পাঁচ
চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছেন ভারতী দেবী। চোখদুটো বোজা। রাধা তার চুলে তেল ঘষছে। দরজার আওয়াজে চোখ খুলে ঘাড় ফেরালেন। স্বামীকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন, রাধা তড়িঘড়ি গায়ের আঁচল ঠিক করে সরে দাঁড়াল।
বাসুদেব এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন, ‘কেমন আছ ভারতী?’
ভারতী দেবী উত্তর না দিয়ে রাধার দিকে তাকালেন। রাধা ঘরের কোণে রাখা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অন্য কেউ এলে পেশেন্টকে ফেলে ঘর ছাড়ে না রাধা। পিতাপুত্রের বেলায় নিয়ম আলাদা।
ভারতী দেবী স্বামীকে বললেন, ‘বোসো।’
‘বললে না তো কেমন আছ?’
ভারতী দেবী শুকনো হেসে বলল, ‘ভালো, তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।’
খোলা জানালা দিয়ে সকালের মেঘ কাটা নরম রোদের একটা ফালি এসে পড়েছে মেঝের ওপর। ভারতী দেবী পা ছড়িয়ে সেই রোদ ছুঁয়ে আছেন। প্রতিদিনের মতো বাসুদেব আজও লক্ষ করলেন, বয়স এবং দীর্ঘ রোগভোগ মানুষটার সৌন্দর্যের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চোখ-মুখের আড়ালে আজও সেই স্নিগ্ধ, শান্ত ভাবটা রয়েই গেছে। বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে চেহারায় এক ধরনের চাপা আভিজাত্য ফুটে উঠছে ভারতীর।
পাগল মানুষের ‘জরুরি কথা’র কোনও মূল্য নেই। তবু বাসুদেব স্বাভাবিকভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘বলো, শুনি তোমার জরুরি কথা কী। বাগান নিয়ে কিছু?’
‘তুমি আমাকে হাসপাতালে রেখে এসো।’
বাসুদেব ভুরু কুঁচকে সামান্য হেসে বললেন, ‘কেন? বাড়িতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে?’
ভারতী দেবী মাথা নামিয়ে চেয়ারের হাতলে আঙুল বোলাতে লাগলেন, ‘আমার নয়, অসুবিধে হচ্ছে তোমাদের।’
বাসুদেব সামান্য চমকে উঠলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললেন, ‘এত বছর পর হঠাৎ অসুবিধের কথা! কে বলল?’
ভারতী দেবী মুখ না তুলেই বললেন, ‘আমি জানি।’
বাসুদেব স্ত্রীর বাঁ-হাতের ওপর আলতো করে হাত রেখে বললেন, ‘এসব বলছ কেন ভারতী? এই বাড়ি তো তোমারই। এখানে তোমার সুবিধে অসুবিধেটাই আসল কথা। এতবছর যখন পারা গেছে, বাকি দিনগুলোও চমৎকার চলবে। সেদিন যখন বাড়িতে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম, তখন নিশ্চয়ই সবাই মনে-মনে বিরক্ত হয়েছিল। আজও তো প্রমাণ হচ্ছে ভুল কিছু করিনি। তুমি তো অনেকটা সুস্থ।’
এতকিছু শুনলেন বলে মনে হল না, ভারতী দেবী একইভাবে মাথা নামিয়ে বললেন, ‘আমার জন্য তোমার ঘর সংসার তছনছ হয়ে গেছে, আর নষ্ট হতে দিও না।’
বাসুদেব মৃদু হাসলেন। প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বললেন, ‘মাথা থেকে এসব হাবিজাবি চিন্তা একেবারে ঝেড়ে ফেলো তো ভারতী। ঠিক করেছি, এবার থেকে মাঝেমধ্যে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব। সকালবেলা পার্কে গিয়ে একটু বসবে। পার্কটা চমৎকার। কত গাছ। যখন এখানে এসেছিলাম গাছগুলো সব ছোট-ছোট ছিল, এখন কত বড় হয়ে গেছে। একটা ঝিলের মতো আছে। সেই ঝিলের পাশে বসে থাকলে তোমার ভালো লাগবে।’
‘কী জানি হয়তো লাগবে। কিন্তু তুমি আমাকে হাসপাতালেই পাঠিয়ে দাও।’
বাসুদেব হতাশ বোধ করলেন। ভারতী এখন এটার মধ্যে ঢুকে গেছে। চট করে বেরোতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অসুস্থতার শুরুতে মেন্টাল ক্লিনিকেই ভরতি করা হয়েছিল রোগীকে। খোঁজাখুঝির পর মেয়ের বাপের বাড়ির কাছেই এক জায়গায় ব্যবস্থা হল। সেই সময় বাসুদেব বাইরে চলে যাচ্ছেন। মেয়ের বাবাকেই দেখাশোনা করতে হবে। ভদ্রলোক অবশ্য চেয়েছিলেন, কলকাতায় বড় কোথাও চিকিৎসা হোক। বাসুদেব চৌধুরি বললেন, ‘আমি চাই না, আমার বউ পাগল হয়ে গেছে এই খবরটা এখনই সবাই জেনে যাক। যতই খরচ হোক এখানেই ব্যবস্থা করতে হবে। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।’
ভারতী দেবীর বাবা অসহায়ভাবে বলেছিলেন, ‘এই সময়টায় তুমি থাকলে ভালো হত।’
বাসুদেব ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘হত, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। অনেকগুলো অর্ডারের ব্যাপার।’
‘তুমি যদি অফিসের কাউকে পাঠাতে…আমি বুড়ো মানুষ পাগল মেয়েকে নিয়ে…আত্মীয়পরিজন তো কেউ তেমন নেই।’ বাসুদেব কঠিন গলায় বললেন, ‘আত্মীয় পরিজনের কী প্রয়োজন? আপনাকে বললাম তো, আমি চাই না ঘটনা জানাজানি হোক। আপনাকে কিছু করতে হবে না, যা করার ডাক্তার আর ক্লিনিকের লোকজনই করবে। আমি নিজে না গিয়ে ম্যানেজারদের কাউকে হয়তো বাইরে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু এই ধরনের ইমপর্ট্যান্ট নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ব্যাবসাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কেন গুরুত্বপূর্ণ সে আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। গিয়ে লাভ হবে না, আপনারা বুঝতেও পারবেন না। ‘কনক গার্মেন্টস’কে ঠিকভাবে রক্ষা করা আমার রেসপনসিবিলিটির মধ্যে পড়ে। বিশ্রী অবস্থা থেকে আজ আমি যে এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি, তার কারণ এই ব্যাবসা। এর কোনও ক্ষতি আমি করতে পারব না। এখন বাইরের অর্ডারগুলো না নেওয়া মানে কোম্পানির ক্ষতি করা।’
ভদ্রলোক অবাক হয়ে জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিস্মিত গলায় বলেন, ‘নিজের স্ত্রীর অসুবিধে হবে জেনেও করবে না। টাকার এত লোভ?’
ছোট পদের একটা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জামাইয়ের বদান্যতায় বেঁচে থাকা সামান্য শ্বশুরের মুখে এ কথা শুনে অন্য কেউ হলে অপমানিত হত। বাসুদেব মৃদু হাসলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘টাকার লোভ কি সহজ জিনিস বলে মনে করেন আপনি? টাকা থাকলে অচেনা অজানা, বয়েসে বড় একটা লোকের সঙ্গে সুন্দরী মেয়ের বিয়ে দিতেও মানুষ পিছপা হয় না। একবার মনে হয় না, খোঁজ নিয়ে দেখি, লোকটা কেমন কী তার অতীত? স্বভাব চরিত্রই বা কী, বেটা আরও কোথাও ঘরসংসার করে বসে আছে কি না, কোনও প্রশ্নই আর প্রশ্ন থাকে না। টাকায় সব প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়। তাই না?’
ভারতী দেবীর বাবা খোঁচাটা নিয়ে চুপ করে রইলেন।
বাসুদেব বললেন, ‘শুধু টাকার জন্য হলে হয়তো আমি সব প্রাোগাম ক্যানসেল করে ভারতীর কাছে থেকে যেতাম, কিন্তু আমার ব্যাবসাটা তার থেকেও বেশি কিছু। যাক চিন্তা করবেন না, আমি বাইরে থেকে খোঁজ রাখব। ফিরে এসে যা করবার করব। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার মেয়ে উন্মাদ, কোনওদিন সে আমার সন্তানের মাও হতে পারবে না, তবু আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তাকে ভালো রাখব।’
ভদ্রলোক খানিকটা অনুশোচনার ঢঙে বলে, ‘আমি যদি এই ক’টাদিন তাকে আমার কাছে রাখি, বাড়িতে…।’
‘সেটা করতে যাবেন না। এই রোগীকে বাড়িতে রাখা যায় না। সি বিকামস ভায়োলেন্ট। সামলাতে পারবেন না।’
ঘটনা তাই। অসুখ শুরুর খুব অল্পদিনের মধ্যে দেখা গেল, বাড়াবাড়ির সময়গুলোতে রোগী শুধু হিংস্র হয়ে পড়ে না, ভয়ংকর আচরণ করতে থাকে। গায়ের জামাকাপড় খুলে ফেলে। খুলতে না পারলে হাতে টেনে, দাঁতে কেটে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়। তারপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। চেষ্টা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে নেমে যেতে চায় সিঁড়ি দিয়ে। বাধা দিতে গেলে আঁচড়ে কামড়ে একাকার কাণ্ড করে। পরিচারিকা মেয়েটির তিনদিনের মাথায় কাজ ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে অনেকটা সময় কাঁদল। সম্ভবত সে তার একসময়ের সুন্দর স্নেহপ্রবণ মালকিনকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে কষ্ট পাচ্ছিল।
প্রথম চোটে যতটা ভেঙে পড়া উচিত বাসুদেব ততটা ভাঙলেন না। সম্ভবত তিনি আর পাঁচজনের মতো নন বলেই ভাঙলেন না। জীবনের অনেকগুলো টালমাটাল অধ্যায় তাকে পার হতে হয়েছে। অথবা ভেতরে-ভেতরে ভাঙলেন, কাউকে চট করে বুঝতে দিলেন না। বাইরের লোকজন যেটুকু জানল তা খুবই ভাসা ভাসা। শুধু চিকিৎসকের কাছেই কিছুটা মনের কথা বলছিলেন বাসুদেব। তখন ডাক্তার বর্ধন ভারতীদেবীর চিকিৎসা শুরু করেছেন।
‘যতই মাথা খারাপ হোক, নিজের স্ত্রী ওভাবে ছোটাছুটি করছে, সহ্য করা মুশকিল ডাক্তারবাবু। এত আপসেট লাগে। যে মেয়েটি এত লাজুক ছিল, সে-ই সব লজ্জা ভুলে…।’
ডাক্তার বর্ধন নরম গলায় বললেন, ‘উনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ার এক জটিল পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছেন মিস্টার চৌধুরি। এই সময়ে হঠাৎ-হঠাৎ পেশেন্টের মধ্যে এক ধরনের উগ্র ভাব তৈরি হয়।’
‘হঠাৎ কেন এমন হল?’
ডাক্তার চিন্তিত গলায় বলেছিলেন, ‘কী করে হল সেটা এত সহজে বোঝা যায় না। জেনেটিক ডিসঅর্ডার বা হরমোনাল ডিসব্যালান্স ব্রেন ফাংশনকে কোথায় কখন সমস্যায় ফেলে বোঝা মুশকিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। হয়তো একদিন জানা যাবে।’
‘আমি কি বাইরে কোথাও চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাব? বিদেশে?’
‘এই কন্ডিশনে পেশেন্টকে মুভ করানো কঠিন। তা ছাড়া এতে বাড়তি লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশ যে মানসিক রোগের চিকিৎসায় খুব পিছিয়ে আছে এমন নয়। অনেকরকম ওষুধ বেরিয়ে গেছে। গরিব মানুষ সেসব চিকিৎসা পায় না এই যা।’
বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন বাসুদেব। এই রোগীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে মাস কয়েকের মধ্যে চিকিৎসা শেষ করে ফিরে আসা যাবে। আরও সময় লাগতে পারে। কতদিন তারও কোনও ঠিক নেই। ব্যাবসাপাতি ছেড়েছুড়ে অতদিন তার পক্ষে বাইরে বসে থাকাও অসম্ভব। ভারতীকে যে ছেড়ে চলে আসবেন তার উপায়ও নেই, এই রোগীকে শুধু বাইরের লোকের হাতে ছেড়ে রাখা যায় না। অফিসের কাউকে দায়িত্ব দিতে গেলে জানাজানি হয়ে যাবে। মালিকের সুন্দরী স্ত্রী উলঙ্গ হয়ে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে এটা গল্প হিসেব বড্ড বেশি মুখরোচক। কেউ ‘আহা উঁহু’ করলেও সেটা সহ্য করা যাবে না। বাকি রইল আত্মীয়পরিজন। বাসুদেব চৌধুরির দিক থেকে সেরকম কারও থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আর ভারতীর বাপের বাড়ি বলতে শুধু বৃদ্ধ বাবা। সবদিক ভেবেচিন্তে রোগীকে তার বাবার দায়িত্বে রাখার সিদ্ধান্তই নিলেন বাসুদেব। তবে সরাসরি দায়িত্বে নয়, কাছাকাছি মেন্টাল ক্লিনিকে ভরতি করা হল।
বাইরে থেকে ফেরার পর সেই ক্লিনিক থেকেও নিয়ে আসতে হয়। ভারতী দেবীই থাকতে চাননি।
বাসুদেব তার স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, ‘বাড়িটায় রং করব ভেবেছি ভারতী। অনেকদিন কিছু করা হয়নি। খুচখাচ মেরামতিরও দরকার।’
ভারতী দেবী থম মেরে রইলেন। বাসুদেব বললেন, ‘কী রং করা যায় বলো তো? আচ্ছা, ঠিক আছে রঙের চার্টটা তোমাকে পাঠিয়ে দেব। তুমি বেছে দিও।’
‘তুমিই বলে দিও। রং বেছে আমার কী হবে?’
বাসুদেব মৃদু হেসে বললেন, ‘বা: কী হবে মানে। তোমার বাড়িতে কী রং হবে তুমিই তো বলবে।’
ভারতী দেবী ছোট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আচ্ছা, বলব।’
বিদেশ থেকে ফিরেই বাসুদেব চৌধুরি সোজা ক্লিনিকে চলে যাওয়ার যে গল্পটা চালু আছে সেটা আধখানা সত্যি। তিনি গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু রোগীর সঙ্গে দেখা হয়নি। ডাক্তার বলল, ‘মিস্টার চৌধুরি, গত দুদিন পেশেন্ট একটা আনরেস্ট অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই সময়ে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটা মনে হয় না তার পক্ষে ঠিক হবে। আপনার স্ত্রীর কথা ভেবেই আমরা অনুরোধ করব, এতদিন যখন করেছেন ক’টাদিন অপেক্ষা করুন।’
‘ক’দিন।’
‘ম্যাক্সিমাম দিনতিনেক।’
‘এরকম আনরেস্ট অবস্থা কি তার প্রায় চলছে?’
‘না প্রায় না, তবে একটা সাইক্লিক অর্ডারে ঘুরে ঘুরে আসছে। সমস্যা হল কখন আসবে আগাম বলা যায় না। হঠাৎ যে-কোনও সময় হয়। তবে এখানে ভরতি হওয়ার সময়ে যা ছিল তার থেকে অনেক বেটার। অনেকটা সময় তিনি প্রায় স্বাভাবিকের কাছাকাছি আচরণ করতে পারছেন।’
‘আমি কি দূর থেকে তাকে একবার দেখতে পারি।’
ডাক্তার অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি যদি জোর করেন আমরা বাধ্য হব, কিন্তু আমি না দেখারই পরামর্শ দেব।’
বাসুদেব বলেন, ‘ঠিক আছে। আমি তিনদিন পরেই আসব।’
তিনদিন নয়, দু-দিনের মাথায় গেলেন বাসুদেব। রোগা ধরনের এক মহিলা অ্যাটেনডেন্ট পেশেন্টকে ভিজিটরস রুমে নিয়ে এল। স্ত্রীকে দেখে ভালো লাগল বাসুদেবের। পরিপাটি করে চুল বাঁধা। চোখমুখও অনেকটা ঝরঝরে। গায়ে নার্সিং হোমের সবুজ রঙের গাউন। গলা থেকে পা পর্যন্ত বড়-বড় বোতাম। কোমরে পাকানো দড়ির বেল্ট ঘরের এক কোনায় স্বামীর মুখোমুখি জবুথবু হয়ে বসলেন ভারতী দেবী। বাসুদেবের হাতের ইশারায় অ্যাটেনডেন্ট সরে দাঁড়াল।
কেমন আছ ভারতী?’
ভারতী দেবী আলতো ভাবে ঘাড় নাড়ালেন। এতদিন পর স্বামীকে দেখে তার কোনও বাড়তি উচ্ছ্বাস হল না।
‘খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ?’
‘হ্যাঁ, করছি।’
‘কী দেয়?’
‘মাছ দেয়। মাংসও দিয়েছে।’
বাসুদেব বললেন, ‘রাতে পুডিং দেয়? আমি তো স্পেশাল ডায়েটের জন্য বলে গিয়েছিলাম।’
‘দেয়। বেশি মিষ্টি বলে খেতে পারি না।’
বাসুদেব সামান্য বিরক্ত হলেন। তিনি ঠিক করলেন মেট্রনের সঙ্গে কথা বলবেন। এটা কেমন কথা? পেশেন্ট কেন খেতে পাচ্ছে না দেখবে না? পুডিং-এ মিষ্টি কমিয়ে দিলেই তো সমস্যা মিটে যায়। সেরকম হলে এবার বাড়ি থেকে দুবেলা খাবার আসবে।
বাসুদেব একটু হেসে বললেন, ‘কই তুমি তো জিগ্যেস করলে না আমি কেমন আছি? কেমন কাজ হল?’
ভারতী দেবী একইরকম ঝিম ধরা গলায় বললেন, ‘কেমন আছ?’
বাসুদেব হালকা গলায় বললেন, ‘ভালো খারাপ, দু-রকমই আছি। তোমার জন্য খারাপ আর ব্যবসার কাজ খুব ভালো হয়েছে বলে ভালো। তোমার বাবাকে তো দেখলাম, আমাকে দেখে যেন হাতে চাঁদ ফিরে পেলেন।
ভারতী দেবী বললেন, ‘ও!’
ডাক্তারবাবু আসেন?’
‘আসেন। সকালে আর রাতে আসেন।’
ঘুম হয়?’
ভারতী দেবী মাথা কাত করলেন। বাসুদেব খুশি হলেন। সামান্য পুডিং-এ গোলমাল হলেও চিকিৎসা যে ভালো হচ্ছে, তা পেশেন্টকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, ‘তা হলে ব্যবস্থা সব ভালোই বলছ?’
ভারতী দেবী একটু চুপ করে থেকে ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।’
বাসুদেব নড়েচড়ে বসলেন। ‘যাব, আর একটু সুস্থ হয়ে ওঠো, তার পরই নিয়ে যাব। তা ছাড়া এবার কলকাতার বড় কোনও জায়গায় তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। এখানে আর অল্প কিছুদিন থেকে যাও। আমি ওখানে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি। কিচ্ছু ভেব না, সব ঠিক হয়ে যাবে। এই অসুখের এখন খুব ভালো ভালো চিকিৎসা হয়েছে।
ভারতী দেবী শান্ত গলায় বললেন, ‘তুমি আমাকে এখনই নিয়ে চলো, আজই।’
বাসুদেব শান্ত গলায় বললেন, ‘এতদিন থাকলে, আর ক’টাদিন থাকতে পারছ না।’
ভারতী দেবী চাপা গলায় বললেন, ‘না পারছি না। শরীর খারাপ করলে ওরা আমার কাপড়চোপড় সব খুলে নেয়।’
‘মানে! কাপড় খুলে নেয় মানে।’ বাসুদেব বিস্ফারিত চোখে বলেন।
‘সবার সামনে লজ্জা করে।’
ভারতী দেবীকে নিয়ে অ্যাটেনডেন্ট উঠে যাওয়ার পরেই মেট্রনের সঙ্গে দেখা করলেন বাসুদেব। অভিযোগ শুনে মোটা চেহারার মহিলা হাসলেন।
‘মিস্টার চৌধুরি আপনার স্ত্রীর মাথায় সমস্যা। তার কথা শুনে আপনার উত্তেজিত হওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
আপনি নিশ্চয় জানেন যে ফ্লোরে মিসেস চৌধুরিকে রাখা হয় সেটা একটা সেপারেট ফিমেল ওয়ার্ড। তবে এ-ধরনের ভায়োলেন্ট পেশেন্টের ক্ষেত্রে কিছু প্রিকশনারি মেজার তো আমাদের নিতেই হয়। ইটস পার্ট অব দ্য ট্রিটমেন্ট।’
‘তা বলে জামাকাপড় খুলে রাখবেন?’
মহিলা হাত তুলে বলে, ‘আপনি শান্ত হোন। ভায়োলেন্ট পেশেন্টকে অনেক সময় বেঁধেও রাখতে হয়। সবাই রাখে। তার ভালোর জন্য রাখে। আপনার স্ত্রীর বিশেষ সমস্যাটা আপনি তো জানেন, আমরা সবসময়ই অ্যালার্ট থাকি।’
সেদিনই বাসুদেব চৌধুরি ফিরতে-ফিরতে সিদ্ধান্ত নিলেন, আর ফ্ল্যাট নয়, যত দ্রুত সম্ভব একটা বাড়ি কিনবেন। গোটা বাড়ি। শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে একটু সরে। চারপাশে অনেকটা জায়গা থাকবে। বাড়ি ফিরে থাকবে উঁচু দেওয়াল। বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যাবে না। সেই বাড়িই হবে ভারতীর নার্সিংহোম। ডাক্তার, নার্স, অ্যাটেনডেন্ট সবাই থাকবে।
কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। ঠিক যেমনটা চাইছিলেন। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। শুধু বাউন্ডারি ওয়ালটা উঁচু করে নিতে হবে। বাড়ির মালিক সব বেচেবুচে আমেরিকায় একমাত্র পুত্রের কাছে চলে যাচ্ছে। লনের কারণে দাম একটু বেশিই পড়ল।
হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন বাসুদেব। অফিসের জন্য তৈরি হওয়ার সময় হয়ে গেল।
‘এবার উঠি ভারতী? তুমি তো দেখছি বেশ ভালো হয়ে উঠছ। আমার চিন্তা কমে যাচ্ছে।’
ভারতী দেবী অস্ফুটে বললেন, ‘আর একটা কথা ছিল।’
বাসুদেব ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বললেন, ‘সেটাও কি জরুরি?’
ভারতী দেবী চুপ করে রইলেন। বাসুদেব রসিকতার ছলে হেসে বললেন, ‘বাপরে, একদিনে এতগুলো জরুরি কথা! বলো।’ ভারতী দেবী নীচু গলায় বললেন, ‘তুমি স্বর্ণকে এবার বলে দাও।’
নিমেষে মুখ কঠিন হয়ে গেল বাসুদেবের। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী বলব?’
‘সব বলে দাও।’
বাসুদেব চৌধুরি মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন। দরজা বন্ধ। তা হোক, ওপাশে নিশ্চয় রাধা রয়েছে। ভারতী দেবী ঝুঁকে স্বামীর হাত ধরলেন।
‘আর লুকিয়ে রেখো না, দোহাই তোমায়।’
নিজের থতোমতো ভাবটা দ্রুত সামলে ওঠবার চেষ্টা করলেন বাসুদেব।
‘আ: কী হচ্ছে ভারতী।’
ভারতী দেবী ফিসফিস করে বললেন, ‘প্রায়ই ভাবি কথাটা তোমায় বলব। পাগল মানুষ ভুলে যাই। সাহসও পাই না।’
হাত সরিয়ে বাসুদেব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘শান্ত হও।’
‘আগে তুমি বলো স্বর্ণকে সব জানিয়ে দেবে? বলো।’
কথার জবাব না দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বাসুদেব বললেন, ‘উত্তেজিত হলে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
সোজা হয়ে বসলেন ভারতী দেবী। বাসুদেবের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘স্বর্ণকে তাহলে তুমি বলবে না?’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বাসুদেব শান্ত গলায় বললেন, ‘বলার মতো কিছু নেই। তুমি ভুল করছ।’
‘আমি ভুল করছি!’
বাসুদেব এবার কঠিন গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, ভুল করছ। আগেও এ কথা তুমি আমাকে অনেকবার বলেছ।’
‘এ কাজ তুমি কোরো না। এ অন্যায়। ওকে মুক্তি দাও তুমি।’
বাসুদেব চৌধুরি থমকে গেলেন। তার এতবছরের পাগল স্ত্রী ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলছে! ভারতী কি এতটাই ভালো হয়ে উঠেছে! তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। ভারতী দেবী কাঁপা গলায় বললেন, ‘তুমি যদি না বলো, তা হলে আমিই স্বর্ণকে ডেকে সব বলে দেব। সবাইকে বলে দেব।’
স্বর্ণর প্রসঙ্গ ওঠবার পর থেকেই ভেতরে-ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন বাসুদেব। এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। মুহূর্তের জন্য তিনি যেন স্ত্রীর অসুখের কথা বিস্মৃত হলেন। ঠোঁটের কোনায় হেসে বললেন, ‘কোনও লাভ হবে না ভারতী। মানুষ উন্মাদের কথা নিয়ে আলোচনা করে, হাসে কিন্তু বিশ্বাস করে না। তোমার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটবে। কেউ তোমার ও কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি বিশ্রাম করো, আমি রাধাকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।’
বাসুদেব চৌধুরি ঘর থেকে বেরিয়ে রাধার মুখোমুখি হলেন। মাথায় ঘোমটা টেনে রাধা সলজ্জ ভঙ্গিতে সরে দাঁড়াল একপাশে। বাসুদেব চৌধুরি অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘ভেতরে যাও রাধা, তোমার বড়মা সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’
রাধা ঘরে ঢুকতে ভারতী দেবী বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমাকে ওষুধ দে রাধা। আমি ভালো হতে চাই, এমন ভালো যাতে সবাই আমায় বিশ্বাস করে।’
ছয়
মালবিকা নার্ভাস মুখে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই দরজা বাসুদেব চৌধুরির অ্যান্টি চেম্বারে ঢোকার দরজা। আগে থেকে জানা না থাকলে চট করে এই দরজার অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল। সিলিং পর্যন্ত দেওয়াল জোড়া ওয়ালপেপারে ঘন সবুজ জঙ্গলের ছবি। গাছের গুঁড়ির গায়ে ছোট্ট নব লুকিয়ে আছে। সেই নব ধরে ঠেলা দিলে জঙ্গলের ভেতর পথ খুঁজে পাওয়ার মতো একফালি দরজা খুলে যায়।
মালবিকা সেই জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। দরজায় কি ধাক্কা দেবে? না কি নিজের টেবিলে ফিরে যাবে? হাতে সময় কম। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই কম সময়ের মধ্যেই নিতে হবে। লোকটা বলেছে, পাঁচমিনিট পরে আবার ফোন করবে।
কর্মচারী সামান্য হলেও মালবিকার কাজ যথেষ্ট ঝামেলার। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের যাবতীয় চিঠিপত্র এবং টেলিফোন চেক করা ঝামেলা ছাড়া আর কী? গুরুত্ব বুঝে চিঠি ফাইল করো, মেল? চেক করো, টেলিফোনের লাইন ‘স্যার’-এর টেবিলে পাঠাও। উনি ব্যস্ত থাকলে নম্বর টুকে রাখতে হয়।
এখনও তাই বলেছিল। বলেছিল, ‘দয়া করে আপনার নামটা বলবেন।’
ওপাশের লোকটা কঠিন গলায় বলল, ‘নামের দরকার নেই, আপনি আপনার স্যারকে লাইনটা দিন। আমার হাতে সময় কম।’
কথা বলার ধরনে প্রচ্ছন্ন একটা ধমকের ভঙ্গি।
মালবিকা শান্ত গলায় বলে, ‘সরি, এখন তো লাইন দেওয়া সম্ভব নয়। এই সময় উনি বাইরের কোনও ফোন ধরেন না।’
ওপাশের লোকটা যেন সামান্য হাসল।
‘আমারটা ধরবেন। বলুন, দুলাল ফোন করছে।’
কথা শেষ করে লোকটা সত্যি একটু হাসল। গা জ্বালানো ধরনের হাসি। মালবিকা নিজেকে সামলে বলল, ‘দু:খিত, এখন লাইন দেওয়া যাবে না।’
লোকটা একটু চুপ থাকে। তারপর বলে, ‘আপনার যখন এত ভয় করছে ম্যাডাম, আপনি বরং একটা কাজ করুন, ওর মোবাইল নম্বরটা বলে ফেলুন। দয়া করে নতুনটা বলবেন। পুরোনো দুটোই উনি বদলেছেন।’
‘স্যারের নতুন নম্বর আমি জানি না।’
লোকটা এবার ‘খ্যাক খ্যাক’ ধরনের নোংরা আওয়াজ করে হাসতে লাগল। হাসতে-হাসতে বারকয়েক কাশল। গলা শুনে মনে হচ্ছে বুড়ো মানুষ। মদটদ খেয়েছে না কি? এপাশে নাক সিটকোল মালবিকা।
‘আপনি বসের নতুন নম্বর জানেন না এ কখনও হয় ম্যাডাম? আচ্ছা, আপনার স্যার ঘনঘন মোবাইলের নম্বর বদলান কেন? এসব তো চোর-ডাকাতের কাজ। আপনার স্যার তো আর চোর-ডাকাত নন। তিনি একটা এত বড় কোম্পানির মালিক।’
মালবিকা বুঝতে পারল, এবার ফোন কেটে দেওয়ার সময় হয়েছে। লোকটা হাসি থামিয়ে বলল, ‘ডোন্ট ওয়ারি নম্বর কোথা থেকে পেয়েছি জানাব না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলে ফেলুন।’
মালবিকা কঠিন গলায় বলল, ‘স্যারের মোবাইল সুইচড অফ। আপনি হয়, আপনার নম্বরটা দিন, নয়তো ঘণ্টাখানেক পরে রিং করুন। স্যারকে বলে রাখব।’
‘ঘণ্টাখানেক! আমার হাতে দশ মিনিটও সময় নেই। শুধু আমার নয় ম্যাডাম, আমার কথা শোনার পর আপনার স্যারের হাতেও সময় থাকবে না। আমার নাম শুনেই দেখুন না কী করে। মাথায় ধরবার জন্য আইসব্যাগ রেডি করুন। অফিসে আইসব্যাগ রাখেন?’
