শূন্য শুধু শূন্য নয়

শূন্য শুধু শূন্য নয়

বাংলা দেশের নরম মাটি শেষ হইয়া যেখানে ছোটনাগপুরের পাথুরে কঠিনতা আরম্ভ হইয়াছে, সেইখানে একটি ছোট রেলের স্টেশন। স্টেশন ঘিরিয়া দুই-চারিটি লোকালয়। বেশির ভাগ ট্রেন এখানে থামে না, হুইস্‌ল্‌ বাজাইয়া টিটকারি দিতে দিতে চলিয়া যায়। দুই-একটা অতি-মন্থর যাত্রী ট্রেন থামে। আর মালগাড়ি থামে।

স্থানটির পরিবেশ অতিশয় নিঝুম। যে দুই-চারিটি মানুষ এখানে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, তাহাদের প্রকৃতিও নিঝুম। লোকগুলিকে দেখিলে মনে হয় তাহারা এইমাত্র ঘুম হইতে উঠিয়াছে কিংবা এখনই ঘুমাইয়া পড়িবে। স্টেশন হইতে আধ মাইল দূরে একটি ছোট্ট নিস্তরঙ্গ নদী আছে; সেটিও যেন ঘুমের ঘোরে চলিতে চলিতে উপলশয্যার উপর ঝিমাইয়া পড়িয়াছে।

পূর্ব বা পশ্চিম হইতে ট্রেন আসিয়া স্টেশনে থামিলে কদাচিৎ দুই-একটি গ্রাম্য যাত্রী মোটঘাট লইয়া গাড়ি হইতে অবতরণ করে, তারপর মোটঘাট মাথায় তুলিয়া দিগন্তে বিলীন হইয়া যায়। স্টেশন হইতে যে পথটি অসমতল দিগন্তের পানে চলিয়া গিয়াছে, সেটির কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থান আছে বলিয়া মনে হয় না। মনে হয়, এই পথে কিছুদূর চলিলেই দেখা যাইবে, পাথরের কোন এক ফাটলের মধ্যে ঢুকিয়া পথটি পাহাড়ী ময়াল সাপের মতো কুণ্ডলী পাকাইয়া ঘুমাইতেছে।

ঘুম-নগরীর রাজকুমারীর দেশ। কেবল রাজকুমারীর সন্ধান কেউ জানে না।

একদা চৈত্র মাসের অপরাহ্নে পুব দিক হইতে একটি অতি-মন্থর যাত্রী-গাড়ি আসিয়া স্টেশনে থামিল। একটি মাত্র যাত্রী গাড়ি হইতে নামিল। ভদ্ৰশ্রেণীর বাঙালী যুবক; সঙ্গে অনেক লটবহর— একটা তোরঙ্গ, দুইটা কাঠের বাক্স, দুইটা পরিপুষ্ট চটের বোরা, একটা স্থূল হোল্‌ড-অল্, একটি ইক্‌মিক্‌ কুকার। গাড়ির অন্য যাত্রীদের সাহায্যে মালগুলি নামাইবার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ফোঁস ফোঁস শব্দে অসন্তোষ জ্ঞাপন করিতে করিতে চলিয়া গেল।

যুবকের চেহারা শৌখীন গোছের। লম্বা রোগা গড়ন, মাথার চুল ঢেউ খেলানো, কানের মূল পর্যন্ত জুল্‌পি নামিয়া আসিয়াছে, পাতলা গোঁফ; চোখে ধোঁয়াটে কাচের চশমা। বয়স আন্দাজ তেইশ-চব্বিশ।

যুবক এদিক ওদিক চাহিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইল না। তখন সে স্টেশন মাস্টারের প্রকোষ্ঠের দ্বারে গিয়া দাঁড়াইল।

স্টেশন মাস্টার মধ্যবয়স্ক হিন্দুস্থানী; ট্রেন পাশ করিয়া দিয়া তিনি ইজি-চেয়ারে লম্বা হইয়া আর এক প্রস্থ ঝিমাইবার উপক্রম করিতেছিলেন, যুবককে দেখিয়া খাড়া হইয়া বসিলেন এবং চোখে চশমা পরিলেন। মোটা কাচের ভিতর দিয়া তাঁহার চোখের বিস্ময় আরও বিবর্ধিত আকারে দেখা দিল। এ স্টেশনে এই শ্রেণীর যাত্রী তিনি বেশি দেখেন নাই।

যুবক বলিল, ‘স্টেশনে কুলি দেখছি না। কুলি কোথায়?’

স্টেশন মাস্টার উঠিয়া আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইলেন এবং আরও কিছুক্ষণ বিবর্ধিত নেত্রে যুবককে নিরীক্ষণ করিলেন। কিন্তু যুবকের প্রশ্নের উত্তর তিনি দিলেন না; কারণ উত্তর দিতে হইলে বলিতে হয়, স্টেশনের একমাত্র কুলি স্টেশন মাস্টারের হুকুমে অদূরবর্তী তালগাছে চড়িয়া তাড়ির ভাঁড় পাড়িতে গিয়াছে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’

যুবক বলিল, ‘কাছেই বাজ-পড়া বাংলা আছে— সেইখানে।’

স্টেশন মাস্টারের নয়ন বিস্ফার এবার চশমার কাচকে ছাড়াইয়া গেল। তিনি কিয়ৎকাল স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘বাজ-পড়া বাংলা! মোহনলাল শেঠের কুঠি! সেখানে তো কেউ নেই। তালা লাগানো।’

যুবক পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া বলিল, ‘এই যে বাড়ির চাবি। মোহনলাল আমার বন্ধু, আমাকে তাঁর বাংলায় থাকতে দিয়েছেন।’

‘ও— তা—’ স্টেশন মাস্টারের গলায় হঠাৎ যেন ব্যাঙ ডাকিয়া উঠিল, ‘আপনি ওখানে থাকবেন?’

যুবক ভ্রূ তুলিল, ‘থাকব না কেন?’

স্টেশন মাস্টার ঘরের বাহিরে আসিলেন, সন্তর্পণে প্ল্যাট্‌ফর্মের চারিদিকে চাহিলেন, তারপর ষড়যন্ত্রকারীর মতো গাঢ় নিম্নস্বরে বলিলেন, ‘ও বাংলায় যাবেন না।’

‘সে কি! কেন?’

‘ও বাংলায় দেও আছে।’

যুবকের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা দিল— ‘দেও! মানে— ভূত?’

স্টেশন মাস্টার ঘাড় নাড়িয়া সশঙ্ক সম্মতি জানাইলেন। যুবক হাসিয়া উঠিল— ‘ভালই হল, একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে।’

স্টেশন মাস্টার এবার গম্ভীর হইয়া গেলেন।

যে অর্বাচীন ভূত-প্রেত লইয়া তামাসা করে, তাহাকে সদুপদেশ দিতে যাওয়া পণ্ডশ্রম। তিনি হাত বাড়াইয়া বলিলেন, ‘আপনার টিকিট?’

যুবক টিকিট বাহির করিয়া দিল।

স্টেশন মাস্টার টিকিট পরীক্ষা করিলেন, তারপর টিকিট পকেটে রাখিয়া নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘কুলি জরুরি কাজে বাইরে গেছে। আপনার যদি মুটে দরকার থাকে, স্টেশনের বাইরে যান। সামনেই মুদির দোকান আছে, সেখানে লোক পাবেন।’

যুবক বাহিরে গিয়া মুদির দোকান পাইল। দোকানটি একাধারে মুদির এবং ময়রার দোকান। এক দিকে চাল ডাল মশলা, অন্য দিকে লাড্ডু মিঠাই পকৌড়ি। ময়রা দোকানে বসিয়া পকৌড়ি ভাজিতেছিল এবং দুইজন অন্তরঙ্গের সঙ্গে স্তিমিত কণ্ঠে আলাপ করিতেছিল, যুবককে দেখিয়া সচকিত হইয়া উঠিল। তারপর যুবকের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া তাহাদের একেবারে চক্ষুস্থির হইয়া গেল। ভূতের বাড়িতে মানুষ থাকিবে, এত বড় বুকের পাটা!

যা হোক, মোট বহনের প্রস্তাবে মুদি আপত্তি করিল না, বরং এক টাকা মজুরির লোভে সবান্ধবে প্ল্যাট্‌ফর্মে আসিয়া মোট মাথায় তুলিয়া লইল।

যুবক লক্ষ্য করিল, বাজ-পড়া বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করিবার পূর্বে মুদি নিজের দোকান হইতে কিছু মিষ্টান্ন ও তেলেভাজা পুঁটুলি করিয়া বাঁধিয়া লইল।

যুবক মোটবাহীদের সঙ্গে চলিতে চলিতে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সঙ্গে খাবার নিলে যে! বাজ-পড়া বাড়ি কি অনেক দূর?’

মুদি বলিল, ‘জি, না— কাছেই। খাবার নিলাম দেওকে চড়াব বলে।’

যুবক বলিল, ‘ও— ভূতকে খেতে দেবে। খাসা ভূত তো, পিণ্ডি খায় না, তেলেভাজা খায়!’

‘জি। আমরা সবাই পালা করে ভোগ দিই।’

‘ভোগ না দিলে কী হয়?’

‘তা কি বলা যায় হুজুর! ঘরে আগুন লেগে যেতে পারে।’

মুদির একজন সাথী বলিল, ‘ভূত আজ পর্যন্ত কারুর ঘরে আগুন লাগায়নি হুজুর, কিন্তু একদিন খাবার না পেলেই কারুর না কারুর ঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে যায়, ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করে। তাই আমরা ব্যবস্থা করেছি, যার যেদিন পালা সে সেদিন মুদিভাইকে চার পয়সা দেয়, মুদিভাই দেওকে খাবার দিয়ে আসে।’

‘হুঁ। ভূতকে তোমরা কেউ দেখেছ?’

‘গোড়ার দিকে কেউ কেউ ছায়ামূর্তি দেখেছিল, এখন আর দেখা যায় না।’

‘ভূত বাজ-পড়া বাড়িতে থাকে জানলে কি করে?’

‘বাড়িতে বাজ পড়ার কিছুদিন পর থেকেই ভূতের আবির্ভাব হয়েছে, আজ দশ বছরের কথা। যারা বজ্রাঘাতে মরেছিল তাদেরই একজন ভূত হয়ে আছে।’

বাজ-পড়া বাড়ির একটু ইতিহাস আছে। পনের-ষোল বছর আগে মদন শেঠ নামক একজন ধনী ব্যবসাদার অর্থোপার্জনের ক্লান্তি বিনোদনের জন্য নিভৃত স্থানে এই বাড়ি করিয়াছিলেন; তিনি বছরে দুই-একবার আসিয়া বাড়িতে বাস করিতেন; বাড়ি খালি থাকিলে তাঁহার ব্যবসায়ের অংশীদার নিধিরাজ মল্লিকও মাঝে-মধ্যে আসিতেন। একবার বছর দশেক আগে নিধিরাজ আসিয়া এখানে বাস করিতেছিলেন, সঙ্গে স্ত্রী ও অল্পবয়স্ক পুত্রকন্যা ছিল। গ্রীষ্মকাল, একদিন কালবৈশাখীর ঝড় দেখা দিল। ঝড় থামিলে দেখা গেল, বাড়ির মাথায় বজ্রপাত হইয়াছে; নিধিরাজ মল্লিক ও তাঁহার পরিবারের কেহই জীবিত নাই। খবর পাইয়া বাড়ির মালিক মদন শেঠ যখন আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন অধিকাংশ মড়া শৃগালে টানিয়া লইয়া গিয়াছে। মদন শেঠ সেই যে বাড়িতে তালা লাগাইয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন, আর বাড়িতে পদার্পণ করেন নাই। তারপর মদন শেঠের মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার পুত্র মোহনলাল এখন বাড়ির মালিক। সেও এ পর্যন্ত বাড়িতে পদার্পণ করে নাই। কেবল বন্ধুকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য তাহাকে বাড়িতে থাকিতে দিয়াছে। আমাদের পরিচিত যুবকই সেই বন্ধু।

এই সূত্রে যুবকের অজ্ঞাতবাসের ইতিহাস এখানে বলিয়া লওয়া যাইতে পারে। যুবকের নাম গৌরমোহন সাহা। বড় মানুষ ব্যবসাদারের একমাত্র সন্তান হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াও সে যখন ছবি আঁকিতে শুরু করিল, তখন তাহার পিতৃদেব মনের দুঃখে ইহলীলা সংবরণ করিলেন। বাড়িতে রহিল গৌরমোহন ও তাহার বিমাতা শশিমুখী। শশিমুখী বিমাতা হইলেও গৌরমোহনকে ভালবাসিতেন, তাহার নিজের পুত্রকন্যা ছিল না। তিনি তাহাকে পৈতৃক ব্যবসায়ে নিয়োজিত করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে ছবি আঁকিতে লাগিল। ছেলের ইহকাল পরকাল নষ্ট হইয়া যায় দেখিয়া শশিমুখী তাহার বিবাহের আয়োজন করিলেন; কারণ পুরুষের মন সংসারধর্মে আকৃষ্ট করার পক্ষে বিবাহই সর্বোৎকৃষ্ট মুষ্টিযোগ। শশিমুখী তাঁহার ভগিনীর দেবরের কন্যার সহিত সম্বন্ধ করিলেন; কিন্তু গৌরমোহন তপোভঙ্গের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিয়া একাগ্রমনে ছবি আঁকিয়া চলিল। সে বর্তমান যুগের অনৈসর্গিক শৈলীর চিত্রকর, মনের ছবি আঁকে, স্রেফ রঙ দিয়া কাম-ক্রোধাদি ষড়রিপুর রূপদান করে। তাহাকে স্থুল পিশিতপিণ্ড দিয়া প্রলুব্ধ করা সহজ নয়।

শশিমুখী কিন্তু হাল ছাড়িবার পাত্রী নয়। কন্যার রূপযৌবনের সাড়ম্বর বর্ণনা শুনিয়া যখন গৌরমোহন ঘামিল না, কন্যাকে স্বচক্ষে দেখিয়াও যখন সে অটল রহিল, তখন শশিমুখী যুক্তিতর্কের পথ ছাড়িয়া সবলতর পন্থা অবলম্বন করিলেন।

একদিন গৌরমোহনকে বলিলেন, ‘পরশু, রবিবারে ওরা তোমাকে আশীর্বাদ করতে আসবে। সব ঠিক হয়ে গেছে, আর দেরি করা চলবে না।’

নোটিস নয়, সমন নয়, একেবারে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। গৌরমোহনের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। কিন্তু সে মায়ের সঙ্গে কখনও তর্ক করে না, তাঁহার কথার অবাধ্য হইবার মতো রূঢ়তাও তাহার চরিত্রে নাই। একান্ত অসহায় ভাবে সে ছুটিয়া গেল তাহার প্রাণের বন্ধু মোহনলালের কাছে। মোহনলাল গৌরমোহনের সমবয়স্ক হইলেও বিবাহিত এবং বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন যুবা। সে গৌরমোহনকে সৎ পরামর্শ দিল; বুঝাইয়া দিল যে পলায়ন করিলে মাতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করা হয় না। কিছুদিন অজ্ঞাতবাস করিলেই মাতৃদেবী ধাতস্থ হইবেন।

অতঃপর গৌরমোহন আর নিজের বাড়িতে ফিরিয়া যায় নাই, বাজ-পড়া বাড়ির চাবি লইয়া অজ্ঞাতবাসে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। অবশ্য বাড়িটার যে ভৌতিক দুর্নাম আছে, তাহা সে পূর্বাহ্নে জানিতে পারে নাই; পারিলেও বোধ করি সঙ্কল্পচ্যুতি হইত না।…

পনের মিনিট পরে লটবহর লইয়া গৌরমোহন বাজ-পড়া বাড়ির সম্মুখীন হইল। জীর্ণ-স্খলিত পাঁচিল-ঘেরা বিঘাখানেক স্থান শুষ্ক আগাছায় ভরা, তাহার মাঝখানে ছোটখাটো একতলা একটি বাড়ি। প্রবেশ-পথের ফটক অদৃশ্য হইয়াছে; কেবল থাম দুটা দাঁড়াইয়া আছে। থামের দুই পাশের ঝাঁকড়া দুটা পাকুড় গাছ প্রবেশ-পথের উপর তোরণ রচনা করিয়াছে; এই তোরণের ভিতর দিয়া ত্রিশ-চল্লিশ গজ পিছনে বাড়িটি দেখা যায়।

ফটকে প্রবেশ করিবার পূর্বে মুদি খাবারের পুঁটুলি পাকুড় গাছের ডালে টাঙাইয়া দিল। গৌরমোহন বলিল, ‘ভূত বুঝি ঐ গাছে বসে খানাপিনা করে?’

মুদি উত্তর দিল না। ভূতের আস্তানায় দাঁড়াইয়া ঠাট্টা ইয়ার্কি করা তাহার নিরাপদ মনে হইল না।

অতঃপর বাড়ির দিকে চলিতে চলিতে গৌরমোহন লক্ষ্য করিল, ফটক হইতে আরম্ভ করিয়া বাড়ি পর্যন্ত আগাছার ভিতর দিয়া অস্পষ্ট একটি পায়ে-হাঁটা পথের চিহ্ন গিয়াছে। কঠিন মাটির উপর কোনও দাগ নাই, কেবল শুকনা আগাছা দুই পাশে একটু সরিয়া গিয়া যেন যাতায়াতের পথ ছাড়িয়া দিয়াছে।

‘এ বাড়িতে কেউ থাকে নাকি?’

মুদি চোখ কপালে তুলিল, ‘কে থাকবে হুজুর? কার এত সাহস!’

‘চোর-ডাকাত?’

‘এদেশে মানুষই নেই, যারা আছে তাদের পয়সা নেই। চোর-ডাকাত কি জন্যে আসবে! আমরা বিশ বছরের মধ্যে চোর-ডাকাতের নাম শুনিনি।’

গৌরমোহন ভাবিল, হয়তো শিয়াল-কুকুর এদিক দিয়া যাতায়াত করে। আরও কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিল, অস্পষ্ট পথটা বাড়ির সদরে না গিয়া বাড়ির পাশ বেড়িয়া পিছন দিকে চলিয়া গিয়াছে।

সদর দরজায় মরিচা-ধরা তালা লাগানো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করিবার পর তালা খুলিয়া গেল।

গৌরমোহন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল।

সে প্রত্যাশা করিয়াছিল, বহুকালের অব্যবহৃত বাড়ির মেঝেয় পুরু হইয়া ধূলা জমিয়াছে। ঘরের কোণে কোণে ময়লা মাকড়সার জাল ধূলার ভারে ঝুলিয়া পড়িয়াছে; সে মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল, কুলিদের আরও কিছু পয়সা দিয়া অন্তত একটা ঘর পরিষ্কার করিয়া লইবে।

কিন্তু এ কি! ঘরের মেঝে তক্‌তক্‌ করিতেছে, কোথাও একটু অপরিচ্ছন্নতার চিহ্ন নাই। যেন অতিথির আগমন প্রত্যাশায় কেহ সমস্ত ঝাড়িয়া মুছিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছে।

গৌরমোহন অন্য ঘরগুলিতে গিয়া দেখিল। বাস করিবার জন্য গুটিচারেক ঘর, তাছাড়া রান্নাঘর স্নানের ঘর ইত্যাদি। সমস্তই ঝাড়ামোছা, ব্যবহারে সুমার্জিত।

বাড়ি বহুকাল বন্ধ থাকিলে দূষিত বায়ুর যে অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতা গন্ধ পাওয়া যায়, তাহা একেবারে নাই। বরং যে গন্ধটা গৌরমোহনের নাকে আসিল, তাহা এ বাড়ির পক্ষে বড়ই বিস্ময়কর। মানুষের গন্ধ! যে বাড়িতে সর্বদা মানুষ বাস করে, সে বাড়ির বাতাসে একটি সহজ স্বাভাবিক গন্ধ আছে তাহা আমরা পাই না— রূপকথার রাক্ষসেরা বোধ হয় পায়— এ সেই গন্ধ! কিন্তু এ গন্ধ এ বাড়িতে আসিল কোথা হইতে? বাড়ির দরজায় তালা লাগানো ছিল—

গৌরমোহনের গায়ে হঠাৎ কাঁটা দিল। ইহা ভয়ের রোমাঞ্চ নয়, স্বতঃপ্রবৃত্ত স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া। মনকে দৃঢ় করিয়া সে বাহিরের ঘরে ফিরিয়া আসিল।

মুদি ও তাহার সঙ্গী দুইজন মোটঘাট নামাইয়া অস্বচ্ছন্দ ভাবে অপেক্ষা করিতেছিল, গৌরমোহন তাহাদের মজুরি দিল।

মুদি বলিল, ‘হুজুর, আপনার রাত্রিতে খানাপিনার কী হবে? যদি হুকুম করেন, গরম গরম পুরি তরকারি এনে দিতে পারি।’

গৌরমোহন বলিল, ‘আজ রাত্তিরে কিছু দরকার হবে না, আমার সঙ্গে যা আছে তাতেই চলে যাবে। যদি কিছু দরকার হয়, কাল সকালে তোমার দোকানে যাব।’

‘জি হুজুর’—

মুদি সঙ্গীদের লইয়া চলিয়া গেল।

তাহারা চলিয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে গৌরমোহনের মনে হইল, সে একেবারে একা! সে নিজেকে বুঝাইল, একা থাকিবার জন্যই তো সে এখানে আসিয়াছে। সে নিজে নিজের জন্য রাঁধিবে, খাইবে, ঘুমাইবে— আর মনের সুখে ছবি আঁকিবে। নিরন্তর ‘বিয়ে কর, বিয়ে কর’— এই তাগাদা শুনিতে হইবে না।

সূর্যাস্তের এখনও দেরি আছে, তবে রৌদ্রের রঙ হল্‌দে হইয়া গিয়াছে।

গৌরমোহন বাড়ির বাহিরে আসিল। এককালে বোধ হয় বাড়ি ঘিরিয়া ফুলের বাগান ছিল, এখন বাগানের চিহ্নমাত্র নাই। বর্ষার জল পাইয়া যে আগাছা প্রতি বৎসর জন্মগ্রহণ করে, তাহাও এখন রোদে পুড়িয়া খড় হইয়া গিয়াছে। সেই খড়ের ভিতর দিয়া অস্পষ্ট পায়ে-হাঁটা পথের ইশারা।

গৌরমোহন সেই ইশারা অনুসরণ করিয়া বাড়ির পিছন দিকে চলিল। ওদিকটা এখনও দেখা হয় নাই।

পথটি বাড়ির পাশ দিয়া গিয়া পিছনে খিড়কির দরজার কাছে শেষ হইয়াছে। গৌরমোহন দরজা ঠেলিয়া দেখিল ভিতর হইতে বন্ধ। তারপর সে পিছন দিকে ঘাড় ফিরাইয়া একেবারে চমৎকৃত হইয়া গেল।

পিছন দিকে পাঁচিল নাই, তৎপরিবর্তে চওড়া সিঁড়ি ধাপে ধাপে নামিয়া গিয়াছে। যেখানে সিঁড়ি শেষ হইয়াছে, সেখানে স্বচ্ছ শীর্ণ একটি নদী বিরল-বাস পাহাড়ী মেয়ের মতো শুইয়া আছে। ওপারে শিলাখণ্ড রচিত ঢালু পাড়।

বাড়ির পিছন দিকে লুকানো এই দৃশ্যটি দেখিয়া গৌরমোহন মুগ্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। চারিদিকের শিলাসঙ্কুল শুষ্কতার মাঝখানে দৃশ্যটি যেন আরও শ্ৰীমন্ত হইয়া উঠিয়াছে।

যাহারা এই নিভৃত স্থানে বাড়ির পিছন দিকে পাথর বাঁধানো ঘাট তৈয়ার করিয়াছিল, তাহারা কাল-স্রোতে ভাসিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু ঘাটটি এখনও জীবন্ত রহিয়াছে, নূতন মানুষের পদধ্বনি শুনিবার আশায় উৎসুক চক্ষে অপেক্ষা করিতেছে।

গৌরমোহন ঘাটে গিয়া দাঁড়াইল; তাহার শিল্পী-চক্ষু চারিদিকে ফিরিয়া দৃশ্যটির রস গ্রহণ করিল। তারপর সে জুতা খুলিয়া ঘাটের নিম্নতম পৈঠায় গিয়া পা ডুবাইয়া দাঁড়াইল। কী ঠাণ্ডা জল! রক্তচক্ষু সূর্যের ভয়ে বাতাসের সমস্ত শীতলতা যেন এই জলের মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে। সে নত হইয়া মুখেচোখে জল দিল, মনে মনে স্থির করিল কাল সকালে উঠিয়াই নদীতে স্নান করিবে।

ঘাট হইতে ফিরিবার পথে গৌরমোহন আবার পথের অস্পষ্ট রেখা দেখিতে পাইল।

আসিবার সময় লক্ষ্য করে নাই, ঘাট হইতে খিড়কি দরজা পর্যন্ত রেখা রহিয়াছে। সে একটু বিমনা হইল। শিয়াল-কুকুরের পায়ের দাগ। শিয়াল-কুকুর সদর দরজায় আসে কেন, এবং সেখান হইতে ঘাটেই বা যায় কি জন্য?

এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে গৌরমোহন আবার বাড়ির সামনের দিকে উপস্থিত হইল।

সূর্য অসম দিগন্ত-রেখা স্পর্শ করিয়াছে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া যাওয়ায় সে দ্রুতপদে ফটকের দিকে চলিল।

ফটকের পাকুড় গাছের নিচে ছায়া-ছায়া হইয়া আসিয়াছে। যেখানে গাছের ডালে খাবারের পুঁটুলি টাঙাইয়া দিয়াছিল, গৌরমোহন সেখানে গিয়া দাঁড়াইল।

দেখিল পুঁটুলি অন্তর্হিত হইয়াছে।

গ্রীষ্মকালে সূর্যাস্তের পর দিনের আলো বেশিক্ষণ থাকে না। তাই অন্ধকার হইবার আগেই গৌরমোহন গিয়া নিজের জিনিসপত্র গুছাইতে লাগিয়া গেল, অবশ্য সব জিনিসপত্র আজই মোট খুলিয়া বাহির করিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু কিছু জিনিস আজ রাত্রেই প্রয়োজন হইবে। লণ্ঠন, মোমবাতি, স্টোভ ইত্যাদি এবং বিছানা।

বাড়িতে আসবাবপত্র কিছুই ছিল না, কিন্তু গৌরমোহনের মনে পড়িল একটা ঘরে সে একটি লোহার খাট দেখিয়াছে। সে গিয়া আবার দেখিয়া আসিল, হ্যাঁ, পশ্চিম দিকের ঘরের এক কোণে একটি সরু লোহার খাট আছে। সে খাটটিকে টানিয়া জানালার সামনে আনিল। জানালায় মোটা মোটা গরাদ আছে, কিন্তু কাচ বেশির ভাগ ভাঙা। গ্রীষ্মকালে তাহাতে কোনই অসুবিধা নাই।

গৌরমোহন হোল্‌ড-অল্ টানিয়া আনিয়া বিছানা পাতিয়া ফেলিল। বিছানা বালিশ সবই নূতন, বন্ধু মোহনলাল যোগাড় করিয়া দিয়াছে।

বন্ধু বটে মোহনলাল! যেমন তার বিষয়বুদ্ধি, তেমনি তার বন্ধুপ্রীতি, এক জোড়া নূতন চটি জুতাও বিছানার মধ্যে দিতে ভুলে নাই। রাত্রে পরিবার জন্য সিল্কের পাজামা-সুট্ দিয়াছে।

গৌরমোহন জুতা খুলিয়া চটি পরিল, তারপর হৃষ্টমনে বাহিরের ঘরে ফিরিয়া আসিল। বাক্স, প্যাকিং কেস্, চটের বস্তা প্রভৃতিতে কোথায় কি আছে মোহনলাল বলিয়া দিয়াছিল, কিন্তু গৌরমোহনের ভাল মনে নাই। সে পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া প্রথমে ট্রাঙ্ক খুলিল। ট্রাঙ্কটা মোহনলালের, তাহার ভিতরের কাপড়-জামা-তোয়ালে প্রভৃতিও মোহনলালের, বন্ধুকে ব্যবহার করিতে দিয়াছে; দুই বন্ধুর শরীরের মাপ একই রকম, একের জামা অন্যে পরিলে বেমানান হয় না। উপরন্তু ট্রাঙ্কে সাবান, কেশতৈল, দাড়ি কামাইবার যন্ত্রপাতি, আয়না, চিরুনি আছে। একটি বৈদ্যুতিক টর্চও আছে।

গৌরমোহনের মন খুশি হইয়া উঠিল। নিত্যব্যবহার্য সকল বস্তুই বন্ধু দিয়াছে। সে টর্চটি লইয়া পকেটে রাখিল, তারপর ট্রাঙ্ক সরাইয়া ছোট প্যাকিং কেস্‌টা টানিয়া লইল। ঐ লম্বা প্যাকিং কেস্‌টায় ইজেল্ ক্যাম্বিস প্রভৃতি ছবি আঁকার সরঞ্জাম আছে, সেটা আজ খুলিবার দরকার নাই; এটাতে কি আছে দেখা যাক্। শূন্য বাড়িতে নূতন করিয়া সংসার পাতিবার আনন্দে গৌরমোহন মাতিয়া উঠিল।

প্যাকিং কেসের ঢাকনা চাড় দিয়া খুলিয়া দেখিল, ঘরকন্নার জিনিস। একটা ছোট্ট হ্যারিকেন লণ্ঠন, দুই বান্ডিল মোমবাতি, স্টোভ, স্পিরিটের বোতল; চায়ের প্যাকেট, টিনের দুধ, চিনি, কেট্‌লি, টি-পট্, পিরিচ পেয়ালা, এমন কি দুধের টিন খুলিবার যন্ত্রটা পর্যন্ত বাদ যায় নাই।

গৌরমোহনের মন যেমন তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল, তেমনি চায়ের পিপাসাও জাগ্রত হইয়া উঠিল। তাহার সায়াহ্নিক চা পানের গোধূলি লগ্ন উপস্থিত; আজ যে তাহাকে স্বপাক চা খাইতে হইবে, তাহা স্মরণ ছিল না। সে হৃষ্টমনে চা প্রস্তুত করিতে প্রবৃত্ত হইল।

সঙ্গে বড় একটা ফ্ল্যাস্কে জল আছে, কিন্তু নদী হইতে জল আনিয়া চা প্রস্তুত করাই প্রশস্ত। গৌরমোহন কেট্‌লি হাতে লইয়া উঠিল, সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া পিছনের দরজার দিকে চলিল। বাড়ির ভিতরে তখন ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে।

পিছনের দরজাটি ভিতর দিক হইতে হুড়কা ও ছিটকিনি লাগানো। কবাট খুলিবার সময় মরিচা-ধরা কব্জায় ক্যাঁ-চ্ করিয়া একটা করুণ শব্দ হইল। কিন্তু কবাটে জাম ধরে নাই, সহজেই খুলিয়া গেল।

বাহিরে একটু আলো আছে, নদীর ছোট্ট বুকে সন্ধ্যার ছোপ ধরিয়াছে। গৌরমোহন কেট্‌লিতে জল ভরিয়া ফিরিয়া আসিল, দরজা আবার বন্ধ করিয়া দিল।

স্টোভ জ্বালিয়া সে জল চড়াইয়া দিল।

এক পেয়ালা জল গরম হইতে বেশি সময় লাগিবে না, ইতিমধ্যে হ্যারিকেন লণ্ঠনটি জ্বালিল। স্টোভের ছোট্ট নীল-কমলটির পাশে পীতবর্ণ একটি বুদ্বুদ ফুটিয়া উঠিল। ঘরের অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিয়াছিল, একটু একটু হালকা হইল।

পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে চা তৈরি হইয়া গেল। গৌরমোহন তখন ইক্‌মিক্‌ কুকার খুলিয়া তাহার খোলের ভিতর হইতে খাবার বাহির করিল। আলাদা টিফিন-বক্স না দিয়া বন্ধ কুকারের মধ্যেই খাবার দিয়াছে। একটা খোলের মধ্যে চিংড়ি মাছের কাটলেট ও হিঙের কচুরি, অন্য খোলে কড়া পাকের সন্দেশ। তাছাড়া একটা বড় পাঁউরুটি, চীজ, মাখন ইত্যাদি আছে। প্রচুর খাবার।

গৌরমোহন দুইটি সন্দেশ বাহির করিয়া খাইতে বসিল। সঙ্গে নিশ্চয় আসন আছে, কিন্তু তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে অনেক হাঙ্গামা। বিশেষত মেঝে বেশ পরিষ্কার ঝক্‌ঝকে, ধূলা নাই।

সে তরিবত করিয়া সুগন্ধি চায়ের পেয়ালাটি মুখে তুলিতে যাইবে, এমন সময় সদর দরজায় খুট্ খুট্ শব্দ হইল।

গৌরমোহন চমকিয়া মুখ তুলিল। তারপর গলা চড়াইয়া বলিল, ‘কে?’

দরজার ওপার হইতে কেহ সাড়া দিল না, কিন্তু আবার খুট্ খুট্ শব্দ হইল।

গৌরমোহন উঠিয়া গিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইল, আবার প্রশ্ন করিল, ‘কে? কি চাও?’

এবারও সাড়া নাই।

গৌরমোহন একটু ইতস্তত করিল; যদি চোর-ডাকাত হয়! কিন্তু চোর-ডাকাত তাহার কী লইবে? সে সাহস করিয়া দ্বার খুলিয়া ফেলিল।

বাহিরে কেহ নাই, কেবল অন্ধকার।

গৌরমোহন পকেট হইতে টর্চ লইয়া বাহিরে আলো ফেলিল। আলোর সীমানার মধ্যে কাহাকেও দেখা গেল না। মানুষ তো নাই-ই, কুকুর বিড়ালও নাই।

গৌরমোহন বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। টর্চের আলোয় যে বৃত্তাভাস রচিত হইয়াছে তাহার বাহিরে কিছু দেখা যায় না। একটা এলোমেলো বাতাস উঠিয়াছে। গৌরমোহন এদিক ওদিক ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিল; ভাবিল, হয়তো হাওয়ার ধাক্কায় দরজায় শব্দ হইয়াছিল। পবন দিগন্তের দুয়ার নাড়ে।

দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া সে চা খাইতে বসিল। বসিয়াই কিন্তু চমকিয়া উঠিল। প্লেটে একটি কাটলেট ও একটি সন্দেশ রহিয়াছে।

সে সচকিত ভাবে ঘরের চারিদিকে চাহিল। তবে কি বিড়াল ঢুকিয়াছিল? তাহার ক্ষণিক অনুপস্থিতির সুযোগ পাইয়া কাটলেট ও সন্দেশ লইয়া পালাইয়াছে? নিশ্চয় বিড়াল। তাছাড়া আর কী হইতে পারে?

বিড়ালের উচ্ছিষ্ট খাইবার প্রবৃত্তি তাহার হইল না; সে খাবারের প্লেট এক পাশে সরাইয়া রাখিয়া চায়ের পেয়ালা এক চুমুকে নিঃশেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে হইবে বিড়ালটা বাড়ির মধ্যে কোথাও লুকাইয়া আছে কি না।

টর্চ লইয়া গৌরমোহন প্রত্যেকটি ঘর দেখিল, কিন্তু কোথাও বিড়াল নাই। অবশ্য কাচভাঙা জানালা দিয়া পলায়ন করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু তবু গৌরমোহনের মনটা সংশয়-কণ্টকিত হইয়া রহিল। এতগুলো লোক যাহা বলিতেছে, তাহাই যদি সত্য হয়?

বিছানার পাশে পা ঝুলাইয়া বসিয়া গৌরমোহন ভাবিতে আরম্ভ করিল। প্রেতযোনি থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাকে ভয় করিব কেন? ভূতে মানুষের ঘাড় মটকায় একথা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়।

মনে পড়িল, স্টেশন মাস্টারকে সে পরিহাসচ্ছলে বলিয়াছিল— ভালই হল, একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে। যদি সত্যিই এ বাড়িতে ভূত-প্রেত থাকে— যদিও এ পর্যন্ত স্পষ্ট নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যায় নাই— তাহাতে ক্ষতি কি? সে তো ভূতের কোনও অনিষ্ট করে নাই, বরং ভূতই তাহার খাবার খাইয়া গিয়াছে। এ ক্ষেত্রে তাহার প্রতি ভূতের কোনও বিদ্বেষ থাকা উচিত নয়। ভূতের যদি খাদ্যদ্রব্যের প্রতি লোভ থাকে, বেশ তো, ভূতের সঙ্গে সে নিজের খাবার ভাগ করিয়া খাইবে।

এই ভাবে নানা যুক্তিতর্কের দ্বারা গৌরমোহন মনকে দৃঢ় করিতেছে, এমন সময় বাহিরের ঘর হইতে অস্পষ্ট একটা শব্দ তাহার কানে আসিল। এতক্ষণ সে লক্ষ্য করিয়াছিল, বাড়ির ভিতরে কি বাহিরে, কোথাও এতটুকু শব্দ নাই, ঝিঁঝির আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাইতেছে না। হাওয়া উঠিয়া যে শব্দের সৃষ্টি করিয়াছিল তাহাও থামিয়া গিয়াছে। তাই এত গভীর স্তব্ধতার মধ্যে সামনের ঘরের সামান্য আওয়াজটা সে শুনিতে পাইল।

গৌরমোহন নিঃশব্দে উঠিয়া দাঁড়াইল। হ্যারিকেন লণ্ঠনটা সামনের ঘরেই ছিল, সে পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া ঘরে উঁকি মারিল। কেহ নাই। তখন সে টর্চ জ্বালিয়া দ্রুত ঘরের চারিদিকে ঘুরাইল। সদর দরজা আগের মতোই বন্ধ, ঘর শূন্য। কিন্তু—

বিড়ালের উচ্ছিষ্ট বলিয়া যে খাবারগুলি সে সরাইয়া রাখিয়াছিল, সেগুলি নাই, প্লেট খালি।

গৌরমোহন মনে মনে মন্তব্য করিল— ‘পেটুক ভূত। তেলেভাজা থেকে সন্দেশ পর্যন্ত কিচ্ছু বাদ দেয় না।’

গৌরমোহন হাতের ঘড়ি দেখিল— সাড়ে আটটা।

গ্রীষ্মকালের পক্ষে এমন কিছু বেশি রাত্রি নয়। কিন্তু সঙ্গীহীন অবস্থায় কাহারও সহিত কথা না বলিয়া কতক্ষণ জাগিয়া থাকা যায়! ট্রেনের হটরানিতে শরীরও ক্লান্ত। সুতরাং খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া শুইয়া পড়া যাইতে পারে। কাল ভোরে উঠিয়া নদীতে স্নান করিতে হইবে।

গৌরমোহন আহার শেষ করিল। তারপর একটি কৌটায় কিছু খাবার রাখিয়া ঢাকনা বন্ধ করিয়া এক পাশে সরাইয়া রাখিল। বিড়াল ঢাকনা খুলিয়া খাইতে পারিবে না, কিন্তু ভূতের যদি ক্ষুধার উদ্রেক হয়, সে স্বচ্ছন্দে খাইতে পারিবে। নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যাইবে।

সামনের এবং পিছনের দরজা বন্ধ আছে কিনা ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া সে শয়ন করিল। লণ্ঠনটা কমাইয়া ঘরের এক কোণে রাখিল। টর্চ বালিশের পাশে রহিল।

খোলা জানালা দিয়া ফুরফুরে বাতাস আসিতেছে। আকাশের দক্ষিণ দিকে কয়েকটা উজ্জ্বল তারা দেখা যাইতেছে। গৌরমোহন শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল।

খাসা বাড়িটি; এতদিন শূন্য পড়িয়া আছে, কিন্তু মনে হয় না পোড়ো বাড়ি। কে বাড়িটি এমন তক্‌তকে ঝক্‌ঝকে করিয়া রাখিয়াছে? ভূত? হয়তো আছে। কিন্তু নিরীহ ভূত, কোনও প্রকার গণ্ডগোল নাই। ভূতের সঙ্গে ভাব-সাব করিয়া কথাবার্তা বলা যায় না কি?

ঘুমে তাহার চোখ জড়াইয়া আসিতে লাগিল… কলিকাতায় মাতৃদেবী বোধ করি খুবই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু উপায় কি? ঐ দুম্বো মেয়েটাকে সে কিছুতেই বিবাহ করিবে না…

গৌরমোহনের ঘুম ভাঙিল সকাল পাঁচটার সময়। বাহিরে দিনের আলো ঝলমল করিতেছে, সূর্য উঠিতে বিলম্ব নাই।

সে উঠিয়া বসিয়া আড়মোড়া ভাঙিয়া হাই তুলিল।

রাত্রে সুনিদ্রা হইয়াছে, এক ঘুমে রাত কাবার হইয়া গিয়াছে। ভূতের উৎপাত কিছু হয় নাই। তবু তাহার মনে হইল ঘুমের মধ্যে সে নানা প্রকার স্বপ্ন দেখিয়াছে। কে যেন তাহার খাটের চারিপাশে সারারাত্রি ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে, শিয়রে দাঁড়াইয়া মুখের উপর ঝুঁকিয়া মুখ দেখিবার চেষ্টা করিয়াছে, পাখির পালকের মতো নরম হাতে তাহাকে স্পর্শ করিয়াছে। কিন্তু উহা স্বপ্নই। গত রাত্রে তাহার জাগ্রত মনের মধ্যে যে সংশয়গুলা ঘুরিতেছিল, তাহারাই বোধ হয় স্বপ্নে নব-কলেবর ধরিয়া দেখা দিয়াছিল।

গৌরমোহন উঠিয়া পড়িল।

সাবান তোয়ালে লইয়া মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে ঘাটে স্নান করিতে চলিল। সূর্যোদয়ের পূর্বে অবগাহন স্নান করিলে সারাদিন শরীর ঠাণ্ডা থাকে।

খিড়কির দরজা খুলিতে গিয়া গৌরমোহন আজ প্রথম ধাক্কা খাইল। খিড়কির দরজা ভেজানো রহিয়াছে বটে, কিন্তু খিল ও ছিটকিনি খোলা। তাহার বুকের ভিতরটা একবার ধ্বক্ করিয়া উঠিল। কাল রাত্রে শয়নের পূর্বে সে ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়াছিল দরজা বন্ধ আছে। তবে—?

সে স্থির হইয়া চিন্তা করিল। ভূত আছে, কাল রাত্রে দরজা বন্ধ করার সময় সে বাড়ির মধ্যে ছিল, তারপর কোনও সময় দরজা খুলিয়া বাহিরে গিয়াছে। কিন্তু এ কি রকম ভূত? বাহিরে যাইবার জন্য দরজা খোলে কেন? প্রেতযোনি তো অশরীরী! কিন্তু না, ভয় পাইলে চলিবে না। ভূতের সঙ্গে যখন এক বাড়িতে বাস করিতে হইবে, তখন ভয় করিলে চলিবে না। বিশেষত ভূত যেমনই হোক, তাহার স্বভাবটি শান্ত-শিষ্ট। গৌরমোহন এ বাড়িতে আসাতে সে যে বিরক্ত হইয়াছে তাহার কোনও প্রমাণ নাই। তবে কেন সে ভূতকে ভয় করিবে? ভূতের ভয় একটা কুসংস্কার।

নদীর ঘাটে পৌঁছিয়া গৌরমোহন দ্বিতীয়বার ধাক্কা খাইল। ঘাটের মাথায় দাঁড়াইয়া সে দেখিল, ঘাটের কিনারায় নদীর শান্ত জল তোলপাড় হইতেছে। জলে কেহ নাই, অথচ মনে হইতেছে কেহ হাত-পা ছুঁড়িয়া সাঁতার কাটিতেছে। কিংবা একটা বিরাট মাছ জলের তলায় থাকিয়া ল্যাজের ঝাপটায় জল মথিত করিয়া তুলিতেছে।

গৌরমোহন হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার বুকের ভিতরটা আর একবার ধ্বক্ ধ্বক্ করিয়া উঠিল।

হঠাৎ জলের আলোড়ন শান্ত হইল। একটা চিৎকারের মতো শব্দ শোনা গেল, যেন স্নাতক আগন্তুককে দেখিতে পাইয়াছে। তারপর আর এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিল। গৌরমোহন বিস্ময়াহত চক্ষে দেখিল— জলের প্রান্তে ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ণ কম্পন রাখিয়া একজোড়া সজল চরণচিহ্ন ধাপে ধাপে উঠিয়া আসিতেছে। মানুষ নাই, কেবল মানুষের ভিজা পায়ের দাগ।

পায়ের দাগ ঘাটের পৈঠাগুলিকে অতিক্রম করিয়া মাটির ওপর অদৃশ্য হইয়া গেল।

গৌরমোহন কিছুক্ষণ পায়ের দাগগুলির দিকে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে সোপানের পাথরের উপর বসিয়া পড়িল। হঠাৎ অতিপ্রাকৃত ব্যাপার দেখিয়া বুক ধড়ফড়ানির অবস্থা কাটিয়া গিয়াছে, সে গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল।— এ কী কাণ্ড! এ কেমন প্রেত? এ প্রেতের ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, দরজা খুলিয়া সে বাড়ির বাহিরে আসে, নদীর জল উদ্বেলিত করিয়া স্নান করে। সবই মানুষের মতো, কেবল চোখে দেখা যায় না।

হয়তো সব প্রেতই এই রকম, মানুষ তাহাদের সম্বন্ধে একটা বিকৃত ধারণা করিয়া বসিয়া আছে।

সজল পদচিহ্নগুলি তাহার চোখের সামনে শুকাইয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল।

আরও কিছুক্ষণ ঘাটে বসিয়া থাকিবার পর গৌরমোহন জলে নামিয়া স্নান করিল। দেহ শীতল হইল, মনও অনেকটা শান্ত হইল।

বাড়িতে ফিরিয়া সে সদর দরজা খুলিয়া দিল, তারপর চা তৈয়ার করিতে বসিল।

স্টোভ ও লণ্ঠনের জন্য কেরাসিন যোগাড় করিতে হইবে। ইক্‌মিক্‌ কুকারের জন্য কাঠ-কয়লা দরকার।

চা প্রস্তুত হইলে পাঁউরুটিতে মাখন মাখাইয়া সে খাইতে বসিল। খাইতে বসিয়া তাহার মনে পড়িয়া গেল, কাল রাত্রে ডিবার মধ্যে খাবার রাখিয়াছিল ভূত খায় কিনা দেখিবার জন্য। ডিবাটা ঢাকনা-ঢাকা ছিল। গৌরমোহন সেটা টানিয়া লইয়া খুলিয়া দেখিল। হুঁ।

খালি কৌটার দিকে চাহিয়া সে কিছুক্ষণ চিন্তা করিল। তারপর শূন্যের দিকে মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘তুমি এখন কিছু খাবে?’

গৌরমোহন কান খাড়া করিয়া রহিল, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইল না। প্রেত বোধ হয় কথা বলিতে পারে না। সে আর এক পেয়ালা চা ঢালিল, দু’স্লাইস্ রুটিতে মাখন লাগাইয়া খানিকটা দূরে রাখিয়া আসিল।

তারপর পানাহার করিতে করিতে আড়চোখে দেখিতে লাগিল।

প্রেত কিন্তু খাইতে আসিল না, চা-রুটি যেমন পড়িয়াছিল, তেমনি পড়িয়া রহিল।

প্রাতরাশ শেষ করিয়া গৌরমোহন উঠিয়া দাঁড়াইল।

ঘরটা বড় অগোছালো হইয়া আছে, বস্তাগুলাও খোলা হয় নাই। এইবার লাগা যাক। একটা অসুবিধা এই যে, বাড়িতে একটিও ফার্নিচার নাই। একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা কাবার্ড যদি থাকিত! যা হোক, মেঝেয় জিনিসপত্র গুছাইয়া কাজ চালাইতে হইবে।

পাঞ্জাবির আস্তিন গুটাইয়া গৌরমোহন প্রস্তুত হইতেছে, এমন সময় খোলা দরজা দিয়া বাহিরের দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল। ফটকের কাছে একটা লোক উঁকিঝুঁকি মারিতেছে কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিতে সাহস করিতেছে না। বোধ হয় মুদি, গৌরমোহন বাঁচিয়া আছে কিনা দেখিতে আসিয়াছে।

গৌরমোহন দ্বারের বাহিরে আসিয়া হাতছানি দিয়া মুদিকে ডাকিল।

মুদি তখন চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, ‘হুজুর, আপ জিন্দা হ্যায়!’

গৌরমোহন হাসিয়া বলিল, ‘আলবৎ জিন্দা হ্যায়। তুমি কি ভেবেছিলে ভূতে আমার ঘাড় মটকেছে?’

মুদির বিস্ময়-বিমূঢ়তা কাটিল বটে, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল সে খুশি হইতে পারে নাই। ভূত যেন তাহার কর্তব্যকর্মে অবহেলা করিয়াছে।

অবশেষে মুদি বলিল, ‘কিছু দেখেননি?’

‘ভূত দেখিনি।’

মুদি এবার সত্য সত্যই অসন্তুষ্ট হইল, বলিল, ‘আপনারা ম্লেচ্ছ, তাই দেও আপনাকে দেখা দেয়নি। কিন্তু আছে, একদিন দেখবেন।’

গৌরমোহন হাসিয়া বলিল, ‘আমি তো তাকে দেখবার জন্যে চোখ পেতে আছি। কিন্তু ও-কথা থাক। আমার এক বোতল কেরাসিন আর কিছু কাঠ-কয়লা চাই। তুমি এনে দিতে পারবে?’

মুদি বলিল, ‘এখন পারব না। আধ-ঘণ্টা পরে ট্রেন আসবে, এখনও আমার জিলিপি ভাজা বাকি। তবে আপনি যদি আমার সঙ্গে আসেন, দিতে পারি।’

‘বেশ, চল।’

গৌরমোহন সদর দরজায় তালা লাগাইয়া মুদির সঙ্গে বাহির হইয়া পড়িল।

ফটকের ভিতর দিয়া যাইবার সময় গৌরমোহন জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি আজ ভোরবেলাই এদিকে এলে যে?’

মুদি পাকুড় গাছের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, ‘দেওয়ের জন্যে ভোগ এনেছিলাম।’

গৌরমোহন দেখিল পাকুড় গাছের ডালে শালপাতার মোড়ক ঝুলিতেছে। সে প্রশ্ন করিল, ‘তোমরা ক’বার ভূতের ভোগ চড়াও?’

‘দিনে একবার চড়াই৷ কখনও সকালে, কখনও বিকেলে।’

‘ও— তাই ভূতের পেট ভরে না!’

মুদি সচকিতে তাহার পানে চাহিল, ‘পেট ভরে কিনা আপনি জানলেন কী করে?’

গৌরমোহন উত্তর দিল না, শুধু হাসিল।

আধ ঘণ্টা পরে গৌরমোহন ফিরিয়া আসিল। এক হাতে গলায় দড়ি বাঁধা কেরাসিনের বোতল, অন্য হাতে কাঠ-কয়লার পুঁটুলি। ফটক পার হইবার সময় সে দেখিল, পাকুড় গাছের ডালে খাবারের মোড়ক যেমন ঝুলিতেছিল, তেমনি ঝুলিতেছে, ভূত তাহা লইয়া যায় নাই।

গৌরমোহন মনে মনে হাসিল।

ভূতের বোধহয় লাড্ডু ও পকৌড়িতে আর রুচি নাই।

তালা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ঘরটি পরিষ্কার ভাবে ঝাঁট দেওয়া, কিন্তু জিনিসপত্র মোটঘাট একটিও সেখানে নাই।

গৌরমোহনের চক্ষুস্থির হইয়া গেল।

কেরাসিনের বোতল এবং কয়লা নামাইয়া রাখিয়া সে ছুটিয়া ভিতরে গেল। তাহার শয়নের ঘরটিও পরিষ্কৃত হইয়াছে। এবং তাহার ট্রাঙ্কটি ঘরের এক পাশে রাখা রহিয়াছে।

অতঃপর গৌরমোহন অন্য সব ঘরগুলিতে গিয়া দেখিল, তাহার কোনও জিনিস খোয়া যায় নাই। যে বস্তুগুলি খোলা হয় নাই, সেগুলি অন্য একটি ঘরে রাখা হইয়াছে, ইক্‌মিক্‌ কুকার স্টোভ ইত্যাদি যাবতীয় দ্রব্য রান্নাঘরে শোভা পাইতেছে। যে দুটি পেয়ালায় সে চা ঢালিয়াছিল, সে দুটি ধোয়া-মোছা অবস্থায় রান্নাঘরে রহিয়াছে। প্লেট দুটিও তাই।

গৌরমোহন প্রকাণ্ড একটি হাঁফ ছাড়িয়া গদ্‌গদ্‌ কণ্ঠে বলিল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ। আমার অনেক কাজ গুছিয়ে দিয়েছ।’

ভূতের নিকট হইতে কোনও প্রত্যুত্তর আসিল না। কিন্তু গৌরমোহন বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করিতে লাগিল। এমন সহৃদয় ভূতকে সঙ্গীরূপে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ভূত তাহার আগমনে রাগ করে নাই, বরঞ্চ খুশি হইয়াছে। গৌরমোহন কাজে লাগিয়া গেল; বস্তা, প্যাকিং কেস্ প্রভৃতি খুলিয়া জিনিসগুলি যথাযোগ্য স্থানে সাজাইয়া রাখিতে লাগিল। ছবি আঁকার জিনিসগুলিকে একটি ঘরে রাখিয়া আসিল; এই ঘরটি হইবে তাহার ছবি আঁকার ঘর।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সাজানো গোছানো সম্পন্ন হইল। তখন সে বাহিরের ঘরে আসিয়া দেখিল ভূত কোন্ ফাঁকে কেরাসিনের বোতল এবং কয়লা রান্নাঘরে রাখিয়া আসিয়াছে। ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভূত, অগোছালো এলোমেলোভাব একেবারে পছন্দ করে না।

এতক্ষণে বেশ বেলা বাড়িয়াছে। গৌরমোহনের মনে পড়িল, হাতঘড়িটা রাত্রে বালিশের তলায় রাখিয়া শুইয়াছিল, আজ সকালে দম দেওয়া হয় নাই। সে শয়নঘরে গিয়া বালিশ উল্টাইয়া দেখিল ঘড়ি যথাস্থানে আছে এবং তাহাতে দম দেওয়া হইয়াছে। সে উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।

ঘড়িতে এখনও আটটা বাজে নাই। সুতরাং রান্না চড়াইবার তাড়া নাই৷ ইতিমধ্যে কি করা যায়? ভূতের সঙ্গে আলাপ জমাইতে পারিলে মন্দ হইত না, কিন্তু ভূত যে কথা কয় না! এক তরফা বাক্যালাপ কতক্ষণ চালানো যায়? তবু গৌরমোহন চেষ্টার ত্রুটি করিল না, এ-ঘর ও-ঘর ঘুরিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে অশরীরীর উদ্দেশে বলিতে লাগিল, ‘দ্যাখো, তোমার নাম জানি না, কিন্তু তুমি আমার বন্ধু, আমার কত কাজ করে দিয়েছ… আমার বন্ধুভাগ্য খুব ভাল, ওদিকে মোহনলাল আর এদিকে তুমি… এস না দু’জনে বসে খানিক গল্প করি… তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ, কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না— আমার চেয়ে তোমার চোখের জ্যোতি বেশি— কিন্তু তুমি কথা কও না কেন? বল না দুটো কথা, শুনি… আচ্ছা, আজ কি রান্না করব বল। আমার সঙ্গে চাল, মুগের ডাল, ময়দা, আলু, পটোল, পেঁয়াজ আছে। ভাল ঘি আছে, খাঁটি সরষের তেল আছে। বল না কী রাঁধি, তুমি যা বলবে তাই রাঁধব। দু’জনে মিলে খাওয়া যাবে।…’

কিন্তু কোনও ফল হইল না। গৌরমোহন অনুভব করিল ভূত কাছেই আছে, তাহার কথা শুনিতেছে, তাহাকে দেখিতেছে। কিন্তু কথা কহিতেছে না। হয়তো ভূতেরা কথা বলিতে পারে না। গৌরমোহন আর কিছুক্ষণ ভূতকে কথা কইবার চেষ্টা করিয়া শেষে হতাশ হইয়া হাল ছাড়িয়া দিল।

ন’টা বাজিলে গৌরমোহন দাড়ি কামাইতে বসিল। দাড়ি কামাইবার জরুরী প্রয়োজন ছিল না, এখানে কে-ই বা তার দাড়ি লক্ষ্য করিতেছে, কিন্তু সময় কাটাইবার জন্য একটা কিছু করা চাই তো। ছবি আঁকার যোগাড়-যন্ত্র করিতে পারিত, কিন্তু সকাল হইতে তাহার মন চঞ্চল হইয়া আছে, ছবি আঁকায় মন বসিবে না।

