৎ স্থায়িত্ব। যেমন একটি ইলেকট্রন পার্টিকেল একই সঙ্গে ইলেকট্রন ওয়েভ হয়েও থাকে। এই থেকেই বিজ্ঞান পথ দেখাচ্ছে চেতনা ও আদিক্ষেত্রের যুগপৎ স্থিতি সম্পর্কের।

চেতনা এবং আদিক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দিকে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান। এইভাবে দেখলে, একই অন্তর্নিহিত পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ চেতনা এবং আদিক্ষেত্রের প্রাথমিক বাস্তব।

ডেভিড বোম এই মৌলিক পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ইমপ্লিকেট অর্ডার। বেসিল হাইলির মতে, কোনও প্রভেদ নেই মন ও পদার্থের এই নিহিত ইমপ্লিকেট অর্ডারের স্তরে। এরা পৃথকভাবে বেরিয়ে এসেছে এই একই স্তর থেকে। ডেভিড বোম গাণিতিক গণনার সাহায্যে দেখাতে চাইছেন, কেবলমাত্র কোনও দার্শনিক ভাবনা নয় এই ইমপ্লিকেট অর্ডার, এর মধ্যে ধৃত অন্তরগত পদ্ধতিটির যথাযথ বর্ণনা।

নিছক গাণিতিক প্রত্যাশায় পরিণত হয় মহাশূন্যের গভীরতম স্তর যা অকল্পনীয়ভাবে ক্ষুদ্র প্লাঙ্ক’স ডাইমেনশনের থেকেও ছোট। বোম এবং হাইলি এটাকেই প্রি-স্পেস বলেছেন। জন হুইলার-প্রস্তাবিত প্রি-জিওমেট্রি এই থেকেই। অনেকেই আশা করেন কোয়ান্টাম ফিজিক্স এই ছবিটাকে গ্রহণ করবে অনুধাবনের জন্য। বোম আর হাইলির মতে প্রি-স্পেস স্তরে মহাবিশ্ব অখণ্ড। সেই অখণ্ড মহাবিশ্বে সবকিছুর সঙ্গে সবকিছু যুক্ত। এবং মহাবিশ্বকে এমন সুসংবদ্ধ করেছে কোয়ান্টাম পোটেনশিয়ালের আত্ম-সংবদ্ধতার স্বভাব।

আবার প্রি-স্পেস স্তরে যাওয়া যাক। সেখানে সারা বিশ্বজুড়ে পারস্পরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে চেতনার এবং আদিক্ষেত্রের সম্ভাবনাগুলি মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ ইমপ্লিকেট অর্ডারের সারকথা হল ‘এক উৎস’। আদিক্ষেত্র এবং চেতনার রূপে নিজেকে প্রকাশ করছে এই একই উৎস। সুতরাং ভারতের ঋষিরা বেদে ও উপনিষদে ব্রহ্ম নামে যে একই উৎসের কথা বলেছিলেন, আজকের বৈজ্ঞানিক সত্য সেই প্রাচীন ধ্যানের উপলব্ধিকে সমর্থন করছে। একই উৎস থেকে আমরা সবাই উৎসারিত। এবং মহাবিশ্বে আমরা উত্সের সঙ্গে সদা সম্পৃক্ত।

এই কারণেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার দ্বিধাহীনভাবে বলতে পেরেছেন, সব চেতন সত্তাই একই সত্তার প্রকাশ। শ্রোডিঙ্গারের এই উক্তির প্রেরণায় আমরা সাহস করে বলতেই পারি, মহাবিশ্বের চেতনার আদিউৎসের সঙ্গে সুর মেলাবার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। আমাদের প্রাণের কথা রণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে—

আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *