শৃঙ্খলা

শৃঙ্খলা

নসু অনেক্ষণ হল জেগেছে। চাদরের নিচ থেকে এখনো মাথা বের করছে না। এমন কিছু তাড়া নেই। এক সময় মাথা বের করলেই হল। তাছাড়া চাদরের ভেতর শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে। শান্তি শান্তি লাগছে। নিজেকে নিরাপদ লাগছে। চাদরটা তার মাথার উপর এল কি করে তা অবশ্যি তার মনে নেই। রাতে যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন কি ছিল? মনে পড়ছে না। মনে না পড়লে নেই। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। নসু শুয়েছিল কুভুলি পাকিয়ে। সে তার ডান পা-টা ছড়িয়ে দিল। সমস্যা একটাই, এতে তার পা চাদরের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়বে। চাদরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে পা-টা বের করা কি ঠিক হবে? জগৎটাতো খুব সহজ জায়গা না। কোত্থেকে কি হয় কে জানে। তারপরেও তার চারপাশের জগৎটা ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্যেই কাজটা তাকে করতে হচ্ছে। নরম কোন জিনিসের সঙ্গে পায়ের ধাক্কা লাগার কথা। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে নরম জিনিসটার ঘেউ করে একটা শব্দ করার কথা। যদি উঠে তবে বুঝতে হবে সব ঠিক আছে।

পায়ের সঙ্গে নরম জিনিসটার ধাক্কা লাগল। জিনিসটা একবার ঘেউ করেই কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। কোন অনিয়ম হয়নি। পায়ের কাছে কুকুরটা ঠিক আছে। পরিপূর্ণ নিয়ম ও শৃঙ্খলার ভেতর শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি দিন। নসু তার পা দিয়ে কুকুরটাকে আরেকটা ধাক্কা দিল। আবারো কুঁই কুঁই শব্দ হল। আহারে, কুকুরটা কি সুন্দর করেই না কুঁই কুঁই করে।

নসু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এত নীল যে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখে ধাঁধা লাগে। মাথা ঝিম ঝিম করে। নসু চোখ ফিরিয়ে নিল। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে তাকালো সোজাসুজি। রাস্তায় লোক চলাচল করছে, রিকশা চলছে, হুস হাস করে গাড়ি যাচ্ছে। বাহ কি সুন্দর। চলমান জীবন দেখার আনন্দই অন্য রকম। নসু চোখে পলক পর্যন্ত ফেলে না। মনে হয় পলক ফেললেই মজাদার কিছু দেখা হবে না। এক পলকে অনেক কিছু হতে পারে।

নসু কোমরের নিচে হাত দিল। গায়ে কাপড় আছে কি না চট করে দেখে নেয়া। গায়ে কাপড় না থাকলে চাদরটা কোমরে জড়াতে হবে। নগ্ন অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। শহরের কিছু লোক আছে যারা নগ্ন মানুষ পছন্দ করে না। মা’রধোর পর্যন্ত। করে। সে যতবার নগ্ন অবস্থায় বের হয়েছে ততবার মা’র খেয়েছে।

নসু হাত দিয়ে দেখল তার পরনে একটা প্যান্ট। প্যান্টের যেখানে বেল্ট থাকার কথা সেখানে দড়ি বাঁধা। বেশ শক্ত করেই বাঁধা। কেউ একজন বেঁধে দিয়েছে। বাঁধাবাঁধির কাজ সে আজকাল করতে পারে না। বড়ই বেড়া ছেঁড়া লাগে। তার নিজস্ব জগতে সে বেড়া ছেঁড়া চায় না। সে চায় শৃঙ্খলা। মেয়েদের স্কুলের সামনে আগে সে প্রায়ই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আজকাল যায় না। শৃঙ্খলার কারণেই যায় না। ফুটফুটে সব মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে কত ভাল লাগতো দেখতে। মাঝে মাঝে হেসে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তো–আহা কি মধুর দৃশ্য। ওরা কথাও বলতো কি সুন্দর করে—ঐ দেখ পাগলা। ঐ যে পাগলা। ও মাগো, পাগলা হাসে। কি ভয়ংকর! পাগলা হাসছে।

