শূন্য খাম – ১৫

পনেরো

কপিলের মনটা ভালো নেই। তার কারণ, তার সাহেবের মন আজ খারাপ। পার্ক ঘিরে প্রথম চক্কর শুরু হওয়ার আগেই সাহেব বলেছে, ‘কপিল, আজ বেশি হাঁটব না, দুটো পাক দিয়েই ফিরে যাব।’

‘জি সাব।’

‘মনটা ভালো নেই কপিল, মোটে ভালো নেই।’

কপিলের খারাপ লাগল। সে বোকাসোকা লোক। লেখাপড়া নেই। মন নিয়ে তার কারবারও নয়। তার কারবার দেহ নিয়ে। মানুষের দেহরক্ষার কায়দা সে শিখেছে, মন রক্ষার কিছুই জানে না। সে দায়িত্বও তার নয়। তবু এই মানুষটা যখন নিজের মুখে মন খারাপের কথা বলল, তখন তারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই সাহেবের বেলায় তার এমন কতকগুলো ব্যাপার হচ্ছে যা হওয়া উচিত নয়, তবু হচ্ছে।

কপিল পিছনেই হাঁটছিল, সাহেবের ইশারায় কয়েক পা এগিয়ে এল। বাসুদেব চৌধুরি তাকে আরও পাশে সরে আসতে বললেন। কপিল দোনামোনা করল। অন্যদিনের মতো হুট বলতে পজিশন বদলানোর সমস্যা আছে। কাল বিকেলে অফিস থেকে খবর দিয়েছে, সাহেবের ডিউটিতে আরও অ্যালর্ট থাকতে হবে। কোনওরকম গলতি যেন না হয়।

বাসুদেব চৌধুরি নীচুস্বরে বললেন, ‘তোমাকে আজ প্রয়োজনীয় কতকগুলো কথা বলব। মন দিয়ে শুনবে।’

জি সাব।’

‘স্বর্ণর কথা বলেছিলাম, মনে আছে?’

‘জরুর সাব।’

‘এবার তোমাকে কাজটা করতে হবে কপিল। কাজটা একটু গোলমেলে।’

‘আপ ফিকর মাত কিজিয়ে সাব।’

‘এ মাসের বারো তারিখ স্বর্ণ সকাল দশটার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছোবে। জেটিঘাটের সামনে ওর জন্য একটা বুড়ো লোক অপেক্ষা করবে। আমার কাছাকাছি বয়স। চোয়াড়ে টাইপের ভাঙা চেহারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। লোকটা একটুক্ষণ অন্তর অন্তর নিজের গালে হাত বোলায়। সে স্বর্ণকে নিয়ে কলকাতার বাইরে যেতে চায়। বুঝতে পারছ?’

‘জি সাব।’ মাথা নেড়ে গভীর গলায় বলল কপিল।

গলার স্বর শুনেই বাসুদেব বুঝলেন বোকাসোকা কপিল আজ আর শুধু মাথা নাড়ছে না; সত্যিই তার কথাগুলো বুঝছে।

‘কপিল আমি চাই না, স্বর্ণ ওই লোকটার সঙ্গে কলকাতার বাইরে যাক। সেদিন ওদের আটকাতে হবে। তুমি নিজে সামনে যাবে না। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবে। বুড়ো লোকটার সঙ্গে তোমার সেই লোক গোলমাল পাকাবে। যদি দুলাল আগে চলে আসে ভালো, আমার মনে হয় না সেটা হবে, দুলাল অন্য কোথাও থেকে জায়গাটার ওপর খেয়াল রাখবে, স্বর্ণ আসার পর দেখা দেবে।’

কপিল একটু অবাক গলায় বলল, ‘দুলাল!’

বাসুদেব ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ সেই দুলাল, যার বোনকে আমি বিয়ে করেছিলাম। এর কথাই তোমাকে আমি বলেছি। মনে পড়ছে।’

কপিল মাথা নাড়ে।

সেদিন দুলালের সামনে গিয়ে তোমার লোককে বলতে হবে, তাকে সে চেনে। বহুবছর আগে সোনাগাছিতে দেখেছে। কথাটা বলতে হবে স্বর্ণর সামনে। দুলাল প্রথম চোটে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করবে। তখন তাকে আরও চেপে ধরতে হবে, দরকার হলে চিৎকার করতে হবে। বলতে হবে, তুমিই সোনাগাছির এক বেশ্যাকে খুন করে পালিয়েছিলে। এতে একটা গোলমাল শুরু হবে। স্বর্ণ সরে যাবে। তার মতো ছেলে, এই ধরনের ঘটনা স্ট্যান্ড করতে পারবে না। লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকবে, পুলিশ আসবে। পারবে না?’

কপিল চিন্তিত মুখে বলল, কেশিশ করেঙ্গে সাব।’

কয়েক পা নীরবে হাঁটলেন বাসুদেব। নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘আমি নিজেও পুলিশকে জানাতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমি করব না। স্বর্ণ ভাববে, আমার হাত আছে। এতে সাময়িকভাবে ওর যাওয়া সেদিনকার মতো আটকানো যাবে, কিন্তু আমার প্রতি তার অবিশ্বাস বাড়বে। তা ছাড়া আমি নিজে সরাসরি জড়াতে চাইছি না। কোম্পানির নাম এসে পড়বে। দ্যাট উইল হ্যামপার দ্য গুড উইল।’ এবার ঘুরে কপিলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন বাসুদেব।

‘আর যদি এই প্ল্যান কোনও কারণে ফেল করে, তা হলে অন্য কোনও ভাবে আটকাতে হবে, যে-কোনও ভাবে। তোমার তো অস্ত্র আছে। তাই না?’

কপিল মাথা কাত করে বলল, ‘জি সাব। রিভলভার।’

‘গুড। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই কপিল। আমি তোমার ওপর ভরসা করি। বহুবছর পর আমি কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে যাচ্ছি। আমার একটা প্রজেক্ট নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেই সমস্যা মিটিয়ে ফিরব। কপিল, আমি চাই, এখানকার সমস্যাও সেই সময়ের মধ্যে মিটে যাক। আর একটা কথা…।’

‘জি সাব।’

সামান্য সময় নিয়ে বাসুদেব গাঢ় গলায় বললেন, ‘কথাটা বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু উপায় নেই, আশা করি তুমি বুঝতে পারবে। আমি তোমাকে ছুটি দিয়ে দিচ্ছি কপিল। এটাই হবে আমার জন্য তোমার শেষ কাজ। এতদিন তুমি তোমার ডিউটি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছ, তার থেকেও বড় কথা তোমার সঙ্গে আমি দীর্ঘ একটা ভালো সময় কাটালাম। এই ভালো সময়টুকু আমার জন্য যে কতটা প্রয়োজনীয় ছিল তুমি বুঝবে না।’ একটু থেমে বাসুদেব কপিলের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু ভেরি মাচ।’

‘সাহেবের পিছনে নিজের পজিশনে ফিরে যেতে যেতে কপিলের মনে হল, সাহেবের মন খারাপ ভাবটা কমে গেছে। আজ এই চাকরির মেয়াদ ফুরোল, তবু সে খুশি হল। সে চায় এই মানুষটার মন সবসময় ভালো থাকুক।

ছায়া বোধহয় এরকমই, পাশে থাকতে থাকতে একটা সময় শুধু শরীর নয়, মূল অবয়বের সুখ-দু:খও বহন করতে শুরু করে।

বাড়িতে ফিরে বাসুদেব বদ্যিনাথের কাছে খবর পেলেন, কাল সারারাত ঘুম হয়নি ভারতী দেবীর। রাধা নাকি ওষুধের ডোজ বাড়িয়েও তাকে ঘুম পাড়াতে পারেনি। বাসুদেব ওপরে উঠলেন। খানিকটা হালকা লাগছে। ঘুঁটি সাজানো হয়ে গেছে। জীবনের স্বাদকে পরখ করতে যে খেলা তিনি শুরু করেছিলেন পঁচিশ বছর আগে, সেই খেলার অন্তিম পর্বের মুখোমুখি হয়েছেন। এই পর্বই সব থেকে কঠিন, সব থেকে জটিল। তিনি নিজে সামনে থাকবেন না। মুম্বই চলে যাচ্ছেন। ইচ্ছে করেই যাচ্ছেন। সঙ্গে সাক্ষী হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন, বৈদ্যকে। কপিল বা রাধা, কারও কীর্তির দায়ই তার ঘাড়ে পড়বে না।

জানলা বন্ধ থাকার কারণে এই সকালেও ঘর অন্ধকার। পাশ ফিরে শুয়ে আছেন ভারতী দেবী। বাসুদেব ডাকতে মুখ ফেরালেন। দুটো চোখই টকটক করছে লাল। চোখের তলায় রাত জাগার কালি। নাকের পাশে অল্প অল্প ঘাম। স্বামীকে দেখে উঠে বসতে গেলে বাসুদেব হাত তুলে বললেন ‘থাক শুয়ে থাকো ভারতী।’

ভারতী দেবী তাও সামান্য উঠে বসলেন। তাকালেন স্বামীর দিকে। বন্ধ দরজা জানলা ফাঁকি দিয়ে আসা দিনের আলোয় বাসুদেব দেখলেন, সেই দৃষ্টি ঘোলাটে।

আড়ষ্ট জিভে ভারতী দেবী বললেন, ‘আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি।’

মমতা মাখা গলায় বাসুদেব বললেন, ‘আ: ভারতী এখন ওসব ছাড় তো। তুমি কেমন আছ?’

ভারতী দেবী স্বামীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘আমি স্বর্ণকে বলে দিয়েছি। সব বলে দিয়েছি।’

 ঠোঁট কাঁপছে, কথা আরও জড়িয়ে যাচ্ছে ভারতী দেবীর। বাসুদেব চৌধুরি ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসলেন। রাধা কাজ শুরু করে দিয়েছে তা হলে। মানুষটা আবার তার পুরোনো জগতে ফিরতে শুরু করেছে। খুব ধীরে, কিন্তু ফিরছে। স্ত্রীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বাসুদেব বললেন, ‘বেশ করেছ ভারতী। ঠিক কাজই করেছ।’

ভারতী দেবী বিড়বিড় করে বললেন, ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’

বাসুদেব হাত বাড়িয়ে ভারতী দেবীর হাত ধরলেন। গভীর আবেগে বললেন, ‘আই লাভ ইউ ভারতী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

‘আগে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?’