মালবিকা আর ভদ্রতা রাখতে পারল না। ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ওপাশ থেকে কঠিন গলা ভেসে এল, ‘আমার কথা আপনার বোঝার কোনও প্রয়োজন নেই।’
মালবিকা বিড়বিড় করে বলে, ‘আপনার নামটা কি দয়া করে বলবেন?’
‘একই কথা বারবার বলছেন কেন? বললাম তো, নাম, নম্বর কিছুই বলব না। বলে লাভও হবে না। আমি বুথ থেকে ফোন করছি। আপনার স্যারের সঙ্গে কথা হয়ে গেলেই বুথ ছেড়ে বেরিয়ে যাব। আপনার স্যারকে ফোনটা ধরতে বলুন। সময় নষ্ট করবেন না।’
এটা কি কোনও থ্রেট কল? লোকটা হুমকি দিচ্ছে? মালবিকার নার্ভাস লাগছে। আজকাল ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের হুমকি দেওয়ার খবর কাগজে প্রায়ই দেখা যায়। এ-ও কি সেরকম কিছু?
‘আপনি কি লাইনটা একটু ধরতে পারবেন?’
ওপাশের বুড়ো লোকটা খুশি হল। বলল, ‘গুড গার্ল। এই তো এতক্ষণে গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছেন। ছোট মেয়ে তো ধমক ছাড়া কথা বুঝতে চাইছিলেন না। আপনি বরং একটা কাজ করুন, বাসুদেব চৌধুরিকে গিয়ে বলুন, আমি ঠিক পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন করব। উনি যেন রেডি থাকেন।’ কথা শেষ করে গলা একটু থমকাল। মুহূর্তখানেকের নীরবতা। আবার বলল, ‘বলবেন, ওর ছেলে স্বর্ণ একটা কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়াতে চলেছে। মুহূর্তখানেকের নীরবতা। বিচ্ছিরি ধরনের পারিবারিক কেচ্ছা। সেটা জানাতেই আমি কথা বলতে চাইছি।’
লোকটা ফোন নামিয়ে রাখে।’
এর পরেই মালবিকা ‘স্যার’-এর ঘরে ঢুকে অ্যান্টিচেম্বারের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। দরজা নক করার জন্য দু-দুবার হাত তুলেছে। দুবারই খেয়াল করল, তার হাত সামান্য কাঁপছে। স্যার কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? ঘুমিয়ে পড়লেও কিছু করার নেই। তাকে ডাকতে হবে। স্যার নিশ্চয় তার সমস্যাটা বুঝতে পারবেন। সে মৃদু হাতে দরজায় টোকা দিল।
‘স্যার, স্যার…।’
লাঞ্চের পর ঘণ্টাখানেকের জন্য বাসুদেব চৌধুরি নিজের টেবিল ছেড়ে এই ঘরে ঢুকে পড়েন। এটা তার বিশ্রামের সময়। বহুদিন ধরেই এই নিয়ম চালু রয়েছে। একটা সময় স্ত্রীর জন্য দিনের পর দিন রাত জাগতে হত। দুপুরে রেস্ট না নিলে তখন উপায় ছিল না। ঘুম না আসুক, খানিকটা সময় প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে চোখ বুজে টানটান শুনে থাকেন।
আজও শুয়েছিলেন। শুয়ে শুয়ে সেদিনের কথা ভাবছিলেন। গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছেন। স্বর্ণকে নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন ভারতী? কই এতগুলো বছরে তো কখনও সে এ কথা বলেনি। ন্যায় অন্যায়, ঠিক বেঠিকের সেন্স তো অনেকদিন আগেই হারিয়েছে। হারিয়েছে বলেই, উন্মাদ অবস্থায় উলঙ্গ হয়ে ছুটে বেড়াতে পারে। স্মৃতির একটা অংশও ওলটপালট হয়ে গেছে। বাড়াবাড়ির হলে কতসময় সে পরিচিতদের চিনতে পারে না। আবার সম্পূর্ণ অপরিচিতর সঙ্গে চেনা লোকের মতো ব্যবহার করে। নিজের বাবার মৃত্যুর খবর শোনার পর হাসতে-হাসতে বলেছিল, ‘কে আমার বাবা? ওই লোকটা মোটেই আমার বাবা ছিল না। একটা বদ লোক ছিল। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গায়ে হাত দিত। এই যে এখানে।’ ধমক দিয়ে থামাতে হয়েছিল। কথা থামালেও উন্মাদের হাসি থামাত না। কয়েকবছর আগেও মাথায় ঘোমটা টেনে ডাক্তারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেত, পা সরিয়ে নিলে বলত, ‘ছি শ্বশুরমশাইকে প্রণাম না করলে হয়?’ সেই ভারতীর হঠাৎ কী হল! স্বর্ণর অতীতে হাত বাড়াচ্ছে কেন? সে কি তার সেন্স ফিরে পাচ্ছে। স্মৃতিও? স্বর্ণর কথা কেউ কি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে? উন্মাদ মানুষের মাথায় একটা কিছু ঢুকিয়ে দিলে অনেক সময় সেটা সহজে বেরোতে চায় না। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? বহু অর্থ ব্যয়, বহু ভাবনা চিন্তায় যা আড়াল করা আছে তা আর কে জানবে? যারা ভাসা ভাসা জানত তাদের সকলকেই ভারতীর আশপাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রান্নার লোক থেকে দারোয়ান, পুরুত ঠাকুর থেকে ড্রাইভার সবাই নতুন। এই আড়াল শুধু ভারতীর কাছ থেকে নয়, আড়াল স্বর্ণর থেকেও। তা হলে?
মালবিকার ডাক শুনে চিন্তার জাল কেটে অ্যান্টিচেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন বাসুদেব।
‘কী হয়েছে মালবিকা?’
মালবিকা কাঁপা গলায় টেলিফোনের কথা বলে। বাসুদেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘দুলাল। কোন দুলাল?
মালবিকা আমতা-আমতা করে বলল, ‘লোকটার গলাটা জড়ানো মতো। বিশ্রী, মনে হচ্ছিল ড্রাঙ্ক।’
‘তুমি স্বর্ণর কথাটা ঠিক শুনেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
হাত নেড়ে মালবিকাকে ঘর ছাড়তে বললেন বাসুদেব। কপালে গভীর রেখা ফেলে খানিকটা ভূতগ্রস্তের মতোই নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। দুলাল ফিরে এসেছে? কতদিন ফিরে এসেছে? কী চায় সে? পাক্কা পঁচিশ মিনিট ফোনের জন্য অপেক্ষা করলেন বাসুদেব। তারপর ইন্টারকমে মালবিকাকে ধরলেন।
‘তুমি বিকাশকে একবার আমার কাছে আসতে বলো। যদি বাইরে থাকে মোবাইলে ধরে নাও।’
‘স্যার।’
‘আর শোনো, ফোনের কথা কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
মালবিকা সামান্য দু:খ পেল। ‘কাউকে বলার দরকার নেই’ কথাটা তার বেলায় খাটে না। তিন বছরের চাকরি জীবনে সে এই কাজ কখনই করে না। করবে ও না। মানুষটাকে শুধু ‘বস’ হিসেবে নয় তার থেকে খানিকটা বেশিই পছন্দ করে সে। মাসে এক-দুদিন দুম করে আগে চলে যেতে চাইলে কোনওদিনও ‘না’ বলেননি। বরং একদিন চমকে দিয়ে মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, ‘তমোঘ্ন নামটা কিন্তু ভালো। ভালো না?’
লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নামিয়েছিল মালবিকা। উনি জেনে গেছেন!
বাসুদেব মুচকি হেসে বললেন, ‘যাও দেরি হয়ে গেলে আবার ঝগড়া হবে।’
‘আপনি…আপনি স্যার ওর কথা জানেন?’
বাসুদেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘না জানি না।’
এই মানুষকে পছন্দ না করে থাকা যায়?
বড় কোম্পানির প্রধান শুনলেই চোখের সামনে একটা ঝকঝকে মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। ভারিক্কি অথচ সৌম্যদর্শন। একমাথা কাঁচা পাকা চুল। চোখে হালকা সোনালি ফ্রেমের চশমা। বাসুদেব চৌধুরি পুরোটা সেরকম নন। লম্বা আর শক্তসমর্থ হলেও চেহারায় অতটা ঝকঝকে ভাব নেই। গায়ের রং ময়লা। ষাটে পৌঁছেও চুলে পাক ধরেনি। ধরলেও একটা-দুটো, চট করে চোখে পড়বার মতো নয়। তবে দুটো চোখই বড়। সম্ভবত বুদ্ধির কারণে। সেই বড় চোখ টেবিলের দিকে রেখে তিনি শান্ত গলায় বিকাশকে ঘটনা জানালেন।
‘লোকটাকে কি আপনি চেনেন স্যার?’
বাসুদেব চৌধুরি খানিকটা অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘সত্যি যদি সেই দুলাল হয়, তা হলে বলব চিনতাম। ভালো করেই চিনতাম। তবে সে তিরিশ-বত্রিশ বছর আগের কথা। দেন হি ওয়াজ ইয়াং। কলেজে পড়ছে। ব্যবসায়ী বাবার অঢেল টাকা। মদ, জুয়া, রেডলাইট এরিয়া সব চলছে। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি বাবার ক্যাশ ভেঙে, ব্যাংকের সই জাল করে গাদাখানেক টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। শোনা যায় যাওয়ার সময় সোনাগাছির একটা মেয়েকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মেয়েটি রাজি হয়নি বলে তাকে কাচের বোতল দিয়ে পিটিয়েছিল। বেচারি মারা যায়। মৃত্যুর আগে পুলিশকে দুলালের নাম বলে।’
বিকাশ পিঠ সোজা করে বসল। বলল, ‘মারাত্মক! স্যার, আপনার সঙ্গে এই লোকটির পরিচয়ের সূত্রটা কী ছিল?’
কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন বাসুদেব চৌধুরি। মুহূর্তখানেক বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিনতাম,ব্যস এইটুকুই।’
‘স্যার লোকটা ক্রিমিনাল। টাকাপয়সা ফুরিয়ে গেছে, এবার ফিরে এসেছে। বদ মতলবে ফিরেছে, পুরোনো পরিচিতদের খোঁজ করে দেখছে কার টাকা আছে, ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা চাইবে। আমার মনে হচ্ছে, কেসটার মধ্যে খুব কিছু জটিলতা নেই। পুলিশে খবর দিলেই হয়ে যাবে। আবার যদি ফোন করে…।’
বাসুদেব চৌধুরি চেয়ারে হেলান দিলেন। সামনে পড়ে থাকা ফাইলটা তুলে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। নতুন প্রজেক্টের ভায়াবিলিটি রিপোর্ট। কল্যাণীর কাছে একটা হাউজিং প্রজেক্ট। শুধু হাউজিং না বলে ছোটখাটো একটা শহরের মতোই বলা উচিত। উঁচু কোনও ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, ছোট ছোট কটেজ থাকবে শুধু। সঙ্গে অনেকটা সবুজ, কিছুটা জল। সেন্ট্রাল পজিশনে একটা বড় পার্ক। ইলেকট্রিসিটির জন্য নিজস্ব ক্যাপটিভ প্ল্যান্ট। জমি দেখা হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর বেসড এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির জয়েন্ট ভেঞ্চারের জন্য ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। তাদের মুম্বই অফিস কথাবার্তা চালাচ্ছে। জমি নেওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক স্তরে যাতে সমস্যা না হয় তার ব্যবস্থাও শেষ। বড় অ্যামাউন্ট ধরা হয়েছে। বিকাশের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে নেতা মন্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথাও হয়ে গেছে। বাসুদেব চৌধুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রজেক্টের কাজ শুরু হলে ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসাটা পুরো গুটিয়ে ফেলবেন। বাস, ট্রাক, গাড়ির ঝামেলা হল ছোটলোকের ঝামেলা। এই ঝামেলা থেকে তিনি মুক্তি চান। প্রজেক্টের নামও ঠিক হয়ে গেছে। ‘ড্রিমল্যান্ড’, বাংলায় ‘স্বপ্নদ্বীপ’। এর জন্য নতুন ভাবে কোম্পানি তৈরি করা হবে। ‘কনক গার্মেন্টস’-এর থেকে একেবারে আলাদা।
হাতের ফাইল নামিয়ে রেখে বাসুদেব বললেন, ‘দুলাল নামের লোকটাকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই বিকাশ। ওকে নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। সে আগে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুক। দেখি কী চাইছে। কিন্তু তার আগে স্বর্ণর বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সত্যি কি সে কোনও ধরনের স্ক্যান্ডালের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে? পড়লে সেটা কী ধরনের স্ক্যান্ডাল? নাকি সবটাই বানানো হুমকি মাত্র? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ? আমি উলটোদিকে শুরু করতে চাইছি।’
বিকাশ তার স্যারের কথা বুঝতে পারল। সে মাথা নাড়ল।
‘তুমি তোমার লোকদের আজই বলে দাও। দে শুড স্টার্ট ফ্রম টু ডে। স্বর্ণর ওপর তারা নজর রাখা শুরু করুক।’
বিকাশ বলল, ‘স্যার, একটা কথা বলব? যদি পারমিশান দেন।’
‘বলো।’
‘আপনি কি বিষয়টা নিয়ে আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন? উনি যদি কোঅপারেট করেন কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
বাসুদেব বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘কেউ কি নিজের ওপর নজরদারিতে রাজি হয়? নাকি পিছনে চর নিয়ে কেলেঙ্কারির পথে পা বাড়ায়? ওসবের দরকার নেই, তুমি নিজের মতো কাজ করো। আমি বুঝতে পারছি, বসের ছেলের পিছনে লোক লাগাতে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে। ডোন্ট হেসিটেট। বাসুদেব চৌধুরির ছেলে নয়, আর পাঁচজনের মতো কাজটা করো।’
কথা শেষ করে বাসুদেব মলিন ভাবে হাসলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘বিকাশ, কথাটা আমি কাউকে বলি না, তোমাকে বলছি। কাজের জন্যই বলছি। আমার একমাত্র পুত্র আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। সম্ভবত সে তার বাবাকে ঘেন্না করে। হি হেটস হিজ ফাদার।’
রাতে বাড়ি ফিরে বাসুদেব চৌধুরি চিঠির তাড়ার ভেতর আবার একটা খাম পেলেন। সেই খাম শূন্য।
সাত
প্রীতি ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপালে ঝুঁকে পড়া চুলের গোছা মাথার পিছনে ঠেলে বলল, ‘লোকটাকে তুমি চেনো?’ স্বর্ণ চায়ের কাপ মুখের কাছে অন্যমনস্ক ভাবে তুলে বলল, ‘না, চিনি না। কোনওদিন দেখিনি।’
‘এটা কীরকম কথা স্বর্ণ? যে লোকটাকে তুমি চেনো না, দেখনি কখনও, তাকে এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক হচ্ছে?’
স্বর্ণ কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি তো বিশ্বাস করিনি।’
‘বিশ্বাস না করলে তার সঙ্গে এতদিন এত কথা বললে কেন? কেনই বা ডাকলে ছুটে যাচ্ছ?’
স্বর্ণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। দূরে লঞ্চ চলে যাচ্ছে। অন্ধকারে লঞ্চ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তার আলোগুলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলোর ছায়া জলে পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। যেন তারাই হাত ধরে লঞ্চকে নিয়ে চলেছে। আউটরাম ঘাট থেকে একটু সরে এসে গঙ্গাতীরের এই নতুন রেস্তোরাঁ প্রীতির বিশেষ পছন্দের। পছন্দ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। একটা কারণ হল নাম। নামটা শুধু সুন্দর নয়, অন্যরকমও। ‘কাগজের নৌকা।’ কাগজের নৌকা’র বয়স বেশি হয়নি, বছরখানেকও নয়। ফলে এখনও ভিড় কম। দোতলার চা-কফি খাওয়ার জায়গাটা কাচে ঘেরা ডেকের মতো। একপাশে সারি দিয়ে সাজানো ছোট ছোট টেবিল। দুজন করে মুখোমুখি বসতে পারে। স্বর্ণ চা নিলেও প্রীতি কফিই চেয়েছে।
স্বর্ণ জলের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলল, ‘ছুটছি না, আমি শুধু জানতে চাই প্রীতি। সবটা জানতে চাই।’
‘কী হবে জেনে? তোমার বাবা তাঁর জীবন কীভাবে তৈরি করেছেন, কী ভাবে তাকে বয়ে নিয়ে গেছেন সে তো তার বিষয়। তিনি তার মতো থাকবেন, তুমি তোমার মতো।’
স্বর্ণ শুকনো হেসে বলল, ‘তা হয় না। জীবনটা একটা গাছের মতো। শিকড়, গুঁড়ি থেকে শুরু করে সামান্য ডালপালা পর্যন্ত সে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কাউকে আলাদা করা যায় না। তা ছাড়া ঘটনা যদি সত্যি হয় তা হলে বুঝে নিতে হবে ভদ্রলোক খুব বড় একটা অন্যায় করেছেন।’
‘ঘটনাটা সত্যি জানার আগে এতটা ক্রুড হওয়ার কি কোনও যুক্তি আছে? ইউ শুড থিংক লজিক্যালি। এরকম তো হতেই পারে, কেউ ওঁর নামে মিথ্যে স্ক্যান্ডল রটাচ্ছে। ওঁর কোনও বিজনেস এনিমি। তোমার বাবা একজন ধনী মানুষ। ধনী মানুষের অনেকরকম শত্রু হয়। হয়তো কোনও কর্মচারীই করছে। একবার আমার এক মামার অফিসে এরকম হয়েছিল, ইউনিয়ন থেকে প্ল্যান করে ঝামেলায় ফেলেছিল, একটা মেয়েকে পর্যন্ত হাজির করল।’
স্বর্ণ অষ্ফুটে বলে, ‘এক্ষেত্রে আমার তা মনে হয় না। আমি কিছু কিছু প্রমাণ পেয়েছি।’
প্রীতি চুপ করে রইল। কফি মাগে চুমুক দিল সময় নিয়ে। স্বর্ণ নিজে ইউনিভার্সিটিতে না এলেও বিকেলে তাকে ফোন করে। প্রীতি তখন ক্যান্টিনে।
‘আমি আসছি, তুমি অপেক্ষা করো প্রীতি।’
প্রীতি নাটকীয় কায়দায় বলে, ‘তোমার জন্য তো দিবস রজনী অপেক্ষা করেই আছি। নতুন করে আর কী অপেক্ষা করব?’
ওপাশ থেকে স্বর্ণ বিরক্তি দেখিয়ে বলল, ‘উফ, এগেইন ইউ স্টার্ট। প্রীতি তোমার সঙ্গে একটা সিরিয়াস কথা আছে।’
‘কী কথা? আমাদের বিয়ের কথা?’
‘আ: তোমার এই ঠাট্টা মশকরাগুলো এখন থামাও।’
প্রীতি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠাট্টা বন্ধ করে তোমার মতো মুখ বেজার করেছি। এবার বলো কোথায় অপেক্ষা করতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে থাকি?’
‘না, আমরা কাগজের নৌকায় চলে যাব।’
স্বর্ণ নিজে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে চাইছে, এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। প্রীতি পুলকিত গলায় বলল, ‘দারুণ হবে। কাগজের নৌকায় বসে দাঁড় বাইতে বাইতে আমরা দুজনে চলে যাব আগুনের স্রোতের ভেতর দিয়ে।’
স্বর্ণ ফোন কেটে দেয়। প্রীতি অবশ্য তখনও বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি, স্বর্ণ এরকম একটা অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে আসছে।
ট্যাক্সিতে গোটা পথটাই মূলত চুপ ছিল স্বর্ণ। প্রীতি দু-একটা কথা বলতে চেষ্টা করে, থমথমে মুখে স্বর্ণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। চুপ করে থাকে রেস্তোরাঁতে আসার পরও। গঙ্গায় অলস সন্ধে নামে। আলো জ্বলে ওঠে দু-পাড়ে। গলুইতে মলিন কুপি জ্বেলে এলোমেলো ভেসে থাকে ডিঙি।
প্রীতি কৌতুকভরা চোখে হেসে বলে, ‘নাও এবার তোমার সিরিয়াস কথাটা শুনি।’
স্বর্ণ মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘জানো প্রীতি, আমার বাবার আরও একজন স্ত্রী রয়েছেন।’
কথাটার আকস্মিকতায় প্রীতি হকচকিয়ে যায়। কী বলছে, ছেলেটা! স্বর্ণর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে হাসে। বলে, ‘হঠাৎ এরকম একটা জিনিস তুমি জানলে কোথা থেকে?’
‘আমাকে একজন খবর দিয়েছে।’
‘কে? ওই মহিলা?’
‘না মহিলা নয়, অন্য একজন। তাকে আমি চিনি না।’
প্রীতি এবার সত্যি করে হাসল। বলল, ‘এটা তোমার বাড়াবাড়ি স্বর্ণ। একটা অচেনা অজানা লোক হুট করে তোমাকে কী না কী খবর দিল আর তুমি সে কথা বিশ্বাস করে থমথমে মুখে বসে আছ? ইটস সিম্পলি টু মাচ।’
‘হুট করে কিছু বলেনি। সময় নিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে লোকটা আমাকে একটু একটু করে সব জানাচ্ছিল।’
‘দীর্ঘদিন! কই আমাকে তো কখনও কিছু বলোনি!
স্বর্ণ ম্লান হেসে বলল, ‘পারিবারিক কেলেঙ্কারি গল্প বলে বেড়ানোর মতো কিছু বিষয় নয়। এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে জানানোটা জরুরি। তুমি জানো কোথায় এসে দাঁড়াতে চাইছ।’
প্রীতি হাসতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। বলল, ‘ওসব বাদ দাও। কী হয়েছে বলো।’
‘লোকটা নানাভাবে আমাকে কনভিনসড করিয়েছে। প্রথমে চিঠি লিখেছিল, পরে ফোনে আসে। প্রথম চিঠিটা ছিল এক লাইনের।’
প্রীতি ভুরু কুঁচকে বলে, ‘এক লাইনের।’
হ্যাঁ, এক লাইনের চিঠি। জড়ানো হাতে লেখা ছিল, বাসুদেব চৌধুরি তার উন্মাদ স্ত্রীর চিকিৎসা না করে ঘরে বন্ধ করে রেখেছেন।’
প্রীতি নড়ে বসল। সে নীল ট্রাউজারসের সঙ্গে একটা ভায়োলেট রঙের টপ পরেছে। গলার চেনে রং মেলানো একটা পাথর। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে গিয়ে এর বেশি সাজের প্রশ্ন ওঠে না। তা ছাড়া এমনিতেও প্রীতি খুব কিছু চটকদারি পোশাক-আশাক, মেকআপের মধ্যে থাকে না। ইচ্ছে করে, কিন্তু স্বর্ণর জন্যই উৎসাহ পায় না। আলাপের পর থেকেই দেখছে এই ছেলে তার সাজপোশাকের প্রতি উদাসীন। নিজে মুখ ফুটে বলা তো দূরের কথা, ‘কেমন লাগছে’, জিগ্যেস করলে না তাকিয়েই বলে, ‘ঠিক আছে।’ বন্ধুরা ঠাট্টা করে। রাই বলেছে, ‘একদিন চেপে ধরে চুমু খেয়ে দেখবি তো সন্ন্যাসীটা কী করে?’
প্রীতি বলল, ‘তুমি কী করলে?’
‘কী করব? চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। ঠিক তিনমাসের মাথায় আবার চিঠি পাঠাল। সেটা সামান্য বড়। এনভেলাপে দেওঘর না জসিডির ছাপ ছিল। বক্তব্য হল, ইচ্ছে করলেই নাকি বাসুদেব চৌধুরি তার স্ত্রীকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে পারতেন। তার অর্থের কোনও অভাব নেই। লোকও আছে। তবু তিনি নিয়ে যাননি। শুধু বিদেশে নয়, এমনকী এই শহরের কোনও ভালো ক্লিনিকেও তাকে কখনও রাখেননি। এর কারণ কী? সেই চিঠিও আমি ফেলে দিলাম, কিন্তু আমার ভেতরে একটা অস্বস্তি তৈরি হল। মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। অসুখটা জানতাম। জানতাম, বাল্য এবং কৈশোরে ওর ভয়ংকর অবস্থাটা যাতে আমাকে দেখতে না হয় তাই আমাকে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হত। আমি এবার খোঁজ নিলাম। আমাদের পারিবারিক অতীত খুঁজে বের করাটা খুব কঠিন একটা কাজ প্রীতি। বাবা বা মা কোনও পক্ষের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। বাড়ির কর্মচারীদেরও বারবার বদলানো হয়েছে। তবুও জানতে পারলাম, দুটো ঘটনাই সত্যি। সুযোগ থাকা সত্বেও আমার বাবা-মাকে বিদেশে নিয়ে যাননি। ক্লিনিকের কথাটাও ঠিক। প্রীতি তুমি হয়তো জানো না, আমার মা যে ধরনের মানসিক রোগী তাতে তাকে হাসপাতালে ভরতি রেখে চিকিৎসা করাটা খুবই জরুরি ছিল। বাবা, সেখান থেকেও তাকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। কেন নিয়ে আসেন আমি খুব পরিষ্কার জানাতে পারিনি। তবে নিয়ে এসেছিলেন এটা সত্যি। সম্ভবত বাইরে চিকিৎসা করতে নিয়ে না যাওয়ার মতো তুচ্ছ কোনও যুক্তি ছিল।’
স্বর্ণ চুপ করল। বাইরে তাকিয়ে রইল। প্রীতি কী বলবে বুঝতে পারছে না।
‘তুমি কিছু খাবে?’
স্বর্ণ মাথা নাড়ল। প্রীতি বলল, ‘আর একটা চা বলব?’
‘বলো। প্রীতি, এই বিষয়গুলো জানার পর আমার আর এক মুহূর্ত আর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করল না। তখন আমি কলেজে সবে ঢুকেছি। হস্টেলে চলে গেলাম। মাঝেমধ্যে বাড়ি ফিরলেও রাতে থাকতাম না। ওই বার্ড়ির ওপর আমার এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হল। অ্যাটাচমেন্ট অবশ্য আগেও কখনও ছিল না। যে বয়েসে একটা ছেলের বাড়ির প্রতি টান তৈরি হয়, বাড়ির মানুষদের চিনতে পারে, সেই বয়েসে দিনের পর দিন বাইরের বোডিং-এ কাটিয়েছে। কোনওটাতেই স্থির ভাবে নয়, একটার পর আর একটা, আবার আর একটা। কখনও পুরুলিয়া, কখনও দার্জিলিং। যেন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়। ছুটির সময়েও বাড়িতে আসতে দেওয়া হত না। যে সময় মা একটু ভালো থাকতেন, ঘণ্টাকয়েক, ম্যাক্সিমাম একদিনের জন্য আমাকে কলকাতা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত।’
প্রীতি উঠে গিয়ে কাউন্টার থেকে চা নিয়ে এল। প্রীতির খুব খারাপ লাগছে। ঘটনা সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক স্বর্ণ খুব আপসেট হয়ে রয়েছে। তবে সব খারাপের মধ্যে যেমন একটু ভালো লুকিয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। স্বর্ণর স্থায়ী বিষণ্ণতার কারণ তার কাছে এই প্রথম খানিকটা স্পষ্ট হচ্ছে। স্বর্ণও নিশ্চয় বলতে পেরে হালকা হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, স্বর্ণর পারিবারিক খুঁটিনাটি জিনিস বিশেষ কিছু জানা নেই প্রীতির। শুধু জানত, স্বর্ণর বাবা একজন বড় বিজনেসম্যান। মা মানসিক রোগী। সেই রোগ যখন-তখন খুব খারাপ চেহারা নেয়। এমন খারাপ যে রোগীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। বাড়িতে না ঢুকলেও প্রীতি দেখেছে স্বর্ণদের বাড়িটা বেশ বড়। সেই বাড়িতে উঁচু দেওয়াল আর গেটে সিকিউরিটি। বদ্ধ উন্মাদ গৃহকর্ত্রীকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য সবরকম ব্যবস্থা। স্বর্ণ কখনওই তার বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। ‘তোর বাড়ি যাব’ বললে, গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়, ‘ওটা আমার বাড়ি নয়।’
‘এরপর বছরখানেকের গ্যাপ দিয়ে লোকটা একদিন আমাকে ফোন করে বসল। মোবাইল নম্বর কীভাবে পেল কে জানে। বলল, চিঠি দুটো পেয়ে কেমন লাগল? আমি বললাম, কে আপনি? লোকটা বিচ্ছিরি ভাবে হাসল। বলল, চিঠিতে যে কথাগুলো লিখিনি সেটা বলতে তোমায় ফোন করেছি। তুমি কি সেটা শুনতে চাও? শুনতে চাও তোমার বাবা কেন তার স্ত্রীর ঠিকমতো চিকিৎসা না করে ঘরে বন্ধ করে রেখেছেন? মনে আছে প্রীতি সেদিন আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, নো, নেভার। কে আপনি? কেন আপনার কথা শুনব? আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। নইলে আমি কিন্তু পুলিশে যাব। লোকটা হেসে বলেছিল, তুমি পুলিশে কেন, কারও কাছেই যেতে পারবে না। তোমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। বলে ফোন কেটে দিল।’ ক্ষণিকের নীরবতার পর স্বর্ণ বলল, ‘কথাটা আমি ভুলতে পারলাম না প্রীতি।’
প্রীতি অস্ফুটে বলল, ‘তুমি সরাসরি তোমার বাবাকে জিগ্যেস করলে না কেন?’
‘ততদিনে বাবার সঙ্গে আমার সেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। ইনফ্যাক্ট আমাদের দুজনের মধ্যে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক কোনওদিন তৈরি হয়েছিল কিনা দ্যাট ইজ অলসো আ কোয়েশ্চন। সম্ভবত কেন হয়নি বলাই উচিত। স্কুল বোর্ডিং-এ ফেলে রাখার জন্য বাবার ওপর প্রথম-প্রথম আমি অভিমান করতাম, তারপর উনি যখন দামি-দামি খাবার, উপহার ঘুষ হিসেবে পাঠাতেন তখন আমার ভেতরে এক ধরনের রাগ তৈরি হল। আমি সবকিছু ফেলে দিতাম। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একটা লামসাম অ্যামাউন্ট কোম্পানি থেকে জমা পড়ে। যেটুকু প্রয়োজন তুলি, বেশিটাই পড়ে থাকে। আজও পড়ে আছে। আই নেভার বদারড।’
বাইরে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। সেই অন্ধকারে ফটফট আওয়াজ তুলে লঞ্চ ছুটছে। লঞ্চ দেখা যাচ্ছে না, জল শুধু আওয়াজটুকু নিয়ে আসছে।
‘আমি একদিন আমাদের হাউস ফিজিশিয়নের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বললেন, ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া অসুখটা জটিল। তার ওপর এতদিনের। তবে আজকাল সব জটিল অসুখেরই চিকিৎসা হচ্ছে। তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে নিয়মিত দেখছেন। তবে আমার মনে হয়, এধরনের পেশেন্টের বাড়িতে যতটা কেয়ার হয়, ট্রিটমেন্ট ততটা হয় না। এদের একধরনের আইসোলেশন প্রয়োজন। কিন্তু মিস্টার চৌধুরি তো তাঁকে চোখের আড়ালই করতে চান না। ইউ স্যুড বি প্রাউড অফ ইওর ফাদার স্বর্ণ। তিনি তোমার মাকে খুবই ভালোবাসেন। উনি যেভাবে তাকে আগলে রেখেছেন সেটা অবশ্যই একটা দৃষ্টান্ত। দু’সপ্তাহের মাথায় লোকটা আবার ফোন করল। এবার আর আমি ধমক দিতে পারলাম না প্রীতি। কখনও হেসে, কখনও বিদ্রুপ করে লোকটা যা বলল তার অর্থ হয়, বাসুদেব চৌধুরি নাকি চেয়েছেন, আমার মা চিরকালই পাগল অবস্থায় ঘরবন্দি থাকুন। নানা ধরনের বাহানা তুলে তিনি সেটাই করেছেন। আসলে তিনি তার কলঙ্কিত অতীত গোপন রাখতে চান। এই কারণে সার্ভেন্ট, মেইডসার্ভেন্টসদেরও একটানা এ বাড়িতে বেশিদিন রাখা হয় না। এখন যারা আছে তাদেরও সরানো হবে। বাড়িটাকেও বানিয়েছেন দুর্গের মতো করে যাতে বাইরের পৃথিবীর কেউ ঢুকতে না পারে। ইনফ্যাক্ট হি ইজ অলসো আ সাইকিক পেশেন্ট।’
‘ইটস টু মাচ স্বর্ণ। কেন তোমার বাবা এরকম একটা বিশ্রী কাজ করবেন?’
স্বর্ণ প্রীতির দিকে তাকাল। বিমর্ষ ভঙ্গিতে হাসল সামান্য। বলল, ‘আমারও সেই প্রশ্ন ছিল। লোকটা উত্তর দিয়েছে। এক সঙ্গে দেয়নি, ছেঁড়া ভাবে দিয়েছে। ন’মাসে ছ’মাসে ফোন করেছে। সবসময় বুথ থেকে করে যাতে আমি রিং ব্যাক করে ট্রেস করতে না পারি। আশ্চর্য কথা কী জানো একটা সময় আমি খেয়াল করলাম, ওই বিশ্রী লোকটার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘তোমাকে ধীরে-ধীরে পয়জন করেছে। মন বিষিয়েছে।’ প্রীতি নিজের মনেই যেন বলল।
‘হয়তো তাই, বাসুদেব চৌধুরির প্রতি আমার রাগটাকে ধীরে ধীরে উসকেছে। অ্যান্ড হি ওয়াজ সাপোজড টু বি সাকসেসফুল।’
‘কী বলত?’
স্বর্ণ আবার মুহূর্ত খানেকের জন্য চুপ করল। সম্ভবত কথাটা বলার জন্য মনকে শক্ত করল।
‘ছেঁড়া ছেঁড়া সেই সব কথা যোগ করলে যা দাঁড়ায় সেটা হল বাসুদেব চৌধুরি যৌবনের শুরুতে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি এখনও জীবিত।’
‘আমি জানি না কথাটা সত্যি না নিছক একটা স্ক্যান্ডাল স্বর্ণ। তবে যদি সত্যিও হয়, তা হলে বলব সো হোয়াট? এটা আর কী এমন ব্যাপার? দুটো বিয়ে আজকের যুগে কোনও ঘটনা নাকি স্বর্ণ? ডিভোর্স তো আকছার হচ্ছে, ঘরে-ঘরে।’
স্বর্ণ প্রীতির চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘ডিভোর্সের বিষয়টা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’
‘মানে! তুমি কি বলতে চাও, স্টিল দ্যাট ওম্যান ইজ ইওর ফাদারস লিগাল ওয়াইফ?’
স্বর্ণ অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘জানি না। তবে দ্যাট টাইম দ্য ওম্যান ওয়াজ প্রেগন্যান্ট। বাবা যখন তাকে ত্যাগ করতে চান, তিনি নাকি রাজি হচ্ছিলেন না।’
‘পরে? পরেও দিতে পারতেন।’
‘অচেনা লোকটার দেওয়া তথ্য ঠিক হলে, পিছনে আরও কারণ আছে। লোকটা সবক’টা কারণ আমাকে বলেনি, তবে একটা বলেছে। টাকা। একটা দুটো টাকা নয় প্রীতি, অনেক টাকা। দ্য গ্রেট বাসুদেব চৌধুরির এত বড় ব্যাবসা সাম্রাজ্যের ভিতই নাকি গড়ে উঠেছে সেই মহিলার সম্পত্তির ওপর। মহিলার বাবা তার কালোকুলো খর্বকায় মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আমার বাবাকে সব সম্পত্তি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইট ওয়াস আ টাইপ অব ডাউরি।’
মুখে অস্ফুটে আওয়াজ করে প্রীতি হাত বাড়িয়ে স্বর্ণর ডানহাতটা চেপে ধরল।
‘আমার বাবা নাকি সম্পত্তি পেয়েছিলেন একটা শর্তে।’
‘শর্ত।’
স্বর্ণ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলে, ‘মহিলাকে কখনও ত্যাগ করবেন না। বাট হি ডিড ইট। তিনি সেটাই করেছেন।’
দুজনেই চুপ করে বসে রইল। একটা সময় স্বর্ণ নীচু গলায় বলল, ‘প্রীতি, শুনেছি আমার বাবা দরিদ্র মানুষ ছিলেন। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর আশ্রয়ের জন্য তাকে দোরে দোরে ঘুরতে হয়েছে। দু’বেলা খাবার জোগাড় করাটাই একটা বিরাট সমস্যা দাঁড়ায়। সম্ভবত সেই কারণেই তার ভেতরে এক ধরনের তীব্র লোভ, আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। বড় হওয়ার, ধনী হওয়ার লোভ।’
প্রীতি মাথা নামিয়ে চুপ করে আছে।
‘দরিদ্র মানুষ যেরকম সেরকম একজন স্ত্রীকে নিয়ে জীবন কাটাতে পারে, ‘কনক গার্মেন্টস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট’-এর মালিক পারে না। তার একটা নতুন জীবন তৈরি হয়। যে জীবন সে এতদিন হয়তো স্বপ্নে দেখেছে।’
টেবিলের ওপর রাখা মোবাইল ফোনটা নাড়াচাড়া করতে করতে প্রীতি ফিসফিস করে বলল, ‘আই কান্ট বিলিভ, সিম্পলি আই কান্ট বিলিভ।’
‘আমিও করি না। সেই কারণেই আমি মহিলার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি। এতদিন পর লোকটা আমাকে সেই ঠিকানা দিতে রাজি হয়েছে। শনিবার যেতে বলেছে। বলেছে, দরকার পড়লে সঙ্গে লোক দিয়ে দেবে।’
প্রীতি স্বর্ণর হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘আমার ভয় করছে স্বর্ণ। ইট মে বি আ ট্র্যাপ।’
‘কীসের ফাঁদ?’
‘আজকাল কতরকম হয়, তোমার বাবা অত বড় মানুষ, হি মাস্ট হ্যাভ লট অব এনিমি। শত্রু নেই হতে পারে না। তোমাকে সমস্যায় ফেলতে পারলে তাকে কবজা করা যাবে।’
স্বর্ণ নিজের মনেই যেন হাসল। বলল, ‘হতে পারে প্রীতি। কিন্তু এ ঝুঁকি আমাকে নিতে হবে। ওই মহিলা যদি সত্যি থেকে থাকেন আমাকে তাঁর কাছ অবধি পৌঁছোতেই হবে।’
প্রীতি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি যদি সঙ্গে যাই তোমার আপত্তি আছে স্বর্ণ?’
স্বর্ণ প্রীতির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার একার সন্ধান। নিজের শরীরের ঘা পুঁজ রক্ত নিজেই খুঁজে বের করতে হয়। প্রীতি, এর মধ্যে তুমি নিজেকে আর জড়িয়ে রেখো না। প্লিজ ফরগেট মি। তোমাকে বহুবার আমি দূরে ঠেলার চেষ্টা করেছি, তুমি বুঝতে পারোনি। অথবা বুঝতে চাওনি। সেই কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোমাকে সবটা বলব। যতটা আমি জেনেছি সবটা। আশা করি তুমি এবার বুঝেছ।’
ট্যাক্সির খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। ধোঁয়া ধুলোর কলকাতাতেও যে এত সুন্দর বাতাস আছে মাঝেমধ্যে মনে থাকে না। প্রীতি জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চুল উড়ে-উড়ে পড়ছে মুখের ওপর। ইচ্ছে করেই সে সেই চুল সরাচ্ছে না। সে চায় না স্বর্ণ তার চোখের জল দেখতে পাক। বিষণ্ণ ছেলেটার জন্য তার খুব দু:খ হচ্ছে।
ইডেন গার্ডেন্সের সামনে এসে ট্যাক্সি বাঁক নিতেই প্রীতি দুম করে একটা কাজ করে বসল। ঘুরে বসে স্বর্ণর গলা জড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজের নরম ঠোঁটদুটো চেপে ধরল স্বর্ণর ঠোঁটে। হতচকিত স্বর্ণ কিছু বোঝার আগেই সে গভীর আবেগে চুমু খেতে লাগল পাগলের মতো। নিজের জিভ ঢুকিয়ে দিল স্বর্ণর মুখের ভেতর।
আট
‘বুঝলে কপিল, একটা সময় ভেবেছিলাম, সকালের হাঁটাহাঁটিটা বাড়ির ভেতরেই সারব। বাগান, লন সবই আছে। অসুবিধে কিছু নেই। পরে ভাবলাম, থাক, ওটা তোমার মেমসাহেবের জন্যই রাখা থাক। আমি যদি আগে চলাফেরা করি তা হলে জায়গাটার ভার্জিনিটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভার্জিনিটি বোঝো?’
‘নেহি সাব।’
‘থাক ও জিনিস তোমার না বুঝলেও চলবে। পার্কে আমার ভালোই লাগে। কত রাত যে বেঞ্চে শুয়ে কাটিয়েছি। তখন আমার বয়স কত হবে, সবে স্কুল পার হয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার পর এক কাপড়ে চলে এলাম কলকাতা। সঙ্গে টাকাকড়ি নেই, থাকার জায়গা নেই। চেনা, আধচেনা সবাই দূর করে দেয়। মা বেলেঘাটার এক বাড়িতে রান্নার কাজ নিল। সে বাড়ির লোক বলল, তোমায় রাতে থাকতে দেব, কিন্তু ওই দামড়া ছেলেকে রাখতে পারব না। আমি মাকে বললাম, কোনও অসুবিধে নেই। গরমকাল আছে, আমি দিব্যি পার্কে শুয়ে কাটিয়ে দেব। মশা কামড়াত, কুকুর চেঁচাত, ভিখিরি আর ভবঘুরের দল এসে বেঞ্চের দখল নিয়ে ঝামেলা পাকাত। ঘুম আসত না। অনেক রাতে উঠে পায়চারি করতাম। এখন করছি মর্নিংওয়াক, তখন করতাম নাইটওয়াক।’
বাসুদেব আওয়াজ করে হেসে ওঠেন। কপিল চুপ করে থাকে।
‘শুধু পার্ক নয়, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, চায়ের দোকান, লোকের বাড়ির বারান্দাতেও রাত পার করেছি। এর মধ্যে লঞ্চঘাটটাই সবথেকে ভালো ছিল। নদীর বাতাস পেতাম। ভোরে পুলিশ এসে লাঠির গুঁতো দিয়ে পয়সা চাইত। চার আনা, আট আনা যা থাকে দিতে হবে। ঘাট-ভাড়া। মজার না?’
‘জি সাব।’
‘তখন আমি সদ্য কাপড়ের ছাঁট নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছি। বড়বাজার থেকে মাল তুলে সারাদিন ছুটে বেড়াই। ব্যাবসা একটু একটু করে লেগেও গেল। সাহস বাড়ল। মায়ের হাতে একটা বালা ছিল, বেচে দিয়ে থান কাপড়ে ঢুকে পড়লাম। গদি থেকে ধারবাকিতে মাল নিতে শুরু করেছি। কাশীপুরের কাছে এক কামরার বাসা নিয়েছি। তার মধ্যে আবার এক কেলেঙ্কারি করে ফেললাম। নাইট কলেজে নাম লিখিয়ে বসলাম। লিখতাম না, মা এমন কান্নাকাটি শুরু করে দিল যে তোমাকে কী বলব কপিল। কলেজে ভরতি না হলে নাকি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেবে। বোঝো কাণ্ড। কলেজে সময় দিলে তো ব্যাবসার বিরাট ক্ষতি। এদিকে মাকেও বোঝাতে পারি না। খুবই গড়বড়ে সিচ্যুয়েশন। তাই না?’
কপিল বিন্দুমাত্র উৎসাহ প্রকাশ না করে বলল, ‘জরুর সাব। বহুত গড়বড়।’
‘কিন্তু গড়বড়ের বদলে উলটোটাই হল। এমন উলটো যে আমার গোটা জীবনটাই পালটে গেল। গল্পের মতো লাগছে তো? আমারও লাগত। মনে হত আশ্চর্য এক কাহিনির ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো পট । সেই পট গুলো আমি সুতো দিয়ে বুনে বুনে চলেছি। আমার অতীত খুব কম মানুষই জানে। আমি চাইও না কেউ জানুক। অনেকে টাকাপয়সা করার পর পুরোনো দারিদ্র্য নিয়ে গর্ব করে। আমি করি না, ভুলে যেতে চাই। যে সুতোগুলো দিয়ে গল্পটাকে বেঁধেছিলাম, তার অনেকগুলো আমি নিজেই ছিঁড়তে ছিঁড়তে চলি। আবার নতুন করে বাঁধিও। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ কপিল?’
কপিল চুপ করে রইল। সে সমস্যায় পড়েছে। সাহেব একটানা কথা বলার কারণে সে আজ সাহেবের পিছনে থাকতে পারছে না। বারবার তাকে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে কাজটা উচিত হচ্ছে না। তার ডিউটি সাহেবের কথা শোনার নয়, পাহারা দেওয়ার। কিন্তু কথা না শুনেই বা সে থাকে কী করে? এই সমস্যায় সাহেব তাকে মাঝেমধ্যেই ফেলে। একনাগাড়ে কথা বলতে থাকেন। সেসব কথা কপিল অধিকাংশই বুঝতে পারে না, কিন্তু এটুকু বোঝে, এসব জোরে বলার জিনিস নয়। যদি কেউ তাকে জিগ্যেস করে, ‘কীভাবে তুমি বুঝলে এগুলো জোরে বলার নয়?’ সে বলতে পারবে না। শুধু মাথা চুলকে বলবে, ‘হাম সমঝতা হায়।’
কপিলের চুপ করে থাকায় বাসুদেব নিশ্চিন্ত হলেন। এর অর্থ সে বুঝতে পারছে না। তিনি আবার শুরু করলেন।
‘সারাদিন কাপড় নিয়ে ছোটাছুটির পর সন্ধেতে কলেজে যেতাম। কলেজে গিয়ে ঢুলতাম। সেই ঢুলতে-ঢুলতেই আলাপ হল দুলালের সঙ্গে। দুলাল মাইতি। বিশ্রী থলথলে চেহারা। সে-ও দেখি আমার মতো ক্লাসরুমের পিছনে বসে ঢোলে। সম্ভবত একই আচরণের কারণে দুজনের মধ্যে আলাপ জমে গেল। ক’দিনের মধ্যে জানতে পারলাম, দুলাল ওস্তাদ ছেলে। বাড়ি মেদিনীপুরে। বাবা পরেশ মাইতি, অনেকরকম কারবারের মালিক। মেদিনীপুর লাইনেই ছ’টা বাস ছোটে, মুর্শিদাবাদের ডোমকলের কাছে কাপড়ের মিল, দিঘায় হোটেল, হাওড়ায় দশ বিঘে জমিতে ফুল চাষ হয়। সেই ফুল যায় মঙ্গলাহাটে। ছড়ানোছিটানো এলাহি ব্যাপার। পাছে বাপের ব্যাবসায় বসতে হয় সেই ভয়ে দুলাল কলেজে এসে ভরতি হয়েছে। লেখাপড়ায় এক চিলতে মন নেই। দু-একটা দিন কলেজে আসে, অন্যদিনগুলো এখানে ওখানে ফুর্তি করে কাটায়। বাপ অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে কলকাতা ছাড়াতে পারেনি। পারবে কী করে? কলকাতায় যে হরেক মজা। বেটা শনি রবি করে খারাপ পাড়ায় যেত। কলেজে ছেলেরা এড়িয়ে চলে। আমি এড়ালাম না। দুলালের সঙ্গে ঝুলে পড়লাম। মদ ছুঁতাম না, তবু ওর ঘরে গিয়ে বসে থাকতাম। হাবিজাবি বকত, আমি চুপ করে শুনতাম। একদিন সোনাগাছিতেও চলে গেলাম। টগর না চাঁপা বলে একটা মেয়ের ঘরে গিয়ে দোর দিল, আমি দরজার বাইরে পায়চারি করতে লাগলাম। কেন জানো?’
‘নেহি সাব।’
বাসুদেব হাসলেন।
‘বেটার কনফিডেন্সে আসতে চাইছিলাম। আমার তখন একটাই ধান্দা, দুলাল যদি ওর বাপের কাপড়ের কারখানায় একটা বড় অর্ডার ধরিয়ে দেয়। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর একদিন দুলাল আমাকে মেদিনীপুরে পাঠিয়ে দিল। ছেলের চোদ্দোপুরুষ তুলে গাল দিয়ে সেই পরেশ মাইতি আমাকে অর্ডার দিল। এক-দু-টাকার অর্ডার না। একেবারে লাখ টাকার অর্ডার বুঝলে কপিল, সেদিন মনে হয়েছিল আমার পিঠে দুটো ডানা লেগেছে। আমি কলকাতায় ফিরলাম সেই ডানায় উড়ে উড়ে। একেবারে গল্পের মতো না?’
‘জি সাব।’
এই পর্যায়ে এসে বাসুদেব খানিকটা চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘কিন্তু ঘটনা কী জানো কপিল, সব সুন্দর গল্পের ভেতরেই একটা করে নোংরা বাস্তব লুকিয়ে থাকে। তোমরা কী বলো? গনধা? সেই গনধা বাস্তবটা প্রথমে দেখা দেয় না, যখন দেখা যায় তখন হয় সমস্যা। তখন না ফেলা যায় গল্পটাকে, না গেলা যায় বাস্তবকে। আমার বেলায়ও তাই ঘটল। কলেজে পাশ করতে না করতে দুই সন্তানের পিতা পরেশ মাইতি আমাকে তার এক মাত্র হতকুচ্ছিত, এইট ফেল কন্যাটিকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। সম্ভবত ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন তার কুলাঙ্গার পুত্রের বন্ধু হলেও, পাত্র হিসেবে আমি খারাপ নয়। শুধু সৎ নয়, অসম্ভব পরিশ্রমী। সবথেকে বড় কথা, তার ছড়িয়ে থাকা বিশাল ব্যাবসার অনেকটা দায়িত্ব আমি ঘাড়ে নিতে পারব। প্রস্তাব শুনে আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। উত্তেজিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মনে-মনে দ্রুত হিসেব করে নিয়েছি, মাতাল, লম্পট দুলালের ব্যাবসায় কোনও ইন্টারেস্ট নেই। যদি ভবিষ্যতে হয়ও তাতেও কোনও সমস্যা নেই, তাকে সামলাতে আমার অসুবিধে হবে না। সে ব্যাবসায় ঘাঁতঘোঁত কিছুই বোঝে না। সে জানে দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার হয়। আমি জানি, চার হলে হবে না, ওটাকে করতে হবে পাঁচ। পুরোটা যদি নাও পাই, পরেশ মাইতির একমাত্র জামাই হিসেবে তার সম্পত্তির একটা বড় ভাগীদার তো হবই। ব্যাবসার নেশায় আমি তখন আচ্ছন্ন কপিল। একটু-একটু করে টাকার স্বাদ পাচ্ছি। আরও চাই, আরও অনেক চাই। কৈশোর, তারুণ্যের সব কষ্ট অপমান পায়ের তলায় ফেলে দুমড়ে-মুচড়ে পিষে মারতে হবে। টাকা ছাড়া তা অসম্ভব। এই সময় এরকম একটা প্রস্তাব হাতে চাঁদ পাওয়ার থেকেও বেশি। পাত্রী কালো না ফরসা, বোবা না কালা কিছু এসে যায় না। তবু ঠান্ডা মাথায় ভাবার জন্য আমি ক’টাদিন সময় চাইলাম। বললাম, কাজে বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে মতামত জানাব। তা ছাড়া মা তখনও বেঁচে। তাকেও তো জিগ্যেস করতে হবে। ঠিক করলাম না?’
‘ঠিক কিয়া সাব, সবকুছ সোচ সমঝকে করনা হোগা।’
‘এরপর যা করলাম সোচ সমঝকেই করলাম। হাওয়া বোঝার জন্য একদিন দুলালের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করলাম। দিনদুপুরেই দেখি বেটা ভরপেট নেশা ভাং সেরে চোখ লাল করে বসে আছে। ওর জন্য আমিও বড় একটা বোতল নিয়ে গিয়েছিলাম। নেশা বাড়লে মনের কথা বুঝতে পারব। ভগ্নিপতি হিসেবে সে আমাকে কতটা মেনে নেবে, কতটা বাধা দেবে জানা দরকার। জানব কী, বেটা মদ খেতে খেতে ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিল। সেইসঙ্গে নিজের বাপকে মা মাসি তুলে গাল দেয়। একবার কাঁদে, একবার তড়পায়। কী ব্যাপার? না, ওই টগর নামের সোনাগাছির মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে সে নাকি বাপের কাছে পারমিশন চাইতে গিয়েছিল, বাপ ঘাড় ধরে শুধু বের করে দেয়নি; বেশ্যাকে বিয়ে করলে ত্যাজপুত্র করবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে। গাধাটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তার মা বেঁচে থাকলে নাকি বাবা এই অবিবেচকের কাণ্ড করতে পারত না। মা ছেলের বউকে ঠিক বুকে টেনে নিত। পরেশ মাইতি আমাকে তড়িঘড়ি জামাই করবার পিছনের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হল।’
মর্নিংওয়াকের দু-নম্বর চক্কর শেষ করে বাসুদেব বাঁধানো ইটের রাস্তা থেকে একটু সরে দাঁড়ালেন। এবার একটু দম নেবেন। হাঁটার সঙ্গে একটানা কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছেন। তবে তাতে অসুবিধে হচ্ছে না। কথা বলতে ভালো লাগছে। এই ছায়া-মানুষটার সঙ্গে কথা বললে তার হালকা লাগে। দম নিয়ে বাসুদেব আবার হাঁটতে শুরু করলেন। কপিলও পাশে এগিয়ে এল।
‘আমি আর দেরি করলাম না। তার জন্য আরও মদের ব্যবস্থা করলাম। নিজের বিয়ের কথা পুরোপুরি চেপে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় লম্বা সময় ধরে তাকে দুটো সৎ পরামর্শ দিলাম। একনম্বর, সে যেন তার পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও না সরে। আর দু-নম্বর, বিয়ে করার পর কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেয়। পরে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেই চলবে। ততদিনে তার বাবার রাগ কমানোর দায়িত্ব আমার। পরামর্শ কেমন ছিল কপিল? ভালো না?’
কপিল গলা নামিয়ে বলল, ‘জি সাব বহুত আচ্ছা।’
‘এখানেই পরামর্শ শেষ করিনি। আরও আছে। আমার কথা দুলালের মনে খুব ধরল। সে বলল, কোথায় পালাব? আমি বললাম, পালানোর জায়গার আবার অভাব? দিল্লি, মুম্বই কত জায়গা আছে। বউ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লেই হল। দুলাল আমার হাত চেপে ধরে বলল, টাকা? অনেক টাকা লাগবে তো। আমি তখন হেসে বলেছিলাম, পারিবারিক ব্যাবসার টাকা না বলে নিলে দোষ হয় না। মনে রাখবে ব্যাবসা তোমারও। ধার হিসেবেই ধরো না। কথাটা মনে ধরল দুলালের। আসলে এইসব সময়ে মানুষের বোধবুদ্ধি লোপ পায়। পছন্দ মতো কথা ভয়ংঙ্কর হলেও মনে হয় ঠিক। আর ওই ছেলের মাথা তো তখন পুরোপুরি গেছে। তিনদিনের মাথায় দুলাল মেদিনীপুরে গিয়ে বাবার ক্যাশ ভাঙল, সই জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা সরাল, এমনকী বোনের বিয়ের জন্য সরিয়ে রাখা মরা মায়ের কিছু গয়নাও হাতাল। আমি তখন ব্যাবসার অর্ডার ধরতে সুরাটে বসে আছি। প্ল্যান কেমন ছিল?’
‘আচ্ছা সাব।’
সত্যি আচ্ছা ছিল। ফিরে এসে দেখলাম, ছেলের কীর্তিতে পরেশ মাইতি একেবারে ভেঙে পড়েছে। শুধু মনের দিক থেকে নয়, শরীরের অবস্থাও খারাপ। শয্যাশায়ী যাকে বলে। বিছানায় শোওয়া অবস্থাতেই আমার হাত ধরে বললে, এই বিয়েতে তুমি না বলো না বাবা। তোমার অপগণ্ড বন্ধুটিকে আর কোনওদিনই আমি ক্ষমা করতে পারব না। তার কি একটিবারের জন্য বোনটার কথা মনে পড়ল না! তুমি আমার মেয়ের দায়িত্ব নাও, আমার ব্যাবসার দায়িত্ব নাও। দুলালের অধ:পাতের ঘটনা শুনে আমি খুবই ভেঙে পড়লাম। বললাম, আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করব। কিন্তু আপনি বিজনেসটা পাকাপাকি ভাবে আমার নামেই লিখে দিন, আমি দুলালকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। যে ছেলে এই কাজ করতে পারে সে ফিরে এসে আরও কী গোলমাল করবে তার ঠিক নেই। আপনার মেয়ে সেই গোলমাল সামলাতে পারবে না। আইনগতভাবে জোর না থাকলে আমিই বা কী করে ঠেকাব? পরেশ মাইতি দেরি করলেন না। দু-দিনের মধ্যে উকিল ডেকে, লেখাপড়ার কাজ শেষ করলেন। ততক্ষণে আমার কাছে খবর এসে গেছে, সোনাগাছির টগর দুলালের সঙ্গে পালাতে রাজি হয়নি। তার পেটে ভাঙা মদের বোতল ঢুকিয়ে পালিয়েছে দুলাল। পুরোপুরি মারতে হয় তো চায়নি, কিন্তু মেয়েটা ফস করে মরে গেছে। পুলিশ দুলালকে খুঁজছে। আমি নিশ্চিন্তে বিয়ে করে ফেললাম। তবে বিয়ে হল, খুবই নমো নমো করে। মেয়ের বাড়ির অবস্থা কঠিন। কনের পিতা শয্যাশায়ী, ভাই বেশ্যা খুন করে ফেরার। আমিও ঘটা চাইনি। প্রায় গোপনেই গ্রামের বাড়িতে আচার অনুষ্ঠান শেষ হল। বিয়ের পর মেয়ে তমলুকেই রয়ে গেল। বউকে তখন আনব কোথায়? দেখবে কে? তা ছাড়া বাড়ির দখল ধরে রাখাও তো একটা কথা। আমি ব্যাবসায় মন প্রাণ ঢেলে দিলাম। চারদিকে ছুটে বেড়াই। মাসে হয়তো একবার বউয়ের কাছে যাই।’
বাসুদেব চুপ করলেন। কপিলের অস্বস্তি হচ্ছে। হিসেবমতো সাহেবের এবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। চার নম্বর চক্কর শেষ হতে চলল। বেলাও বাড়ছে। কিন্তু এ কথা বলা যায় না। বডিগার্ডের কাজ পাহারা দেওয়া, সময় মনে করিয়ে দেওয়া নয়।
বাসুদেব আনমনে বললেন, ‘দেখতে যেমনই হোক, সেই মেয়ের নামটা বড় সুন্দর ছিল কপিল কনকচাঁপা, সবাই ডাকত কনক। সুন্দর না?’
কপিল মাথা নেড়ে বলল, ‘বহুত বড়িয়া নাম।’
‘স্বভাবটাও সুন্দর। দুলালের একেবারে উলটো। শান্ত, চুপচাপ, কোনও চাহিদা নেই। কোনও প্রশ্নও নেই। যেন যেটুকু পেয়েছে, যা পেয়েছে তাই অনেক। হয়তো চেহারার কারণেই এরকম। আমিও খুশি। পরেশ মাইতির বিজনেস দ্রুত নিজের মতো করে সাজিয়েগুছিয়ে নিতে লাগলাম। জানতাম সময় খুব বেশি পাব না। পুরোনো কারখানা বেচে নতুন ওয়ার্কশপ করলাম। ফুলের ব্যাবসা গুটিয়ে টাকা ঢাললাম নতুন ওয়ার্কশপে। দিঘার হোটেল বেচে কলকাতায় বড় অফিস কিনলাম। টাকা, ক্ষমতা, খ্যাতি বাড়তে লাগল। কনকের কাছে যাওয়া কমে গেল। আগে মাসে একবার যেতাম, সেটা বেড়ে দু-মাস, তিনমাসও হয়ে গেল। একটা সময় বুঝতে পারলাম, ওই মেয়ের জন্য আমার টান কমে যাচ্ছে। টান তো কমবেই। কলকাতায় মেলামেশা তখন বাড়ছে। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে পার্টিতে যাচ্ছি। সেখানে ঝলমলে সুন্দরী মেয়েরা চকচকে শরীর নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায়। কনকের কথা কাউকে বলতে পারি না, কারও সামনে আনতে পারি না। পুরোনো বাসুদেব চৌধুরি তো আর নেই, সে তো তখন অন্য মানুষ। প্লেটের সুতো জুড়ে জুড়ে তার গল্প অনেকখানি এগিয়ে গেছে। অতীত সে শুধু ভুলে যেতে চায় না, অস্বীকারও করে। তবু কী আশ্চর্যের কথা জানো কপিল, পরেশ মাইতি মৃত্যুর কয়েকমাস পরে আমার আর কনকের একটি সন্তান হল। যদিও আমার মা নাতিকে দেখে যেতে পারেনি। আমি একদিন কনককে গিয়ে বললাম, এই পাড়াগাঁয়ে ছেলে মানুষ হবে কী করে? সে-ও তোমার মতো ক্লাস এইট পর্যন্ত গিয়ে হাঁপিয়ে উঠবে। আর মামার রক্ত গায়ে থাকলে তো কথাই নেই, মাতাল নয়তো, খুনি। আমিও ব্যাবসায় বাইরে বাইরে ঘুরি, বরং একটা কাজ করি, ছোটবেলা থেকেই ওকে ভালো কোনও বোর্ডিং-এ ভরতি করে দিই। একেবারে মানুষ হওয়ার পর ফিরিয়ে আনব।’
কথা থামিয়ে বাসুদেব একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘চলো কপিল বাড়ি যাই, রোদ বাড়ছে।’
কপিল খুশি হল। ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও এই মানুষটাকে তার পছন্দ হয়। বডিগার্ডের কাজ সে এই প্রথম করছে না, আগেও করেছে, কিন্তু সকলেই তাকে দেখেছে যন্ত্রের মতো। প্রাণহীন একটা রোবট। মাপা চলা, মাপা কথা, মাপ বুঝে পাহারা দেওয়া। এই মানুষটাই কেবল অন্যরকম। তাকেও মানুষ ভাবে। মেয়ের সাদি হবে শুনে পাঁচ হাজার টাকা নগদ হাতে তুলে দিয়েছে। দেওয়ার সময় বলেছে, ‘দ্যাখো কপিল, জামাই যেন ভালো হয়। যার তার হাতে মেয়েকে তুলে দিও না বাপু।’
মোড়টা ঘুরলেই বাড়ির গেট চোখে পড়বে। বাসুদেব চৌধুরি থমকে দাঁড়ালেন। কপিল এগিয়ে এসে বলল, ‘জি সাব!’
‘আজ এত ঘটনা তোমাকে কেন বললাম জানো কপিল। বললাম কারণ সেই দুলাল ফিরে এসেছে। আমি জানতাম একদিন না একদিন হি উইল কাম ব্যাক। প্রতিশোধ নিতে সে আসবেই। তাতে আমি যে খুব ঘাবড়ে গেছি এমন নয়। কিন্তু আমার চিন্তা প্রতিশোধের পদ্ধতি নিয়ে। কোন পথে সে আমাকে ধাক্কা মারতে চাইবে? আমি যদি খুব ভুল না করি সে প্রথম টার্গেট করবে স্বর্ণকে। ইতিমধ্যে করেছেও। কপিল, আমি চাই না স্বর্ণর কোনওরকম সমস্যা হোক। তার কোনও ধরনের ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারব না। তাকে রক্ষা করতে হবে। এই কাজ পুলিশ দিয়ে হবে না। দুলাল যে পথে যাচ্ছে সে পথ আটকানোর সাধ্য পুলিশের নেই। আমার ইচ্ছে, তুমি তাকে পাহারা দাও। তার জন্য যত দূর পর্যন্ত যেতে হয় তুমি কি যেতে রাজি আছ?’
কপিল বুক টান-টান করে দাঁড়াল। উজ্জ্বল চোখে বলল, ‘জরুর সাব। আপনি যদি অনুমতি দেন আজ থেকেই ছোটসাহেবের সঙ্গে লেগে যাই।’
বাসুদেব হাসলেন, ‘না, ওভাবে হবে না। ছোটসাহেব তোমাকে সঙ্গে ঘুরে পাহারা দেওয়ার অনুমতি দেবে না। কাজটা করতে হবে গোপনে। সময় হলে আমি তোমাকে বলে দেব। মনে হচ্ছে, সেই সময়ের খুব দেরি নেই।’
বাসুদেব চৌধুরির খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। এই কথা বিকাশও জানবে না। নিজের ছায়া নিজের সন্তানকে রক্ষার দায়িত্ব নিলে তার থেকে ভালো আর কী আছে?
নয়
বাংলোয় রং হবে।
এখনই যে রং করার দরকার ছিল, এমন নয়, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত। তবু বাসুদেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রং হবে। এ বাড়িতে নতুন করে যে-কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি সেটা সকলের বোঝা জরুরি। রঙের পাশাপাশি বাগানে আলো লাগানোর কথাও বলেছেন তিনি। স্ট্যান্ডের ওপর বড়-বড় সেডে ঢাকা আলো। সন্ধের পর থেকেই আলোগুলো জ্বলবে।
রং কোম্পানিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়িতে অসুস্থ মানুষ রয়েছে, কাজ শেষ করতে হবে দ্রুত। আগে বাড়ির বিভিন্ন অংশে খানিকটা করে রং লাগিয়ে ‘সেড’ পরীক্ষা করে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। স্বর্ণর ঘরে যখন রঙের একটা পোঁচ পড়ল স্বর্ণ তখন বাড়িতে ছিল না। সন্ধের পর ফিরে দেওয়ালের রং দ্যাখে এবং বদ্যিনাথকে ডাকে।
‘বদ্যিনাথদা, আমার ঘরের দেওয়ালে রং কেন?’
স্বর্ণ খবর পাঠাতেই হাতের কাজ ফেলে ছুটে এসেছে বদ্যিনাথ। স্বর্ণকে অনেকদিন ধরেই সে দেখছে। এ বাড়ির অন্যদের মতো তার স্বভাব চরিত্র, মেজাজের সঙ্গে পরিচিত। তবু সে এই ছেলেকে ঠিক বুঝতে পারে না। ধাঁধার মতো লাগে। গত কয়েক বছরে সেই ধাঁধা আরও জটিল হয়েছে। সবসময়েই চোখমুখে রাগ, বিরক্তি অথবা নিস্পৃহ ভাব। কীসের রাগ? কেন এত বিরক্ত? নাকি বিরক্তি নয়, অন্য কিছু? এই জটিল ধাঁধা ভাঙার চেষ্টা বদ্যিনাথ করে না। দরকার কী? যে জটিল ধাঁধা নিয়ে থাকতে চায়, সে জটিল ধাঁধা নিয়ে থাকুক। তার জীবন জটিল নয়, অতি সরল জীবন। সেই জীবনের একটাই লক্ষ বাকিদিনগুলো এই ‘পাগলাবাড়ি’র কাজটাকে টিকিয়ে রাখা। তবে স্বর্ণকে সে খানিকটা সমঝেই চলে।
বদ্যিনাথ ঢোঁক গিলে বলল, ‘বাড়িতে রং হচ্ছে ছোটবাবু।’
স্বর্ণ শান্ত গলায় বলল, ‘বাড়িতে হোক, কিন্তু আমার ঘরে রং দিতে কে বলেছে?’
‘মিস্ত্রিরা দিয়েছে।’
স্বর্ণ বলল, ‘পারমিশান ছাড়া কী করে দিল?’
‘পারমিশান নিয়েছে। বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে সব ঘরেই দিচ্ছে। বাইরেও দিয়েছে। এখনও ফাইনাল কাজ শুরু হয়নি। সেড মিললে ফাইনাল কাজ শুরু হবে।’
স্বর্ণ কাঁধের ব্যাগ টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘ফাইনাল, সেমিফাইনাল কোনও কিছুতেই আমার প্রয়োজন নেই। কাল সকালেই বলবে, আমার ঘর থেকে যেন রং তুলে ফেলা হয়।’
বদ্যিনাথ বলল, ‘বলব ছোটবাবু।’
‘আর শোনো, কাল আমার জন্য একটা তালা এনে রাখবে। এবার থেকে আমি ঘরে তালা দিয়ে বেরোব।’
বদ্যিনাথ মাথা নাড়ল।
পরদিন সকালে মিস্ত্রিরা রং তুলে ফেলার পর সত্যি সত্যি ঘরে তালা লাগিয়ে দিল স্বর্ণ। রাত দশটার কিছু পরে বাড়ি ফিরে দেখল, ড্রইংরুমে বাসুদেব চৌধুরি বসে আছেন। হাতে অফিসের ফাইল। মাথা নামিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল স্বর্ণ। বাসুদেব ছেলের পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন।
‘স্বর্ণ।’
স্বর্ণ থমকে দাঁড়াল। বাসুদেব হাতের ফাইল সামনের নীচু কাচের টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। এবার ফাইলের মাথাটা দেখা গেল। লাল পেন দিয়ে বড় করে লেখা—’স্বপ্নদ্বীপ।’
‘পড়াশোনা কেমন চলছে স্বর্ণ। তোমার এখন কোন ইয়ার যেন?’
স্বর্ণর একবার মনে হল, উত্তর না দিয়ে চলে গেলে কেমন হয়? খারাপ হয় না। খুব সহজভাবে খানিকটা অপমান করা যাবে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলাল। না, এত সহজ অপমান নয়। এই মানুষটার যদি সত্যি অপমান প্রাপ্য হয় তা হলে তা হবে অনেক কঠিন। অনেক স্থায়ী। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
‘ফাইনাল ইয়ার।’
‘ভেরিগুড, লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?’
স্বর্ণ অস্ফুটে বলল, ‘চলছে।’
বাসুদেব ছেলের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলেন। সোফায় হেলান দিয়ে বললেন, ‘তুমি যে এতদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করছ তার জন্য আমি খুব খুশি। আমার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, আমি পড়াটা চালিয়ে যাই।’
স্বর্ণ চুপ করে রইল। তার বিরক্তি বাড়ছে। মানুষটা কী বলতে চায়? নিশ্চয়ই পড়াশোনার কথা শোনার জন্য ডাকেনি। অন্য কিছু বলার আছে। সেটা কী?
‘স্বর্ণ তোমার প্ল্যান কী?’
মাথা না তুলেই স্বর্ণ ভুরু কোঁচকাল।
‘দেখ স্বর্ণ, আমি তোমাকে বলতে পারতাম, তুমি ব্যাবসায় চলে এসো। ব্যাবসার জন্য সেটা খুবই প্রয়োজন। আমি ডাইভারসিফিকেশনের চেষ্টা করছি। প্রাোডাকশনে আজকাল অনেক ঝামেলা। রিয়েল এস্টেটে সে সমস্যা নেই। বিক্রিবাটা হয়ে গেলে ঝাড়া হাত-পা। আমি সেদিকেই যাওয়ার কথা ভাবছি। তুমি যদি দায়িত্ব নাও, তা হলে অবশ্যই খুব ভালো হয়। কিন্তু আমি তা বলব না। তুমি আগে পড়া শেষ করো। যদি বাইরে কোথাও পড়তে যেতে চাও, যেতে পারো। এখন তো অনেক স্কোপ। তুমি কি কিছু চিন্তাভাবনা করছ?’
স্বর্ণ ঠোঁট কামড়াল। লোভ দেখাচ্ছে? তাই হবে। ছোটবেলা থেকেই এই মানুষটা তাকে নানা ধরনের লোভের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করেছে। স্কুলজীবনে বোর্ডিং-এ থাকতে বিশেষ বিশেষ অকেশনে বাক্স সাজিয়ে খাবার যেত। বিস্কুট, চকোলেট, কেক, পেস্ট্রি। জামাকাপড়, গল্পের বই, খেলাধুলোর সরঞ্জামের কোনও অভাব ছিল না। কোনওদিনই কিছু চাইতে হয়নি। শর্ত শুধু একটাই; বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না চলবে না। গেলেও এক-দুদিনের বেশি নয়। বিষয়টা বুঝতে সময় লেগেছিল স্বর্ণর। যখন বুঝল, ততক্ষণে রাগ আর অভিমান ভেতরে স্থায়ী ভাবে জমে গেছে। ছুটিছাটায় বোর্ডিং ফাঁকা হয়ে যেত। খেলার সঙ্গী না পেয়ে একা ঘুরে বেড়াত মাঠে। ঘরে শুয়ে থাকত। ভাবত কেন তাকে এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে? কোন দোষে? কার দোষে?
স্বর্ণ রাগ চেপে বলল, ‘না, ভাবনাচিন্তা করিনি।’
‘ঠিক আছে অসুবিধে কিছু নেই, সময় আছে। চিন্তাভাবনা করো। ইউনিভার্সিটিটা শেষ করো মন দিয়ে। সেইসঙ্গে বিদেশ যাওয়ার কথাটাও মাথায় রাখো। আজকালকার ফিউচার প্ল্যান আগে থেকে করতে হয়। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা কোরো না। বাইরে থেকে ফিরে কোম্পানির দায়িত্ব বুঝে নেবে। আমি ততদিনে আরও কিছুটা গুছিয়ে রাখব।’
স্বর্ণর ভালো লাগছে না। সে এই ঘর থেকে চলে যেতে চায়। বাসুদেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্বর্ণ, তুমি ঘরে রং করতে বারণ করেছ?’
‘স্বর্ণ সামান্য চমকে চোয়াল শক্ত করল।
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? ওই রং কি তোমার পছন্দ নয়? অন্য কোনও সেড চাইছ? যদিও চাও তা হলে ওরা তোমার সঙ্গে কথা বলুক। আমি বদ্যিনাথকে বলে রাখছি।’
‘না, কোনও রং-ই চাই না। যতদিন আমি এখানে আছি, আমার ঘর যেরকম আছে তেমনই থাকবে।
বাসুদেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কোনও রংই চাও না! কেন, রঙে তোমার অসুবিধে কী? নিয়ম করে বাড়িঘরের রং বদলানো ভালো। ফার্নিচারও বদলাতে হয়। দীর্ঘদিন এক জিনিস একঘেয়ে লাগে। রোজ রোজ বাড়ি বদলানো যায় না, রং ফার্নিচার বদলে এই একঘেয়েমি কাটাতে হয়। তোমার মায়ের পক্ষেও সেটা ভালো হবে।’
স্বর্ণ চুপ করে রইল। একই ভাবে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘তা ছাড়া বাড়ির মেইনটেনেন্সে একটা ব্যাপার আছে। এতবড় বাড়ি, তাকে ঠিকমতো রক্ষাও তো করতে হবে। এখন আমি করছি, পরে তুমি করবে।’
‘আমার ঘর রক্ষা করার দরকার নেই।’
মুহূর্তখানেক ছেলের দিকে তাকিয়ে বাসুদেব কঠিন গলায় বললেন, ‘দরকার আছে। তোমার ঘরটা এ বাড়ির থেকে আলাদা নয়। সব ঘরে যখন রং হচ্ছে, তোমারটাতেও হবে।’
স্বর্ণর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কি আপনার অর্ডার?’
বাসুদেব থমকে গেলেন। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই স্বর্ণ বাবাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে। এটা এ যুগের অভ্যেস নয়। ছেলেকে অনেক বলেও বদলাতে পারেননি বাসুদেব। পরে বুঝতে পেরেছিলেন, এই সম্বোধন আসলে একটা দূরত্ব। সেই দূরত্ব বলে টপকানো যাবে না। সেই দূরত্ব ক্রমশ বেড়েছে। দুজনের কথাবার্তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেখাই হয় কালেভদ্রে। কলেজে ভরতি হওয়ার পর স্বর্ণ জোর করে হস্টেলে চলে গেল। বাসুদেব অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কেন! বাড়িতে সমস্যা কোথায়? এতবড় বাড়ি, মানুষ বলতে আমরা তিনজন। তাও তো তোমার মা…।’
স্বর্ণ জোর গলায় বলেছিল, ‘না, আমি হস্টেলেই থাকব। এ মাস থেকেই আমি চলে যেতে চাই।’
বাসুদেব ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘স্বর্ণ, আমি জানি তুমি কেন এ কথা বলছ। এটা তোমার রাগের কথা। স্কুলের দিনগুলোতে তোমাকে আমি চট করে বাড়িতে আনতে চাইতাম না। সেই কারণে রাগ, তাই তো? তোমার রাগ হওয়াটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু কাজটা আমি ভুল করিনি। তুমি তখন ছেলেমানুষ ছিলে। তোমার মা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে কী ধরনের আচরণ করে তা তুমি জানো। সেটা কি একজন ছোটছেলের দেখা উচিত? সেই বয়েসে ঘটনার কারণ বোঝবার ক্ষমতা তৈরি হয় না, শুধু ঘটনাটাই মনের ভেতর থেকে যায়। আমি চাইতাম না, অমন একটা বিশ্রী জিনিস তোমার অপরিণত মনের ভেতর থেকে যাক। কোনও বাবাই চাইত না। এখন তুমি বড় হয়েছ; বুঝতে শিখেছ। তুমি জানো তোমার মা যা করে স্বইচ্ছায় করে না, তার অসুখ তাকে করায়। এখন তো তোমার বাড়িতে থাকতে কোনও অসুবিধে নেই। তা ছাড়া ভারতীর জন্য আমি আলাদা ব্যবস্থা করেছি।’
স্বর্ণ আবার বলেছিল, ‘আমি হস্টেলেই থাকব।’
হস্টেল থেকে খুব অল্পই বাড়িতে আসত স্বর্ণ। ভারতী দেবীর সঙ্গে অল্পসময় দেখা করত, টুকটাক জামাকাপড়, জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যেত আবার। রাত কাটাতে চাইত না। বাসুদেব চৌধুরির সঙ্গে প্রায়দিনই দেখা হত না ছেলের। রাতে খবর পেতেন, স্বর্ণ এসেছিল।
একেবারে কলেজের পাট শেষ করে বাড়ি ফিরল স্বর্ণ। দোতলার নির্ধারিত সাজানো গোছানো নিজের ঘর ছেড়ে নেমে এল নীচে। ঢুকে গেল পিছনের ঘরে, বাড়ির কোনায়। আপত্তি করতে গিয়েও বাসুদেব চুপ করে গেলেন। যাক, ছেলে বাড়ি তো ফিরেছে। কাছে-কাছে থাকবে। তবে কাছে থাকায় দূরত্ব আরও বাড়ল।
কিন্তু আজ স্বর্ণ এত কঠিন কেন? ভারতী কি ইতিমধ্যে তাকে কিছু বলে ফেলেছে? বললেই বা কী? উন্মাদের কথা সে বিশ্বাস করবে কেন?
‘না অর্ডার নয়, প্রয়োজন। স্বর্ণ, তুমি ঘরে তালা দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
স্বর্ণ ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাল। অনেক হয়েছে, এবার স্পষ্ট করে বলে দেওয়াই ভালো। বলল, ‘আমি চাই না, কেউ আমার ঘরে ঢুকুক।’
বাসুদেব টেবিলে রাখা ফাইল তুলতে তুলতে শান্ত গলায় বললেন, ‘এটা ঠিক নয়, বাড়ির মধ্যে একটা ঘরে তালা খারাপ দেখায়। তুমি তালা খুলে দেবে।’
শান্ত স্বর্ণর মাথায় যেন ধক করে আগুন জ্বলে উঠল। বাবার দিকে ফিরে ঠোঁটের ফাঁকে ব্যঙ্গের হাসি হাসে। চাপা গলায় বলে, ‘কেন? এ বাড়িতে কি এই প্রথম তালা পড়ছে? আপনি তো আরও ঘরে তালার ব্যবস্থা রেখেছেন। রাখেননি?’
চমকে মুখ তুললেন বাসুদেব। এই আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
‘তোমার মায়ের কথা বলছ? সে তো একজন মানসিক রোগী, উন্মাদ। তাকে বন্ধ করে না রাখলে সে কী করতে পারে তুমি জানো না?’
স্বর্ণ চোখ নামিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘শুধু কি সেটাই কারণ? না কি অন্য কিছুও আছে?’
বাসুদেব স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।
স্বর্ণ নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলে এখন যেতে পারি। আই অ্যাম টায়ার্ড।’
স্বর্ণ চলে যাওয়ার পর বাসুদেব দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন শূন্য দৃষ্টিতে। এক সময় বদ্যিনাথকে ডেকে বললেন, ‘বাড়ির রঙের প্রয়োজন নেই। কালই মিস্ত্রিদের কাজ বন্ধ করে দিতে বলবে।’