দাড়ি কামাইবার ক্ষৌর-যন্ত্রগুলি ঘাটে গিয়া পরিষ্কার করিয়া আসিতে সাড়ে ন’টা বাজিল। এবার রান্না চড়ানো যাইতে পারে। বেশি কিছু নয়, ভাত, আলুভাতে আর আলু-পটোলের ডালনা। সঙ্গে ঘি আছে, ইহাতেই এ বেলা চলিয়া যাইবে। ও বেলা না হয় ভাল করিয়া রাঁধা যাইবে। গৌরমোহন রন্ধন ব্যাপারেও একজন শিল্পী।

রান্নাঘরে গিয়া সে প্রথমে নদী হইতে এক বালতি জল লইয়া আসিল। তারপর চাল ধুইয়া এবং আলু-পটোল কুটিয়া কুকারে রান্না চড়াইয়া দিল।

দুই ঘণ্টা আর কোনও কাজ নাই। গৌরমোহন গুন্ গুন্ স্বরে সুর ভাঁজিতে ভাঁজিতে বাড়িময় ঘুরিয়া বেড়াইল, ট্রাঙ্ক খুলিয়া জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করিল, আসিবার সময় হাওড়া স্টেশনে কয়েকটি লোমহর্ষণ উপন্যাস কিনিয়াছিল, সেগুলির পাতা উল্টাইল, ভূতের সঙ্গে আর একবার ব্যবহারিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করিল। তারপর বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া পা নাড়িতে নাড়িতে কলিকাতার পরিস্থিতির কথা ভাবিতে লাগিল। মাতৃদেবী বোধ হয় এতক্ষণ কলিকাতা শহর চষিয়া ফেলিতেছেন! তিনি যদি জানিতে পারেন মোহনলাল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, তাহা হইলে আর রক্ষা থাকিবে না, মোহনের জীবন দুর্বহ হইয়া উঠিবে।

বারোটার সময় গৌরমোহন আহার করিতে বসিল। সঙ্গে একটি মাত্র বগি থালা ছিল, সেটিতে ভূতের জন্য ভাত বাড়িল। নিজের জন্য রেকাবি লইল। আহার করিতে করিতে ভূতকে বলিল, ‘তুমি খেতে বসলে পারতে, একসঙ্গে খাওয়া চুকিয়ে নেওয়া যেত। যা হোক, তোমার যেমন ইচ্ছে। আমার সামনে খেতে যদি সঙ্কোচ হয়—’

একাকী আহার সম্পন্ন করিয়া গৌরমোহন শয়নঘরে ফিরিয়া গেল। একটি লোমহর্ষণ উপন্যাস লইয়া শয়ন করিল। দিবানিদ্রা তাহার অভ্যাস নাই, একটু ঝিম্‌কিনি দিয়া ভাতের নেশা কাটাইয়া উঠিয়া পড়িবে।

লোমহর্ষণ উপন্যাস পড়িতে পড়িতে তাহার চোখ জড়াইয়া আসিল। তন্দ্রার মধ্যে সে শুনিতে পাইল খিড়কি দরজা খোলার ক্যাঁ—চ্ শব্দ হইল। বোধ হয় ভূত দরজা খুলিয়া নদীর ঘাটে গেল।… আলুভাতে আলু-পটোলের ডালনা ভূতের কেমন লাগিল কে জানে…

গৌরমোহন ঘুমাইয়া পড়িল। তাহার দেহ-মনে বোধ হয় অলক্ষিতে কিছু ক্লান্তি জমা হইয়াছিল, এক্কেবারে ঘুম ভাঙিল বেলা তিনটায়। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল, মুখে-চোখে জল দিবার জন্য রান্নাঘরে গেল। দেখিল দুপুরবেলার উচ্ছিষ্ট বাসন-কোসন ভূত মাজিয়া ধুইয়া ঘরের কোণে উপুড় করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। মনে মনে ভূতকে ধন্যবাদ জানাইয়া সে জল পান করিল, তারপর ছবি আঁকার ঘরে গিয়া ছবি আঁকিবার জন্য প্রস্তুত হইল।

ঘরের একটা জানালা পিছন দিকে, এই জানালা দিয়া নদী ও ঘাটের দৃশ্য দেখা যায়। বাহিরে অপরাহ্নের সঞ্চিত সূর্যতাপ নিথর বাতাসে সূক্ষ্ম বাষ্পের মতো স্পন্দিত হইতেছে। গৌরমোহন জানালার কাছে ইজেল খাড়া করিল, একটা প্যাকিং কেস্ টানিয়া আনিয়া তাহার উপর বসিল। কি আঁকিবে তাহা সে ঠিক করিয়া ফেলিয়াছে। শুষ্ক প্রাণহীন শূন্যতার মাঝখানে একটি ছোট বাড়ি। বাড়িটি জীবন্ত, তাহার ছোট ছোট দরজা-জানালা যেন তাহার মুখ-চোখ। বিপুল শূন্যতার মাঝখানে বসিয়া বাড়িটি হাসিতেছে। ছবির নাম— শূন্য শুধু শূন্য নয়।

মনে ছবির প্ল্যান ঠিক করিয়া লইয়া সে আঁকিতে আরম্ভ করিল। তেল রঙ ছবি আঁকিতে গৌরমোহনের সুবিধা হয়, সে প্যালেটে রঙ মিশাইল। প্রথমটা ধীরে ধীরে আঁকিল, তারপর মন বসিয়া গেল।

কতক্ষণ আপন মনে ছবি আঁকিতেছে তাহার জ্ঞান ছিল না। ঘাড়ের কাছে আতপ্ত নিশ্বাসের স্পর্শে সে চমকিয়া উঠিল। ভূত বোধ করি ছবি আঁকা দেখিতে দেখিতে তন্ময় হইয়া শিল্পীর ঘাড়ের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল, গৌরমোহন সচকিতে ঘাড় ফিরাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘অ্যাঁ!’

মনে হইল, যে পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল সে চট্ করিয়া পিছু হটিল। গৌরমোহন মুহূর্তমধ্যে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া বলিল, ‘ও— তুমি! আমার ছবি আঁকা দেখছ? বেশ বেশ। তা যেটুকু এঁকেছি কেমন মনে হচ্ছে? এখন বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারছ না, আর একটু আঁকা হলে বুঝতে পারবে।’

গৌরমোহন আবার আঁকায় মন দিল। আঁকিতে আঁকিতে ভূতের উদ্দেশে দুই-চারটি কথা বলে, আবার আঁকে। এইভাবে বেশ খানিকক্ষণ চলিবার পর এক সময় সে অনুভব করিল যেন ঘরের আলো কমিয়া আসিতেছে। শুধু তাই নয়, বাতাসের অভাবে দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে। সে তুলি ফেলিয়া জানালার বাহিরে তাকাইল।

সূর্যের আলো কেমন যেন ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। তারপরই তাহার চোখ পড়িল নদীর ওপারে ঈশান কোণে ধূসর-পিঙ্গল মেঘ মাথা তুলিয়াছে। একটা দমকা হাওয়া আগাছার ভিতর দিয়া বহিয়া গেল। নদীর নিস্তরঙ্গ জল রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।

গৌরমোহন সানন্দে বলিয়া উঠিল, ‘ঝড় আসছে! ঝড় আসছে!’

চৈতালি ঝড়। নূতন কিছু নয়, প্রতি বৎসরই আছে। একবার এই বাড়ির সকলকে বজ্রাহত করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছিল।

দেখিতে দেখিতে বিদ্যুজ্জিহ্ব ঝড় আসিয়া পড়িল, আকাশে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ বাধিয়া গেল। শন্‌শন্‌ বাতাস, চক্‌মক্‌ বিদ্যুৎ, গম্‌গম্‌ বজ্রগর্জন। বৃষ্টির মুষলধারে আকাশের কোথাও তিলমাত্র ছিদ্র রহিল না।

গৌরমোহনের মন ময়ূরের মতো নাচিয়া উঠিল। সে আঁকার সরঞ্জাম ঘরের একপাশে সরাইয়া রাখিয়া জানালাগুলা বন্ধ করিবার চেষ্টা করিল। সব জানালা বন্ধ হইল না, ভাঙা কাচের ভিতর দিয়া বৃষ্টির ছাট আসিতে লাগিল। সে পুলকিত দেহে বাড়ির ঘরে ঘরে অকারণ সঞ্চরণ করিতে করিতে তারস্বরে গান জুড়িয়া দিল। গানটা অবশ্য সর্বাংশে স্থানকালের উপযোগী নয়, তবু বর্ষার গান বটে—

আহা রে ঐ ডাকছে ডোবায় ব্যাংগুলি

মনের সুখে ছড়িয়ে তাদের ঠ্যাংগুলি।

আকাশেতে ছুটোছুটি মেঘে হাওয়ায় ঝুটোপুটি

ভূত-পেরেতে দত্যি-দানায় খেলছে যেন ডাংগুলি।

বর্ষার মহিমাজ্ঞাপক অন্য কোনও গান জানা না থাকায় সে এই গানটিই অনেকক্ষণ ধরিয়া গাহিল।

কড়্ কড়্ শব্দ করিয়া কোথাও বাজ পড়িল।

গৌরমোহন খাটের কিনারায় বসিয়া পা দোলাইতে দোলাইতে জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে। তাহার শিল্পী-মন প্রকৃতির এই উদ্দাম উন্মাদনাকে রঙের ফাঁদে ধরিবার ফন্দি আঁটিতেছে।

কড়্ কড়্ কড়াৎ! এবার যেন বাড়ির খুব কাছেই বাজ পড়িল। বিদ্যুতের ঝলক এবং বাজের আওয়াজ প্রায় একসঙ্গেই তাহার চক্ষু-কর্ণ ধাঁধিয়া দিল।

তারপরই— লোমহর্ষণ কাণ্ড!

গৌরমোহনের কানের কাছে ভাঙা ভাঙা অস্ফুট স্বরে— ‘আমার বড্ড ভয় করছে—’ বলিয়া কে তাহাকে জড়াইয়া ধরিল।

গৌরমোহনের হৃৎপিণ্ড একটা ডিগবাজি খাইয়া গলার কাছে ধড়ফড় করিতে লাগিল। সে দিশাহারা হইয়া অদৃশ্য জীবনের আলিঙ্গন হইতে মুক্ত হইবার জন্য হাত-পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে চিৎকার করিতে লাগিল— ‘কে? কে? ছেড়ে দাও—আমাকে ছেড়ে দাও!’

কিন্তু সে অদৃশ্য প্রাণীর আলিঙ্গন ছাড়াইতে পারিল না, ধস্তাধস্তি করিতে করিতেই ভাঙা ভাঙা স্বর শুনিতে পাইল— ‘আমাকে ছেড়ে দিও না— আমার বড্ড ভয় করছে।’

কড়্ কড়্ কড়াৎ।

তৃতীয়বার বজ্রপাতের শব্দে বাড়িটা কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা! এই শব্দে গৌরমোহনের ভয়বিহ্বলতা কাটিয়া গেল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বোধ করি অপ্রাকৃতের ভয়কে দূর করিয়া দিল। এতক্ষণ সে নিজেকে ছাড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল, এখন কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া অদৃশ্য দেহটাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে লাগিল।

একটা বাহু। চোখে দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু স্পর্শানুভূতির দ্বারা জানা যাইতেছে, কোমল অথচ দৃঢ়-মাংসল বাহু। গৌরমোহন দুই হাতে অদৃশ্য দেহটাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে দেখিতে বলিল, ‘তুমি কে? ভূত নও?’

শীর্ণ কম্পিত কণ্ঠের উত্তর আসিল, ‘না, আমি মানুষ।’

‘মানুষ! কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’

‘আমি— আমি—’ অদৃশ্য দেহটা থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

গৌরমোহন হাত দিয়া অনুভব করিয়া চলিল। বাহু শেষ হইয়া কাঁধ আরম্ভ হইয়াছে… কাঁধের ওপর অদৃশ্য চুলের গোছা… তারপর গলা… তারপর—

গৌরমোহন একটা খাবি খাওয়া চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘অ্যাঁ— তুমি মেয়ে!’

ঝড়ের দুরন্ত অভিযান দশ দিক দলিত করিয়া চলিয়া গিয়াছে। পিছনে পড়িয়া আছে ভিজা মাটি এবং বাতাসের অবসন্ন নিশ্বাস।

দুইটি মানুষ খাটের কিনারায় পাশাপাশি বসিয়া আছে। একজন অদৃশ্য, একজন দৃশ্য। থামিয়া থামিয়া কথা হইতেছে। গৌরমোহন চিরদিনই মেয়েদের কাছে মুখচোরা, আজ অভাবিত ঘটনাচক্রে এই অদর্শনা যুবতীর সংস্পর্শ লাভ করিয়া সে আরও বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছে।

গৌরমোহন বলিল, ‘তোমার আর ভয় করছে না তো?’

উত্তর আসিল— ‘না। মেঘ ডাকলেই ভয় করে।’ গলার স্বর এখন একটু স্পষ্ট হইয়াছে।

‘ইয়ে— তোমার নামটা এখনও জানা হয়নি। আমার নাম গৌর।’

‘আমার নাম ছায়া!’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর গৌরমোহন হাতের ঘড়ি দেখিল— ‘সাড়ে ছ’টা বেজেছে, চায়ের সময় হল। তুমি চা খাবে তো?’

‘খাব।’

‘চায়ের সঙ্গে লুচি আর আলুভাজা। কী বল?’

‘হুঁ।’

খাট হইতে উঠিতে গিয়া ছায়ার গায়ে গা ঠেকিয়া গেল। গৌরমোহন লজ্জায় লাল হইয়া উঠিল। অদর্শনা যুবতী যে সম্পূর্ণরূপে বিবস্ত্রা তাহা স্মরণ হইয়া গেল।

রান্নাঘরে গিয়া গৌরমোহন স্টোভ জ্বালিয়া জল চড়াইয়া দিল। তারপর ময়দা মাখিতে বসিল। দেখিল তাহার অনতিদূরে বঁটিতে আলু কোটা হইতেছে, চাকা চাকা আলু কোটা হইয়া একটি রেকাবে জমা হইল, তারপর বালতির জলে ধৌত হইয়া তাহার পাশে আসিয়া উপস্থিত হইল।

‘রাত্রে খিচুড়ি রাঁধা যাবে। তুমি খিচুড়ি ভালবাসো তো?’

একটি নিশ্বাস পড়িল— ‘তেলেভাজা আর লাড্ডু ছাড়া সব ভালবাসি।’

তাই সে নূতন খাদ্যদ্রব্য দেখিয়া লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। গৌরমোহন সহানুভূতির সুরে বলিল, ‘আহা! তেলেভাজা ফুলুরি আর লাড্ডু খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে।— তুমি চায়ে ক’চামচ চিনি খাও!’

‘অনেক দিন চা খাইনি। যখন খেতুম, পাঁচ চামচ চিনি খেতুম।’

চায়ের জল টি-পটে ঢালিয়া গৌরমোহন লুচি ভাজিতে বসিল।

‘আমি লুচি ভাজতে জানি। তুমি সরো— আমি ভাজছি।’

‘না, না। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। অনেক কষ্ট করেছ। ঘর পরিষ্কার করেছ, বাসন মেজেছ—’

‘আমার ইচ্ছে কচ্ছে—’ কণ্ঠস্বরে একটু আদুরে আদুরে ভাব।

‘তা— আচ্ছা। তুমি ভাজো।’

গৌরমোহন সরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল। লুচি ও আলুভাজা প্রস্তুত হইল, রেকাবির উপর সজ্জিত হইল। স্টোভ নিভিয়া গেল।

দু’জনে খাইতে বসিল। গৌরমোহন চা ঢালিল, নিজের পেয়ালায় দু’চামচ চিনি দিল, ছায়ার পেয়ালায় পাঁচ চামচ।

খাওয়া চলিতেছে। ছায়ার রেকাবি হইতে লুচির টুকরো শূন্যে উঠিয়া অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে, চায়ের পেয়ালা ক্রমে ক্রমে খালি হইয়া গেল। গৌরমোহন দেখিতেছে, তাহার বিস্ময় কিছুতেই শেষ হইতেছে না।

‘তুমি হঠাৎ কথা কইলে যে! আগে তো কথা কওনি।’

‘কথা কইতে ভুলে গিয়েছিলুম। বলতে চেষ্টা করছিলুম, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। তারপর— বাজ পড়ার শব্দ হল। ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে গেল।’

গৌরমোহন চায়ে চুমুক দিয়া একটু সঙ্কুচিত হাসিল— ‘শুধু কথাই বলনি, আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।’

‘বড্ড ভয় করছিল যে!’

সরল অকপট উক্তি, লজ্জা নাই। লজ্জা বোধ করি স্ত্রীলোকের দেহচেতনার অভিব্যক্তি। যাহার দেহ দেখা যায় না, সে কিসের লজ্জা করিবে!

‘আচ্ছা, কাল আমি যখন এলাম, তুমি আমাকে দেখেছিলে?’

‘হ্যাঁ। আমি তো পাকুড় গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিলুম।’

‘আমি যখন বাড়িতে এসে উঠলাম, তখন তোমার কি মনে হয়েছিল?’

‘প্রথমটা ভয়-ভয় করছিল। তারপর তোমাকে খুব ভাল লাগল।’

গৌরমোহনের বুকের ভিতরটা দুরু দুরু করিয়া উঠিল। কিন্তু তাহা ভয়ের দুরু দুরু নয়।…

সে-রাত্রে পেট ভরিয়া খিচুড়ি খাইবার পর গৌরমোহন নিজের খাটের পাশে আসিয়া বসিল। ছায়া তাহার গা ঘেঁষিয়া বসিল। এই কয়েক ঘণ্টায় গৌরমোহনের লজ্জা-সঙ্কোচ অনেকটা কাটিয়াছে। তবু ছায়ার গায়ে গা ঠেকিতে তাহার শরীর একটু রোমাঞ্চিত হইল।

‘আচ্ছা, তুমি মানে— খালি গায়ে থাকতে কোনও ইয়ে হয় না।’

‘অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম দু’-একবার কাপড় চুরি করে পরেছিলুম, কিন্তু কাপড় পরলে শুধু কাপড়টাই দেখা যায়, আমাকে দেখা যায় না, লোকে ভয় পায়। তাই আর পরি না।’

‘ভাল কথা। তুমি রাত্তিরে শোও কোথায়?’

‘মেঝেয় শুই।’

‘শীতকালে শীত করে না?’

‘না। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।’

‘তা হোক। আজ তোমাকে খাটে শুতে হবে। আমি তোষক পেতে মেঝেয় শোব।’

‘না। আমি খাটে শোব না।’

‘তুমি মেয়ে হয়ে মেঝেয় শোবে আর আমি খাটে শোব, এ হতেই পারে না।’

‘আমি খাটে শোব না।’ ছায়ার কণ্ঠস্বর দৃঢ়।

‘শোবে না! তাহলে মেঝেতেই তোমার তোষক পেতে দিই। কোন ঘরে শোবে বল।’

‘এই ঘরেই শোব। তুমি ওঠো। আমি তোষক পেতে দিচ্ছি।’

গৌরমোহন কুণ্ঠিত হইয়া উঠিয়া দাড়াইল— ‘এই ঘরে? কিন্তু— মানে—’

খাটে দু’খানা তোষক ও দু’টা বালিশ ছিল। ছায়া একখানা তোষক টানিয়া খাটের পাশেই পাতিয়া ফেলিল। গৌরমোহন বলিল, ‘বালিশ নাও।’

একটু হাসির শব্দ শোনা গেল— ‘বালিশ লাগবে না। তোষকেই হয়তো অস্বস্তি হবে। এবার ঘুমিয়ে পড়, তোমার বোধ হয় ঘুম পাচ্ছে। আলো কমিয়ে দিই?’

‘দাও।’

ঘরের কোণে দেয়ালের পাশে লণ্ঠনটা জ্বলিতেছিল, এখন কমিয়া গিয়া দেয়ালের একটুখানি স্থান প্রভান্বিত করিল মাত্র। গৌরমোহন উদ্বেলিত হৃদয়ে অপরিসীম বিস্ময়ানন্দ লইয়া শুইয়া রহিল। এ কী অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা! বিশ্বসংসারে আর কেহ কি ইহা অনুভব করিয়াছে?

‘ছায়া!’

মুহূর্তমধ্যে ছায়া তাহার গায়ে হাত দিয়া দাঁড়াইল— ‘কী?’

গৌরমোহন বলিল, ‘তুমি কে, কি করে অদৃশ্য হয়ে গেলে, কিছুই তো জানা হয়নি। বলবে আমায়?’

ছায়া খাটের পাশে বসিল, গৌরমোহনের একটা হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে চাপিয়া ধরিল।—

‘আমার বয়স তখন নয় কি দশ বছর।’

গৌরমোহন মনে মনে হিসাব করিল, ছায়ার বয়স এখন উনিশ কি কুড়ি।

—‘বাবা, মা, আমি আর আমার ছোট ভাই ভাদু এখানে বেড়াতে এসেছিলুম। আমার বাবার নাম ছিল নিধিরাজ মল্লিক। এ বাড়ির মালিক ছিলেন মদনলাল শেঠ, তাঁকে আমরা মদন কাকা বলে ডাকতুম।

‘একদিন বিকেলবেলা ঝড় উঠল। আজ যেমন ঝড় উঠেছিল তেমনি। আমরা দোর-জানালা বন্ধ করে বাড়ির মধ্যে বসে রইলুম। বাড়ির ওপর বার বার বাজ পড়তে লাগল। আমি এই খাটের উপর বসে ছিলাম। তারপর কি হল জানি না, আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লুম।

‘যখন জ্ঞান হল দেখলুম এই ঘরের এক কোণে পড়ে আছি। নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না। বাড়িতে কেউ নেই, সামনের দরজায় তালা লাগানো। এখন মনে হয় তিন-চার দিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম।

‘গলার আওয়াজ একেবারে বুজে গিয়েছিল। আমি খিড়কি দোর দিয়ে বেরিয়ে বাগানে গেলুম, বাগানেও কেউ নেই। তখন ইস্টিশানের কাছে বাজারে গেলুম। সেখানে দু’-তিনজন লোক মুদির দোকানে বসে গল্প করছিল। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলুম, আমার মা-বাবা-ভাই কেউ বেঁচে নেই। কাঁদতে কাঁদতে আবার এই বাড়িতে ফিরে এলুম।

‘সেই থেকে একলা এই বাড়িতে আছি। প্রথম প্রথম ক্ষিদে পেলে মুদির দোকানে গিয়ে খাবার চুরি করে খেতুম। তারপর ওরাই এসে আমার খাবার দিয়ে যেত। এমনি করে কত বছর কেটে গেল।… তারপর তুমি এলে।’—

গৌরমোহন শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল, কি বিচিত্র এই জগৎ! বাজ পড়িয়া মানুষ অদৃশ্য হইয়া যায়, ইহা কি সম্ভব? গৌরমোহন বিজ্ঞান জানে না, হয়তো বিজ্ঞানী ইহার ব্যাখ্যা জানেন। যদি না জানেন তাহাতেই বা ক্ষতি কী? বিজ্ঞানীরা কি সকল বিশ্ব-রহস্যের ব্যাখ্যা করিয়াছেন? এই যে অদর্শনা যুবতী তাহার হাতে হাত রাখিয়া বসিয়া আছে, সে কি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে?

গৌরমোহন একটি আকাঙক্ষা-ভরা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘তোমাকে ভারি দেখতে ইচ্ছে করছে ছায়া!’

পরদিন সকালবেলা দেরিতে ঘুম ভাঙিল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহারা গল্প করিয়াছে, ফুলশয্যার রাত্রে নূতন বর-বধূর মতো। তবু কৌতূহল শেষ হয় নাই, সঙ্গ-তৃষ্ণা মিটে নাই। অবশেষে রাত্রি শেষ হয় দেখিয়া জোর করিয়া ঘুমাইয়াছিল।

সকালে ছায়া গৌরমোহনের বুকের উপর করতল রাখিয়া ডাকিল— ‘ওঠো, চা এনেছি।’

গৌরমোহন উঠিয়া বসিয়া শূন্যে অবস্থিত চায়ের পেয়ালা হাতে লইল, ঘুমভরা গলায় বলিল, ‘তোমাকে ভারি দেখতে ইচ্ছে করছে ছায়া।’

ছায়া করুণ নিশ্বাস ফেলিল— ‘কি করে দেখবে!’

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতেই গৌরমোহনের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলিয়া গেল। সে মুখ তুলিয়া বলিল, ‘ছায়া, একটা কাজ করবে?’

‘কী?’

‘তুমি কাপড়-জামা পরো। তাহলে খানিকটা তো দেখতে পাব।’

কাপড়-জামা পরার নামে ছায়ার কণ্ঠে একটু স্ত্রী-সুলভ ঔৎসুক্য ফুটিয়া উঠিল, ‘কাপড়-জামা কোথায়?’

‘আমার বাক্সে ধুতি আর গেঞ্জি আছে। তাই পরো। শাড়ি-ব্লাউজ তো নেই।’

ছায়া দ্বিধাভরে বলিল, ‘আচ্ছা।’

গৌরমোহন চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া বলিল, ‘আমি এখনি আসছি।’ বলিয়া গোসলখানার দিকে চলিয়া গেল।

দশ মিনিট পরে ঘরে ফিরিয়া আসিয়া গৌরমোহন চমকিয়া উঠিল। খাটের পাশে দাঁড়াইয়া আছে একটি প্রেতমূর্তি। হাত-পা নাই, মাথা নাই, সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি কবন্ধ। গৌরমোহন সত্রাসে বলিয়া উঠিল, ‘ছায়া! খুলে ফ্যালো, শিগ্‌গির খুলে ফ্যালো। আমি দেখতে পারছি না। মনে হচ্ছে তুমি একটা পেত্নী।’

ত্বরিতে ধুতি-গেঞ্জি স্খলিত হইয়া মাটিতে পড়িল।

তারপর সারাদিন দু’জনে অশান্ত মনে বাড়িময় ঘুরিয়া বেড়ায়, কখনও নদীর ঘাটে গিয়া দাঁড়ায়। গৌরমোহন বলে, ‘ছায়া, কী করে তোমাকে দেখতে পাব? ভারি যে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

ছায়া কঁদো-কাঁদো সুরে বলে, ‘আমি কি করব?’

‘তোমাকে না দেখতে পেলে জীবনই বৃথা।’

‘আমারও। মানে—’

‘বুঝেছি। আমি তোমাকে না দেখতে পেলে তোমার জীবন বৃথা!’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে এখন কি করা যায়? আমি যেন অন্ধ হয়ে গেছি, সব দেখতে পাচ্ছি, কেবল তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। বিজ্ঞানে আজকাল কত কী হচ্ছে, একটা অদৃশ্য মানুষকে জলজ্যান্ত করে দিতে পারে না! ছাই বিজ্ঞান।’

সেইদিন অপরাহ্নে গৌরমোহন বিষণ্ণ মনে ছবি আঁকিতে বসিল। কাল ছবিটা অতি সামান্যই আঁকা হইয়াছিল, একটা প্রাকৃতিক পরিবেশের আমেজ ফুটিয়া উঠিতে আরম্ভ করিয়াছিল মাত্র। গৌরমোহন ভাবিতে লাগিল— এই পরিবেশের মধ্যে ছায়ার একটি কল্প-মূর্তি আঁকা যায় না কি? কাপড়-পরা অবস্থায় ছায়ার দেহের যে ইঙ্গিত সে পাইয়াছে, তাহাকেই সূত্র ধরিয়া গোটা মানুষকে আঁকা যাইতে পারে। অবশ্য মুখ-চোখের গড়ন কাল্পনিক হইবে—

‘ছায়া, তোমার গায়ের রং কিরকম ছিল?’

ছায়া তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল, ‘ফরসা। মা বলতেন দুধে-আলতা।’

‘আর মুখ-চোখ?’

‘তা কি করে বোঝাব?’

‘হুঁ। আচ্ছা দেখি, তুমি আমার সামনে দাঁড়াও।’

গৌরমোহন আঙুলের স্পর্শে ছায়ার মুখ চোখ অনুভব করিয়া দেখিতে লাগিল। চোখ দুটি বেশ টানা টানা মনে হইতেছে, নাকটি সরু, ঠোঁট দুটি ভারি নরম, প্রসারে একটু বড়—

গৌরমোহন বলিল, ‘তুমি আমার মডেল। দাঁড়িয়ে থাকো, তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আঁকব।’

প্যালেটের উপর রঙ মিশাইয়া তুলিতে তুলিতে সে ক্যাম্বিসের দিকে ফিরিতেছে এমন সময় একটা চোখ-ধাঁধানো আইডিয়া ক্ষণেকের জন্য তাহাকে বিমূঢ় করিয়া দিল। তারপর সে চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘ছায়া! ছায়া!’

‘এই যে আমি।’

‘কাছে এস। কই, তোমার মাথাটা দেখি। হ্যাঁ, এইবার চুপটি করে থাকো। এ বুদ্ধিটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি। তোমার গায়েই তোমার ছবি আঁকব, যেমন কাচের উপর ছবি আঁকে। বুঝেছ?’

বাঁ হাতে ছায়ার মাথা ধরিয়া গৌরমোহন ডান হাতের রঙ-মাখা তুলি দিয়া তাহার গালে স্পর্শ করিল। গালের উপর পাকা ডালিমের রঙ লাগিয়া রহিল।

গৌরমোহনের ইচ্ছা হইল উঠিয়া নৃত্য করে। কিন্তু ইচ্ছা দমন করিয়া সে অতি যত্নে ছায়ার মুখে রঙ লাগাইতে আরম্ভ করিল। ধীরে ধীরে মুখখানি ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। ঠোঁটে একটু গোলাপী রঙ দিল, ভুরুতে কালো রঙ। কিন্তু—

চোখের মণিতে তো রঙ লাগানো যায় না, চোখ দুটি শূন্য রহিল। তবু মুখখানি চমৎকার; পান-পাতার আকৃতি, একটু কৃশ। গৌরমোহন বলিল, ‘ছায়া! কি সুন্দর তুমি! দাঁড়াও, চোখের ব্যবস্থা করছি।’

সে ছুটিয়া গিয়া পাশের ঘর হইতে নিজের ধোঁয়া-কাচের চশমা আনিয়া ছায়ার চোখে পরাইয়া দিল। ছায়ার মুখ প্রাণবন্ত হইয়া উঠিল। রূপকথার রাজকন্যার মতো মুখ, ঘুমন্ত রাজকন্যার চোখে নিদালীর অন্ধকার।

ছায়া একটু ভঙ্গুর হাসিল।

গৌরমোহনের শিল্পী-মন আর শাসন মানিল না, সেই দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলিয়া ছায়াকে ঘিরিয়া নাচিতে লাগিল।

তারপর নাটকীয় পরিস্থিতি।

গৌরমোহনের মাতৃদেবী শশিমুখী সহসা ঘরের দ্বারদেশে আবির্ভূতা হইলেন। এবং গৌরমোহনকে একটি দেহহীন মুণ্ডের চারিপাশে নৃত্য করিতে দেখিয়া একটি অনৈসর্গিক আর্তনাদ ছাড়িয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। তাঁহার পশ্চাতে গৌরমোহনের বন্ধু মোহনলাল রোমাঞ্চিত কলেবরে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

শশিমুখীর আবির্ভাব অনৈসর্গিক নয়। গৌরমোহন ফেরার হইবার পর তিনি প্রচণ্ড-বেগে তদন্ত শুরু করিয়া দিয়াছিলেন এবং অল্পকাল মধ্যে বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, মোহনলাল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। তিনি তখন মোহনলালের গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলেন। মোহনলাল বেশিক্ষণ এই কণ্ঠ-নিষ্পেষণ সহ্য করিতে পারে নাই; সত্য কথা বলিয়া ফেলিয়াছিল। তখন শশিমুখী মোহনলালকে সঙ্গে লইয়া গৌরমোহনকে ধরিতে আসিয়াছিলেন।

তারপরই নাটকীয় পরিস্থিতি।

গৌরমোহন বন্ধুকে ভর্ৎসনা করিল না, বরং বলিল, ‘ভালই হয়েছে।’ সে মোহনলালকে সব কথা খুলিয়া বলিল।

ছায়া ইতিমধ্যে নদীতে গিয়া মুখের রঙ ধুইয়া আবার সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। সে ভীতু মানুষ, এইসব গণ্ডগোল দেখিয়া ভয় পাইয়া গিয়াছে।

শশিমুখীর জ্ঞান হইলে তিনি ভয়ার্ত চক্ষে একবার চারিদিকে চাহিলেন, তারপর ‘বাবা গো’ বলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে স্টেশনের দিকে যাত্রা করিলেন। তাঁহার গতিবেগ লক্ষ্য করিবার লোক ছিল না, থাকিলে এই দৃশ্য দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া যাইত।

পাকুড়তলায় দাঁড়াইয়া গৌরমোহন মোহনলালকে বলিল, ‘তুই মাকে নিয়ে ফিরে যা। শিগ্‌গির একটা পুরুত নিয়ে আসবি, দেরি করবিনে।’

‘আচ্ছা। তখন তোর বৌকে ভাল করে দেখব।’

‘আর একটা কথা। তুই তোর বাড়িটা আমাকে বিক্রি করে দে ভাই। এখানেই বৌ নিয়ে থাকব।’

‘বিক্রি করব না। বাড়িটা তোর বিয়ের যৌতুক।— আচ্ছা চললাম, কাল-পরশুর মধ্যেই পুরুত নিয়ে ফিরব। দই, সন্দেশ, মাছ, কনের গয়না, বেনারসী সব নিয়ে আসব।’

মোহনলাল চলিয়া গেল। গৌরমোহন দাঁড়াইয়া হাত নাড়িতে লাগিল।

একটি বাহু আসিয়া তাহার বাহুর সহিত জড়াইয়া গেল। গৌরমোহন সেই দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘চল, আর একবার। ভাল করে এখনও তোমায় দেখা হয়নি।’

৫ আশ্বিন ১৩৬৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *