শূন্য কলসী
এতটুকু একটা প্লেট। ফিকে গোলাপি প্লাস্টিক পেন্টের ওপর টুকটুকে লাল রঙে লেখা?
ক্যালকাটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি
রং নির্বাচন আর হরফের কায়দা থেকেই বোঝা যায়, এজেন্সির কর্ণধার যতই অভাবী হোক, তার রুচির অভাব নেই।
কবিতাও বলল, ঠাকুরপো নেমপ্লেটটি করেছে বেশ। কিন্তু এই ভাঙা মেসবাড়ি থেকে অফিস না ওঠালে, রেসপেকটেবল ক্লায়েন্টরা আসবে কেন?
কথাটা ঠিক। কবিতার যুগপৎ ভ্রূকুটি আর সনির্বন্ধ অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত কলকাতার সর্বপ্রথম প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি স্থাপিত হল ইন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায়। কিন্তু এই কি অফিস করার উপযুক্ত জায়গা? রংচটা দরজা আর নোনাধরা দেওয়াল দেখেই উদ্যমের অর্ধেক অন্তর্হিত হয়। তারপর দাঁত বার করা সিঁড়ি পেরিয়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকে ভাঙা তক্তপোষ আর নড়বড়ে পায়া চেয়ার দেখেই তো বাকিটুকু আস্থাও কঞ্জুরের মতো উবে যায়।
তবে হ্যাঁ, এজেন্সির কর্ণধারকে দেখলে তার অতীত কীর্তিকলাপের কিছু কিছু শুনলে মনে ভরসা আসে বটে। সেদিনও দুজনে ঘরে ঢুকে দেখলাম, তক্তপোষের ওপর আড় হয়ে শুয়ে কঁচি ধ্বংস করছে ইন্দ্রনাথ। দুই চোখে তার শিল্পীর তন্ময়তা, দৃষ্টির অন্দরে অতলান্ত বিষাদ, আর ধারালো চিবুক ঠোঁট নাকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির বিচ্ছুরণ।
কবিতার চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজেই চমকে উঠছিল ইন্দ্রনাথ। আমাদের দেখেই দু-হাত সামনে প্রসারিত করে মঞ্চ নটের কায়দায় দরাজ গলায় বলে উঠল, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বীরের বীর্য, কর্মীর কর্মোদ্যম, রূপকারের কলাকৃতিত্ব প্রভৃতি সভ্যতার সমস্ত বড় বড় চেষ্টার পিছনে নারীপ্রকৃতির গূঢ় প্রবর্তন আছে।
ভুরু কুঁচকে কবিতা বললে, তোমার অনেক রকম ঢং দেখেছি। কিন্তু এ-ঘরটার ভেতরে এমনকী intellectual beauty-র সন্ধান পেয়েছ যে–
দমভোর সুখটান দিয়ে গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইন্দ্রনাথ বললে, বসো, বসো, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–
আরে গেল যা! কি কুক্ষণেই রবীন্দ্র-রচনাবলী তোমাকে দিয়েছিলাম। ওঠো, উঠে পড়ো।
কোথায়?
বাইরের অক্সিজেনে।
কিন্তু জয়ন্ত যে এখনি আসছে!
জয়ন্ত! এখন!
হ্যাঁ, খবর পাঠিয়েছে সে। একটা নতুন ঝামেলায় ডাক পড়েছে তার, তাই আমাকেও জ্বালাতে চায়। ওই তো এসে গেছে ও।
সিঁড়িতে ভারী জুতোর আওয়াজ শুনলাম। পরক্ষণেই মসমস শব্দে পুরো পুলিশী ইউনিফর্ম পরে ঘরে ঢুকল জয়ন্ত। ঢুকেই এক চিৎকার, আরে, কপোত-কপোতী যে–কী ব্যাপার? এখানে তো নন্দন নিকুঞ্জবন নেই শ্বেতশিলাসনও নেই–তবে কেন বৃথা কালক্ষেপ এই দারিদ্রের কুটিরে?
কবিতা বলল, আমার খুশি। কী জন্যে তুমি এসেছ, তাই আগে শুনি।
অরিণী সরখেল আত্মহত্যা করেছেন।
চট করে উঠে বসল ইন্দ্রনাথ।
ডক্টর তারিণী সরখেল?
হ্যাঁ।
আলনা থেকে পাঞ্জাবিটায় টান দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, চল, বেরিয়ে পড়া যাক। বউদি ভাই, মৃগাঙ্ক, আজকের মতো বিদেয় হও তোমরা।
কপাল কুঁচকে কবিতা বললে, কেন, আমরাও তো তোমার সঙ্গে আসতে পারি?
চোখ কপালে তুলে জয়ন্ত বললে, কী সর্বনাশ, পুলিশী তদন্তে নারীর উপস্থিতি–
ইন্দ্রনাথ বোতাম আঁটতে আঁটতে বললে, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প।
ঝঙ্কার দিয়ে উঠল কবিতা, থাক, থাক, আর রবীন্দ্রনাথ কপচাতে হবে না, আমরা যেতে চাই না তোমাদের সঙ্গে।
.
আকাশ-পথে নিউইয়র্ক শহরে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার সময়ে গগনচুম্বী হৰ্য্যনগরী দেখে টার্জেন মন্তব্য করেছিল–পাথরের জঙ্গল। আধুনিক কলকাতা শহর দেখলেও বোধ করি প্রকৃতিলালিত টার্জেন সেই একই ভুল করত। কিন্তু এই ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলও এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, শুরু হয়েছে ঝিকমিকে ঝিল আর সবুজসুন্দর পত্রপুষ্পের চোখজুড়ানো শোভা। এই কলকাতারই শহরতলীতে যে এমন রমণীয় উপবন থাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
জায়গাটার একটু ইতিহাস আছে। আসবার পথে জয়ন্তর মুখে তা শুনেছিলাম। ইন্দ্রনাথের টিটকিরির পর অভিমানিনী কবিতা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, অগত্যা আমি একাই এসেছিলাম। তখনই শুনেছিলাম মায়াগড়ের ইতিবৃত্ত।
বড়ি গ্রামের সাবর্ণ চৌধুরীর বংশের মনোহর, রামাদ, রামভদ্র প্রভৃতির কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা কিনে নেওয়ারও আগে পত্তন হয় এই মায়াগড়ের। প্রাচীন গৌড়ের এক শক্তিশালী নরপতি বর্গীদের অত্যাচার থেকে রাজপ্রাসাদ সুরক্ষিত রাখার জন্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বৃত্তাকারের পরিখা খনন করেছিলেন। পরিখার সঙ্গে ভাগীরথীর সংযোগ ছিল। মারাঠা দস্যুদের প্রবেশ রোধ করার জন্যে ইচ্ছেমতো পরিখার ওপর পা পাটাতন টেনে তুলে ফেলা হত। এখন অবশ্য মোটা মোটা মরচে ধরা লোহার শেকল ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই। পরিখার পরেই মাটি আর ইটের তৈরি তোরণ। বট-অশ্বথের প্রপে তা পড়ো-পড়ো হয়েও সমুন্নত। এককালে যা বাগান ছিল, এখন তা অরণ্য। দূরে গাছপালার ফাঁকে ঝিলের ঝিকিমিকি। অন্তঃপুরবাসিনীরা অবগাহন করতেন এইখানেই। উঁচু-নীচু পথ বেয়ে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর জিপ এসে থামল মূল প্রাসাদের সামনে।
এক নজরেই বোঝা যায় এ সৌধের সৃষ্টি ইংরেজ আগমনের অনেক পরে। সামনের দিকটা ইংরেজি কাসল-এর অনুকরণে তৈরি। সংস্কারের অভাবে কিছুটা জীর্ণ স্থানে স্থানে আগাছার দৌরাত্ম্যও চোখে পড়ে। এর ঠিক পেছনেই পরবর্তী যুগের তৈরি একটি বিশাল ইমারত। গাড়ি বারান্দার নীচেই পুলিশের ট্রাক আর একটি জিপ দাঁড়িয়েছিল। দুজন কনস্টেবলকেও দেখলাম সঙীন বাগিয়ে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।
জয়ন্ত অন ডিউটি আর এক মানুষ। স্বল্প কথায় স্থানীয় ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে মোটামুটি বিবরণ শুনে নিয়ে, সরাসরি সে এগিয়ে গেল মৃতদেহ যে ঘরে আছে–সেই ঘরে। নীরবে অনুসরণ করলাম আমরা।
একটা মাঝারি প্রকোষ্ঠ। একদিকে লেখবার টেবিল। অপর দিকে কারুকাজকরা সেকেলে কাঠের আলমারিতে সাজানো বিস্তর কেতাব। আর একদিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে সাজানো আরাম কেদারা আর কিউরিও।
টেবিলের ওপরেই মাথা রেখে স্থির হয়ে বসেছিল একটি নিষ্প্রাণ দেহ। কানের ওপর ন্যস্ত মাথার দু-দিকে ছড়িয়ে রয়েছে দুটি হাত। ডান হাতের শিথিল আঙুলগুলো টেবিলের বাছরে ঝুলছে। আর বাঁ-হাতের মুঠিতে ধরা একটি রিভলভার।
মৃতদেহ ছাড়া যে জিনিসটি সবার আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হল কালির স্রোত। দোয়াতের কালি। আধারটি উল্টেছে টেবিলের ঠিক মাঝখানে। বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার স্রোতের আকারে তা বয়ে গেছে চারদিকে। একটি ধারা এসে পৌঁছেছে মৃতদেহের মাথার ঠিক নীচেই।
জয়ন্ত নীচু হয়ে মাথাটা কাত করলে। তারপর সিধে হয়ে তাকালে ইন্দ্রনাথের পানে।
ইন্দ্রনাথও দেখেছিল। ঠোঁটের ডগায় একটা কঁচি লাগাতে-লাগাতে বললে, এই জন্যেই আত্মহত্যার কেসে তলব পড়েছে তোর?
ঠিক তাই। এটা আত্মহত্যাই নয়, খুন।
কী করে? ফস করে বলে ফেলি আমি।
ওহহ, তুই বুঝি দেখিসনি?
কী দেখব?
কেন মাথার নীচে?
দেখেছি, কিছু নেই ওখানে।
কিছু না থাকাটাই তো সমস্যা। তুই কি বলতে চাস, আত্মহত্যা করার পর মৃত ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে দোয়াতটি উল্টে দিয়েছিলেন?
অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি।
তাই কি সম্ভব নাকি?
তা না হলে কালির ধারা মাথার নীচেও থাকত, মাথা ঘিরে চলে যেতো না। আচ্ছা ইন্সপেক্টর শিকদার, চিঠিটা কোথায়?
যেখানে ছিল, সেইখানেই রেখেছি, স্যার। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। জবাব দিলেন লোক্যাল ইন্সপেক্টর শিকদার।
ঘরের মধ্যে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ছিল শুধু একটিই, আর তা মৃত ব্যক্তির শূন্যে বেরিয়ে থাকা ডান হাতের শিথিল আঙুলের ঠিক নীচেই।
এক মুখ ধোয়া ছেড়ে ঝুঁকে পড়ল ইন্দ্রনাথ। দোমড়ানো-মোচড়ানো কাগজের স্তূপের ঠিক ওপর থেকেই তুলে আনল একটা কাগজ। গোটা গোটা অক্ষরে কাগজটির ওপরে লেখা শুধু কয়েকটি পংক্তি:
এই শেষ। আর আমি তোমাকে জ্বালাবো না। তারিণী সরখেল।
অর্থাৎ আত্মহত্যার স্বীকারোক্তি। এরপরেও তারিণী সরখেল আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন বলতে গেলে একটু দ্বিধা হয় বইকি। জয়ন্তকে মৃদু স্বরে এই কথাই বললাম আমি।
জয়ন্ত ঠাট্টা করল না। গম্ভীর মুখে বললে, বেশ, আরো প্রমাণ তোমায় দেখাচ্ছি। ইন্সপেক্টর শিকদার, ডাক্তারের রিপোর্ট কি?
গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেলেন ইন্সপেক্টর–
এক, গুলিটা হৃদপিণ্ড ছুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। দুই, খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। তিন, গুলিটা একটু ওপরের অ্যাঙ্গেল থেকে করা হয়েছে। চার, গতকাল রাত্রে মারা গেছেন ডক্টর সরখেল।
জয়ন্ত বললে, এছাড়াও উনি তদন্ত করে জেনেছেন, ডক্টর সরখেল ল্যাটা ছিলেন না। অর্থাৎ ডান হাত মুক্ত থাকা সত্ত্বেও বাঁ-হাতে রিভলভার ধরার কোনও দরকারই ছিল না তার। কাজে কাজেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ডক্টর সরখেল আত্মহত্যা করেননি এবং আততায়ী টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফায়ার করেছিল।
ইন্দ্রনাথ বলে উঠল, আরও আছে। আততায়ী ডক্টর সরখেলের পরিচিতও বটে। কেননা, ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তির কোনও চিহই নেই। টেবিলের কাগজপত্রও সুবিন্যস্ত। আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও ডক্টর কিছু বুঝতে পারেননি–পারলে নিশ্চয় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠতেন। তাছাড়া, ওঁর মুখ-চোখেও সেরকম কোনও ভাব দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া আরাম কেদারার ওপর একটা বিলিতি ম্যাগাজিনও পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ আততায়ী নিশ্চয় আরাম কেদারায় বসেছিল, সামনের স্তূপীকৃত ম্যাগাজিনের একটি টেনে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিল, হয়তো ডক্টর সরখেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজবও হয়েছিল! কেননা, আরাম কেদারার সামনে রক্ষিত ছাইদানে সিগারেটের ছাইয়ের সঙ্গে চুরুটের ছাইও আছে। কিন্তু টেবিলের ওপর রাখা ছাইদানে যেখানে হামেশাই ডক্টর সরখেল বসতেন, সেখানে সিগারেটের ছাই ছাড়া আর কিছু নেই।
অবাক চোখে ইন্দ্রনাথের বক্তিমে শুনছিলেন লোক্যাল ইন্সপেক্টর শিকদার। মুখের ভাবখানা তুমি কোন্ তালেবড় হে! ইন্দ্রনাথ স্তব্ধ হতেই জয়ন্ত তাই হাসি গোপন করে ভারিক্কি চালে বলে উঠল, ইন্সপেক্টর, এঁর নাম নিশ্চয় আপনি শুনেছেন। আমার বিশেষ বন্ধু ইনি–সত্যসন্ধানী ইন্দ্রনাথ রুদ্র। আর ইনি মৃগাঙ্ক চৌধুরী–লেখক, কবি, এবং ইন্দ্রনাথের কাহিনীকার।
যথারীতি লাফিয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর। উচ্ছ্বাসে একটু স্তিমিত হয়ে আসার পর ইন্দ্রনাথ শুধোলে–আপনি ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটটা ভালো করে দেখেছেন?
আজ্ঞে না। আপনারা আসবেন বলে–
আচ্ছা, আমিই দেখছি, বলে উবু হয়ে বসে পড়ে ইন্দ্রনাথ। উপুড় করে দেয় বাস্কেটটা। ভেতর থেকে খুব বেশি কাগজপত্র অবশ্য পাওয়া গেল না। কতকগুলো পরিত্যক্ত ভেষজ সম্পর্কিত লিটারেচার, একটা পুরোনো প্রেসক্রিপশন রেফারেন্স-বুক, আর এটা খবরের কাগজের কাটিং।
ইংরাজি দৈনিকের পাতা থেকে সযত্নে কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া অংশটা হাতে নিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে ছিন্ন পত্রটা তুলে দিলে আমার হাতে।
ভাবলাম, শার্লক হোমসের মতো না জানি আবর্জনা স্তূপ থেকে অতি মূল্যবান সূত্রই আবিষ্কার করে ফেলেছে বন্ধুবর ইন্দ্রনাথ। কাগজটার একদিকে দেখলাম জুতোর পালিশের বিজ্ঞাপন। আর একদিকে শুধু দুটি লাইন:
T. S. FRIDAY NIGHT TEN
MOULIN ROUGE. K. L.
এক নজরেই বুঝলাম, অংশটি পার্সোনাল কলমে বিজ্ঞাপিত হয়েছিল।
নীরবে কাটিংটা তুলে দিলাম জয়ন্তর হাতে। একে একে সবার পর্যবেক্ষণ শেষ হলে পর জয়ন্ত তা নোটবইয়ের ফাঁকে রাখতে রাখতে বললে, ইন্দ্রনাথ, ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটটা লক্ষ্য করেছ?
করেছি। বেতের বাস্কেট। নিউ মার্কেটে এ জিনিস এন্তার কিনতে পাওয়া যায়।
আর কিছু?
সম্প্রতি বাস্কেটটা উল্টো করে তার ওপর কেউ দাঁড়িয়েছিল। কয়েক জায়গায় সামান্য মচকে গিয়েছে। যেই দাঁড়াক, ওজন তার খুব বেশি নয়। কেননা, গুরুভার ব্যক্তি হলে অমজবুত বাস্কেটকে আর বাস্কেট বলে চেনা যেত না।
ব্যস?
স্যার, আচমকা লাফিয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর শিকদার, স্যার, আমি একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি এখান থেকেই।
এক সঙ্গে তিন জোড়া দৃষ্টি এসে পড়ে শিকদারের উত্তেজিত মুখের ওপর।
কী?
একটা লাল সুতো।
কোথায়?
বাস্কেটের কোণে; খাঁজে আটকে রয়েছে। অর্থাৎ ইন্দ্রনাথবাবু যা বললেন, তা সত্যি। বাস্কেটের ওপর যে দাঁড়িয়েছিল, তার পরিধেয়র একটা অংশ বাস্কেটের বেতের খোঁচায় আটকে গিয়েছিল। টান মেরে তা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সুতোটা থেকে গিয়েছে।
বটে, ভুরু কুঁচকোয় জয়ন্ত, তাহলে এর মধ্যেই আততায়ীর চেহারার একটা মোটামুটি বর্ণনা আমরা পাচ্ছি। সে কৃশকায়, অঙ্গে লাল পোশাক, এবং সে ডাক্তার সরখেলের বিশেষ পরিচিত। ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরোতে আমি খবর দিয়ে এসেছি, তারা এল বলে। ম্যাগাজিন, অ্যাস্ট্রে, আর এই আত্মহত্যার স্বীকৃতিপত্রে কার কার আঙুলের ছাপ আছে, তা আমাকে জানতেই হবে। তবে আপাতত এ-ঘরে আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। গতকাল রাত্রে এ-বাড়িতে কে কে ছিল?
ডক্টর সরখেল, মিসেস এবং মিস সরখেল, আর পুরোনো চাকর রামহরি।
ব্যস? এত বড় বাড়িতে মাত্র একজন চাকর?
ডাকব স্যার? এখনই জেরা করুন না?
শুধু রামহরিকে ডাকুন।
কনস্টেবলকে নির্দেশ দিলেন ইন্সপেক্টর সরখেল। তারপর নিহত ব্যক্তির সান্নিধ্য ত্যাগ করে সবাই বেরিয়ে এলাম বাইরে। আসতেই মুখোমুখি হয়ে গেলাম পঞ্চাশোত্তীর্ণ এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে।
ইন্সপেক্টর বলে উঠলেন, এই যে রামহরি, তোমাকেই খুঁজতে পাঠাচ্ছিলাম, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
এজ্ঞে, উই পাশটিতে দাঁড়িয়ে ছেলেম।
বিচিত্র চেহারা প্রৌঢ়ের। বৃদ্ধের মতোই পলিতকেশ মাথা। এতটুকু কালো আঁচড়ও দেখা যায় রুপোর মতো ঝকঝকে একরাশ চুলে। চোখেমুখে নিবিড় প্রশান্তির অভিব্যক্তি। ঋষির মতোই স্নিগ্ধ সে মুখ; কোনও অভাব নেই, দুঃখ নেই, বাসনা নেই। অথচ তাপসিক কঠোরতার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না তার ললাটের ভাঁজে, চোখের বহির্বিন্দুর দু-ধারের প্রজ্ঞারেখায়।
নরম সুরে ইন্দ্রনাথ কথা শুরু করলে, তোমারই নাম রামহরি? তোমার সঙ্গে আমাদের বিশেষ দরকার।
এজ্ঞে ।
আচ্ছা রামহরি, এ-বাড়িতে তুমি কতদিন আছ?
তা অনেক দিন হল; এটুকু বয়স থেকেই এ-বাড়িতে এসেছিলেম।
তুমি ছাড়া আর কোনও… কথাটা অসমাপ্ত রাখে ইন্দ্রনাথ।
কিন্তু রামহরি বুঝে নেয়। বলে, এজ্ঞে, আর কেউ নেই। দরকার কি বলুন? বাবু, মামণি আর দিদিমণি বই তো আর কেউ নেই সংসারে? বাড়িটা বড় হলে কি হবে, সংসারটি তো ছোট!
তুমিই তাহলে সব কাজ করো?
এজ্ঞে, সব। বাজার-হাট, রান্নাবান্না, ঘরদোর সাফ–সব।
বাবুর গাড়ি আছে তো?
এজ্ঞে আছে; দুটো গাড়ি।
ড্রাইভার নেই?
এজ্ঞে, না। দরকার হয় না। দিদিমণি, মামণি, বাবু–প্রত্যেকেই যে গাড়ি চালাতে জানেন।
এত বড় বাড়িতে শুধু কটি প্রাণী থাকে, তোমাদের ভয় করে না?
এজ্ঞে, ভয় কীসের? এটুকু বয়স থেকেই তো রয়েছি এখানে।
আচ্ছা রামহরি, তোমার বাবু আত্মহত্যা করলেন কেন? মানে, তুমি তো পুরোনো লোক, কাজেই কোনও কারণ-টারণ থাকলে নিশ্চয় তা তোমার অজানা নয়।
মাথা নীচু করে রইল রামহরি। তারপর মৃদুস্বরে বললে, এজ্ঞে, এ-বড় কঠিন প্রশ্ন।
কেন?
আত্মহত্যা তো অনেকেই অনেক কারণে করে!
যেমন আর্থিক অভাব?
এজ্ঞে, বাবুর টাকার অভাব নেই।
সাংসারিক অশান্তি?
এজ্ঞে, সেরকম খিটিমিটি সব সংসারেই আছে।
আর কিছু? অর্থব্যঞ্জক চোখে তাকালো ইন্দ্রনাথ।
বুদ্ধিমান রামহরি ইঙ্গিতটুকু বুঝে নিয়ে বললে, এজ্ঞে, সেরকম কিছু তো আমি জানি না। দিনের বেশির ভাগ সময় শহরেই কাটাতেন বাবু, বাড়ি ফিরতেন অনেক রাত্রে।
সেকি? এরকম নির্জন বাড়িতে!
এজ্ঞে, সেইটেই তো তাজ্জব কাণ্ড! আমরা কেউই কোনও শব্দ শুনিনি। বাবুর শোবার ঘর নীচেই। রাত্রে তাকে বিরক্ত করা বারণ। তাই সকালবেলা চা নিয়ে গিয়ে দেখি এই দৃশ্য।
পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল ইন্দ্রনাথ ও জয়ন্ত।
জয়ন্ত শুধোলে, আচ্ছা, বাবুর কোনও শত্রু আছে বলে জানো কি?
এজ্ঞে, তা তো বলা মুশকিল।
বন্ধু?
এজ্ঞে, তা আছে নিশ্চয়। তবে এ-বাড়ি শহর থেকে এত দূরে যে, কাউকে বড় একটা আসতে দেখি না। পার্ক স্ট্রিটে বাবুর চেম্বারেই তেনারা যান।
চুপ করল জয়ন্ত।
তারপর শুধোলে, তোমার মা-মণি কোথায়?
ওপরে। বড় কাদাকাটা করছেন। ডাকব?
না, না, ডাকতে হবে না। তুমি নীচে থাকো, আমরাই যাচ্ছি।
মিসেস সরখেল তাঁর ঘরেই ছিলেন। কাশ্মীরি জাজিম বিছানা শয্যায় মখমলের উপাধানে মুখ লুকিয়ে শুয়েছিলেন তিনি। দোরগোড়ায় আমাদের পদশব্দ শুনেই এস্তে উঠে বসলেন।
মৃদু গম্ভীর স্বরে জয়ন্ত বললে, মাপ করবেন, এ সময়ে আপনাকে বিরক্ত করা যে কতখানি হৃদয়হীনতা, তা আমি বুঝি। কিন্তু কর্তব্য বড় নিষ্ঠুর, কি করি বলুন।
ভিজে গলায় বললেন মিসেস সরখেল, ভেতরে আসুন।
দেওয়ালের ধার ঘেঁষে পাতা আরামকেদারায় বসলাম আমরা। বিষণ্ণ চোখ মেলে তাকালেন মিসেস সরখেল। আমি কবিতা লিখি, তাই বুঝি তার এমন দুঃসময়েও ভারি ভালো লাগল তাঁর চাহনি। বয়স তার চল্লিশের কাছাকাছি। যৌবনকে এখনও তিনি সযত্নে বন্দি করে রেখেছেন ঢলঢলে মুখের মিষ্টি লাবণ্যের পিঞ্জরে। সজল দুই চোখে দেখলাম শ্যামল ঘাসের কান্না। সারা মুখের বিষাদাভা যেন এইমাত্র শুক্লপক্ষের চাঁদকে অস্তাচলে পাঠিয়েছে। আজন্ম আভিজাত্যের মধ্যে লালিতা হলে যে গরিমা মাখানো সৌন্দর্য নিয়ে বঙ্গললনা প্রাণতরাঙ্গিনীর কুলে কুলে নৃত্য করে, তাই সম্বল করেই আজ বিধবা হয়েছেন মিসেস সরখেল।
আচমকা অত্যন্ত বেরসিকের মতো একটা প্রশ্ন করে বসল ইন্দ্রনাথ, মিসেস সরখেল, আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর ঘরে কী জন্যে গিয়েছিলেন তা বলবেন কি?
দারুণ চমকে উঠলেন মিসেস সরখেল। আমার চোখে মনে হয় যেন বীণার তার ছিঁড়ে গেল, সঙ্গীতের তাল কেটে গেল, কবিতার ছন্দ-পতন ঘটলো। ভীষণ রাগ হয়ে গেল ইন্দ্রনাথের ওপর।
আমি? ক্ষীণস্বরে বললেন মিসেস সরখেল।
হ্যাঁ, আপনি। রামহরির মুখে শুনলাম, আপনারা কেউই ফায়ারিং-এর শব্দ শোনেননি, অথচ তার মৃত্যুর ঠিক পরেই তাঁর টেবিল হাতড়ে ছিলেন কেন, তা জানতে পারি কি?
অসাধারণ সংযম বলে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেছিলেন মিসেস সরখেল। গোলাপের ভীরু পাপড়ির মতো থরথর করে কেঁপে উঠছিল তাঁর অধরোষ্ঠ–গোপন শঙ্কার কৃষ্ণছায়া এসে পড়েছিল দুই মণিকায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রশ্নবাণের আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠলেন উনি। আরক্ত থমথমে মুখে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বলতে চান?
অকস্মাৎ কররেখা নিরীক্ষণে তন্ময় হয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। মুখ না তুলেই ধীর শান্ত সুরে থেমে থেমে বললে, দেখুন, আমি যা জিগ্যেস করেছি, তার মধ্যে অস্বচ্ছতা কিছুই নেই। তবুও যদি প্রশ্নটাকে পুনরাবৃত্তি করতে বলেন–
না আমি যাইনি।
দীর্ঘশ্বাস ফেললে ইন্দ্রনাথ। এবার নখের ডগাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললে, মিসেস সরখেল, অনুমতি করেন তো একটা কথা বলি। বলে, অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঢিমেতালা স্বরে বলে চলে, আমরা এসেছি সত্যের সন্ধানে, অন্যায়ের উদঘাটনে। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে কিছু গোপন করার প্রচেষ্টা করা মানেই আপনার স্বামীর প্রকৃত হত্যাকারীকে আত্মগোপন করতে সাহায্য করা।
যেন চমকে উঠলেন মিসেস সরখেল, অন্তত আমার তো তাই মনে হল।
হত্যাকারী! কী বলছেন কি?
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি আত্মহত্যা করেননি–নিহত হয়েছেন। আমরা এ-কথাও জানি, তাঁর মৃত্যুর পর আপনি তার ঘরে গিয়েছিলেন।
না!
সে সময়ে আপনার পরনে ছিল লাল শাড়ি।
না!
আপনি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট উল্টে তার ওপর দাঁড়িয়েছিলেন।
না! রীতিমতো সঙ্কিত হয়ে উঠি ভদ্রমহিলার কাগজের মতো সাদা মুখ দেখে।
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে ইন্দ্রনাথ। বিদ্যুৎবেগে সামনে এগিয়ে গিয়ে মিসেস সরখেলের ডান হাত টেনে নিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটা তুলে ধরে ইস্পাতের মতো কঠিন গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে, তবে তাঁর টেবিলের এই কালির দাগ আপনার আঙুলে এল কী করে?
না, না, না! আর্ত চিৎকার করে ভেঙে পড়েন মিসেস সরখেল। ছিন্নমূল লতার মতোই শয্যার ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদে ওঠেন অসহায়ভাবে–ফুলে ফুলে উঠতে থাকে তার দেহ।
পরিস্থিতির নাটকীয়তা আর ক্লাইম্যাক্সের ধাক্কায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ইন্দ্রনাথ কিন্তু অবিচল। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে কণ্ঠে বজ্রের বিষাণ বাজিয়ে পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে পালটে ফেলেও এখনও যে তা তার আয়ত্তের বাইরে যায়নি, তা ওর নির্বিকার মুখ দেখেই বুঝলাম। মিসেস সরখেলের হাত ছেড়ে দিয়ে মন্থর চরণে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও।
আর, আমরা নিশ্চুপ হয়ে দেখতে লাগলাম পতিবিয়োগ বিধুরা এক প্রৌঢ়ার উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন।
অনেকক্ষণ পরে শান্ত হল মিসেস সরখেল। কিন্তু মুখ তোলেন না উপাধান থেকে। নির্বিষ্ট মনে বাগানের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্রনাথ–আমাদের অস্তিত্বই যেন ভুলে গিয়েছিল। জীবনে উপর্যুপরি আঘাত আর ব্যর্থতার গ্লানিতে বিষিয়ে উঠেছে যার অন্তর, এ যেন সেই অলস চির-ক্লান্ত ইন্দ্রনাথ রুদ্র নয়। ওর কর্তব্য-নিষ্ঠুর গ্রানাইট পাথরের মতো কঠিন মুখচ্ছবির মধ্যে সন্ধান পেলাম আর এক ইন্দ্রনাথ রুদ্রের।
ফিরে দাঁড়ায় ইন্দ্রনাথ। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় পালঙ্কের পাশে। তারপর সহানুভূতি আর সমবেদনায় কোমল-স্নিগ্ধ সুরে বলে, মিসেস সরখেল!
কোনও উত্তর নেই।
মিসেস সরখেল, আপনি আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। বিশ্বাস করুন, আমরা এসেছি আপনার মঙ্গলের জন্যেই। আমাদের উপকারী বন্ধু হিসেবেই গ্রহণ করুন। আপনার গতিবিধির অনেক খবরই আমরা সংগ্রহ করেছি, এক্ষেত্রে কোনও কিছু গোপন করতে গেলেই আইনের রক্তচক্ষু থেকে তো আপনি রেহাই পাবেন না।
এতক্ষণ পরে মাথা তুললেন মিসেস সরখেল। শিশিরে ভেজা পদ্ম-পলাশের মতো দুই চোখ মুছে বললেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে ঘটনার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার কোনও সংযোগ নেই।
তবুও আমাদের তা জানা দরকার।
কিন্তু সে-কথা যে পাঁচজনকে বলার মতো নয়।
ক্ষণেক নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। তারপর বলল, বিশ্বাস করলাম। আচ্ছা, আমার পরিচয়টা আপনাকে এখনও দেওয়া হয়নি, আমি সরকারি গোয়েন্দা নই–বেসরকারি অর্থাৎ প্রাইভেট ডিটেকভ। কাজেই যে কাহিনিকে সরকারি নথিপত্রে স্থায়ীভাবে রেখে যেতে আপনার দ্বিধা, এত ভয়–তা অসঙ্কোচে আমার কাছে বলতে পারেন। আমি কথা দিচ্ছি, সে-কাহিনির সঙ্গে যদি আপনার স্বামীর হত্যারহস্যের কোনও সংযোগ না থাকে, তবে তা কোনওদিনই লোকসমাজে প্রচারিত হবে না।
আমি বহুবার ভেবেছি, frustrated না হয়ে গিয়ে ইন্দ্রনাথ যদি অভিনয়জগতে আবির্ভূত হত, তাহলে কুশলী শিল্পী হিসেবে যশস্বী হতে ওর বেশিদিন লাগত না। কণ্ঠের উত্থান-পতন, প্রবল ব্যক্তিত্ব আর চোখ-মুখের ভাবপ্রকাশ খুশিমতো নিয়ন্ত্রণ করার ঈশ্বর প্রদত্ত গুণটি থাকার ফলে যে কোনও পরিস্থিতিকে ঢেলে সাজিয়ে, নিজের আয়ত্তে আনা ওর কাছে ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন অনাত্মীয়ও পরম আত্মীয় হয়ে উঠে মনের মণিকোঠার অর্গল খুলে দিত ইন্দ্রনাথের সামনে। স্বয়ং নগর-কোটাল এবং ধর্মাবতার এলেও যা সম্ভব হত কিনা সন্দেহ, তা মুহূর্তের মধ্যে সহজ হয়ে উঠল ওর কণ্ঠের এই জাদুর জন্যে। কণ্ঠে নির্ভরতা ঢেলে মিসেস সরখেল আমাদের পানে তাকিয়ে শুধু বললেন কিন্তু–
আর বলতে হল না; সর্বাগ্রে উঠে দাঁড়াল জয়ন্ত, তার পরেই আমি আর ইন্সপেক্টর শিকদার অনুসরণ করলাম তার দৃষ্টান্ত–একটি কথাও না বলে তিনজনে নেমে এলাম নীচে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, মিনিট পনেরোর মধ্যেই ইন্দ্রনাথ নেমে এল আমাদের পাশে।
ভাবলেশহীন মুখে বললে এবার আর একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বাকি।
মিস শকুন্তলা সরখেল। উনিও ওপরে আছেন। বললেন ইন্সপেক্টর।
ইন্দ্রনাথ জয়ন্তর পানে তাকালে। জয়ন্ত বললে, চলো, সেরে আসা যাক।
দোতলাতেই করিডরের আর এক প্রান্তে দক্ষিণ ভোলা একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। দরজা খোলা। পুরু হ্যান্ডলুমের পর্দা ঝুলছিল সামনে। তারই ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, জানলার সামনে আমাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন তন্বী তরুণী। জাফরানী রঙের চোলী আর আশমানী রঙের শাড়ির ওপর ফণিনীর মতো এলিয়ে রয়েছে একটি দীর্ঘ বেণী। দুই হাতে জানলার গরাদ ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি।
এ অবস্থায় সাড়া না দিয়ে ঘরে প্রবেশ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কাজেই জয়ন্ত হাত তুলেছে দরজায় টোকা দেওয়ার জন্যে, এমন সময়ে একটা কাণ্ড ঘটল।
তীক্ষ্ণ শিস দেওয়ার একটা স্পষ্ট শব্দ শুনলাম। শব্দটা এলো বাগানের দিক থেকেই।
শব্দটা মিলোনোর আগেই চনমনে হয়ে উঠল তন্বী মূর্তি। উদগ্র উত্তেজনায় দুই গাল চেপে ধরল গরাদের ওপর। তার পরেই একটা হাত বারবার আন্দোলিত হল শূন্যে। একটি মাত্র অর্থই সুস্পষ্ট হল এই হাত নাড়ার মধ্যে এবং তা না-বাচক।
অল্পক্ষণ পরেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জানলার সামনে থেকে সরে এল রহস্যময়ী নারী মূর্তি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গলা খাঁকারি দিয়ে ভারী গলায় জয়ন্ত বলে উঠল, ভেতরে আসতে পারি?
দারুণ চমকে উঠল তরুণী মেয়েটি। সামনে ভূত দেখলেও বুঝি মানুষ এতটা চমকে ওঠে না। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে কাষ্ঠহেসে হেসে কোনও মতে বলে উঠল, ও, আপনারা–মানে–পুলিশ–
ধন্য নারী, ধন্য তোমার চির-অতলান্ত রহস্য আর ছলনার অপরিসীম ক্ষমতা! চমকিত না হয়ে উপায় ছিল না।
এবারেও নাটক শুরু করল ইন্দ্রনাথ স্বয়ং। জয়ন্তকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল, চলে গেছে তো?
থমকে গেল সামনের পক্ক বিম্বাধরের ঋজু দেহবল্লরী। চকিতে স্ফুরিত হয়ে উঠল পাতলা নাসারন্ধ্র। কৃষ্ণশিলায় খোদিত আননের প্রসাধনকলায়, নয়নের রুচিসুন্দর কজ্জ্বললেখায়, পরনের উজ্জ্বল, আশমানী রঙা অঞ্চলের বঙ্কিম রেখায় আর চারু-ললাটের কুমকুমবিন্দুর রাঙা আভায় নিমেষে স্পষ্ট হয়ে উঠল দৃপ্ত ঔদ্ধত্য। সিংহীর মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকা সুরে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল কৃষ্ণ সুন্দরী, তার মানে?
হাসি মুখে হালকা সুরে জবাব দিলে ইন্দ্রনাথ, অত্যন্ত মামুলী প্রশ্ন। আপনার মতো বিদূষী প্রগতিশীলা বুদ্ধিমতী মহিলার কাছেও কি এর বিশদ ব্যাখ্যা করতে হবে? তাছাড়া, অনেকক্ষণ ধরে ও-জানলা থেকে তাকে দেখলাম তো!
তোষামোদের জন্যেই হোক বা ইন্দ্রনাথের আমি-সব-জানি ভাবের জন্যেই হোক, ধীরে ধীরে স্তিমিত প্রদীপশিখার মতোই নরম হয়ে আসে তন্বীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
এরপর যা ঘটল, তা সংক্ষেপে পূর্ব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ ইন্দ্রনাথ একাই ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নাটক জমিয়ে তুলে ক্লাইম্যাক্স এনে ফেলে এবং আগের মতোই আমাদের বিদায় করে অশ্রুনয়না শকুন্তলা সরখেলের কাছে শুনতে বসল তার গোপন কাহিনি।
এর পরের একঘেয়ে পুলিশী তৎপরতার বিবরণ দিয়ে কাহিনিকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। মোটের ওপর, রাত নটার আগে শহরতলীর এই রহস্যময় উপবন মায়াগড় থেকে বেরোতে পারলাম না আমরা তিন বন্ধু।
পথে পড়েই রহস্যতরল কণ্ঠে বললাম, কি হে ইন্দ্রনাথ, শ্যামা শিখরদশনা পীন পয়োধরার সঙ্গে কী কী গোপন কথা বলে এলে জানতে পারি কি, না কবিতাকে এজন্যে নিয়োগ করতে হবে?
কাঁচির আগুনের আভায় দেখলাম, গোঁফের একপ্রান্ত বেঁকিয়ে ফিক করে হাসল ইন্দ্রনাথ। বলল, সেটুকু না হয় সাসপেন্সই থাকুক।
দেখো বন্ধু, শার্লক হোমকে নকল করো না। মা আর মেয়ের মুখে কী কী গোপন কথা শুনেছ, তা না শোনা পর্যন্ত আমি ঘুমোতেই পারব না।
উঁহু, এখন এত কথা বললেই কাহিনির রসটুকুই নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া, তোমাকে দারুণ সাসপেন্সের মধ্যে রাখতে পারলে পাঠকসমাজেরই লাভ। নিজে সাসপেন্সে ছটফট না করলে লেখার মধ্যে সে সাসপেন্স আসবে কেন?
অগত্যা মৌন হলাম।
পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গৃহিণীর সঙ্গে মতবিরোধ এবং ঘোরতর কলহের সম্ভাবনা আছে জেনেও, একটি কথা এই কাহিনিপ্রসঙ্গে নিবেদন করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। রুপোর টাকা উপন্যাস পড়ার দুর্ভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তারা জানেন পূর্বরাগের পরেই এই হতভাগাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়েছিল। এত কাণ্ডের পরেও কিন্তু নারীজাতির মনের অন্দরমহলের বিস্তর অলি-গলি সম্বন্ধে এখনও আমি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে পারিনি এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিধাতার সৃষ্ট এই ফুরফুরে জীবগুলি প্রয়োজনমতো দেবী ও দানবী উভয় রূপই ধারণ করতে পারে।
প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তারিণী সরভেলের হত্যা-রহস্যের গ্রন্থি মোচন করতে গিয়েও আমি সন্দেহ করে বসলাম পূর্ববর্ণিত দুই স্ত্রী-চরিত্রকে। বিশেষত প্রথম সাক্ষাতেই তাঁদের সন্দেহনজনক কার্যকলাপের যেসব নির্দেশন শুনলাম এবং দেখলাম এরপর আর কোনও প্রমাণ ব্যতিরেকেই তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো চলে।
পরের দিন দুপুরে এ সম্পর্কে অনেক ভেবে-চিন্তে আরও তদন্তসাপেক্ষ দুটি সিদ্ধান্ত আমি মনে মনে খাড়া করে ফেললাম। সরকারি আর বেসরকারি গোয়েন্দা বন্ধু দুজনের ক্ষুরধার বুদ্ধি যাতে আমার এই সিদ্ধান্ত পক্ষীর পক্ষ যুক্তিশরে ছিন্নভিন্ন করতে না পারে, সেই জন্যে বসে বসে যথোপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছি, এমন সময়ে টেলিফোন এল ইন্দ্রনাথের কাছ থেকে।
আজকের স্টেটসম্যান দেখেছিস?
দেখেছি।
পার্সোনাল কলম?
না। কেন?
কাল রাত্রেই জয়ন্ত গিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসেছিল ওদের অফিসে। কাগজটা দয়া করে খোলোই না কলমবাগীশ।
খুললাম। রিসিভার রেখে দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেলাম মজাদার বিজ্ঞাপনগুলোর ওপর দিয়ে। এক জায়গায় এসে থমকে থেমে গেলাম।
K. L. TODAY NIGHT TEN
MOULIN ROUGE T. S.
রিসিভার তুলে নিয়ে বললাম, দেখেছি।
কী বুঝলি?
পণ্ডশ্রম।
বটে! কেন শুনি?
খুন যে অথবা যারা করেছেন, তাঁরা ওই মায়াগড়েই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
হাসির শব্দ ভেসে এল তারের মধ্যে দিয়ে।
এ সম্বন্ধে দীর্ঘ বিতর্কের প্রয়োজন। আপাতত টেলিফোনের মধ্যে সেটা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলি, এটা একটা চান্স। পোপার কাটিংয়ের K. L. নামধারী ব্যক্তিই যে হত্যাকারী, তা আমি বলছি না। তবে সে যদি হত্যাকারী হয়, তবে সে আজ রাত্রে মূল রুজে আসবে না। এলে বুঝব, সে নির্দোষ। অবশ্য তাকে চিনতে পারব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে, তাই মিস শকুন্তলা সরখেলও
আমাদের সঙ্গে থাকছেন যদি সনাক্ত করতে পারেন, এই আশায়।
বুঝেছি।
কী বুঝেছ?
তুমি মরেছ।
তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ইন্দ্রনাথ, আরে না, না, তা নয়। তোমরা, এই বিয়ে করা লোকগুলো, সব সময়ে ব্যাচেলরদের এমন সব সন্দেহ করে বসো, যে–
আমার কাছে ওসব সাফাইয়ের দরকার নেই ভাই, আমি কবিতাকে দিচ্ছি।
কবিতা পাশেই ছিল। রিসিভারটা আমার হাত থেকে নিয়েই তো প্রথমে বেশ করে দু-কথা শুনিয়ে দিলে। তারপর লাইন কেটে দিয়ে আমার পানে ফিরে বললে, ঠাকুরপো কি বলছে জানো?
কী?
বলছে, তুমি তো বোম্বাই নগরীর ধনীর দুলালী, তবুও তোমাকে ৩৬০০০ টাকা খরচ করে তৈরি একটা মেয়েদের বাথরুম দেখাব, যদি আজ ঠিক রাত দশটার সময়ে মূলা রুজে আসো। তাছাড়া, বর্তমান কেসের কৌতূহলোদ্দীপক উপসংহার দেখারও আশা করতে পারি। তোমাকে বলেছে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কই আর বলল। বউদিঅন্ত প্রাণ তার।
ঝঙ্কার দিয়ে উঠল গিন্নি, মরণ! ও আবার কি কথা!
.
পার্ক স্ট্রিটের মূলা রুজ রেস্তোরাঁ।
ঘূর্ণায়মান আলোক উইন্ডমিলের সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন দশটা বাজতে দশ মিনিট।
ঢুকেই বাঁদিকে কোণের কেদারাগুলো রিজার্ভ করে রেখেছিল আমার আই.ডি.ডি. বন্ধু জয়ন্তকুমার। আসর জমিয়ে বসেছিল সে, ইন্দ্রনাথ আর শকুন্তলা সরখেল।
কবিতার সঙ্গে শকুন্তলার পরিচয়পর্ব সাঙ্গ হলে পর শুধোলাম, শুধু কি আমরাই আছি, না জয়ন্ত অন্যান্য সাঙ্গ-পাঙ্গও এনেছ?
প্রয়োজন আছে কি? বলল জয়ন্ত।
লক্ষ্য করলাম, দু-বন্ধুরই সজাগ চাহনি প্রবেশ পথের ওপর নিবদ্ধ। যতবার দরজা খুলে যাচ্ছে, ততবারই চকিত হয়ে উঠেছে দুজনে, এবং শকুন্তলা সরখেলও দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে প্রতিজনের ওপর।
কব্জি ঘড়িতে দেখলাম, ছোট কাটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে বড় কঁটা; রাত দশটা।
অনেকেই টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। এল নতুন যুগলমূর্তি। নতুন তান ধরল ক্যাবারে মিউজিক পার্টি। গমগমে জ্যাজ সঙ্গীত।
রাত দশটা পনেরো মিনিট।
হতাশ হয়ে তাকালাম বন্ধুদের পানে। একমাত্র শকুন্তলা সরখেলই দেখলাম অবদমিত উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে, হাতে ধরা কফির পেয়ালাও নিষ্কম্প নয়।
চুক চুক করে চুমুক দিতে দিতে ইন্দ্রনাথ বললে কবিতাকে বউদি, ছত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে তৈরি জুলিয়েটদের বাথরুমটা দেখে এসো এইবেলা–মাথা ঘুরে যাবে-খন।
কিন্তু তার আগেই আবার খুলে গেল স্প্রিংডোর–টকটকে লাল রঙের পুরু গালিচার ওপর পা দিলেন খদ্দর পরিহিত এক প্রৌঢ়মূর্তি। চোখে পুরুলেন্সের মোটা চশমা। মুখভাব অত্যন্ত গম্ভীর।
মুখটা যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি বলে মনে হল–বড় পরিচিত মুখ। কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল জয়ন্ত, কার্তিক লাহিড়ী।
কার্তিক লাহিড়ী! পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জাঁদরেল মন্ত্রী কার্তিক লাহিড়ী। কেন্দ্রীয় দপ্তরে যাঁর অসীম প্রভাব, বাংলার জনগন-মানসে যিনি বর্তমানে ধ্রুবতারার মতো প্রোজ্জ্বল–সেই কার্তিক লাহিড়ী এত রাতে মূলা রুজে?
পরক্ষণেই দারুণ চমকে উঠলাম আমি। হয়তো চেঁচিয়েই উঠতাম যদি না ইন্দ্রনাথ পাশ থেকে মোক্ষম চিমটি কেটে স্তব্ধ করে দিত আমায়।
কার্তিক লাহিড়ী! K. L.! ইনিই কি তাহলে স্টেটম্যানে বিজ্ঞাপিত সেই K. L.?
