শৃগাল
পরিবেশ সাপ্লাই করপোরেশান, একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কাজই হবে যখন যেখানে যেমন পরিবেশ প্রয়োজন হবে তৈরি করে দেওয়া। খেতাবধারী একাধিক এনভায়রনমেন্ট আর্কিটেক্ট এই প্রতিষ্ঠানের মাথা। চেয়ারম্যান কি ‘সাম’ ব্যানারজি! ব্যানারজি সাহেব বললে তিনি ভারি খুশি হন।
এই প্রতিষ্ঠান এখন কলকাতার পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। সব কাজই ধাপে-ধাপে এগোয়। প্রথমে সার্ভে। তারপর —ব্লু-প্রিন্ট। তারপর—একজিকিউসান। রোজ সকালে চেয়ারম্যানের ঘরে বৈঠক বসে। বৈঠকের নাম—একসপার্ট মিটিং।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষ হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, পড়ছি তা হলে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়ুন। পশ্চিমে, গোদাবরী…
গোদাবরী! ব্যানারজি সাহেব বাধা দিলেন, কোন শহরের কথা বলছেন মশাই! কলকাতার পশ্চিমে গোদাবরী! আবগারী বিভাগ আপনাকে যে ধরবে মশাই!
অ্যাম সরি, স্যার। সাউথ ইন্ডিয়ান প্রভাব।
করেক্ট করুন, করেক্ট করুন। কাজ কি হবে না হবে পরের কথা। রিপোর্ট-টাই থাকবে। ড্রেস মেকস এ ম্যান, রিপোর্ট মেকস ইন্ডিয়া। মাইলের পর মাইল রিপোর্টের দুব্বো দিয়ে ভারতকে মুড়ে দিয়ে….
কয়েক লক্ষ গরু ছেড়ে দাও।
মি: সেন, নো রসিকতা। স্বপ্ন দেখতে শিখুন, কল্পনাকে উদ্রিক্ত করতে শিখুন, চার্ন ইওর ইম্যাজিনেসান টু ফার্ন হাইট। বিশেষত আমরা যে ডিসিপ্লিনে আছি, সেখানে কল্পনাটাই আমাদের ক্যাপিটাল। স্বপ্ন দিয়ে একখানি ঘর বাঁধবো, বাঁধবোও ভালোবেসে। ও কতদিনের শোনা গান কিভাবে ফিরে এল মাইরি! সরি, শেষের শব্দটা মুখ ফসকে রিলিজড হয়েছে। একসপাঞ্জ ইঁট।
পশ্চিমে গঙ্গা, পুবে ধাপা।
ধাপা!
ইয়েস স্যার ধাপা নট ভাপা।
ধাপা বলবেন? আগলি শব্দ!
আছে যখন বাদ দি কি করে, আইডেন্টিফিকেসান মার্ক!
থাক তা হলে।
পুবে ধাপা। দক্ষিণে, দক্ষিণে কলকাতা, উত্তরে উত্তর কলকাতা।
বা: বা:। বেশ হয়েছে। নাইস! জিনিয়াস।
অনেক মাথা খাটিয়ে বের করতে হল, স্যার। তিন-চার রকমের কলকাতা আছে। স্যার। সি এম ডি-এর এক রকম, সি ই এস সি-র এক রকম, করপোরেশানের এক রকম, পুলিশের আর এক রকম। কে অত ঝামেলার মধ্যে যায়!
বেশ করেছেন, কলকাতা কি, তা সবাই জানে, কোথায়, তাও জানে। পড়ে যান।
পশ্চিমের গঙ্গা প্রায় বুজে এসেছে। খোঁচাখুঁচি করেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। ফারাক্কা ফেঁসে গেছে।
ফেঁসে গেছে মানে?
পার্পস সার্ভড। শব্দটা অনেক ভেবে বসিয়েছি। একে বলে ডিপ্লামেটিক শব্দ। যে যেমন মানে করে। পুবের ধাপায় সহস্র বছরের আবর্জনার স্তূপ। স্টুপাস অব জঞ্জালস। মাঝখানে মনুমেন্ট। চারপাশে প্যাসচারস ডটেড উইথ অ্যাপলজি গার্ডেনস। আকাশ থেকে কলকাতা দেখলে মনে হবে, ছ্যাতরান, ডেন্টেড, টিপটেড, এ পিস অফ ভূখণ্ড। ধুলো দিয়ে ধোঁয়া দিয়ে ঢাকা।
এ সুইপিং সার্ভে রিভিলস—০০০০০৫ পার্সেন্ট ফুটপাত অক্ষত আছে।
ফিগারটা চেক করেছেন তো!
অফকোর্স! রাস্তা! রাস্তার অবস্থা—হেঁ হেঁ রাস্তা।
তার মানে?
রাস্তাকে প্রশ্ন করা হলে, রাস্তা এইভাবেই উত্তর দেবে—লোকে বলে তাই আমি রাস্তা—হেঁ হেঁ।
ও আই সি! ভাববাচ্য!
ইয়েস স্যার, ভাববাচ্য। সবাই ভাবে তাই কলকাতা একটা শহর। আসলে এটা একটা ফ্রন্টিয়ার। ভীষণ লড়াই চলেছে এই রণভূমিতে! কয়েক গণ্ডা এজেনসিজ খাবলে খুবলে, কোদলা-কুদলি করে হালে আর পানি পাচ্ছে না। যে ভালো করেছিস কালী/ আর ভালোতে কাজ নেই মা/ এবার ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা/আলোয় আলোয় চলে যাই।
এটা কার ডায়ালগ?
প্ল্যানার ছাড়া সকলের। গ্রীক নাটকের কোরাস।
নাটক সম্বন্ধে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই। ঘাঁটাঘাঁটির সাহসও নেই। ‘আলসার’ আছে। টক নিষেধ। তবে শুনেছি সব গ্রীক নাটকের শেষেই ট্র্যাজেডি।
দ্যাটস রাইট।
তা হলে এই এলিমেন্টটা মনে রাখুন। আমাদের কাজের সুবিধে হবে। ট্র্যাজেডির উপাদান দিয়েই ভবিষ্যতের কলকাতাকে গড়ে তুলতে হবে। নিয়তিকে তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না! রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, সর্বত্রই নিয়তির অট্টহাসি। মনে রাখতে হবে, আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ দ্যাট টেল অফ স্যাডেস্ট থটস।
তা হলে এই ট্র্যাজেডির পরিবেশই আমাদের তৈরি করতে হবে। বন্ধুগণ! বন্ধুগণ শব্দটা উইথড্র করুন। দিস ইজ নট এ পলিটিক্যাল বক্তৃতা! ফ্রেন্ডস বলুন মেনে নেবো বাট নট দ্যাট বন্ধুগণ।
অলরাইট, ফ্রেন্ডস! ট্র্যাজেডির উপাদান কি কি? মৃত্যু, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, হত্যা, জিঘাংসা, জিজীবিষা, জুগুপ্সা, জুজু, টর্চার, ফ্রাকচার, ম্যাসাকার, হাহাকার, বিকার, অন্ধকার। এর থ্রি-ফোর্থ এই শহরে অলরেডি আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আনপ্ল্যানড ওয়েতে আছে। এদের মেজার্ড ডোজে, মার্কড এলাকায় সাজাতে হবে। প্রথমেই হল মৃত্যু। মৃত্যু না হলে বিচ্ছেদ আসে না, বিচ্ছেদ না হলে বিষন্নতা আসে না। সুতরাং মৃত্যুর নানা রকম ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। মৃত্যু যত আকস্মিক হবে, বেদনা তত জোরদার হবে। সার্ভে বলেছে মৃত্যুর একজিস্টিং অ্যারেঞ্জমেন্ট যা আছে তা হল—কিলিং ডিজিজ। ডিজিজ আমাদের আওতার বাইরে। গ্রীক অথবা শেকসপীরিয়ান ট্র্যাজেডিতে কেউ অসুখে মরেনি। অসুখ হল ন্যচারাল ফেনমেনান, নেচারস ন্যাচারাল। আমাদের পুরো কারবারটাই হল আনন্যাচারল নিয়ে। অতএব ডেথ-ট্র্যাপ তৈরি করতে হবে—মরণফাঁদ। মরণফাঁদ যা যা রয়েছে তার মধ্যে নাম্বার ওয়ান—পথ এবং পথ দুর্ঘটনা। এটাকে প্ল্যানড ওয়েতে বাড়াতে হবে। সকলের সহযোগিতার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে—বাসচালক, মিনিবাস চালক, ট্যাকসি ও প্রাইভেট গাড়ির চালক, লরি ড্রাইভার, পথচারী, পুলিশ। ইতিমধ্যেই যাঁদের মধ্যে সহযোগিতার ভাব উসখুস করছে তাঁরা হলেন—লরিচালক, মিনিবাস চালক, বাসচালক। এঁদের আর একটু মদত দিতে পারলে পুরা কাম খতম হোগা। মদত! কিভাবে মদত!
মদত নম্বর এক। পথের পাশে খাল খনন। যে কোনও গাড়িরই খালের দিকে, খাদের দিকে যাবার একটা সুস্থ প্রবণতা আছে। খাদলোভী, খালপ্রেমীরা তাই মাঝেমধ্যে ফুটপাথে চড়ে বসে। দিবসের ফুট আর রজনীর ফুটে অনেক তফাৎ। রজনীতে আরোহণ করলে একসঙ্গে অনেককে পিষ্ট করা যায়। রজনীতে আরোহনের জন্যে দ্রাক্ষারিষ্ট চাই। আমরা দেখেছি ট্র্যাজেডির সবচেয়ে বড় উৎস দ্রাক্ষা। আগেও দ্রাক্ষা, পরেও দ্রাক্ষা। দেবদাসের কথা স্মরণ করুন। প্রেম, বিচ্ছেদ, দ্রাক্ষা, ডেথ। মাঝে সামান্য থাইসিস। তাহলে একটি দ্রাক্ষানীতির প্রয়োজন। দ্রাক্ষা দ্রাক্ষৈব পরমাগতি।
এই খাদ-খননের ব্যাপারে আর একটি এজেনসি খুব তৎপর হয়েছে। আমরা তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাব। কিভাবে! আমরা তৈরি করব ডেথ-ট্র্যাপ। মনে রাখতে হবে, প্রথমে বিশ্বাস উৎপাদন, তারপরই ঝপাত করে পতন, ধড়ফড়, ধড়ফড় মৃত্যু। সাধারণ মানুষের পায়ের তলা থেকে পাটাতন সরিয়ে নিতে হবে আচমকা। এই ব্যাপারে ডেকিং আমাদের চমৎকার সাহায্য করতে পারে হামেসাই কেভইন করে। তাহলে মেথড ওয়ান হল—ডেকিং কেভইন।
এইবার বন্ধুগণ, সরি ফ্রেন্ডস! এইবার একবার চোখ বুজিয়ে মানসচক্ষে দেখুন—চৌরঙ্গী, পার্কস্ট্রিট ইত্যাদি অঞ্চলের সেই কাটাখালের চেহারা। গভীর, পঙ্কিল। আচ্ছা, চোখ খুলুন। পরবর্তী পর্যায় হল, অপারেশন ক্রোকোডাইল। আমরা ‘র্যান অফ কাছ’ থেকে কিছু কুমির আনাব। সেখানে না পেলে আফ্রিকা থেকে। ওই কর্দমাক্ত গহ্বরে কুমির! ভাবা যায় না। পার্কের ইঁদুরতলায় কলকাতার মানুষ কাজকর্ম ছেড়ে মুড়ি খাওয়াবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েন। কুমির দেখলে তারা তো নেচে উঠবেন। বিশেষত মহিলারা। শৈশবের সেই কুমির-কুমির খেলার দিনগুলি মনে পড়ে যাবে। ডেকিং-এর রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়বেন, কুমির তোর জলকে নেমেছি। এদিকে টন টন গাড়ি চলেছে, লোক চলেছে। এমন সময় ডেক ভেঙে ধুস। উপোসী কুমিরের পেটে কয়েকশ মানুষ। ব্যানার হেডলাইন। টেলিগ্রাম। হই হই, রই রই। সভা, সমিতি, মিছিল। রাজনৈতিক দলাদলি। রাজভবন ঘেরাও। মৃদুলাঠি, কড়ালাঠি, টিয়ার গ্যাস, গুলি। একেই বলে স্নোবল এফেক্ট।
কল্পনা করুন। ইডেন উদ্যান। সময় : প্রথম রাত। ঝোপের পাশে-পাশে, জোড়া- জোড়া ফিসফাস। ওদিকে গেট দিয়ে জিভ চাটতে-চাটতে ডোরা বেঙ্গল ঢুকছে। কেউ জানে না কে আসছে! প্রেমে মশগুল। জলের ধারে বসে থাকা প্রথম জোড়াটাকে তেমন পছন্দ হল না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে চলে গেল। প্রেমিকা প্রেমিককে সুর করে বললেন, দ্যাখোওও, দ্যাখোওও, কি সুন্দর একটা কুকুর। প্রেমিক বললেন, রাখো কুকুর। তুমি ওর চেয়েও সুন্দর, উম। তৃতীয় জোড়ার ঘাড়ে ততক্ষণে বাঘ লাফিয়ে পড়েছে—হালুম। পরের দিন হেডলাইন—ইডেনে বাঘ। সংবাদে প্রকাশ, একই সময়ে, কার্জনপার্কে জনৈক নাদুস চ্যাটাইতে চিত হয়ে শুয়ে মালিস নিচ্ছিলেন, দুজনেই বাঘের পেটে। নিউ মার্কেটেও একটি বাঘ ন্যাজ নেড়ে-নেড়ে ঘুরছিল। বিলিতি কুকুর ভেবে অনেকে আদর করে মাথায় চাঁটিফাঁটি মেরেছিল, তারপর হঠাৎ আলো নেভার সঙ্গে-সঙ্গে একটি খাসা জিনিস মুখে করে গ্লোবের গলিতে ঢুকে গেছে। মিনতির শাশুড়ি আমাদের সংবাদদাতাকে চোখ বড়-বড় করে বলেছেন—বোঁটকা গন্ধ শুঁকে আমি ঠিকই ধরেছিলুম বাবা, বউমা ধমকে উঠল, চুপ করুন তো কলকাতায় আবার বাঘ আসবে কোথা থেকে। যখন মুখে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তখন আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, কেমন লাগছে। তা বাবা মুখ দিয়ে কেবল বা-বা-বা বেরোল। অজ্ঞান হয়ে গেলুম। বড় ভালো হয়েছে, ছেলের আবার বে দোবো, নগদ দশ হাজার।
বড় বাঘ তেমন মানাবে না, পরিবেশের সঙ্গে তেমন খাপ খাবে না। মিনিবাসের জন্যে মিনি বাঘ চাই। যেখানে সেখানে ঘুরবে। তোমায় চিনি গো, চিনি গো করতে-করতেই তিনি জলযোগ শেষ করে ফেলবেন। এই গুল বাঘ কোথা থেকে আমদানী করা যায় ভেবে দেখতে হবে।
উত্তর কলকাতার জন্যে বেশ বিগ সাইজের, ফ্রেশ কিছু ঠ্যাঙাড়ে আর ফাঁসুড়ে চাই। দক্ষিণ কলকাতার জন্যে চাই আধুনিক ধরনের কিছু ‘টেকসান গ্যাঙস্টার’। নদীপথে বর্গীর হামলার মতো নতুন কিছু হামলা উদ্ভাবন করতে হবে। সন্ধে নামলেই ঘোর অন্ধকার, ভিন-ভিন মশা, ঠ্যাঙাড়ে, ফাঁসুড়ে, কাউবয়, জলদস্যু। ভাবা যায় না। রোমানস, ট্র্যাজেডি, ফিয়ার। কি সাংঘাতিক উত্তেজনা ডিয়ার! রঙমহলের সামনে সত্যিকারের কার্ভালো ঘুরছে। হ্যাঁগো, কোনও অভিনেতা নয়, রিয়েল কার্ভালো, এই দ্যাখো মাইরি, সব খুলে নিয়েছে, পাঁচ ভরি ফাঁক। আর কিছু করেনি তো! না, না, ভীষণ ভদ্র। দেবভাষায় মুখপোড়াটা শুধু বললে, মাত: বঙ্গজননী, তব বক্ষ বিদীর্ণ করি তুলে দাও মণিহার, কর্ণকুণ্ডল, বাজুবন্ধ। সে কী হাসি! এগজ্যাক্ট স্টেজের কার্ভালো।
দুশো বছর পরে, পাক্কা দুশো বছর পরে, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঠ্যাঙাড়ে দেখা গেল। বেলগেছের ব্রিজে আবার ফাঁসুড়ে। রাসবিহারীতে গান ডুয়েল। বিশুডাকাত, রঘুডাকাতের সেকেন্ড এডিশান তৈরির দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। বন্ধ কলকারখানা, অচল চটকল, পাটকল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেস্ট হবে এদের পীঠস্থান। সেখানেই এদের কালচার করতে হবে। দেখতে হবে হাইব্রিড তৈরি করা যায় কি না। ডাকাতের সঙ্গে ঠ্যাঙাড়ে ক্রস করে, কি ঠ্যাঙাড়ের সঙ্গে কাউবয়।
আচ্ছা! চেয়ারম্যান, স্যার। আপনি একটা হিসেব চেয়েছিলেন। আমি একটা একমেটে ব্রেকডাউন তৈরি করেছি। ইডেনে দশ জোড়া, বিবাদি বাগে তিরিশ জোড়া, চৌরঙ্গীতে একশো জোড়া, এইভাবে সারা কলকাতার জন্যে প্রয়োজন হাজার দুয়েক পেয়ার। এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের শেয়ালরা সব গেল কোথায়! সব পণ্ডিত হয়ে গেল নাকি! হতেও পারে। তা না হলে দেশে শেয়ালের সংখ্যা কমে পণ্ডিতের সংখ্যা এত বেড়ে গেল কি করে!
চেয়ারম্যান চেয়ারে নড়েচড়ে বললেন, শেয়াল ছাড়া রাত জমে না, অন্ধকারের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়ে যায়! শেয়াল বড় তান্ত্রিক, বড় মিসটিক। শেয়াল ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। হ্যাঁ, কোথায় লাগে জ্যোতিষী! দুর্ভিক্ষের আগে ডাকতে থাকে, ক্রাইমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে মাঝরাতে আহত সৈনিকের আর্তনাদ, আর মাঝে-মাঝে শেয়ালের ডাক, আনন্দমঠে শেয়ালের ডাক, তারাশঙ্করের পঞ্চগ্রামে শেয়ালের ডাক, খালি নীলকুঠির ভাঙা চাতালে দাঁড়িয়ে শেয়ালের ডাক, তারাপীঠের মহাশ্মশানে শেয়ালের ডাক। শিবা, শিবা। তন্ত্র, তান্ত্রিক, নরবলি। এই অন্ধকার মজা-হাজা কলকাতায় প্রহরে-প্রহরে শৃগালের হাহাকার চাই।
চেয়ারম্যান ঠিকই বলেছেন, অন্ধকার এসেছে, এইবার শেয়াল আনাতে হবে। কবিরাজী ওষুধের মতো, অন্ধকারের অনুপান শেয়াল। মনে পড়ে সেই অতীতের কথা! প্রহরে-প্রহরে পেটা ঘড়ি বাজছে, চৌকিদার হেঁকে যাচ্ছে, সাবধান! আর্তচিৎকারে রাত চমকে উঠছে। ভারি কিছু বয়ে নিয়ে যাবার শব্দ। ছুটে পালাচ্ছে আততায়ীর দল। মা বুকের কাছে সন্তানকে চেপে ধরছেন। আকাশের দিকে মুখ তুলে শেয়াল ডাকছে। একবার ভেবে দেখুন, জীবনের তারটাই কেমন পাল্টে যাবে। বিবাদিবাগের জলের ধারে দাঁড়িয়ে ভর সন্ধেবেলায় কোরাসে শেয়াল ডেকে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে অফিসের বাবুরা দপ্তর গুছিয়ে দ্রুত রাস্তায় নেমে এলেন, বাড়ি চল, বাড়ি চল। মারমুখী বাস, ট্রাম অন্ধকারে আসছে যাচ্ছে, যেন অবরুদ্ধ নগরীতে নাজি সাঁজোয়া বাহিনী। কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে বন্দীদের নিয়ে চলেছে। থামঅলা বিশাল-বিশাল বাড়ির অন্ধকার ছায়া পেরিয়ে যেতে-যেতে মনে হবে—কারফিউ টোলস সি নেল অফ দি পার্টিং ডে।
প্রস্তাব একা। শেয়ালদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আলাদা একটা দপ্তর চাই। ফুল ফ্লেজেড একজন মন্ত্রী চাই। একটা ডাইরেকটরেট চাই। মনে রাখতে হবে, শেয়ালের মান-সম্মান জ্ঞান মানুষের চেয়েও বেশি। কত কাহিনির নায়ক, যুগ-যুগ ধরে, এই শেয়াল। সেই শেয়ালকে নতুন করে ইনট্রডিউস করতে হবে, জাপানী জাতের রেশম চাষের মতোই যত্ন নিতে হবে।
প্রস্তাব দুই। বিভিন্ন জাতের শেয়াল আছে—রেড ফকস, গ্রে ফকস, আর্কটিক ফকস, কিট ফকস, সুইস ফকস, ফেনেক ফকস। আমরা আফ্রিকা থেকে আপাতত দু হাজার পেয়ার কিট ফকস আনাব। বড়-বড় কান, ছোট চেহারা, চটপটে। গরম সহ্য করতে পারে, জল কম খায়। বাঙালির চেয়েও ধূর্ত।
প্রস্তাব তিন। আপাতত এরা অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত ভূগর্ভ সুড়ঙ্গে থাকবে অভিজ্ঞ তত্বাবধানে। যদি ইচ্ছে করে, কলকাতার তলায়-তলায় আরও কিছু গর্ত খুঁড়ে কলকাতার পুরো বুনিয়াদটাকে আরও একটু নড়বড়ে করে আমরা যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছি সেই মহৎ কাজে সাহায্য করতে পারে।
প্রস্তাব চার। এরা যদি এই পরিবেশে প্রাণ খুলে ডাকতে ইতস্তত করে, করতেও পারে, তার জন্যে আগেভাগেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। সে ব্যবস্থা নেবেন শেয়াল মন্ত্রণালয়। অভিজ্ঞ কিছু গায়ক তাঁরা নির্বাচন করবেন। শেয়ালের ডাকের স্বরলিপি তৈরি করে…
ও: মোস্ট ডিফিকাল্ট টাস্ক! প্রথমে হুককাটা ধরে মুদারায়, মনে হয় গান্ধারে তারপর কিভাবে সড়াৎ করে কা হুয়ায় চলে যায়, একেবারে তারার পঞ্চমে, সেখানে গিয়ে সকালের জিভ ছোলার মতো—কা হুয়া, কা হুয়া, কা হুয়া। ইয়েস, স্বরলিপি একটা চাই।