এক
খামটা হাতে নিয়ে থমকে গেলেন বাসুদেব চৌধুরী।
এবার খামের রং আগেরগুলোর মতো নয়। যতদূর মনে পড়ছে আগের খামগুলো ছিল সাদা আর লম্বা ধরনের। চিঠি লেখার সাধারণ খাম যেমন হয়। এই খামও লম্বা তবে ব্রাউন পেপারের। রং আলাদা হলেও, ওপরে ঠিকানা লেখার ধরন একই। কম্পিউটারে টাইপ করা কাগজের টুকরো সাঁটা। ঠিকানা লেখার একই কায়দা দেখেই বাসুদেব থমকে গেছেন। বাকিসব চিঠিপত্র, কাগজ সরিয়ে তিনি খামের মুখ ছেঁড়েন দ্রুত হাতে।
এবারও একই ব্যাপার! ভেতরে কিছু নেই। আবার কেউ তাকে শূন্য খাম পাঠিয়েছে।
টাইয়ের ফাঁস আলগা করতে-করতে বাসুদেব সোফায় হেলান দিলেন। এটা কী ধরনের রসিকতা? দীর্ঘদিন ধরে এই রসিকতা চলছে। কখনও মাসে একবার, কখনও তিন-চার মাস অন্তর হঠাৎ করে একটা। কে এই রসিকতা করে? এ-মাসে দুবার এল।
এ-বাড়ির চিঠিপত্র পোস্টাপিসের পিওন বা ক্যুরিয়ার সার্ভিসের লোক গেটে সিকিউরিটির হাতে দিয়ে যায়। সিকিউরিটির খুপরি ঘরে সেগুলো জমা থাকে। দিনের শেষে ভেতরে আসে। বাসুদেব অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন। সব চিঠি যে খুলে পড়েন এমন নয়। প্রয়োজন হলে খোলেন, নইলে এক ঝলক দেখে সরিয়ে রাখেন। পরদিন অফিসে গিয়ে মালবিকাকে দেন। মালবিকা ‘কনক গার্মেন্টস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’-র ম্যানেজিং ডিরেক্টরের অফিস সেক্রেটারি। বসের যাবতীয় টেলিফোন, চিঠিপত্র, ই-মেল, ঝাড়াইবাছাইয়ের দায়িত্ব তার। বাড়িতে আসা বেশিরভাগই চিঠিপত্রই ফেলা যায়। অপ্রয়োজনীয় বলেই ফেলা যায়।
বাসুদেব চৌধুরির আত্মীয়স্বজনের ঝামেলা মিটে গেছে অল্প বয়েসেই। বাবা মারা যাওয়ার পর, কলকাতায় এসে মাকে নিয়ে মাথা গোঁজার জন্য যখন কিশোর বাসুদেব হন্যে হয়ে ঘুরেছে, সকলেই মুখের ওপর দরজা আটকে দিয়েছিল। দেওয়ারই কথা। এক দরিদ্র বিধবা আর তার সদ্য স্কুল পার হওয়া ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় চাইলেই তো ‘এসো, বসো’ করে আপ্যায়ন করা যায় না। তার ওপর কানাঘুষো ছিল এই পরিবারে ‘ব্ল্যাকস্পট’ আছে। স্পটটি খোদ বাসুদেব চৌধুরির বাবা মৃণাল চৌধুরির। শোনা যায়, তিনি তাঁর সামান্য উপার্জনের বেশিটাই নানাবিধ ফুর্তিতে ব্যয় করেছেন। সেই ফুর্তির তালিকায় নেশা ভাং থেকে শুরু করে বে-পাড়ায় যাতায়াত সবই ছিল। এই অবস্থায় তার স্ত্রী এবং নাবালক পুত্রকে করুণা দেখানোর প্রশ্ন ওঠে না। মানুষ মারা যায়, কিন্তু তার ‘কালো দাগ’ সন্তানকে দিয়ে যায়। এই ঝুঁকি কে নেবে? তারপর থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি বাসুদেব। দীর্ঘ দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অপমানিত জীবন পার করার পর যখন প্রতিষ্ঠিত হলেন, তখন মাঝেমধ্যে ‘মামা’, ‘মাসি’ ‘পিসি’ বলে অনেকেই হাজির হয়। মেয়ের বিয়ের খরচ, ছেলের চাকরি, স্বামীর চিকিৎসায় সাহায্য চাই। বাসুদেব তাদের কাছে আসতে দেননি, তবে বঞ্চিতও করেননি। দূর থেকে যেটুকু পেরেছেন টাকাপয়সা ছুড়ে দিয়েছেন। সুতরাং আত্মীয়রা যে চিঠি লিখবে সে সম্ভাবনা কম। যা আসে বেশিরভাগই হাবিজাবি। কখনও এটা সেটা প্রাোডাক্টের বিজ্ঞাপন, কখন বিভিন্ন কোম্পানির বুলেটিন, চাকরির আবেদন কয়েকটা। গুরুত্ব দেওয়ার মতো খুব কিছু নয়।
প্রথম ফাঁকা খাম আসার তারিখটা মনে নেই, তবে ঘটনাটা বাসুদেব চৌধুরির মনে আছে।
চিঠির তাড়া ঘাঁটতে-ঘাঁটতে হঠাৎই লম্বা সাদা খামটা চোখে পড়ে। স্ট্যাম্প লাগানো, ডাকে আসা নির্দোষ খাম। ওপরে গোটা-গোটা টাইপ-হরফে নাম, ঠিকানা লেখা। একইরকম অবহেলায় বাসুদেব খামের মুখ ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ভেতরের চিঠি টেনে বের করতে গিয়ে থমকে যান। চিঠি কোথায়? নেই। বাসুদেব অবাক হলেন। খামটা তুলে ভেতরে নজর করেন। অনেক সময় বড় খামে ছোটখাটো চিরকুট কোণে পড়ে থাকে। এক্ষেত্রে সেরকমও কিছু হয়নি তো? এবার খামের ওপরের অংশটা বড় করে ছিঁড়ে ফেললেন বাসুদেব। না, কোথাও কিছু নেই!
বাসুদেব নিজের মনেই সেদিন হেসেছিলেন। পত্রলেখক সম্ভবত তাড়াহুড়োয় চিঠিটাই ভরতে ভুলে গেছে। দ্রুত বিষয়টা ভুলে গেলেন বাসুদেব।
পরের মাসের গোড়ার দিকে একই ঘটনা ঘটল।
সেদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে চিঠিপত্র দেখেছিলেন বাসুদেব। খেতে খেতেই বাঁ হাতে চিঠিগুলো সরিয়ে সরিয়ে রাখছিলেন। সাদা লম্বাটে খাম আর টাইপ করা নাম ঠিকানা লেখা দেখে চেনা চেনা ঠেকল। তখনকার মতো খামটা আলাদা করে রাখলেন। পরে খাওয়া সেরে খাম খুলে অবাক হলেন। আবার শূন্য খাম! এবার খামের ওপর পোস্টাপিসের লাগানো ছাপ খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করেন বাসুদেব। পোস্টাপিসের ছাপে কালি আবছা। শুধু ইংরেজিতে লেখা ‘কলকাতা’টুকু পড়া যাচ্ছে. ‘কনক গার্মেন্টস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবার একটু অস্বস্তি বোধ করেন। পরপর দুবার চিঠি ভরতে ভুল। কেউ রসিকতা করছে না তো? কিন্তু ফাঁকা খাম পাঠিয়ে এ কেমন রসিকতা? হতেও পারে। রসিকতার ব্যাপারে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা অসাধারণ।
সেদিন রাতে শোওয়ার পরও শূন্য খাম কিছুক্ষণের জন্য মাথার ভেতর ঘুরল বাসুদেবের। তবে সে খুবই অল্প সময়। পরদিন আর কিছু মনে রইল না।
শূন্য খাম আসা বন্ধ হয়নি, তবে ধীরে-ধীরে বিষয়টা খানিকটা গা-সওয়ার মতো হয়ে গেছে। বাসুদেব অবজ্ঞা করেন। কেউ যদি চিঠিহীন খাম পাঠিয়ে মজা পায়, পাক। অসুবিধে কোথায়?
আজ কেন যেন খানিকটা বিরক্ত হলেন বাসুদেব। খাম হাতে ধরেই বদ্যিনাথকে ডাকলেন তিনি। বুড়ো বদ্যিনাথ এ-বাড়ির কেয়ারটেকার। বাইরের একমাত্র পুরুষমানুষ যাকে চব্বিশ ঘণ্টা এ-বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তার জন্য বাড়ির পিছনে, বাগানের একপাশে আলাদা ঘর রয়েছে। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও সে বাসুদেব চৌধুরির টুকটাক ফাইফরমাস খাটে, অনেকটা সাংসারিক ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করে। লোকটাকে দেখলে মনে হয় হাবাগোবা প্রকৃতির। তবে যতটা মনে হয়, ততখানি নয়, কিছুটা ভানও আছে। বদ্যিনাথ জানে, এই ‘পাগলবাড়ি’-তে চাকরি টিকিয়ে রাখার এটাই আসল চাবিকাঠি। এখানে কাজ করতে হলে খানিকটা বোকাসোকা হয়ে থাকতে হবে। অতিরিক্ত উৎসাহ বা কৌতূহল বাসুদেব চৌধুরি বরদাস্ত করেন না। কেন করেন না? তার খানিকটা বদ্যিনাথ, বোঝে, খানিকটা বোঝে না। বোঝার জন্য যে তার আগ্রহ নেই এমন নয়, তবে সেই আগ্রহ বাকি কাজের লোকদের মতো সে-ও গোপন রাখে। অনেক হিসেবনিকেশ করে বদ্যিনাথ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে থাকাটাই নিরাপদ বলে সাব্যস্ত করেছে। তাতে কাজও দিয়েছে। চাকরি বহুদিন টিকে গেল।
বাসুদেব বললেন, ‘বদ্যিনাথ, এই চিঠিগুলো আজ এসেছে?’
‘হ্যাঁ বড়বাবু।’
‘কখন এসেছে?’
বদ্যিনাথ অবাক হল। চিঠি কখন এসেছে কথাটার অর্থ কী! সে মাথা চুলকে বলল, ‘সারাদিন ধরেই এসেছে। সন্ধের সময় গেট থেকে নিয়ে এলাম।’
বাসুদেব বুঝলেন, প্রশ্নটা ঠিক হয়নি। সত্যি তো, চিঠি তো সারাদিন ধরেই আসবে। কোনটা কখন এসেছে, কোনটা সাধারণ ডাক, কোনটা রেজিস্টারড, কোনটা ক্যুরিয়র দিয়ে গেছে এসব হিসেব বাড়িতে থাকে না। অফিসে কি মালবিকা নোট রাখে? কে জানে হয়তো রাখে। তবে এই ধরনের খাম কখনও অফিসে আসেনি। এলে কি মালবিকা তাকে বলত না?
‘বড়বাবু কাল থেকে কি আমি টাইম লিখে রাখতে বলব?’
বাসুদেব সতর্ক হলেন। চিঠি নিয়ে কোনও গোলমাল হয়েছে এটা প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। তিনি হাত নেড়ে বললেন, ‘না না, তার প্রয়োজন নেই। বদ্যিনাথ, তোমাদের বড়মা কেমন আছেন?’
বদ্যিনাথ খুশি-খুশি গলায় বলল, ‘ভালো আছেন বড়বাবু, ক’দিন শান্ত আছেন।’
বাসুদেব বললেন, ‘রাধা কোথায়?’
‘বাড়ি গেছে।’
বাসুদেব বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কেন? বাড়ি গেছে কেন?’
‘বলল, অনেকদিন বাড়ি যাই না, ক’টাদিন বড়মা তো ভালো আছেন, একদিন ঘুরে আসি।’
বাসুদেব ভুরু কুঁচকে বললেন,’এটা ঠিক করেনি; বাড়ি ঘুরে আসতে হলে দিনের বেলা ঘুরে আসবে। ভারতীর রাতে যদি সমস্যা হয়।’
‘চারুর মাকে বলেছি, সে আজ থাকবে, বড়মার ঘরের বাইরে শোবে।’
বাসুদেব আরও বিরক্ত হলেন। উঠতে-উঠতে বললেন, ‘চারুর মাকে দিয়ে কি হবে? ভারতী দুদিন শান্ত আছে, খারাপ হতে কতক্ষণ? একজন রাঁধুনির পক্ষে কি এই পেশেন্টকে সামলানো সম্ভব? স্বর্ণ ফিরেছে?’
খুশি ভাব দ্রুত মুখ থেকে মুছে ফেলে বদ্যিনাথ অপরাধী গলায় বলল, ‘জানি না, দেখে আসব?’
বাসুদেব অস্ফুটে বললেন, ‘থাক, তুমি এখন যাও। গিজারটা অন করে দিও, আর অফিসের ব্যাগটা এদিকে দিয়ে যাও।’
‘গিজার চালিয়ে দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে তুমি যাও।’
বদ্যিনাথ চলে গেলে, ফাঁকা খামটা অ্যাটাচিতে ভরলেন বাসুদেব। স্নান করতে করতে বুঝলেন মনটা খচখচ করছে। একটা মোটা দাগের রসিকতার জন্য এতদিন পরে মন কেন খচখচ করবে? এই ঘটনা তো আজ ঘটছে না, অনেকদিন ধরেই ঘটছে। প্রতিদিনের মতো নতুন সাবানের মোড়ক ছিঁড়তে-ছিঁড়তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মাথা থেকে ঘটনাটা ঝেড়ে ফেলে দেবেন। ফেলেও দিলেন। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে রইলেন দীর্ঘক্ষণ। এই শাওয়ারে জল শুধু মাথায় পড়ে না। চারিদিকে গোল একটা জলের বলয় তৈরি করে। সারাদিনের ক্লান্তির পর এই বলয়ের মধ্যে ঢুকলে বেরোতে ইচ্ছে করে না। একটা সময় গেছে, যখন স্নানের জন্য রাস্তার টাইম-কলই ভরসা ছিল। বালতি নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হত। মাথায় দু-মগ জল ঢেলে বালতি ভরে এক চিলতে ঘরে জল তুলে নিয়ে যেতে হত মায়ের জন্য। মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার সেই অন্ধকার এক কামরার বাড়িতে বাথরুম বলতে উঠোনে তখন একদিকে টিন দিয়ে ঘেরা এক ফালি জায়গা ছিল। নরম তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে-মুছতে বাসুদেব বাথরুমের বাইরে এলেন। দাঁড়ালেন প্রশস্ত আয়নার মুখোমুখি। নিজের দীর্ঘ, মেদহীন, শক্ত, সমর্থ শরীরের দিকে তাকিয়ে মনে-মনে সামান্য হাসলেন। কে বলবে বয়স ষাট পেরিয়েছে? কপালে দু-একটা রেখা, গালের চামড়া কুঁচকেছে সামান্য। খুঁটিয়ে না দেখলে চোখে পড়ে না। ভয়ংকর জীবনযুদ্ধের ছাপ শরীরে আজও পড়েনি।
নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের খচখচানিটা ফিরে এল বাসুদেবের। শূন্য খামের খচখচানি। চলল অনেক রাত পর্যন্ত।
পরদিন অফিসে পৌঁছেই বিকাশকে ঘরে ডেকে নিলেন বাসুদেব। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের এই ছেলেটিকে তিনি একইসঙ্গে পছন্দ এবং ভরসা করেন। নানা ধরনের যোগাযোগ আছে বিকাশের। মূলত কোম্পানির পলিটিক্যাল কানেকশনের দিকটা দেখভাল করে। ব্যাবসার কারণে নেতা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে ছোটখাটো মস্তান গুন্ডা সামলানোর দায়িত্ব তার। কোথায় কাকে কত ঘুষ, কমিশন, চাঁদা দিয়ে কাজ বাগিয়ে আনতে হবে, সে বুঝে নেয়। ফ্যাক্টরির ইউনিয়ন সমস্যা সামলায়। ট্রান্সপোর্ট বিভাগের অনেক ঝুট-ঝামেলাও তার ঘাড়ে আছে। অনেকটা ‘অড জবস’-এর মতো। এই কাজ করতে হলে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সম্পর্কে খবরাখবর রাখতে হয়। কোন নেতার কোন মেয়েমানুষের কাছে যাতায়াত, কোন সরকারি অফিসার কোন ব্র্যান্ডের মদ পছন্দ করে, কোন কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার মেয়ের বিয়ের টাকা তুলছে—এইসব খবর। এর জন্য বিকাশ অফিসের বাইরে একটা ‘গোপন টিম’ পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে। সেই ‘টিম’-এর কাজ খবর সংগ্রহ। সেই অনুযায়ী অপারেশনে নামে বিকাশ। বাসুদেব যখন বিকাশের এই ‘টিম’ এর খবর জানতে পারলেন মুগ্ধ হলেন ছেলেটার ওপর ভরসা বাড়ল। গত এক বছর ধরে তিনি বিকাশের ‘টিম’কে অফিসের ভেতরের কাজেও ব্যবহার করছেন। ‘কনক গার্মেন্টস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’-র কর্মচারীদের সম্পর্কে ফাইল তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে প্রেম থেকে শুরু করে, দুর্নীতি, সমাজসেবা, শনিবার করে সোনাগাছি সবই থাকছে। বাসুদেব চৌধুরি বিশ্বাস করেন, ব্যাবসার নিরাপত্তা ঠিক রাখতে হলে শুধু বাইরের দিকে নজর রাখলেই চলে না। ভেতরটাও জানতে হয়। তিনি বিকাশের জন্য ভালো টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেই টাকার জন্য বিকাশকে ভাউচারেও সই করতে হয় না।
বসের মুখে ফাঁকা খামের কথা শুনে বিকাশ বিস্মিত হল।
‘কতদিন ধরে এই ঘটনা চলছে স্যার?’
বাসুদেব বললেন, ‘বছর দুই-তিন তো হবেই। একটু বেশিও হতে পারে। ঠিক হিসেব রাখিনি। আগে গা করিনি; এখনও যে করছি এমন নয়, আমি জানি জিনিসটা সস্তা ধরনের একটা রসিকতা। তবু তোমাকে ঘটনাটা জানালাম।’
‘ঠিক করেছেন স্যার। এত দিন ইগনোর করাটাও ঠিক নয়। মে বি সামথিং সিরিয়াস।’
বাসুদেব একটু হেসে বললেন, ‘আমার অতটা কিছু মনে হয় না, তবে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। দেখো যদি সেই অস্বস্তিটা কাটাতে পারো।’
‘খামগুলো কি আপনার কাছে আছে?’
বাসুদেব হেসে বললেন, ‘খেপেছ?’
‘ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়ে রাখলে কেমন হয় স্যার?’
বাসুদেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘পুলিশ হাসবে। একটা ফাঁকা খামের জন্য থানা পুলিশ করে লোক জানাজানির মানে হয় না। বিষয়টা কেউ জানতে পারুক এটা আমি চাই না বিকাশ। পারলে অন্যভাবে ভাব।’
বিকাশ চিন্তিত মুখে বলল, ‘অফিসের কেউ ইনভলভ থাকলে হয়তো ধরতে পারব, কিন্তু বাইরের কেউ হলে তো পুলিশ ছাড়া উপায় নেই। বড় কথা হল, মোটিভটা বুঝতে পারছি না। ইচ্ছে করেই পোস্টাপিসের থ্রু দিয়ে পাঠাচ্ছে। রেজিস্ট্রি বা ক্যুরিয়রে দিলে সেন্ডারের নাম ঠিকানা লাগে।’
বাসুদেব বললেন, ‘তুমি কি এটাকে থ্রেট ধরনের কিছু মনে করছ? হুমকি?’
‘হতেও পারে। হয়তো নেক্সট কোনও চিঠিতে ক্লিয়ার হবে। চিঠি না হয়ে অন্যকিছুও হতে পারে। হয়তো ফোন, হয়তো ই-মেল। আগে একটা বেস তৈরি করতে চাইছে।’
বাসুদেব আবার মুচকি হেসে বললেন, ‘এটা কি বেশিদূর ভাবা হয়ে যাচ্ছে না বিকাশ? হুমকি দেওয়ার জন্য শূন্য খাম! একটা ছেলেমানুষি?’
‘আজকাল কিডন্যাপ, এক্সটরশন জাতীয় ক্রাইমে ছেলেমানুষরাই বেশি ইনভলভড স্যার। নিউজপেপারে দেখছেন না, স্কুল-কলেজের ছেলেরা কেমন ধরা পড়ছে? অল টিনএজারস।’
‘এতটা সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু বলে আমার মনে হয় না। তবে বিষয়টা আর আমি একেবারে উড়িয়েও দিতে চাইছি না। যতই ছোট হোক অস্বস্তিটা দূর হওয়া প্রয়োজন। যাই হোক তোমাকে বলে রাখলাম, দেখো যদি কিছু করতে পারো।’
বিকাশ বলল, ‘খামটা কি আমি রাখতে পারি?’
বাসুদেব খাম এগিয়ে বললেন, ‘ঘটনাটা তোমার মাথায় থাকল, নাউ ইটস ইওর প্রবলেম।’
বিকাশ পিঠ সোজা করে বলল, ‘অফ কোর্স স্যার ইটস মাই ডিউটি।’ একটু থেমে বিকাশ নীচু গলায় বললে, ‘কপিল ডিউটি ঠিকমতো করছে তো স্যার?’
বাসুদেব টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রের দিকে নজর করতে-করতে বলছে, ‘হ্যাঁ, করছে। তবে ভাবছি, ওকে এবার ডিসকন্টিনিউ করব।’
‘এখন নয় স্যার।’
বাসুদেব মুখ তুলে বললেন, ‘কেন? এখন নয় কেন? ওই খামের জন্য? একটা ফাঁকা খামের জন্য তুমি আমাকে বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করতে বলছ?’
‘থাকুক না স্যার, এতদিন যখন আছে আর ক’টাদিন থাকলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া সময়টা ভালো নয়। দেখছেন তো এক্সট্রিমিস্ট প্রবলেম কোথায় পৌঁছেছে। ওদেরও তো টাকাপয়সা লাগবে। একটু বড় বিজনেসম্যান দেখলেই…।’
বাসুদেব চৌধুরি চাপা গলায় বললেন, ‘ভয় দেখাচ্ছ নাকি?’
বিকাশ সামান্য হেসে বলল, ‘যদি তাই মানে করেন তা হলে তাই স্যার। যখন দায়িত্ব দিয়েছেন তখন সবটাই আমার বিষয়। ভয় দেখানো এবং আলটিমেটলি সেই ভয় তাড়ানোটাই আমার কাজ হবে। কপিল এতদিনে আপনাকে অনেকটা বুঝেও গেছে। এ ধরনের কাজে এইটা একটা জরুরি বিষয়, যাকে পাহারা দিতে হয়, তাকে বুঝতে হয় কাকে সে পাহারা দিচ্ছে।’
বাসুদেব খুশি হলেন। এই কারণেই বিকাশের ওপর তিনি ভরসা করেন। দু-বছর আগে কপিলকে বিকাশই জোগাড় করে দিয়েছিল। সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে বেছেবুছে এনেছিল। মজ:ফরপুরের ছেলে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। বেঁটেখাটো আর গাঁট্টাগোট্টা চেহারার জন্য দেখে যদিও আরও বেশি মনে হয়। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। বন্দুকের লাইসেন্স আছে। তবে সঙ্গে বন্দুক রাখে না, সম্ভবত রিভলভার জাতীয় কিছু আছে। বাসুদেব কখনও জানতে চাননি। সেবার কলকাতায় পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিল। ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়। অবাঙালি একজনকে মেরেও গেল। লোকটা বড় ধরনের কিছু শিল্পপতি ছিল না। ময়দানে মর্নিংওয়াক করছিল। মোটরবাইকে মাত্র দুটো ছেলে এসেছিল। গুলিরও আওয়াজ নাকি ভালো করে শোনা যায়নি। কাগজে ক’দিন খুব লেখালিখি হয়েছিল। তারপরই কপিলকে রাখা হয়। বাসুদেব যতক্ষণ বাইরে থাকেন, এই লোকও সঙ্গে থাকে।
কপিল বাড়িতে চলে আসে ভোরের আলো ফোটার সময়। বাসুদেব চৌধুরির মর্নিংওয়াক থেকে ডিউটি ধরে, ফেরে রাতে সাহেব বাড়ি ঢুকে গেলে। বাড়ির ভেতরে তার কোনও দায়িত্ব নেই। সেখানে তার প্রবেশ নিষেধ।
বাসুদেব মাথা নামিয়ে অফিসের কাজে মন দিতে দিতে বললেন, ‘ঠিক আছে বিকাশ, তোমার কথাই শুনলাম। কপিল আপাতত রইল। তুমি খাম রহস্য সমাধান করতে পারো কিনা দ্যাখো।’
বিকাশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কু স্যার।’
বাসুদেব চুপ করে রইলেন। তিনি এটাই চাইছিলেন। কপিলকে তিনি ছাড়তে চান না। ভয়ে নয়, ছাড়তে না চাওয়ার পিছনে আরও কারণ আছে। সেই কারণ অন্য কেউ বুঝবে না। এই ক’দিনে ‘কপিল’ একটা অভ্যেসের মতো হয়ে গেছে। খানিকটা নেশার মতোও। মানুষের কাছে দেহরক্ষী বিষয়টা যে এরকম ভাবেও আসতে পারে বাসুদেবের ধারণা ছিল না। কোনও কোনও সময় মানুষটাকে নিজের ছায়ার মতো মনে হয়। বুঝতে দেয় না, জানতে দেয় না তবু আছে। অস্তিত্বহীন উপস্থিতি। চুপিসাড়ে সঙ্গে চলেছে। বাড়িতে বা অফিসে আজকাল কখনও কখনও বাসুদেব চৌধুরির মনে হয় পিছনে কপিল রয়েছে। ভুল বুঝে মজা পান। গোড়াতে লোকটার সঙ্গে টুকটাক কথা বলতেন। একতরফা কথা। আজকাল নানা ধরনের হাবিজাবি বকরবকর করেন। রোজ করেন না, মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে করেন। ভাবলেশহীন চাহনিতে লোকটা ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ,’ ‘জি সাব’, ‘আচ্ছা সাব’, ছাড়া উত্তর জানে না। কথার মাঝখানে হঠাৎ চুপ করে গেলেও ক্ষতি নেই। ভুলেও জানতে চায় না, ‘তারপর কী হল।’ নিজের দৃষ্টির মতোই আগ্রহহীন, আবেগহীন, নির্বিকার মানুষ একজন। বাসুদেবের মনে হয়, যাকে সারাদিন অন্যের সঙ্গে প্রতিটা কথা ভেবেচিন্তে, হিসেব করে বলতে হয়, ইচ্ছেমতো কথা বলার মতো যার কেউ নেই, তার জন্য এমন একজন ‘ছায়া-মানুষ’ খুব জরুরি ছিল যেন। কিছু সময়টা অন্তত মন খুলে যা খুশি বলা যায়। বাসুদেবের বিশ্বাস কপিল তার বেশিরভাগ কথাই বুঝতে পারে না। দেওয়ালের মতো, কনফেশান বক্সের মতো শুধু শুনেই যায়।
এ-কথা কাউকে বলা যায় না। বিকাশকেও নয়।
দুই
একটা পাখি ডাকছে। টি টি টি…। বিরামহীন, বিচ্ছেদহীনভাবে একটানা ডেকে চলেছে।
পাখিটা কোথায় ডাকছে? দূরে কোথাও? নাকি কাছে? একবার মনে হচ্ছে, ডাকটা আসছে দূর থেকে পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, না দূরে নয়, পাখি বসে আছে খুব কাছে, একেবারে মাথার ভেতরে। সেখান থেকে ডাকছে।
স্বর্ণ পাশ ফিরল। সত্যি কি পাখি ডাকছে? না কি স্বপ্ন?
ঘুম ভাঙার এই সময়টা এক সন্ধিক্ষণ। মানুষ অচেনা জগৎ ছেড়ে নিজের চেনা জগতে ফিরে আসে। চেতন আর অবচেতন এই সময়টা দুটো জগতেই চলাফেরা করে। সত্যি-মিথ্যের বোধ ঝাপসা হয়ে একটা বিভ্রমের মতো তৈরি হয়। মন খারাপ হয়, আবার ভালোও লাগে।
আজকাল ঘুম ভাঙার পর অনেকটা সময় স্বর্ণর মন ভার থাকে। মনে হয়, ঘুমের অচেনা জগৎটাই ভালো ছিল। না জাগলেই বেশ হত। ঘুম ভাঙার পরও অনেকটা সময় সে বিছানায় পড়ে থাকে। আজও থাকল।
স্বপ্ন নয়, পাখি সত্যি ডাকছে। বালিশ হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করে সময় দেখল স্বর্ণ। সাড়ে ছ’টা। অথচ আলো দেখে মনে হচ্ছে, ঠিকমতো ভোরই হয়নি। মাথার ভোঁতা যন্ত্রণাটা আজও শুরু হয়েছে। আজকাল এই এক সমস্যা। কোনও কোনওদিন ঘুম ভেঙে দেখে মাথা ধরে আছে। চোখের সমস্যা? না কি অন্য কিছু? দু-হাতে রগ টিপে স্বর্ণ খেয়াল করল, পায়ের কাছে খোলা জানলা দিয়ে আসা আলোতে জোর নেই। মলিন আলোতে পাখির ডাক ভেসে আসছে।
কলকাতার ভিড় থেকে সামান্য সরে ই এম বাইপাসের গায়ের লোকালয়ে এই আড়াইতলা বাংলোতে পাখির ডাক অবাক হওয়ার মতো কোনও ঘটনা নয়। উঁচু বাউন্ডারি দেওয়াল আর লোহার গেটের এপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান। ছোটবড় নানা ধরনের ফুল ফলের গাছ। একদিকে একটুকরো লনও রয়েছে। সেখানে নরম সবুজ ঘাস। দুজন মালি নিয়মিত বাগান পরিচর্যা করে। সপ্তাহে দুদিন করে আসে ফিরোজ। তার দায়িত্ব লন রক্ষণাবেক্ষণ। নিজেকে ‘গালিচা-বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচয় দেয়। অন্যজন নিতাই দেখে ফুলের বিষয়টা। সিজনাল ফুল। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার অঙ্ক কষে বীজ ছড়ায়, চারা বসায়। ফুল ফুটলে পোকা মারার ওষুধ দেয়, ডাল ছাঁটে। এই বাগানে পাখি ডাকবে, সেই পাখির ডাক শুনে ভালো লাগবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
স্বর্ণর ভালো লাগছে না। তার বিরক্ত লাগছে। যখনই বুঝতে পেরেছে পাখি এই বাগানের তখনই তার বিরক্তি শুরু হয়েছে। শুধু পাখির ডাক নয়, চব্বিশ বছরের এই যুবক এ বাড়ির যাবতীয় সৌন্দর্য, বৈভব, বিলাসিতার প্রতি উদাসীন এবং বিরক্ত। কোনও কিছুই সে স্পর্শ করতে চায় না। শুধু শরীর দিয়ে স্পর্শ নয়, দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণেও এদের সঙ্গে তার যেন কোনও যোগসূত্র নেই।
একতলায় স্বর্ণর এই ঘর একেবারে সাদামাঠা, বাহুল্যবর্জিত। দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, এই ঘর বাড়ির মালিক বাসুদেব চৌধুরির একমাত্র পুত্রের ঘর। যেটুকু না হলেই নয়, মাত্র সেটুকুই স্বর্ণ এ-ঘরে রাখবার অনুমতি দিয়েছে। ফার্নিচার বলতে নেড়া একটা খাট, একটা ওর্য়াডরোব। একপাশে টেবিল চেয়ার। সে-ও আধুনিক ডিজাইনের নয়। সাধারণ চেহারার। টেবিলের ওপর কম্পিউটার, প্রিন্টার। স্তূপীকৃত বইখাতা এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। বইগুলো বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটির পাঠ্য। দু-একটা গল্প-কবিতা, এক আধখানা রাজনীতি, ধর্ম বা বিজ্ঞান। ঘরের ফ্যাকাশে রং অনেকদিন তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। সব মিলিয়ে ঘরটাকে ঘরের বাসিন্দার মতোই বিষণ্ণ লাগে।
খাট থেকে নেমে স্বর্ণ বাথরুমে ঢুকল। বাথরুম ঘরের ভেতরেই। ফ্ল্যাট বাড়ির অ্যাটাচড বাথরুমের মতো, স্বল্পপরিসরের একফালি বাথরুম। অথচ একতলাতেই তার জন্য বড় বাথরুম রয়েছে। সেখানে এলাহি ব্যবস্থা। কালো মার্বেলের মেঝের সঙ্গে রং মিলিয়ে বাথটব, বেসিন, জলের কল। স্বর্ণ সেই বাথরুমে যায় না, নিজের ঘরেরটাতেই কাজ সারে। বাড়িতে যে সময়টুকু সে থাকে ঘর থেকে প্রায় বেরোয় না বললেই চলে। দু-তিনদিন একবার করে শুধু ওপরে ওঠে। ভারতী দেবীকে দেখতে যায়। যাওয়ার আগে বদ্যিনাথের কাছে খবর নেয়, ঘরে তালা দেওয়া কি না। তালা থাকলে ওঠে না। সে কখনও মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য তালা খুলতে বলে না।
বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল স্বর্ণ। ক’দিন দাড়ি কামানো হয়নি। দু-গালে হালকা দাড়ি। ভালো লাগছে না। রুক্ষ্ম, অসুস্থ মনে হচ্ছে। ভারতীদেবীর উজ্জ্বল ফরসা রং সে পায়নি। বাসুদেবের ময়লা রং-ই তার জুটেছে। শুধু রং নয়, ভারতী দেবীর সৌন্দর্যের অন্য কোনও ছাপও স্বর্ণর শরীরে নেই। না বড়-বড় মায়াভরা চোখ, না টিকালো নাক, না পানপাতার মতো চিবুক। কৈশোরে একটা সময় ছিল, যখন স্বর্ণ গোপনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। নিজের মুখের প্রতিবিম্বে ভারতী দেবীকে খুঁজত তন্নতন্ন করে। না পেয়ে কষ্টও পেত। কত ছেলেই তো মায়ের মতো দেখতে হয়। একইরকম চোখ, মুখ। একইরকম হাসি। সে কি কিছুই পেতে পারত না? রূপ সৌন্দর্য নয়, শরীরে পাগল মায়ের একটা চিহ্ন পেলেই সে যেন খুশি হত।
আজ সেই ছেলেমানুষি নেই, কিন্তু অভ্যেস একেবারে যায়নি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে কোনও-কোনওদিন এখনও নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে স্বর্ণ।
দাড়িটা কামালে হত। হাত দিলে খসখস করছে। থাক, কী হবে কামিয়ে? আবার সাবান ঘসতে হবে, রেজার চালাতে হবে। ক্লান্তিকর। যদিও দাড়ি দেখলে প্রীতি বিরক্ত হয়। বলে, ‘একেই সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকো, তার ওপরে দাঁড়িটাড়ি রেখে আরও যেন ঝিমিয়ে গেছ।’
স্বর্ণ উদাসীন গলায় বলে, ‘আমি ঝিমিয়ে থাকতেই পছন্দ করি প্রীতি।’
‘আমি বাসি না।’
‘আমার কিছু করার নেই প্রীতি। তুমি একটা কাজ করতে পারো আমার দিকে তাকিও না।’
‘বয়ে গেছে আমার তাকাতে। তুমি কি ভেবেছ, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি?’
স্বর্ণ নিজের গালে হাত বুলিয়ে বলে, ‘তা হলে তো সমস্যা মিটেই গেল।’
প্রীতি হাত উলটে বলে, ‘কোথায় মিটল? চোখ বুজলেও তো তোমায় দেখতে পাই, আর সেটাই তো ঝামেলার।’
প্রীতি জানে স্বর্ণ আর পাঁচজনের মতো এই জাতীয় কথায় মুগ্ধ হওয়ার ছেলে নয়। উলটে বিরক্ত হয়, রাগ দেখায়। তবু সে বলে। ভালোবাসার মানুষ রাগ করে বলে ভালোবাসার কথা বলা যাবে না, এমন কোনও নিয়ম নেই।
চোখ-মুখে জল দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বর্ণ খেয়াল করল, মাথার ব্যথাটা হালকাভাবে লেগে আছে। বাসি মুখেই খাটে বসে চা খেল স্বর্ণ। ভোরে দরজা খুললে বদ্যিনাথ চা দিয়ে যায়। দুপুর বা রাতের খাবারও স্বর্ণ নিজের ঘরে বসে খায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাঝেমধ্যে দোতলার ডাইনিংরুমে যেত। একা একাই খেত। কোনও-কোনওদিন বাসুদেব চৌধুরি এসে বসতেন। তিনি ছেলের সঙ্গে দু-একটা কথা বলতেন। বেশিরভাগেরই কোনও উত্তর দিত না স্বর্ণ। যেটুকু ‘হুঁ’ ‘হাঁ,’ না বললেই নয় সেটুকু। বছরখানেক হল ওপরে খেতে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। বাসুদেব ছেলেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন।
‘আজকাল তুমি ওপরে খেতে ওঠো না?’
স্বর্ণ চুপ করে রইল। বাসুদেব বললেন, ‘কোনও সমস্যা হয়েছে?’
স্বর্ণ মাথা নামিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার সময়ের ঠিক নেই। রাত হয়।’
‘লাঞ্চও তো করো না শুনছি।’
স্বর্ণ আবার চুপ করে থাকে। বাসুদেব বলেন, ‘রোজ না হোক, যেদিন সময় পাবে সেদিন তো আমরা একসঙ্গে খেতে পারি।’
‘একসঙ্গে’ শব্দটায় স্বর্ণ কোনও উৎসাহ বোধ করল না। সে আলোচনা বন্ধ করার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে বলল, ‘আমি নীচেই খেয়ে নেব।’
বাসুদেব মুহূর্তকয়েক ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘আমার জন্য বলছি না, তোমার মা খুশি হত। আমরা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করছি শুনলে ওর হয়তো ভালো লাগত।’
স্বর্ণ মনে-মনে হাসল। যে মানুষটার বছরের পর বছর পরিবারের সঙ্গে শোওয়া, বসা, খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই তার খুশি! তা ছাড়া মাকে রাত আটটার মধ্যে ডিনার সেরে ওষুধ খেয়ে নিতে হয়। বেশিরভাগ দিনই হয়তো স্বাভাবিক খাওয়ার অবস্থায় থাকেন না। জোর করে দুধজাতীয় কিছু খাইয়ে দিতে হয়। বাসুদেব চৌধুরি এ কথা খুব ভালো করেই জানেন। তবু মিথ্যে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আসলে ‘সবাই’ নয়, তিনি নিজে ছেলের সঙ্গ চাইছেন। কথাটা বুঝতে পেরে স্বর্ণর বিরক্তি বাড়ল। যে সময় সন্তান বাবা, মায়ের সঙ্গ পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত লালায়িত থাকে সেই সময় তাকে একা কাটাতে হয়েছে। এক-দুদিন নয়, বছরের পর বছর। গোটা বাল্য, কৈশোর কেটেছে, বাড়ি থেকে দূরে। স্কুল বোর্ডিং-এ। শৈশবের যে সামান্য স্মৃতিটুকু ছাড়া-ছাড়া মনে পড়ে সেখানে যারা আছে, তারা কে মনে পড়ে না। খুব মনে করার চেষ্টা করলে একটা দুটো মুখ মনে পড়ে অস্পষ্ট। বাসুদেব চৌধুরির কথায় চুপ করে রইল স্বর্ণ।
চেয়ারের গায়ে বাসি কাপড় জামা ঝুলছে। লোক এসে একটু পরে সেগুলো নিয়ে যাবে। বিকেলে কেচে, ইস্তিরি হয়ে ফেরত আসবে। এ বাড়ির সাংসারিক কাজগুলো যাতে নিয়ম মেনে, নিখুঁত ভাবে হয় তার সব ব্যবস্থাই বাসুদেব চৌধুরি করে রেখেছেন। শুধু বাগানের ফুল নয়, রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচার জন্য যেমন আলাদা-আলদা লোক আছে তেমন সন্ধেতে ঠাকুরঘরে পুরুতঠাকুর ঘুরে যায়, সকালবেলা মুচি আসে জুতো পালিশ করতে। সপ্তাহে একবার ক্লিনিং এজেন্ট থেকে লোক এসে সোফা পরদা, কার্পেটের ধুলো তুলে নিয়ে যায় মেশিনে। স্বর্ণর বিশ্বাস, তার বাবার এই আয়োজন শুধু তিনি ধনী বলেই নয়, আসলে তিনি ঘরবাড়ি দেখে বুঝতে দিতে চায় না, তার স্ত্রী সংসার করতে পারেন না। সে ক্ষমতা তার নেই। এটা একটা আড়াল। শুধু বাইরের লোকজনের কাছে নয়, আড়াল নিজের কাছেও। এ বাড়িতে বাইরের কারও আসার ব্যাপার নেই। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে ড্রইংরুম পর্যন্ত অনুমতি মেলে। সুতরাং বাড়ি সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার এত আয়োজন কার জন্য?
স্বর্ণ এই আয়োজনের খুব সামান্যই ব্যবহার করে। নিজে রান্না করা বা কাপড় কাচার মতো কোনও ‘নাটক’ সে তৈরি করতে চায় না। সে পাকাপাকিভাবে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায়। বিদেশে কোথাও পড়তে যাবে। ইতিমধ্যে একবার সে ‘জিআরই’ পরীক্ষায় বসেছিল। পাশ করতে পারেনি। ইউনির্ভাসিটি শেষ হলে আবার বসবে। ইচ্ছে করলে সে বাসুদেব চৌধুরির টাকায় বাইরে চলে যেতে পারে। সে তা করবে না। তাকে যেতে হবে নিজের ক্ষমতায় স্কলারশিপে।
মোবাইলটা বেজেই থেমে গেল। স্বর্ণ দলা পাকানো চাদর হাতড়ে ফোনটা টেনে নেয়। প্রীতির মিসড কল। সাতসকালে সুন্দরী মেয়ে মিসড কল দিলে ভালো লাগার কথা। স্বর্ণর ভালোমন্দ কিছুই লাগল না। সে অলস হাতে প্রীতির নম্বর টিপল।
‘কী হয়েছে?’
ওপাশ থেকে প্রীতি আনন্দিত গলায় বলল, ‘স্বর্ণ তুমি উঠেছ?’
‘না উঠলে ফোন করছি কী করে?’
এই বিরক্তি প্রীতি বিন্দুমাত্র গা করল না। সমান উচ্ছ্বাসেই বলল, ‘আজকের সকালটা কী সুন্দর না?’
‘এটা বলার জন্য ফোন করেছ?’
‘কেমন একটা মেঘ মেঘ ভাব। নিশ্চয় আজ বৃষ্টি হবে।’
স্বর্ণ হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘হলে হবে।’
‘ওমা! হলে হবে কী বলছ? এখন কি বৃষ্টির সময়? অসময়ে বৃষ্টি হলে দারুণ লাগে।’
‘প্রীতি, আমি এখন আরও কিছুক্ষণ ঘুমোব।’
‘অ্যাই শোনো, আমি ঠিক করেছি আজ কিছু করব না, নাথিং। চলো দুজনে কোথাও যাই। কাগজের নৌকায় বসে কফি খাবে? রাস্তায় হাঁটতেও পারি।’
স্বর্ণ নির্লিপ্ত ভাবে বলল, ‘আমি আজ বাড়ি থেকে বেরোব না প্রীতি।’
প্রীতি উৎসাহের মাত্রা আরও বাড়াল।
‘কোনও অসুবিধে নেই, তোমাকে বেরোতে হবে না। আমি এখনই একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা তোমার ওখানে চলে যাচ্ছি। বাইরে বৃষ্টি হবে, দুজন ঘরে বসে গল্প করব। ঘরের জানলা খোলা রাখব, যাতে ছাঁট ঢোকে।’
স্বর্ণ কঠিন গলায় বলল, ‘না, বাড়িতে আসবে না।
প্রীতি খিলখিল করে হেসে বলল, ‘বাপরে কী ধমক! সত্যি কি আমি তোমার বাড়িতে চলে যাচ্ছি? কোনওদিনও গেছি? তুমি বারণ করে দিয়েছ, ইটস ওকে। যেদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে নিয়ে যাবে সেদিন একেবারে যাব।’
স্বর্ণর আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। মাথার ব্যথাটা মনে হচ্ছে বাড়ছে। সে বলল, ‘আমি ফোন রাখছি প্রীতি।’
‘অ্যাই শোনো, আজ কখন আসবে?’
স্বর্ণ খানিকটা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘বলছি তো প্রীতি আজ আমি বেরোব না। ভালো লাগছে না।’
ওপাশে একটুক্ষণ চুপ করে থাকল প্রীতি। গাঢ় গলায় বলল, ‘তুমি এমন কেন স্বর্ণ? আর কারও বাড়িতে কি প্রবলেম নেই? সবারই আছে। তোমার মায়ের অসুখটা খুবই দু:খজনক। বাট ইটস নট নিউ। শিশুকাল থেকেই তুমি দেখছ, অন্তত জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। অলরেডি ইউ আর হ্যাবিচুয়েটেড। সেটা নিয়ে তুমি যদি সারাজীবন…’
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে স্বর্ণ বলল, ‘আমার কোনও সমস্যা নেই প্রীতি।’
‘অবশ্যই আছে। সমস্যা ছাড়া কেউ এভাবে দিনের পর দিন গুমরে থাকে না।’
‘মায়ের অসুস্থতার কারণে আমার মন খারাপ নয়।’
প্রীতি ফিসফিস করে বলল, ‘তা হলে কী কারণে? হোয়াই?’
স্বর্ণ সামান্য থেমে বলল, ‘একদিন বলব, আজ ভালো লাগছে না, আমার ঘুম পাচ্ছে।’
ফোন রেখে সত্যি-সত্যি স্বর্ণ আবার নতুন করে ঘুমিয়ে পড়ার কথা ভাবল। ঘুমোলে পাখিটা কি আবার মাথার মধ্যে উড়ে আসবে? এসে ডাকতে থাকবে? পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা গায়ের ওপর টানতে-টানতে স্বর্ণর প্রীতির জন্য একটু দু:খ অনুভব করল। বেচারি। সে কীভাবে জানবে স্বর্ণ চৌধুরি এমন কেন? কেন চারপাশের প্রাচুর্য, ভোগবিলাস, ভালো ও মন্দ হওয়ার সুযোগকে তুচ্ছজ্ঞান করে অনাগ্রহের জীবন নিয়ে পড়ে আছে নিজের মতো? সামান্য বছরখানেকের আলাপেই সে বুঝেছে প্রীতি ভালো মেয়ে। কিন্তু ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষরা দু:খ বেশি পায়। এই মেয়েকে দু:খ দিতে মন চায় না। গোড়ায় স্বর্ণ তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে। নির্লিপ্ততা, রাগ, বিরক্তি এমনকী ছোটখাটো অপমান পর্যন্ত করেছে। লাভ হয়নি। যত করেছে প্রীতি যেন আরও বেশি-বেশি করে জড়িয়ে-জড়িয়ে ধরে। এটা ঠিক নয়, এতে কষ্ট বাড়বে। আধো তন্দ্রায় ঢোকার মুখে মুখে স্বর্ণ সিদ্ধান্ত নিল, খুব দ্রুত একদিন প্রীতির সঙ্গে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলবে সে। বলবে, ‘ভুল কোরো না প্রীতি, যে জীবনে তুমি ঢোকবার স্বপ্ন দেখছ সে জীবন তোমার নয়। আমারও নয়। আমার কিছু কাজ বাকি আছে, সেই কাজ শেষ করে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাব একদিন।’
আবার মোবাইল বেজে উঠল। সত্যি? না কি তন্দ্রায়? ফোনটাও হয়তো পাখির মতো মাথার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। চোখ মুখ কুঁচকে স্বর্ণ মোবাইল তুলল। অচেনা নম্বর। শুয়ে শুয়েই ফোন কানে দিল স্বর্ণ।
‘হ্যালো?’
‘স্বর্ণ, আমি বলছি।’
ওপাশের গলা শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসে স্বর্ণ। গায়ের চাদর সরাতে সরাতে বলে, ‘আপনি। এখন!’
ওপাশের পুরুষকণ্ঠ চাপা গলায় বলল, ‘বুথ থেকে বলছি।’
‘স্বর্ণ বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনি তো সবসময় তাই করেন। যাতে আমি আপনার নম্বর ট্রেস করতে না পারি।’
ওপাশের পুরুষকণ্ঠ মৃদু হেসে বলল, ‘আহা, অত চটামটি করো কেন? বুড়ো মানুষের সঙ্গে অত রাগারাগি করলে হয়? তা ছাড়া, তুমি হলে কোটিপতি মানুষের পুত্র। নিজের বাপকে দেখো না কেমন ঠান্ডা মাথা?’
স্বর্ণ চাপা গলায় বলল, ‘বাজে কথা ছাড়ুন। কবে দেখা করবেন সেটা বলুন।’
‘এবার করব।’
স্বর্ণ দ্রুত পিছনের দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললে, ‘কবে? আজ?’
‘না, আজ নয়, শনিবার। শনিবার পারবে?’
‘পারব।’
পুরুষকণ্ঠ সামান্য কাশল। বুড়ো মানুষের কাশি। স্বর্ণ বলল, ‘আবার মত বদলাবেন না তো?’
বয়স্ক গলা এবার বিশ্রী আওয়াজে হাসল। বলল, ‘নিজের মত বদলে তোমার মতো তৈরি করছিলাম। পাঁচবারে না হলে পঞ্চাশবার করতাম। স্বর্ণ, এবার মনে হচ্ছে, তোমার মতো তৈরি হয়েছে। আমার কথা শোনবার জন্য তুমি প্রস্তুত।’
‘কোথায় যাব?’
ওপ্রান্তের পুরুষকণ্ঠ চিবিয়ে বলল, ‘আহা তাড়াহুড়ো করো কেন? পানশালায় আসতে কোনও অসুবিধে নেই তো?’
‘পানশালা! বার?’ স্বর্ণ ঠোঁট কামড়াল।
লোকটা বিশ্রী আওয়াজ করে বলল, ‘দেশি মদের দোকান কাম বার।’
স্বর্ণ একটু ভেবে বলল, ‘না কোনও অসুবিধে নেই।’
‘ভেরি গুড, আমি ভেবেছিলাম, পুত্রও বুঝি তার বাপের মতো হয়েছে। তোমার বাবা মদ শুনলে একশো হাত দূরে পালাত। চরিত্রবান মানুষ। অথচ…।’
লোকটা চুপ করল। স্বর্ণ বলল, ‘অথচ কী?’
‘এখন নয়, দেখা হলে বলব।’
স্বর্ণ মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করে বলল, ‘অসুবিধে কী? অনেক কিছুই এতদিনে বলে দিয়েছেন।’
মানুষটা আবার কাশল। বলল, ‘এবার বাকিটা সামনে বসে বলব। নাও জায়গাটা বুঝে নাও। ফোনের বিল উঠছে।’
টেবিলে সামনে চলে এল স্বর্ণ। হাতের সামনে পড়ে থাকা খাতার পাতা। উলটে খসখস করে পথনির্দেশ লিখতে লাগল। তাড়াহুড়োয় লক্ষ করেনি এই পাতারই ওপর এক কোণে মেয়েলি হাতে গোটা গোটা হরফে লেখা—’তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন বারতা। / রঙের তুলি পাব কোথা।’
ফোন ছেড়ে স্বর্ণ একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত হল। প্রীতি কখন এসব লিখে রেখেছে।
তিন
দ্রুত হাতে তালা খুলে ঘরে ঢুকল রাধা। পেশেন্ট উঠে পড়েছে। চেয়ার টেনে বসে আছে জানলার পাশে।
রাধার আজ দেরি হয়েছে। আজ স্নান করেছে। সব সকালে সে স্নান করে না, কোনও কোনও সকালে করে। এগুলো ‘বিশেষ সকাল’। যতই দেরি হোক, ভালো করে গায়ে সাবান ঘষে, পাউডার ঢেলে তবে রোগীর ঘরে ঢুকবে। এতেই খানিকটা দেরি হয়ে যায়।
‘বড়মা গুডমর্নিং। রাতে ঘুম হয়েছে?’
ভারতী দেবী মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। চোখে সামান্য ক্লান্তি থাকলেও, অস্থিরতা নেই। ক’দিন ধরেই অস্থিরতাটা কম।
‘ঘুম হয়েছে কি না তুই জানিস। রাতে যেভাবে ওষুধ গেলাস।’
রাধা দ্রুত হাতে অগোছালো বিছানা ঠিক করতে-করতে বলল, ‘গিলিয়েছি কোথায় বড়মা? তুমি তো এখন বলতেই খেয়ে নাও। ক’দিন আগেও জোর করতে হত।’
‘আমার মাথায় আজ একটু তেল দিয়ে দিস তো।’
‘দেব, তেল দিয়ে শ্যাম্পু করে দেব। কিন্তু আজ আকাশটা কেমন বিচ্ছিরি হয়ে আছে। মেঘলা মেঘলা।’
ভারতী দেবী বললেন, ‘কটা বাজে?’
রাধা বালিশের ওয়াড় বদলাতে-বদলাতে বলল, ‘সাতটা তো বেজেই গেছে।’
‘ও। এই ঘরে ঘড়ি নেই বলে সময়ও বুঝতে পারি না। পাগল মানুষের অবশ্য সময় দিয়ে কী হবে?’
কথাটা বলে হাসলেন ভারতী চৌধুরি। বিষণ্ণ অথচ সুন্দর হাসি। রাধা দেখে মুগ্ধ হল। এই মহিলার হাসি সে যতবারই দেখে মুগ্ধ হয়। শুধু হাসি কেন, চোখ, মুখ চেহারা সবই সুন্দর। কে বলবে পঞ্চাশ ছুঁতে আর মাত্র এক-দু-বছর বাকি? এখনও এত রূপ, অল্প বয়েসে না জানি কী অবস্থা ছিল। নিশ্চয় এই মেয়েকে দেখে ‘বড়বাবু’র মাথা ঘুরে গিয়েছিল।
রাধার ধারণা পুরোটা সত্যি না হলেও অনেকটা সত্যি। ঘটনা খানিকটা নাটকীয়ও ছিল। তরুণী ভারতী দেবীকে প্রথমদিন দেখেই আটকে পড়েছিলেন। কয়েক মাস পরে যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তখন সে সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেননি। তবু নিয়েছিলেন, কারণ ততক্ষণে বুঝতে পেরে গেছেন, এই মেয়েকে ছাড়া তিনি থাকতে পারবেন না।
ব্যারাকপুরের কাছে অফিসের কর্মচারীর বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো অনুষ্ঠান। কোম্পানির মালিকের যাওয়ার মতো নয়। তবু বাসুদেব গেলেন। ব্যাবসা সবে বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়টা জটিল। পরিশ্রমও যেমন দরকার, তেমন ওপর নীচ সবধরনের কর্মচারীদের সঙ্গে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার ভান রাখতে হয়। সেই অনুষ্ঠানেই ভারতী দেবীকে দেখেন। অতি সাধারণ সাজপোশাকেও ঝলমল করছে। তবে রূপের থেকেও মেয়েটির শান্ত ভাব বাসুদেব চৌধুরিকে মুগ্ধ করল অনেক বেশি। মেয়েটি সরে গেলে, তার বাবার সঙ্গে কথা হয়। ভদ্রলোকই আগ বাড়িয়ে এলেন। বাসুদেব চৌধুরির পরিচয় ততক্ষণে অনুষ্ঠান বাড়িতে চাউর হয়ে গেছে। কর্মচারী ছেলেটি তার মালিককে খাতির করতে চা, কফি, শরবত নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করেছে। প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পরিচয় করলেন। তারপর হড়বড়িয়ে যা বললেন, তা থেকে জানা গেল, মেয়ের মা গত হয়েছেন বছর পাঁচ হয়ে গেল। বাপ-মেয়ের দুজনের সংসার। মেয়ে সবে কলেজের পাট শেষ করেছে, রেজাল্ট ভালো হলেও আর পড়ার উপায় নেই। টানাটানির সংসারে এর বেশি লেখাপড়া সম্ভব নয়। চাকরিবাকরির চেষ্টা চলছে। ভদ্রলোক চারপাশ দেখে গলা নামিয়ে বললেন, ‘দেখুন না, আপনার ওখানে যদি কিছু হয়।’
বাসুদেব মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘সে দেখা যাবে?’
‘দেখবেন মেয়ে যেন আবার জানতে না পারে। বকাবকি করবে। ভারতী আমার রাগি মেয়ে।’
‘রাগি! দেখলে তো উলটো মনে হয়। শান্ত।’
ভদ্রলোক গদগদ গলায় বললেন, ‘ভেতরে রাগ আছে। তবে সবার জন্য নয়, মা নেই তো বাপের ওপরই যত চোটপাট। আরে বাপু, আজকাল কাজকর্মের জন্য একটা ধরা করা না করলে হয়? আপনি যদি একটা ব্যবস্থা করে দেন, দেখবেন, ঠকবেন না। আমার মেয়ের মধ্যে কোনও ফাঁকি নেই।’
বাসুদেব অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘ঠিকানাটা লিখে দিন। কিছু হলে আমার অফিস থেকে যোগাযোগ করবে।’
ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতায় এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়লেন যে ঠিকানা লিখতে গিয়ে হাতটাত কেঁপে একটা কাণ্ড হল।
পরের রবিবার সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসুদেব সটান সেই ঠিকানায় হাজির। ছোট গলিতে গাড়ি ঢোকাতে অসুবিধে হল। ‘কনক গার্মেন্টস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’-র মালিককে দেখে মেয়ের বাবা তো বিরাট নার্ভাস। মানুষটাকে কোথায় বসাবেন, কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ঘর বলতে রেলের দেশলাই বাক্সের সাইজের কোয়ার্টার। বসার ব্যবস্থা বলতে ভাঙা বেতের চেয়ার আর নড়বড়ে মোড়া। মেয়ে আবার বাড়িতেও নেই যে চট করে ঘরদোরটা একটু গুছিয়ে দেবে। বাসুদেব চৌধুরি ভাঙা চেয়ারে সহজ ভাবে বসেন। ভারতী দেবী ফিরে এলে সহজ ভাবে কথা বলেন। একবার বলতেই দুপুরে খেয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন সহজ ভঙ্গিতে। ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, মাছের ঝোল খেয়ে পরম তৃপ্তিতে বলেন, ‘একটা পান হবে?’
বিয়েটা হয়েছিল চুপচাপ। মেয়ে পক্ষের কিছু আত্মীয়স্বজন আর বাসুদেব চৌধুরির দু-চারজন পরিচিতির উপস্থিতিতে রেজিস্টার বাড়িতে খাতা এনে সই করিয়ে গেল। আড়ম্বরহীন বিয়ে বাসুদেবই চেয়েছিলেন। ভারতী দেবীর বাবার ক্ষীণ আপত্তি ছিল। কিন্তু সে আপত্তি তিনি তোলেননি। এরকম ধনী ঘরে মেয়ের বিয়ে হবে তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। মেয়ে চলে যাওয়ার পর দুদিন ধরে কান্নাকাটি করলেন। কান্নার কারণ আনন্দ এবং দু:খ দুটোই।
এই হল ভারতী দেবীর বিবাহপর্বের মোটামুটি ইতিহাস।
রাধা চাদর ভাঁজ করতে-করতে বলল, ‘ঠিক আছে বড়মা, বদ্যিনাথকে এই ঘরে একটা দেওয়াল ঘড়ি লাগাতে বলব।’
জানলার বাইরে চোখ রেখে ভারতী দেবী বললেন, ‘আমার ঘরে দরকার নেই, তুই বরং বাইরে একটা লাগিয়ে রাখিস, তুই যেখানে শুস।’
রাধা হেসে বলল, ‘ওখানে আছে বড়মা নইলে টাইমে-টাইমে তোমাকে ওষুধ দিই কী করে?’
ভারতী দেবীর অসুস্থতার প্রথম পর্যায়ে নার্স, আয়া যারা এসেছিল তারা থাকত রোগীর ঘরেই। একবার মাঝরাতে ভারতী দেবী রোগা পাতলা এক নার্সের গলা টিপে ধরলেন। তারপর থেকে রাতে রোগীর ঘরে থাকা বন্ধ হয়েছে। দরজার ঠিক বাইরে, প্যাসেজে ক্যাম্প খাট পেতে বিছানা হয়। রাধাও সেখানেই শোয়।
‘এদিকে আয় রাধা, আয় একবার।’
হাতে বেডকভার নিয়ে রাধা ভারতী দেবীর চেয়ারে পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘বলুন।’
ভারতী দেবী ঠোঁটের ফাঁকে আলতো হেসে বলেন, ‘দেখ ওদিকের আকাশটায় কেমন সুন্দর রং হয়েছে, সোনালি একটা ভাব। সুন্দর না?’
রাধা অবাক হল। এই উন্মাদিনীর মুখে আকাশ বাতাসের কথা আগে কখনও শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না। না, পেশেন্টের অবস্থা সত্যি খানিকটা ভালো হয়েছে। নইলে…। বাইরে তাকিয়ে সৌন্দর্যের কিছু বুঝতে পারল না রাধা, তবু বলল, ‘সত্যি সুন্দর বড়মা। মনে হয় এবার মেঘটা কেটে যাবে।’
ঘরের এই জানলাটা বড়। বাগানের অনেকটাই দেখা যায়, সবুজ লনটা পর্যন্ত। এই কারণেই ঘরটা ভারতী দেবীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। আসলে আড়াইতলার গোটা অংশটাই তার জন্য রাখা। আস্ত একটা ফ্ল্যাট যেন। সিঁড়ির মুখে কোল্যাপসেবল, সামনে ভারী পরদা। বাড়ির কর্ত্রীকে শুধু তালাবন্ধ করে রাখলেই হয় না, তাকে যাতে চট করে কেউ যাতে দেখতে না পায় সে ব্যবস্থাও করতে হয়েছে। গোড়াতে ঘরের জানলাগুলোতে বড়-বড় কাচ ছিল। স্লাইডিং উইন্ডো। ঠেলা দিলেই সরে যেত। একবার ফুলদানি ছুড়ে ভারতী দেবী জানলার সেই কাচ ভেঙে দিলেন। ডাক্তার এসে রাগারাগি করল।
‘আপনারা করেছেন কী? এই ধরনের পেশেন্টের ঘরে কেউ ফুলদানির মতো ভারী জিনিস রাখে? উনি কাচ ভেঙেছেন তাই রক্ষে, কারও দিকে ছুড়লে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার হত।’
তার পরই জানলায় কাঠের পাল্লা বসল, গ্রিল দেওয়া হল। মিস্তিরা গ্রিলে কোনও কায়দাকানুন করেনি। লম্বা লোহার রড বসিয়েছিল। সেই জানলা দেখে বাসুদেব চৌধুরি রেগে গেলেন। বললেন, ‘এ কী! এটা পাগলাগারদ না জেলখানা? রডগুলো এখনই খুলে ফেল।’ পাগলাগারদ বা জেলখানা না হলেও এ বাড়িকে বাইরের অনেকেই ‘পাগলবাড়ি’ বলে জানে। ভারতী দেবীর কারণেই জানে। তবে সেদিন রড খুলে জানলার গ্রিলে ফুল-পাতার নকশা করা হয়েছিল।
সেই লোহার ফুল পাতার মধ্যে দিয়ে ভারতীদেবী আকাশের সোনালি আভা দেখছেন।
রাধা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভারতী দেবীর প্রায় সব কাজই তাকে করতে হয়। রাধা ছাড়া কেউ একা এ-ঘরে ঢুকতে ভরসা পায় না। ‘বড়মা’-কে বোঝা যায় না। শান্ত, সুন্দর থাকতে-থাকতে কখন যে ভয়ংকর হয়ে উঠবে কেউ জানে না। আর সেই ‘ভয়ংকর’ সাধারণ নয়, অন্যরকম ‘ভয়ংকর।’
ভারতী দেবী ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘তোদের বড়বাবু কোথায়?’
রাধা চকিতে মুখ তুলে ফের মাথা নামাল। বলল, ‘নিশ্চয় মর্নিংওয়াকে গেছেন।’
‘এলে একটা খবর দিস।’
রাধা ওয়ার্ডরোবের দরজা খুলল। বেডশিট বের করতে-করতে বলল, ‘খবর দিতে হবে না, বড়বাবু তো মর্নিংওয়াক সেরে রোজই একবার আপনার সঙ্গে দেখা করে যান।’
‘তবু খবর দিস। যদি ভুলে যায়।’
রাধা হেসে বলল, ‘ওমা, ভুলবে কেন? কী যে বলেন না বড়মা।’
ভারতী দেবী বললেন, ‘স্বর্ণ কি এখনও ঘুমোচ্ছে?’
‘কে জানে? উনি তো বেলা পর্যন্ত দোর বন্ধ করে থাকেন। তবে ওর খবর আমি আনতে পারব না বাবা। আমাকে দেখলে…।’
কিছু একটা বলতে গিয়ে রাধা চুপ করে গেল। ভারতী দেবী সামান্য হেসে বললেন, ‘কী করে তোকে দেখলে? রাগ করে?’
রাধা মুহূর্তখানেক চুপ করে রইল। সম্ভবত মনে মনে উত্তর ভাবল। গলা নামিয়ে বলল, ‘না রাগ করে না, তবে পছন্দ করে না এটা বুঝতে পারি।’
ভারতীদেবী চিন্তিত গলায় বললেন, ‘ছেলেটার বড্ড রাগ। ছেলেবেলা থেকে মাকে কাছে পায়নি, রাগ হওয়াই তো স্বাভাবিক।’
খাটের চারপাশে ঘুরতে-ঘুরতে বেডশিট পাতছে রাধা। চোখ তুলে তাকিয়ে ভারতী দেবীর মুখের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করল। বলল, ‘আচ্ছা বড়মা, ছেলেবেলা থেকেই ছোটবাবু বুঝি এমন? রাগি?’
ভারতী দেবী অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘স্বর্ণর ছেলেবেলাটা আর আমি দেখতে পেলাম কই? ও যখন এল…।’
রাধা একটু থমকাল। স্বর্ণকে নিয়ে এ বাড়ির কর্মচারীদের মধ্যে চাপা কৌতূহল রয়েছে। এখনকার কেউ-ই অতীতে এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। রাধা তো দূরের কথা, রান্নার লোক, চারুর মা, মালি নিতাই বা ফিরোজ, এমনকী বদ্যিনাথও নয়। চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। তখনও এই বাংলো কেনেননি বাসুদেব। কানাঘুষোয় কিছু কথা শোনা যায়। সেসবের কোনটা সত্যি, কোনটা বানানো বলা মুশকিল। কেউ বলে, গর্ভে সন্তান ধারণের কয়েক মাস পরেই নাকি ভারতী দেবীর অসুখ ধরা পড়ে। বাসুদেব চৌধুরি তখন বিদেশে। ছুটে বেড়াচ্ছেন ব্যাবসার কাজে। ফেরবার উপায় নেই। বাইরে থেকেই স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ঠিক কীরকম ছিল তাও স্পষ্ট নয়। কেউ বলে, বাসুদেব স্ত্রীকেও বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই উন্মাদ ভারতী দেবীর শিশুপুত্রের জন্ম হয়। আবার শোনা যায়, ভারতী দেবীকে আদৌ কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাকে ব্যারাকপুরে তার বাবার কাছে রেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাসুদেব চৌধুরি চাননি, স্ত্রীর মাথা খারাপের খবর জানাজানি হোক। শহর থেকে একটু দূরে ক্লিনিকে ভরতি করা হয় গোপনে। দীর্ঘ ট্যুরের পর বাসুদেব যখন ফিরে এলেন তখন ভারতী দেবীর অবস্থা মারাত্মক। সম্ভবত এরই ফাঁকে কোনও একটা সময় স্বর্ণর জন্ম হয়। সেই সময়টাও ধোঁয়াশার মতো। বছরখানেকের মধ্যে ভারতী দেবীর বাবা মারা গেলেন। এমনিতেই মানুষটা ছিলেন রোগাভোগা অসুস্থ, মেয়ের এই অবস্থায় তিনি আরও ভেঙে পড়েছিলেন। পিছনের কয়েকটা বছরের তথ্য প্রমাণ, সাক্ষী, মুছে ফেলে উন্মাদ স্ত্রীকে নিয়ে বাসুদেব যখন নতুন এই বাংলোতে এসে উঠলেন তখন স্বর্ণ খানিকটা বড় হয়ে গেছে। এই বাড়িতে একে-একে নতুন করে নার্স, আয়া, রাঁধুনি, মালি, ড্রাইভার, দারোয়ান রাখা শুরু হল। এমনকী ডাক্তারও বদল হল। মানুষের অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বদলালে বাড়ির ঘরের মতো চারপাশের মানুষজনকেও বদলাতে হয়। বাসুদেব চৌধুরির বেলায়ও তাই ঘটেছে। তারপরও কর্মচারী অনেক পালটেছে। এমনকী বদ্যিনাথও এসেছে স্বর্ণর বাল্য অবস্থায়।
স্বর্ণের জন্মের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বলতে পারে মাত্র দুজন। তাদের মধ্যে একজন উন্মাদ, অন্যজন স্বয়ং বাসুদেব চৌধুরি। বাসুদেব চৌধুরির কাছে এ কথা জানতে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর ভারতীদেবীকে জিগ্যেস করা অর্থহীন। উনি কখন কী বলেন নিজেই বুঝতে পারেন না। সবথেকে বড় কথা হল এসব নিয়ে আলোচনার সাহস নেই কারও। ‘বড়বাবুর কানে গেলে কাজটাই চলে যাবে। তিনি দু-একটা ছোটখাটো চুরি-চামারি বা ফাঁকিবাজি নিয়ে মাথা ঘামান না। কিন্তু এ বাড়ি সম্পর্কে কোনওরকম কৌতূহল বরদাস্ত করেন না। এই বোকামি কে করবে? ‘বড়বাবু’ শুধু একজন বিত্তশালী মানুষই নন, তাদের সহায় সম্বলও বটে। কর্মচারীদের জন্য তিনি শুধু ভালো বেতনের ব্যবস্থাই করেননি, আপদে বিপদেও সবসময় পাশে থাকেন। না চাইতেই অসুখ বিসুখে চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, এমনকী ঝড়বৃষ্টির সময় দেশে ঘরবাড়ির ক্ষতি হলেও টাকাপয়সা দিতে দ্বিধা করেননি কোনওদিন। এমন একটা মানুষের অতীত কচলানোর দরকার কী? স্বর্ণ ব্যারাকপুরে জন্মালেই বা কী, লন্ডনে জন্মালেই বা তাদের কী?
ভারতী দেবী নিজেই মাঝেমধ্যে টুকটাক বলেন। বলতে-বলতে প্রসঙ্গ পালটান। পুরোটা মনেও করতে পারেন না। উন্মাদ মানুষের স্মৃতির কোনও-কোনও অংশ জট পাকিয়ে যায়। রাধা ঘাঁটাতে সাহস পায় না। তারও ভয় আছে। শুধু কৌতূহল ‘বড়বাবুর কানে পৌঁছোনোর বিপদ নয়, রোগী রিঅ্যাকটও করতে পারে। কে জানে হয়তো হুলুস্থুলু শুরু করে দিল।
রাধা এগিয়ে এসে ভারতী দেবীর কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘বড়মা, উঠুন বাথরুমে যাবেন।’
ভারতী দেবী বাধ্য মেয়ের মতো উঠে পড়লেন। রাধা খুশি হল। কিছুদিন হল জ্বালাতন কমেছে। বাথরুমের দরজা আলতো করে লাগিয়ে সে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় না। শুধু বাথরুম নয়, এই দিককার কোনও দরজায় ভেতর থেকে আটকানোর উপায় নেই। লক, ছিটকিনি সব খোলা। পাগল মানুষকে অন্যরা আটকে রাখতে পারে, কিন্তু সে নিজে নিজেকে আটকাতে পারে না। কথাটা ভেবে মনে-মনে একটু হাসল রাধা। তার মতো সামান্য মানুষের পক্ষে এটা কি বড় কথা হল?
বাথরুম থেকে বেরিয়ে শান্ত ভাবে জলখাবার খেলেন ভারতী দেবী। রাধাকে বললেন, ‘আমি বাগানে যাব।’
রাধা একটু অস্বস্তি বোধ করে। ভারতী দেবীকে হুটহাট ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে খুব একটা সাহস পায় না সে। খুব বেশি হলে বারান্দায় হাঁটচলা করায়। কখনও কখনও ছাদে নিয়ে যায়।
‘বড়মা, আর একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতেন। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলছিলেন না?’
ভারতী দেবী বললেন, ‘না হোক, আমি এখন বাগানে যাব। চিন্তা করিস না, আমার শরীর ভালো যাচ্ছে।’ মালকিনকে খুশি করতে রাধা তাড়াতাড়ি বলল, ‘সে তো ক’দিন ধরেই যাচ্ছে।’
সে ভারতী দেবীর হাত ধরল।
লনে ধীরেপায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন ভারতী দেবী। পায়ের চটি জোড়া একপাশে খুলে রেখেছেন। রাধা পাশেই রয়েছে। ‘একটা চেয়ার এনে দেব বড়মা? একটু বসবেন?’
‘না,বসব না। জানিস রাধা কাল একটা মজার স্বপ্ন দেখলাম।’
সকালবেলায় পাগল মানুষের স্বপ্ন শুনতে ইচ্ছে করছে না, তবু রাধা আগ্রহ দেখাল। একটা জিনিস সে বুঝে গেছে, এ বাড়িতে তার প্রাণভোমরাটি এই ভারতী চৌধুরি। এখানে টিকতে হলে এই প্রাণভোমরাটিকে যত্নআত্তিতে রেখে তবে টিকতে হবে। সে মিথ্যে আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘কী স্বপ্ন?’
‘দেখলাম, একবারে সুস্থ হয়ে গেছি। সেই আগের মতো। তোর বড়বাবুকে রান্না করে খাওয়াচ্ছি, টবে গাছ করছি।’
রাধা বানানো হেসে বলল, ‘সত্যি-সত্যি তো ভালো হয়ে উঠছেন। আরও হবেন। তারপর স্বপ্নের কী হল?’
ভারতী দেবী অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘এক সময় স্বপ্নের মধ্যে একটা গন্ধ পেলাম। গন্ধটা ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ মাথার মধ্যে ছিল।’
গন্ধ! রাধা চমকে উঠল। প্রথম যে রাতে ‘বড়বাবু’ তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন, পরদিন সকালে ভারতী দেবী তাকে বলেছিলেন, ‘তোর গা থেকে কেমন একটা গন্ধ আসছে রাধা।’
‘গন্ধ!’ রাধা থতোমতো খেয়ে যায়। নিজের হাত তুলে কবজি শোঁকে। তালু শোঁকে। ভারতী দেবী চোখ-মুখ কুঁচকে নাক টেনে দূর থেকে আবার গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করেন।
‘কীসের গন্ধ বড়মা? রাধা ভয়ে-ভয়ে বলে।
‘কাছে আয়, গন্ধটা কেমন চেনা-চেনা লাগে।’
কাছে আসার বদলে রাধা কয়েক পা পিছিয়ে যায়। হাসতে চেষ্টা করে। ঘাবড়ানো গলায় বলে, ‘আমার গায়ে থেকে আবার কীসের গন্ধ? এখনও তো স্নান করিনি যে তেল সাবানের গন্ধ হবে।’
ভারতী দেবী মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলেন, ‘না, তেল সাবানের গন্ধ নয়, অন্য গন্ধ। এ গন্ধ আমার চেনা, কিন্তু ধরতে পারছি না…।’
রাধা তাড়াতাড়ি বলে, ‘নিন দুধটা খেয়ে নিন দেখি; ওষুধগুলো খেতে হবে না?’
ভারতী দেবী চুপ করে যান, কিন্তু চোখমুখ থেকে সন্দেহের ছায়া দূর হয় না। রাধা আমল না দেওয়ার চেষ্টা করে। ঘর গুছিয়ে, ভারতী দেবীকে ফেলে রেখে দ্রুত নীচের বাথরুমে চলে যায়। শাড়ি, জামা খুলে হুড়মুড়িয়ে মাথার জল ঢালে। সাবান লাগায়। বারবার নিজের গা শুঁকে দেখে, কোথাও কি বাসুদেব চৌধুরির শরীরের গন্ধ লেগে আছে? বুকে, পেটে কোথাও? কই না তো! তা হলে? পাগল মানুষের গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা কি বেশি? দূর, তা কী করে হবে? তা ছাড়া ‘বড়বাবু’ তো কিছুই করেনি। ছুঁয়েও দেখেনি। শুধু কাপড়চোপড় খুলিয়ে নেংটা করে বসিয়ে রেখেছিল চোখের সামনে।
মনে-মনে বিশ্বাস না করলেও তারপর থেকে রাতে ‘বড়বাবুর কাছে গেলে পরদিন স্নান না করে রোগীর ঘরে ঢোকে না রাধা। আজও তাই করেছে। তবু সেই গন্ধের কথা! রাধা ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘কীসের গন্ধ বড়মা?’
ভারতী দেবী সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘গন্ধ ভালো না। তবে এখন আর মনে পড়ছে না।’
রাধার শরীরের ভেতরে ঝনঝন করে উঠল। বলে কী! শুধু শরীর নয়, এই পাগল কি ঘরের গন্ধও পায়। স্বামীর ঘর?’
দুশ্চিন্তা গোপন করে রাধা হাসার চেষ্টা করল। ভারতী দেবীকে খুশি করতে বলে, ‘মনে যখন পড়ছে না ভালোই হয়েছে। খারাপ গন্ধ বাদ দিয়ে এবার প্রাণভরে ফুলের গন্ধ নিন দেখি। দেখুন, দেখুন গাছটায় কত কুঁড়ি এসেছে।’
ভারতী দেবী গাছের দিকে তাকালেন ঠিকই, কিন্তু খুশি হলেন বলে মনে হল না। আসলে উন্মাদ মানুষকে বাইরে থেকে খুশি করা যায় না। সে নিজের মধ্যে থেকেই সুখ-দু:খ খুঁজে নেয়। রাধা তবু ভারতী দেবীকে খুশি করতে চেষ্টা করে। দীর্ঘ কষ্টের পর সবে সুখের মুখ দেখা শুরু হয়েছে তার। সে এই সুখ সহজে ত্যাগ করতে রাজি নয়।
চার
চারপাশে কেমন যেন ঝিম ধরা আলো। অস্পষ্ট, বিবর্ণ।
অথচ এখন এমন হওয়ার কথা নয়। আশ্বিনের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষ হতে চলল। এই সময়ে সকালগুলো শুরু হয় ঝলমলে ভাবে। দীর্ঘ ক্লান্তিকর বৃষ্টির পর আকাশ থাকে ঝকঝকে। শেষ রাত থেকে অল্প-অল্প হাওয়া দেয়। আজ অন্যরকম হয়েছে।
শুধু আলো ঝিম ধরা নয়, বাতাসও থমকে আছে। একটা গুমোট ভাব। পার্কের ঝাঁকড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে থমথমে মুখে। যেন অপেক্ষা করছে। বৃষ্টির অপেক্ষা? তবে কি মেঘ করল?
মর্নিংওয়াকের নিয়ম হল, হাঁটায় নির্দিষ্ট গতি ধরা থাকে। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই সুর কেটে যায়। আজ বাসুদেব চৌধুরির সুর কেটে যাচ্ছে। অন্যদিন এতক্ষণে গোটা পার্ক তিনবার চক্কর দেওয়া হয়ে যেত। এখন পর্যন্ত দুবারও হয়নি।
বাসুদেব গতি আরও কমিয়ে নীচু গলায় ডাকলেন, ‘কপিল।’
কপিল শুনতে পেল না। সে রয়েছে পিছনে, হাত কয়েক দূরে। বাসুদেব গলা সামান্য তুলে আবার ডাকলেন।
‘কপিল।’
দেহরক্ষীদের কায়দা হয় দুরকম। কেউ-কেউ থাকে গায়ের ওপর। যাকে পাহারা দেয় তার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলে। অন্য কায়দায় দেহরক্ষীকে থাকতে হয় খানিকটা পিছনে। কপিল সেটাই করে। খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটে। এতে নজর রাখতে সুবিধে। দুপাশের রাস্তা মানুষজন, ঝোপঝাড়, গাছপালার আড়াল, একসঙ্গে অনেকটা চোখের মধ্যে থাকে। কপিলের মতে এটাই আসল কেরামতি। আক্রমণ আসার আগেই আক্রমণকারীকে ঠেকাতে হবে। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল।
‘জি সাব।’
বাসুদেব মুখ না ঘুরিয়ে বললেন, ‘মেঘ করেছে?’
প্রশ্ন হিসেবে এটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ষাট বছরের একজন সুস্থ, সবল মানুষ মেঘ করেছে কিনা অন্যকে জিগ্যেস করবে কেন? সে তো আর ঘরের মধ্যে নেই। কপিল খানিকটা বিভ্রান্তই হল। আবার বলল, ‘জি সাব?’
বাসুদেব বুঝতে পারলেন, কপিল প্রশ্ন ধরতে পারেনি। অন্য কারও ক্ষেত্রে এই ঘটনা হলে তিনি বিরক্ত হতেন। মেঘ করেছে কি না জানতে চাওয়া এমন কোনও জটিল প্রশ্ন নয়। কপিলের ক্ষেত্রে বিরক্ত হলেন না। তিনি নিজেই মুখ তুলে আকাশ দেখলেন। ঠিকই, মেঘ-ই করেছে। তবে সাধারণ মেঘ নয়, ঘোলাটে ধরনের মেঘ। কুয়াশার মতো আবছা একটা আস্তরণ আকাশে বিছিয়ে আছে। আশেপাশে কোথাও ছাতিম গাছে ফুল এসেছে। সুন্দর গন্ধ আসছে। তবে বেশিক্ষণ নাকে এলে কড়া লাগে। এই সময়টা কি ছাতিম ফোটার সময়? বাসুদেব মনে করতে পারলেন না। ফুল-ফলের হিসেব তার ঠিকমতো মনে থাকেন না। জীবনের বড় সময়টাই টাকাপয়সার হিসেবে কেটে গেছে, ফুল-ফলের হিসেবে রাখবেন কখন? সে হিসেব ছিল ভারতীর। জুঁই, টগর, গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালেন্ডুলা থেকে শুরু করে কসমস, জিনিয়া, দোপাটির জন্মমৃত্যুর সনতারিখ সব ছিল তার মুখস্থ। কথাটা মনে পড়তে নিজের মনেই একটু হাসলেন বাসুদেব। হিসেব করে অনেক আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিত ভারতী। বরানগরের ফ্ল্যাটে গাছ করবার মতো জায়গা বলতে ছিল লম্বা বারান্দাটা আর ছাদটুকু। সেখানেই টব, মাটি, বীজ, চারা এনে আয়োজন চলত। বিয়ের পরের বছর তো এলাহি কাণ্ড করল। সকাল বিকেল গাছ নিয়ে পড়ে থাকত। ঘরে ঢুকত হাতে পায়ে মাটি মেখে। বাসুদেব অবাক হতেন, আবার মজাও পেতেন।
‘এত কী করছ ভারতী? রাতদিন দেখি টব আর মাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো।’
‘শীতের ফুল করছি।’
বাসুদেব অবাক হয়ে বলতেন, ‘শীত! শীত এখন কোথায়? আমার তো রীতিমতো ঘাম হচ্ছে।’
‘শীতের গাছ কী শীতে করে? গাছ তো আগে থেকেই রেডি করতে হবে। ফুল হবে ঠান্ডার সময়। সকালবেলা গায়ে চাদর দিয়ে যাতে ফুল দেখতে পাও তার জন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা করছি।’
‘বাপরে, এত হিসেব।’ বাসুদেব হেসে হাত বাড়িয়ে ভারতীকে কাছে টেনে নিলেন।
ভারতী হেসে সামান্য ঠেলা দিয়ে বলল, ‘অ্যাই, আমার গায়ে কিন্তু মাটি।’
‘থাকুক, মাটি আমার ভালো লাগে।’ বাসুদেব স্ত্রীর গালে, গলায়, ঠোঁটে, নাক-মুখ ঘসে আদর করতে-করতে বললেন।
ভারতী মুখ তুলে হেসে বলত, ‘কচু লাগে। দিনরাত তো কাপড়, গাড়ি আর হোটেলের ব্যাবসা নিয়ে পড়ে আছ। গাছপালার কী বুঝবে?’
মুখ ওপরে তুলে নিজের ধবধবে ফরসা রাজহাঁসের মতো লম্বা গলার পুরোটাই স্বামীর চোখের সামনে তুলে ধরত ভারতী। হাউসকোটের আড়ালে ফুটে উঠত তার সুডৌল স্তনজোড়া। শরীর-গাছের গায়ে আলতো করে লেগে আছে যেন। কাপড়ের ভেতর থেকেই ফুলের কুঁড়ির মতো বড় হয়ে জানান দিত বৃন্ত। যতবারই দেখতেন ততবারই বাসুদেব মুগ্ধ হতেন। শরীরের পরতে পরতে এই মেয়ে তার রূপ লুকিয়ে রেখেছে। এই মুগ্ধতা শুধু তার নয়, বাইরেও ভারতীর সৌন্দর্যের খুব প্রশংসা হয়েছিল। সেই প্রশংসার খবর কানে এসেছে বাসুদেবের। বিয়ের পর ম্যানেজারের স্ত্রী-রা দলবেঁধে দেখা করতে এসেছিল। ভারতীর হাত ধরে বলেছিল, ‘ম্যাডাম, ইউ আর লুকিং লাইক আ কুইন। স্যারের পাশে আপনাকে দারুণ মানাচ্ছে।’
তরুণী ভারতী সেদিন লজ্জা পেয়েছিল। রাতে স্বামীকে বলেছিল, ‘ইস আমাকে ম্যাডাম বলছে। আমার থেকে বয়েসে কত বড়।’ গর্বিত তৃপ্ত বাসুদেব মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘তুমি মালিকের বউ না? নাম ধরে তো আর ডাকতে পারে না। চিন্তা কোরো না, ও তোমার অভ্যেস হয়ে যাবে?’
মাটির গন্ধ নিতে-নিতে ভারতীয় হাউসকোটের বেল্ট, বোতাম দ্রুত হাতে খুলতেন বাসুদেব।
‘অতরকম ব্যাবসা নিয়ে আর থাকব না ভারতী। ট্রান্সপোর্ট, হোটেল ছেড়ে দেব ভেবেছি। শুধু কাপড়ে কনসেনট্রেট করব। মিডল ইস্ট থেকে অনেকগুলো অর্ডার পাওয়ার কথাবার্তা চলছে, ভেবেছি নিজেই চলে যাব। বড় কাজ লোক দিয়ে হয় না। অনেক সময় কমপ্লিকেটেড ডিসিশন নিতে হয়। অর্ডারগুলো যদি পেয়ে যাই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।’
ভারতী স্বামীর ঘন রোমশ বুকে হাত বোলাতে-বোলাতে মিথ্যে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত। ফিসফিস করে বলত, ‘ইস, সাতসকালে কী শুরু করলে বলো তো? ব্যাবসার কথা থামাবে?’
হাউসকোটের বুক উন্মোচিত করে স্ত্রীর নরম স্তনের মাঝে মুখ ডোবাতেন বাসুদেব। সত্যি মেয়েটার শরীরে মাটির গন্ধ। মাটি আর সুগন্ধী মেশানো মিষ্টি গন্ধ। ফুলের? গভীর তৃপ্তিতে গলা জড়িয়ে আসত তার। বলতেন, ‘কী কথা বলব তা হলে? ভালোবাসার কথা? সে আমি জানি না ভারতী, কাঠখোট্টা মানুষ, তবে ভালোবাসতে পারি।’
স্বামীর অশান্ত মাথাটা চেপে ধরে সামলায় ভারতী। কখনও নগ্ন হাতদুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে গলা। বলে, ‘জানো ঠিক করেছি টবে ডালিয়া করব। বড়-বড় ফুল। ভালো হবে না? অ্যাই জানলার পরদাগুলো টানবে তো।’
‘এত ওপরের ফ্ল্যাট, কে দেখবে?’
‘না দেখলেও টানো।’
নগ্ন স্ত্রীকে ডিভানের ওপর শুইয়ে দিতে দিতে বাসুদেব ভাবতেন, একেই কি শিল্পীর আঁকা ছবি বলে? চোখ, নাক, বুক থেকে শুরু করে নাভিমূল কোমর উরু, যোনি কত নিখুঁত সব! প্রতিটা ভাঁজ আনাচ কানাচ তুলিতে আঁকা যেন! নারী শরীর এই প্রথম দেখছে না, তবু ভারতীকে বারবার দেখেও মন ভরে না। বাসুদেব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন দীর্ঘক্ষণ। তারপর নীচু হয়ে স্ত্রীর পায়ের পাতার চুমু খেতেন। ভারতী তখন গোড়ালিতে নূপুর পরত। রূপোর নূপুর। জড়োসড়ো ভাবে উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বলত, ‘ছিছি, কী ছেলেমানুষি করো। পায়ে মুখ দাও কেন? লজ্জা করে না?’
‘আমাকে লজ্জা কীসের? স্বামীর কাছে কেউ লজ্জা পায়?’
‘মাগো, স্বামী বলে খুব মজা না? ড্যাব-ড্যাব করে খালি দেখা। কী দেখো?’
‘বলব কী দেখি।’
ভারতী বাসুদেবের ঠোঁটে হাত রেখে হেসে বলত, ‘থাক বলতে হবে না।’
হাত বাড়িয়ে চাদরও খুঁজত। বাসুদেবও হাসতেন। সত্যি মেয়েটা বড্ড লাজুক। পোশাক খোলার সময় যে কতরকম বাধা দেবে তার ঠিক নেই। জানলা আটকাও, আলো নেভাও। এমনকী প্রথম-প্রথম তাকে চোখ বুজতেও বলত। বাসুদেব ভারতীর ঊরুতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলতেন, ‘আর ফ্ল্যাট-ট্যাট নয়, এবার টাকাপয়সা হলে আস্ত একটা বাড়ি কিনব। খুব বড় বাড়ি। অনেকটা জায়গা থাকবে। তুমি মনের আনন্দে বাগান করবে।’
স্বামীকে নিজের ওপর টেনে তোলে ভারতী। তার শরীর দিয়ে নিজের নগ্নতা ঢাকতে ঢাকতে বলল, ‘সত্যি?’
ভারতীর শরীরে নিজের শরীর প্রবেশ করাতে-করাতে বাসুদেব ফিশফিশ করে বললেন, ‘শুধু বাগান নয়, ছোট একটা লনও থাকবে, সেখানে তোমার ছেলে খেলবে। নরম ঘাসে পড়ে গেলেও লাগবে না।’
বোজা চোখে যেন স্বপ্নের মধ্যে চলে যেত ভারতী। গাঢ় স্বরে শৃঙ্গারের শীৎকার তুলে বলত, ‘কবে? কবে বলো?’
জেগে ওঠা রক্তাভ স্তনবৃন্তে আলতো ভাবে মুখ ঘষতে-ঘষতে বাসুদেব বলতেন, ‘খুব দেরি নেই ভারতী। তোমার ছেলে তোমার থেকেও সুন্দর হবে। সবাই বলবে, বাসুদেব চৌধুরির ছেলেকে রাজকুমারের মতো দেখতে।’
শিথিল শরীরে ভারতী দু-হাতে স্বামীর পিঠ খামছে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘দাও দাও…।’
গভীর তৃপ্তি আর পরম যত্নে স্ত্রীর শরীরে নিজেকে প্রবেশ করান বাসুদেব।
তখনও তিনি জানেন না, ভারতীদেবীর কোনওদিনই সন্তান হবে না। সৃষ্টিকর্তা এই নারীকে উজাড় করে রূপ দিয়েছেন, কিন্তু সন্তানধারণের ক্ষমতা দেননি। যখন জানলেন তখন ভারতী দেবীর অসুখের লক্ষণ একটু-একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। প্রায় প্রতি সন্ধেতেই মাথার তীব্র যন্ত্রণায় ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকেন। এক দুপুরে বাড়ির কিশোরী পরিচারিকাটি অফিসে ফোন করল। ভয়ার্ত গলায় কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘দাদাবাবু, আপনে এখনই চলে আসেন। এখনই আসেন।’
‘কী হয়েছে?’
‘আমি জানি না কী হয়েছে, আপনে আগে আসেন। বউদি কেমন করে, আপনে আসেন।’
ফোনেই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মেয়েটি।
দুটো মিটিং বাতিল করলেও ফিরতে খানিকটা বেশি সময় লেগে গেল বাসুদেবের। বিটি রোডের মাঝখানে একটা লরি অ্যাক্সেল ভেঙে পড়েছিল। ঘনঘন বেল টিপতে কাজের মেয়েটি দরজা খুলল। লজ্জা আর আতঙ্কে চুপসে আছে। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে কোনওরকমে হাত তুলে বেডরুম দেখাল।
দ্রুত হাতে বেডরুমের দরজা খুলে থমকে দাঁড়ালেন বাসুদেব।
বিছানার ওপর গুড়িসুড়ি মেরে বসে আছে ভারতী। পা দুটো বুকের কাছে তুলে জড়িয়ে ধরা। চিবুক রাখা দুই হাঁটুর মাঝখানে। গোলাপি ঠোঁটদুটোয় এক চিলতে হাসি।
গায়ে একটুকরো সুতো নেই। সম্পূর্ণ নগ্ন।
শিউরে উঠলেন বাসুদেব। আজও মনে পড়ে রূপবতী ভারতীর সেই নগ্নতা ছিল কত বীভৎস! কী ভয়ংকর।
স্বামীর আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে ঘোলাটে চোখে তাকিয়েছিলেন ভারতী। শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘এসে গেছ? ভালো হয়েছে। আমি তৈরি, চলো এবার বেরোই।’
মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল বাসুদেবের। ভারতীর সেই হাসি, দৃষ্টি যেন এ জগতের নয়, অন্য কোনও জগতের।
বাসুদেব বললেন, ‘কপিল আজ আর হাঁটতে ভালো লাগছে না; বরং কোথাও খানিকটা বসে বাড়ি ফিরে যাই।’
পার্কটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। কোথাও ঘাসের পথ, কোথাও খানিকটা খোলা মাঠ। জায়গা বেশি বলে, সকালে হাঁটতে আসা মানুষজনের মধ্যে ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ির ভয় নেই। মাঝখানের ঝিলটা চমৎকার। জলের ওপর দিয়ে কাঠের ব্রিজ চলে গেছে। ইচ্ছেমতো এপার-ওপার করা যায়। জল ঘিরে ছোট-বড় নানা ধরনের বসার জায়গা।
একটু নির্জনে সরে এসে ঝিলের দিকে মুখ করে বেঞ্চে বসলেন, বাসুদেব।
‘কপিল।’
‘জি সাব।’
‘ভাবছি তোমাদের বড়মাকে মাঝেমধ্যে এখানে নিয়ে আসব। কেমন হবে?’
‘বড়মা’ সম্পর্কে যে কপিলের খুব কিছু জানা আছে এমন নয়। বাড়ির ভিতরের বিষয়। শুধু শুনেছে, সাহেবের বউয়ের ব্যামো আছে। সাধারণ ব্যামো নয়, মাথার ব্যামো। এটা একটা আপশোশের ঘটনা।
‘বহুত আচ্ছা সাব।’
‘অসুবিধে কিছু নেই, অমার সঙ্গে হাঁটবে, দরকার হলে একটু বসব। তুমি তো আছই।’
‘জি সাব।’
‘বেশি শরীর খারাপের সময় তো আনছি না, মোটামুটি ভালো থাকলে তবেই আনব। ইদানীং শুনছি ভালোই আছে।’
‘জরুর।’
বাসুদেব খুশি হলেন। কপিলের এটাও একটা বড় গুণ। এই যে তিনি তার উন্মাদ স্ত্রীকেও মাঝেমধ্যে এখানে নিয়ে আসবেন বলছেন তা নিয়ে কপিলের কোনও ভাবান্তর হল না। অন্য যে কেউ হলেই কমবেশি কৌতূহলী হত। অতিরিক্ত দু-একটা কথাও বলে বসত। উন্মাদ মানুষের পার্কে আসার সুবিধে অসুবিধে বিষয়ে কথা। যদি তা নাও করত, ভুরু তো কোঁচকাত বটেই। কপিল সেসব কিছুই করল না। বাসুদেবের বেঞ্চের পিছনে সে দ্রুত নিজের পজিশন নিল। এর মানে কিছু সময়ে এদিকটায় সহজে কাউকে ঘেঁষতে দেবে না সে। মুখে কিছু বলতে হবে না, কটমট চোখে তাকালেই সরে যাবে। গাঁট্টাগোট্টা আর ছোট ছোট চুলের লোককে এদেশের মানুষ ভয় পায়। পুলিশ বা মিলিটারি ভাবে। বাসুদেবের ইচ্ছে করল, কপিলের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলতে। ছায়া ছায়া সকালে নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগবে না। মনে মনে কথাও সাজালেন তিনি।
‘বড় মানুষের কী সমস্যা জানো কপিল, তাদের অর্থ থাকে, ক্ষমতা, থাকে, এমনকী বডিগার্ডও থাকে, কিন্তু মন খারাপ থাকে না। তারা সংসারে দায়িত্ব পালন করে, কাজের জায়গায় রাগ দেখায়, পার্টিতে গিয়ে হাসে। কিন্তু মন খারাপ নট অ্যালাউড। মজার নয়?’
‘জি সাব।’
‘আবার সব বড় মানুষের যে এই সমস্যা আছে এমন নয়। যেমন আমার স্ত্রী। মাথাখারাপ মানুষ। মন খারাপ করে সে যদি হইচই, গোলমাল শুরু করে বলার কিছু নেই। অথবা স্বর্ণ, মনে হয় সর্বদাই তার মনখারাপ। তবে মন খারাপ বলে সে ভারতীর মতো হইচই করে না। তার প্রকাশ উলটোরকম। সে চুপ করে থাকে। আমার সমস্যাটা বোঝো কপিল, দুই মন খারাপ করা মানুষের মধ্যিখানে আমি রয়ে গেছি বছরের পর বছর। একজন চেঁচায়, অন্যজন চুপ করে থাকে। আমার জন্য কোনওটাই রইল না। মজার না?’
‘জি সাব।’
‘ওদের জগতে আমার ঢোকার অনুমতি নেই। একেকজনের একেকটা জগৎ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আমার জন্য যে জগৎ ঠিক করা হয়েছে তা শুধুই কাজের। কর্তব্য আর দায়িত্বের। চারপাশের মানুষ দু:খ পাবে, দু:খ দেবে। আমি শুধু কর্তব্য পালন করে যাব। আমার জন্য এটাই সম্ভবত পূর্বনির্ধারিত। প্রিডেসটিনড। প্রিডেসটিনড বোঝো?’
‘নেহি সাব।’
‘আমিও যে খুব ভালো বুঝি এমন নয়। আজকাল মনে হয় অনেককিছু গোলমাল করে ফেলেছি। তার শাস্তি পাচ্ছি। তুমি পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস করো?’
‘বহুত সাব।’
‘আমি করতাম না। ভয়াবহ রকমের দারিদ্র্য আর অপমানের মধ্যে দিয়ে বাঁচতে হলে পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস করলে চলে না। এখন মনে হয় করলে ভালো হত। তা হলে ফল বিচার করতে সুবিধে হত।’
কপিলকে বাসুদেবের কিছুই বলা হল না। মনের কথোপকথন মনেই অসমাপ্ত রেখে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লেন।
‘চলো ফিরে চলো।’
যে মেঘের কারণে বাসুদেব মর্নিংওয়াক স্থগিত করলেন, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোনোর আগেই সেই মেঘ কাটতে শুরু করল। হালকা রোদ পড়েছে চারপাশে। এই পথটা মূলত নির্জন। লোকজন, গাড়ি চলাচল কম। বাজারের থলি হাতে দু-চারজন মহিলা পুরুষ হেঁটে যাচ্ছেন দ্রুতপায়ে। খবরের কাগজের হকার সাইকেল ঘণ্টি বাজাচ্ছে। বাসুদেব নিজের বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালেন। উর্দি পরা সিকিউরিটি মাথার টুপি ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়াল তড়িঘড়ি। কপিল সরে গেল একপাশে। সকালের মতো তার ডিউটি শেষ। ক্লান্ত পায়ে বাসুদেব বাড়িতে ঢুকলেন।
লনে ভারতী দেবীকে নীচু গলায় কিছু বলছিল রাধা। গেটের আওয়াজে মুখ তুলে তাকাল। মাথা নামিয়ে হেঁটে যাওয়া বাসুদেবকে দেখে তার কালো মোটা ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ভারতী দেবী সেই হাসি দেখতে পেলেন না।