অদূরেই একা শূন্য টেবিল অধিকার করেছিলেন স্বনামধন্য মন্ত্রী কার্তিক লাহিড়ী। চারপাশের বিলাতি পরিচ্ছদ আর ফরাসি পরিবেশের মাঝে তার খাঁটি গান্ধী পোশাক বেশি করে প্রত্যেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হল না। স্টুয়ার্ড এসে অর্ডার নিয়ে যাওয়ার পর ইয়া মোটা একটা সিগার বার করে অগ্নিসংযোগ করলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফির সরঞ্জাম এসে পৌঁছল। অন্যমনস্কভাবে ধুমোদগীরণ করতে করতে কফি তৈরি করলেন। তারপর পকেট থেকে একটা শিশি বার করে খানিকটা তরল পদার্থ ঢাললেন পেয়ালার কফিতে–সম্ভবত কৃত্রিম শর্করা–চিনি খাওয়া নিষেধ স্বাস্থ্যের জন্যে।
আরও মিনিট কয়েক পরে জয়ন্ত চোখের ইঙ্গিত করল ইন্দ্রনাথকে। উঠে দাঁড়াল দুজনে।
–আমিও কলের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে–তিনজনেই লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলাম মন্ত্রীমহাশয়ের টেবিল অভিমুখে।
টেবিলের সামনে পৌঁছলাম। আসন গ্রহণ করলাম। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হল, পৃথিবীতে ওই টর্পেডোর মতো চুরুট ছাড়া আর কোনও বস্তু আছে বলে মন্ত্রীমহোদয়ের জানা নেই। কিন্তু আমার সন্দেহ হল আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে উনি অনেক আগে থেকেই সচেতন–বোধ করি আমাদের জোড়া জোড়া শিকারি কুকুরের মতো একাগ্র দৃষ্টির জন্যেই।
গলা-খাঁকারি দিয়ে জয়ন্ত বললে, নমস্কার স্যার, এ সময়ে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। আমি ডি-ডিতে হোমিসাইড সেকশনের ইনচার্জ।
আমিও তাই অনুমান করেছিলাম,সিগার না নামিয়েই এই প্রথম গুরুগম্ভীর স্বরে কথা বললেন কার্তিক লাহিড়ী।
কোনওরকম গৌরচন্দ্রিকা না করে কথোপকথনকে একেবারে সংক্ষিপ্ত করে আনলে জয়ন্ত। কর্তব্যকঠিন নীরস স্বরে বলে উঠল, নিশ্চয় শুনেছেন গাইনিকোলোজিস্ট তারিণী সরখেল আত্মহত্যা করেছেন?
আত্মহত্যা করেনি; খুন হয়েছে।
আপনি জানলেন কী করে?
খুনটা আমিই করেছি।
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম আমি। আমার সুহৃদযুগলের অবস্থাও যে তথৈবচ, তা পাশে না তাকিয়ে বুঝলাম আমি।
ক্ষণেকের জন্যে কনসার্ট স্তব্ধ হতেই থমথমে নৈঃশব্দ্য নেমে এল চার দেওয়ালের মধ্যে।
ইন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম ফিসফিস করে বলে উঠল, আপনি বিষ খেলেন?
হ্যাঁ, খেলাম, ঘরে ঢুকেই শকুন্তলাকে দেখেছিলাম আমি। তাছাড়া, বিজ্ঞাপন পড়েই বুঝেছিলাম আমার লীলাখেলা ফুরিয়েছে। আশা করি, আমার আঙুলের ছাপও পেয়েছ তোমরা। তাছাড়া, কাজটা করার পর আমার অনুতাপের অন্ত নেই। কিন্তু সব ব্ল্যাকমেলিংয়েরই তো এই একই পরিণতি।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মন্ত্রীকার্তিক লাহিড়ী। নির্মীলিত চোখে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সময় খুব সংক্ষিপ্ত–কাজেই তোমাদের রিপোর্টের খোরাক এখুনি দিয়ে যাচ্ছি। অরিণী সরখেল আমার বাল্যবন্ধু। তার মতো শয়তান, সমাজশত্রু আর নিষ্ঠুর মানুষ আর দুটি দেখিনি। ছাত্রজীবনেও তার কীর্তিকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। কিন্তু সে মেধাবী। তাই স্ত্রীরোগ বিদ্যায় বিলেত থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে এল সে। আর এই বিদ্যেই হল তার পাপাচারের প্রধান হাতিয়ার। সব কথা বলার সময় নেই, শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, তার মৃত্যুতে সমাজের ক্ষতি হয়নি এতটুকু, বরং উপকার হয়েছে প্রচুর। সম্ভ্রান্ত ঘরের কত নিরীহ মহিলা আর পুরুষ নিস্তার পেয়ে গেল তার বিরাট ব্যাপক শোষক যন্ত্রের নিষ্পেষণ থেকে।
জীবনে আমি একবারই ভালোবেসেছিলাম–এবং তা যৌবনে, যখন ভোমরার গুঞ্জনকে মনে হত মোজার্টের সঙ্গীত। জীবনে তখনও আমি প্রতিষ্ঠা পাইনি–কিন্তু মেয়েটি ছিল বাংলার এক বিখ্যাত ধনীর একমাত্র কন্যা। কাজেই যা হবার তাই হল। এই মুহূর্তে সে এখন এই কলকাতারই নাইট খেতাব-ধন্য এক সুবিখ্যাত ধনকুবেরের ঘরনী। পূর্বরাগকালীন উচ্ছ্বাস মুহূর্তে আমাকে কয়েকটা চিঠি লিখেছিল সে। তার কয়েকটিতে দুর্বার প্রণয়াবেগের এমন নিদর্শন ছিল, এবং এমন কয়েকটি নিষিদ্ধ কথা ছিল, যার প্রতিলিপি কাগজে কাগজে ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টি-টি পড়ে যাবে বাংলাদেশে, এবং মেয়েটির তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।
জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসার জন্যেই বুঝি একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলে বেদম হয়ে পড়েছিলেন কার্তিক লাহিড়ী। দম নেওয়ার জন্যে থামতেই ইন্দ্ৰনাথ শুধোলে, সেই চিঠিগুলো ডক্টর সরখেলের হস্তগত হয়েছে?
হ্যাঁ। এবং এই চিঠি কাগজে ছাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে সে এত বছর ধরে সমানে আমাকে আর সেই মেয়েটিকে শোষণ করে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমি মরিয়া হয়ে গেলাম; ভেবে দেখলাম, এভাবে সারাজীবন নিদারুণ উদ্বেগের মধ্যে থাকার চাইতে এরকম একটা ক্লেদাক্ত জোঁককে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়াই ভালো।
তাই সেদিন রাতে মায়াগড়ে গিয়েছিলাম সাইলেন্সার ফিট করা রিভলভার নিয়ে। গাড়ি রেখেছিলাম, প্রধান তোরঙ্গ থেকে অনেকদূর। তারিণী টেবিলেই বসেছিল। অত রাতে আমাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল ও। আমি অনেক করে ওকে বোঝালাম, কাকুতি মিনতি করলাম চিঠিগুলো নষ্ট করে ফেলে আমাদের চিরতরে রেহাই দেওয়ার জন্যে। শেষে একটা রফা হল। চিঠি আমি ফেরত পাব না; কেননা, নিরস্ত্র হয়ে রাজ্যের মন্ত্রীর হাতে নাজেহাল হওয়ার মতো উজবুক নাকি সে নয়, তাই চিঠিগুলো সে নিজের কাছেই রেখে দেবে। তবে এই শেষ; একটা মোটা টাকা পেলেই আর সে আমাদের বিরক্ত করবে না।
আমিও তাই চাইছিলাম। বললাম, কথাটা লিখে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হল সে। কেননা, এ-লেখার কোনও মূল্যই তো নেই। কাগজ টেনে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখে কলমে কালি নেই। দোয়াত খুলে কালি ভরে নিলে সে। তারপর লিখলে?
এই শেষ। আর আমি তোমাকে জ্বালাবো না।
তারিণী সরখেল।
সইটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুচক্রী তারিণী নিশ্চয় আমার মতলবটা আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু আমি আর সময় দিলাম না, ও লাফিয়ে ওঠার আগেই টেবিলের সামনে থেকে এক গুলিতে ফুটো করে দিলাম ওর হৃদ্যন্ত্র। টেবিলের ওপরেই মাথা রেখে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ল সমাজের জঘন্যতম অপরাধী তারিণী সরখেল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে দু-একবার হাত ছুঁড়েছিল– তাইতেই দোয়াতটা গেল উল্টো। স্বীকারোক্তি লেখা কাগজটা পড়ল মেজেতে। লোহার আলমারির কোন কে চিঠিগুলো আছে, তা জানতাম। ওরই পকেট থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে চিঠির তাড়াটা পকেটস্থ করলাম। তারপর ওর স্বীকারোক্তি লেখা কাগজটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে নিয়ে বাঁ-হাতের মুঠিতে গুঁজে দিলাম রিভলভারটা। সাইলেন্সারটা শুধু খুলে নিয়ে রাখলাম পকেটে।
কিন্তু অনভ্যস্ত খুনি হিসেবে আমি চারটি ভুল করেছিলাম, মাথা ঠান্ডা হলে পর ভুলগুলো আপনা হতেই ধরা পড়েছিল আমার কাছে।
প্রথম ভুল, বাঁ-হাতে রিভলভার দেওয়া। আমি নিজে ল্যাটা। উত্তেজনার মুহূর্তে আমি তাই তারিণীর বাঁ-হাতটাই তুলে নিয়েছিলাম।
দ্বিতীয় ভুল, খবরের কাগজের কাটিংটা ফেলে আসা।
তৃতীয় ভুল, বিস্তর আঙুলের ছাপ ফেলে আসা।
চতুর্থ ভুল, তারিণী স্থির হয়ে যাবার পর দোয়াতের কালি ওর মাথা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আমার উচিত ছিল ওর মাথার নীচেও খানিকটা কালি গড়িয়ে দেওয়া।
বুক ভরে কয়েকবার শ্বাস নিলেন কার্তিক লাহিড়ী। তারপর স্খলিত স্বরে বললেন, কিন্তু এত ভুল সত্ত্বেও আমি সন্দেহের বাইরে থাকতাম। কিন্তু মরেও তারিণী আমায় মেরে গেল। বাড়ি গিয়ে চিঠির বান্ডিল খুলতেই তারিণীরই লেখা একটা চিরকুট পেলাম। তাতে লেখা, আমার অনিচ্ছায় এই তাড়া যদি তোমার হাতে যায়, তাহলে জেনো তুমি ফেঁসে গেলে। কেননা, এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ চিঠিটা যাতে যথাসময়ে প্রেসে যায়, সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।
আবার থামলেন কার্তিকবাবু। শেষবারের মতো ফুসফুঁসে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে বললেন, কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুলটা কি জানো? তোমরা একালের ছেলে, শুনে হাসবে। কিন্তু আমি এসব খুব মানি। সেই রাত্রে তারিণীকে খুন করার জন্যে বাড়ি থেকে বেরনোর আগে দরজার পাশেই, একটা শূন্য কলসি গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলাম। জানি না, জানো কিনা, খনার বচনেই আছে :
শূন্য কলসি শুকনা না।
শুকনা ডালে ডাকে কা।।
যদি দেখ মাকুন্দ ধোপা।
এক পা যেও না বাপা।।
খনা বলে এ-ও ঠেলি।
যদি সামনে না দেখি তেলি।।
বলে, পাণ্ডুর মুখে হাসবার চেষ্টা করলেন কার্তিক লাহিড়ী। কিন্তু সে হাসির পরিবর্তে কান্নাই মূর্ত হয়ে উঠল তাঁর পুরু লেন্সের ওপারে ঘোলাটে চোখে।
আর দেরি করা সঙ্গত নয়। উঠে দাঁড়ালাম আমরা তিন বন্ধু। ধরাধরি করে প্রৌঢ় কার্তিক লাহিড়ীকে নিয়ে এলাম বাইরে।
গাড়ির মধ্যেই চির-শান্তির দেশে রওনা হলেন তিনি।
.
ভাঙা তক্তপোষের ওপর পদ্মাসনে বসে মৌজ করে গঞ্জিকা সেবনের মতো কাঁচিতে দমভোর এক টান দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, তারিণী সরখেলের যে একদিন এই রকম শোচনীয় মৃত্যু হবে, তা আমি জানতাম। সেই জন্যেই জয়ন্তর মুখে ভদ্রলোকের আত্মহত্যার খবর শুনে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি। এরকম একটা জঘন্য শোষক কখনো আত্মহত্যা করে না করতে পারে না।
কবিতা বললে, খামোকা তুমি আবার মরা লোকটাকে গালাগাল দিচ্ছ কেন?
খামোকা নয় বউদি, তারিণী সরখেলের কীর্তিকাহিনি অনেক আগেই আমার কানে এসেছে। মক্কেলের হয়ে তার সঙ্গে আমাকেও মোলাকাত করতে হয়েছে। লোকটার নৃশংসতা দেখে আমার গা রী রী করে উঠলেও কিছু করতে পারিনি। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে তিনি যে কত অভিজাত মহিলার সর্বনাশ করেছেন, তারপর ব্ল্যাকমেল করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
অসহিষ্ণু স্বরে বললাম, পাস্ট ইস পাস্ট। আমি এখুনি শুনতে চাই মা আর মেয়ে যে খুন করেননি, এটা তুমি জানলে কখন?
তাঁদের মুখেই শুনলাম। হত্যার রাতে ঘুম না আসায় জানলায় দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস সরখেল। হঠাৎ অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তিকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সন্দেহ হয় ওঁর। নীচে নেমে এসেই নিহত স্বামীকে দেখে উনি মুচ্ছা যান। জ্ঞান ফিরে পান অনেক রাত্রে। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি না হারিয়ে চটপট টেবিলের ড্রয়ার থেকে কতকগুলো কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। আঙুলে কালি লেগে যায় তখনই। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট উল্টে তার ওপর দাঁড়িয়ে আলমারির তাকেও এই কাগজ খুঁজতে হয়েছে। আঁকে। সেই সময় দোমড়ানো বাস্কেটে একটা লাল সুতো লেগে গিয়েছিল।
কবিতা শুধোলে কাগজগুলো কি সম্পর্কিত?
ইন্দ্রনাথ বললে, সেটা গোপনীয়। আমি কথা দিয়েছি।
চোখ পাকিয়ে কবিতা বললে, বটে, আমার কাছে আবার গোপনীয়তা!
আঃ জ্বালিয়ে মারলে। তবে শোনো, কিন্তু দয়া করে মেয়েমহলে আলোচনা কোরো না। তারিণী সরখেল তাঁর স্ত্রীকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন।
কী করে?
বিয়ের আগেই শকুন্তলা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। চিকিৎসার অছিলায় এই কাণ্ড করেন তারিণী সরখেল। তারপর বিবাহ এবং মায়াগড়ের মতো বিশাল সম্পত্তি লাভ। মায়াগড়ের পুরোনো পরিচারক রামহরির মুখেও একাহিনি শুনতে পারো তুমি।
কিন্তু কাগজগুলো কীসের?
এই কেলেঙ্কারির প্রমাণ ছিল এই সব কাগজপত্রে। মেয়ে বড় হয়েছে, তাই যাতে স্বামীর মৃত্যুর পর একথা আর কেউ না জানতে পারে, বিশেষ করে নিজের মেয়ের কানেও যাতে না ওঠে, তাই অমন দুঃসাহসী হয়েছিলেন মিসেস সরখেল।
শুধোলাম, এতদূর পর্যন্ত বোঝা গেল। কিন্তু বোঝা গেল না শকুন্তলা সরখেলের জানলার সামনে হাত নাড়া আর সেই শিসের অর্থ।
মুচকি হেসে বললে ইন্দ্রনাথ, উঠতি বয়েসে সব জুলিয়েটদেরই ওরকম দু-একটা রোমিও জোটে।
ও। কিন্তু শিসটা?
ন্যাকামো করো না। বিয়ের আগে প্রেম করার সময়ে শিস টি দিয়ে বউদিকে কোনওদিন ডাকোনি বলতে চাও?
মুখে আগুন তোমার! বলল কবিতা।* * রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত (মে-জুন, ১৯৬৪)