শূন্য কোল!
পশ্চিমের সূর্যের দিকে যখন তাকাই ফিকে লাল হতে থাকা সূর্য আমাকে অতীতে ঠেলে দেয়। এত বছরের জীবন তখন দুলতে থাকে পাওয়া না পাওয়ার নানা সুতোর টানে। মাত্র ৬ বছর বয়সে রাইবেশে অভিনয় নেমেছিল যে ছোট্টো মেয়েটা ৭৭ এ পৌঁছে আজও নানা মাধ্যমের অভিনয়ে আচ্ছন্ন সে সত্যিই কি পরিপূর্ণ?
কেউ কি পূর্ণ হতে পারে তার জীবন জুড়ে? সম্প্রতি পড়া শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে ”পূর্ণতাকে পাবই যদি ভাববো কাকে/ শূন্য থেকে শূন্য নিলেও শূন্য থাকে”
সাত দশক ধরে আমার অভিনেত্রী জীবনে হয়তো অনেক শূন্যতা থেকে গেছে। যেভাবে যেমনটা করবো ভেবেছি ছুঁতে পারিনি সমগ্রতাকে। তবু সবাই ভালোবাসায় ভরিয়েছে বারবার। নিজেকে ভেঙে নতুন চরিত্রের মধ্য দিয়ে আপনাদের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করেছি। অভিনয়ের অপূর্ণতা সমালোচকেরা খুঁজে বের করবেন। রবীন্দ্রনাথ তো অপূর্ণতাকে শূন্য বলে মানতে চাননি। আমিও মনে করি অপূর্ণতা আসলে পূর্ণতার পথে এগোনোর একেকটা ধাপ।
তাই আলো, শব্দ, ক্যামেরা- আজও আমার মধ্যে নবীন কিশোরীর মতো মাদল তোলে। সব ছেড়ে আমি ছুটতে থাকি মাদলের সুরে তাল দেবো। কতবার তাল ভঙ্গ হয়েছে! মনে হয়েছে এই অভিনয়টা আরও কত ভালো যে হতে পারতো! এ অপূর্ণতা তো সব শিল্পীরই থাকে। আমরণ রক্তাক্ত হতে হয়। মঞ্চে, চলচ্চিত্রে এমনতরো ক্ষত যে আমার বুকে নেই তা নয়। একসময় খুব মনে হত আরও কিছুদিন বম্বেতে থাকলে মন্দ হতনা। পরের পর কাজ। ‘চুপকে চুপকে’, ‘আলাপ’, ‘আচানক’ এর মত ছবি। অমিতাভ, বিনোদ খান্নাদের সান্নিধ্য। গুলজার, হৃষীকেশ মুখার্জীর মত স্বনামধন্য পরিচালক। কষ্ট করে আরও কিছুদিন পরে থাকলে হয়তো আমিও শর্মিলার মত হতে পারতাম। কিন্তু সবার তো সব আসা পূর্ণ হয়না! আমি যে আবার যেচে কাজ চাইতে পারিনা! ইন্ড্রাস্ট্রির রাজনীতিও তো মাথায় ঢোকেনা! তাছাড়া আবহাওয়া, খাবারদাবার তেমন স্যূট করছিল না। বম্বেতে টিঁকে থকা বড় অনিশ্চিত ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ‘জন অরণ্যে’র অফারটা এলো। এ অফার কি মিস করা যায়! সেই যে এলাম আর ফেরা হল না। বলিউডের নায়িকা হওয়ায় সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে গেল! আজকাল যখন একা একা বসে ভাবি মনে হয় সেদিনের ফিরে আসার সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিল? হয়তো না। যদি জন্মান্তর বলে কিছু থাকে আমি অভিনেত্রী হয়েই ফিরে আসতে চাই। সেদিন না হয় সব অপ্রাপ্তি পুষিয়ে দেবো।
ব্যক্তি জীবনে বড় শখ ছিল ঘর ভরা সংসারের। আলোয়, আনন্দে যে সংসারের রামধনু ছড়িয়ে দেবে নতুন মন। সংসার জীবনের শুরু থেকেই তো শুধু কাজ আর কাজ। ভেবেছিলাম আর একটু পর, আর কয়েকটা দিন, তারপর না হয় আসুক আমাদের সন্তান। হেসেছিলেন বিধাতা। কলকাতা থেকে দক্ষিণ ভারত, সেখান থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে ফের কলকাতা— অভিনয়ের যাত্রাপথে নিজেকে সঁপে দিতে দিতে সে আশায় জলাঞ্জলি। ভরা সংসারের বদলে ক্রমশ একলা হাওয়া খেলতে লাগলো আমার ঘরে। এই অপ্রাপ্তি আজও আমার জীবনে ভীষণরকম সত্যি!