নসু হাসতো ঠিকই। এরকম সুন্দর সুন্দর দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে না হেসে পারা যায়? হাসার কারণেই শৃঙ্খলায় গন্ডগোল হয়ে গেলো। সে সবার নজরে পড়ে গেলো। মারের চোটে জীবন যাওয়ার উপক্রম। মারের সঙ্গে কি সব কঠিন কঠিন কথাবল হারামজাদা আর মেয়েছেলের দিকে নজর দিবি? জাতে পাগল তালে ঠিক। জায়গামত চলে আসে। হারামজাদা চোখ গেলে ফেলব, তখন জন্মের দেখা দেখবি।

নসু বলতে বাধ্য হয়েছে–সে আর আসবে না। সে থাকবে শৃঙ্খলার ভেতরে।

সবচে বেশী শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয় একজন পাগলকে। অন্য কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে কোন অসুবিধা নেই, পাগল ভাঙ্গলেই সমস্যা। দরকার কি? অন্যসব পাগলদের মত সেও ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করে। সারা দিন মনের আনন্দে পৃথিবীর শৃঙ্খলা দেখা। রাতে পায়ের কাছে কালো রঙের কুকুর নিয়ে সুখে দ্রিা। খাওয়া দাওয়া কোন সমস্যা না। হোটেল মালিকরা পাগল পছন্দ করে। পাগলদের খাওয়ালে বিক্রি ভাল হয়। হোটেল চালু থাকে। আয় উন্নতি হয়। কাজেই পাগলদের জন্য হোটেল ভাগ করা থাকে। একেক পাগলের জন্যে একেক হোটেল। নসুর ভাগের হোটেলটার নাম–নিউ ঢাকা কাবাব হাউস। নসু গভীর রাতে কাবাব হাউসের সামনে দাঁড়ায়। তাকে কিছু বলতে হয় না। তাকে দেখা মাত্র হোটেলের মালিক বলে–আসছেরে, নসু পাগলা আসছে। তখন বড় একটা এনামেলের গামলায় আধ গামলা খাবার তাকে দেয়া হয়। কাস্টমা’ররা প্রচুর খাবার নষ্ট করে, তার একটা অংশ নসু পায়। শিক কাবাব, নান রুটি, খানিকটা পরোটা। মুরগীর মাংস। নসুর কাছ থেকে খানিকটা পায় তার কুকুর। দুজনই মহা তৃপ্তিতে খায়। হোটেলের মালিক এই সময় তার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা বলেন। খাবার সময় নসুর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবু সে বলে। তার কথা শুনতে লোকটা পছন্দ করে। কি আর করা।

কেমন আছিসরে নসু?

জ্বে, আছি ভাল।

দেশে কবে যেন যাবি?

মাথাটা ঠিক হলেই চলে যাব।

দেশে আছে কে?

বউ আছে। পুলাপান আছে।

দেশ কোথায়?

স্মরণ নাই।

স্মরণ না থাকলে যাবি কি ভাবে?

বউ আইসা নিয়া যাবে।

নসুর এই কথাতে হোটেল মালিক হো হো করে হাসে। তার সঙ্গে অন্যরাও হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল হবার পর বউ এসে তাকে ঢাকায় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। এইটাই নিয়ম–পাগল ঘরে পুষা যায় না। শহরে ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়। বউও তাই করেছে, শহরে ছেড়ে দিয়ে গেছে। এত বড় শহর খাওয়া খাদ্যের অসুবিধা হবে না। সে সুখে থাকবে।

বউ যখন রেখে গেছে বউ নিয়েও যাবে। এটাইতো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক কথা শুনে লোকে হাসবে কেন। নসু বড়ই বিরক্ত হয়। তবে বিরক্তি প্রকাশ করে না। পাগলদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। তাদের যখন তখন বিরক্তি প্রকাশ করলে চলে না।

তোর বউ দেখতে কেমনরে নসু?

আছে, সুন্দর-মুন্দর আছে।

এই কথাতেও সবাই হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে তাও নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল বলে তার বউ সুন্দর-মুন্দর হতে পারে না?

নসু ঠিক করে রেখেছে তার বউ যখন তাকে নিতে আসবে তখন এই হোটেলে তাকে নিয়ে আসবে। হোটেল মালিককে দেখিয়ে নিয়ে যাবে সে মিথ্যা কথা বলে নি।

তোর বউয়ের নাম কিরে?

নাম বলব না।

নাম বলবি না কেন? নাম স্মরণ নাই?

স্মরণ আছে বলব না। পর পুরুষরে পরিবারের নাম বলতে নাই।

বললে অসুবিধা কি?

পর পুরুষরে পরিবারের নাম বললে পরিবার অসতী হয়।

 হোটেল মালিক আবারো গলা ফাটিয়ে হাসে। নসুর বিরক্তির সীমা থাকে না।

বল নসু নাম বল। নাম বললে তোকে ফাইভ ফাইভ সিগারেট খাওয়াব।

জ্বে না নাম বলব না।

নসু গম্ভীর হয়ে যায়। পাগল হলেও এইসব বিষয়ে সে খুব সাবধান। ছেলেপুলের নাম জানতে চাইলে সে বলে দেবে কিন্তু পরিবারের নাম বলবে না। মুশকিল হচ্ছে ছেলেপুলের নাম তার স্মরণ নাই। শুধু পরিবারের নামই স্মরণ আছে। তার পরিবারের নাম শরুফা।

শরুফার কথা সে দিনে কখনো মনে করার চেষ্টা করে না। সারা দিন সে শহরে ঘুরে বেড়ায়, শহরের শৃঙ্খলা দেখে। তার বড় ভাল লাগে। প্রতিদিনই চোখের সামনে কত শিক্ষনীয় ব্যাপার ঘটে যায়। নসুর নতুন নতুন জিনিস শিখতে ভাল লাগে। যেমন মাত্র কয়েকদিন আগে সে একটা নতুন জিনিস শিখল–ট্রাফিক পুলিশ যখন দুহাত তুলে তখন রিকশা এবং গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সাইকেল চলে। কত দিন ধরে সে এই শহরে আছে কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তার আগে চোখে পড়েনি। যখন চোখে পড়ল তখন বিষ্ময় ও আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়ল। কি বিচিত্র ব্যাপার! ট্রাফিক পুলিশ ট্রাক, বাস, রিকশা সব আটকাতে পারে কিন্তু সাইকেলের মত দুচাকার একটা সামান্য জিনিস আটকাতে পারে না। তখন শৃঙ্খলার মধ্যে একটা। গন্ডগোল হয়ে যায়। নসুর খুব ইচ্ছা করছিল এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা সে তার কুকুরটাকে বুঝিয়ে দেয়। সেটা সম্ভব না। আল্লাহ পাক পশুদের প্রতি তেমন দয়া। করেননি। শৃঙ্খলার ব্যাপারটা তাদের বোঝার ক্ষমতা দেননি। নসুর সেদিন তার কুকুরটার প্রতি বড় মায়া লেগেছিল। আহারে অবোধ পশু।

নসু ঠিক করে রেখেছে যেদিন সে ভাল হয়ে দেশের বাড়িতে যাবে কুকুরটাকেও নিয়ে যাবে। গ্রামদেশে শহরের মত খাওয়া খাদ্য নাই, তা কি আর করা। অবোধ একটা পশুকে সেতো আর ফেলে রেখে যেতে পারে না।

নসু সারা দিন হাঁটে। মজা করে চারপাশের শৃঙ্খলা দেখে। রাতে ফুটপাতের কোন একটা নিরাপদ কোনায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার খুব ভাল ঘুম হয়। হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আচমকা মনে হয় শৃঙ্খলায় কোন গন্ডগোল হয়নি তো? কয়েক মুহূর্ত সে আতংকে অস্থির হয়ে থাকে। আঁ আঁ করে বিকট চিৎকার দিতে ইচ্ছা করে। তখনই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে শব্দ করে। নসুর মনে হয়–সব ঠিক আছে। শৃঙ্খলা বজায় আছে। কুকুরটার সঙ্গে সে তখন দুএকটা কথা বলে। সে জানে মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ পাক পশুদের দেননি। তারপরেও কথা বলে। কথা বলতে তার ভাল লাগে–আমার পরিবার যখন আমারে নিতে আসবো তখন তোরেও ইনশাল্লাহ নিয়া যাব। কোন চিন্তা করিস না। আমার পরিবারের নাম হইল–শরুফা। পরিবারের নাম মুখে আনার জন্যে নসু খানিকটা লজ্জা বোধ করে। কাজটা ঠিক হয়নি। তারপরেও তার ভাল লাগে। শরুফার বিষয়ে আরো দুএকটা কথা তার বলতে ইচ্ছা করে। সে বলে না। পশুরা মানুষের জটিল কথা বুঝবে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। তাদের জগতে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরী হবে। কি দরকার?

1 Comment
Collapse Comments

It would be great if stories were written with proper spelling. I found so many spelling mistakes in this book.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *