শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব
সাজিদের কাছে একটি মেইল এসেছে সকালবেলা। মেইলটি পাঠিয়েছে তার নাস্তিক বিপ্লব ধর। বিপ্লব দা’কে আমিও চিনি। সদা হাস্য এই লোকটার মাঝে মাঝেই টি.এস.সিতে দেখা হতো। দেখা হলেই উনি একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুই কি এখন রাতের বেলা ভুত দেখিস?’
বিপ্লব দা মনে হয় হাসিটি প্রস্তুত করেই রাখতো। দেখা হওয়া মাত্রই প্রদর্শন। বিপ্লব দা’কে চিনতাম সাজিদের মাধ্যমে। সাজিদ আর বিপ্লব দা একই ডিপার্টমেন্টের। বিপ্লব দা সাজিদের চেয়ে দু ব্যাচ সিনিয়র।
সাজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে প্রথম নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলো, তার পুরো ক্রেডিটটাই বিপ্লব দা’র। বিপ্লব দা তাকে বিভিন্ন নাস্তিক, এগনোষ্টিকদের বই-টই পড়িয়ে নাস্তিক বানিয়ে ফেলেছিল। সাজিদ এখন আর নাস্তিক নেই।
আমি ক্লাশ শেষ করে রুমে ডুকে দেখলাম সাজিদ বরাবরের মতোই কম্পিউটার গুতাচ্ছে।
আমাকে দেখা মাত্রই বলল, ‘তোর দাওয়াত আছে।’
-‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সাজিদ বলল, -‘বিপ্লব দা দেখা করতে বলেছেন।’
আমার সাথে উনার কোন লেনদেন নেই। আমাকে এভাবে দেখা করার হেতু কি বুঝলাম না। সাজিদ বলল, ‘ঘাবড়ে গেলি নাকি? তোকে একা না আমাকেও।’
এই বলে সাজিদ দা’র মেইলটি ওপেনকরে দেখাল। মেইলটি হুবহু এরকম, –
‘সাজিদ
আমি তোমাকে একজন প্রগতিশীল, উদারমন সম্পন্ন, মুক্তমনা ভাবতাম। পড়াশুনা করে তুমি কথিত ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তুমি যে আবার সি অন্ধ বিশ্বাসের জগতে ফিরে যাবে – সেটা কল্পনাও করি নি আমি। আজ বিকেলে বাসায় এসো। তোমার সাথে আলাপ আছে।’
আমরা খাওয়া দাওয়া করে, দুপুরের নামাজ পড়ে বিপ্লব দা’র সাথে করার জন্য বের হলাম। বিপ্লব দা আগে থাকতেন বনানী, এখন থাকেন কাঁটাবন। জ্যাম ট্যাম কাটিয়ে আমরা যখন বিপ্লব দা’র বাসায় পৌছাই, তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। বিপ্লব দা’র সাথে হ্যান্ডসেক করে আমরা বসলাম না। সাজিদ বলল, ‘দাদা আলাপ একটু পরে হবে। আসরের নামাজটা পড়ে আসি আগে।’
বিপ্লব দা না করলেন না। আমরা বেরিয়ে গেলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে ব্যাক করলাম উনার বাসায়।
বিপ্লব দা ইতিমধ্যেই কফি তৈরি করে রেখেছেন। খুবই উন্নতমানের কফি। কফির গন্ধটা পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সাজিদ কফি হাতে নিতে নিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিপ্লব দা’র এর কফি বিশ্ববিখ্যাত। ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের কফি। এইটা কানাডা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিপ্লব দা কানাডা থেকে অর্ডার করিয়ে আনেন।’
কফির কাপে চুমুক দিয়ে মনে হল আসলেই সত্যি। এত ভালো কফি হতে পারে ভাবাই যায় না।
সাজিদ এবার বিপ্লব দা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলাপ শুরু হোক।’
বিপ্লব দা’র মুখে সদা হাসি ভাবটা আজকে নেই। উনার পরম শিষ্যের এরকম অধঃপতনে সম্ভবত উনার মন কিছুটা বিষণ্ণ। তিনি বললেন, ‘তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তবে, তোমাকে একটি বিষয়ে বলার জন্যই আসতে বলেছি। হয়তো তুমি ব্যাপারটি জেনে থাকবে -তবুও।’
সাজিদ কফির কাজে চুমুক দিয়ে বলল, ‘জানা বিষয়টাও আপনার মুখ থেকে শুনলে মনে হয় নতুন জানছি। আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি তা তো আপনি জানেনই।’
বিপ্লব দা কোন ভুমিকায় গেলেন না। সরাসরি বললেন, ‘ওই যে, তোমার সৃষ্টিকর্তা, উনার ব্যাপারে বলতে চাই। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি হয়তো এ ব্যাপারে জানো। সম্প্রতি বিজ্ঞান প্রমান করেছে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিকর্তার কোন দরকার নেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকেই। আগে তোমরা, মানে বিশ্বাসীর বলতে, একটা সামান্য সূচও যখন কোন কারিগর ছাড়া এমনি এমনি তৈরি হতে পারে না, তাহলে এই গোটা মহাবিশ্ব কিভাবে তৈরি হবে আপনা আপনি? কিন্তু বিজ্ঞান এখন বলছে, এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে আপনা আপনিই তৈরি হয়েছে। কারো সাহায্য ছাড়াই।’
এই কথাগুলো বিপ্লব দা এক নাগাড়ে বলে গেলেন। মনে হয় তিনি কোন নিঃশ্বাসই নেন নি এতক্ষন।
সাজিদ বলল, ‘অদ্ভুত তো। তাহলে তো আমাকে নাস্তিক হয়ে যেতে হবে দেখছি। হা হা হা হা।’
সাজিদ চমৎকার একটা হাসি দিল। সাজিদ এইভাবে হাসতে পারে, তা আমি আজই প্রথম দেখলাম। বিপ্লব দা সেদিকে মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হল না। উনি মোটামুটি একটা লেকচার শুরু করেছেন। আমি আর সাজিদ খুব মনযোগী ছাত্রের মতো উনার বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুনছিলাম। তিনি যা বুঝালেন, বাঁ বললেন, তার সার সংক্ষেপ এরকম।
‘পদার্থ বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি থিউরি আছে, সেটি হল, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মুল কথা হল, মহাবিশ্বে পরম শূন্য স্থান বলে আদতে কিছু নেই। মানে, আমরা যেটাকে Nothing বলে জেনে এসেছি, বিজ্ঞান বলছে, আদতে Nothing বলতে কিছুই নেই। প্রকৃতি শূন্য স্থান পছন্দ করে না। তাই যখন কোন শূন্যস্থান (Nothing) তৈরি হয়, সেখানে এক সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে কনা এবং প্রতিকনা (Matter & anti-matter) তৈরি হচ্ছে, এবং একটির সাথে অন্যটির ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তোমরা জান কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ধারনা কোথা হতে এসেছে?’
আমি বললাম, ‘না।’
বিপ্লব দা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এই ধারণা এসেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ থেকে। হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত সূত্রটা তোমরা জানো নিশ্চয়ই?’ সাজিদ বলল, ‘হ্যাঁ, হাইজেনবার্গ বলেছেন, আমরা কখনও একটি কনার অবস্থান এবং এর ভরবেগের সঠিক পরিমান একসাথে একুরেইটলি জানতে পারব না। যদি অবস্থান সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর ভরবেগের মধ্যে গলদ থাকবে। আবার যদি ভরবেগ সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর অবস্থানের মধ্যে গলদ থাকবে। দুটো একসাথেই সঠিকভাবে জানা কখনই সম্ভব না। এইটা যে সম্ভব না, এটা বিজ্ঞানের অসারতা না, আসলে এটা হল কনার ধর্ম বাঁ বৈশিষ্ট্য।’
বিপ্লব দা বললেন, ‘এক্সাক্টলি। একদম তাই। হাইজেনবার্গের এই নীতিকে শক্তি আর সময়ের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা যায়। হাইজেনবার্গের এই নীতি যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্বে ‘শূন্যস্থান’ বলে কিছু থাকতে পারেনা। যদি থাকে, তাহলে তার অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই শূন্য চলে আসে, যা হাইজেনবার্গের নীতি বিরুদ্ধ।’
এইটুকু বলে বিপ্লব দা একটু থামল। কফির পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘বুঝতেছ তোমরা?’
সাজিদ বুঝেছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও, বিপ্লব দা’র উপস্থাপন ভঙ্গিমা সেটাকে অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলেছে। ভালো লাগছে।
বিপ্লব দা কফিতে চুমুক দিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তাহলে তোমারা বলো না, যে বিগ ব্যাং এর আগে তো কিছুই ছিল না। না সময়, না শক্তি, না অন্যকিছু। তাহলে বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণটি হল কিভাবে? এর জন্য নিশ্চয়ই কোন শক্তি দরকার? কোন বাহ্যিক বল দরকার, তাই না? এটাই বলে তোমরা স্রষ্টার ধারণাকে জায়েজ করতে। তোমরা বলতে, এই বাহ্যিক বলটি এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু দেখ, বিজ্ঞান বলছে, এইখানে স্রষ্টার কোন হাত নেই। বিগ ব্যাং হবার জন্য যে শক্তি দরকার ছিল, সেটা এসেছে এই কোয়ান্টাম ফ্লায়েকচুয়েশন থেকে। সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বিজ্ঞান ডাইরেক্ট না বলে দিয়েছে। আর, তোমরা এখন স্রষ্টা স্রষ্টা করে কোথায় যে পরে আছ।’
এতটুকু বলে বিপ্লব দা’র চোখ মুখ ঝলমলিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, উনি যে উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এখানে ডেকেছেন তা সফল হয়ে গেছে। আমরা হয়তো উনার বিজ্ঞানের উপর এই জ্ঞান গর্ভ লেকচার শুনে এক্ষুনি নাস্তিকতার উপর ঈমান নিয়ে আসব।
যাহোক, ইতিমধ্যে সাজিদ দু কাপ কফি গিলে ফেলেছে। নতুন এক কাপ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এই ব্যাপারে স্টিফেন হকিংয়ের বই আছে। নাম -‘The grand design’। এটা আমি পরেছি।’
সাজিদের কথা শুনে বিপ্লব দা’কে খুব খুশি মনে হল। তিনি বললেন, ‘বাহ, তুমি তাহলে পড়াশুনা স্টপ করনি? বেশ বেশ। পড়াশুনা করবে। বেশি বেশি পড়বে।’
সাজিদ হাসল। হেসে সে বলল, ‘কিন্তু দাদা, এই ব্যাপারে আমার কনফিউশান আছে।’
-‘কোন ব্যাপারে?’
-‘ষ্টিফেন হকিং আর লিওনার্ড ম্লোদিনোর বই The grand design এর ব্যাপারে।’
বিপ্লব দা একটু থতমত খেলো বলে মনে হল। মনে হয় উনি মনে মনে বলছে – এই ছেলে দেখি খোদার উপর খোদাগিরি করছে।
তিনি বলল, -‘ক্লিয়ার করো।’
সাজিদ বলল, -‘আমি দুইটা দিক থেকেই এটার ব্যাখ্যা করবো। বিজ্ঞান এবং ধর্ম।
যদি অনুমতি দেন।’
-‘অবশ্যই।’ বিপ্লব দা বললেন।
আমি মুগ্ধ শ্রোতা। গুরু এবং এক্স-শিষ্যের তর্ক জমে উঠেছে।
সাজিদ বলল, ‘প্রথমে কথা হচ্ছে, ষ্টিফেন হকিং এর এই থিওরিটা এখনো ‘থিওরি’, সেটা ফ্যাক্ট নয়। এই ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস। তিনি এইটা নিয়ে বিশাল সাইজের বই লিখেছেন। বইটার নাম ছিল ‘A universe from nothing’
অনেক পরে, এখন ষ্টিফেন এটা নিয়ে উনার The grand design এ কথা বলেছেন। উনার এই বইটি প্রকাশ হবার পর সি এন এনের এক সাংবাদিক হকিংকে জিজ্ঞেস করেছিলো, -‘আপনি কি ইসসরে বিশ্বাস করেন?’
হকিং বলেছিল, -‘ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে, তবে, মহাবিশ্ব তৈরিতে তার প্রয়োজন নেই।’
বিপ্লব দা বলল, ‘সেটাই, উনি বুঝালেন যে, ঈশ্বর মূলত ধার্মিকদের একটি অকার্যকর বিশ্বাস।’
-‘হকিং কি বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু হকিংয়ের ওই বইটি অসম্পূর্ণ। কিছু গলদ আছে।’
বিপ্লব দা কফির কাপটি রাখতে রাখতে বললেন, ‘গলদ? মানে?’
– ‘দাঁড়ান, বলছি। গলদ মানে, উনি কিছু বিষয় বইতে ক্লিয়ার করেন নি। যেহেতু এটা বিজ্ঞান মহলে প্রমানিত সত্য নয়, তাই এটা বিজ্ঞান মহলে প্রচুর বিতর্কিত হয়েছে।
উনার বইতে যে গলদগুলো আছে তা সিরিয়ালি বলছি।
গলদ নাম্বার ১ –
হকিং বলছেন, শূন্য থেকেই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে বস্তু কনা তৈরি হয়েছে, এবং সেটা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিউট্রালাইজ হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল, শূন্য বলতে হকিং কি একদম Nothing (কোন কিছুই নেই) বুঝিয়েছেন, নাকি Quantum vaccum (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটা ক্লিয়ার করেন নি। হকিং বলেছেন, শূন্যস্থানের বস্তু কনার মাঝে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হতে হলে সেখানে মহাকর্ষ বল প্রয়োজন। কিন্তু ওই শূন্যস্থানে (যখন সময় আর স্থানও তৈরি হয় নি) ঠিক কোথা থেকে এবং কিভাবে মহাকর্ষ বল এলো, তার কোন ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।
গলদ নাম্বার – ২
হকিং তার বইতে বলেছেন, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে একদম শূন্য থেকে, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে। তখন ‘সময়’ (Time) এর আচরন আজকের সময়ের মতো ছিল না। তখন সময়ের আচরন ছিল ‘স্থান’ (Space) এর মতো। কারন, এই ফ্ল্যাকচুয়েশন হবার জন্য প্রাথমিকভাবে সময়ের দরকার ছিল না, স্থানের দরকার ছিল। কিন্তু হকিং তার বইতে এই কথা বলেন নি যে, যে সময় মহাবিশ্বের একদম শুরুতে ‘স্থান’ এর মতো আচরন করেছে, সেই ‘সময়’ পরবর্তীতে ঠিক কবে আর কখন থেকে আবার Time এর মতো আচরন শুরু করলো এবং কেন?’
আমি বিপ্লব দা’র মুখের দিকে তাকালাম। তার চেহারার উৎফুল্ল ভাবটা চলে গেছে।
সাজিদ বলে যাচ্ছে,
‘গলদ নাম্বার – ৩
পদার্থ বিদ্যার যে সুত্র মেনে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হল, তখন শূন্যবস্থায় পদার্থবিদ্যার এই সুত্রগুলো বলবত থাকে কি করে? এটার ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।
গলদ নাম্বার – ৪
আপনি বলেছেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, শূন্যস্থান পুরন করতে আপনা আপনি কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল – যেখানে আপনি শূন্যস্থান নিয়ে কথা বলছেন, যখন সময় ছিল না, স্থান ছিল না, তখন আপনি প্রকৃতি কোথায় পেলেন?’
সাজিদ হকিংয়ের বইয়ের পাচ নাম্বার গলদের কথা বলতে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লব দা বললেন, ‘ওকে ওকে। বুঝলাম। আমি বলছি না যে এই জিনিসটা একেবারে সত্যি। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। আলোচনা-সমালোচনা হবে। আরো পরিক্ষা নিরিক্ষা হবে। তারপর ডিসাইড হবে যে এটা ঠিক না ভুল।’
সাজিদের কাছে বিপ্লব দা’র এরকম মৌন পরাজয় আমাকে খুব তৃপ্তি দিল। মনে মনে বললাম, ‘ইয়েস সাজিদ, ইউ ক্যান।’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, সে পরিক্ষা চলতে থাকুক। যদি কোন দিন এই থিওরি সত্যিও হয়ে যায়, তাহলে আমাকে ডাক দিয়েন না দাদা। কারন, আমি কোরআন দিয়েই প্রমান করে দিতে পারব।’
সাজিদের এ কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে গেল। কি বলে রে? এতক্ষন যেটাকে গলদপূর্ণ বলেছে, সেটাকে আবার কোরআন দিয়ে প্রমান করবে বলছে? ক্যামনে কি?
বিপ্লব দা’ও বুঝলোনা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম?’
সাজিদ হাসল। বলল, -‘শূন্য থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা আল কোরআনে বলা আছে দাদা।’
আমি আরো অবাক। কি বলে এই ছেলে?
সে বলল, ‘আমি বলছি না যে কোরআন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছে। কোরআন যার কাছ থেকে এসেছে, তিনি তার সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সেটা বিগ ব্যাং আসলেও পাল্টাবে না, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন থিওরি আসলেও পাল্টাবে না। একই থাকবে।’
বিপ্লব দা বলল, ‘কোরআনে কি আছে বললে যেন?’
-‘সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে আছে –
“যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনায়ন করেন (এখানে মূল শব্দ ‘বাদ্যিয়ূ’ Originator- সেখান থেকেই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ধারণা) এবং যখন তিনি কিছু করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তখন শুধু বলেন হও, আর তা হয়ে যায়। ”
‘Creator of heavens and earth from nothingness, He has only to say when he is wills a thing, “Be” and it is’…
দেখুন আমি আবার বলছি, আমি এটা বলছি না যে, আল্লাহ তায়ালা এখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছেন। তিনি তার সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি ‘অনস্তিত্ব’ (Nothing) থেকে ‘অস্তিত্বে’ (something) এ এনেছেন। এমন না যে, আল্লাহ তার হাত দিয়ে প্রথম মহাবিশ্বের ছাদ বানালেন। তারপর তাতে সূর্য, চাঁদ, গ্যালাক্সি এগুলো একটা একটা বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল নির্দেশ দিয়েছেন।
হকিংও একই কথা বলেছে। কিন্তু তারা বলছে বলছে, এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে, শূন্য থেকেই। আল্লাহ বলছেন, নাহ এমনি হয় নি। আমি যখন নির্দেশ করেছি ‘হও’ (কুন), তখন তা হয়ে গেল।
হকিং ব্যাখ্যা দিতে পারছে না এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের জন্য মহাকর্ষ বল কোথা থেকে এল, ‘সময়’ কেন, কিভাবে ‘স্থান’ হল, পরে আবার সেটা ‘সময়’ হল।
কিন্তু আমাদের স্রষ্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘হতে’ আর তা হয়ে গেল।
ধরুন, একটা ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ান বসে আছে স্টেজের এক কোনায়। কিন্তু সে তার চোখের ইশারায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দর্শক দেখছে, খালি টেবিলের উপর হঠাত একটা কবতর তৈরি হয়ে গেল, এবং সেটা উড়েও গেল।
দর্শক কি বলবে এটা কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে হয়ে গেছে? না, বলবে না। এর পিছনে ম্যাজিশিয়ানের কারসাজি আছে। সে স্টেজের এক কোনা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে বলেই এটা হয়েছে।
স্রষ্টাও সেরকম। তিনি শুধু বলেছেন, ‘হও’, আর মহাবিশ্ব আপনা আপনি হয়ে গেলো। ….
আপনাদের সেই শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব কেবল ওই ‘হও’ পর্যন্তই।’
মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লব দা’কে অনেকটাই হতাশ দেখলাম।
আমরা বললাম, ‘আজ তাহলে উঠি।’
উনি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এসো।’
আমরা বেরিয়ে পরলাম। আমি অবাক হয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কে বলবে এই ছেলেটা গত ছ’মাস আগেও নাস্তিক ছিল। নিজের গুরুকেই কিরকম কুপোকাত করে দিয়ে আসলো। কোরআনের সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতটি কত হাজার বার পড়েছি, কিন্তু এভাবে কোনদিন ভাবিনি। আজকে এটা সাজিদ যখন বিপ্লব দা কে বুঝাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজকেই নতুন শুনছি এই আয়াতের কথা। গর্ব হতে লাগলো আমার।
অনেকদিন পর আবারও পড়লাম।। খুব ভালো লাগলো।।