বাসুদেব চৌধুরি পকেট থেকে রুমাল বের করে ভারতী দেবীর ঠোঁটের কোণ মোছাতে মোছাতে বললেন, ‘একটা আনন্দের খবর আছে ভারতী। তোমার ছেলে মনে হয় তার লাইফ পার্টনারটিকে খুঁজে পেয়েছে। শুনলাম ভারী সুন্দর মেয়ে। লাইক ইউ মাই ডার্লিং।’

ভারতী দেবী অর্থহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন।

বাসুদেব চৌধুরি হেসে বললেন, ‘মেয়েটির নামটাও ভারী চমৎকার। প্রীতি। ভারতী আমি কয়েকদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে একদিন প্রীতিকে ডেকে পাঠাব। আমরা সবাই মিলে ডিনার করব। প্রীতি, স্বর্ণ, তুমি আর আমি।’

ভারতী দেবী বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘আমি।’

স্ত্রীর কপালে হাত রেখে বাসুদেব চৌধুরি বললেন, ‘অবশ্যই তুমি। ডাক্তার সেন বলেছেন, তুমি সুস্থ হয়ে উঠছ। আমি ফিরে এসে নিশ্চয় দেখব, আরও অনেক ভালো হয়ে গেছ।’

ক্লান্ত ভারতী দেবী চোখ বুজলেন। বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

অন্যদিনের তুলনায় বেশ খানিকটা আগে অফিসে ঢুকলেন বাসুদেব চৌধুরি। বৈদ্যর সঙ্গে বসে কাগজপত্র তৈরি করলেন দীর্ঘসময় নিয়ে। ‘স্বপ্নদীপ’-এর জমি সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি তিনি মুম্বই নিয়ে যাবেন। এক ছটাক জমির ব্যাপারেও ওদের মনে যেন কোনও সন্দেহ না থাকে। আজও মিটিঙের মাঝখানে বিকাশ খবর দিল, সে দেখা করতে চায়। বিষয়টা জরুরি। বাসুদেব ঠিক করেছিলেন, বৈদ্যর সঙ্গে কথা শেষ হলেই বিকাশকে ডেকে নেবেন। ডাকা হল না। মিটিং শেষ হতেই মালবিকা ইন্টারকমে কাঁপা কাঁপা গলায় খবর দিল, ‘স্যার আপনার কল। মনে হচ্ছে স্যার। সেই মাতাল লোকটা। লাইনটা দেব?’

যে টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করে থেকে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, হঠাৎ সেটা চলে আসার প্রথম ধাক্কায় খানিকটা হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন বাসুদেব। দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। শান্ত মাথায় কথা বলতে হবে। শান্ত এবং সরাসরি। দুলালের মতো লোকের পক্ষে সরাসরি কথাই একমাত্র পথ।

‘কেমন আছও ভায়া? গলা মনে আছে? থাকার কথাও নয়, কত বছর পর কথা হচ্ছে।’

ওপাশের মেকি উচ্ছ্বাসে গুরুত্ব না দিয়ে বাসুদেব ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘দুলাল, তোমাকে আমি খুঁজছি।’

‘সে কী! আমাকে খুঁজছ! এত রামস নেম ইন ঘোস্ট মাউথ! ভূতের মুখে রাম নাম। আমাকে যত খুঁজে না পাওয়া যায় তোমার তো ততই লাভ।’

এ-প্রান্ত থেকে বিশ্রী হাসির আওয়াজ ভেসে এল।

‘বাজে কথা রাখো দুলাল। এতদিন কোথায় ছিলে?’

‘কোথায় ছিলে। কেমন ছিলে তো জিগ্যেস করলে না? পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে এতবছর পর কথা হচ্ছে, কেমন ছিলে জিগ্যেস না করলে মনটা হু হু করে ওঠে।’ আবার হাসল দুলাল। হাসি থামিয়ে বলল, ‘দূরে ছিলাম, আবার কাছেও ছিলাম। তোমার ওপর নজর রেখেছি। তুমি বুঝতে পারোনি।’

বাসুদেব নড়েচড়ে বসলেন, ‘কাম টু দ্য পয়েন্ট দুলাল। সরাসরি বলো, কী চাও।’

‘অতীতটা একবার হিসেব করে দেখো, নিজেই বলতে পারবে আমার কী চাওয়া উচিত।’

 চোয়ালে চোয়াল চেপে নিজেকে শান্ত রাখলেন বাসুদেব। চাপা গলায় বললেন, ‘ফরগেট অ্যাবাউট দ্য পাস্ট।’

‘সে কী! অতবড় বেইমানি আমি ভুলে যাব।! ঘর ছাড়া করেছ, শহর থেকে তাড়িয়েছ, ফিরে এসে যে নিজের বাড়িতে ফিরব সে উপায়টুকু পর্যন্ত রাখোনি, এখন বলছ ফরগেট।’

‘আমি কোনও বেইমানি করিনি দুলাল। তুমি ভালো করেই জানো যা যা ঘটেছে, তার জন্য অন্য কেউ নয়, দায়ী তোমার চরিত্র।’

ও-প্রান্তে আবার বিশ্রী হাসি শোনা গেল। সঙ্গে বারকয়েক হিক্কা তোলার মতো আওয়াজ।

‘ওরে আমার বিরাট চরিত্রবান এসেছেন রে। যাই হোক, তোমার দ্বিতীয় ওয়াইফ কেমন আছে বাসুদেব? সুন্দরী বউটি শুনেছি যখন-তখন নেংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সত্যি নাকি?’

‘শাট আপ’ বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করলেন বাসুদেব। দুলাল তাকে উত্তেজিত করতে চাইছে। ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।

‘দুলাল, আমি আবার বলছি, যা ঘটেছে তার জন্য তুমি রেসপনসিবল। তোমার বাবা, আমাকে তার ব্যাবসা লিখে দিয়েছিলেন নিজের ইচ্ছেতে। আমি তাকে লিখে দিতে বলিনি।’

‘আর কনক? সে-ও কি তুমি বলোনি?’

এক মুহূর্ত ভেবে বাসুদেব বললেন, ‘না আমি বলিনি। তোমার বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাবটাও তার ছিল। সে বিয়ে টেঁকেনি। সব সম্পর্ক টেকে না।’

দুলাল বড় করে শ্বাস ফেলল। বিদ্রুপের শ্বাস বলল, ‘ঠিকই সব সম্পর্ক টেকে না। এবার দেখো, স্বর্ণর সঙ্গে সম্পর্কটা তোমার টেকাতে পারো কি না।’

‘কত টাকা চাই?

হাসতে-হাসতে ওপাশের কণ্ঠস্বর বলল, ‘শাবাশ, এই তো ধনী মানুষের মতো কথা। কী ছিলে আর কী হয়েছ বাছা, বড় হিংসে হয়।’

‘দুলাল, আবার তুমি ভুল করছ। আমি যা হয়েছি তা আমি নিজের গুণে হয়েছি।’

‘অবশ্যই হয়েছ, টাকাটা শুধু আমার বাপের।’

‘আমি তোমার সঙ্গে তর্কে যেতে চাইছি না। তুমি মাথা ঠান্ডা করো এবং আমাকে বলো, কত টাকা তুমি চাও। কত পেলে শহর ছাড়বে?

কথার বদলে ওপাশ থেকে খানিকক্ষণ কাশির আওয়াজ পাওয়া গেল। বাসুদেব অপেক্ষা করে রইলেন।

তোমাকে একটা কথা বলি বাসুদেব, তুমি এসব বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। স্বর্ণর হাতে ছেড়ে দাও। তুমি বরং মন দিয়ে ব্যাবসাপাতি করো, পাগলা বউ সামলাও, মেয়েছেলে করছ? লাগলে বোলো, সোনাগাছিতে এখনও আমার যোগাযোগ আছে। ওরা খাতির করে; পাগল বউ নিয়ে আদিখ্যেতা চলতে পারে, ইয়ের খিদে মিটবে না।’

বাসুদেব হিম শীতল গলায় বললে, ‘স্বর্ণকে এসবের মধ্যে জড়িও না দুলাল।’

‘হুমকি দিচ্ছ? বডিগার্ড নিয়ে ঘুরছ, বাড়িতে দারোয়ান বসিয়েছ, পারলে রোজ ফোন নম্বর বদলাচ্ছ, এখন হুমকি দিয়ে ভয় দেখাচ্ছ?’

‘আমি আবার বলছি তুমি অ্যামাউন্ট বলো। বলো টাকা নিয়ে কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা করব।’

‘তোমার সঙ্গে আমার অবশ্যই দেখা হবে। তবে এখন নয় বাসুদেব, কয়েকটা দিন পরে। স্বর্ণকে আগে কনকের কাছে পৌঁছে দিই তারপর।’

বাসুদেব আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বললে, ‘স্টপ! আই সে স্টপ।’

অপর প্রান্তের গলা হিসহিসিয়ে বলল, ‘আমাকে স্টপ করে লাভ হবে না বাসুদেব চৌধুরি, স্বর্ণকে থামাতে পারবে না। সে তার মায়ের কাছে যাচ্ছে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।’

 ফোন কেটে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বাসুদেব চৌধুরি। ইন্টারকম তুলে বিকাশকে খবর দিলেন।

বিকাশের হাতে আজও তার গুপ্তচর বৃত্তির ফাইল। টেবিলে সেই ফাইল রেখে অস্বস্তির সঙ্গে সে বলল, ‘স্যার, একটা খারাপ খবর আছে।’

থমথমে মুখ তুললেন বাসুদেব। বিকাশ বলল, ‘স্যার, আপনার শুনলে খারাপ লাগবে। কিন্তু স্যার খবরটা ঠিক।’

বাসুদেব চেয়ারের হাতল চেপে ধরে বললেন, ‘বলো।’

বিকাশ আমতা আমতা করে বলল, ‘আপনাকে ওই খামগুলো স্যার স্বর্ণবাবু পাঠান। ওই এম্প্রটি খামগুলো। বিষ্ণু এসে যখন খবরটা দেয় আমি বিশ্বাস করিনি স্যার, ভেবেছিলাম নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে। উনি কেন আপনাকে ফাঁকা খাম পাঠাবেন? হোয়াটস দ্য রিজন?’

স্বর্ণ পাঠাচ্ছে! শূন্য খাম পাঠাচ্ছে স্বর্ণ! বাসুদেব চৌধুরির মনে হল, পায়ের তলায় কার্পেট মোড়া মেঝে খুব সামান্য হলেও নড়ে উঠল। একেই কি ভূকম্পন বলে?

বিকাশ বলে যেতে থাকে।

‘আমি বিষ্ণুকে বললাম, কোথাও ভুল করছ না তো? সে বলল হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। কাল দুপুরেই স্বর্ণবাবুকে এস. এন ব্যানার্জি রোডের পোস্টাপিসে খাম ফেলতে দেখেছে। কাউন্টারে গিয়ে স্ট্যাম্পও কেনেন। পাশে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু দেখেছে, খামের ওপর টাইপ করা কাগজে আপনার নাম লেখা। হিসেব মতো আজ বা কাল সকালে বাড়িতে আপনার কাছে সেই খাম আসার কথা। আমিও তাও বিষ্ণুকে বলেছি, আবার চেক করো।’

হাত তুলে বিকাশকে থামতে বললেন বাসুদেব চৌধুরি। বিকাশ থামল না।

‘সরি স্যার, আগে জানলে…।’

বাসুদেব মাথা নামিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আগে জানলে কী করতে? খোঁজ করতে না? তুমি তোমার অ্যাসাইনমেন্ট পালন করেছ বিকাশ।’

বিকাশ একটু যেন আশ্বস্ত হল। বলল, ‘স্যার, কাল সকাল থেকে ওই দুলাল লোকটার জন্য ছেলে নামিয়ে দিচ্ছি।’

বাসুদেব অনেকটা সময় ধরে মাথা নামিয়ে চুপ করে রইলেন। একটা সময় অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘থাক বিকাশ। স্বর্ণর ওপর থেকেও নজরদারি তুলে নাও। আমার মনে হচ্ছে, এসবের আর প্রয়োজন নেই।’

বিকাশ অপরাধী গলায় বলল, ‘সরি স্যার। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

বাসুদেব ঠোঁটের কোণে বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি বিকাশ। অনেক পরে হলেও এখন বুঝতে পেরেছি।’ বিকাশ চলে যাওয়ার পর বাসুদেব চৌধুরির মনে হল শরীরের ভেতরে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। লম্বা চওড়া শরীরটা সবদিক থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

ষোলো

বহুদিন পর বাসুদেব চৌধুরি ছেলের ঘরে এলেন।

স্বর্ণ তৈরি ছিল না। দরজা ভেজিয়ে টেবিলের দিকে মুখ করে বসেছিল সে। গত কয়েকদিনই এমন চুপ করে আছে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। ঘোর কেটে গেলে কখনও মনে হচ্ছে, চিৎকার করে ওঠে। কখনও মনে হচ্ছে, হাতের কাছে যা আছে সবকিছু ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আতঙ্কে। সে-ও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করছে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। ঘটনা যদি সত্যি হয়, মাথা ঠান্ডা করেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। গত কয়েকদিন ভারতী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও ওপরে উঠতে পারেনি। সিঁড়ির মুখে কোলাপসেবল টানা। আবার উনি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তবে কি শুধু কথাটুকু জানানোর জন্যই কিছুদিনের জন্য সুস্থ হয়েছিলেন? সুস্থ সেজেছিলেন? অস্থির স্বর্ণ বেরিয়ে পড়ছে বাড়ি ছেড়ে। বাসে উঠে চলে যাচ্ছে এলোমেলো। এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে। এই অবস্থায় প্রীতি তাকে একদিন জোর করে ধরে নিয়ে যায় ‘কাগজের নৌকা’য়।

‘কী হয়েছে তোমার?’

‘কিছু নয়।’

‘আমাকে লুকিও না স্বর্ণ। অবশ্যই কিছু হয়েছে। চেহারার ‘এ কী হাল করেছ! সেভ করোনি, পোশাকের ঠিক নেই। ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ। কী শুরু করেছ তুমি?’

স্বর্ণ মলিন হাসে। প্রীতি টেবিলের ওপরে রাখা হাত চেপে ধরে বলে, ‘হেসে কথা এড়িয়ে যেও না স্বর্ণ। ওই লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই তুমি নিজের ওপর এসব অত্যাচার শুরু করেছ। হোয়াট ইজ দিস? আর ইউ গন ম্যাড? তুমি কি লোকটার কথা শুনে পাগল হয়ে গেলে?

স্বর্ণ চুপ করে থাকে। প্রীতি কান্না ভেজা গলায় বলে, ‘চুপ করে থেকো না স্বর্ণ। প্লিজ আমার কথার উত্তর দাও। ওই লোক তোমার কী এমন বলেছে যার জন্য তুমি এতটা ভেঙে পড়েছ?’

স্বর্ণ প্রীতির হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলে, ‘তোমাকে তো সব বলেছি প্রীতি? ওই লোক আমাকে একটা ডেট দিয়েছে। বলেছে, আমাকে সেই মহিলার কাছে নিয়ে যাবে।’

প্রীতি এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, ‘কেন যাবে তুমি? সে কে তোমার? কেউ নয়। তোমার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। তার প্রতি তোমার কোনও দায়িত্ব আছে? কোনও দায়িত্ব নেই। ওই বাজে লোকটার কথা যদি ঠিকও হয়, সত্যি যদি তাকে ঠকানো হয়ে থাকে, তা হলেই বা তুমি কী করতে পারো? ইটস ইওর ফাদারস ফলট, পাপ অন্যায় যা-ই বলবে সেটা তোমার নয়, তার। তার হয়ে তুমি কী করবে? ক্ষতিপূরণ দেবে? কমপেনসেশন?’

স্বর্ণ মাথা নামিয়ে বলে, ‘ক্ষমা তো চাইতে পারব।’

‘এ কেমন কথা! ইউ আর টকিং রাবিশ। ইউ আর নট ইন সেন্স স্বর্ণ। চেনো না জানো না, একটা মহিলার কাছে তুমি খামোকা ক্ষমা চাইতে যাবে কেন। কী করেছ তুমি?’

কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় স্বর্ণ। নিজের সম্পর্কে সে যা জেনেছে, তা সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক কিছুতেই তা এখন সে প্রীতিকে বলতে পারবে না। তার কাছে সবটাই গল্প কথা মনে হবে। এক বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপ। সে বোঝাতে পারবে না, কেন একটা সময় দীর্ঘদিন তাকে বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হত? কেন আত্মীয়স্বজন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন? কেন বাসুদেব চৌধুরি বাড়ির কাজের লোকদের ঘনঘন বদল করেছেন? কোন সত্য গোপন করতে? স্বর্ণর কাছে আজ সবটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন মনে হয়, বাসুদেব চৌধুরির প্রতি তিল তিল করে যে ঘৃণা, ক্রোধ, অভিমান তৈরি হয়েছে তা কোনও মানুষ নয়, কোনও ঘটনা নয়, প্রকৃতিই তার ভেতরে তৈরি করে দিয়েছে।

প্রীতির কাতর গলায় বলল, ‘এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যালো। ঝেড়ে ফেলে আর পাঁচটা সুস্থ সুন্দর মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসো।’

স্বর্ণ কষ্ট করে হাসে। বলে, আমি চেষ্টা করছি প্রীতি , খুব চেষ্টা করছি। গায়ে জড়িয়ে থাকা লতা, পাতা, শিকড়, শেওলা সাফ করে আমি সকলের মতো স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছি। আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দাও।’

বাসুদেব চৌধুরির পায়ের আওয়াজে মুখ ফেরাল স্বর্ণ।

‘কেমন আছ?’

স্বর্ণ উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাসুদেব হাত তুলে স্মিত হেসে বললেন, ‘বোসো, কেমন আছ বললে না তো?’

স্বর্ণ এ কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘আপনি এত রাতে?’

বাসুদেব একই ভাবে সামান্য হেসে বললেন, ‘রাতে ছাড়া তোমাকে পাব কীভাবে? শুনলাম তোমার শরীর ভালো নেই। বদ্যিনাথ বলছিল, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ, রাত পর্যন্ত জেগে থাকো। কী হয়েছে তোমার?’

মুহূর্তও দেরি করল না স্বর্ণ। চকিতে মুখ তুলে নীচু স্বরে বলল, ‘আপনি জানেন না কী হয়েছে?’

স্বর্ণর উত্তেজনায় বাসুদেব যেন স্বস্তি পেলেন। খাটের একপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা চাদর বালিশ সরিয়ে বসতে বসতে শান্ত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ জানি। সবটা জানি না, তবে অনেকটাই জানি; তোমার সঙ্গে দুলালের দেখা হয়েছে, ভারতীর কথা হয়েছে। তাই তো?’

স্বর্ণ ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘তা হলে? তা হলে আর প্রশ্ন করছেন কেন? প্রশ্ন তো আমার আপনাকে করার কথা। করতামও, কয়েকটা দিন অপেক্ষা করছি মাত্র।’

‘ক’টাদিন? বারো তারিখ পর্যন্ত? টুয়েলভথ?’

স্বর্ণ ভুরু কোঁচকাল। তারিখটা জানল কী করে? লোকটা বলে দিয়েছে?

‘কী বলবেন এবার? মিথ্যে? ব্ল্যাকমেল? নাকি স্ক্যান্ডাল?’

বাসুদেব সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, ‘এসব কিছুই বলব না। আগে হলে বলতাম, আজ বিকেলের পর থেকে আর বলছি না।’

স্বর্ণ মাথা নামিয়ে বলল, ‘একটা কথা পরিষ্কার হয়ে থাকাই ভালো, আমি কারও অতীত ঘাঁটতে ব্যস্ত হইনি। সে ইচ্ছেও আমার নেই, আমি শুধু আমারটুকু জানতে চাই। একটা বয়স পর্যন্ত সে অধিকার আমার ছিল না, এখন হয়েছে।’

‘আর যদি জানো সবটাই মিথ্যে। দুলাল যা বলেছে, ভারতী যা বলেছে সব?’

স্বর্ণ একইরকম বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘তা হলে সেটাই জানব। আশাকরি আপনি নিশ্চয় আমাকে বাধা দেবেন না, মিথ্যেটাই আমাকে খুঁজতে দেবেন।’

বাসুদেব উঠে দাঁড়ালেন। স্বর্ণর জোর তাকে তৃপ্ত করেছে। তিনি হালকা বোধ করছেন। মনে হচ্ছে, তিনি মুক্ত হয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে যে বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই বোঝা এবার নামিয়ে রাখার সময়। স্বর্ণ তার দায়িত্ব নিতে পারবে। সে তার যোগ্য হয়েছে। তিনি নরম গলায় বললেন, ‘একটা সময় পর্যন্ত আমি ঠিক করেছিলাম বাধা দেব, কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত বদল করেছি স্বর্ণ। তুমি যাবে, অবশ্যই যাবে। কনকের কাছ থেকে প্রায় ভিক্ষে করে তোমাকে যখন আমি নিয়ে আসি তখন তাকে কথা দিয়েছিলাম, একদিন ফিরিয়ে দিয়ে আসব। সে কথা আমি রাখিনি। ফেরাতে গিয়েও বারবার স্বার্থপরের মতো ভেবেছি, তা হলে আমি কী নিয়ে থাকব?’

থরথর করে কাঁপছে স্বর্ণ। খাটের পাশ ধরে অস্ফুটে বলল, ‘উনিই আমার মা! কনক?’

বাসুদেব চৌধুরি ছেলের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ কনক, কনকই তোমার মা। আমাদের বিয়ের ঠিক দেড় বছরের মাথায় তোমার জন্ম হয়। সেটা ছিল শ্রাবণ মাস। দু’দিন ধরে সমানে বৃষ্টি চলছিল। সকালে কনকের পেইন উঠল। শেষ বিকেলে যখন তার সন্তানের জন্ম হয়, তখন আকাশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এক কোণে সোনালি আভা ফুটেছে। সোনার মতো। কনক তার কালো ছেলের নাম রাখল স্বর্ণ।’

স্বর্ণ চেয়ারে বসে পড়ল। দু-হাতে মুখ ঢেকে বলল, ‘কেন? কেন এতবড় অপরাধ আপনি করেছিলেন?’

‘ভারতীকে ভালোবাসাটা তুমি অপরাধ বলছ স্বর্ণ? প্রীতি কি অপরাধী?’

অস্পষ্ট গলায় স্বর্ণ বলল, ‘আর আমার মা? তিনি কি দোষ করেছিলেন?’

‘কোনও দোষ করেনি। করেনি বলেই তো আমি তার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছি, এমনকী তার ছেলেকে মানুষ করারও। তুমি মানুষ হয়ে গেছও। ব্যস, মাই ডিউটি ইজ ওভার।’

স্বর্ণ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, ‘আমি আপনার আর একটা কথাও বিশ্বাস করি না, একটা কথাও না। আপনি শুধু তার ছেলেকে নিয়ে আসেননি, তাকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করেছেন।’

বাসুদেব নিজের মনেই হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমিও করি না। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না আর। দীর্ঘ কষ্ট, দীর্ঘ অপমানের পর সুখের জন্য লালায়িত যে জীবনে আমি ঝাঁপ দিয়েছিলাম তার দিকে ফিরে তাকালে নিজের প্রতি মাঝেমধ্যে তীব্র ঘৃণা হয়।’

স্বর্ণ তার লাল চোখদুটো তুলে বলল, ‘উইল ইউ প্লিজ স্টপ অ্যান্ড লিভ মি অ্যালোন?’

বাসুদেব চৌধুরি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, আমি চলে যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি বলতেই তোমার কাছে এত রাতে এলাম স্বর্ণ। দুলাল হয়তো তোমাকে সবকিছুই বলেছে, শুধু এটুকু বলতে পারেনি, আজও আমি আমার কোম্পানির নাম থেকে কেন কনকের নামটা মুছে দিইনি। ইচ্ছে করলেই তো পারতাম। কনককে শুধু মুছে দিতে চাইনি বলে নয়, কোম্পানির একটা বড় শেয়ার আজও তার নামে জমা পড়ে। তার ইচ্ছেমতো সে খরচও করতে পারে। ভারতীর নামে আমি আলাদা প্রজেক্ট করে দিচ্ছি। তুমি যদি মনে করো, তুমি তোমার মায়ের গোটা ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নেবে, নিতে পারো, অনেক কমপিটেন্ট লোক সেখানে আছে। দায়িত্ব নেওয়া তোমার পক্ষে খুব কঠিন হবে না। আর যদি মনে করো সব বিক্রি করে কনককে নিয়ে কোথাও চলে যাবে, তাও পারো। আশাকরি, যা করবে কনকের সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করবে। কাগজপত্র আমি সব তৈরি করে রেখেছি।’

স্বর্ণ চমকে উঠল। বলল, ‘আপনি এসব কী বলছেন!’

এ কথার জবাব না দিয়ে নিজের মতোই বলে চললেন বাসুদেব।

‘আর একটা দায়িত্ব তোমার নিতে হবে স্বর্ণ। ভারতীর চিকিৎসার দায়িত্ব। ডাক্তার আমাকে জানিয়েছে, সে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠছে। আর একটু কেয়ার পেলে হয়তো আরও ভালো হবে। বড় কোনও ক্লিনিকে এখন তাকে রাখা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা আমি আগেই করতে চেয়েছিলাম। দেশে বিদেশে মেন্টাল ক্লিনিকের কোনও অভাব নেই। ভারতীর কারণেই করতে পারিনি। বাড়াবাড়ির সময় সে যে ধরনের আচরণ করত, পরে সেন্সে ফিরলে লজ্জায় কুঁকড়ে থাকত। সেই অর্থে ভারতী এখন তোমার রক্তের কেউ নয়, সন্তান সাজিয়ে তোমাকে তার সামনে এনে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মায়ের ভূমিকা সে পালন করতে পারেনি। অসুস্থতার কারণেই পারেনি। আমার ভুলে সে যেন কষ্ট না পায়।’

‘বাবা, তুমি চুপ করো।’

স্বর্ণ এগিয়ে এসে বাসুদেব চৌধুরির হাত চেপে ধরে। পরম আনন্দে বাসুদেব চোখ বোজেন। আ:, কতবছর পরে স্বর্ণ তাকে স্পর্শ করল। ‘বাবা’ বলে ডাকল কতদিন পর।

‘এবার আমি চুপ করব। এবার আমার চুপ করার সময় হয়েছে। ক’দিনের জন্য আমি একটু বাইরে যাচ্ছি স্বর্ণ। কালই মর্নিং ফ্লাইটে যাব। অফিসের কয়েকজনকে নিয়ে যাব ঠিক ছিল, একটু আগে তাদের না বলে দিয়েছি, আমি একাই যাব। ওরা এখন এখানে থাকুক, তোমার প্রয়োজন হতে পারে।’

বাসুদেব চৌধুরির কথা বুঝতে পারছে না স্বর্ণ। মানুষটাকে সে চিনতেই পারছে না! এ যেন আর একটা মানুষ, অন্য মানুষ!

‘আর ও হ্যাঁ রাধা, রাধা মেয়েটি ভারতীর জন্য খুবই হেল্পফুল। কিন্তু আমি চাই না সে আর থাকুক। বদ্যিনাথকে বলে দিয়েছি, কাল সকালেই সে যেন তার টাকাপয়সা বুঝিয়ে দেয়। বাইরের যে মানুষ ভেতরের কথা আড়িপেতে শোনে সে যতই হেল্পফুল হোক, তার ভেতরে না থাকাই ভালো। কাল সকাল থেকেই পেশেন্টের ওষুধপত্রের দায়িত্ব নতুন কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। ব্যস, আর কী? উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক মাই বয়। বারো তারিখ পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না, ইউ অ্যাভয়েড দুলাল। লোকটা সুবিধের নয়, লোভী এবং ক্রিমিনাল। তার নজর কনকের টাকার দিকে; আমি কনকের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরও সেই টাকা আগলে রেখেছি। এবার তোমাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। তুমি নিজেই চলে যাও স্বর্ণ। ড্রাইভারকে আমার বলা আছে। সে রাস্তা চেনে।’

বিস্মিত স্বর্ণ ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কি ওখানে যাও বাবা?’

বাসুদেব চৌধুরি জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন।

‘তুমি কি আমার সঙ্গে আর একবার যাবে?’

বাসুদেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘না, এবার তুমি যাবে। শুধু তাকে বলবে…থাক কিছু বলতে হবে না।’

বাসুদেব চৌধুরি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে স্বর্ণ দ্রুত পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

‘আমারও একটা কথা আছে।’

বাসুদেব চৌধুরি ছেলের পিঠ ছুঁয়ে বললেন, ‘কী কথা? আমাকে শূন্য খাম পাঠানোর কথা?’

‘একটা সময় তোমার ওপর খুব রাগ হত। ইচ্ছে করত সেই রাগ, অভিমান, কষ্টের কথা চিঠি লিখে জানাই। বোর্ডিং-এ লুকিয়ে বসে পাতার পর পাতা লিখেও ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। বড় হলাম কিন্তু ছেলেমানুষি থেকে বেরোতে পারলাম না। অথবা কে জানে হয়তো ছেলেমানুষি নয়, আসলে, বেরোতে পারলাম না সেই রাগ, সেই অভিমান থেকে। শূন্য খামই পাঠিয়েছি দিনের পর দিন।’

বাসুদেব চৌধুরি সৌম্য সুন্দর হেসে বললেন, ‘কে বলেছে শূন্য? আগে বুঝিনি, আজ যখন জানতে পারলাম ওগুলো তুই পাঠাস, তখন বুঝলাম, ওগুলো শূন্য নয়। ওতে চিঠি আছে। সেই চিঠি আমি পড়তে পেরেছি।’

‘সরি বাবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’

বাসুদেব উজ্জ্বল চোখে বললেন, ‘আসলে কী জানিস স্বর্ণ কোনও কোনও জীবন হয়তো তোর ওই খামের মতোই। লম্বা পথ পার হয়ে যখন হাতে আসে তখন খুলে দেখা যায়, কিছুই নেই। সব শূন্য? সেটাই তার কথা। কেউ পড়তে পারে, কারও পড়তে সময় লাগে। আমার সময় লেগেছে। চিয়ার আপ মাই বয়, চিয়ার আপ।’

‘বাবা, আমি এমন কেন?’

বাসুদেব পরম স্নেহে ছেলের কাঁধে আবার হাত রাখলেন। বললেন, ‘কারণ তুমি একজন চমৎকার মানুষ বলে।’

মসৃণ হাইওয়ে ধরে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটছে। বেলা বেশি হলেও রোদ ভালো করে ফোটেনি। আকাশে কুয়াশার মতো মেঘের আস্তরণ। এক ধরনের বিষণ্ণ আলোয় চারপাশ থম মেরে আছে। বৃষ্টি কি হবে?

নিজের কোলের ওপর হাত রেখে স্থির হয়ে বসে আছে স্বর্ণ। তার ঠোঁটদুটো অল্প-অল্প কাঁপছে।

খানিক আগেই তার মোবাইলে খবর এসেছে, মুম্বইয়ের পাঁচতারা হোটেলে ঘরের দরজা ভেঙে এক ভদ্রলোকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে আজ ভোরে। মৃতদেহের পাশে ছিল গাদাখানেক ঘুমের ওষুধের ছেঁড়া মোড়ক। হোটেল রেজিস্টার বলছে, ভদ্রলোকের নাম বাসুদেব চৌধুরি। বয়স ষাট। বাড়ি কলকাতা। মুম্বই নেমেছেন কাল সন্ধের ফ্লাইটে। আন্দাজ করা হচ্ছে, রাতের কোনও একটা সময় তিনি ঘুমের ট্যাবলেটগুলো খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃতদেহের পাশে একটা সাদা লম্বা খাম পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ সেই খাম খুলেছে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেছে, সেই খামের ভেতরে কিছু নেই। খামটি শূন্য।

স্বর্ণ ফিসফিস করে গাড়ির চালককে বলল, ‘বলাইবাবু, আপনি গাড়িটা কি একটু দাঁড় করাবেন?’

দু-দিকে চলে যাওয়া দীর্ঘ রাস্তার একপাশে থেমে থাকা গাড়িতে বসে আছে স্বর্ণ। শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদছে সে।

বলাই দরজা খুলে নেমে গেছে। কোনও কোনও কান্না মানুষকে একা কাঁদতে হয়।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *